সীমার মাঝে, অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমায় প্রকাশ তাই এত মধুর।
(গীতাঞ্জলী)
এক.
আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে মরুভূমিতে পাহাড়ে-গালিল সাগরের তীর ঘেষে যে মানুষটি প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন তিনি খ্রিস্ট। ‘প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করো’—এই অমোঘ বাণীর মাধ্যমে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এর যিনি পূর্ণতা দিলেন তিনি খ্রিস্ট। ক্ষমা-দয়া আর প্রেম-ই মানুষকে দিতে পারে মিলনের আনন্দ। ঈশ্বর প্রেম। তাই তিনি জগৎকে এমন প্রেম করলেন যে—মর্ত্যরে নশ্বর মানুষকে নিজের সাথে মিলনের আনন্দ দান করতে নিজে মানুষ রূপে জগতে এলেন। ‘ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা ঈশ্বরের পুত্র বলে আখ্যাত হবে।’ এভাবে মিলনের বাণী প্রচার করে মানবপুত্র খ্রিস্ট হয়ে ওঠেন ঈশ্বর তনয়—আর বাইবেল হয়ে ওঠে খ্রিস্টের বাণী সম্বলিত ঐশী পুস্তক। আর মানুষ যে আমরা, সে আমরাও তার কাছে এসে তার সমকক্ষ হয়ে উঠি। মানুষকে এইভাবে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া কেবল প্রেমের পক্ষেই সম্ভব। কেননা ঈশ্বর নিজে প্রেমের আঁধার। আর সকল মহামানবের মতো যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীতে এসেছিলেন সহজ কথা বলার জন্য। সেই সহজ কথা বলেন তিনি প্রেমের ভাষায়। প্রেমের ভাষা কী? প্রেমের ভাষা হলো ক্ষমা-দয়া। বাইবেলে প্রেম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে—‘যদি আমি মনুষ্যদের এবং দূতগণেরও ভাষা বলি, কিন্তু আমার প্রেম না থাকে, তবে আমি শব্দকারক পিওল ও ঝম্ ঝম্কারী করতাল হইয়া পড়িয়াছি। আর যদি ভাববাণী প্রাপ্ত হই ও সমস্ত নিগূঢ়তত্ত্বে ও সমস্ত জ্ঞানে পারদর্শী হই এবং যদি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকে যাহাতে আমি পর্বত স্থানান্তর করিতে পারি, কিন্তু আমার প্রেম না থাকে তবে আমি কিছুই নহি। আর যথাসর্বস্ব যদি দরিদ্রদিগকে খাওয়াইয়া দেই, এবং পোড়াইবার জন্য আপন দেহ দান করি, কিন্তু আমার মধ্যে প্রেম না থাকে তবে আমার কিছুই লাভ নেই। প্রেম চির সহিষ্ণু, প্রেম মধুর, ঈর্ষা করে না, প্রেম আত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব করে না, অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থচেষ্টা করে না, রাগিয়া ওঠে না, অপকার গণনা করে না, অধার্মিকতায় আনন্দ করে না, সত্যের সহিত আনন্দ করে—প্রেম কখনো শেষ হয় না।‘ (নিউটেস্টামেন্ট: ১, করিন্থীয়-১৩: ১-৮)।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কী বলেন? তিনি বলেন, ‘মিলনের মধ্যে যে সত্য, তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে। তাহা আনন্দ, তাহা রস স্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে তাহা সমগ্র কারণ তাহা কেবল বুদ্ধি নহে, তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে।… মিলনের যে শক্তি, প্রেমের যে প্রবল সত্যতা, তাহার পরিচয় আমরা পৃথিবীতে পদে পদে পাইয়াছি। পৃথিবীতে ভয়কে যদি কেহ সম্পূর্ণ অতিক্রম করতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করিতে পারে, তবে তাহা প্রেম। স্বার্থপরতাকে আমরা জগতের একটা সুকঠিন সত্য বলিয়া জানিয়াছি, সেই স্বার্থপরতার সুদৃঢ় জালকে অনায়াসে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয় প্রেম।‘ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:ধর্ম/ উৎসব,৭-৮)।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রেম তো কিছু না দিয়া বাঁচিতে পারে না।‘ বাইবেল বলে, ‘প্রেম প্রত্যাশা করেনা।. রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রেম যাহা দান করে, সেই দান যতই কঠিন হয় ততই তাহার স্বার্থকতার আনন্দ নিবিড় হয়। (রবীন্দ্রনাথ:ধর্ম পৃ: ২৩)।
যিশু বলেন, ‘ধন্য যারা দয়াশীল কারণ তারা দয়া পাবে।’ কেবল উপদেশ বাণী সংবলিতই নয়, ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যে প্রার্থনা, সেখানেও তিনি আরোপ করেছেন প্রেম ও ক্ষমার শর্ত। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা যদি লোকের অপরাধ ক্ষমা করো, তবে তোমাদের স্বর্গীয় পিতা তোমাদিগকেও ক্ষমা করিবেন। কিন্তু তোমরা যদি লোকের অপরাধ ক্ষমা না করো, তবে তোমাদের পিতা তোমাদেরও অপরাধ ক্ষমা করিবেন না। তাই প্রার্থনায় বসবার আগে কারও বিরুদ্ধে কথা থাকলে তা মিটিয়ে ফেলা উচিত, না হলে সে প্রার্থনা হয় অর্থহীন। প্রার্থনার নিজের কোনো স্থান নেই। সমগ্র পৃথিবীতে যেন ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, শান্তি আর প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, এই হলো প্রার্থনার বিষয়। এ জন্য খ্রিস্টীয় প্রার্থনায় আমরা বলি:
হে পিতা…তোমার রাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক
তোমার ইচ্ছা যেমন স্বর্গে তেমনি
মর্ত্যে পূর্ণ হোক—আর
আমরাও যেমন আপন আপন
অপরাধীদিগকে ক্ষমা করিয়াছি
তেমনি তুমিও আমাদের অপরাধ
সকল ক্ষমা কর।..
এই যে প্রার্থনা—এর মর্ম ক্ষুদ্র নয় বৃহৎ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যিশু চরিত্র আলোচনা করিলে দেখিতে পাইব, যাহারা মহাত্মা, তাহারা সত্যকে অত্যন্ত সরল করিয়া সমস্ত জীবনের সামগ্রী করিয়া দেখেন, তাহারা কোনো নতুন পন্থা, কোনো বাহ্য প্রণালী, কোনো অদ্ভুত মত প্রচার করেন না। তাহারা অত্যন্ত সহজ কথা বলিবার জন্য আসেন।‘ (রবীন্দ্রনাথ:খৃস্ট/যিশু চরিত)।
সহজ কথাই ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তো রাজা-ই। তাই তিনি অভিষিক্ত হলেন স্বর্ণ-কুন্দুরু ও গন্ধরসে। প্রত্যাখ্যান করলেন শয়তানের প্রদত্ত রাজ্যের প্রলোভন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সে প্রলোভনকে নিরস্ত করিয়া তিনি জয়ী হইয়াছিলেন। এই প্রলোভনের কাহিনীকে কাল্পনিক বলিয়া উড়াইয়া দিবার হেতু নাই। রোমের জয় পতাকা তখন রাজ গৌরবের আকাশে আন্দোলতি হইতেছিল এবং সমস্ত ইহুদি জাতি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার সুখ স্বপ্নে নিবিষ্ট হইয়াছিল।…এই সর্বব্যাপী মায়াজালকে ছেদন করিয়া তিনি ঈশ্বরের সত্যরাজ্যকে সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ করিলেন।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:খিস্ট/যিশু চরিত)।
এই যে ঈশ্বরের রাজ্যের কথা তিনি ঘোষণা করলেন, যেখানে ধন-সম্পদের কোনো মূল্য নেই, দারিদ্র যেখানে প্রধান শর্ত, দুঃখভোগ সেখানে ঐশ্বর্যতুল্য। তিনি বলেন ‘সুচের ছিদ্র দিয়া উটের যাওয়া সহজ কিন্তু ধনী লোকের পক্ষে স্বর্গে যাওয়া কঠিন।’ (নিউটেস্টমেন্ট মথি ১৯ :২৩/২৪)।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘হে রুদ্র, তোমার প্রসন্ন মুখ কখন দেখি? যখন আমরা ধনের বিলাসে লালিত, মানের মদে মত্ত, খ্যাতির অহঙ্কারে আত্মবিস্মৃত…তখন?…. দারিদ্র্য ভিক্ষুক না করিয়া যেন আমাদিগকে দুর্গম পথের পথিক করে এবং দুর্ভিক্ষ ও মারী আমাদিগকে মৃত্যুর মধ্যে নিমজ্জিত না করিয়া সচেষ্টতর জীবনের দিকে আকর্ষণ করে।’ (ধর্ম: পৃ- ৭৮/৭৯)।
এভাবে-ই খ্রিস্টধর্মের খ্রিস্ট হয়ে ওঠেন অর্থনৈতিক সাম্যবাদের ঘোষক। হয়ে ওঠেন ঐশী রাজ্যের সন্ন্যাসী রাজা। বাইবেলে এই সত্য ঘোষিথ হয়েছে এই ভাবে, ‘যারা দীন তারা ধন্য কারণ স্বর্গরাজ্য তাদের, যারা নম্র তারা ধন্য কারণ পৃথিবীর অধিকার তারাই লাভ করবে।’ রবীন্দ্রনাথ এর ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এইভাবে স্বর্গরাজ্যকে যিশু মানুষের অন্তরের মধ্যে নির্দেশ করিয়া মানুষকেই বড়ো করিয়া দেখাইয়াছেন। তাহাকে বাহিরের উপকরণের মধ্যে স্থাপিত করিয়া দেখাইলে মানুষের বিশুদ্ধ গৌরব খর্ব হইত। তিনি আপনাকে বলিয়াছেন মানুষের পুত্র। মানব সন্তান যে কে তাহাই তিনি প্রকাশ করিতে আসিয়াছেন।’ (খৃস্ট:যিশুচরিত)
অন্যদিকে ওল্ড টেস্টামেন্ট সরাসরি ঘোষণা করে, ‘তোমরাই ঈশ্বর।’ এই ঘোষণায় প্রমাণিত হয় মানুষ কেবল মানুষ নয়। সে ছোট নয় সে বড়। তার এই বড়ত্ব তার অন্তরে সত্যে, সৌন্দর্যে, সরলতায় এবং প্রেমে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘মানব সমাজে দাঁড়াইয়া ঈশ্বরকে তিনি পিতা বলিয়াছেন। পিতার সাথে পুত্রের যে সম্বন্ধ তাহা আত্মীয়তার নিকট সম্বন্ধ। আত্মা জায়তে পুত্র:। তাহা আদেশ পালনের ও অঙ্গীকার রক্ষার বাহ্য সম্পর্ক নহে। ঈশ্বর পিতা এই চিরন্তন সম্বন্ধের দ্বারাই মানুষ মহীয়ান, আর কিছু দ্বারা নহে। তাই ঈশ্বরের পুত্ররূপে মানুষ সকলের চেয়ে বড়, সম্রাজ্যের রাজা রূপে নহে। তাই শয়তান আসিয়া যখন বলিল, ‘তুমি রাজা’, তিনি বলিলেন, ‘না, আমি মানুষের পুত্র।’ এই বলিয়া তিনি সমস্ত মানুষকে সম্মানিত করেছেন।” (যিশুচরিত/খৃস্ট)
এভাবে রবীন্দ্রনাথ খ্রিস্টকে আবিষ্কার করেছেন মানবপুত্র হিসেবে। ঈশ্বরপুত্র হিসেবে তার আবির্ভাব কোনো তর্কের বিষয় নয় বরং মানুষকে ঈশ্বরের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রেমকে বড় করে তুলে ধরেছেন তিনি। এভাবে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরপুত্র হিসেবে, সন্ন্যাসী রাজা হিসেবে, প্রেমের রাজা হিসেবে,সত্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মনোভূমিকে সহজ করেছেন। দুঃখকে স্বীকার করে তিনি হয়েছেন দুঃখের মানুষ, মহাসাধক, মহাপুরুষ।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘তিনি পরম আনন্দ পরমাগতি: এই কথা উপলব্ধি করবার জন্য যে ত্যাগের দরকার যারা তা শেখেনি…এই মহাপুরুষ তাই আপনার জীবনে ত্যাগের দ্বারা, মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত হযে মানুষের কাছে এই বাণী এনে দিয়েছিলেন।’ (খৃস্ট/খৃস্টাৎসব)
দুই.
রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকারোক্তিতেই নয় খ্রিস্টাদর্শ বা খ্রিস্টদর্শনের মূল সুর ছড়িয়ে যেতে দেখি সবখানেই। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘হে রাজা, তুমি আমাদের দুঃখের রাজা, হঠাৎ যখন অর্ধরাত্রে তোমার রথচক্রের বজ্রগর্জনে মেদিনী বলির পশুর হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপিয়া ওঠে তখন জীবনে তোমার সেই প্রচণ্ড আবির্ভাবের মহাক্ষণে যেন তোমার জয়ধ্বনি করিতে পারি…সেদিন যেন দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তোমাকে ঘরে প্রবেশ করিতে না হয়, যে সম্পূর্ণ জাগ্রত হইয়া সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়া তোমার উদ্দীপ্ত ললাটের দিকে দুইচক্ষু তুলিয়া বলিতে পারি: হে দারুণ, তুমি-ই আমার প্রিয়।’ (ধর্ম/দুঃখ পৃ:৭৪)।
এখানে এসেও আমরা যিশুর সতর্ক বাণীর কথা মনে করতে পারি। খ্রিস্টদর্শনের মূল বক্তব্য হৃদয়ে ধারণ করে রবীন্দ্রনাথও হয়ে ওঠেন খ্রিস্টের প্রতিনিধি। রবীন্দ্রনাথের এই মনোভূমি তৈরি হয়েছিল কিসের দ্বারা? বৌদ্ধদর্শন না কি খ্রিস্টদর্শন? পক্ষপাতিত্বের দোষ থাকলেও একথা স্বীকার করতেই হয় যে বৌদ্ধ ধর্মদর্শন রবীন্দ্রনাথকে প্রবলভাবে টেনেছিল, যার প্রমাণ আমরা তার সাহিত্যে যেমন ছড়িয়ে যেতে দেখি তেমনি জীবনাচারেও তার প্রতিফলন দেখতে পাই। তবু কি তিনি খ্রিস্টাদর্শের কাছে আসেননি? চেতনে অবচেতনে সর্বত্রই তো খ্রিস্টের ছায়া দেখতে পাই তার রচনায়।
রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘আমাদের বেশভূষা দীন হউক, আমাদের উপকরণ সামগ্রী বিরল হউক, তাহাতে যেন লজ্জার লেশমাত্র না পাই, কিন্তু চিত্তে যেন ভয় না থাকে, ক্ষুদ্রতা না থাকে, বন্ধন না থাকে, আত্মার মর্যাদা সকল মর্যাদার ঊর্দ্ধে থাকে।’ (ধর্ম:৪২)। এই যে, দীনতার কথা মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আত্মার মর্যাদার কথা স্বীকার করলেন—এ বাণী? ভগবান বুদ্ধের নাকি খ্রিস্টের?
খ্রিস্ট যখন আমাদের প্রার্থনা করতে শেখান আমরা কী বলি? হে পিতা তোমার রাজ্য আইসুক, তোমার ইচ্ছা যেমন স্বর্গে তেমনি মর্ত্যে পূর্ণ হউক। এই যে তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন। একি কোনো জেহাদ ঘোষণা করে সম্ভব? ঈশ্বরের ইচ্ছা কী? ব্রহ্মের ইচ্ছা কী? তাঁর ইচ্ছা মানুষ তাঁর কাছে আসুক, মানুষ তাঁর অন্বেষণ করুক। ঈশ্বর যেমন দয়াশীল-মানুষ তেমনি দয়াশীল হোক, ঈশ্বর যেমনি ক্ষমাশীল মানুষ তেমনি ক্ষমাশীল হোক। ঈশ্বর যেমন ভক্তের হৃদয় অধিষ্ঠান করতে ভালোবাসেন তেমনি মানুষও যেন ভক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে ঈশ্বরের অন্তরে নিগুঢ় সত্য অন্বেষণ করে। তাহলে আমাদের প্রার্থনা কী? আমাদের প্রার্থনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমি এখন তোমার নিকট শক্তি প্রার্থনা করি না, আমাকে প্রেম দাও, আমি সংসারে জয়ী হইতে চাহি না, তোমার নিকট প্রণত হইতে চাই, আমি সুখ-দুঃখকে অবজ্ঞা করিতে চাহি না, সুখ-দুঃখকে তোমার মঙ্গল হস্তের দান বলিয়া বিনয়ে গ্রহণ করিতে চাই।…ইহা যেন মনে রাখি, জীবনকে তুমিই আমার প্রিয় করিয়াছিলে, মরণকে তুমিই প্রিয় করিবে; তোমার দক্ষিণ হস্তে তুমি আমাকে সংসারে প্রেরণ করিয়াছিলে,তোমার বাম হস্তে তুমি আমাকে ক্রোড়ে আর্কষণ করিয়া লইবে। তোমার আলোক আমাকে শক্তি দিয়াছিল তোমার অন্ধকার আমাকে শান্তি দিব।’ (ধর্ম: দিনরাত্রী/১৯)।
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন ধর্ম নয় আত্মার মর্যাদা খর্ব করে অভ্যাসগত সংস্কার। এই সংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। তাই বুদ্ধ তার কাছে যেমন মহামানব খ্রিস্টও তাই।উভয়-ই চেয়েছেন মানুষ মোক্ষ লাভ করুক।এটাই হলো অনন্ত জীবনপ্রেমে, সত্যে, ত্যাগে এবং দুঃখে নিজের আত্মাকে উন্নত করা।এই রবীন্দ্রনাথ কোন ধর্মের প্রভাবে এই সত্যের সন্ধান পেলেন, সেই বিতর্কে না গিয়ে বরং একথা বলতে চাই যে, ভারতবর্ষের নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে যে বুদ্ধের আবির্ভাব, সেই বুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে যখন প্রাচ্যের খ্রিস্টের সঙ্গে আদর্শের বৈরিতা নেই, তখন বুদ্ধকে সমীহ করলে রবীন্দ্রনাথের মহত্ত যেমন কলুষিত হয় না, তেমনি খ্রিস্টও তুচ্ছ হয়ে যান না। এরপরেও খ্রিস্ট কি প্রভাবিত করেননি রবীন্দ্রনাথ কে? একটি ‘শিশুতীর্থ’ নামক কবিতা কিংবা নৃত্যনাট্য না রচনা করলেও কি রবীন্দ্র মনে খ্রিস্টাদর্শের উপস্থিতি লক্ষ করা যেত না? যে অর্থে বৌদ্ধ ভারতীয়দের অবতার, সেই অর্থে খ্রিস্ট নন। তিনি বিদেশির মতোই। তবু ভারতীয় বোদ্ধা ব্যক্তিদের কাছে তিনি অবতার রূপেই শ্রদ্ধেয়। যেভাবে খ্রিস্ট স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন, সেই একই কারণে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও তাঁকে নিজের লোক বলে গ্রহণ করেছেন।আর স্বামী বিবেকানন্দ যে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা যে খ্রিস্টীয় মিশনের ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত, তা সবাই মানেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তরুণ স্যানাল বলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ যে রামকৃষ্ণ মিশন গড়েছিলেন সেখানেও ছিল খ্রিস্টীয় মিশনের আদর্শ। শ্রীমা রচিত কথামৃত যেন খ্রিস্টীয় সুসমাচার, ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেন খ্রিস্টাবতার এবং কথামৃতের কথনে যেন নিউটেস্টমেন্ট, স্বামী বিবেকানন্দ যেন সন্তপল।’ (অরুণ সন্যাল: সহস্রাব্দের সমীক্ষা-১ম খণ্ড পৃ:৯) ।
কেবল তাই নয় মহাত্মা গান্ধী যে আদর্শের পতাকা তুলে ধরেছিলেন, তার পেছনেও রয়েছে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ কি এ প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারতেন? না কি পেরেছেন? সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথের যে অসাধারণ গুণ ছিল, তা হলো আত্মস্থ এবং পর্যবেক্ষণ করার শক্তি। যে শক্তিতে স্বামী বিবেকানন্দ তৈরি করেছিলেন নিজস্ব ভাবমূর্তি, যে শক্তিতে রামকৃষ্ণ আত্মস্থ করেছিলেন খ্রিস্টকে এবং সৃষ্টি করলেননিজস্ব ঠিকানা, সেই একই শক্তিতে তিনি বুদ্ধ ও খ্রিস্টকে আত্মস্থ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে ব্রাহ্মধর্মের উপাসনা করতেন, তার কাঠামো বিন্যাসও তো ছিল খ্রিস্টীয় ভাবধারায়। এ জন্য তিনি বলেন…সাম্প্রদায়িক খৃস্টানের হাত থেকে খৃস্টকে সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবের হাত থেকে বিষ্ণুকে, সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মের হাত থেকে ব্রহ্মকে উদ্ধার করে নেওয়ার জন্যে বিশেষ ভাবে সাধনা করতে হয়।আমাদের আশ্রমে আমরা সাম্প্রদায়ের ওপর রাগ করে সত্যের সঙ্গে বিরোধ করব না। আমরা খৃস্টধর্মের মর্মকথা গ্রহণ করবার চেষ্টা করব। খৃস্টানের জিনিস বলে নয়, মানবের জিনিস বলে।’ এভাবেই রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ, খ্রিস্ট ও ব্রাহ্ম থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেন আর তাঁর দর্শনও আলাদাভাবেই হয়ে ওঠে রাবীন্দ্রিক।