আপনি কী করবেন—যখন দেখছেন আপনার প্রতিপক্ষের চাহিদা পূরণে একটি গ্রন্থ লিখতে হচ্ছে? —যা একজন মূলধারার লেখকের অশুদ্ধ পাঠের ভূমিকা। এই রকমটিই ঘটেছিল ১৯৬৫ সালে ফ্রান্সের সমালোচক রোলা বার্থ (১৯১৫-১৯৮০)-এর ক্ষেত্রে। যখন জ্যাঁ-ফ্রাঙ্কুইস রেভেল-এর Libertes গ্রন্থে একটি প্রবন্ধের পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হলো; যে প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ওই বছরই La Revue des Sciences Humaines জার্নালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংস্করণে। আদতে এ প্রবন্ধটিকে কেন্দ্র করেই লেখক রেমন্ড পিকার্ড তার বিখ্যাত গ্রন্থ Nouvelle Critique ou Nouvelle Delire রচনা করেছিলেন। আর রোলা বার্থ জ্যাঁ-ফ্রাঙ্কুইস রেভেলের পক্ষে দাঁড়ালেন। উল্লেখ্য জ্যাঁ-ফ্রাঙ্কুইস রেভেলের পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রচেষ্টাতেই রেমন্ড পিকার্ড সার্বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি সাহিত্যের চেয়ারে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এমনকি তার উদ্যোগ ছাড়া পিকার্ডের তাত্ত্বিক ভাবনাগুলো অ্যাকাডেমিক বিশ্বের বাইরে অপেক্ষাকৃত অজানা হয়ে থাকতো। রোলা বার্থ এইসব সত্যেরই সুলুক সন্ধান করেছিলেন এবং বলিষ্ঠতার সঙ্গে পত্র-পত্রিকায় সেই সত্য উন্মোচন করে দিয়েছিলেন; যা বিরোধীদের কাছে বিষ মনে হয়েছিল। এছাড়া রোলা বার্থের করবারই-বা কী ছিল?
ফরাসিরা সবসময় ভালো সাহিত্যিক ঝগড়া পছন্দ করে। বিশেষ করে সে ঝগড়া যদি হয় মতাদর্শগত অথবা রাজনৈতিক বিষয়গত। বিশ শতকের সমগ্র বিশ ও ত্রিশের দশকে সুরিয়ালিস্টরা তাদের চিন্তা-চেতনা দিয়ে ফ্রান্সবাসীকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে জ্যাঁ পল সার্ত্রে ও তার অনুসারীরা ‘অস্তিত্ববাদ’কে দার্শনিক বিতর্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত শব্দে পরিণত করে তুলেছিল। তর্ক, বিতর্ক ও ঝগড়ার ক্ষেত্রে সার্ত্র কুখ্যাতির শিখরে উঠে এসেছিলেন। ১৯৫২ সালে আলবেয়ার কামুর সঙ্গে কমিউনিজম প্রসঙ্গে তার প্রকাশ্য ঝগড়া এক চরম রূপ নেয়। তাদের দু’জনের এই প্রজ্ঞাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্বের তুলনা করা চলে ১৭ শতকের আগের প্রাচীন কাল ও আধুনিক কালের সাহিত্য ও দর্শনগত দ্বন্দ্ব-বিরোধের সঙ্গে। এছাড়া যুক্তি প্রসঙ্গে ঠিক এমনই ঝগড়া ও বিতর্ক দেখা গেছে ১৮ শতকে ভলতেয়ার ও রুশোর মধ্যে, উনিশ শতকে ধ্রুপদীবাদ ও রোমান্টিসিজমের সমর্থকদের মধ্যে। উনিশ শতকে এসে প্রকৃতিবাদ, প্রতীকতত্ত্ব ও ইমপ্রেশনিজম নিয়ে দুস্তর বিতর্ক দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে; যে স্মৃতি ফ্রান্সের সাহিত্য-সংস্কৃতি ধারায় আজও বিদ্যমান। তেমনিভাবে বার্থ ও পিকার্ড-এর সাহিত্যতাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিতর্ক-দ্বন্দ্ব ফ্রান্সবাসীর কাছে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় এক জীবন্ত অধ্যায় হয়ে আছে।
তারপর পিকার্ড বলেন যে, সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে—Subjective, সমালোচনা সাহিত্যে Objective- জ্ঞানেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এদুটি বিষয় একে অপরের পরিপূরক। বার্থ এ বিষয়টি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
রেমন্ড পিকার্ডের মর্মভেদী রসময় সমালোচনাকে রোলা বার্থ বিজ্ঞতার সঙ্গে অস্বীকার ও প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘সমালোচনা ও সত্য’ নামে গ্রন্থটি রচনা করেন। যে গ্রন্থে রোলা বার্থ সমালোচনার ভাষা কেমন হওয়া উচিত কিংবা সাহিত্য-সমালোচনায় কী ধরনের ভাষা ব্যবহার করা উচিত—সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন। রেমন্ড পিকার্ড ও তার অনুসারী সাংবাদিকরা যেভাবে সাহিত্যের রসময় সমালোচনা নিয়ে মেতে উঠেছিলেন, সেই জায়গাতে বার্থ যেন বিষ ঢেলে দিলেন। বার্থ দেখালেন সমালোচকেরা যা ভাবে, তা-কে অবশ্যই অর্থপূর্ণ ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। তা না করে রসময় সমালোচনার আশ্রয় নিলে তা হবে এক ধরনের ধৃষ্টতা। বার্থ তাদের প্রসঙ্গে আরও বলেন তারা বছরের পর বছর পূর্বসূরিদের দেখানো তথাকথিত সমালোচনার ধারাকে লালন-পালন করে চলেছে। যাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—কারও কাছে একটা যুক্তিসঙ্গত শিক্ষার মাধ্যমে কোনো বিষয়কে বোধগম্য করে তোলা। কোনো ধারণাকে সহজে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি অবশ্য একটি নিরপেক্ষ পথ হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে রোলা বার্থ প্রতি-উত্তরে দেখান—এভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে ভাষার বৈভব রচনার মধ্য দিয়ে যারা চরিত্রের রূপায়ণ ঘটাতে চায়, আদতে সে ভাষা দিয়ে সে চরিত্রের বৈশিষ্ট্য কোনোভাবেই প্রকাশ হয় না। যেমন, রেমন্ড পিকার্ড ও তার অনুসারী সাংবাদিকেরা যারা ‘নিরপেক্ষ ভাষা’র তাৎপর্যের কথা নিয়ে আলোচনা করতেন। আদতে সেখানে নিরপেক্ষ ভাষার কোনো অবস্থানই ছিল না। যে কারণে রোলা বার্থ বাধ্য হয়েই নতুন ধারার সমালোচনার রীতি অনুসন্ধানে পরিব্যপ্ত হয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দেখান ভাষার স্টাইলের মধ্যে প্রচলধারার রীতি প্রবাহমান থাকবেই; নিরপেক্ষগত ভাষার কোনো সার্বজনীন রূপ নেই। এটিকেই তার ‘নব্য সমালোচনা’ রীতির একটি একক বলা যেতে পারে। তার প্রথম গ্রন্থ Writing Degree Zero যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৩ সালে; সে গ্রন্থে তিনি দেখান যে ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতার ক্ষেত্রে যে ভাষাগত ধারণার কাঠামো ব্যবহার করেন, তা মূলত শ্রেণী অবস্থানগত এবং সে ভাষা সামাজিক ও দার্শনিক মনোভাবের যোগাযোগ ও প্রকাশগত একটি নির্দিষ্ট ছক ছাড়া কিছুই না। বার্থের এই বিবেচনাকে নিতান্তই অদ্ভুত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ১৯২৩ সালে মার্সেল প্রুস্ত তার Le cote de Guermantes গ্রন্থে দেখান যে, যখন কারো মন কান্টের ধারণা দিয়ে অস্থিরতায় পরিব্যপ্ত হয় এবং বদলেয়ারের স্মৃতিতে বিভর হয়ে ওঠে, তখন তার মন অন্য কিছু আর ভাবতে পারে না। সে মন অন্য কোনো চরিত্রেরও রূপায়ণ ঘটাতে পারে না। তিনি এক্ষেত্রে আরও দেখান কোনো মার্জিত নায়িকা এসেও তার ভাষা ও আবেগ দিয়ে কান্ট ও বদলেয়ারের মোহ থেকে সে মানুষকে নিবৃত করতে পারে না। এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার্থ উল্লেখ করেন, ‘ঐ নারীর ভাষার মধ্যে প্রতীকের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যে কারণে সে (নারী) মেধাগত ও আবেগগত কোনো অবস্থানেই কোনো সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারে না।’ তার মতে ফ্রান্সের সমালোচনা রীতির মধ্যে সৃজনশীলতার ধারা প্রায় রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অর্থহীন রসময় বাক্য ব্যবহারের পদ্ধতির কারণে।
বার্থ ও তার সমর্থক-সংশ্লিষ্ট এ বিতর্কটি শুধু মাত্র কোনো সাহিত্য বিতর্ক ছিল না; এটি শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কে রূপ নিয়েছিল। ১৯৮০ সালের ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী পরিমণ্ডল কিংবা ১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের মেলবন্ধনে সংগঠিত ছাত্র বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সেখানে বার্থ ও পিকার্ডের জ্ঞানতাত্ত্বিক বিতর্ক একটি গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে এবং ফ্রান্সের জনজীবনে নাটকীয় চিন্তার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। এই বিতর্ক একদিকে যেমন ফ্রান্সের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই, অন্যদিকে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফ্রান্সে বিকশিত অ্যাকাডেমিক জীবনব্যবস্থার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা স্মারক হিসেবে মহান হয়ে আছে। লক্ষণীয় যে ১৯৬৮ সালের পর থেকে রোলা বার্থের সাহিত্যতত্ত্ব, ভাষার স্বরূপ ও দর্শনগত তত্ত্বের প্রভাব ও প্রচার ফ্রান্সের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে; এক্ষেত্রে তার ‘সমালোচনা ও সত্য’ (CRITICISM AND TRUTH) গ্রন্থটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাভাষী পাঠকেরা রোলা বার্থের ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থটিকে শুধু সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রগত ঐতিহ্য হিসেবেই গ্রহণ করেন নি; সেই সঙ্গে একে বুদ্ধিবৃত্তিক ও ভাষাতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। বার্থ এ-গ্রন্থে তার অভিমতকে যুক্তিনিষ্ঠ করতে ইউরোপ তথা ফ্রান্সের তত্ত্ব, তথ্য, সূত্র ও অভিমতের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়াও তিনি নোয়াম চমস্কির বাক্যগঠনবিধি-সংক্রান্ত (Syntactic Structures)- তত্ত্বের অনুমোদন করেছেন। তাছাড়া আমবারটো ইকো, সিগমন্ড ফ্রয়েড ও ফ্রান্জ কাফকার রচনাকেও রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জন্মসূত্রে ইংরেজ নয় অথচ ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন এমন কোনো সমালোচক, তাত্ত্বিক, কবি, ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারকে উদ্ধৃত করেন নি। ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থে যে সব লেখকদের তিনি উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রুস্ত, মালার্মে ও র্যাব এবং তার চিন্তার বীজমন্ত্র হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন ফ্রান্সের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ইংরেজি ভাষাভাষী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এটা এক ধরনের গর্ব ও অহংকারের বিষয় যে বার্থের অনেক রচনা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তার চিন্তা-চেতনা ইংল্যান্ড, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার নানান সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে প্রেরণা যোগাচ্ছে। শুধু ইংরেজি ভাষাভাষী কেন, পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাভাষী দেশেও রোলা বার্থ পঠিত হচ্ছে। কিন্তু এই উদ্যোগটি গ্রহণ করা হচ্ছে না যে, কীভাবে তার সাহিত্যতাত্ত্বিক সমালোচনা রীতিকে জেন অস্টিন, ডিকেন্স, শেক্সপীয়র বা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সমালোচনার ঐতিহ্যের সঙ্গে সন্নিবেশিত করা যায় বা পুনরবয়ান ঘটানো যায়। আমরা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছি যে জেমস জয়েস বা স্যামুয়েল বেকেট; এমনকি সমকালীন ঔপন্যাসিক যেমন জন ফৌলেস, ডেভিড লজ প্রমুখের গদ্য ও কথাসাহিত্যের চিন্তনকে বার্থের সাহিত্যতত্ত্ব ও শৈলীতে নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। কেননা সাহিত্য-সমালোচনা রীতিতে বার্থ প্রদর্শিত তত্ত্বসমূহ আধুনিকতার প্রথম পথ উন্মুক্ত করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রচল ধারার সাহিত্য-সমালোচনার রীতির বিরুদ্ধে বার্থের যে বিদ্রোহ; যে মৌল চিন্তার কারণে বার্থ সাহিত্যতত্ত্বে নতুন রীতির প্রবর্তন করেছেন, সেই চিন্তা ও তত্ত্বসমূহ বিশ্বসাহিত্য সভায় এখনো তেমনভাবে প্রচার-প্রসার হয় নি। তবে, বার্থের সমালোচনার রীতির স্বাতন্ত্র্য অনুভব করতে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে কীভাবে দার্শনিকরা ভাষার ব্যবহার করেন।
১৯৩০ সালে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ ও ভাষা বিশ্লেষণী দার্শনিকদের উত্থানের মধ্য দিয়ে ভাষা-দর্শনের ক্ষেত্রে একটি সর্বজন ও স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম গড়ে উঠেছে যে, দার্শনিকরা লেখার ক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব প্রাঞ্জল ভাষা ব্যবহার করবেন। ব্যবহারিক জগতের প্রয়োজন মেটানোর সকল ক্ষেত্রেই এই ভাষার স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ব্যবহারের দিকেই তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ. জে এয়ার-এর Language, Truth and Logic; গিলবার্ট কাইলের Dilemmas অথবা The Problem of Mind গ্রন্থে এ বিষয়ের যথার্থ প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ভিটগেনস্টাইন এক্ষেত্রে আরো অগ্রগণ্য হয়ে তার Tractatus Logico-Philosophicus গ্রন্থে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুপারিশ করেন, ‘প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষায় যে কোনো শব্দকেই স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল অর্থের ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হবে’ এবং সেই গ্রন্থের উপসংহার টানেন তিনি এভাবে, ‘যা আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না সে সম্বন্ধে চুপ থাকাই শ্রেয়’। অন্যদিকে রেমন্ড উইলিয়ামস, ফ্রান্সের নব্য সমালোচকদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব লুসিয়েন গোল্ডমান প্রসঙ্গে একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করেন: এটা সবসময় দেখা যায় যে, মানবিক চর্চার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ চিন্তাবিদদের একটা সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘প্রচল শব্দের সাধারণ ভাষা ব্যবহারের রীতি’ এবং তারা আশা করে এই ভাষা ব্যবহারের রীতি দিয়েই তারা তাদের অভিমতকে চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা অন্য বিজ্ঞানের সহকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। সেই সঙ্গে তারা এও আশা করে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার বিধি দিয়েই তারা ‘কাঠামোবাদ’ কিংবা ‘রূপতত্ত্ববিদ্যা’ চর্চার ক্ষেত্রে অভিযাত্রা শুরু করবে। এই প্রবণতা ইংরেজি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে চলেছে। রেমন্ড উইলিয়ামসের এই চিন্তা রোলা বার্থ ও রেমন্ড পিকার্ডের বিতর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা যখন রেমন্ড উইলিয়ামস বলেন, “সাহিত্য সমালোচনায় ইংরেজ বুর্জোয়াদের সঙ্গে আড়ি এবং নব্য সমালোচনার রীতিতে প্রয়োজন বিকল্প পথ ও শৈলীর”। আদতে রোলা বার্থও তার নব্য সমালোচনা তত্ত্বে বুর্জোয়ারীতির বাইরে সমালোচনার নতুন পথ ও শৈলীর কাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছেন এবং ভাষা ব্যবহারের যৌক্তিক বিন্যাসের দিকে নজর দিয়েছিলেন। যেটি মেনে নিতে পারছিলেন না ফ্রান্সের প্রচল ধারার সমালোচক রেমন্ড পিকার্ড।
ডেভিড হিউম, বার্ট্রান্ড রাসেল কিংবা ভিটগেনস্টাইনের ভাষা রীতিরও অনেক পুরোনো—প্রচলধারার এই দার্শনিক রচনাশৈলীর প্রতি যদিও আমরা এক ধরনের সহানুভূতি অনুভব করি; তবে উপলব্ধি করতে পারছি যে এ-রীতি আসলে এংলো স্যাক্সন পেশাদারী মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর বহুচর্চিত রীতি। যেখানটায় মন, মনন ও যুক্তিকাঠামোর তথাকথিত প্রয়োগ লক্ষণীয় এবং একটা দল এই চর্চার ভিতর দিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
যদিও রোলা বার্থ কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকারবদ্ধ লেখক ছিলেন না, যেমনটি ছিলেন জাঁ পল সার্ত্রে; তবুও এরা দুজনই প্রবলভাবে ফ্রান্সের বুর্জোয়া সমাজের আধিপত্যের অনিবার্য বিনাশ কামনা করেছেন। রোলা বার্থ ফ্রান্সের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ক্ষেত্রে মানবতাবাদী ধারার অন্বেষণ করেছেন এবং সমগ্র জীবনভর তার চিন্তা ও কাজের মধ্যে প্রকাশ করেছেন ‘ভাষাই শক্তি’ এবং ভাষা প্রসঙ্গে নানা বিভেদ ও জটিলতা অপসারণ করে ভাষার প্রাঞ্জল অবস্থান নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।
০২.
ফ্রান্সের সাহিত্য সমালোচনা ও ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বার্থের ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থটি একটি বিশ্বজনীন আবেদন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। তবে উল্লেখ্য, তিনি তার চিন্তাকে তুলে ধরতে যে নিজস্ব ভাষা, রচনারীতি ও শৈলীর ব্যবহার করেন—তা, নানা চ্যালেঞ্জ দ্বারা হয়ে উঠেছে বহুবর্ণিল। Degree Zero (1953) গ্রন্থে রোলা বার্থ দেখিয়েছিলেন, যে ধ্রুপদী গদ্য দিয়ে ফ্রান্সের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনকে সাহিত্যে তুলে ধরা হচ্ছে, তা মূলত সপ্তদশ শতাব্দীতে উদ্ভব হয়েছিল। আর আজকের যুগে গুটিকয়েক আধুনিক সংবেদনশীল ফ্রান্সবাসী তাদের অস্তিত্বকে স্বাভাবিকভাবে যে ভাষা ও মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষায় প্রকাশ করছে, তা অনেকটাই রোলা বার্থের ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থ অনুসৃত। এই মানুষগুলো তাদের স্বাভাবিক ভাষা দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করলেও ফ্রান্সের বেশির ভাগ মানুষই তাদের আগন্তুক হিসেবে চিহ্নিত করেন। বার্থ এবং তার চিন্তা ও ভাষা-কাঠামো এভাবে আজও সংকট মোকাবেলা করছে।
ফ্রান্সের সাহিত্য সমালোচনা ও ধ্রুপদী সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বার্থের ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থটি একটি বিশ্বজনীন আবেদন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। তবে উল্লেখ্য, তিনি তার চিন্তাকে তুলে ধরতে যে নিজস্ব ভাষা, রচনারীতি ও শৈলীর ব্যবহার করেন—তা, নানা চ্যালেঞ্জ দ্বারা হয়ে উঠেছে বহুবর্ণিল। Degree Zero (1953) গ্রন্থে রোলা বার্থ দেখিয়েছিলেন, যে ধ্রুপদী গদ্য দিয়ে ফ্রান্সের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনকে সাহিত্যে তুলে ধরা হচ্ছে, তা মূলত সপ্তদশ শতাব্দীতে উদ্ভব হয়েছিল। আর আজকের যুগে গুটিকয়েক আধুনিক সংবেদনশীল ফ্রান্সবাসী তাদের অস্তিত্বকে স্বাভাবিকভাবে যে ভাষা ও মনস্তাত্ত্বিক অভীক্ষায় প্রকাশ করছে, তা অনেকটাই রোলা বার্থের ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থ অনুসৃত। এই মানুষগুলো তাদের স্বাভাবিক ভাষা দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করলেও ফ্রান্সের বেশির ভাগ মানুষই তাদের আগন্তুক হিসেবে চিহ্নিত করেন। বার্থ এবং তার চিন্তা ও ভাষা-কাঠামো এভাবে আজও সংকট মোকাবেলা করছে।
১৯৬৫ সালের শেষ দিকে সার্বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেমন্ড পিকার্ড তার গ্রন্থ Nouvelle Critique ou nouvelle imposture- এ তার নিজের ভাষায় ‘নব্য ধারার তথাকথিত সাহিত্য-সমালোচকদের’ আক্রমণ করে বসেন। (এই নব্য ধারার সমালোচকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন Poulet, Richard, Goldmann, Mouron প্রমুখ। যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফ্রান্সের নব্য ধারার সাহিত্য ও সমালোচনা আন্দোলনে পুরোধা হিসেবে কাজ করেছেন)। যা হোক ফ্রান্সের নব্য ধারার সমালোচকদের মধ্যে পিকার্ডের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন রোলা বার্থ। বলা যেতে পারে রোলা বার্থকে লক্ষ্য করেই পিকার্ড তার আক্রমণের বিস্ফোরণ ঘটান। ১৯৬৩ সালে রোলা বার্থ তার তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করেন On Racine গ্রন্থটি। গ্রন্থটি অনেকাংশেই মনঃসমীক্ষণ বিশ্লেষণী পদ্ধতির ভিত্তিতে রচিত। এ-গ্রন্থের ভূমিকায় বার্থ জানান, সপ্তদশ শতাব্দীতে লেখক রাসিন তার রচনাশৈলী ও চিন্তা দিয়ে যে জগৎ নির্মাণ করে গেছেন; সে জগৎকেই তিনি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন-এর বাইরে অন্য কিছু নয়। এরপর ১৯৬৪ সালে রোলা বার্থ তার গ্রন্থ Critical Essays প্রকাশ করেন। যে গ্রন্থে তিনি মনঃসমীক্ষণ প্রক্রিয়া-নির্ভর বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। এই গ্রন্থে তিনি ব্যাখ্যামূলক (নতুন ধারা) সমালোচনার সঙ্গে ঐতিহ্যগত সমালোচনা বা অ্যাকাডেমিক সমালোচনার পার্থক্য তুলে ধরেন। অ্যাকাডেমিক সমালোচনা প্রসঙ্গে বার্থ বলেন, সমালোচকেরা নিতান্ত কেজো প্রয়োজনে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজের প্রয়োজনে কোনো ব্যাখ্যামূলক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। অ্যাকাডেমিক সমালোচনা গড়ে উঠেছে প্রত্যক্ষবাদী মনোবিজ্ঞানের পুরোনো ধারার চরিত্র-কাঠামো নিয়ে এবং এটি তার কাজের ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়ায় মিথ্যা উপমার মধ্যে। সমালোচনার এই পদ্ধতি সবসময় লেখকের আবেগগত অভিজ্ঞতা, ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও তুলনা রীতির ওপর নির্ভর।
অ্যাকাডেমিক সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে রোলা বার্থের এই অবস্থান ও অভিমতকে আক্রমণ করতে রেমন্ড পিকার্ড কলম ধরলেন। রোলা বার্থের বিরুদ্ধে পিকার্ড অনেকগুলো অভিযোগ দাঁড় করান। মূলত এই সব অভিযোগ খণ্ডন করতেই রোলা বার্থ তার ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থটি রচনা করেন।
প্রথমে রেমন্ড পিকার্ডের অভিযোগগুলো লক্ষ করা যাক। বার্থ সাহিত্যে উপমা ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিমত প্রদান করায় পিকার্ড তাকে অভিযুক্ত করেন। পিকার্ড বলেন উপমা ব্যবহারের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কবি-সাহিত্যিক সাহিত্যে রস সৃষ্টিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। সাহিত্য সমালোচনার প্রাণ হচ্ছে—উপমা, তুলনা ও সাদৃশ্য। সাদৃশ্য, উপমা, তুলনা প্রভৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে সাহিত্য সমালোচনার একটি বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। তারপর পিকার্ড বলেন যে, সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে—Subjective, সমালোচনা সাহিত্যে Objective- জ্ঞানেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এদুটি বিষয় একে অপরের পরিপূরক। বার্থ এ বিষয়টি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
রেমন্ড পিকার্ড আরও জানান, রাসিন কর্তৃক ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দের একেকটি সাহিত্যিক অর্থবোধকতা রয়েছে, যা সপ্তদশ শতাব্দীর শ্রোতা ও পাঠকেরা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন এবং একে উপেক্ষা করা যাবে না যতক্ষণ না ভাষা রূপান্তরিত হয় সুযোগের একেকটি খেলায়।
লেখক সেই ব্যক্তি যার কাছে ভাষা একটি সংকট; সংকট এ কারণে যে ভাষাকে সে বিবেচনা করতে চায় স্বচ্ছতা ও উপলব্ধির গভীরতা দিয়ে। ভাষা তার কাছে কোনো যান্ত্রিক বিষয় নয়।
সত্য সম্পর্কে রাসিনের একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম রয়েছে, যার উপর রয়েছে সকলের আস্থা। বিশেষত ভাষা প্রয়োগের নিশ্চয়তা, মানসিক সঙ্গতি, ভাষারীতির কাঠামো আর বিষয়ীগত ভাবনার সজ্ঞায়ন দিয়ে সত্য সম্পর্কিত রাসিনের এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়মটি গড়ে উঠেছে। যা বার্থ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
পিকার্ড অস্পষ্ট ও অপভাষা ব্যবহারের জন্যে বার্থকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি দাবি করেন যে, রাসিন প্রসঙ্গে বার্থের সমালোচনা অযৌক্তিক ও ইম্প্রেশনিস্টিক ধারার। চূড়ান্ত বিচারে পিকার্ড বলেন যে, সাহিত্য শুধু মনোবিশ্লেষণের বিষয় নয়। আবার সাহিত্যকে অচেতন অন্ধ শক্তির ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করাও যুক্তিযুক্ত নয়। বরং একে মূল্যায়ন করতে হবে এর অন্তর্গত বাস্তবতা দিয়ে, নির্ভার স্বেচ্ছাকৃত কাজের ফলাফল হিসেবে, নির্দিষ্ট পন্থায় একটি কাজ করবার প্রণোদিত ইচ্ছা এবং একটি নির্দিষ্ট রীতির আদর্শ অনুসরণে। পিকার্ডের মতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে কাজের অর্থ কাঠামোবদ্ধ রীতি আর নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মধ্যে থেকে লেখক সচেতনভাবে কী বলতে চাইছেন—তার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে চলা।
রোলা বার্থ ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থে পিকার্ড উত্থাপিত বিতর্কের বিষয়গুলোর জবাব দেবার পাশাপাশি পিকার্ডের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সাধারণ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তিনি দেখান সমালোচনা অপরিহার্যভাবে মূল্যগত আদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত। এক্ষেত্রে তিনি অভিযোগ করেন পিকার্ড সুকৌশলে এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। পিকার্ড তার বিষয়গত ভাবনাকে আদর্শিক চেতনার মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখতে চান এবং সত্যকে তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। উল্লেখ্য যে, রোলা বার্থ তার Mythologies গ্রন্থে দেখান বুর্জোয়াদের মতাদর্শ এমন এক আদর্শের অনুসরণ যেখানে তারা তাদের স্বার্থে নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত, সার্বজনীন, বিষয়ীগত ও অমূল্য বিষয়ক চিন্তাগুলোকে দার্শনিক আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেন। ফ্রান্সের ঐতিহ্যগত সমালোচনার আদর্শগুলোকে রোলা বার্থ তার গ্রন্থ ‘সমালোচনা ও সত্য’ তুলে ধরেন এবং তার উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে কয়েকটি শিরোনামে চিহ্নিত করে দেখান। সংক্ষেপে সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হচ্ছে।
আপাত সত্যের জটিলতা
সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ আপাত সত্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা হয়। যেমন পাঠক কী পড়তে চায় অথবা কী পড়ার কথা চিন্তা করে? বার্থের মতে সাহিত্য সমালোচনায় এ বিষয়টি আমলে আনলে দেখা যাবে যে সেখানে এক ধরনের ‘আপাত সত্য’ দিয়ে বিষয়টির উত্তর খোঁজা হবে মাত্র। প্রকৃত সত্য পাওয়া যাবে না। সাহিত্যিককে পাঠকের দিকে তাকিয়ে লিখতে হলে তার সাহিত্যচর্চা গতিপথ হারাবে। আসলে প্রকৃত সাহিত্যিক কখনও পাঠকের দিকে তাকিয়ে লেখেন না।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ আপাত সত্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা হয়। যেমন পাঠক কী পড়তে চায় অথবা কী পড়ার কথা চিন্তা করে? বার্থের মতে সাহিত্য সমালোচনায় এ বিষয়টি আমলে আনলে দেখা যাবে যে সেখানে এক ধরনের ‘আপাত সত্য’ দিয়ে বিষয়টির উত্তর খোঁজা হবে মাত্র। প্রকৃত সত্য পাওয়া যাবে না। সাহিত্যিককে পাঠকের দিকে তাকিয়ে লিখতে হলে তার সাহিত্যচর্চা গতিপথ হারাবে। আসলে প্রকৃত সাহিত্যিক কখনও পাঠকের দিকে তাকিয়ে লেখেন না।
তথাকথিত সমালোচনা রীতি অনুযায়ী যদি প্রশ্ন করা হয় সাহিত্য পরিণতি পায় কিসে? সে ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় অনুশীলন আর কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ প্রসঙ্গটি উঠে আসবে। কিন্তু রোলা বার্থ দেখান অনুশীলন আর কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়টি আপাত সত্য হিসেবে মেনে নিলেও তা শেষ পর্যন্ত সমালোচনা রীতির বিরুদ্ধে এসে দাঁড়ায়। কেননা সাহিত্য শুধু অনুশীলন আর কাণ্ডজ্ঞানের বিষয় নয় আর সাহিত্য সমালোচনাও অনুশীলন আর কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ দিয়ে যথাযথ মূল্যায়নভিত্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। তা শুধু আপাত সত্যের জটিলতায় আবেগগ্রস্থ বিকট আর ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
বিষয়ীগত ধারণাগুলো
১. শব্দের অর্থ
পিকার্ড বলেছিলেন, সমালোচনার ক্ষেত্রে শব্দের অর্থ অনুধাবনে রোলা বার্থ ব্যর্থ। পিকার্ডের এ অভিযোগকে রোলা বার্থ অস্বীকার করেন।
১. শব্দের অর্থ
পিকার্ড বলেছিলেন, সমালোচনার ক্ষেত্রে শব্দের অর্থ অনুধাবনে রোলা বার্থ ব্যর্থ। পিকার্ডের এ অভিযোগকে রোলা বার্থ অস্বীকার করেন।
এ ক্ষেত্রে রোলা বার্থ বলেন, শব্দের অর্থ অনুসন্ধানে অভিধানের উপর গুরুত্বের পাশাপাশি শব্দের বহুমাত্রিক অর্থ অনুসন্ধানে গোষ্ঠী, সংগঠন আর আড্ডার উপর নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ শব্দের শুধু একমাত্রিক অর্থ নয় বহুমাত্রিক অর্থের দিকেও লেখককে নজর দিতে হয়। এমন অনেক শব্দ আছে যুগের পরিবর্তনে তার অর্থ পাল্টে যায় অথবা প্রচল শব্দটি অপ্রচল হয়ে ওঠে। সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
২. মনস্তাত্ত্বিক সঙ্গতি
রোলা বার্থ বলেন, এ-বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে অনুভব করতে হবে যে, বিংশ শতাব্দীতে এসে ধ্রুপদী সাহিত্যের চরিত্রচিত্রণে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক অভূতপূর্ব উত্তরণ ঘটেছে। অবশ্য ধ্রুপদী সাহিত্যে সচেতনভাবে কোনো চরিত্রে মনস্তাত্ত্বিক সঙ্গতি ও বিশ্লেষণ প্রয়োগ করা ছিল না, বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ববীক্ষা এবং সার্বিক মনঃনিরীক্ষণ পদ্ধতির বিকাশের ফলে সাহিত্য সমালোচনায় মনস্তাত্ত্বিক সঙ্গতির এই প্রয়োগ ঘটেছে। যে কোনো মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ সবসময়ই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পিকার্ডের কল্পনা আশ্রিত অপরিবর্তনীয় চরিত্রচিত্রণের বিশ্লেষণের পদ্ধতিও কোনো না কোনোভাবে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন রাসিনীয় চরিত্রচিত্রণে পিকার্ডসহ অন্যান্যরা ‘উন্মত্ততা’, ‘আবেগ’ ইত্যাদি পদ দিয়ে চরিত্রচিত্রণ করেন হর হামেশাই।
রোলা বার্থ বলেন, এ-বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে অনুভব করতে হবে যে, বিংশ শতাব্দীতে এসে ধ্রুপদী সাহিত্যের চরিত্রচিত্রণে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক অভূতপূর্ব উত্তরণ ঘটেছে। অবশ্য ধ্রুপদী সাহিত্যে সচেতনভাবে কোনো চরিত্রে মনস্তাত্ত্বিক সঙ্গতি ও বিশ্লেষণ প্রয়োগ করা ছিল না, বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্ববীক্ষা এবং সার্বিক মনঃনিরীক্ষণ পদ্ধতির বিকাশের ফলে সাহিত্য সমালোচনায় মনস্তাত্ত্বিক সঙ্গতির এই প্রয়োগ ঘটেছে। যে কোনো মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ সবসময়ই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পিকার্ডের কল্পনা আশ্রিত অপরিবর্তনীয় চরিত্রচিত্রণের বিশ্লেষণের পদ্ধতিও কোনো না কোনোভাবে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন রাসিনীয় চরিত্রচিত্রণে পিকার্ডসহ অন্যান্যরা ‘উন্মত্ততা’, ‘আবেগ’ ইত্যাদি পদ দিয়ে চরিত্রচিত্রণ করেন হর হামেশাই।
৩. ব্যাখ্যামূলক নীতি হিসেবে সাহিত্যশৈলীর কাঠামো প্রসঙ্গে
রোলা বার্থ খেয়াল করে দেখেছেন যে ফ্রান্সের ধ্রুপদী ট্রাজেডি সাহিত্যগুলো চমৎকার তাত্ত্বিক কাঠামোর বাতাবরণে নির্মিত কিন্তু সাহিত্যের শৈলীগত কাঠামো বিবেচনায় খুব দুর্বল ও অসংজ্ঞায়িত। এক্ষেত্রে রোলা বার্থ বলেন, সাহিত্যে প্রত্যেকটি শব্দের কাঠামো তার শৈলীগত সৌন্দর্য তুলে ধরে এবং পদ্ধতিগতভাবে যে কোনো সাহিত্যের শৈলী ও কাঠামো অনুধাবনের মধ্য দিয়ে পাঠক সাহিত্যকে নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন করতে শেখে।
রোলা বার্থ খেয়াল করে দেখেছেন যে ফ্রান্সের ধ্রুপদী ট্রাজেডি সাহিত্যগুলো চমৎকার তাত্ত্বিক কাঠামোর বাতাবরণে নির্মিত কিন্তু সাহিত্যের শৈলীগত কাঠামো বিবেচনায় খুব দুর্বল ও অসংজ্ঞায়িত। এক্ষেত্রে রোলা বার্থ বলেন, সাহিত্যে প্রত্যেকটি শব্দের কাঠামো তার শৈলীগত সৌন্দর্য তুলে ধরে এবং পদ্ধতিগতভাবে যে কোনো সাহিত্যের শৈলী ও কাঠামো অনুধাবনের মধ্য দিয়ে পাঠক সাহিত্যকে নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন করতে শেখে।
সাহিত্যে সুরুচি প্রসঙ্গ
রোলা বার্থ বলেন, পুরোনো ধারার সমালোচনার রীতি ট্যাবু (Taboos) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট নিয়মের উপর গড়ে উঠেছে। যা হোক এই রীতিতে অসংখ্য ট্যাবু সমালোচকের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ট্যাবুর এই শাসন করবার অদৃশ্য প্রণালীকে লেখক জে.পি রিচার্ড গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যে কারণে তিনি সাহিত্য মূল্যায়ণ ও নির্মাণে ট্যাবুকে পরিহাস ও পরিহারে সচেষ্ট ছিলেন। সাহিত্যে ‘সুরুচি’ সবসময় পুরোনো সমালোচকদের প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি পুরোনো সমালোচকদের যে কোনো বিশ্লেষণ, মনগড়া বক্তৃতা আর অসমর্থিত নান্দনিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকেও আধুনিক মননদীপ্ত সাহিত্যের এই ‘সুরুচি’ অপছন্দ করে।
রোলা বার্থ বলেন, পুরোনো ধারার সমালোচনার রীতি ট্যাবু (Taboos) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট নিয়মের উপর গড়ে উঠেছে। যা হোক এই রীতিতে অসংখ্য ট্যাবু সমালোচকের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ট্যাবুর এই শাসন করবার অদৃশ্য প্রণালীকে লেখক জে.পি রিচার্ড গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যে কারণে তিনি সাহিত্য মূল্যায়ণ ও নির্মাণে ট্যাবুকে পরিহাস ও পরিহারে সচেষ্ট ছিলেন। সাহিত্যে ‘সুরুচি’ সবসময় পুরোনো সমালোচকদের প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি পুরোনো সমালোচকদের যে কোনো বিশ্লেষণ, মনগড়া বক্তৃতা আর অসমর্থিত নান্দনিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকেও আধুনিক মননদীপ্ত সাহিত্যের এই ‘সুরুচি’ অপছন্দ করে।
ট্যাবুর বিষয়বস্তুর মধ্যে সবসময় যৌনকেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনা নিহিত থাকে এবং এটা হয়েছে একারণে যে পুরোনো ধারার সমালোচনা গড়ে উঠেছিল সেকেলে মানুষের শরীর-মন, জাত-শ্রেণী, প্রভৃতি বিষয়ের বিভক্তি-নিয়ন্ত্রণ, অসংহত চেতনা ও নৈরাজ্যবাদী ধারণার মধ্য দিয়ে।
প্রসঙ্গ: স্বচ্ছতা
সাহিত্যমূল্য সবসময় স্বচ্ছতা ও মতাদর্শগত আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। প্রাচীন সমালোচনা শাস্ত্রে স্বচ্ছতাকে একটি শ্রেণীর নিজস্ব ভাষাব্যবস্থার এক প্রকার রাজনৈতিক অনুমোদনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নব্য সমালোচনার তথাকথিত দুর্বোধ্য বা অপভাষাকে পুরাতন ধারার সহজাত গুণাবলী দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না—কেননা পুরাতন ধারার সমালোচনার শৈলী তার প্রভাব দিয়ে সবকিছুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতে চায়। নব্য সমালোচনার ভাষা ও শৈলীর বিরুদ্ধে পুরাতন ধারার সমালোচকেরা নানা ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালায়। এমনকী তারা এও বলে নব্য ধারার এ ভাষার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই; এ ভাষা একদম অর্বাচীন।
সাহিত্যমূল্য সবসময় স্বচ্ছতা ও মতাদর্শগত আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। প্রাচীন সমালোচনা শাস্ত্রে স্বচ্ছতাকে একটি শ্রেণীর নিজস্ব ভাষাব্যবস্থার এক প্রকার রাজনৈতিক অনুমোদনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নব্য সমালোচনার তথাকথিত দুর্বোধ্য বা অপভাষাকে পুরাতন ধারার সহজাত গুণাবলী দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না—কেননা পুরাতন ধারার সমালোচনার শৈলী তার প্রভাব দিয়ে সবকিছুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখতে চায়। নব্য সমালোচনার ভাষা ও শৈলীর বিরুদ্ধে পুরাতন ধারার সমালোচকেরা নানা ধরনের প্রপাগাণ্ডা চালায়। এমনকী তারা এও বলে নব্য ধারার এ ভাষার সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই; এ ভাষা একদম অর্বাচীন।
রোলা বার্থ বিশ্লেষণ করে দেখান স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে পুরাতন ধারার সমালোচকদের অভিমত অযৌক্তিক। বরং স্বচ্ছতা এমন একটি বিষয় যাকে অন্তর্নিহিতভাবে বাইরে থেকেও যেকোনো চিন্তার ক্ষেত্রে আরোপ করা যেতে পারে।
প্রতীকী চিন্তা অনুভবের অক্ষমতা প্রসঙ্গে
রোলা বার্থ অনুভব করেন পুরোনো ধারার সমালোচনার রীতি ও শৈলী একটি নির্দিষ্ট ব্যাধিতে আক্রান্ত। সে ব্যাধিটি হচ্ছে প্রতীকী চিন্তা অনুভবের অক্ষমতা। পুরাতন ধারার সমালোচকেরা একটি গ্রন্থকে শুধু আক্ষরিক অর্থেই পাঠ করে থাকেন। তারা কখনই সে গ্রন্থের অক্ষরের ভেতরকার প্রতীককে অনুভব করতে পারেন না। তাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না প্রতীকের হাত ধরে যে কোনো গ্রন্থের গভীরে প্রবেশের।
রোলা বার্থ অনুভব করেন পুরোনো ধারার সমালোচনার রীতি ও শৈলী একটি নির্দিষ্ট ব্যাধিতে আক্রান্ত। সে ব্যাধিটি হচ্ছে প্রতীকী চিন্তা অনুভবের অক্ষমতা। পুরাতন ধারার সমালোচকেরা একটি গ্রন্থকে শুধু আক্ষরিক অর্থেই পাঠ করে থাকেন। তারা কখনই সে গ্রন্থের অক্ষরের ভেতরকার প্রতীককে অনুভব করতে পারেন না। তাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না প্রতীকের হাত ধরে যে কোনো গ্রন্থের গভীরে প্রবেশের।
আমরা প্রায়ই ভাষাকে পদ্ধতিগত চিন্তার আওতায় আনতে ভাষার ‘আক্ষরিক’ বা ‘প্রতীকী’ বিশ্লেষণ করে থাকি। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে-কোনো সাহিত্যের একটি প্রতীকী পঠন ‘তথ্যগত সত্য’ থেকে কোনোভাবেই বিচ্যুত কিছু নয়। বার্থের মতে সমালোচনা সাহিত্যে এক ধরনের কাঠিন্য বিদ্যমান; সেই কাঠিন্য সাহিত্য পাঠ ও মূল্যায়নের মধ্যে নয়, বরং সাহিত্য অনুভবের অপারঙ্গমতার মধ্যে বিদ্যমান।
‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে রেমন্ড পিকার্ডের তথাকথিত সরল ধারণাপ্রসূত সমালোচনার রীতিকে রোলা বার্থ প্রথমেই খারিজ করে দিলেন। যেখানে পিকার্ডের অভিমত ছিল সাহিত্যের একটি যাচাইযোগ্য বস্তুনিষ্ঠ অর্থ রয়েছে; যা শব্দের অর্থগত তাৎপর্য নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে লেখকদের হাত ধরে পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। পিকার্ডের এ অভিমতের সরাসরি বিরোধিতা করেন রোলা বার্থ। তার মতে গত একশত বছর ধরে মার্লামে পর্যন্ত সমালোচনা সাহিত্য একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে এসেছে।
এই সংকট, রোলা বার্থ যার নাম দিয়েছেন ‘ভাষা সংকট’। রোলা বার্থের মতে এই সংকটের কারণে প্রুস্ত ও ব্লানচোটের মতো লেখক আমাদেরকে ‘সৃজনশীল লেখা’ আর ‘সমালোচনা সাহিত্যে’র সীমারেখাকে চিহ্নিত করে বুঝিয়ে দেন, প্রচল ধারার সমালোচনা সাহিত্যের আদতে কোনো অস্তিত্ব নেই। একজন লেখককে তার শ্রেণী অবস্থান দিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে না; যাবে না তার সরকারি ভূমিকা দিয়ে—যে দায়িত্ব সমাজ তাকে দিয়েছে। কিন্তু তাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব তার চিন্তার কাঠামো দিয়ে। লেখক সেই ব্যক্তি যার কাছে ভাষা একটি সংকট; সংকট এ কারণে যে ভাষাকে সে বিবেচনা করতে চায় স্বচ্ছতা ও উপলব্ধির গভীরতা দিয়ে। ভাষা তার কাছে কোনো যান্ত্রিক বিষয় নয়।
রোলা বার্থ এমন এক সুপণ্ডিত, যিনি তার পাঠকের চেতনা উত্তরণের জন্য লেখেন। তিনি তার নিজস্ব মানসকাঠামো দিয়ে ফ্রান্সের ধ্রুপদী সাহিত্য ও সমালোচনার ঐতিহ্যকে ফ্রান্সবাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এবং তার চিন্তা দিয়ে পাঠকের সাংস্কৃতিক চেতনাকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন।
ভাষার কোনো একমাত্রিক অর্থ নেই, যেমনটি অভিধানে দেয়া থাকে। ভাষা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার ইতিহাসগত বয়স নির্ধারণ সম্ভব নয়। ভাষাকে বয়স দিয়ে বিবেচনা করলে বয়সের এক এক স্তরে এসে শব্দের একেকটি অর্থ বদলে যায়; শব্দের অর্থ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বদলে যায় ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এমনকি শব্দের অর্থ একেক পাঠকের কাছে একেক রকম। ভাষা প্রকৃতপক্ষে কোনো একক অর্থকে প্রকাশ করে না, ভাষা বহুমাত্রিক। এমনটি হয়েছে একারণে যে ভাষার বহুমাত্রিক কাঠামো রয়েছে। পাঠক ভেদে ভাষার কাঠামোও পাল্টে যায় বলে ভাষাকে কোনো একক মাত্রিকতায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। রোলা বার্থ ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থটি রেমন্ড পিকার্ডের সঙ্গে সাহিত্যতাত্ত্বিক ঝগড়ার প্রেক্ষিতে লিখতে শুরু করলেও এক পর্যায়ে এ গ্রন্থে তিনি সাহিত্য পাঠ ও সমালোচনা তত্ত্ব সম্পর্কে তার নিজস্ব অভিমত আবিষ্কার করে ফেলেন। একটি কাজের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি একটি ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের প্রকৃতি উৎঘাটন করেন। ভাষার প্রকৃতি ও বৈচিত্র উৎঘাটনে তিনি এ ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক দিয়ে ভাষাবিষয়ক কাজকে ব্যাখ্যা করেন। সেই সঙ্গে ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের বাতাবরণকে বিজ্ঞান, সমালোচনা ও পঠন— এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন।
রোলা বার্থ বলেন, সাহিত্যের বিজ্ঞান এমন একটি প্রসঙ্গ যেখানে কোনো চিন্তা, বক্তৃতা বা আলাপের ক্ষেত্রে কাজের বস্তুগত উদ্দেশ্য একটি একক মাত্রাগত অর্থে সীমাবদ্ধ না থেকে বহুমাত্রিকতার সম্ভাবনাকে উন্মচিত করে। এই বিজ্ঞান সত্যের শাখা-প্রশাখার উপর ভিত্তি করে একটি সাহিত্যকর্মকে লিখিত ভাষার মধ্য দিয়ে পরিণতি দান করে। ঠিক যেমন চমস্কি ভাষার ক্ষেত্রে সৃজনমূলক (generative) ব্যাকরণের ধারণাকে নির্মাণ করেছিলেন ভাষার মধ্যকার বাক্যকাঠামোর নীতি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে; তেমনি রোলা বার্থও একটি কাজের সূচির মধ্যে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও অস্তিত্বগত বিকাশের শর্ত দিয়ে কাজটির সম্ভাব্য অর্থগত সৃজনমূলক ব্যাকরণ আবিষ্কার করেন।
সাহিত্যের বিজ্ঞান কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে কোনো সাধারণ লেখকের কল্পনাকেও সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়, কাজের অর্থগত উৎসের জামানত হিসেবে। সাহিত্যগত বিজ্ঞান যে কোনো লেখকের কাজের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে; লেখকের চিন্তায় বাস্তবতার যে মূর্তি পৌরাণিকতা থেকে উঠে এসেছে সে উৎসেরও সন্ধান দেয়। লেখকের কোনো লেখা হয়ত তার মৌলিক সৃষ্টি, কিন্তু সেই লেখায় যে পৌরাণিক ও মানব তাৎপর্য উঠে এসেছে তা লেখক অবগত নন। সাহিত্যের বিজ্ঞান লেখককে এ প্রসঙ্গে অবগত করে তোলে।
অন্যদিকে সমালোচনা প্রসঙ্গে রোলা বার্থ বলেন, সমালোচনা কোনো বিজ্ঞান নয়। সাধারণভাবে বিজ্ঞান অর্থ (meaning)- র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর সমালোচনা সৃষ্টি করে বিশেষ অর্থ। সমালোচনা একটি ধারা যা সাহিত্যকর্মকে একটি অর্থ ও রূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে। প্রকৃতপ্রস্তাবে যেমন কোনো সাহিত্যকর্মের অনুবাদ করা যায় না; শুধু সাহিত্যকর্মটির কিছু লক্ষণ অনুবাদে প্রকাশ করা হয়। তেমনি সমালোচনা কোনো সাহিতকর্মের বিকৃত মুখকেই তুলে ধরে মাত্র, সাহিত্যের বস্তুগত অর্থের প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। সমালোচক সাহিত্যকর্মের প্রকৃত অর্থকে উদ্ধার করতে পারেন না, সে শুধু তার আত্মোপলব্ধ অর্থকেই পাঠকের কাছে তুলে ধরেন।
রেমন্ড পিকার্ড মনে করতেন সমালোচনা সাহিত্যের মূল কাজ সাহিত্যের নির্দিষ্ট বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি মনযোগ ও মূল্যায়ন। পিকার্ডের অভিযোগের বিরুদ্ধে রোলা বার্থ অভিযোগ করে বলেন যে, যদি সাহিত্য সমালোচনায় শুধু বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি নির্দিষ্ট মনযোগ দেয়া হয়, তাহলে সমালোচক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে যা খুশি তাই বলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বার্থ মনে করেন, সমালোচনা এখনও একটি সীমাবদ্ধতার সেটে আবদ্ধ।
বার্থের মতে সমালোচনার সীমাবদ্ধতাগুলো হচ্ছে: প্রথমত, সমালোচকেরা মনে করেন—সাহিত্য কর্মে সবকিছুই বোধগম্য এবং সাহিত্যের সব কিছুকেই মূল্যায়ন করার ক্ষমতা থাকতে হবে সমালোচনার মধ্যে। এক্ষেত্রে বার্থ মনে করেন, এটি একটি ‘অযৌক্তিক নিয়ম’ এবং সাহিত্য সমালোচনায় এই অযৌক্তিক নিয়মটি রেমন্ড পিকার্ডও মেনে চলেন। একে যদি পিকার্ডেরই ‘পরিসংখ্যানগত যাচাইকরণ’(system of statistical verification) নিয়ম দিয়ে পরীক্ষা করা যায়, তাহলে এর অসারতা প্রমাণ হবে। বোঝা যাবে এখানে কোনো বিজ্ঞান বা পরিসংখ্যান নেই। অথচ সমালোচকরা তাদের ইচ্ছে মতো একে একটা সমালোচনা প্যাটার্ন হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, বার্থ মনে করেন, সমালোচকেরা কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম দিয়ে সাহিত্যের রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলেন। যদিও সেই নিয়মে কিছু লজিক কাজ করে, কিন্তু এই লজিক দিয়ে সাহিত্যের মূল নির্যাসকে উপলব্ধি করা যায় না সবসময়। যাই হোক সাহিত্যকে অযাচিতভাবে রূপান্তর করার এই ধরনের কয়েকটি মডেল হচ্ছে মনোবিশ্লেষণ ও অলঙ্কারশাস্ত্র। সমালোচকেরা এই মডেলগুলো দিয়ে সাহিত্যের রূপান্তর ঘটান এবং তাদের কাজের প্রতীকীযুক্তি খুঁজে বেড়ান।
তৃতীয়ত, সমালোচকেরা মনে করেন সমালোচনাকে অবশ্যই সবসময় একই পন্থা অবলম্বন করে চলতে হবে। পিকার্ড যেভাবে সমালোচনার বিতর্ক বোঝাতে আত্মনিষ্ঠতা ও বস্তুনিষ্ঠতার দ্বন্দ্বকে বোঝায়, রোলা বার্থ তেমনটি মনে করেন না। তিনি মনে করেন সাহিত্য সমালোচনার আভ্যন্তরীণ সামঞ্জস্য রক্ষার ক্ষেত্রে সমালোচনা রীতিকে বহুমাত্রিক পথ অনুসরণ করতে হয়। সমালোচনা সবসময় নিয়মের ছাঁচে ফেলা কাজ নয়। কোনো সাহিত্যসংশ্লিষ্ট কাজের সীমাবদ্ধতা দূর করতে অচর্চিত ও সাহিত্যমনা বস্তুনিষ্ঠতার চাইতে বিষয়ীগত আত্মনিষ্ঠতার নৈর্ব্যক্তিক পথ উন্মোচনের দিকেই রোলা বার্থ গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি।
রোলা বার্থের মতে পঠন হচ্ছে ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের তৃতীয় ধারা, যা সাহিত্য ও সমালোচনার সঙ্গে গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ। তবে সমালোচনা থেকে এই পঠনপ্রক্রিয়াকে অবশ্যই নির্ভার ও মুক্ত থাকতে হয়। সমালোচক সাহিত্যকর্ম পাঠের সময় একটি পরিকল্পনা ও চিন্তা নিয়ে আগান; সাহিত্যকর্ম অথবা গ্রন্থটির মূল ভাষ্য, উপাদান ও উপস্থাপনার পুনর্বিন্যাস ঘটান। এক্ষেত্রে সমালোচককে অবশ্যই নৈতিক অবস্থানে সৎ থেকে আদর্শ, নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়।
রোলা বার্থের মতে পঠনপ্রক্রিয়া সাহিত্যকর্ম বা গ্রন্থের সঙ্গে সূক্ষ্ম সম্পর্কে আবদ্ধ। এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ‘ভাষা-কোড’ (code of language)- র উপর নির্ভরশীল ইচ্ছা-শক্তিকে কেন্দ্র করে।
যদিও ‘সমালোচনা ও সত্য’ গ্রন্থটি ফ্রান্সের ‘নতুন ধারার সমালোচনা’ রীতির স্বপক্ষে প্রতিরক্ষা কবজ হিসেবে লিখিত, তবুও এর অনুশীলনকারীদের অনেকে (যেমন, জে.পি রিচার্ড এবং চার্লস মর্ন প্রমুখ) সরলভাবে বিশ্বাস করেন যে, সাহিত্যকর্মের মধ্যে লেখকের মানসগঠনের একটি নিবিড় উপস্থিতি থাকে, যা আংশিকভাবে হলেও সাহিত্যকর্মটি ব্যাখ্যায় ভূমিকা রাখেন। যেমন বার্থের গ্রন্থে, তার মানসগঠনের প্রভাবের কারণে গ্রন্থের উদ্দেশ্যগত লক্ষ্য বদলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের মনযোগ গিয়ে পড়েছে বিষয় ও ভাষা সম্পর্কের সমস্যার মধ্যে। তারা (যেমন, জে.পি রিচার্ড এবং চার্লস মর্ন প্রমুখ) মনে করেন রোলা বার্থ সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এ-প্রসঙ্গটি অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন।
রোলা বার্থ সমালোচনার জন্য সমালোচকের নিজস্ব ভাষার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি দেখাতে পারেন নি কীভাবে সমালোচক প্রচল ভাষার প্রবাহ থেকে মুক্ত হয়ে তার নিজস্ব ভাষা কাঠামো গড়ে তুলবে। তবে বার্থের রচনা ও সমালোচনাগুলো পাঠ করলে তার ভাষা ব্যবহারের একটা নিজস্ব রীতিকে আমরা অনুধাবন করতে পারি। রোলা বার্থ এমন এক সুপণ্ডিত, যিনি তার পাঠকের চেতনা উত্তরণের জন্য লেখেন। তিনি তার নিজস্ব মানসকাঠামো দিয়ে ফ্রান্সের ধ্রুপদী সাহিত্য ও সমালোচনার ঐতিহ্যকে ফ্রান্সবাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এবং তার চিন্তা দিয়ে পাঠকের সাংস্কৃতিক চেতনাকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। আর একারণেই ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাভাষী পাঠক রোলা বার্থের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে খুব বেশি প্রবেশাধিকার পায় না।
সহায়ক-গ্রন্থ :
- R. Barthes, Critique et vérité, Seuil, 1966; Criticism and truth, trs. Katrine Pilcher Keuneman, The Athlone Press, 1987.
- R. Barthes, Essais critiques, Seuil, 1964; Critical Essays, trs. Richard Howard, Northwestern University Press, 1972.
- R. Barthes, Mythologies, Seuil, 1957; Mythologies, partial English ranslation by Annette Lavers, Cape, 1972; Hill & Wang, 1973.
- Remaining essays, The Eiffel Tower and Other Mythologies, trs. Richard Howard, Hill & Wang, 1979.
- R. Barthes, The Death of the Author, trs. Stephen Heath in Image- Music-Text S. Heath (ed.), Fontana, 1977.
- R. Barthes, Sur Racine, Seuil, 1963; On Racine, trs. Richard Howard, Hill & Wang, New York, 1964.
- R. Barthes, Essais critiques, Seuil, 1964; Critical Essays, trs. Richard Howard, Northwestern University Press, 1972.
- R. Picard, Nouvdle Critique ou nouvelle imposture, Pauvert, Utrecht, 1965; New criticism or new fraud? trs. F. Towne, Washington State University Press, 1969.
- Ludwig Wittgenstein, Tractatus-Logico-Philosophicus, Trs. C. K. Ogden, Routledge and Kegan Paul, London, 1933
- Noam Chomsky, Language and Responsibility, Harvester Press, Sussex, 1979
- Noam Chomsky, Current Issues in Linguistic Theory, The Hague, London, 1967
- A.J. Ayer, Language, Truth and Logic, Victor Gollanez Ltd., London, 1964
মন্তব্য