আধুনিক কবির কাজ স্বসমাজ-রাষ্ট্রের পাশাপাশি নিজের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করা। সেই প্রতিচ্ছবিতে বহিরাঙ্গের চিত্র যেমন থাকবে, তেমনি অন্তর্গত চিত্রও ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই কাজে যিনি যতটা নৈপুণ্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন, তাঁর কবিতা ততই হৃদয়গ্রাহী হবে। আর এই নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখার জন্য কবিকে ঊর্ধ্বকাশের দিকে তাকাতে হয় না। তাকে শেকড়লগ্ন থাকতে হয়। শেকড়ের মাধ্যমেই তাকে স্বদেশ-স্বভূমি থেকে প্রাণসঞ্জিবনী গ্রহণ করতে হয়। আর শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে একদিকে হাওয়ার পরশ পেতে হয়, অন্যদিকে সূর্যের আলো গ্রহণ করতে হয়। যিনি এই গ্রহণে যতটা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেন, তিনি ততটাই কালের মানচিত্রে নিজের দীর্ঘস্থায়ী ছবি এঁকে যেতে পারেন। কবি রকিবুল হাসানের মাজিভাই (২০২৪) কাব্যে উল্লিখিত বক্তব্যের স্বাক্ষর পাওয়া যাবে।
বইটিতে রয়েছে মোট ৫৪টি কবিতা। এই বইয়ে নিরূপিত তিন ছন্দেরই প্রয়োগ করেছেন কবি। বিষয় হিসেবে এনেছেন মা, মাটি, দেশ, প্রকৃতি, শৈশব, কৈশোর, প্রেম, বিরহসহ মানবজীবনে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের নির্বাচিত কিছু অংশ। বিষয়, আঙ্গিক ও প্রকরণ বিচারে মাজিভাই কবিতাগ্রন্থে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
১. ছন্দের বহুমাত্রিক প্রয়োগ
২. বিষয়ের বিচিত্র প্রকাশ
৩. অলঙ্কার প্রয়োগে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
৪. ইতিহাসচেতনা
৫. দর্শনচেতনা
মাজিভাই কবিতাগ্রন্থে নিরূপিত তিন ছন্দ, অর্থাৎ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের পাশাপাশি গদ্যছন্দেরও ব্যবহার করা হয়েছে। নিরূপিত ছন্দে কখনো অন্ত্যমিল রক্ষা করেছেন, কখনো অন্ত্যমিল বর্জন করেছেন। কখনো সমপার্বিক চরণ গঠন করেছেন, কখনো বিসম-পার্বিক চরণ নির্মাণ করেছেন। বিষয় ও ছন্দের চাল অনুযায়ী কবিতার আঙ্গিক গঠন করা হয়েছে। আবার বিষয় নির্বাচনেও কবি বহুমাত্রিকতা দেখিয়েছেন। গ্রামের খেলার মাঠ থেকে শুরু, শহরের পিচঢালা পথ, গঞ্জের হাট থেকে নগরের বহুতল ভবন, পল্লীর আঙিনা থেকে শহরের নীল আলো ঝলমল পাঁচতারা হোটেল—সবই কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। বাদ যায়নি কুচুরি ফুল, আখের রস, শামুক, মাঠ, ভাঙা চেয়ার, মায়ের গায়ের গন্ধ মাখা খাট, আলপথ, নদী, শিশিরভেজা দুবলা ঘাস, প্রবঞ্চনা, চাতুর্য, বাঘা যতীন, বিপ্লবী বীর, মায়ের কবর, মেঘ, শরীরের ঘ্রাণ, একান্নবর্তী পরিবার, ঝরাপাতা, মক্কা-মদিনা, কাশি, বৃন্দাবন, ভণ্ডামি, পরোপকারিতা, কৃতঘ্নতা, সন্তানবাৎসল্য, শ্মশান ও মৃত্যুচিন্তা। এই ধারার উল্লেখযোগ্য একটি কবিতা ‘মাজিভাই’। কবিতাটি অক্ষরবৃত্তাশ্রয়ী গদ্যছন্দে রচিত।
কবিতাটি দ্বিস্বরিক। কথক স্বরের বিপরীত স্বরটি নীরব হলেও নীরুত্তর নয়। অব্যক্ত ভাষায় দ্বিতীয় স্বরটি অর্থাৎ ‘মাজিভাই’ই মূলত কথক স্বরটিকে আত্মজিজ্ঞাসাময় করে তোলে। শুরুতেই কথক স্বর দ্বিতীয় স্বরটির কাছে জানতে চায়, ‘মাজিভাই’ নামের সত্তাটি কেমন আছে। এরপর একে একে স্মৃতিরোমন্থনের ছলে শৈশব-কৈশোর-যৌবনকাল থেকে শুরু বার্ধক্য পর্যন্ত জীবনের একটি বিপুল অংশ তুলে ধরা হয়। এটি একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা হলেও এতে উপন্যাসের বীজ বুনে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভাবের দিক থেকে এই উপন্যাসোপম কবিতাটি হয়ে উঠেছে প্রথমত রকিবুল হাসানের আত্মজৈবনিক রচনা। দ্বিতীয়ত তাঁর জন্মস্থান, কুষ্টিয়া অঞ্চল ও ওই জনপদের সামষ্টিক সংস্কৃতি মন্থন করে তুলে আনা কৃষিসমাজভিত্তিক জীবনালেখ্য। ফলে কবিতার শব্দসমবায়ের ভেতর তিনি গুঁজে দিয়েছেন কুষ্টিয়া জনপদের লৌকিক ভাষাও। কবিতার শিরোনাম ‘মাজিভাই’ও ওই জনপদের জনভাষা থেকেই গৃহীত। ‘মাজিভাই’ শব্দযুগল কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক শব্দ, এর অর্থ মেজ ভাই। পুরো কবিতায় সংসারের ‘মেজভাইয়ের’ দায়িত্ব, কর্তব্য, ত্যাগ ও নিগৃহের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবিতাটির শুরু প্রশ্ন দিয়েই:
ক তো মাজিভাই, ক তো ক্যাম্বা-কোথায় আছিস
কতদিন কুনো কথা হয় না তেমন
পোটনিতে তোর সাথে রাতবিরাত কবিতা নিয়ে
কথাও হয় না আর—তখন যে চালশূন্য ভাতের হাঁড়িটা।
কবিতারা একদিন ক্যাম্বা জীবনের খরস্রোতা নদী
হয়ে বয়ে বয়ে যেতো নগর-বন্দর।১
মানবজীবনে স্বতঃসিদ্ধ স্বভাব এই যে, বয়স হলে তার স্মৃতিরোমন্থনের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। অর্থাৎ বয়স্ক মানুষের শেষ সম্বল অর্থ নয়, বিত্ত নয়, কীর্তিও তেমন নয়। দুরন্ত শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির সঙ্গে উদ্দাম যৌবনকালের উন্মত্ত দিনরাত্রির স্মৃতিই তার সঞ্চয়। তার প্রবীণ বয়সে বিগত দিনের স্মৃতির ভেতর সান্ত্বনা খোঁজে সে। এই কবিতার কথক স্বরও এর ব্যতিক্রম নয়। কথক স্বরটি মাজিভাইয়ের কাছে জানতে চাওয়ার ছলে নিজের অতীতচারণাই করে যায়। মাটিলগ্ন কবির স্বভাবই এই—তিনি নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সম্মিলনেই কবিতা রচনা করেন। তিনি জানেন,
মানুষ কল্পনায় সবসময়েই মৌলিক—প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র কল্পনাশক্তির অধিকারী। সৃজনশীতার অঞ্চলে এই তথ্য আরও বেশি সত্য—বিশেষত কবির কল্পনা। মানুষ নির্বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে—একজনের পাঠলব্ধ ধারণা ও জীবনাভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যজনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমন দুজন মানুষ পাওয়া যাবে—যাঁরা অবিকল একই স্বপ্ন দেখেন এবং একই ধরনের কল্পনার অধিকারী। কবিদের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো শতভাগ খাঁটি।২
সাধারণ মানুষ যেমন স্বতন্ত্র কল্পনার অধিকারী, কবিও তেমনি। কবিদের কল্পনা বরং আরও বেশি সূক্ষ্ম প্রভেদ সৃষ্টিকারী। কবি রকিবুল হাসানও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি ‘মাজিভাই’ কবিতায় কথক স্বর ও মাজিভাই স্বরের মধ্যে উত্তরহীন প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজিয়ে মানবজীবনের শৈশব থেকে প্রবীণকাল, জীবনাবসানের পরও তার প্রতি স্বজন ও সন্তানের মায়ার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।
সংসারের ভার যার কাঁধে, তার কাছে জগৎভাবনা আর দশ জন সাধারণ মানুষের সংসারচিন্তা এক নয়। তাই সংসারের ভারবহনকারী মানুষটিকে বাইরে থেকে পাথরের মতো স্থাণু, কঠিন ও আবেগবিবর্জিতই মনে হলেও ভেতরের দৃশ্য ভিন্ন। ভেতরটা তার নারকেলের শক্ত খোলসের ভেতর থাকা মিষ্টি টলটলে পানির মতো কোমল। মানবজীবনের এই রূঢ়-নিঃশব্দ রোদনভরা জীবনকে ‘মাজিভাই’ কবিতার শেষ দুই স্তবকে রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন এভাবে:
মাজিভাই কোনো কথা কয় না—কিছুই তো কয় না,
মাজিভাইয়ের চোখে কোনো আলো থাকে না—শুধুই আঁধার
মাজিভাইয়ের বুকে কোনো ব্যথা থাকে না—অবস সমুদ্র,
মৃত মানুষ এবং মাজি ভায়ের ভেতর কোনো পার্থক্য থাকে না।বাতাসে ব্যাকুল একতারা কেঁদে যায়
একতারা সুর এখন নিজেও মনে মরে ভেসে যায়
মাজিভাই ভেসে যায়
. ভেসে যায়
. ভেসে যায়
অথই নদীর বুকভাঙা জীবনঢেউয়ে কূল-কিনারা ঠিকানাহীন।
(মাজিভাই)৩
মানবজীবনের দুই চূড়ান্ত সত্যের একটি জন্ম, অন্যটি মৃত্যু। সংসারে যে ‘মাজিভাই’ সবার নির্ভরতার প্রতীক-আশ্রয় হয়ে ওঠেন, তাকেও একটি মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে যায়। জীবন-মৃত্যু মূলত জোয়ারভাটারই নামান্তর। তাই মাজিভাইয়ের কাছে কথক স্বর যতই প্রশ্ন করে, জবাব মেলে না। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং কথক স্বর জিজ্ঞাসার ছলে দিয়ে যায়। একজন মাজিভাইয়ের জীবনচরিত বর্ণনার চলে কথকস্বর মূলত সমগ্র মানবজীবনের জন্ম থেকে মৃত্যুপর্যন্ত ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার ইতিবৃত্তই বর্ণনা করে।
এই ইতিবৃত্ত সবিস্তারে বর্ণনার জন্য কবি বিশ শতকের শেষ সিকিভাগ ও একুশ শতকের প্রায় প্রথম সিকিভাগকে বেছে নিয়েছেন। আর স্থান হিসেবে কুষ্টিয়ার কয়াগ্রাম অর্থাৎ নিজের জন্মগ্রামকে বেছে নিয়েছেন। এই কয়াগ্রাম নাম মাত্র, প্রকৃতপক্ষে তিনি সমগ্র বাংলাকেই জন্মস্থান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই সময় ও স্থানের সঙ্গে মিল রেখে উভয়ের গ্রহণযোগ্য ভাষা থেকে লোকজ শব্দও নিয়েছেন। আর তিন অনুষঙ্গে সমন্বয়ে তৈরি করেছেন কিছু কিছু সংকেত। যা ভাষায় বর্ণনা না করলেও বোধের দরজায় ঠিকই কড়া নাড়ে। কবি জানেন,
কবিরও নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড ও নিজস্ব ভাষাসংকেত রয়েছে। অবশ্যই কিছু ব্যতিক্রম বাদে। পরাধীন ভূমিতে জন্ম নেওয়া কবির নিজস্ব ভূ-খণ্ড নাও থাকতে পারে। নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের পাশাপাশি কবিকে হতে হয় কালসচেতনও। তার স্থান-ভাষা-সংকেতের সঙ্গে সঙ্গে কালিকচেতনা কবিতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা করে। স্থান, কাল, ভাষা ও সংকেত—এই চারের সুসমন্বয়ে কোনো এক ব্যক্তির রচনা হয়েও কবিতা পরিণত হতে পারে সর্বজনীন সম্পদে।৪
স্থান-কালের কথা আগেই বলা হয়েছে। এবার ভাষা-সংকেতের কয়েকটি নমুনা দেওয়া যাক:
ক. আহা! যেন লাউডগা অষ্টাদশী কোনো রূপবতী!
খ.সদরপুরের বিলে কতদিন যে সাপ গলায় জড়িয়েছি
গ. হাঁটিস পথের পরে পথ—নিজের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে
ঘ. নদীর বিশল পাড় ভাঙার বিকট শব্দে তোর বুকে বাজে!
‘মাজিভাই’ শীর্ষক নাতিদীর্ঘ কবিতাটি এই কাব্যের নাম কবিতা, পরন্তু কবির আত্মজৈবনিক রচনাও। এই কবিতায় নিজের জীবনকে যেমন চিত্রিত করেছেন, তেমনি তার স্বগ্রাম, স্বসমাজ ও স্বজনদেরও চিত্র অঙ্কন করেছেন।
ছন্দ ও বিষয়ে বহুমাত্রিকতার দিক থেকে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি কবিতা হলো—‘এই ছবি যতবার দেখি’, ‘কবি ও নেতা’, ‘পলান পাগলের কথা’, ‘নদীর গল্প’, ‘বেদনার নীল মেঘ’, ‘তোমার কণ্ঠে’, ‘শৈশবনামা’ ও ‘প্রিয় সন্তান, তোমাকে বলছি’। এসব কবিতায় ব্যক্তির একাকিত্ব, ক্ষোভ, হতাশা, অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার, বঞ্চনা, সন্তানবাৎসল্য, সামাজিক অবক্ষয়, প্রকৃতি, প্রেম, নৈতিক স্খলন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একইসঙ্গে এসব কবিতায় জড়বাদী ও যুক্তিবাদী চেতনার সঙ্গে সঙ্গে ভাববাদেরও সম্মিলন ঘটিয়েছেন কবি। যদিও কবি জানেন তাঁর উপস্থিতকালে ভাববাদের আর স্থান নেই। সেই স্থান অনেক আগেই জড়বাদী ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞান দখল করে নিয়েছে। তবু কবিহৃদয় কিছুটা জড়বাদী কিছুটা ভাববাদী চেতনার সমন্বয়ে সংশয়বাদী হয়ে ওঠে। কবি-শিল্পীর শিল্পচর্চার অন্যতম অনুষঙ্গও সংশয়, সন্দেহ ও প্রশ্ন। কারণ,
উনবিংশ শতাব্দীতে জড়বাদী ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞান ধর্মের স্থান অধিকার করেছিল এবং মানুষের সমাজ ও তার মূল্যবোধকে একটি ঐক্যসূত্রে ধ’রে রেখেছিল। কিন্তু এই শতকের অন্তিমে ও বিংশ শতকের প্রথম দশকে কতকগুলি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের মানসজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটালো।৫
রকিবুল হাসান হাসানের জন্ম ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়াগ্রামে। অর্থাৎ তাঁর জন্ম বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, পরাধীন বাংলাদেশে। শৈশব কেটেছে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের করালগ্রাসে। কৈশোরে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনকাল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মকে পুঁজি করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সেই বিভক্ত রাষ্ট্রের মধ্যে পাকিস্তানেরই একটি প্রদেশের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। কিন্তু রাষ্ট্রগঠনের যে মৌলিক ভিত্তি ধর্ম হতে পারে না, বরং একক ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐক্য ও ভূ-প্রকৃতির নৈকট্যই রাষ্ট্রগঠনের প্রধান উপাদান হওয়া উচিত। যেহেতু ভুল বিষয়কে ভিত্তি করে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, সেহেতু কিছু দিন পরই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে পতাকা তুলে ধরতে হয়েছিল। এরপরই নতুন রাষ্ট্রের পুনর্গঠনকালে রকিবুল হাসানের কৈশোরের মানসগঠন সম্পন্ন হয়েছিল। কৈশোরের স্মৃতি পরিণত বয়সেও তাঁর মানসপটে দেদীপ্যমান হয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
মাজিভাই কাব্যের কবিতাগুলো নিছক কল্পনার প্রকাশ নয়। জীবনাভিজ্ঞতা-প্রজ্ঞারই প্রকাশ। এর মূলে রয়েছে তাঁর ইতিহাসচেতনা ও দর্শনচিন্তা। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
১.
এই ছবি যতবার দেশি তত দেখি মেঘে মেঘে
উড়ে উড়ে ভেসে আসে গৌরিকা তরুণীগভীর চোখের কুচকুচে কালো মণি
ভ্রƒতে হাতে কবিতার রেখা
যেন ঢেউবতী নদী দূরে বয়ে যায়
পরান গাঁয়ের গান হয়ে।
(এই ছবি যতবার দেখি)৬২.
মাঠফাটা রোদ্দুরের মতো ঠা-ঠা মতো
গ্রামের ইজ্জত গেলো—গেলো গেলো মান!
এ গ্রাম তো পাগলের গ্রাম!
(পলান পাগলের কথা)৭৩.
বিরান জমিনে ফলেনি ফসল কত দিন কেটে গেলো
স্বপ্ন দেখতে ভয় পাওয়া চাষি ছুটে যায় এলোমেলো
শ্মশানের মতো পড়ে আছে মাঠে চৌচির পিপাসায়
এখানে এখন তৃষ্ণাকাতর পাখিরাই কাতরায়।
(নদীর গল্প)৮৪.
যার কম্পিত বুকে মুখ ঢেকে রেখে
দূরের দোয়েল ভেজা ডানা ঝাপটায়
সেও ভালোবেসে রমণী তোমাকে খোঁজে
শরীরের ঘ্রাণে খোঁজে ভোরে সন্ধ্যায়।
(তোমার কণ্ঠ)৯
উল্লিখিত চারটি উদাহরণের ‘এই ছবি যতবার দেখি’ কবিতায় প্রকৃতির সঙ্গে তরুণীর তুলনা করা হয়েছে। সেই তরুণীর চোখের কুচকুচে কালো মণি আর তার ভ্রূতে কবি দেখেছেন কবিতার রেখা। কবিকল্পনার সঙ্গে রকিবুল হাসান এখানে পল্লী অঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সেতুবন্ধ রচনা করেছেন। ‘পলান পাগলের কথা’য় সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে চাতুর্য-ধূর্তামি দিয়ে একে অন্যকে ঠকানোর চেষ্টা করে প্রশংসার পরিবর্তে স্তুতি করে, সমালোচনার পরিবর্তে নিন্দা করে, সেখানে প্রতীকী চরিত্র ‘পলান পাগল’কেই ক্ষেপে উঠতে হয়। অর্থাৎ যে অপ্রকৃতিস্থ সেও বুঝতে পারে সমাজে পচন ধরেছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় নেমেছে। আপাত চোখে যে পাগল, সেই পলান মূলত সমাজেরই বিবেক, সেই তার জনপদকে ধূর্তদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সবাইকে সতর্ক করে।
‘নদীর গল্প’ কবিতায় প্রকৃতির প্রতি মানুষের নির্দয় আচরণ চিত্রায়ণ করা হয়েছে। মানুষ যখন নির্দয়-নিষ্ঠুর ও দয়াহীন-মায়াহীন হয়ে ওঠে—তখন চরাচরের সর্বত্রই তার প্রতিচ্ছায়া পড়ে। চারিদিকে হাহাকার ধ্বনিত হয়। আর চাষি অর্থাৎ স্বপ্নবান-সৃষ্টিশীল মানুষের মনে হয় তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্র—‘শ্মশানের মতো পড়ে আছে মাঠে চৌচির পিপাসায়’। ‘তোমার কণ্ঠে’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্তে রচিত। কবিতাটি আপাত প্রেমের মনে হলেও এখানে প্রচলিত প্রেম মুখ্য নয়। নর-নারীর প্রেমের আড়ালে মূলত মানবতার কথাই বর্ণিত হয়েছে এই কবিতায়। এখানে রমণীকে কেবলই রক্তেমাংসের প্রেমিকা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। তাকে অসহায় আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় হিসেবেই কল্পনা করা হয়েছে।
রবিকুল হাসান তাঁর নিজের পূর্ববর্তী সব কাব্যের বিষয় ও প্রকরণ অতিক্রম করে মাজিভাই কাব্যে নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করেছেন। তবে, এই কাব্যে বিষয়ের চেয়ে প্রকরণগত দিক; বিশেষত ছন্দে তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বদলে দিয়েছেন। সম্ভবত দীর্ঘ কাব্যযাত্রার একপর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, ছন্দেই কবিতার মুক্তি। তাই তিনি এই কাব্যের প্রতিটি কবিতার ছন্দের যথাযথ প্রয়োগের ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন। তিনি হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছেন—ছন্দহীন রচনা কাব্যিক হতে পারে, কাব্যঘেঁষা ছোটছোট কয়েকটি বাক্যের সমষ্টিকে গদ্যাংশ পর্যন্ত বলা যেতে পারে। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই কবিতা বলা যায় না। কারণ:
ব্যক্তি যখন স্বল্পতম শব্দব্যয়ে কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলনে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে যায়, তখনই তাকে ছন্দের আশ্রয় নিতে হয়। কারণ তার বলার কথাটি সাধারণ গদ্যের বাক্যে বললে লোকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে না। চোখে দেখা, কানে শোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। আর যদি কথাগুলো ছন্দবদ্ধ করে প্রকাশ করা হয়, তাহলে তার মধ্যে এক ধরনের তাল-লয় সৃষ্টি হয়, যা ভিন্ন রকমের ব্যঞ্জনা দেয়। সাধারণ কথাবার্তার ভিড়ে ব্যতিক্রমী কথাগুলো সহজেই শ্রোতা হৃদয়াঙ্গম করতে পারে। এছাড়া ছন্দবদ্ধ বাক্যাবলির যে গতি-বেগ, তা গদ্যের বাক্যের স্বাভাবিক গতির চেয়ে বেশি শ্রুতিমধুর। এ কারণে গদ্যের ত্রিশ শব্দ সংবলিত তিন-চারটি বাক্য লোকে সহজেই মনে রাখতে না পারলেও চল্লিশ-পঞ্চাশ শব্দের ছন্দবদ্ধ চার-পঙ্ক্তি অনায়াসে মনে রাখতে পারে।১০
ফলে কবি রকিবুল হাসান তাঁর পূর্ববর্তী আট কাব্য অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে, এক ধরনের অহংকার, দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত, দেবতীদেউল, রহস্যস্বাক্ষর, ব্যর্থ ভয়ংকর দৌড়ের কাছে, বুলবুলবেদনাকাব্য ও জলের গোপন গল্প-এর কবিতাগুলোর সঙ্গে বর্তমান কাব্য মাজিভাই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য পূর্ববর্তী কাব্যগুলোর বিষয়বস্তুতে যেমন, তেমনি আঙ্গিক-প্রকরণেও। পূর্ববর্তী আটটি গ্রন্থে কবি কেবল শব্দে-বাক্যে-অলঙ্কারে মনের ভাব প্রকাশ করে গেছেন। যে মনের ভাব রীতিসিদ্ধ হয়ে উঠেছে কি না, সেদিকে তাঁর লক্ষ ছিল না। কিন্তু মাজিভাই কাব্যে এসে রকিবুল হাসান যেন নিজেকে আমূল বদলে নিলেন। পাল্টে ফেললেন সমূহ খোলনলচে। আভির্ভূত হলেন সম্পূর্ণ নতুন রূপে। পূর্ববর্তী কাব্যগুলোর মধ্যে থেকে তিন কাব্য—অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে, এক ধরনের অহংকার ও দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত থেকে তিনটি কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করে মাজিভাই কাব্যের তিনটি কবিতার তিনটি স্তবক উপস্থাপন করে এই পার্থক্য পরিষ্কার করা যাক।
১.
আমার জননী কাঁদছে—আটাশ কোটি পায়ের শব্দ কাঁদছে
আজন্ম সবুজ চেতনায় উজ্জীবিত সেইসব শাণিত মানুষেরা কোথায়
সমুদ্র গভীরের মতো বোধের পাখিদের সাহসী কণ্ঠ কোথায়
শ্মশান আগুনে পুড়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছি এখনো গভীর প্রতীক্ষায়
(অদ্ভুত আঁধা, অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে)১১২.
কার যেন পাঁজর ভাঙা কান্নায় ভার হয়ে আসে রাতের আকাশ
কোনো এক পাখি যেন ঘুমোতে পারছে না কিছুতেই সারা রাত
কোনো এক পথিক যেন বারবার পথ ভুলে যাচ্ছে এদিকে সেদিকে
কার যেন পাঁজর ভাঙা কান্নায় ভার হয়ে আসে রাতের আকাশ।
(রাতের রান্না, এক ধরনের অহংকার) ১২৩.
কী ভয়ানকভাবে সব আনন্দ ফ্যাকাশে করে
কীভাবে যে উড়ে গেলে কলজে পাখিটি
ভাঙা চাঁদ আরো ভাঙে— ভেঙে ভেঙে
রক্তাক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটায়
স্য্যাঁতসেঁতে মাটির উঠোনে
ভেঙে যায় খুশবু পাঁজর
(ভাঙা চাঁদ, দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত)১৩
উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলো কাব্যঘেঁষা, কিন্তু পুরোপুরি কবিতা হয়ে উঠেছে এ কথা সমালোচক কিংবা শাস্ত্রবিদরা বলতে পারবেন না। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে— কবি কেন দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন? এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো রকিবুল হাসানের কবিতা চর্চাকাল মূলত ১৯৯০ সালের পর, স্বৈরশাসকের পতন শেষে। গণতান্ত্রিক আবহের কালে। এই গণতান্ত্রিক আবহের কালে সাধারণ নাগেিকর মতো কবিরাও সবকিছুতে স্বাধীনতা ভোগ করতে চেয়েছিলেন। সেই স্বাধীনতার নামে সমস্ত নিয়ম-কানুন ছিন্ন করারও দুর্মর সাহস তাঁরা দেখাতে চেয়েছেন। তাঁদের সেই সাহসের প্রমাণ রেখেছেন ছন্দের প্রতি নিষ্ফল আক্রোশ দেখিয়ে, ছন্দকে কবিতা থেকে বর্জন করে। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন, ছন্দহীন রচনা কবিতা হতে পারে না। একথা শাস্ত্রবিদ থেকে শুরু করে কবিরাও বলে গেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত খুব দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘আমার বিবেচনায় কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য, এবং মূল্য নির্ণয় যেহেতু মহাকালের ইচ্ছাধীন আর অর্থগৌরবের আবিষ্কর্তা অনাগত সমধর্মী, তাই সমসাময়িক কাব্যজিজ্ঞাসার নির্বিকল্প মানদণ্ড ছন্দোবিচার।’১৪
বিষয়টি অনেক দেরিতে হলেও রকিবুল হাসান উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই নিজেকে নতুন করে তৈরি করেছেন তিনি। মনোযোগ দিয়েছেন ছন্দে। রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা। ফলে মাজিভাই এই একটি মাত্র কাব্য তাঁর পূর্ববর্তী আটটি কাব্যের অপূর্ণতাকে পুষিয়ে দিয়েছে ছন্দে, অলঙ্কারে, বিষয়ে ও আঙ্গিকে। কেননা পূর্ববর্তী আটটি কাব্য তাঁর কৈশোর-উত্তীর্ণ প্রথম থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই যুগের মধ্যে রচিত। কিন্তু সেই দুই যুগে ছন্দ বর্জনের একধরনের প্রতিযোগিতা ছিল কবিযশপ্রার্থীদের মধ্যে। অবশ্যই এখনো সেই ধারা বহমান। যারা কবিতার চারিত্র্য ও ছন্দের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন সময় মতো, তারা দ্রুত ছন্দে দীক্ষা নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ছন্দকে নিজেরে বশে নিয়ে এসেছেন। রকিবুল হাসানও তাঁদেরই একজন। তিনিও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন ছন্দে রচিত কবিতায় যেমন দ্বিরুক্তি-পুনরুক্তি-অতিকথন পরিহার করা যায়, তেমনি সংহত-সংযত ভাবও রক্ষা করা চলে। ছন্দহীন রচনার মতো বল্গাহীন প্রগলভতায় ভেসে যাওয়া যায় না। মাজিভাই কাব্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে পূর্ববর্তী কাব্যগুলোর সঙ্গে নতুন কাব্যের মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট করা যাক।
ক.
অনেক দিন গিয়েছে তবু দেখো এখনো শিশিরে
ভিজে আছে দুঠোঁট তোমার।
অরণ্যে এখনো বুনো তৃষ্ণায় কাতর
হরিণ-হরিণী। তোমার গ্রীবায় জাগে
ঠোঁটেরা—সেখানে হেসে ওঠে মধুমুগ্ধ তৃপ্ততায়।
(রাত্রির নহর)১৫খ.
বাঘা যতীনের দাপিয়ে বেড়ানো নদীটা এখন নেই
নেই স্রোতে ভাসা পানসি নৌকা, সাম্পান সারি নেই
যৌবনে ঢেউ তোলা সেই স্রোত সেই সুর বাঁশি নেই
বিবর্ণ দিন রাত পড়ে আছে আঁধারে হারিয়ে খেই—
(নদীর গল্প)১৬গ.
এখন কোনো অপমানেই হয় না খারাপ মন
বাকের হাজার প্রত্যাখ্যানও তোলে না কম্পন
তাঁতের শাড়ি মাটিরঙা আঁচলপাতা নারী
হৃদয় ভাঙার শব্দ তুলে দিক না যতই আড়ি…
আমার তাতে যায় না কিছুই, আমার পাথর মন।
(পিকাসো আমার দুঃখ আঁকে)১৭ঘ.
জীবন কি আর নামতা বলো? মিলবে হিসাব গণ্ডা-কড়ায়
আপন রক্তও পর হয়ে যায় স্বার্থ যদি পূরণ না হয়
মাটি সে তো মাটির মতোই বুক পেতে দেয় সন্তানেরে
মানুষ কেবল স্বার্থ খোঁজে, তাই তো করি মানুষরে ভয়!
(নামতা)১৮ঙ.
প্রিয় সন্তান আমার, তোমাকে বলছি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন
মুক্তিযুদ্ধ তোমার নিশ্বাসে
তোমার রক্তধারায়: শহীদের আত্মদান বোনের সম্ভ্রম
সেই সব ইতিহাস আর্তনাদ—ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
হিসাবের খাতায় তোমার নাম—
যা ইচ্ছে তা করতে পারো না প্রিয়তম সন্তান আমার।
(প্রিয় সন্তান, তোমাকে বলছি)১৯
উল্লিখিত পাঁচটি উদাহরণের প্রথম কবিতা ‘রাত্রির নহর’, এটি অক্ষরবৃত্তাশ্রয়ী গদ্যছন্দে রচিত। চরণগুলো বিসম পর্বে গঠিন। চরণস্থিত পর্বগুলো যেমন বিসম, তেমনি পর্ববিন্যাসেও চিরায়ত নিয়ম রক্ষা করা হয়নি। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তের নিয়ম অনুযায়ী চরণের শুরুতে আট মাত্রার দীর্ঘ পর্ব, এরপর ছয় মাত্রার মাঝারি পর্ব এবং শেষে চার মাত্রার হ্রস্ব পর্ব থাকার কথা। কিন্তু রকিবুল হাসান এই কবিতায় এই নিয়ম রক্ষা করেননি। তিনি স্বাধীনতা ভোগ করেছেন পর্ববিন্যাসে। তাই কখনো দুই পর্বের চরণের শুরুতে চার মাত্রার হ্রস্ব পর্ব আগে রেখেছেন, পরে দিয়েছেন ছয় মাত্রার মাঝারি পর্ব। আবার কখনো দুই পর্বের চরণে ছয়মাত্রার মাঝারি পর্ব শুরুতে রেখেছেন, শেষে দিয়েছেন আট মাত্রার দীর্ঘ পর্ব। এভাবে তিন ও চার পর্বের চরণেও পর্ববিন্যাসে দীর্ঘ, মাঝারি ও হ্রস্ব পর্বের চিরায়ত নিয়ম রক্ষা করেননি। তাতে চরণের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়নি, বরং কালগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয়েছে। বিষয় হিসেবে প্রকৃতি, প্রেম, আত্ম-উদ্বোধন প্রাধান্য পেয়েছে।
দ্বিতীয় উদাহরণ ‘নদীর গল্প’ থেকে নেওয়া। এটি ষাণ্মাত্রিক সমীল মাত্রাবৃত্তে রচিত। এখানে ইতিহাস, প্রকৃতি ও মানুষের জীবনালেখ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তৃতীয় উদাহরণ ‘পিকাসো আমার দুঃখ আঁকে’ কবিতা থেকে নেওয়া। এটি সমীল স্বরবৃত্তে রচিত। এ কবিতায় জীবনসংগ্রামে টিকে থাকা একজন মানুষের মানসপ্রকৃতির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। চতুর্থ উদাহরণ ‘নামতা’ কবিতা থেকে নেওয়া। এই কবিতাও স্বরবৃত্তে রচিত। অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে এই কবিতায় ক-ক-খ-ক চাল বজায় রাখা হয়েছে। বিষয় হিসেবে এসেছে জীবন সম্পর্কে কবির দার্শনিক চিন্তা ও আত্মজিজ্ঞাসা। পঞ্চম উদাহরণ ‘প্রিয় সন্তান, তোমাকে বলছি’ কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি অক্ষরবৃত্তাশ্রয়ী গদ্যছন্দে রচিত। এই কবিতায় বাৎসল্যপ্রেম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ও ইতিহাসচেতনার যুগল সম্মিলন।
অলঙ্কার প্রয়োগে রকিবুল হাসান দৃশ্যগ্রাহ্য-স্পর্শ-শ্রবণ ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে মাজিভাই কাব্যের কবিতাগুলো পাঠকালে বর্ণিত দৃশ্য পাঠকের মানসপটে ভেসে ওঠে।
ক.
পুকুরের পচা পানি—কী সুন্দর ফুল
কবিতার শরীরের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে
যেতো রাতের জোস্নায়
আহা! যেন লাউডগা অষ্টাদশী কোনো রূপবতী।
(মাজিভাই)খ.
বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে নেতা বললেন—
‘কবিরা বড় ঝামেলা! এদের যে কারা ডেকে আনে!’
(কবি ও নেতা)গ.
একদিন এই খানে ছিল তার ঘামের মৌতাত
(লোকটি একদিন তার বাড়িতে)ঘ.
অহঙ্কারে নবাবের মতো হেঁটে যাচ্ছ
( গোলাপের মৃত্যু)ঙ.
আলো নিভে গেলে সব এক
নারী কিংবা কবরপৃথিবীটা একটা জলসাঘর।
(জলসাঘর)
উল্লিখিত উদাহরণের প্রথমটির ‘পুকুরের পচা পানি—কী সুন্দর ফুল/ কবিতার শরীরের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে/ যেতো রাতের জোস্নায়’ উপমা। পরবর্তী চরণ ‘আহা! যেন লাউডগা অষ্টাদশী কোনো রূপবতী’তে উৎপেক্ষার সৃষ্টি। আবার পুরোটা মিলে একটি দৃশ্যগ্রাহ্য চিত্রকল্প। দ্বিতীয় উদাহরণে ‘বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে নেতা বললেন’ উপমা এবং ‘কবিরা বড় ঝামেলা! এদের যে কারা ডেকে আনে!’ অংশে শ্লেষোক্তির প্রকাশ ঘটেছে। তৃতীয় উদাহরণে ‘একদিন এই খানে তার ঘামের মৌতাত’ ছিল চরণে ঘ্রাণেন্দ্রিয় চিত্রকল্পের সৃষ্টি হয়েছে। চতুর্থ উদাহরণে ‘অহঙ্কারে নবাবের মতো হেঁটে যাচ্ছ’ চরণে উপমা এবং পঞ্চম উদাহরণে ‘নারী কিংবা কবর’ শব্দপুঞ্জে উৎপ্রেক্ষা এবং ‘পৃথিবীটা একটা জলসাঘর’ চরণে অনুভবভেদ্য চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে।
রকিবুল হাসানের ‘মাজিভাই’ তাঁর পরিণত বয়সের সৃষ্টি। হয়তো এ কারণে বিষয় নির্বাচনের পাশাপাশি শব্দ নির্বাচন-প্রয়োগ, আঙ্গিকের সঙ্গে ছন্দ নির্বাচন-প্রয়োগে তিনি সতর্ক-সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। এই কাব্যের প্রেমের কবিতা-বিরহের কবিতাগুলো ভাষা যেমন নরম, তেমনি দ্রোহ, আত্মশ্লাঘা, ক্রোধ প্রকাশের কবিতাগুলোর ভাষাও জোয়ারের জল সরে যাওয়ার পর প্রথম দৃশ্যমান পলিমাটির মতোই কোমল।
তথ্যসূত্র
১. রকিবুল হাসান, মাজিভাই, গ্রাফোসম্যান পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০২৪, পৃ. ৯
২. মোহাম্মদ নূরুল হক, কবিতার সময় ও মনীষার দান, বাংলানামা, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০২১, পৃ.১৫-১৬
৩. রকিবুল হাসান, মাজিভাই, গ্রাফোসম্যান পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০২৪, পৃ. ১০
৪. মোহাম্মদ নূরুল হক, বাক্-স্বাধীনতার সীমারেখা, প্রতিকথা, ঢাকা, ২০২৪, পৃ. ৩৭
৫. দীপ্তি ত্রিপাঠী, আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৭, পৃ. ২১)
৬. রকিবুল হাসান, মাজিভাই, গ্রাফোসম্যান পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০২৪, পৃ. ১৩
৭. তদেব, পৃ. ১৮
৮. তদেব, পৃ. ১৯
৯. তদেব, পৃ. ৩১
১০. মোহাম্মদ নূরুল হক, আধুনিক বাংলা কবিতা: ছন্দের অনুষঙ্গে, বাংলানামা, ঢাকা, ২০২৪, পৃ. ১৩
১১. রকিবুল হাসান, কবিতাসংগ্রহ, শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ১৭
১২. তদেব, পৃ. ৫৬
১৩. তদেব, পৃ ৬৯
১৪. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, (আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত), বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৮২
১৫. রকিবুল হাসান, মাজিভাই, গ্রাফোসম্যান পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০২৪, পৃ. ১২
১৬. তদেব, পৃ. ১৯
১৭. তদেব, পৃ. ২৫
১৮. তদেব, পৃ. ৩৪
১৯. তদেব, পৃ. ৬২