বাংলা কবিতার ধারাবাহিক ইতিহাস বাঁকবদলের; প্রতিবাঁকেরও। তারও চেয়ে বড় সত্য, ভাষায়, প্রকরণে, প্রকাশশৈলীতে শক্তিমান কবিমাত্রই স্বতন্ত্রস্বরের অধিকারী। কণ্ঠস্বাতন্ত্র্যই কবি থেকে কবিকে স্বতন্ত্র কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। কবি হয়ে ওঠেন শিল্পের প্রতিভূ; আপন শক্তির স্মারক। রহমান হেনরী’র কবিতাও বাংলা কবিতার একটি ধারাবাহিক অধ্যায়। তার কবিতায় রয়েছে গভীরতর চিন্তার ছাপ, হৃদয়াকুতির সরল প্রকাশ।
‘একবাক্স রাত’ কবিতায় যখন বলেন—‘আঁধার কাঙ্ক্ষিত যদি, এই নাও একবাক্স রাত!’ তখন পাঠক হিসেবে বিস্ময়ে অভিভূত হই। একবাক্স রাত কেন? রাত কী করে মানুষের কাঙ্ক্ষিত বিষয় হতে পারে!
‘আঁধার কাঙ্ক্ষিত যদি, এই নাও একবাক্স রাত!
রাত্রি কাহাকে বলে? অই তো দীর্ঘ ছায়া উঠেছে সংক্রমে…
পুড়–ক প্রশ্নের পাখি অকালের বোশেখ নদীতে
সবুজে নখের চিহ্ন কান্ত পড়ে থাক
তুমি কেন ফুটেছ জারুলে? বোশেখ ফুরালে বুঝি ফিরে যাবে
নদীতে যেমন আসে বাঁক?বলো হে প্রগাঢ় মেঘ, বলো নীরবতা,
কত আর বর্ণনার ভাষা চাও তুমি?
সীমান্ত-সড়কে কেন কুড়াও সংশয়?
কী রূপ সংকেত হৃদয়ের ব্যাখ্যা পাবে, ভাবো?
বেদনায় সাজানো সংসারে যদি সুখী হতে বলো,
কী প্রকার সুখ তাহা, কতটা অসুখ!
বেদনা কাঙ্ক্ষিত যদি, এই নাও কষ্টের কফিন।
কফিন কাহারে কয়?
বৃক্ষ থেকে পাতা ঝরে.. জগতের সেও এক রীতি;
আঁধার কাঙ্ক্ষিত যদি, এই নাও দু’টি চোখ,
পাথরিত যুগ্ম-অন্ধকার,এই নাও অসীমিত একবাক্স রাত…
শুরুতে একটি অসরল প্রস্তাবনা। তার পরই প্রশ্ন। সে প্রশ্ন এতই জটিলসারল্যের স্মারক হয়ে উঠেছে যে, দীর্ঘছায়াকে রাত্রি বলে কেউ কেউ মনে করতে পারেন। সে মনে করায় ভ্রান্তি দেখি না, দেখি একটি কবিতার বহুরৈখিক ব্যাখ্যার নানামুখী দুয়ার। ‘তুমি কেন ফুটেছ জারুলে’? প্রশ্নের লক্ষ্য কী? কবি কি জারুলের আড়ালে কোনো বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করেন? তারপরই আবার এই ব্যথিত প্রশ্ন বেজে ওঠে, ‘বোশেখ ফুরালে বুঝি ফিরে যাবে/নদীতে যেমন আসে বাঁক?’ এ প্রশ্নশীলতায় ফুটে ওঠে মানবমনের একটি গুমরে ওঠা বেদনাবোধ। চিরকাঙ্ক্ষিতকে দৃষ্টির আড়াল করতে মানবমন সাই দেয় না সহজে। এমনকি খুব প্রয়োজনেও আড়াল হতে গেলে মানবমন গুমরে ওঠে। প্রাকৃতিক নিয়মের গতিপ্রবাহকেও মাঝে মাঝে অসহনীয় মনে হয়। প্রগাঢ় মেঘ-এর কাছে প্রশ্ন করা অবান্তর তবু প্রশ্ন জাগে, ‘কত আর বর্ণনার ভাষা চাও তুমি? /সীমান্ত-সড়কে কেন কুড়াও সংশয়?’ মানুষ স্বভাবতই সংশয়ীচিত্তের। সংশয়ী মন বেদনাভারাতুর। সে বেদনাভারতুর মনে আঁধারই প্রত্যাশা করে। এই আঁধার প্রকৃত পে মানবমনের একটি নির্ভার অধিষ্ঠান। এ আঁধার কোনো ভাবেই দিনরাত্রির একটি বিশেষ অস্থা নয়, নয় আলোহীন অবস্থাও। তাই আঁধার কাঙ্ক্ষিত হলে তার জন্য প্রস্তাবনা, ‘পাথরিত যুগ্মঅন্ধকার’। তারপর আরও একটি উপহার ‘এই নাও অসীমিত একবাক্স রাত..’। এখানেই একটি অনাস্বাদিত চিত্রকল্পে নিবিড় অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। এই প্রশ্নশীল চিত্রকল্পের নৈপুণ্য সার্বভৌম চেতনার।
‘পথ’ মানবজাতির জীবনযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ‘পথ’ কেবল চলার মাধ্যম নয়, পথ লক্ষ্যে পৌঁছারও উপায়। ‘পথেতে হাজার পথ, কোন পথে যাই?’ উচ্চারণ করার সাথে উপলব্ধ হয়, পথও বহুমাত্রিক, তারও শাখাপ্রশাখা রয়েছে। যিনি পথের সন্ধান দেবেন তার নিজেরই সব পথ জানা থাকে না, অথচ অনুসন্ধানী চায় শতপথের ঠিকানা। ‘দ্বৈরথে পড়েছে গুরু, শিষ্য শতরথে’। এখানে এসে কি সে সঙ্কেতই পাই, যে গুরুর চেয়ে শিষ্যই জ্ঞানান্বষণে অধিক সফল। বিশেষত শিল্পের প্রশ্নে গুরু যখন কেবল, নিজের অস্তিত্বের সংকটে কম্পমান তখনও শিষ্য এক পথ ছেড়ে শত পথ আবিষ্কারের নেশায় উদ্যোমী? হয়তো একারণেই ‘গুরু যারে ঘর কয়, শিষ্য বলে পথ/ ভেদান্ত বিভেদে বাড়ে মত ও দ্বিমত’। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তার আরণ্যক উপন্যাসের একস্থানে উল্লেখ করেছেন, ‘ঘর দুদিনের বন্ধন, পথ চিকালের’। রহমান হেনরীর কবিতায়ও তার প্রতিধ্বনি শুনি। এবং গুরুর মুখে নয়, গুরু বরং রণশীল; শিষ্যই উদার। তাই গুরুর চোখে যা ঘর বলে প্রতীয়মান, তাই শিষ্যের চোখে পথ। শিল্পে দেয়াল তোলার প্রসঙ্গটি তাৎপর্যহীন। প্রকৃত শিল্পী তাই দেয়ালহীন পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর থাকেন।
যা কিছু সবসময় কাছে পাওয়া যায় না, অথচ অহরহই অনুভবে ধরা পড়ে, তার জন্য মানবমনের হাহাকার চিরন্তন। মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ ঘটনা সারাজীবনই তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, চালিত করে নতুনতর কোনো জগতের প্রতিও। ফলে দূর অতীতের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্তই ব্যক্তি মানুষের জীবনে অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। ওই একটি মাত্র ঘটনা বা দুর্ঘটনাই তার সমস্ত জীবনকে পরিচালিত করে তার নিজের অজান্তেই। আর তাই ব্যক্তি মানুষ মাত্রই বিশেষ মনোবিকারের মুহূর্তে বারবার সে বিশেষ মুহূর্তে ও বিশেষ স্থানে ফিরে যাওয়ার কাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। সে রকম একটি কবিতার নাম, ‘স্মৃতিসম্মলেন’। শুরুটা বড় বিস্ময়কর। পুরো কবিতাটিই উল্লেখ করা প্রয়োজন।
তোমাকে দেখতে যাবো সাধু যোশেফের সমাবেশে
উনিশ শ’ একাশি খ্রিস্টাব্দের সোনালি উৎসবে;তখন আমার দুঃখ মাধ্যমিক, আর তুমি নিম্নমাধ্যমিকে—
এ রকম উৎসব পুনরায় স্মৃতিতে সম্ভব। তোমাকে দেখতে
যাবো অনুতপ্ত স্মৃতিসম্মেলনে। যে রকম প্রাথমিক
গণিতের দিনে দেখতে গিয়েছি সেই জোয়াড়ির
বিশীদের বাড়ি; বাড়িতে মানুষ নেই—বাড়িটিও নেই—
তবু আমি ঘুরে ঘুরে কেন দেখি সারাটি দুপুর?তুমি নেই, কখনও ছিলে না—অস্তিত্ব বিষয়ে এই
চিরায়ত অনুজ্ঞাও অস্বীকার করছি বিনয়ে; আমার যে কোনো পণ
সবিনয় জেদ। অতএব যাবো, তোমাকে দেখতে যাবো স্থাপনদিঘিতে;রানীভবানীর ছাদে যে রকম সারারাত তোমাকে দেখেছি—
শিশিরের ছলে শুধু রক্ত ঝরেছে সারারাত—রাতভর
নক্ষত্রের বীভৎস শরীর থেকে সহিংসার অগ্নি ঝরেছে…
ঝলসে যাওয়াদেহে তবু পালিয়ে আসিনি; সাহসী ইচ্ছায়
দৃঢ় ভষ্মে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থেকেছি আর দেখেছি তোমার নৃত্য
ভয়ঙ্কর অগ্নিদিঘিতে…তোমাকে দেখতে যাবো, চন্দ্রাবতী কবিতা আশ্রমে—
গীতিকা উৎসব যদি ব্যর্থ হয়—অসম্ভব স্বপ্ন হয়ে যায়—
তবু যাবো; রোদ ভেঙে, শিশির মাড়িয়ে, বাসে ট্রেনে,
পায়ে হেঁটে ঘুমের ভেতরে…অবিকল্প যাবো!একবার, তোমাকে দেখতে যাবো অ স ম্ভ বে
‘স্মৃতি সম্মেলন’ কবিতায় কবি আপন ইচ্ছার পালককে জড়িয়ে দেন, জলের বল্কলে প্রাণের স্ফূরণ ঘটানোর মহেন্দ্রণের মত। চিন্তার দৈন্য যেমন ব্যক্তির প্রতিভা বিকাশের পথে অন্তরায়, তেমনি হৃদয়ের কার্পণ্যও মহাজাগতিক আলিঙ্গনের পথে কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ওঠে। রহমান হেনরী যখন বলেন, ‘তখন আমার দুঃখ মাধ্যমিক, আর তুমি নিম্নমাধ্যমিকে—’ তখন কাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গে তার দুঃখবোধ আর সামাজিক অবস্থানই কেবল বিবেচ্য হয়ে ওঠে না, সঙ্গে উভয়ের উপলব্ধির তারতম্যগত দিগটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন আবহমান বাঙলার পটভূমিতে হৃদয়ের পুঞ্জিভূত কথাগুলো, অপ্রকাশ্য বেদনারাশি অন্যের মস্তিস্কের কোষে কোষে অনুরণন তোলার জন্য সরাসরি কোনো পন্থা কি সম্ভব? তাই আড়ালের আশ্রয়। তাই স্মৃতিচারণের নামে অতীতমুখী চেতনার আদলে শেকড়সন্ধানী মনকে প্রবোধ দেওয়ার ছলে সার্বভৌম চেতনাকে ঔজ্জ্বল্যে রাঙিয়ে তোলা। যেখানে কারও অনুকম্পা শ্রাবণের অঝোর ধারপাতের চেয়ে বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে না। হৃদয়ের আকুতিকে মহিমান্বিত করে তোলে। শেষ দিকে কবি যখন বলেন,
গীতিকা উৎসব যদি ব্যর্থ হয়— অসম্ভব স্বপ্ন হয়ে যায়—
তবু যাবো; রোদ ভেঙে, শিশির মাড়িয়ে, বাসে ট্রেনে,
পায়ে হেঁটে ঘুমের ভেতরে… অবিকল্প যাবো!একবার, তোমাকে দেখতে যাবো অ স ম্ভ বে
তখন একই সাথে প্রতীজ্ঞা, আত্মসমর্পণ, আত্মনিবেদন আর ব্যকুলতা একাকার হয়ে ওঠে। চিরকাক্সিতাকে দেখার দুর্মর আকর্ষনে জীবনে অন্তত একবার হলেও কূটাভাসঋদ্ধ ‘অ স ম্ভ বে’ যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন কবি। ‘স্মৃতি সম্মেলন’কে প্রথম পাঠে কেবল প্রেমের কবিতা বলে ভুল হতে পারে। দ্বিতীয়পাঠে একবিতা নিছক প্রেমের কবিতায় স্থির থাকে না, হয়ে ওঠে একটি জাতির আত্মআবিষ্কারের সূত্রবীজ। একটি সমাজব্যবস্থায় একজন প্রেমিক মানুষ কতটা বেপরোয়া হতে পারে? হতে পারেন কতদূর ত্যাগী? তারও চেয়ে বড় কথা যখন পড়ি, ‘রানীভবানীর ছাদে যে রকম সারারাত তোমাকে দেখেছি—/শিশিরের ছলে শুধু রক্ত ঝরেছে সারারাত- রাতভর /নক্ষত্রের বীভৎস শরীর থেকে সহিংসার অগ্নি ঝরেছে…’ তখন বাঙালির শোষনের ইতিহাস যেমন মানসপটে ভেসে ওঠে, তেমনি অনেকদিকে পুঞ্জিভূত বেদনারাশিও ঝলসে ওঠে। এর পরই দেখি একজন প্রেমিকার স্থানে দেশকে বসিয়ে কবি বলছেন, ‘ঝলসে যাওয়াদেহে তবু পালিয়ে আসিনি; সাহসী ইচ্ছায়/ দৃঢ় ভষ্মে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থেকেছি আর দেখেছি তোমার নৃত্য /ভয়ঙ্কর অগ্নিদিঘিতে…’। অর্থাৎ এপঙক্তিকটিতে কেবল নারীপুরুষের আন্তঃসম্পর্ককে প্রেম স্বীকার করা হয়েছে এমন নয়, নারী পুরুষের সম্পর্কের আড়ালে প্রকৃতি ও দেশপ্রেমের অমোঘ সম্পর্কটিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাই কবিতাটি প্রথমপাঠে প্রেমের কবিতা হিসেবে প্রতীয়মান হলেও দ্বিতীয়পাঠে হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের কবিতা।
কবি অনেক সময় সামাজিক বিধিনিষেধকে অস্বীকার করেন। সেখানে নির্মাণ করে নিজস্ব নিয়মনীতি। ফলে কবির ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামাজিক বিধি নিষেধের তর্জনী লঙ্ঘন করলেই কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তিযোগ ঘটে। সে রকম একটি কবিতা, ‘নিষেধাজ্ঞা’।
নদীতে যাইও না কন্যা, সেখানে কুমির
জঙ্গলে যাইও না , আছে ওঁৎ-পাতা বাঘ
উপরন্তু চোখ ঠারে নদীর দু’তীর
গেলেই শেখাবে কিন্তু নিষ্ঠুর সোহাগ!
যে সোহাগ সমাজের চোখে নিষ্ঠু ঠেকে, সে সোহাগই প্রেমিকার আরাধ্য। এসব ভয়ভীতিকে জয় করেছে বলেই মানুষ ভালোবাসতে শেখেছে। কবি বলেই হয়তো বিপদে প্রেম আবিষ্কার করেন। ‘প্রণয়পুরাণ’ কবিতায়, ‘ছিলে তো পাথর খণ্ড, স্পর্শ করেছিমাত্র মুক্তা হয়েছ’ বক্রোক্তির মাধ্যমে কবির শক্তিমত্তা ও সম্মোহনী শক্তির পরিচয় প্রকাশ করেছেন। ‘মুখপত্র’ কবিতায় একটি বিশেষ সময়ের শাসনের ভেতর দিয়ে মানুষের হাহাকার শোনা যায়। সেখানে মহাশূন্যে সংগীতের, কবিতার, মানুষের বাণীই প্রচারিত হচ্ছে। কবিতাটির শুরুর পঙক্তি ‘অনন্ত ঘুমের মধ্যে নেচে উঠছে একটি দোয়েল’। স্তব্ধতার থেকে কোলাহলের সম্ভাবনাকে মহিমান্বিত করে তোলার জন্য এই পঙক্তি অনিবার্য। চিত্রকল্প নির্মাণেও রহমান হেনরী সিদ্ধহস্ত। ‘কৈ উৎসব’ কবিতার ‘ পোয়াতি ধানের ক্ষেতে বহুদিন পর/ আজ রাতে কৈ-উৎসব, তার উত্তেজনা নিয়ে সম্মিলিত নেচে উঠছো কৈ-টোপগুলি’। দৃশ্যটা এমন যে কেবল বর্ণনার কারণেই পাঠকের মানসপটে ভেসে ওঠে। চিত্রকল্পের সাথর্কতা সম্ভবত এখানেই। অপরাপর অলঙ্কারের চেয়ে চিত্রকল্প এখানেই অনেক বেশি শক্তিশালী।
দৃশ্যগত বিষয় নিয়ে মানবমনে সংশয় স্বাভাবিক। যা কিছু দেখছি, তা হুবহু দেখছি কি না, এ নিয়ে মনের সন্দেহ কাটে না। সন্দেহ বিষয়টা শিল্পে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করা যায়। সংশয়াকুল শিল্পই নতুন নতুন ধারনার জন্ম দিতে পারেন। সে রকম একটি কবিতা, ‘দেখা’। মাত্র দুইপঙক্তি। ‘এই যে আপনাকে দেখছি! এই দেখা ধারণাসম্মত;/ আপনি মানে অন্য কেউ, তিনি আপনারই মতো।’ প্রথম লাইলেন প্রথম পর্বে আশ্চর্যবোধক চিহ্নই দৃশ্যমান সামনে উপস্থিত ব্যক্তির বাস্তবতা সম্পর্কে সে ব্যক্তির মনেও সন্দেহের বীজ বপন করে দেয়। তারপর দ্বিতীয় অংশ উচ্চারণ হলে, ‘এই দেখা ধারণাসম্মত’ শ্রোতাব্যক্তিটিও মনে মনে ভাবতে পারেন, তিনিও হয়তো এখানে উপস্থিত নন, মনোবিকারের কারণে এমন মনে হচ্ছে তার। তারপর যখন দ্বিতীয় লাইন শ্রোতাকে শোনানো হয়, ‘আপনি মানে অন্য কেউ, তিনি আপনারই মতো।’ তখন শ্রোতাও ভাবতে বসেন, হয়তো বক্তার কথাই ঠিক। এ জগৎ পরাবাস্তব জগৎ। পুরো দুটি লাইনে বাস্তবতার অধিক কিছু রয়েছে, যা পাঠককে বাস্তবতার ঊর্ধেও কিছু ভাবতে প্রাণিত করে। এখানে পরাবাস্তবতার ছায়া। বাস্তবতার সঙ্গে একপশলা সংশয় উপস্থিত থাকায় কবিতাটি হয়ে উঠেছে পরাবাস্তব।
একজন শিল্পী অনেক সময় তার সৃষ্টির প্রতি মনে মনে বিনয় প্রকাশ করেন। এ বিনয়প্রকাশ সৃষ্টির সৌন্দর্য উপলব্ধিজাত। ‘পাথরপ্রবাহ’ কবিতায় শুরুতে ‘অথচ ভাস্বর নই; অন্তঃসলিলা হে প্রকাণ্ড ও প্রকাশ্য পাথর/ তোমার শরীর কেটে কী বিমূর্ত ভাস্কর্য গড়েছি!’ এখানে শিল্পীর নিজস্ব কর্মকুশলতার চেয়ে কাকতালীয় বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। অবচেতন মনের ঘোরই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। চেতন মনে যা করা সম্ভব নয়, অবচেতন মনে তাই করে তুলেছেন সহজ করে। আস্ত একটা পাথর খণ্ডকে শিল্প করে তোলার স্পৃহা, যোগ্যতা সবার থাকে না। যার থাকে তিনিও সচেতনভাবে গড়ে তুলতে পারেন না। যা কিছু করে অবচেতনমনেই করেন। কবি অনেকটা স্বপ্নপ্রবণ, তাই তার মনে হয়, ‘একদিন হাতেরই উষ্ণতা থেকে এভাবে নক্ষত্রের জন্ম হয়েছি’। কবি স্বাধারণত বিশ্চচরাচরের সমস্ত সৃষ্টিকর্মের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবী করতে চান। উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিটি তার সাক্ষ্যবহ। ‘সিকস্তি-পয়স্তি’ কবিতায় কবি স্বদেশের অনন্ত দুঃখদুর্দশার কথা শোনান। জলপথ বাংলার সৌভাগ্যের চেয়ে দুর্ভাগ্যেরই কারণই বেশী। তাই তার মনে হয়েছে, ‘সভ্যতার সমান বয়সী এই জলপথ/ শুধু নিয়ে যায়। যেটুকু ফিরিয়ে আনে তার সাথে রাষ্ট্র— চৌকিদার;’। রাষ্ট্র মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণসাধন করে বেশি। সে সত্য যেমন উপর্যুক্ত কবিতায় প্রমাণিত, তেমনি ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘ’ কবিতায়ও। গণতন্ত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণরূপে প্রহসন। তাই এই কবিতায় গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। ‘ডানায় ভ্রমণকান্তি, ফিরে যাচ্ছি পরাজিত পাখি। এহেন মুহূর্তে তুমি হায় রাষ্ট্র, হায় সঙ্ঘনীতি, গণতন্ত্রে খুঁকে পাচ্ছ মানবতা; মানুষের মুক্তি ও সমতা!’ কবি সঙ্ঘ আর গণতন্ত্রের অসারত্বকে ব্যঙ্গ করে, তার প্রয়োজনীয়তাকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করেছেন। ‘সার্কাসমুখরিত গ্রাম’ কবিতায় মানবজাতির অভ্যাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি কতগুলো চিত্রকল্প অঙ্কনের চেষ্টা আছে। তবে যখন ‘গভীরে গভীরে স্বাদ,/ গভীর আনন্দ শুয়ে আছে; সামান্য মুগ্ধতা আছে,/ সামগান কাদচিত্রে ধৃত আছে দূর তপোবনে…’ পড়ি তখন একধরনের ঘোরের ভেতর ভেসে যাই। কবি মাত্রই তপোবনে আরাধনাকারী। তপোবনে তপস্যার জোরেই প্রকৃত কবি তার সৃজনক্রিয়াকে প্রবহমান রাখেন।
‘উত্থানপর্ব’ জাতিসত্তার প্রশ্নে একটি জটিল কবিতা। একবিতায় মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের আচরণগত মিল-অমিল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শুরুতে সরলস্বীকারোক্তি, ‘কতকাল তোমাকে দেখি না আর অনার্যকুমারী/ সঙ্গত গড়েছ জানি, অভিামানী, অজ্ঞাত নিবাস/ আমিও তো নই আজ সন্ত শুধু, নই ব্রহ্মচারী; / কেবল স্মৃতির জলে স্বপ্নকেলি করি প্রত্নহাঁস’। প্রতীকি পরাজয়কে কবি ভুলে যেতে চান। নতুন করে জয়টিকা পরাতে চান তার অনার্যকুমারী প্রেমিকাকে। ইতিহাসে পথপরিক্রমায় অনার্যদের গৌরবকথা স্মরণ করিয়ে দেন কবি। আর বলেন, ‘দুচোখে প্রোজ্জ্বল করে তুলি এসো পুনর্জয়টিকা…’। একতিারই প্রতিধ্বনি শুনি ‘নদীর গল্প’ কবিতায়। ‘আমাদের গল্প মানে নদী আর স্বপ্ন মানে ভাষা/ ভাষা মানে দুঃখগাথা, নদী মানে জন্মস্মৃতিনাশা’। এভাবে আমাদের নদীর গল্প বলতে বলতে আমাদের জাতিসত্তার গল্পও বলা হয়ে যায়।
রহমান হেনরী লিরিকের ক্ষেত্রে অনন্য। ‘যুগ্মক্ষতি’ লিরিকধর্মী কবিতা। পুরো কবিতাটির পাঠোদ্ধার করা যাক।
আমরা দু’জনে দু’জনার কাছে খুনি
রক্তে রচিত আমাদের ফাল্গুনী।আমরা শিখেছি অভিমানী এক ক্ষতি
মিথ্যাচারের মানি নাই দুর্গতি।মেকি ভোর দেখে প্রলুব্ধ নই আজ
তাই বেছে নিই রাত্রির কারুকাজ।রাত্রিতে যাবো— রাত্রি আমার বৌ
রাত্রি খুলেই খুঁজি নিরাপদ মৌ।আমরা শিখেছি প্রতিরোধহীন ক্ষতি
তাই প্রেম আজ বেশুমার বেগবতী…
প্রেমে মিথ্যা ও সত্যের প্রভেদ তেমন একটা খুঁজে দেখা হয় না। তাই প্রেমিক ও খুনির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করার চেয়ে সম্পর্ক নির্মাণের সম্ভাব্যতা নির্ণয় করা হয়। এভাবে আলোঝলোমল দিনের চেয়ে রাত্রিই কবির কাছে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে। রাত্রিবেলা কবি নিজেকে প্রকৃতির ক্রোড়ে আপনার মতো করে মেলে ধরতে পারেন, তাই কবি রাত্রিকে নিজের বউ বলে অভিহিত করেছেন। এভাবে যত তির সম্ভাবনা সবাই যুগ্মক্ষতির তালিকাভুক্ত। এককভাবে কারও দায়ভার নেই সেই ক্ষতির। সম্পূর্ণ লিরিকটি প্রেমের অনুষঙ্গে রচিত হলেও কবিতাটি নিছক প্রেমের কবিতা নয়। হয়ে উঠেছে মানুষের অভ্যাস ও আচরণের গোপন স্বভাবের উন্মোচনও।
এভাবে রহমান হেনরী কবিতায় অতীতের সমস্ত ঋণকে আত্মস্থ করে, নিজের মতো নিয়েছেন। আবার যখন নিজের কবিতায় পূর্বজদের ঋণের বিষয়টি টেনেছেন, সেখানে নিছক ঋণগ্রহণের বিষয় স্পষ্ট হয় না, সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একজন প্রবল পরাক্রমশালী কবির অবয়ব। উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণে, কবিতার প্রকরণে রহমান হেনরী নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে।
- অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য থেকে