গবেষণা ও প্রবন্ধ সাহিত্যের বিষয় যেমন বিচিত্র হতে পারে, তেমনি বিশ্লেষণ ও ভাষাশৈলী বহুমুখী হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। গবেষণা-প্রবন্ধ সাহিত্যের বিষয় বহুমুখী হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গুণগত মান বাড়লেও সাধারণত গল্প-উপন্যাস-কবিতার মতো এই শাখার পরিমাণ বাড়ে না। এর কারণও সুস্পষ্ট। যে কল্পনাশক্তি, মননশীলতায় গল্প-উপন্যাস-কবিতা সৃষ্টি সম্ভব, তা সবসময় গবেষণাকর্ম কিংবা প্রবন্ধ রচনার জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে। গল্প-উপন্যাস-কবিতার স্রষ্টার জন্য মৌলিক কল্পনাশক্তি ও মননশীলতাই যথেষ্ট। এজন্য তাঁকে প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা না করলেও চলে। কিন্তু গবেষক ও প্রাবন্ধিকের যতই কল্পনার প্রাখর্য, চিন্তার গভীরতা ও বিশ্লেষণের দক্ষতা থাকুক, পঠন-পাঠন ব্যতিত তাঁর পক্ষে গবেষণাকর্ম কিংবা প্রবন্ধ রচনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এছাড়া কবি-কথাশিল্পী সমাজে যে পরিমাণ ভালোবাসা-মূল্যায়ন পান, সে পরিমাণে গবেষক-প্রাবন্ধিককে লোকে চেনে না। এ কারণেই প্রতিটি ভাষার সাহিত্যেই গল্প-উপন্যাস-কবিতার তুলনায় গবেষণাকর্ম ও প্রবন্ধের সংখ্যা বেশি নয়। তাই প্রতিটি ভাষায় কবি-কথাশিল্পীর চেয়ে প্রাবন্ধিক-গবেষকের সংখ্যা কম। এই সংখ্যালঘুদেরই একজন রকিবুল হাসান (১৯৬৮)। যদিও তিনি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাসও রচনা করেছেন। তবে এই নিবন্ধের বিষয় তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য।
রকিবুল হাসানের প্রবন্ধ মূলত দুই ধরনের। প্রথমত, গবেষণাধর্মী, দ্বিতীয়ত বিশ্লেষণধর্মী। তাঁর গবেষণাপত্র ও প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হলো যথাক্রমে: পথের কথা (২০০৪), কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন (২০০৮), বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন (২০১১), গড়াই নদীর পাড় (২০১২), পথে যেতে যেতে (২০১২), আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি (২০১৩), সাহিত্যের নন্দনচর্যা (২০১৫), পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ (২০১৫), ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ও ফোকলোর (২০১৬), বিপ্লবী বাঘা যতীন (২০১৬), কঠিনেরে ভালোবাসিলাম (২০১৭), প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির (২০১৯), বিপ্লবী বাঘা যতীন (২০১৯), রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন (২০২০), বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়ক (২০২৪), একব্যাগ আনন্দ বেদনা (২০২৪) ও প্রবন্ধসমগ্র (২০২৪)। তাঁর গবেষণাপত্র ও প্রবন্ধে মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এগুলো হলো:
১। সংস্কৃতি
২। সাহিত্য
৩। রাজনীতি
রকিবুল হাসানের গবেষণা-প্রবন্ধের প্রধান বিষয় সাহিত্য। আবার সাহিত্যবিষয়ক গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধের প্রধান বিষয় কথাসাহিত্য, বিশেষত উপন্যাস। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন; আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি; পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ ও প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির।
প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির প্রবন্ধ গ্রন্থে রকিবুল হাসান আলোচনা করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন ও ওমর আলী প্রমুখের সাহিত্যকর্ম নিয়ে। এই গ্রন্থে তাঁর কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘মধুসূদন-নজরুল: বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়প্রতিভা’, ‘বনলতা সেন: কবিতা ও কবিতার নারী’, ‘জসীম উদ্দীনের কাহিনিকাব্য: চারিত্র্যসন্ধান’ ও ‘ওমর আলীর কবিতা: ঐতিহ্যের প্রলুব্ধতা ও আধুনিকতার সম্বিৎ’। এসব প্রবন্ধে তিনি কবিতার বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। এর কারণ এই যে, তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করলেও রুচি ও মননে মূলত কথাশিল্পী। ওমর আলী ছাড়া আর কোনো কবির সামগ্রিক কাব্যপ্রচেষ্টা নিয়ে কোনো প্রবন্ধ রচনা করেননি। জীবনানন্দ দাশের বহুলচর্চিত ‘বনলতা সেন’ কবিতায় নারী এবং জসীম উদ্দীনের কাহিনিকাব্যগুলোর চারিত্র্য বিচার করেছেন। ‘জসীম উদ্দীনের কাহিনিকাব্য: চারিত্র্যসন্ধান’ প্রবন্ধে মূলত জসীম উদ্দীনের নক্সীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট কাহিনিকাব্য দুটি বিষয়বস্তু নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা রয়েছে। এছাড়া ‘বনলতা সেন: কবিতা ও কবিতার নারী’ প্রবন্ধে কবিকল্পনার বনলতা সেনের বাস্তবে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত না হয়ে এটুকু বলেছেন, ‘বনলতা সেন চির মানবীর রহস্যে ঘেরা, রহস্যময়ী।’১
প্রবন্ধের বিষয় কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি রকিবুল হাসান। সংখ্যায় অত্যল্প হলেও সংস্কৃতি ও রাজনীতিও তাঁর প্রবন্ধের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি বিশেষত লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে গিয়েও রকিবুল হাসান মূলত সাহিত্যকেই তাঁর গবেষণাক্ষেত্র হিসিবে বেছে নিয়েছেন। লোকসংস্কৃতির অনুসন্ধান করার জন্য নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)-এর পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)-এর তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)-এর হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), হুমায়ুন কবীর (১৯০৬-১৯৬৯)-এর নদী ও নারী, সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮)-এর গঙ্গা (১৯৫৫), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩)-এর পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০১০)-এর কর্ণফুলী (১৯৬২), শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)-এর সারেং বৌ (১৯৬২) প্রভৃতি। এসব উপন্যাস বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন,
আকর্ষণ-বিপ্রকর্ষণে নদী প্রতিটি মানুষের জীবন-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানুষের জীবন-যাপন, সভ্যতা, ইতিহাস, আন্দোলন-সংগ্রামÑসবকিছুতেই নদী দৃঢ়তর ভূমিকা পালন করে। মানুষের জীবনে নদী কখনো বন্ধু, কখনো ভয়ংকর প্রতিপক্ষ ও ধ্বংসকারীÑএই সংঘসূত্র গ্রোথিত। নদীকে এড়িয়ে মানুষের জীবন গড়া ও সভ্যতার ঐশ্বর্য নির্মাণ অকল্পনীয়। নদীভিত্তিক আঞ্চলিক বিভিন্ন উপন্যাসে এ সত্য নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। (নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের লোকসংস্কৃতি)।২
উল্লিখিত উপন্যাসগুলোয় বিষয় ও কাহিনি মন্থন শেষে রকিবুল হাসান লোকসংস্কৃতির প্রয়োগকৌশল উন্মোচন করেছেন। অর্থাৎ তিনি লোকসংস্কৃতি বিষয়ে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কোনো প্রবন্ধ কিংবা গবেষণাপত্র রচনা করেননি। নদীকেন্দ্রিক কয়েকটি উপন্যাসেই লোকসংস্কৃতির সন্ধান করেছেন।
লোকসংস্কৃতির পর বিপ্লবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবন-সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছেন রকিবুল হাসান। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী বাঘা যতীনের অবদান ও আত্মত্যাগকে রকিবুল হাসান দেখেছেন অন্য যে-কোনো বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বেশি সম্মানের চোখে। এ কারণে বাঘা যতীন বিষয়ক প্রবন্ধে তাঁকে বেশি শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক দেখা যায়। অবশ্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা রচনায়ও রকিবুল হাসান শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়Ñতিনি কথাসাহিত্যের যেমন বিষয় প্রকরণ নিয়ে গবেষণাপত্র ও বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রে খুব বেশি লেখেননি। জসীম উদ্্দীন, ওমর আলী ছাড়া অন্য কোনো কবির রচনারাজি নিয়ে তেমন পূর্ণাঙ্গ কোনো গ্রন্থ কিংবা প্রবন্ধ রচনা করেননি। তবে কবি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনী ও জীবনসংগ্রামকেন্দ্রিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও শেখ মুজিবুর রহমান। এই চার জনকে নিয়ে রকিবুল হাসানের একাধিক প্রবন্ধ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বতন্ত্র দুটি গ্রন্থও। প্রথমটি বিপ্লবী বাঘা যতীন, দ্বিতীয়টি বাংলার চার ট্র্যাজিক নায়ক। এসব রচনায় রকিবুল হাসান এই চার ব্যক্তিত্বের বেড়ে ওঠা, জীবন সংগ্রাম ও কর্মযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরেছেন। সঙ্গে বিশ্লেষণ ও বিচার করেছেন।
বলে রাখা প্রয়োজন, বাংলা জনিপ্রয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন গ্রন্থটি লেখকের পিএইচডির অভিসন্দর্ভ। এই গ্রন্থে তিনি মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনের উপন্যাসের বিষয়-প্রকরণ ও জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধানসহ বিশ্লেষণ করেছেন। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু, নজিবর রহমানের আনোয়ারা ও আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত উপন্যাসের বিষয়-প্রকরণ ও জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধান করেছেন রকিবুল হাসান। পাশাপাশি লেখকত্রয়ের অন্যান্য উপন্যাসের ওপর আলোকপাত করেছেন। এমনকি এই তিন লেখকের সমসাময়িক অন্যান্য লেখকের উপন্যাস নিয়েও আলোচনার প্রয়াস চালিয়েছেন।
বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন গ্রন্থটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভ হওয়ায় এতে তথ্য-উপাত্তের পরিমাণ বেশি সত্য। কিন্তু সেই তথ্য-উপাত্ত তাঁর বিশ্লেষণ-বিচারবোধকে ছাপিয়ে যায়নি। এই বইকে রকিবুল হাসান ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। এসব অধ্যায়ে বাঙালি মুসলমান ঔপন্যাসিকদের সাহিত্যসাধনার সুলুকসন্ধানের পাশাপাশি নন্দনতত্ত্ব, সমাজচিত্রায়নের বিচার করেছেন। একইসঙ্গে এই ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসের চরিত্রবিচারের সঙ্গে-সঙ্গে শিল্পবিচার করেছেন। এই তিন লেখকের উপন্যাসের বিষয় ও জনপ্রিয়তার কারণ শনাক্তের ক্ষেত্রে রকিবুল হাসান সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে,
অনেক মুসলিম লেখক সমাজের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। এসব সমস্যা যেমন: সামাজিক বৈষম্য, বংশাভিমান, ভেদবিরোধী ব্যাপার, পীরপ্রথা, অলৌকিকতা, ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতি, অস্পৃশ্যতা, ধর্মান্ধতা, অবরোধ, নারীনির্যাতন, প্রণয়বীক্ষা এমন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে মুসলিম লেখকরা নানা মাপের উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হন। […] প্রকৃত অর্থে সামাজিক সমস্যার উন্মোচনের ভেতর দিয়ে বাঙালি মুসলমানরা হিন্দুদের পাশাপাশি জনপ্রিয়তার ধারায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা অপ্রতুল নয় কিন্তু আর্থ-সামাজিক ইতিহাসে তাঁরা মুসলমান লেখকদের শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিচর্যায় রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেনের নামই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত।৩
রকিবুল হাসানের উল্লিখিত বক্তব্যে তিন ঔপন্যাসিকের জনপ্রিয়তার কারণ উল্লেখ করে তাঁদের সাহিত্যকর্মের বিশেষত্ব ফুটে উঠেছে। তবে, ‘এক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেনের নামই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত’ বলে যে সিদ্ধান্ত লেখক টেনেছেন, তাতে একটি অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি কি মীর মশাররফ হোসেন, নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনÑএই তিন জনকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, না মীর মশাররফ হোসেন ও আকবর হোসেনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন? যেহেতু এই তিন ঔপন্যাসিককে নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচিত হয়েছে, সেহেতু একথা সহজেই অনুমেয়Ñলেখক তিন জনকেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন।
মীর মশাররফ হোসেনের জনপ্রিয় প্রধান সৃষ্টি হিসেবে রকিবুল হাসান বিষাদ-সিন্ধুকেই স্বীকার করেছেন। ফলে এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু, বাঙালি মুসলমানের আবেগ, বিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস, যুক্তিরহিত ভাবালুতার কেন্দ্রবিন্দু স্পর্শকরা বিষাদ-সিন্ধুর সাফল্য সম্পর্কে রকিবুল হাসানের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা প্রণিধানযোগ্য।
বাংলা সাহিত্যে বিষাদ-সিন্ধু নানা কারণে অনবদ্যরূপে চিহ্নিত হয়। সেখানে জীবন বাস্তবতার চিত্ররূপ নির্ণয়ে যে চিত্তকর্ষক ভাষা প্রয়োগ আর দিগন্তবিস্তারী অনুভূতির আকর্ষণ থাকে, শতবর্ষ পরেও এ উপন্যাসের গুরুত্ব কার্যকর ও গুরুত্ববহ। শিল্পভাষা-উত্তীর্ণ হওয়ার কারণেই মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ লেখক বনে যান। দেশ-কাল-সময় উত্তীর্ণ শিল্পে জয় করেন পাঠক হৃদয। অনেক রচনা লিখলেও প্রধানত বিষাদ-সিন্ধুই তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। রেনেসাঁ-উত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজের লেখক-ব্যক্তিত্ব হিসেবে মীর মশাররফ হোসেন অনিবার্য হয়ে ওঠেন। সেখানে কোনো ধর্ম-বর্ণ-শেণী নয়; গৃহীত হন একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হিসেবে। আর সর্বাধিকরূপে সেখানে তিনি গৃহীত হন অধিকতর জনপ্রিয়তার উৎসকেন্দ্র থেকে। এটাই তাঁর শিল্পশক্তি।৪
রকিবুল হাসান দেখিয়েছেন মীর মশাররফ হোসেনের উপন্যাস রত্নবতী, উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিয়ার বস্তানী, এসলামের জয়, রাজিয়া খাতুন, তাহমিনা, বাঁধাখাতা, নিয়তি কি অবনতি প্রভৃতি উপন্যাসকে ছাপিয়ে বিষাদ-সিন্ধুই জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিল। আর উপন্যাসটির সেই তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এখনো বহমান। এর কারণ, উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। যদিও মীর মশাররফ হোসেন মোহররমের মূল ইতিহাস থেকে অনেক দূরে সরে এসে ইতিহাসকেই মিথে পরিণত করে তুলেছিলেন। উপন্যাসটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে হয়তো এর মিথলজিক্যাল ভূমিকাই অনেকটা নিয়ামক হয়ে উঠেছিল। বাঙালি মুসলমান হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নাতি ঈমাম হাসান ও ঈমাম হোসেনের মৃত্যুর পেছনে এজিদের চক্রান্তকে মনেপ্রাণে ঘৃণার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। একইসঙ্গে এজিদকে বাঙালি মুসলমান কাফের বলেও মনে করেছে মূলত মীর মশাররফ হোসেনের ঘটনা বর্ণনার কৌশলের কারণে। তিনি ঈমাম হাসান ও ঈমাম হোসেনের প্রতি বাঙালির মুসলমানের সমবেদনা, পক্ষপাত সৃষ্টির জন্য এজিদ চরিত্রে সংসারের সমস্ত কালিমা লেপন করেছিলেন। রকিবুল হাসান বাঙালি মুসলমানের সেই ভাবালুতাকেই বিষাদ-সিন্ধুর জনপ্রিয়তার মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
মীর মশাররফ হোসেনের পর মোহাম্মদ নজিবর রহমানের উপন্যাসকে জনপ্রিয়তার নিরিখে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করেছেন রকিবুল হাসান। এই ক্ষেত্রে তিনি নজিবর রহমানের উপন্যাস আনোয়ারা (১৯১৪), চাঁদ-তারা বা হাসান গঙ্গা বাহমনি (১৯১৭, প্রেমের সমাধি (১৯১৮), পরিণাম (১৯১৮), গরিবের মেয়ে (১৯২৩) ও মেহেরউন্নিসা (?) প্রভৃতি উপন্যাসের কাহিনি, ভাষা, চরিত্র, সংলাপ বিশ্লেষণ করেছেন। এসব উপন্যাসের বিষয়-প্রকরণ বিশ্লেষণের পাশাপাশি জনপ্রিয়তার কারণ পর্যালোচনা করেছেন। একইসঙ্গে নজিবর রহমানের ঔপন্যাসিক সত্তার বিচার করেছেন। এই প্রসঙ্গে রকিবুল হাসানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য,
বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার অগ্রভাগে মোহাম্মদ নজিবর রহমানের প্রতিষ্ঠা। গ্রামীণ-অর্থনীতির অভিজ্ঞতা, বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্পন্দন, নিজস্ব অস্তিত্ব চেতনার শেকড়সন্দান অবলম্বী লেখক মজিবর রহমান। তবে স্বসমাজ আর নিজের পরিবার-অভিজ্ঞতারই পুনরাবর্তন ঘটেছে তাঁর সাহিত্যে।৫
মীর মশাররফ হোসেনের প্রতি রকিবুল হাসানের পক্ষপাত যতটা, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের প্রতি ততটা নয়। এই কারণে দেখা যায় মীরের উপন্যাস আলোচনায় তিনি যতটা দরদি মনের পরিচয় দিয়েছেন, নজিবর রহমানের উপন্যাস বিচারের ক্ষেত্রে ততটাই নির্মোহ থেকেছেন। ফলে এই ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের সাফল্যের দিক যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি ব্যর্থতার দিক বলতেও ভুল করেননি। অর্থাৎ মীরের পক্ষে অধিকাংশ সময় রকিবুল হাসানকে উকিলের ভূমিকায় দেখা গেলেও নজিবর রহমানের ক্ষেত্রে তিনি হয়ে উঠেছেন অনেকটাই ফৌজদারি মামলার বিচারক। ফলে নজিবর রহমানের উপন্যাস আলোচনাকালে তাঁকে নিরাসক্ত থাকতে দেখা যায়। এ যেন মহাভারতের পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর চোখে নজিবর রহমান হলেন কৌরব, মীরকে দেখেছেন পাণ্ডব হিসেবে। সঙ্গতকারণেই তার পক্ষপাত পাণ্ডবপক্ষেই। ফলে মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে রকিবুল হাসান সুস্পষ্ট মূল্যায়ন করলেও উল্লেখ করার মতো রকিবুল হাসানের স্মরণীয় উক্তি জোটেনি নজিবুর রহমানের ভাগ্যে।
উল্লিখিত দুই ঔপন্যাসিকের পর আকবর হোসেনের উপন্যাস রকিবুল হাসানকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। এই কারণেই বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন গবেষণাগ্রন্থে যেমন আকবর হোসেনের উপন্যাস নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে, তেমনি স্বতন্ত্র গ্রন্থ আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পীসিদ্ধি গ্রন্থেও তাঁর উপন্যাসসহ কথাসাহিত্য নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে। এদিক থেকে দেখলে মীর মশাররফকে পাণ্ডব, নজিবর রহমানকে কৌরবদের সঙ্গে তুলনা করলে আকবর হোসেনকে ভীষ্মের চোখে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা চলে। অর্থাৎ পুরো ‘মহাভারত’-এ শ্রীকৃষ্ণকে ভীষ্ম যেমন পুরুষত্তম হিসেবেই মান্য করতেন, তেমনি রকিবুল হাসানও আকবর হোসেনের উপন্যাসকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন।
আকবর হোসেনের কথাসাহিত্যবিষয়ে রকিবুল হাসানের আগ্রহ-মনোযোগ বেশি হলেও তা মাত্রাতিরিক্ত হয়নি। এর প্রমাণ আকবর হোসেনে কথাসাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে লেখকের কাহিনি-চরিত্র-সংলাপ-ভাষার শিল্পরূপ বিশ্লেষণেই রয়েছে। আকবর হোসেনকে রকিবুল হাসান জীবনবাদী লেখক হিসেবেই দেখেছেন। তিনি মনে করেন আকবর হোসেন মানব জীবন-সমাজ-সংসার থেকে বাস্তবানুগ অনুষঙ্গ নিয়েই তাঁর কথাসাহিত্যের সৌধ নির্মাণ করেছেন। সেখানে কষ্টকল্পিত কিংবা স্বকপোলকল্পিত বিষয়ের অবতারণার সুযোগ ঘটেনি। ফলে আকবর হোসেন তাঁর অবাঞ্ছিত (১৯৫), কি পাইনি (১৯৫১), মোহমুক্তি (১৯৫৩), ঢেউ জাগে (১৯৬১), দু’ দিনের খেলাঘরে (১৯৬৫), মেঘ বিঝলি বাদল (১৯৬৮), নতুন পৃথিবী (১৯৭৪), আভা ও তার প্রথম পুরুষ (১৯৮৮), দুষ্টক্ষত (১৯৮৯), আলোছায়া (১৯৬৪) প্রভৃতি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থে মর্ত্যরে জীবনযাত্রার ছবি এঁকেছেন। তাই রকিবুল হাসান এসব উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের কাহিনি-বিষয়-চরিত্র-ভাষাশৈলী বিচার করে দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমান কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের পর নজিবর রহমান কিঞ্চিৎ আলো ফেললেও সমাজকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সামর্থ্য দেখিয়েছেন আকবর হোসেনই। এই প্রসঙ্গে রকিবুল হাসানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য,
আকবর হোসেনের লেখা অতীব জীবননিষ্ঠ। আমাদের চারপাশের চেনা পরিবেশ এবং এখানে লালিত মানুষের জীবনের অকৃত্রিম আবহ-ই তিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে তুলে ধরেছেন। শুধু কথাসাহিত্যেই নয় তাঁর অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, কবিতা এবং নাটকেও জীবনধর্মিতার সে পরিচয় সুস্পষ্ট। শিল্পীর রঙ-তুলি আর পেন্সিলের রেখার টানেও তাঁর জীবন-নিষ্ঠতার পরিচয় বিদ্যমান। আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য বিষয়- বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বিষয় নির্বাচনে তাঁর বিশেষ প্রবণতা হলো তিনি সমকালীন জীবন ও সমাজের বাইরে যেতে চাননি। এবং এই সমকাল সচেতনা সাধারণ মানুষের জীবন ও কর্মের ব্যাপ্তিতে রেখায়ত। সর্বদাই তিনি সমাজের নির্যাতিত মানুষের সপক্ষে কথা বলতে ভালোবেসেছেন। ফলে গণজীবন বোধের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল বিষয়কেই তিনি গল্প উপন্যাসের উপজীব্য হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এ কারণে বাস্তবতা বিবর্জিত সাহিত্য রচনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। সমকালকে কথাসাহিত্যে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে আকবর হোসেনের কথাসাহিত্যে বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো পুনরাবৃত্তি ঘটেনি।৬
আকবর হোসেনকে জীবনঘনিষ্ঠ উল্লেখ করার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যের জনপ্রিয়তার কারণও অনুসন্ধান করেছেন রকিবুল হাসান। পুরাণে বর্ণিত দেবতা ও অসুরদের সমুদ্রমন্থনের সময় যেভাবে অমৃত ও গরল উঠেছিল, তেমনি আাকবর হোসেনের সমস্ত কথাসাহিত্য-মন্থন করে তাঁর সাহিত্যকর্মের শিল্পসৌকর্য ও জনপ্রিয়তার নির্যাস আবিষ্কার করেছেন রকিবুল হাসান।
একথা বলা অসঙ্গত হবে না; মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের সঙ্গে ফিকশনাল ইতিহাসকে মিশিয়ে স্বল্পশিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের আবেগকে উসকে দিয়েছেন। এই আবেগকে পুঁজি করে তিনি জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ চূড়ায়ও আরোহণ করেছেন। আজোবধি সেই চূড়ায় তিনি স্থির রয়েছেন। এককভাবে বিষাদ-সিন্ধুর জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করার মতো বাংলা ভাষায় কোনো উপন্যাস আজও রচিত হয়নিÑএকথা অত্যুক্তির মতো শোনালেও সত্য। বিষয়টি রকিবুল হাসানেরও অজানা নয়। ফলে তিনি মীর মশাররফ হোসেনের উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ সহজেই শনাক্ত করতে পেরেছেন। এরজন্য তাঁকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তবে নজিবর রহমানের আনোয়ারা উপস্থিতকালে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছালেও উত্তরকালে প্রায় বিস্মৃতির গহ্বরে চলে গেছে। বর্তমান কালে না নজিবর রহমানকে লোকে জানে, না তাঁর আনোয়ারা উপন্যাস আগ্রহের সঙ্গে পঠিত হয়। প্রত্যেক কালের একটি অসুখ থাকে, সেই অসুখে দেশ-সমাজ-পরিবারকে যতক্ষণ কাঁপিয়ে রাখে, ততক্ষণ সেই অসুখের দৌরাত্ম্য বলি আর দাপট বলি, তা বজায় থাকে। কালের যাত্রায় পথ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে একসময় সেই অসুখও তার তেজ হারায়, মানুষও পরাজিত করে সেই তেজের তীব্রতাকে। নজিবর রহমান ও তাঁর আনোয়ারার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সঙ্গত কারণেই নজিবর রহমানকে নিয়ে রকিবুল হাসান ততটা চর্চা করেননি, যতটা আকবর হোসেনকে নিয়ে করেছেন। বিশেষত আকবর হোসেনের উপন্যাসে তাঁর স্বীয়কাল ও সমাজের চিত্র বাস্তবতার নিরিখে অঙ্কিত হওয়ায় রকিবুল হাসানকেও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
আকবর হোসেনের উপন্যাসের জনপ্রিয়তার মূলসূত্র সহজেই শনাক্ত করতে পেরেছেন রকিবুল হাসান। তিনি মনে করেন, ‘আকবর হোসেনের উপন্যাস সমকালে অধ্যধিক জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে এর বিষয়ভাবনা যতটা কার্যকর, ঠিক ততটা কার্যকর এর শিল্পরূপ।’৭ অর্থাৎ রকিবুল হাসান তার গবেষণাকর্ম ও প্রবন্ধে আকবর হোসেনের উপন্যাসের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে বিষয়ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পরূপকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।
সাহিত্য জনপ্রিয় হওয়ার সূত্রগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে জনগণের কথা বলা, জনগণের মনের ভাষায়। জনগণের মনের ভাষা-ভাবাবেগ যিনি যত বেশি আয়ত্ত করতে পারবেন, তাঁর সাহিত্যকর্ম তত বেশি জনপ্রিয় হয়। সেই জনপ্রিয়তার কারণে সাহিত্যের গুণগত মান ক্ষুণ্নও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, গণমন শিল্পের মান বোঝে না, কিন্তু যে শিল্প তাঁদের হৃদয়কে বিলোড়িত করে, মনকে ছুঁয়ে যায়, তার কদর নিশ্চয় তাঁরা করে। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফের উক্তি প্রণিধানযোগ্য,
দেশে-দেশে গণমানবের বৈষয়িক জীবন দুর্বহ হয়েছে বলেই আজকের সাহিত্যিক যুগ-যন্ত্রণার প্রতিবেদন স্বরূপ হতেই হয়েছে। নান্দনিক সৌকর্ষ এতে যতই ব্যাহত হোক কিংবা সর্বজনীন মানব-চেতনার চিরন্তনত্ব যতই অবহেলিত হোক, আজকের গণমানবের জীবনের দুর্যোগ-দুর্ভোগ ঘুচাবার জন্যেই ফলিত (ধঢ়ঢ়ষরবফ) সাহিত্যের বড় প্রয়োজন। (সাহিত্যে যুগযন্ত্রণা)।৮
অর্থাৎ যে লেখক যুগযন্ত্রণাকে আবিষ্কার করতে পারেন এবং সেই যুগযন্ত্রণার ভাষাচিত্র অঙ্কন করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন, তাঁর সৃষ্টি জনমনে আঁচড় কাটেই। এই যুক্তিরই সাক্ষ্য বহন করছে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু, নজিবর রহমানের আনোয়ারা ও আকবর হোসেনের অবাঞ্ছিত।
মীর মশাররফ হোসেন, নজিবর রহমান ও আকবর হোসেন অত্যল্প শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের অজ্ঞতা, অশিক্ষা, ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে যে সাহিত্য রচনা করেছেন, তাই বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। ফলে লেখক-পাঠকে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই রুচির জোগান দেওয়ার মতো। এই মীর মশাররফ ছাড়া বাকি দুই লেখক বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো রুচি কিংবা মেজাজের জন্ম দিতে পারেননি। সেই চেষ্টাও তারা করেননি। তাঁরা জনপ্রিয়তার মোহে অন্ধ হয়ে গণরুচির জোগান দিয়ে গেছেন। ফলে তাদের উপন্যাস গণমানসে জোয়ার এনেছে, গণমানুষ তাতে সাঁতার কেটেছে। ডুবও দিয়েছে। কিন্তু সে ডুবে শরীর কিঞ্চিৎ শীতল হলেও মুক্তা দূরের কথা, তাতে কোনো ঝিনুকও উঠে আসেনি। এই প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য,
বাংলার মুসলমান সমাজের সাহিত্যচর্চার যে অবস্থা, অর্থাৎ লেখক ও পাঠকের যে সম্বন্ধ তা শুধু অসন্তোষজনক নয়, অনেকখানি আপত্তিকর। পাঠক সমাজের বিচার-শক্তি এখানে অত্যন্ত দুর্বল। সেই দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরি নেবার উদ্দেশ্যে আমাদের অনেক লেখককে অনেক সময়ে দেখতে পাওয়া যায় অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর রচনায় হাত দিতে।৯
রকিবুল হাসান বাঙালি মুসলমান কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনের সাহিত্যে কাজী আবদুল ওদুদ বর্ণিত ‘অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর’ বিষয়ের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। কিন্তু সেই ‘অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর’ অনুষঙ্গ যে অর্ধশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমানের যুক্তি-বিবর্জিত ভাবাবেগ, তা রকিবুল হাসান উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তবে, বিষয়টিকে তিনি এভাবে খোলাখুলি প্রকাশ করেননি। তিনি বিষয়টিকে ঘুরিয়ে বলেছেন, তাতে সাপ যেমন মরেছে, তেমনি লাঠিও অক্ষত রয়েছে। অর্থাৎ তিনি সাহিত্যের সস্তা উপকরণের জন্য ভোক্তা-পাঠককে দোষারোপ করেছেন, কিন্তু স্রষ্টা ঔপন্যাসিকদের রেখেছেন বিরূপ সমালোচনার ঊর্ধ্বে।
লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যের পর রকিবুল হাসান বিপ্লবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবন-সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন ও শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী বাঘা যতীনের অবদান ও আত্মত্যাগকে রকিবুল হাসান দেখেছেন অন্য যে-কোনো বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বেশি সম্মানের চোখে। এ কারণে ‘বাঘা যতীন’ বিষয়ক প্রবন্ধে তাঁকে বেশি শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক দেখা যায়। অবশ্যই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা রচনায়ও রকিবুল হাসান শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় তিনি কথাসাহিত্যের যেমন বিষয় প্রকরণ নিয়ে গবেষণাপত্র ও বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রে খুব বেশি লেখেননি। জসীম উদ্্দীন, ওমর আলী ছাড়া অন্য কোনো কবির রচনারাজি নিয়ে তেমন পূর্ণাঙ্গ কোনো গ্রন্থ কিংবা প্রবন্ধ তিনি রচনা করেননি। তবে কবি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জীবনী ও জীবনসংগ্রামকেন্দ্রিক প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও শেখ মুজিবুর রহমান। এই চার জনকে নিয়ে রকিবুল হাসানের একাধিক প্রবন্ধ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বতন্ত্র দুটি গ্রন্থও। প্রথমটি বিপ্লবী বাঘা যতীন, দ্বিতীয়টি বাংলার চার ট্র্যাজিক নায়ক। এসব রচনায় রকিবুল হাসান এই চার ব্যক্তিত্বের বেড়ে ওঠা, জীবন সংগ্রাম ও কর্মযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরেছেন। সঙ্গে বিশ্লেষণ ও বিচারও করেছেন।
ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে যেমন তাঁর পক্ষপাত আকবর হোসেনের প্রতি, তেমনি বিপ্লবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে বাঘা যতীনের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা লক্ষণীয়। ‘বাঘা যতীনের ট্র্যাজিডি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন ‘স্বদেশী আন্দোলনের’ মূল বিষয় ছিল বাংলার ঐক্য, বয়কট, জাতীয় শিক্ষা ও স্বরাজ। এই প্রবন্ধে রকিবুল হাসান আরও দেখিয়েছেন, বয়কটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবি জড়িয়ে রয়েছে ‘স্বদেশী’ চিন্তা। আর এই চিন্তা ও বিপ্লবের পুরোধা হিসেবে বাঘা যতীনকে অগ্রনায়ক হিসেবে দেখেছেন প্রাবন্ধিক। তবে, ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনে বাঘা যতীনের অবদানের পাশাপাশি তাঁর জীবনের বিয়োগান্তক পরিণতির দিকটিই বেশি প্রাবন্ধিকের হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি স্মরণযোগ্য,
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যিনি বাঘা যতীন নামে বিখ্যাত-তিনি তেমনি ইতিহাসে শক্তিসঞ্চারি একটি পদচিহ্ন। তাঁর আগে ও পরে আরো অনেক পদচিহ্ন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত আছে। সকলের পদক্ষেপে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য একটি পথ রচিত হয়েছিল। সেই পথ বহু আগেই পশ্চাতে পড়ে গেছে, কিন্তু তার আলোটা আমাদের অগ্রসরতার বড় শক্তি, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য অনিবার্যভাবে ধারণ করতে হবে বাঘা যতীন-চেতনা।১০
বাঘা যতীনের জীবনের ট্যাজিক পরিণতির বর্ণনা দিতে গিয়ে রকিবুল হাসান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসও টেনে এনেছেন। ফলে প্রবন্ধটি হয়ে উঠেছে ইতিহাস আশ্রিত রাজনৈতিক ব্যক্তির জীবনচিত্র।
বাঘা যতীনের পাশাপাশি রকিবুল হাসানের সর্বোচ্চ সম্মানের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বন্ধুবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, তাঁর আত্মজীবনী, তাঁর স্বপ্নের ‘বাঘা যতীন মিলিটারি একাডেমি’ নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তবে, এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি তাঁর লেখক সত্তারও বিশদে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ও নেতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর জীবনের সমস্ত কৃতিত্বের পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে বিশেষভাবে চিত্রিত করেছেন।
১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে করুণ মৃত্যু পৃথিবীর সব বাঙালির হৃদয়ে বেদনার মহাকাব্য হয়ে ওঠে। তার অশ্রুধারা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হাজার নদীর অববাহিকা হয়ে চিরকাল প্রবহমান হয়ে থাকবে। এই শোককে শক্তি করেই বাঙালি আজ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে বিশ্বদরবারে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে। আর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন বিশ্বমঞ্চে চিরকালের বিস্ময়।১১
এই প্রবন্ধে রকিবুল হাসান বঙ্গবন্ধু বিশালতা ও নেতৃত্বের বিস্ময়কর ক্যারিশমাটিক চারিত্র্যের পরিচয় বিধৃত করেছেন। একইসঙ্গে তাঁর প্রতি হত্যাকারীদের নির্মম আচরণকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যাতে পাঠকের সামনে সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ভেসে ওঠে।
রকিবুল হাসানের আরেকটি ব্যতিক্রমী গদ্যের বই পথের কথা। এই গ্রন্থে তিনি নিজের দেখা পথ-ঘাট-মানুষ-প্রকৃতি ছবি এঁকেছেন। সেই ছবি গতানুগতিক নয়। তাতে তাঁর গদ্যশৈলীর স্বাতন্ত্র্য ফুঠে উঠেছে। সেই স্বাতন্ত্র্য কী উপস্থাপন শৈলীতে, ভাষার কাব্যিক ভঙ্গিতে, কী উপমায়। এই গ্রন্থের ছোট-ছোট গদ্যে তাঁর নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ, বোধের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে অনীক মাহমুদের উক্তি স্মরণযোগ্য,
এসব আমাদের চলমান জীবনের গল্পের গল্প। এরসঙ্গে লেখকের নিরাসক্ত টিপ্পনী-উইট ও ফানের ব্যবহার সমকালীন পথচলার সমস্যাগুলোকে রসের রভসে মিশ্রিত করে পরিবেশিত হয়েছে। সাংবাদিকের চোখ, কবি ও কথাশিল্পীর শৈল্পিক নৈপুণ্য রকিবের লেখাগুলোকে সত্যই রসবেদ্য করে তুলেছে। (পথের কথা: পথদৃষ্টি ও কথাস্তর)১১২
সাহিত্যের বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাবন্ধিক-গবেষক হিসেবে রকিবুল হাসান মন ও মননে বিচারক, কিন্তু তার প্রবন্ধের ভাষা নিরস নয়। বরং কথাসাহিত্যের ভাষার কোমল রূপ তাঁর গদ্যকে করে তুলেছে চিত্তাকর্ষক। ফলে নিছক গবেষণামূলক প্রবন্ধ কিংবা বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধও সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়া প্রবন্ধে কথাসাহিত্যের গদ্যভঙ্গির প্রয়োগের পাশাপাশি তিনি কবিতার মতো চিত্রকল্প-উপমারও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এ কারণে তাঁর প্রবন্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক চিত্রের পাশাপাশি রয়েছে চিত্তে আনন্দসঞ্চারী গদ্যভঙ্গিও। এছাড়া রয়েছে কথাসাহিত্যের মতো তাঁর প্রবন্ধেও ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সেখানে আগে মানবতাবাদী-দেশপ্রেমিক, পরে শিল্পের সাধক। সম্ভবত রকিবুল হাসানের প্রবন্ধের প্রকৃত সৌন্দর্য ও শক্তি এখানেই নিহিত।
তথ্যসূত্র
১। রকিবুল হাসান, প্রবন্ধ প্রমূর্ত : ভিতর বাহির, শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ৬৩
২। তদেব, পৃ. ৯৭
৩। রকিবুল হাসান, বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর
হোসেন, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ৪১
৪। তদেব, পৃ. ৭১
৫। তদেব, পৃ. ৭৪
৬। রকিবুল হাসান, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পীসিদ্ধি, অক্ষর, ঢাকা,
২০১৩, পৃ. ২২৫
৭। তদেব, পৃ. ১৮১
৮। আহমদ শরীফ, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ১৭৪
৯। কাজী আবদুল ওদুদ, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ২৪১
১০। রকিবুল হাসান, বাঙালির চার ট্র্যাজিক নায়ক, গ্রাফোসম্যান পাবলিকেশন্স, ঢাকা,
২০২৪, পৃ. ৭৪
১১। তদেব, পৃ. ১০৭
১২। শেখ রেজাউল করিম সম্পাদিত রকিবুল হাসানের পথের কথা, পরী প্রকাশন, ঢাকা,
২০০৪, পৃ.১৮