বাংলাদেশের কবিতায় রফিক আজাদ (জন্ম: ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১—১২ মার্চ, ২০১৬) স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি নাম। ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী সময়পর্বের এই কবি নিঃসংকোচে অস্তিত্বের শেকড় থেকে তুলে এনেছেন জীবনঘনিষ্ঠ পঙ্ক্তিমালা। তার কবিতায় রয়েছে আত্মজিজ্ঞাসা, সমাজ ও জীবনলগ্ন অনুভূতি, সত্তাসন্ধান আর সামাজিক অঙ্গীকার। একজন কবি মাত্রই সমাজসচেতন মানুষ। একইসঙ্গে তিনি যেমন শব্দ সচেতন তেমনিভাবে সময়, রাজনীতি এবং পরিপার্শ্ব সচেতনও। রফিক আজাদ তার কবিতায় সৌন্দর্যকে যেমন ধরেছেন তেমনি তার লেখায় সমাজের আশাভঙ্গ ও আশালোকের ইঙ্গিত। কখনো কখনো অস্তিত্বের প্রশ্নে তিনি আপসহীন হয়ে উঠে অন্তর্মুখী শব্দমালাকে নতুন ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেন। যা তার কবিতার অন্তর্ময় চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যেখানে চেতনার গভীর প্রতিফলন যেমন লক্ষ করেন পাঠক, তেমনি জীবনের বস্তুগত এবং ঘটনাপ্রবাহের প্রবণতাও লক্ষ করেন। ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে শৈল্পিক-তাৎপর্যময়। কবি রফিক আজাদ জন্মগ্রহণ করেছেন অবিভিক্ত ভারতবর্ষে। শৈশবে তার স্মৃতিতে রয়েছে ভারত ভাগ, পাকিস্তান আন্দোলন। এরপর পর্যায় ক্রমে আমাদের বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত সময়পর্বের ভেতর দিয়ে দেখেছেন মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনার মধ্য দিয়ে কী করে নতুন স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়। একটি স্বপ্নকে সফল করতে তিনি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। সমাজবাস্তবতার ভেতর থেকে নিজের চিন্তা ও চেতনাকে জীবনজিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে অনুভূব করেছেন। জীবনের দৃষ্টিগ্রাহ্য অনুভূতিমালাকে যেমন অভিজ্ঞতা এবং জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে মূর্ত করে তুলেছেন তেমনি অবলীলায় তিনি অস্তিত্বের প্রশ্নে জীবনের নিগূঢ়তম রহস্যকেও মূর্ত করে তুলতে দ্বিধা করেননি। ফলে রফিক আজাদের কবিতা হয়ে উঠেছে মানবচেতনার প্রতিফলিত রূপ। তার ধ্বনিগুচ্ছ হয়ে উঠেছে শিল্পের অন্য নাম। যে আত্ববিধ্বংসী প্রবণতা পুরো ষাটের দশকের কবিদের মন ও মননে রয়েছে, তার ব্যতিক্রম না হলেও রফিক আজাদ এর মধ্য দিয়েই স্বদেশ, সমাজ এবং মানুষের প্রেমের সঙ্গে নিজের একাকীত্বকে মিশিয়ে বিষণ্নতার প্রতিকূলে নিজেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। প্রেম, বিশেষত নারীর প্রেমের প্রতি ষাটের দশকের কবিতা হয়ে উঠেছিল প্রায় পুরোটাই শরীরবৃত্তীয়। নারীর প্রেম কখনো কখনো হয়ে উঠেছে স্বদেশকেন্দ্রিক, কখনো নিছক ভোগের সামগ্রী। আবার কখনো তাতে রয়েছে আত্মানুসন্ধানের আকর।
যাও পত্রদূত, বোলো তার কানে-কানে মৃদু স্বরে
সলজ্জ ভাষায় এই বার্তা: ‘কোমল পাথর, তুমি
সুর্যাস্তের লাল আভা জড়িয়ে রয়েছো বরতনু;
প্রকৃতি জানে না নিজে কতোটা সুন্দর বনভূমি।’
যাও, বোলো তার কানে ভ্রমরসদৃশ গুঞ্জরণে,
চোখের প্রশংসা কোরো, বোলো সুঠাম সুন্দর
শরীরের প্রতি বাঁকে তার মরণ লুকিয়ে আছে,
অন্য কেউ নয়, সে আমার আকণ্ঠ তৃষ্ণার জল:
চুলের প্রশংসা কোরো, তার গুরু নিতম্ব ও বুক
সবকিছু খুব ভালো, উপরন্তু, হাসিটি মধুর!যাও পত্রদূত, বোলো, ‘হে মাধবী, কোমল পাথর,
দাঁড়াও সহাস্য মুখে সুদূর মধুর মফঃস্বলে!’
বিনম্র ভাষায় বোলো, ‘উপস্থিতি খুবই তো উজ্জ্বল,
যুক্তিহীন অন্ধ এক আবেগের মধ্যে, বেড়াজালে,
আবদ্ধ হয়েছো উভয়েই, পরস্পর নুয়ে আছো
একটি নদীর দিকে—বোলো তাকে, ‘অচ্ছেদ্য বন্ধন
ছিঁড়ে ফেলা সহজ তো নয় মোটে, কোমল পাথর!’যাও পত্রদূত, বোলো—ভালোবাসা গ্রীষ্মের দুপুর?
নীরব দৃষ্টির ভাষা-বিনিময়—দিগন্ত সুদূর?
(যাও, পত্রদূত)
রফিক আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে— ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে; চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া; সশস্ত্র সুন্দর; একজীবনে; হাতুড়ির নিচে জীবন; পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ; অপর অরণ্য; খুব বেশি দূরে নয়; ক্ষমা করো রহমান হে উদার অমেয় বাতাস; করো অশ্রুপাত; পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকার চিঠি; কণ্ঠে তুলে আনতে চাই; বিরিশিরি পর্ব; হৃদয়ের কী বা দোষ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি খুঁজে ফিরেছেন জীবনের সত্যানুসন্ধান। পারিপার্শ্বিকতা এবং সংকটের সন্ধান করেছেন এবং এই প্রভাব তিনি নিজের ভেতরে স্বীকার করে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে তিনি নিজের অন্তর্দহন নিবেদন করেছেন শিল্পের কাছে। যে বোহেমিয়ান এবং নাগরিক ক্লেদে ভরা জীবনকে উপড়ে ফেলে নতুন উদ্দীপনায় প্রাপ্তির আনন্দে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন তিনি সেখানে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাকটুকুও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। ফলে একজন কবি যে প্রকৃত প্রস্তাবেই আলোকিত জীবনের রূপকার তা রফিক আজাদের কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠকের অনুধাবণে কোন দূরত্ব তৈরি হয় না।
কারুাকর্যময় হে দরোজা, তোমার গভীরে আর
স্বপ্নের বাস্তবে যাবো—পথ দাও, পথ ক’রে দাও;
অগস্ত্যের মতো গ্রাস করো এই সমগ্র আমাকে।
নীরন্ধ্র জাহাজ নও, নও মোটে অনুভূতিহীন,
দ্বারে এসে প’ড়ে আছি কনকনে শীতের রাত্রিতে
বিহ্বল রাত্রির মতো উষ্ণতার মর্মে টেনে নাও।
(হে দরোজা)
শিল্পের যে দরজা প্রথম থেকে খুলতে চেয়েছেন রফিক আজাদ, তাকে কখনোই তিনি জীবনের বিপরীত ভাবেন নি। বরং শিল্পকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার যে প্রবণতা তিনি ঘুরে ফিরে প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে খুঁজেছেন তাকেই ব্যর্থতা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির বন্ধনে জড়িয়েই নিজের যাত্রাপথকে সচল রেখেছেন। ফলে তার কবিতায় তৈরি হয়েছে নিজস্ব ভূমি, নিজস্ব বলবার ভঙ্গি, যা সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে পাঠকের । তিনি কখনওই শেকড় থেকে নিজেকে তুলে ফেলার চেষ্টা করেননি তাই তার কবিতায় বারবার উঠে এসেছে স্ব-সমাজ ও জীবনের অভিজ্ঞতা।
ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি : উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে—প্রতিপলে—সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি যেমন চরিত্রের শস্যক্ষেত্রে জ্বেলে দেয়
প্রভূত দাহন—তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহদু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনও দাবি
অনেক অনেক-কিছু চেয়ে নিয়েছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ী, টাকাকড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই-এই চাওয়া সরাসরি – ঠাণ্ডা বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই:
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি!অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা-
চাইনি তো নাভিনিম্নে পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক— যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও—
জেনে রাখো : আমার ও সব এ কোনও প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন—
সমুখে যা পাবো খেয়ে নেবো অবলীলাক্রমে;
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধর, পেয়ে যাই—
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিনতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে!
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী-
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।
(ভাত দে হারামজাদা)
রফিক আজাদ তার কবিতায় ব্যক্তিসত্তাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজসত্তাকেও। তিনি কখনোই এড়িয়ে যেতে চাননি, যে সৌন্দর্যকে তিনি দেখেছেন উপলব্ধি করেছেন, যে কদর্যতাকে তিনি দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাকে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে, কল্পনার ভেতর দিয়ে, অনুভবের ভেতর দিয়ে মূর্ত করে তুলেছেন শব্দে। তার কবিতায় একদিকে যেমন ফুটে ওঠে সৌন্দর্যের সুষমা, তেমনিভাবে জীবনের আড়ালে থাকা দিকও উঠে আসে অবলীলায়। কোন ভাণ প্রথাবদ্ধ ও স্বেচ্ছাকৃত আড়ালে তিনি ডেকে রাখেননি নিজের অনুভূতি। তাই তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় তার নিজস্ব জগৎ। যে জগতের অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে পাঠকের সামনে খুলে যেতে থাকে স্বপ্ন ও বাস্তবের জগৎ। স্পষ্টভাষী রফিক আজাদের নিজস্ব ভাষার মধ্য দিয়ে—
চিত্রকর, দার্শনিক, ধ্যানী— তোমার অনুজ যারা,
তাদের কাছেও প্রিয় চাঁদহীন এই মধ্যরাত,
তারাও তোমার মতো কম্পবক্ষে খুব চুপিসারে
নিঃশব্দে একাকী ঢুকে পড়ে অজানা-অচেনা কোনো
অর্গলিত ভাবনার দ্বারে। তোমার মতোই তারা,
সুন্দরের সুরক্ষিত ঘরে, ধনাগারে— সিঁধ কাটে;
তারাও শিউরে ওঠে, আনন্দিত, কার্যোদ্ধার হ’লে।
উভয়ে ধিক্কারযোগ্য কর্মে রত, দুই সহোদর—
ঘৃণিত মানব-কুলে— জনসাধারণের অপ্রিয়।
নগরের নোংরা এলাকায় উভয়ের যাতায়াত
আছে; সর্বদা ‘জীবন’-নাম্মী এক বেশ্যার সহিত
দুই সহোদর করো কম্পমান মত্ত কাম-কেলি।
তোমরা দু’জন তবু কেউ কারু প্রতিযোগী নও,
আজীবন তোমাদের দু’জনের সমান সদ্ভাব।
(চোর)
কবিতার বিষয়, উপমা, রূপক জীবন থেকেই আহরণ করেন রফিক আজাদ। ফলে তার কবিতায় জীবনের অনিঃশেষ ফল্গ–ধারা তার নতুন নতুন সম্ভবনা নিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে উঠে আসে চিত্রগুণ, উপমা, রূপক অলঙ্কারের অসাধারণত্ব। সেখানে অভিজ্ঞতার অভিঘাতের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে কবির উপলব্দি। ষাটের দশকের কবিতায় যে নেতিবাচক প্রবণতা, জীবনকে যন্ত্রণাদগ্ধ অনুভূতির ভেতর দিয়ে যেতে দেখা, যাতে করে কবিতা হয়ে উঠেছিল অনেকাংশেই আÍজৈবনিক। সেই ধারার রফিক আজাদও লালন করেছেন, পুষ্ট করেছেন। তার কবিতাও হয়ে উঠেছে কবির আÍবিবৃতি। তবে তাতে রয়েছে মানুষের সম্পৃক্ততা। তিনি গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন কিন্তু বেড়ে ওঠা আর ফেলে আসা সময়কে অস্বীকার করে নয়। তাই নাগরিক রুচি যেমন তার কবিতায় উঠে এসেছে তেমনিভাবে ফেলে আসা সময়ের জন্য হাহাকারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের প্রতি অনুরক্ততা। আবার যে অবক্ষয়ী সমাজের ভেতর দিয়ে তাকে যাত্রা করতে হয়েছে যে অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে সময়কে দেখতে হয়েছে তাকেও নির্মোহ ভঙ্গিতে বিচারের ভার হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করেননি। বাস্তবতার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তিনি উপযুক্ত শব্দের মাধ্যমে কবিতাকে বিবর্তিত করেছেন।
আত্মহত্যার বিন্দুমাত্র প্রবণতা
নেই আমার মধ্যে — অতএব, নিজের জন্যেও নয়;কিন্তু এটা সত্যি যে, আমি একটি
কবর খুঁড়ছি
কার জন্যে? — আমি জানি না।
(আমি একটি কবর খুঁড়ছি)
চিরাচরিত ভাবনার গণ্ডি থেকে তিনি কবিতাকে বের করে এনেছেন। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প আর শব্দের ব্যবহারে অপরূপ হয়ে উঠেছে রফিক আজাদের কবিতা। কবিতায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর জাগতিক অনুভূতির সাবলীল বর্ণনাগুণে তার কবিতা হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। রফিক আজাদ কবিতা আত্মস্বরূপকে সন্ধান করেছেন। সমাজ ও সংসার তাকে পীড়িত করেছে। তিনি প্রেমিক, তবে প্রেমের অর্ঘ্য সাজাতে তিনি প্রচলের বাইরে এসে বহুকৌণিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছেন অন্তর্ময় অনুভূতিকে। তাই তার প্রেম শরীরী ভাষার বাইরে এসেও নিঃসঙ্কোচে প্রকাশিত হয়েছে, অবদমিত ভাব সে প্রেমে নেই। সে প্রেমে অবদমন। বরং তাতে আর্তি রয়েছে, আকুলতা রয়েছে, অধরা রূপের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে।
এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা ঝরার শব্দ শুনবো বলে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে
কোন বন্ধুর জন্যে কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপক্ষা করবো …
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি
হয়তো কেউ বলেছিলো, ‘অপেক্ষা ক’রো একসঙ্গে বেরুবো।’এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধুর ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, ‘বাড়ি থেকো ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।’…
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের জন্যে প্রতীক্ষমাণ,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আমার পায়ে শিকড় গজাবে …
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না …
(প্রতীক্ষা)
ষাটের দশকের কবিতায় নান্দনিক নিরীক্ষাধর্মীতা এবং জাতীয়তাবাদী সামাজিক কবিতার যে দুটি ধারা তৈরি হয়েছিল, এর মাঝে থেকেই রফিক আজাদ নিজেকে প্রকাশ করেছেন, নিজের স্বাতন্ত্রতা তুলে ধরেছেন। জীবনের সমগ্র প্রান্ত স্পর্শ করে রফিক আজাদ কবিতাকে চেতনাসমৃদ্ধ করে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাই কবিতা অতি সংবেদনশীল। কয়েক দশকের কাব্যচর্চার ভেতর দিয়ে যে আÍরূপান্তরের সন্ধান তিনি করেছেন তা শিল্পের শুদ্ধতায় যেমন সজীব তেমনিভাবে দ্যুতিময়। ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে সমাজ এবং মানুষের যে মেলবন্ধন রফিক আজাদ কবিতার মাধ্যমে খুঁজে ফিরেছেন, মানুষের নিগূঢ় ও নির্ভৃততম অনুভূতির যে স্বপ্নলোকের সন্ধান তিনি দিতে চেয়েছেন তা কখনোই বিবর্ণ হবার না। বাংলা কবিতার ধারাবাহিক ঐক্যচেতনার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে রফিক আজাদের কবিতা নতুন দ্যোতনাকেই উন্মোচিত করে। ফলে তিনি সমকালে যেমন তেমনি উত্তরকালেও সমান পঠিত থাকবেন বলেই বিশ্বাস।