শিশুতোষ লেখা বা শিশুসাহিত্য, এই নামের সঙ্গে খুব একটা সুবিচার করা হয়নি। শিশুদের নাম নিয়ে লেখা হয়েছে বটে তবে বেশির ভাগেরই ভাব ও ভাষা ছোটদের বোধগম্য নয়। বরং তলিয়ে দেখতে গেলে বাংলায় শিশুতোষ লেখা নিতান্তই কম হয়েছে। এই নামে যা লেখা হয়েছে, তা সদ্য শৈশব ফেরিয়ে ওঠা কিশোরদের বেশি উপযোগী। রূপকথার রাক্কস-খোক্কস, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি থেকে শুরু করে ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘টম সয়ার’ কি ‘জুল্ ভার্ন্’ বা ‘জনাথন সুইফট’ হয়ে আজকের ‘কল্পবিজ্ঞান’ ও ‘রহস্যগল্প’ এই সব অপরিণত শিশুর ভাব-ভাষা জ্ঞান ও পাঠ্যাভ্যাসের জন্য নয় বরং তাদের চেয়ে চিন্তায় কিছুটা অগ্রসর, ভাবনার বিস্তারে একধাপ এগিয়ে যাওয়া কিশোরদের জন্যই। অথচ এই সবই শিশুসাহিত্যের মোড়কে আমাদের সামনে দৃশ্যমান।
বয়ঃসন্ধির অদ্ভুত ঘেরাটোপে আমাদের সাহিত্যে শিশুতোষ রচনার মাঝে ভিন্ন ভুবন নিয়ে এই যে দু’ ফালা হয়ে আছে এটাকে এখন আর অস্বীকারের জো নাই। কখন যেন বেদানা ফলের মতো পুষ্ট-পক্ব হয়ে ফুটে-ফেটে অনিবার্য হয়ে রয়েছে এই বিভাজন। শিশুসাহিত্য-বলয়ের মধ্যে ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়ে শিশু ও বড়দের মাঝখানে এই যে পর্দা নিরন্তর শৈল্পিক দোলায় আন্দোলিত হতে দেখা যাচ্ছে এটি ইদানিংকালে এতটাই তীব্র, স্বচ্ছ ও সাবলীল যে একে আর শিশুসাহিত্য বলয়ে আটকে রাখা যাচ্ছে না। তাই ‘কিশোর সাহিত্য’ নামই এর জন্য যথার্থ মনে করছেন সংশ্লিষ্টজনেরা। বিশ্বসাহিত্য মঞ্চও এই নামকে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘কিশোর গল্প’, ‘কিশোর উপন্যাস’, ‘কিশোর ভ্রমণকাহিনী’ শিরোনামও আজকাল সাধারণ ব্যাপার। সমস্যা যত, তা হলো কবিতা নিয়ে; অর্থাৎ ‘কিশোরকবিতা’ নামে এই ধরনের কবিতার জন্মচিৎকার এখনো অস্বীকার করে চলেছেন অনেকে।
অভিযোগকারীরা মনে করে, ‘কিশোরকবিতা’ বলে পৃথক কিছু নেই এবং কবিতায় এ-ধরনের বিভাজন নিরর্থক। এর নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞার্থ তৈরি করা তাদের কাজ যারা কবিতা লিখতে অপারগ কিন্তু ঠিক ছড়াও লিখতে পারে না; ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্র থেকে প্রস্থান না করে কিশোরকবিতা নামে নতুন ‘লোকাল বাসের’ রুট ঠিক করছে মাত্র! কে না জানে কবিতার কোনও বিষয়-ভাষা-বয়সের গণ্ডি নেই? কিন্তু কিশোরকবিতা নিয়ে যাদের নিযুত অভিযোগ তারা বলেন—শিশুসাহিত্য, কিশোরসাহিত্য, যুবকসাহিত্য। এভাবে বিভাজন কী চলতেই থাকবে? কিন্তু এটাও যৌক্তিক যে, কিশোরকবিতা যদি আলাদা হওয়ার গৌরবী না হবে, তাহলে তার রচনারীতি, তার পরতে-পঙ্ক্তি, শব্দরাজি—সর্বোপরি তার প্রকাশভঙ্গি এতটা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কেন হবে? উপর্যুক্ত স্পষ্ট বৈশিষ্ট্যর মিত্র ও মিশ্রতায় কবিতার যে পৃথক ধারা, অন্ত্যিমে তাই কিশোর কবিতা।
আসলে কিশোর কবিতা বলে কিছু একটা যে বাংলা সাহিত্যে অনেক আগে থেকে হয়ে আছে এই কথাটি ঠিক তেমনই সত্য যেভাবে সত্য আল মাহমুদের, ‘ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা’র নিজেই কবিতা হয়ে ওঠা। আল মাহমুদের ভাষায়, ‘সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে/ কবিতা বোঝে না!’ বাংলা সাহিত্যের দুই হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে কিশোর কবিতার জন্মইতিহাস জ্বলজ্বল করে ওঠে।
যারা কিশোরকবিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা শেষপর্যন্ত ‘কবি’ হয়ে থাকতে চান। তাদের ধারণা, জগতে টিকে থাকতে হলে কবি হয়েই কেবল তা সম্ভব। তাদের কাছে শিশু বা কিশোর সাহিত্যে ভাগ্যান্বেষণের প্রস্তাব এলে,আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায়—‘গলায় নৈরাশ্যের সুর ফুটে ওঠে।’ অথচ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব বড় কবিই শিশুসাহিত্যে তো মাঠ মাঠ ফসল ফলিয়েছেনই, এখন আমরা যেগুলোকে কিশোর কবিতার বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটনের জন্য সামনে আনি তেমন ভুরি ভুরি কবিতাও লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা তারও আগে ধীজেন্দ্রলাল রায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার থেকে শুরু করে ও-পাড়ার শঙ্খ-সুনীল-জয় গোস্বামী বা আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ হক, ফররুখ, আহসান হাবীব, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহসহ আরও কত কত নাম বলা যাবে এই কাতারে।
পৃথিবীর এ-যাবৎ কালের কোটি কোটি কবিযশপ্রার্থী যেমন বিস্মৃতির নিষ্পত্র জগতে হারিয়ে গেছে তেমনি শিশু-কিশোর সাহিত্যের অগণন শক্তিমান স্রষ্টা মানব-স্মরণে অমর জায়গা পেয়েছেন। হ্যান্সা ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন বা মার্ক টোয়েন তাদের সাহিত্যের পৃষ্ঠায় যে অনুপম স্বপ্নের জগৎ রচনা করেছেন, সে-সবের শিল্প-সিদ্ধি পৃথিবীর হাতে-গোনা গুটিকয়েক শ্রেষ্ঠ কবিকে বাদ দিলে ক’জনার চাইতেই-বা খাটো?
প্রকৃতপক্ষে, কিশোর কিবতার যে বহু আরাধ্য, নিষ্ঠার সাধনায় এক বিশাল কল্পনা বৈভবের স্বপ্নীল জগৎ, সেই কল্পনা যাকে স্পর্শ করে সে তো পৃথিবীর আর অন্য আট দশটা শিল্প মাধ্যমের স্রষ্টার মতোই এক শিল্পী; তার রচনা শিল্প—যা অনুপম, অশ্রুতপূর্ব ও অপার্থিব। কবিতা, নাটক, কথাসাহিত্য, শিশুসাহিত্য এমনকি প্রবন্ধ; যাই তার হিরণ-ত্বকের স্পর্শ পায় তাই সোনা হয়ে যায়। ছেঁড়াছাতা আর রাজছত্রের মতো, আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানির মতো, কবিতা আর কিশোর কবিতার কোনো ভেদ নেই। কল্পনার দীপ্তিতে সম্পন্ন হলে অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের মতো কিশোর কবিতাও একই রকম চিরন্তন।
গড়নে, অবয়বে, শিল্প-স্বভাবে ও ভেতরের তাগিদে কিশোরকবিতা আর কবিতা এক হয়েও পৃথক। দু’জনেরই কারবারের মূল পুঁজি সেই আদি কয়েক অকৃত্রিম জিনিস—ভাব, শব্দ, ছন্দ, রস। কবির মতো কিশোর কবিতার কবিকেও জীবনের কোনও একটা আবেগাশ্রিত বিষয়কে ধ্বনিময় চিত্রলোকের বিস্মিত বাসিন্দা করে তুলতে হয় কল্পনা ঐশ্বর্যে সমান সচ্ছলতা দিয়ে, কবিত্বেরই শক্তি দিয়ে। এখানে কি কেউ কারও চেয়ে কম? ‘লুকোচুরি’, ‘বীরপুরুষ’, ‘একদিন রাতে আমি’, ‘আমাদের ছোট নদী’, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ রচনাগুলোয় রবীন্দ্র চিত্রজগৎ, ধ্বনিজগৎ বা ভাবনাজগৎ রচনার কল্পনায় কোনখানে কম, তার কবিতার অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে? নজরুলের ‘আমি হব’ কবিতায় কিশোর-মনের যে দুর্নিবার অপ্রতিরোধ্য কল্পনা আর্ত হয়ে উঠেছে কবিতা প্রতিভার নিরিখে তাকে ক’টা কবিতার চেয়ে হীন বলা যাবে? মহাকাব্যের কবি, গীতিকবিতার কবি, প্রকৃতির কবি, প্রেমের কবি—সবাই যদি কবি হতে পারে তবে কিশোর কবিতার কবি ‘কবি’ হতে আপত্তি কোথায়? আর তার কিশোরের মনসংলগ্ন কবিতা কিশোর কবিতা হতেই-বা দোষ কী?
সাহিত্যের মূল শ্রোতধারায় মানুষের গোটা জীবন উপজীব্য। শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-প্রসূত অনুভূতি রঙ, রেখা, শব্দ বা রূপকের সাহায্যে অন্যের মনে রস সঞ্চারিত করা যদি আর্ট হয়, তবে এই শর্ত বজায় রেখে একটা বিশেষ কালপর্বকে নিয়ে যে কেউ ফলাতে পারে তার কল্পনা-নিগুঢ় সত্যের ফসল। শেষ পর্যন্ত লেখাটি শিল্পগুণ সম্পন্ন হওয়াটাই আসল কথা।
দুই.
একটা সময় ছিলো যখন জ্ঞানকাণ্ডে শিশু-বড় বিভাজন ছিল না। বড়দের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে বলি হতে হতো কোমলমতি শিশুর স্বপ্নীল ভুবন। অবলা শিশুটিই কখনো কখনো আত্মহুতি দিতে হতো বড়দের ইচ্ছার কাছে; ইতিহাসে, ধর্মগ্রন্থে সেসবের নিযুত উদাহরণ পাই। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বুঝলো বড়দের ভাবনার, বাস্তবতার পৃথিবী ও ছোটদের ‘ইচ্ছা রঙিন যা খুশি তাই’র পৃথিবী এক নয়। ইদানিংকালে, মানবিক বিদ্যার উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে আমরা জানতে পেরেছি, কেবল মনোবৃত্তিগত দিক নয়, শাররীক পরিবর্তন ও শিশু-অভিজ্ঞতা থেকে পা বাড়িয়ে কিছুটা অগ্রসরমান হওয়ায় বয়ঃসন্ধির সময়টায় সে ঠিক শিশু নয়, আবার বড়ও নয়—কিশোর।
কৈশোরের দুরন্তপনা বাঙালি জীবন-বোধের গভীরে দারুণভাবে প্রোথিত হয়ে থাকে। এই সময়ের আবেগ-অনুভূতি, রাগ-ক্ষোভ, উচ্ছ্বাস-উদ্যম, চঞ্চলতা জীবনের বহুপর্বে গতি নির্ণয়ক হয়ে দেখা দেয়। উঠতি বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভাবনাও এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না। বাংলার মাটিবর্তী কৃষকের কিশোর ছেলেটির মনের অতল গহ্বরের সারল্যকে উপেক্ষা করেননি জসীমউদ্দীন বা আহসান হাবীবের মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিরাও। আবার আধুনিককালে যখন বিজ্ঞানের নানামাত্রিক ব্যবহারের ফলে বাঙলার শিশু-কিশোরের পরিবেশ প্রকৃতি তথা জীবনধারা পরিবর্তন হচ্ছে তখন এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে সাহিত্যিক মূল্য পাচ্ছে। অনুষঙ্গগুলো সাহিত্যের উর্বর মাঠে হৃদয়গ্রাহী দোল খেতে গিয়ে বিজ্ঞ লেখকের অবিজ্ঞতার চাখনির সূক্ষ্ম ছিদ্র ভেদ করে এবং সেখানে কিশোরের মনোবৃত্তি ও ভাবকল্পলোক মলিন হয়ে যায়নি।
মলিন যে হয়নি তার দু’একটি নজির দেখা দরকার। যেমন—বাস্তবে যে এক অজ পাড়াগাঁয়ের দুরন্ত কিশোর, সে-ই তো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বীরপরুষ’ হয়ে ডাকাত দলের সঙ্গে যুদ্ধ করে—মাকে বাঁচায়; সেই কিশোরই তো অসম্ভবের নিযুত ঘেরাটোপ ফেঁড়ে কল্পনায় নজরুলের ভাষায় ‘সাগর সেঁচে মুক্তা আনে’। কিংবা নিসঙ্গ বালক, যাকে কেউ বুঝতে চায় না, অনেক সময় বুঝতে চেয়েও পারে না এমন বালকের সুখ-দুঃখ বোঝার একান্ত সঙ্গীর সঙ্গে নিবীড় আলাপের জন্য মধ্যরাতে— আল মাহমুদের ভাষার ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ গিয়ে তাদের ‘পকেটে ভাঁজ করা কাব্য’ শোনায়। সম্প্রতি ‘সায়েন্সফিকশন’ তো কিশোর-কল্পনাকে আশ্রয় করে বিজ্ঞানেরই মিশেল; কবিতায় প্রত্যাহিক জীবনে বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ, এলিয়েন, মহাজাগতিক গ্রহানুগহ গতশতাব্দীর রূপকথার স্থালাভিষিক্ত। এই কিশোরবোধ বা মননকে সাহিত্য উপেক্ষা করবে কোন যুক্তিতে? এখানেই কিশোর কবিতা অনিবার্য।
কবিতায় যখন আক্ষরিকার্থে আধুনিকতা এলো, (তিরিশ ও পরবর্তী সময়ে) দেখা যায়, তখন থেকে কাব্যভাষায়ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এলো। কাব্যভাষায় পরিবর্তন আসায় বড়দের কবিতার ভাব ও ভাষা এতাটাই ঘনীভূত হয়ে পড়লো যে তা বয়ঃসন্ধিকালের একজন কিশোরের পাঠে ধরা পড়ে না, কখনো কখনো কবিতার মর্ম উদ্ধারে সে হয়ে পড়ে অক্ষম। অন্যদিকে সে ছড়ার হালকা চালের চটুল শব্দের বুননে ছন্দময় রচনার চেয়ে বেশি কিছু চায়। তাই এই দুইকে ফেঁড়ে নতুন কিছুর সন্ধান পেতে সে যে কিশোর কবিতার প্রতি পা বাড়ায়। কিশোর কবিতা যেমন ঠিক ছড়া নয়, আবার ঘনীভূত ভাষার কোনো লাভাও নয়। তাই এর ভেতরের শৈল্পিক সৌন্দর্য তাকে অনির্বাচণীয় আনন্দে উদ্বেল করে, এমন কবিতায় সে বার বার ডুব দিতে চায়।
কাব্যভাষার পরিবর্তনের ফলে ভাষা ঘনীভূত হওয়া ছাড়াও আরও যে বিষয়টি দেখা দিলো, তা হলো, সুজিত সরকারের মতে, আধুনিক কবিতার ভাষা দৈানন্দিনের মুখের ভাষার কাছাকাছি এসে পড়লো। কিন্তু কিশোর কবিতার দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, ভাষার এই বাঁক বদলে এটি একই দিকে পাল তুললেও বড়দের কবিতার মতো খোলস ঝেড়ে ফেলেনি। ছন্দের আঁটোসাঁটো বন্ধনীতে থেকে কবিতার ভাষায় কিশোর কবিতার কবি বক্তব্য পেশ করে। এই ভাষাটি কিশোরকে আকৃষ্ট করে।
কবিতাকে প্রধানভাবে ছন্দ-মিলবদ্ধ একটি সঙ্গীতমধুর বক্তব্য মনে করা হয়। আধুনিক কবিতা যেহেতু অন্ত্যমিলের চেয়ে অন্ত্যমিল ও প্রাকৃত স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের চেয়ে অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যছন্দকেই প্রধান নিয়ামক করে নিয়েছে তাই কিশোর কবিতাকে আলাদা করে চেনা যায়। কিশোর কবিতা অন্ত্যমিলের সেই পুরানো বৃত্তে নবতর সৃষ্টিকে স্বাগত সব সময় জানায়। কেননা ছন্দের অন্তর্নিহিত সঙ্গীতকে শক্তি ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণতম বিকাশে উত্তীর্ণ করা ছন্দের সঙ্গে অন্ত্যমিলের পরিপূর্ণতম সহযোগের ফলেই সম্ভব। মিল দেওয়ার ক্ষমতার ওপর একজন কবির শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই কিশোর কবিতার কবিরা নিখুঁত নতুন মিলের বিষয়ে ওয়াকেবহাল।
ছন্দ ও মিল দিয়ে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব—এই দাবিকে কি উপেক্ষা করবেন কেউ? কিন্তু সমসাময়িক প্রতিভাবান তরুণ অনেক কবির, বড়দের উপযোগী কবিতায়, লেখা পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, তারা অন্য যেকোনো ছন্দের তুলনায় গদ্যছন্দে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু কিশোর কবিতার কবি যেহেতু প্রধানত স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে আস্থাবান তাই একটি রেখা এ দুটিকে আলাদা করেই দেয়। প্রশ্ন হতে পারে, কিশোর কবিতার কবি কেন গদ্যছন্দে বা অক্ষরবৃত্তে যান না। এর দুটি উত্তরের প্রথমটি হলো—অনেকে এই দুই ছন্দে শিশুকিশোরদের জন্য লিখেছেন, লিখছেন। দ্বিতীয় উত্তর—অক্ষরবৃত্ত বা গদ্য ছন্দের চাল লম্বাশ্বাসের চাল। শিশু-কিশোরদের পাঠানন্দ ও উচ্চারণ স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর লক্ষ রেখে যেভাবে কবিতার ভাষায় সারল্য নিয়ে আসা হয়, তেমনি ছন্দের নমনীয়তার প্রয়োজনে দীর্ঘ গতিময় ছন্দ কিশোর কবিতার কবির অপছন্দ।
তিন.
যথা সময়ে যথাযোগ্য পুষ্টির অভাবে বাড়ন্ত কিশোরের যেমন ঠিকঠাক শারীরিক বিকাশে বাধা পেতে পারে, তেমনি কিশোরবেলায় কিশোর মনসংলগ্ন কবিতাও তাকে মানসিক বিকাশে করে তুলতে পারে বলিষ্ঠ। যদি ‘আর্ট ফর ম্যান সেক’ হয়, তবে এ কথা কি আবন্তর যে কিশোরকে আধুনিক কবিতার অযুতগুণ সমৃদ্ধ কঠিন কিছু দিলে সে মানসিক চাহিদা পূরণ সম্ভব? বরং কবিতা বিমুখিতা ঘটবে অচিরেই। কিশোরকবিতা বাংলার কিশোর মনে সেই জায়গাটি করে নিয়েছে। সুতরাং একে উপেক্ষা করা আমাদের আগামী, আমাদের ভবিষ্যৎ, কিশোরসত্তাকে অস্বীকারের সামিল। তবে এও মনে রাখা আবশ্যকীয় যে, কিশোর কবিতাকে শেষাবধি কবিতাই হতে হবে। হালকা চালে অন্ত্যমিলের শরীরে কোনো পদ্যকে কিশোর কবিতা বলা জ্ঞানহীনতা; ‘আবার ভালো একটি পদ্যও অনেক দামি’। কিশোর কবিতাকে সবকিছু চাপিয়ে শুধু কিশোরদের মনে ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মাধ্যমে সার্থকতা খুঁজলেও প্রকৃত সার্থক কিশোর কবিতা সেটিই যা বয়স নির্বিশেষে সবাইকে অনির্বচনীয় রস জোগাতে সক্ষম।