মোহাম্মদ রফিক (জন্ম: ২৩ অক্টোবর, ১৯৪৩) তার প্রথম কবিতার বই ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি নিজেকে আলাদাভাবে চেনানোর চেষ্টা করেছেন। জীবনের যন্ত্রণা ও সময়ের চাবুকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তাদের কবিতা যে সময়কে ধারণকে করে আছে, মোহাম্মদ রফিক সেই সময়ের প্রতিনিধি।
প্রতিনিধি, কিন্তু তিনি সেই অবরুদ্ধ অথচ সতত বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেননি। প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র আর রাজনৈতিক অস্থিরতাকে তিনি ধারণ না করে, সমাজ ও সময়ের প্রতি অনাস্থা না দেখিয়ে তিনি বরং নান্দনিকতার ভেতর দিয়ে ভয় ও অস্থিরতার কালো মেঘকে তুলে আনেন। যেখানে জীবন প্রতিনিয়ত খুঁজে ফেরে প্রকৃতির মায়ায় নিজস্বতা।
গোলাপের কাছে যাইনি কখনো ভয়ে
যদিও ডাকিছে গন্ধে পরাগে তবু
বিগলিত হৃদে যাইনি কখনো ছুটে;
শুধু ভীত হই; সম্মোহনের মোহে
দালিয়ে মাড়িয়ে পশুদের মতো বুঝি
একাকার করে ছুড়ে ফেলে দেব দূরে
হায়রে পশুরা বোঝে না সুবাস ফুল;গোলাপের কাছে বাড়াইনি হাত আমি
পাছে ভয় হয় সবকিছু দেব ভেঙে
কভু কামনায় কখনো বা অনীহায়;আমাকে কেন যে অস্থির করে ফুল!
(গোলাপের জন্য)
মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় ষাটের দশকের যে অস্থির এবং নৃশংস সময়ের কথা বলা হয়, সেই ভয়াবহতার চিত্রায়ন হয়েছে বিশুদ্ধ শিল্পের মোড়কে। এ সময়ের কবিদের সমাজের প্রতি যে অনাস্থা, প্রচল ভেঙে ফেলার যে তাগিদ, অস্থিরতা তাকে সাধারণীকরণ করে বর্ণনা করেছেন তিনি। ফলে তার কবিতায় অনায়াসে উঠে এসেছে মানুষের চিন্তা, মানুষের ভূগোল। তিনি মানব মনের আবেগসঞ্চারী অনুভূতিমালাকে গ্রন্থিত করেছেন শব্দে। তাই কবিতায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সমকালীন বাংলাদেশ। সমকালীন মানুষ, তাদের ভাবনার জগৎ। তিনি একদিকে কবিতায় যেমন আত্মঅনুসন্ধান করেছেন, তেমনিভাবে মানুষ ও প্রকৃতিকে বর্ণনা করেছেন। এতে করে তার কবিতা হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। তিনি শিল্পের সন্ধান করেছেন, তাই শিল্পকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। ফলে তার কবিতা স্পর্শ করে একদিকে যেমন জীবনের নান্দনিকতাকে তেমনিভাবে তা স্পর্শ করে বিপরীতকেও। সময়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে তিনি বিশুদ্ধ কবিতার দিকে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন বৈশাখী পূর্ণিমার মধ্য দিয়ে সেই যাত্রায় তিনি একে একে অতিক্রম করেছেন—ধুলোর সংসারে এই মাটি, কীর্তিনাশা, গাওদিয়া, খোলা কবিতা, কপিলা, উপকথা, স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময় প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে এক নৈসর্গিক বাংলার পথে। তাই মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সম্পর্কে আলোচনায় আহমদ মিনহাজ ‘মোহাম্মদ রফিকের কবিতা: তাঁর বাংলাদেশ, চিহ্ন ও স্বপ্নসূত্র’ শীর্ষক এক লেখায় বলেছেন, ‘মোহাম্মদ রফিকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হচ্ছে তেমন একটি জায়গা যেখানে মোটামুটি শুরু থেকে তিনি পৌঁছাতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশের ধুলো ও কাদায় লেপ্টানো এ কবির কবিতা পাঠ করলে সবার আগে বাংলাদেশের ছবি চোখে ভাসে এবং ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড বাদ দিয়ে তাঁকে বোঝার কোনো রাস্তা তিনি অবশিষ্ট রাখেন না। এখন যে জায়গাটিতে তিনি পৌঁছাবার জন্য এত ব্যাকুল—তাঁর আগের-পরের কবিরা সেখানে যাননি এমন তো নয়—তাঁরাও গিয়েছেন; একেক জন একেক রকমভাবে বাংলাদেশে পৌঁছেছেনও। কিন্তু মোহাম্মদ রফিকের যাওয়াটাকে এতো চোখে লাগে কেন? কেনই বা প্রথম পাঠে তাঁর যাওয়ার ধরনটিকে অন্যদের থেকে পৃথক মনে হয়? সম্ভবত তা এ কারণে: এই কবি নেহাত যাওয়ার খেয়ালে কোথাও যান না, তাঁর যাওয়াটাও হয় অনেক বেশি সংহত, পরিকল্পিত এবং দূরবিস্তারী- ব্যাপকও বটে। বাঙলার যে জায়গাটিকে তিনি তাঁর হাতের তালুর মতো চেনেন- জানেন ঠিক ঐ জায়গায় পৌঁছাতে আগ্রহী হওয়ার শুরু থেকে তাঁর যাত্রা হয়ে ওঠে নিবিষ্ট ও ব্যাপক। উত্তররৈবিক বাংলা কবিতার জগতে মোহাম্মদ রফিক তাই পাঠকের কাছে এক আকর্ষনীয় চরিত্র-আঙ্গিক এবং ভাববস্তু দুদিক থেকেই।’
প্রকৃত প্রস্তাবে মোহাম্মদ রফিক তাঁর কবিতায় বাংলাদেশকেই খুঁজে ফিরেছেন। বাংলাদেশকেই তুলে এনেছেন। এই তুলে আনার মধ্যে তার যে স্বাতন্ত্র্য তাই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে। ত্রিশের দশকে আমরা কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেভাবে বাংলাদেশকে পাই অথবা এ দশকেরই আরেক কবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় যেভাবে বাংলাদেশকে পাই, তারা কবিতায় যেভাবে বাংলা এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন, তার সঙ্গেও মোহাম্মদ রফিকের কবিতার রয়েছে মোট দাগের পার্থক্য। আসলে পথ এক হলেও সেখানে পৌঁছানোর জন্য সবাই ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। মোহাম্মদ রফিক সেই কৌশলের সঙ্গে পথের দূরত্বের সমন্বয় ঘটিয়েছেন ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে ভিন্ন স্বরের। তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক যে বৃত্তাবদ্ধতা তার ভেতর থেকেই বের করে এনেছেন নিজের জন্য আলাদা ভূমি। যেখানে পাঠক স্বস্তির শ্বাস নিতে পারে। সঙ্গতিপূর্ণ জীবনের মধ্যে খুঁজে পেতে পারে নিজের আলাদা ভুবন।
তুমি এই তোমার হাতের মধ্যে নির্বিকার ভাঙা খেলনা এক,
হাঁটো চলো কথা বলো ভালোলাগা অথবা ভালো না লাগা
এই নিয়ে বেঁচে আছো;—পায়ে পায়ে ছিন্নমূল ঘাসের সবুজ
ধুলোমাখা, নৌকার বৈঠার ঘায়ে ছিন্নভিন্ন জলের আবর্ত মাঝে
পানারাশি ডোবে ভাসে নিরন্তর ডুবতে ডুবতে ভেসে থাকে;
তোমার তোমাকে নিয়ে কোনোদিন করবার কাজ ছিল কোনো!
(তুমি এই)
ষাটের দশকের কবিদের মাঝে যে বৈপরিত্যময় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কারও মাঝে জেগে ওঠা প্রতিবাদীসত্তা, কারও মাঝে অবক্ষয়ের সঙ্গে মিলে নিজের ভাবনাকে ডুবিয়ে দেওয়া, কারও মাঝে বিশ্লেষণীপ্রবণতা আবার কারও মাঝে পুরোপুরি বোদলেয়ারের আধুনিকতার আদলে নিমজ্জিত অন্ধকার আবার কোথাও কোথাও জীবনের সঙ্গে শিল্পের সমান্তরালে ভারসাম্যপূর্ণ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই সব কাব্যপ্রয়াসকে ধারণ করেই মোহাম্মদ রফিক নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। শিল্প সম্ভবনাহীন কোন পথে তিনি হাঁটতে চাননি শুরু থেকেই, বরং পরিকল্পিত এক কাব্যবোধকে ধারণ করে তিনি পূর্ণৃতার দিকে এগিয়েছেন। সেখানে উঠে এসেছে আনন্দের কথা, সেখানে উঠে এসেছে বেদনার কথা। সেখানে উঠে এসেছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রের কথা। সেখানে উঠে এসেছে মানুষের কথা—যে মানুষ, যে সময় পুরো বাংলাদেশের। কিন্তু এই উঠে আসার ভেতর দিয়ে তিনি কিন্তু কখনোই অতিমাত্রায় বর্ণনাশ্রয়ী হয়ে ওঠেননি। বরং শিল্পের পরিমিতি বোধ বজায় রেখে বরাবরই এড়িয়ে গেছেন পুনরাবৃত্তি ও অতিকথন। তার মোহাম্মদ রফিকের কবিতা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রেম, নিসর্গ, শহর, গ্রাম আর মানুষের সম্মিলিত মিশ্রণ। সামাজিক যন্ত্রণার সঙ্গে ব্যক্তির যন্ত্রণা তার আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে যা ষাটের দশকের প্রচল কবিতার বাইরে এক নতুন জগতের সন্ধান দেয়।
ওরা বলবে কাপুরুষ
ওরা কি জেনেছে
প্রতিরাতে শেয়ালের দল ওঁৎ পেতে বসে থাকে
হাঁসের খোপের ধারে-ধারে
হরিণের পিছে ছোটে বাঘ
ওরা কি দেখেছে
সাপের ফণার মুখে ভীত-ত্রস্ত ব্যাঙ
বাজের শানিত নখে মেষের শাবকওরা কি শুনেছে
সমস্ত আকাশ ফেটে হা-হা অট্টহাস
প্রতিটি ঘাসের মধ্যে আগুনের ক্ষিপ্ত হিসহিসওদেরও কি
অর্ধেক ছুরির ফলা গলার ভেতর
ওরাও কি
গলাকাটা রাজহাঁস তড়পাচ্ছে দাওয়ার ওপর
(কাপুরুষ)
মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সম্পর্কে ‘বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা: বিষয় ও প্রকরণ’ গ্রন্থের বাংলাদেশের প্রাক-ষাট দশকের কবিতা ও ষাটের কাব্যান্দোলন প্রবন্ধে বায়তুল্লাহ কাদেরী বলেছেন, ‘মোহাম্মদ রফিক ব্রাত্য ও প্রান্তের মানুষকে, তাদের জীবনাচরণ এবং নদীতীরবর্তী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনালেখ্যকেই মূলত তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন। বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক উপন্যাস ও ব্রাত্য জীবনচিত্র নিয়ে কথাসাহিত্যের উত্তুঙ্গ শিল্পসিদ্ধির পর কবিতায় মোহাম্মদ রফিকের প্রচেষ্টা নতুন এবং নিরীক্ষাধর্মী। জল ও জলকেন্দ্রিক মানুষ, সৌন্দর্যচিত্র তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে বর্ণনাত্মক রীতিতে। সে জন্য তাঁর ক্যানভাস বাংলাদেশের নদীতীর অঞ্চলের ব্রাত্যলোকসমাজ, সংস্কার ও মূল্যবোধ। স্বদেশ, নিসর্গ ও বাস্তবতায় তিনি ব্যবহার করেছেন লোকপুরাণ, রূপকথার অনুষঙ্গ এবং গ্রামীন সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গ।’
ষাঠের দশকের কবিতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই দশকের মূল প্রবণতার মধ্যে রয়েছে বর্ণনাভঙ্গি। বিবৃতিমূলক পঙ্ক্তির সঙ্গে সঙ্গে কবিরা নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে আত্মবিবৃতির ব্যবহার করেছেন। ফলে কবিতায় আমিত্ব প্রাধ্যান্য পেয়েছে। কবিতা হয়ে উঠেছে কোথাও কোথাও আত্মকেন্দ্রিক। মোহাম্মদ রফিকও কবিতায় বিবৃতি ব্যবহার করেছেন, আমিত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে তার আমির প্রকাশ কখনো আত্মগত হয়ে ওঠেনি। বরং তিনি যে আত্মকেন্দ্রিকতার ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন, সেখানে তার আত্মগত অভিজ্ঞতা সমাজের সঙ্গে মিলে একটি মিমাংসার সুর তৈরি করে। যেখানে পাঠকের পক্ষে খুব সহজেই নিজেকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ তৈরি হয়। যে আত্মজৈবনিক উপলব্দিকে মোহাম্মদ রফিক প্রকাশ করেন তাতে প্রতিফলন ঘটে সমাজের এবং সময়ের। আর এ সবের সমন্বয়ের ফলেই তার কবিতায় সরাসরি রাজনৈতিক না হলেও রাজনীতি থেকে তা নির্লিপ্ত না।
একদিন জনাকীর্ণ রাস্তার ওপর হয়তো কেউ
মোহাম্মাদ রফিক এই-যে, ফিরে তাকাতেই তার
প্রচণ্ড মুষ্টির ঘায়ে ছিটকে পড়ব, অসহায়
দরদর রক্তধারা নাইয়ে দেবে, গড়াব ধুলোয়;
কিংবা বন্দুকের নল তাক করে বুকের পাঁজরে
মাত্র একটি তীব্র শব্দে চোখের পাতার গাঢ়তর
পরতে-পরতে ক্রমে লেপ্টে যাবে স্থির অন্ধকারএকদিন জনাকীর্ণ রাস্তার ওপর হয়তো কেউ
রফিক এই-যে, ফিরে তাকাতে এ-সব কোনোকিছু
না বলে না করে শুধু মৃদু অবজ্ঞার হাসি ছুড়ে
যেন আমি যোগ্য নই কোনো ব্যবহারের, এমনি
মিশে যাবে হাজার লোকের মধ্যে, তাকে চিনতাম
কি চিনতাম না, একা নির্বিকার ভিড়ের ভেতর
দাঁড়িয়ে থাকব ঠাঁয় কিছুটা বিব্রত, আহত বা
(রফিক এই-যে)
সমাজ, সময় ও অভিজজ্ঞতার বৈচিত্র্য পেরিয়ে মোহাম্মদ রফিক অন্তর্ময়তার দিকেই যাত্রা করেছেন। কখনো কখনো তার ভাষা তার সুর কিছুটা চড়া হলেও তা তার মূল প্রবণতা নয়। তিনি কখনোই গতিহীন হননি, কখনোই লক্ষহীন হননি। ফলে অবসন্ন হলেও তিনি সময়ের অন্ধ অনুকরণ করেননি। গভীরভাবে সংকটকে অনুধাবন করেছেন, আর সেই অনুভব থেকেই ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে নিজের স্মৃতি, নিজের স্বপ্ন ও বক্তব্যকে ভাষারূপ দিয়েছেন। সেখানে সংকট আছে, সেখানে সম্ভবনা আছে, সেখানে দ্বন্দ্ব আছে, সেখানে নিঃসঙ্গতা আছে, সেখানে অভিজ্ঞতা আছে আর এই সব থাকার মধ্য দিয়েই তিনি পৌঁছুতে চেয়েছেন বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডে। সমকালীন সময়, জীবন ও সমাজচৈতন্যের প্রতিচ্ছবি তার কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠলেও তিনি ব্যক্তির অর্ন্তজগত ঘিরে যে আর্তনাদ, যে হাহাকার তাকে কখনোই অস্বীকার করেননি। বরং এ সবের মিলিত রূপের মাধ্যমে তিনি পৌঁছুতে চেয়েছেন—কবিসত্তার মুক্তি দিতে চেয়েছেন। তাই তার কবিতা একদিকে হয়ে উঠেছে সমাজঘনিষ্ঠ। তেমনি অন্যদিকে তা জীবনঘনিষ্ঠও। ফলে পাঠক কবির আত্মপরিক্রমার ভেতর দিয়ে খুঁজে পায় অস্তিত্বের সন্ধানে ছুটে চলা ধ্যান ও ধারণা।
ছেলে নিলি স্বামী নিলি একটিমাত্র মেয়ে তাকে নিলি
কী আর করবি তুই বড়জোড় আমাকেও নিবি,
কার্তিকের ভোরবেলা বকুলের কান্নামাখা কুঁড়ি
পড়ে আছে, তার সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক ভারী গাঢ়;যদি প্রতারণা করে সবাই ঠকায় যদি ফেরৎ
সারা রাত উন্মাদ জ্যোৎস্নায় বুনো হু হু হাওয়া চিরে
একঝাঁক বাদুড়ের ডানায় নিকষ কালো ছায়া
ছোটে পার হয়ে বিল আদিগন্ত ঘন ধানক্ষেত;
ওই কামিনীর ঝাড় আমার নিজের হাতে পোঁতা,
মাতোয়ারা ফুলে ফুলে মেউলা স্মৃতির ভেজা ভূঁয়ে
একটা গোখরো সাপ আকাল বাসা বেঁধে আছে;
সবকিছু খেয়েখুয়ে সতেরোয় কিশোরী বিধবাএক জন্ম চলে গেল খররোদে দগ্ধ চামেলির
পোড়া ঘ্রাণ; এই বেলা আরও কিছু কাজ বাকি পড়ে
ঘাট থেকে জল এনে গাইটাকে কিছু খড়কুটো;
পিঠে কটা খেয়ে নাও তোমরা বাবা বেঁচেবর্তে থেকো
(ই: কীর্তিনাশা)
সবসময়ই বাস্তবকে কল্পনা, অতিবাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে জীবনের একটি নতুন ভাষ্য নির্মাণ করতে চেয়েছেন মোহাম্মদ রফিক। তিনি জটিল নন, কবিতার প্রকাশে কখনোই অতিমাত্রায় বিমূর্ত নন। তাই তার কবিতা আকর্ষনীয়। তিনি কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হলেও সেখানে শক্তিশালী অনূভতিপ্রবণতার কারণে তার ইন্দ্রিয়ের জন্য অস্বস্তিকর নয়। তার কবিতা আমাদের অনুভূতিতে সৃষ্টি করে দৃশ্যমানতা সেখানে শিল্পীর নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে জেগে ওঠে ধ্বনির বিস্তার। যা ইন্দ্রিয়কে একই সঙ্গে জাগিয়ে তোলে ও দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাঝে ভাবনার উপরিতলকেই শুধু নয়, ভেতরকেও নাড়ায়।
নিজের নিকট নিচ খুব-খুব ছোট হয়ে গেলে
কী-রকম লাগে; জেনে, না-জানার ভান স্বস্তিকর;
বিড়বিড় করে কবি, বিপ্লব বিপ্লব; কিন্তু, তবু,
অজান্তেই শক্ত হয়ে আসে মুঠি; রাজধানী দূর
নারানপুরের পথ কমে এলে ঠিক জানা যাবে
সমাধান কোন পথে; বাবার আলীর ছনচালানতুন জোয়ার ঢলে পলিমাটি নারানপুরের
সত্তর হাজার গাঁও-গ্রাম মাঠ কবিতার খাতা
ফুলে-ফেঁপে ফেটে পড়বে কামিনীর পূর্ণিমা পূর্ণিমা
(৬ : নান্দীপাঠ)
মোহাম্মদ রফিক কখনো কখনো খুব ছোট পরিসরের কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন দীর্ঘকবিতা। তার আঙুলে ফুটে উঠেছে বিশদভাষার দীর্ঘ বণর্না। নতুন কোনো কাব্যভাষা নির্মাণে ব্রতী না হয়েও তিনি প্রকৃতি নিসর্গ এবং মানুষের মধ্য দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। রঙিন চটকদার কোনো আবেগের প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়েও তিনি প্রবলভাবে জীবনঘনিষ্ট। মুহূর্তের আবেগকেও তিনি সংবেদনশীলতায় অনায়াসে তুলে এনেছেন। আর এই তুলে আনার পথে তিনি শুরু থেকে কবিতায় সচেতনভাবে যে পথ নির্মাণের চেষ্টা করেছেন, তা থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। তাই তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ স্বতন্ত্র হলেও তাদের মাঝে রয়েছে নৈকট্য। তাদের মাঝে রয়েছে সেতুবন্ধনের প্রচেষ্টা। মোহাম্মদ রফিক নিজেকে পরিবর্তন করেছেন, সেই পরিবর্তন তার বর্ণনায়, তার ভঙ্গিতে কিন্তু চিন্তার যে ঐক্যসূত্র তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন, যে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চেয়েছেন তাতে কোন পরিবর্তন আনেননি। তার উচ্চারণের হার্দিক ছোঁয়ায় পাঠক বাংলা কবিতার ঐতিহ্যবাহী ধারাবাহিক উত্তরাধিকারের যে সুর শুনতে পায়, তাতে নতুনত্ব যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শেকড়ের প্রতি বিশ্বস্ততা। ফলে মেদবর্জিত কবিতার মাধ্যমে মোহাম্মদ রফিক বাংল কবিতার পাঠককে যে পৃথিবীর দুয়ার খুলে দেন, সেখানে উদ্দীপ্ত হওয়ার মতো, আবেগায়িত হওয়ার মতো, চিন্তার নতুন উদ্ভাসে উদ্ভাসিত হওয়ার মতো উপাদানের অভাব হয় না। অনুভূতিকে ধরে রাখতে তার প্রতীক-উপাদান নির্বাচন খুঁজে পাওয়া যায় প্রতিটি কবিতার শরীরে। অভিজ্ঞতার সাযুজ্য দিয়ে তিনি মানব মনের নির্ভৃততম স্থানের যে দৃশ্যায়ন করেন, তা ইন্দ্রিয়ের জন্য যেমন সুখকর তেমনি চিন্তার ব্যাপকতাকেও তুলে ধরে।