জীবনাধারণ-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রকৃতির উপস্থিতি অনিবার্য। সৃষ্টিশীল ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে একজন কবির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক আরও ব্যাপক-গভীর। সেজন্য কবির সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতির সামগ্রিক রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-স্বাদের ও অন্তর্গত রহস্য ও তাৎপর্যের স্পন্দন লক্ষণীয়। এক অর্থে কবিকে প্রকৃতির সাধক বলা হয়ে থাকে। কারণ কবিতা সৃজনে প্রেরণা ও ক্ষেত্র হিসেবে প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্নতা কাজ করে। বাংলা কবিতা ও গান চিরকাল বঙ্গীয় প্রকৃতির সাতরঙে রঞ্জিত। এ-অঞ্চলের কবি ও গীতিকাররা সৃষ্টিকালে জীবনাভিজ্ঞতার পরেই প্রকৃতির বিশাল জগতে অনুসন্ধানী মন ও দৃষ্টি সম্পাত করেন। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বাস্তবতাও অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে থাকে। নদী, জলাভূমি, বিস্তৃত আবাদী জমিন এবং ঋতুচক্রের পরিবর্তমান আবহাওয়া বাংলাদেশের কবিদের করে তোলে সৃজনশীল ও আনন্দবিহারি। কোনো কোনো কবিকে ‘প্রকৃতির কবি’ও বলা হয়; যেমন ইংরেজি সাহিত্যে ওয়ার্ডওয়ার্থ ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে চিহ্নিত। কারণ তাঁর কবিতায় সমগ্র জীবনানুভব প্রকৃতিকে অবলম্বন করে সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রকৃতির জীবন্ত ও আন্তরিক রূপ অন্যদের চেয়ে তাঁর কবিতায় অনেক বেশি প্রকাশিত।
বাংলা কবিতা প্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতিলগ্ন। ‘চর্যাপদে’র অধিকাংশ পঙ্ক্তিই প্রকৃতি আশ্রিত। মধ্যযুগের বিশাল কাব্যজগৎ প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। আধুনিককালে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রসাহিত্যে। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় প্রকৃতি। তাঁর অধিকাংশ কবিতা ও গান সরাসরি ঋতুসংক্রান্ত। সেখানে বাংলার প্রকৃতি বিপুল ঐশ্বর্যে প্রকাশিত; তার বিস্তৃতি রীতিমত বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাপার। তাঁর চিন্তাধারা ও অলঙ্কারের বাহন হিসেবে প্রকৃতি সবচেয়ে বড় জায়গা জুড়ে আছে এবং জীবনানুভব, চেতনাস্রোত ও জীবনদেবতা নির্মাণে প্রকৃতি প্রধান নিয়ামকরূপে কাজ করেছে। সে কারণে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো তাকেও ‘প্রকৃতির কবি’ বলা হয়েছে। তাছাড়া তাঁর ‘জীবনদেবতা’র উপলব্ধিও মুখ্যত প্রকৃতির ভিতর দিয়ে হয়েছে। এসব কারণে বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে তাকেই ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে প্রধান বলেছেন। কারণ এ জাতীয় কবি সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়েই গ্রহণ ও প্রকাশ করেন। বুদ্ধদেব বসুর এই অভিধার পেছনে এই দুই কবির রোমান্টিকতার প্রতি সমর্পিত প্রাণের বৈভব দায়ী। রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ দুজনই প্রকৃতিকে দেখেছেন মূলত দুটি উপায়ে: এক. নান্দনিক চোখে, দুই. দার্শনিক দৃষ্টিতে। তাই তাঁর কবিতায় জীবন ও জগতের সত্য অনুসন্ধান ও উপলব্ধি এবং সৌন্দর্যসৃষ্টির মূলে প্রকৃতির প্রবল উপস্থিতি লক্ষণীয়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ এই দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমের সাহিত্য ও দর্শনের জগৎ থেকে অর্জন করেন।
২.
বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথ ঋতুপ্রকৃতির রূপায়ণে সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন। তাঁর কবিতা ও গানে একইভাবে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য, বিশালতা, গভীরতা, অন্তর্গত সৌন্দর্য, পালাবদল এবং চলিষ্ণু প্রকৃতির রসিক সঙ্গী হয়ে চলিষ্ণু কবিমনপ্রাণের আকুলিব্যাকুলি বা অভিব্যক্তি প্রকাশিত। কারণ বিশ্বভরা প্রাণের মাঝে কবি নিজের স্থান করে নিয়েছেন এবং বিস্ময়ে তার গান জেগে উঠেছে। সেখানেই অসীমতা, আনন্দ, রক্তের টান, অজানাকে জানার সন্ধান পেয়েছেন। ঋতৃপ্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবিমনের ও কবিদৃষ্টির পরিবর্তন তাঁর গানে ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। প্রত্যেক ঋতুর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও রূপের মাঝে ডুবসাঁতার দিয়ে কবি তুলে এনেছেন অসামান্য মণিমুক্তাহিরা। গ্রীষ্মে কবি তৃষ্ণাতাপ ও অগ্নিময়তা অনুভব করেছেন এবং প্রকৃতির এই শুষ্কদগ্ধ দহনবেলাকে ‘নির্মম’রূপে সম্বোধন করে তার সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছেন। কারণ এই দুঃসহ শুষ্কতাপময় কঠোর রূপের মাঝে কবি গভীর রস, তৃষ্ণার জল ও বৈশাখের ধ্বংসকে উপলব্ধি করেন। বিশেষভাবে মানুষের জীবনের বাঁধন, জরা, মরা, খরা, অসুস্থতা, আবর্জনা, গ্লানির অবসান প্রলয়রূপ বৈশাখী ঝড়ের মাধ্যমে চেয়েছেন। এই বৈশাখ সুচিশুভ্রশুদ্ধ করে দিয়ে যাক জীবনকে—এই আহ্বান বারবার ব্যক্ত করেছেন। বর্ষার গান রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন। আষাঢ়-শ্রাবণে বাংলার আকাশের বিপুল মেঘসম্ভার, অঝরধারায় বৃষ্টি, চারপাশের সবুজতা, সজীবতা কবিকে প্রবলভাবে প্রাণিত করে নানাভাবে। প্রথমত মনের বিরহ-বেদনা-গোপন ব্যথা, প্রিয়ার জন্য হাহাকার, মিলনের জন্য ব্যাকুলতা ডানা ঝাপটায়; মনের উতলা ভাব মেঘবলাকার সাথে সাথে সুদূরে ছুটে যায়। এই ধরনের মনোভাব সেই কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঐতিহ্যরূপে কাজ করে আসছে। দ্বিতীয়ত দহন পিপাসাময় প্রাণহীন রিক্ততার অবসানে প্রকৃতির অন্তরালে নব অঙ্কুরোদগমের জয় নিশান, বর্ষণের আনন্দগীত, সবুজ ফসলের ছন্দ, রসের আগমন, নিরুদ্দেশ মেঘের সঙ্গে মনের উধাও হওয়া, বজ্রের আলোয় হৃদয় আলোকিত করে নেওয়া, ঝড়ের সঙ্গে প্রলয়ের রাতে বন্ধুত্বস্থাপন কবি এই সময়ে করতে চেয়েছেন। তৃতীয়ত শ্রাবণের বুকের মাঝে আগুন অনুভব করেছেন কবি; ঝড়-বাদলের রাতের অভিসারে কবি সেই আগুনে নিজেকে জ্বালিয়ে নিতে চান। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র মনোভঙ্গিতে ও বিচিত্র রূপে বর্ষাকে দেখেছেন। এতটাই বর্ষাপ্রীতি তাঁর ছিলো যে তিনি কলকাতায় বর্ষা উদ্যাপন করতেন ঘটা করে; বর্ষার কবিতা ও গানে এসময় তিনি মশগুল থাকতেন। তবু একটানা বর্ষার পরে রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দিনের আগমনে কবির মনে আনন্দ উছলে উঠতো। সবাইকে নিয়ে মেঘ কেটে যাওয়ার রোদমাখা খুশি-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে চেয়েছেন। ঘরে বৃষ্টিবন্দি হয়ে থাকার পর কবির যেন ছুটির ঘণ্টা বেজে ওঠে এই সময়ে। চারিদিকে, বিশেষভাবে ধানের ক্ষেতে রোদের ঢেউ খেলে যাওয়ার দৃশ্য কবিকে উদ্বেল করে তোলে। সকাল মেঘমুক্ত হয়ে আকাশ হয়ে ওঠে সুনীল-সুন্দর-দৃষ্টিনন্দন। সাদা মেঘের ভেলার সঙ্গে কবির মনও ভেসে বেড়ায় দিকদিগন্তে। নদীর চরে চখা-চখির মেলায় কবিকে টানে। শিশিরভেজা ঘাসে সূর্যের হাসি, ধানের বিপুল মঞ্জরি, কাশফুলের দুলুনি, শেফালির ঝরেপড়া আর শুভ্রতা কবিকে সৌন্দর্য, অপার্থিব আনন্দ, অনির্বচনীয় খুশির অনুভূতির জোয়ারে ভাসায়। প্রকৃতির রাজ্যে ডুব দিয়ে কবি অনিবার্যভাবে বারবার প্রিয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। তাকে কাছে পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়েছেন। শেফালির শুভ্রতা অনুভব করেছেন প্রিয়ার কাছে। আবার শিশিরের ক্ষণিকতা ভেবেছেন জীবনের অনুষঙ্গে। সবকিছু ছাপিয়ে শরতের রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, মেঘমুক্ত আকাশ, শুভ্র শেফালি ও শিশিরে রোদের জ্বলে ওঠার মাঝে কবির চেতনাস্রোত বিস্তারিত। পরিমানের দিক থেকে হেমন্তের গান অত্যন্ত অল্প। এই সময়ে ধান, শস্যের প্রাচুর্য কবিকে আশান্বিত ও আপ্লুত করেছে। হেমন্তে নবান্ন-উৎসবে আলোর দীপ জ্বলানোর আহ্বান জানিয়েছেন। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদের জোৎস্নার প্লাবন, পাতায় পাতায় বাতাসের চঞ্চলতা, হিম-কুয়াশার আগমন কবিকে আরো একবার ভিন্ন জগতের যাওয়ার আগমনী বার্তা দিয়েছে। শীতের আগমনে হিমেল হাওয়া ও কুয়াশায় কবি নিজেকে গুটয়ে নিযেছেন। গাছের পাতাঝরার মধ্যে কবি শূন্যতা, কাঙাল হওয়া, জীর্ণতা, দীর্ণতা ও দুঃখময়তা অনুভব করেছেন। একদিকে ফসলকাটার কাল, অন্যদিকে গাছে গাছে ঝরাপাতার উৎসব। ধানের শিষে শিশির দেখে সুন্দরে মন ডুবে গেছে, আবার প্রকৃতির সবখানে শীতের শুষ্কতা ও রিক্ততায় মনকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এই ঋতুকে তাই নির্মম বলে অভিহিত করেছেন। শীতের শেষে বসন্তের সূচনায় কবি কবি আবার নব জীবন-যৌবনের উন্মাদনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। প্রকৃতির সবখানে চৈত্রের উতল দখিন হাওয়ায় নবজীবনের জয়গান বেজে ওঠায় কবিও একই চেতনায় উদ্বেলিত। শিরীষের হিন্দোল, ঝুমকোলতার সজীবতা, নতুন পাতার ঢেউ, পারুলের হিল্লোল, পিয়ালবনের নব কিশলয়ের আনন্দ-উল্লাস, সবুজের আয়োজনে কবির উচ্ছ্বসিত ও গুঞ্জরিত। অন্যদিকে পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার রক্তরাগ, মল্লিকার সৌন্দর্য, আমের মুকুলের গন্ধমদভরা হিন্দোল, দোলনচাঁপার শুভ্রতা, চম্পার পুলক, বকুলের মাতালকরা সুবাস কবির সুপ্ত প্রাণমনকে চঞ্চল ও উতলা করে। শাখায় শাখায় বনে বনে ফুলে ফুলে দখিন হাওয়ার স্পর্শে প্রাণের আগমন। উতলা উত্তরীয় উড়িয়ে কবি তাই বারবার আহ্বান করেছেন বসন্তকে। প্রেমের অনুভূতি ও আবেগ এই উতল হাওয়ায় কবির মাঝে জাগ্রত। ফাগুন তাই কবির কাছে নবজীবনের সাতরঙের বিচ্ছুরণ, অকারণে চঞ্চলতা, প্রাণের দীপ্তি ও কোলাহল, জীবনের জয়গান, প্রাণঝরনার নিরন্তর আনন্দধারা, জীবনের পল্লবিত সবুজছায়া, নবযৌবনের দৃপ্ত পদযাত্রা এবং মর্মরিত পুলকানন্দ। রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গান সংখ্যায় বর্ষার পরেই: বিপুল। তাঁর ‘রক্তকরবী’র প্রাকৃতিক পটভূমি নির্মিত হয়েছে বসন্তের আবহাওয়ায় ও অনুষঙ্গে।
৩.
বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ বাংলাদেশের প্রকৃতি বলতে যা কিছু বোঝে বা প্রকৃতি বলতে যাকিছু চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়, সেখানে রবীন্দ্রাথের কবিতা ও গানের বিশেষ প্রভাব বিরাজমান। আমাদের চেতনায় বাংলার ষড়ঋতুর চিত্ররূপ ও রঙরেখা, পরিবর্তন ও প্রভাব অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ঋতুসংক্রান্ত গানের অনিবার্য যোগসূত্রে কার্যকর। তাই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সে সব গানের বাণী ও সুর ছাড়া পূর্ণ হয়ে ওঠে না।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে বাংলার প্রকৃতি ব্যবহৃত হয়েছে প্রধানত নান্দনিক দৃষ্টিতে। কবির মনের রঙরূপ ছয় ঋতুতে ছয়বার পরিবর্তন হয়েছে। বৈশাখে ও ফাল্গুনে, শ্রাবণে ও আশ্বিনে কবি প্রিয়জনের সঙ্গে হদয়ের সংযোগ ও টানাপড়েনে প্রকৃতির বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে আহরণ করেছেন গানের অধিকাংশ উপাদান। বিশেষভাবে ঋতুপ্রকৃতির পরিবর্তনে কবিমনের পরিবর্তন, সেইসঙ্গে সেই ঋতুনিসর্গ থেকে অপরিহার্য চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা বা রূপকের ব্যবহার করেছেন। এই কাজটি এমন এক দক্ষতায় করেছেন যে গান থেকে সেইসব উপাদান বিচ্ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব। বাংলা ‘বারোমাস্যা’র শোভন-সুন্দর-বিচিত্র রূপের আধুনিক আঙ্গিক ও রুচির প্রকাশ ঘটেছে তাঁর গানে। রোমান্টিক মনের ও চেতনার গতিপ্রকৃতি যেমন নির্ণিত হয়েছে ঋতুবদলের পরিক্রমায়; সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ গানে গানে সুরে সুরে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মে কঠিন দহনবেলা, বর্ষায় নবীন প্রাণের উন্মেষ ও সজীবতা, শরতে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের আনন্দ, হেমন্তে শস্যসম্ভার, শীতে নির্মম শূন্যতা ও পাতাঝরা এবং বসন্তে নবজীবনের রঙ ও প্রাণের জাগরণের চিত্ররূপকল্প তাঁর গানের কথার পরতে পরতে স্পন্দিত। নান্দনিক অনুভূতি, বোধ, চেতনা, উপলব্ধির নানা রঙ সেখানে অঙ্কিত হয়েছে গানের কথামালার উৎসঙ্গে। এই কাজটি এমন বিপুল পরিমানে বিস্তৃত পরিসরে চিরকালীন ও সর্বজনীন রূপরীতিতে সম্পন্ন করেছেন যে তাঁর রূপের বাইরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে দার্শনিক দৃষ্টিতেও দেখেছেন। জীবনের উন্মেষ, বিকাশ, বাঁকবদল, পরিণতি, ঘাত-প্রতিঘাত, উদ্দীপনা, নির্জীবতা, সজীবতা, উত্থান-পতন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কবি প্রকৃতিকে সামনে এনেছেন এবং সেখানে সবকিছু পেয়েছেন। হৃদয়ের সূক্ষ অনুভূতি থেকে শুরু করে জীবনের বৃহত্তর প্রান্তরে প্রকৃতির ওপর কবি নির্ভর করেছেন, অবলম্বন করেছেন। প্রকৃতির ভেতর দিয়ে তিনি জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন, প্রকৃতির মাধ্যমে জীবনকে ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথের মৌলিক চিন্তাধারা, মতবাদ, চেতনাস্রোত ও বক্তব্যে প্রকৃতির কার্যকারণের প্রসঙ্গ বিরাজমান। কবি আজীবন যে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আনন্দময় জগৎ নির্মাণ করেছেন তাঁর মূলে প্রকৃতিকে স্থাপন করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতে বারবার সেই সত্য বেজে উঠেছে। ঋতুপ্রকৃতির স্বরূপ ও পরিক্রমার মাঝে জীবনের গভীর অনুভব ও সত্যের সন্ধান কবি পেয়েছেন। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সমান্তরাল রূপান্তরের সূত্রটি তিনি গানের জগতে আবিষ্কার করেন। কবির দুঃখানুভব, জীবনানন্দ, প্রেমানুভূতি, চিরায়ত সত্যকে কবি গানের সুরে বেঁধেছেন। মানুষ ও সাহিত্যেক রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও চেতনা সবচেয়ে বেশি ধ্বনিত হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে। আর সেই কাজটি প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
৪.
রবীন্দ্রনাথ মূলত রোমান্টিক কবি। পশ্চিমের রোমান্টিক যুগের কবিতা ও মতবাদ কবিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রকৃতিময়তা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে সমগ্র রবীন্দ্রনাথ বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।