মৃত্যুর সৃজনশীলতা
অন্ধকার রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে খালি চোখে আমরা যা দেখি, যেমন দেখি, লক্ষ লক্ষ বছর আগের নগ্ন মানুষেরাও ঠিক তেমনই দেখত। অন্তহীন মহাকাশে তেমন পরিবর্তন নেই অথচ ভূপৃষ্ঠে বিবর্তন ও পরিবর্তন ঘটে গেছে কত হাজার প্রকারের। এ বিবর্তনের নাম সভ্যতা আর পরিবর্তনের নাম প্রগতি।
সেই নগ্ন মানুষেরা আজকের আমাদের মতোই মৃত্যু নিয়ে ভয়জনিত কারণে ভাবতে শিখেছিল। মানুষের রহস্যজনক জন্ম আর ভীতিজনক মৃত্যু জীবনেরই দুই পাশে বন্ধনী হয়ে ঘিরে আছে। জন্ম নিলেই মরতে হবে, এটাই মহাসত্য। চোখের সামনে মানুষ মরে, পচে মেশে মাটিতে। আদিম মানুষের ধারণা হলো, মাটিই মানুষের উৎস। পানিতে পড়লেও একদিন মিশে যায়। তখন ভাবল, পানিই আদি উৎস। আগুনে পুড়লেও ভষ্ম হয়ে যায়, আবার ভাবল আগুন থেকেই মানুষের সৃষ্টি। এভাবে আগুন, পানি, মাটি ও বায়ুকে শক্তি ভাবা হলো। শক্তি মাত্রই ভক্তিযোগ্য। এভাবে শক্তিশালী বস্তু কিংবা অবস্তুগত ধারণার শক্তি অনুমান করল মানুষ। ভক্তি ও বিশ্বাসের বিবর্তন ঘটতে থাকে, মাঝখানে লাভের লাভ অভিজ্ঞতাটুকু। মানুষের বিশ্বাসের এমন স্তরটিকে আজকের আমরা লক্ষ লক্ষ বছরের পরের মানুষেরা নাম দিয়েছি সর্বপ্রাণবাদ। সেই আদিম মানুষেরা হয়তো কোনো নামই দেয়নি। তখনো সব বস্তুর নাম রাখার প্রচলন হয়নি। চিন্তার নাম দেবে কোথা থেকে? বড়জোর চিন্তনীয় বিষয়গুলোর নাম রেখেছিল। আমাদের দেওয়া নাম হলেও মানুষের প্রথম মতবাদ সর্বপ্রাণবাদ।
মৃত্যুর ভয়ে মানুষ মহামারীর সময় দৌড়ে পালায় নতুন দেশে; কিন্তু সে দেশও মৃত্যুহীন নয়। লাভ হলো ভূগোল বিদ্যার অভিজ্ঞতা। মৃত্যুর ভয়ে মানুষ বিচ্ছিন্ন চিন্তাকে ঐক্যসূত্রে স্থাপন করল, মৃত্যু দূর হলো না। কিন্তু জন্ম হলো দর্শনশাস্ত্রের। মৃত্যুর ভয়ে মানুষ নানা আচার-উপাচার চালু করল বিশ্বাসের সঙ্গে মিশিয়ে; মানুষ অমর হলো না। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হলো ধর্মশাস্ত্রের। মৃত্যু ঠেকানোর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে, সুসংগঠিতভাবে বসবাস করতে শিখল, জন্ম হলো সমাজ-সভ্যতার। এভাবে মৃত্যুকে জয় করতে গিয়ে মানুষ একের পর এক মৌলিক শাস্ত্র উদ্ভাবন করল, এগিয়ে চলল মানবসমাজ। এদিক থেকে বিচার করলে মৃত্যুকে খুবই সৃজনশীল মনে হয়।
তবে মৃত্যু আজ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর। সভ্যতা অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। প্রযুক্তিবিদ্যার আবিষ্কারও পাল্টা বিস্ময়কর। কিন্ত জন্ম-মৃত্যু আর জীবনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। দেশকাল অনুযায়ী কিছু ধারণা তৈরি হয় মাত্র; কিন্তু মহাকালের দৃষ্টিতে সেসব ধারণাকে খুবই হাস্যকর এবং ছেলেখেলা মনে হয়। মানুষের সেসব ধারণাকে আমরা মতবাদ বলি। সর্বপ্রাণবাদ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত এসেছে এবং গেছে এমন অনেক মতবাদ।
মানুষের মতবাদ
মানুষের মতবাদ কী? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। মানুষের মতবাদের শেষ নেই। মতবাদ মানুষের মুক্তির আশা; পথপ্রদর্শক। রামকৃষ্ণ পরম হংসদেব বললেন, যতজন তত মন, যত মত তত পথ। খুব সুন্দর সমন্বয়বাদী এবং বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের কথা এটি। কিন্তু স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ তা ঐক্যমুখী নয় বরং বিচ্ছিন্নতাবাদী। প্রতিজনের মন যদি মত হয় এবং প্রতিটি মতই যদি পথ হয় তা হলে হিটলার-মুসোলিনির মতবাদও স্বীকৃতি পায়।
প্রতিটি মত যদি পথ হতে পারত, তাহলে সোরেন কিয়ের্কেগার্দের অস্তিত্ববাদী দর্শন কাফকা-কামুর হাতে এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতো না। এ দর্শনের প্রভাবে আর্নেস্ট হেমিংওয়েসহ অনেক কবিসাহিত্যিক এবং অনেক ভক্ত পাঠক তরুণ-তরুণী আত্মঘাতী হয়েছে। আবার মানুষ নিজস্ব মত স্থগিত রেখে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছে রুশ-বিপ্লব করেছিল। কিন্তু সেখানেও কি মুক্তি মিলেছে? তাহলে মায়াকোভস্কি-ইয়েসেনিনের আত্মহনন কেন? আবার প্রশ্ন জাগে তাহলে মানুষের মতবাদ কী?
দেশকালের প্রয়োজনে নানা মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কালের বিবর্তনে অনেক মতবাদ বিবর্তিত বা বিলুপ্ত হয়েছে। ধর্মই যেহেতু পুরনো বিদ্যা তাই প্রাচীন মতবাদগুলো মূলত ধর্মীয় মতবাদ। এরপরে দার্শনিক মতবাদ এসেছে। ধর্ম থেকে বেরিয়ে দর্শনতত্ত্ব নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে অনেক সংগ্রাম করে। এরপর বৈজ্ঞানিক মতবাদ, শিল্প-সাহিত্যের মতবাদ-রাজনৈতিক মতবাদ, অর্থনৈতিক মতবাদ, সামাজিক মতবাদসহ অনেক মতবাদ উদ্ভূত ও বিকশিত হযেছে, আবার বিবর্তিত কিংবা বিলুপ্তও হয়েছে।
মতবাদে মতবাদে সংঘর্ষ এবং সমন্বয় স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের এই বাংলায় সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের গীতিকাগুলো বৌদ্ধধর্মের মহাযানপন্থীদের একটি উপশাখা সহজিয়াদের মতবাদকে কেন্দ্র করে রচিত। এ মতবাদ অন্য মতবাদ থেকে পৃথক; কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে সমন্বয় করেছে। এভাবে বৈষ্ণব মতবাদের লোকেরা বৈষ্ণবপদাবলি রচনা করত এবং গাইত অথবা শুনত। আবার তাদের প্রতিপক্ষ শাক্তদের সাহিত্যও প্রচলিত ছিল। নাথপন্থীদেরও একটা ধারা প্রচলিত ছিল। তারা মানিক চাঁদ, গোরক্ষনাথ এবং ময়নামতির গান গাইত-শুনত। মধ্যযুগের মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যেও নানা মতবাদ প্রচলিত ছিল। যেমন সৈয়দ সুলতানের পীরবাদ, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং মারেফতপন্থী। অন্যদিকে শরীয়তনামা গ্রন্থের লেখক খোন্দকার নসরুল্লাহকে দেখা যায় উনিশ শতকের ওহাবি-ফরাজি আন্দোলনের পূর্বসূরি মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী হিসেবে। যদিও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মতবাদের দ্বন্দ্ব খুব প্রকট ছিল না সুন্নি অধ্যুষিত বলে। তবু নানা মতবাদ এ দেশে প্রচলিত ছিল।
চিন্তাধারায় পুনর্গঠন: মতের পরিবর্তন
আধুনিক যুগে এসে উনিশ শতকে পাশ্চাত্যে চিন্তাধারার পুনর্গঠন করা হয। তখন অধিবিদ্যা থেকে অমীমাংসিত বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়। এরপরে মৃত্যুকে মানুষ স্বাভাবিক ঘটনা বলে ভাবতে থাকে এবং অপমৃত্যু বা অকালমৃত্যুকে ইস্যু ধরে নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান সমাজকল্যাণ, এবং অর্থনীতিতে রোধ করার জন্য কাজ করে। এরপর থেকে মৃত্যু নিয়ে অধিক দুশ্চিন্তাকে ব্যক্তিসত্তার অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব বলে বিবেচনা করা হয়।
এটা সত্য যে, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ মৃত্যু নিয়ে ভেবেছে। রহস্যভেদ করতে পারেনি। তাই একে পুনর্গঠিত চিন্তা থেকে বাদ দেওয় হয়। এদিক থেকে দর্শন দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। কিন্তু একটা সমস্যা রয়ে গেছে। যা দেখা গেছে বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে উল্লিখিত অস্তিত্ত্ববাদী দর্শনের প্রভাবে। কাফকা-কামু অস্তিত্ববাদী ভাবনায় নেতিবাচক অবস্থানে চলে যান। হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করে মার্কিন সমাজে অস্তিত্ববাদী চিন্তার বীজ বপন করেন। একইভাবে জাপানেও ঔপন্যাসিক সামুদাজাই আত্মহত্যা করে অস্তিত্বকেই মূল্যবান বলে প্রাচ্য সমাজে জানান দেন। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ অস্তিত্বের প্রশ্নে ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সহানুভূতি দেখান। এবং ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তে মুহাম্মদ মুস্তাফার আত্মহত্যাকে অনিবার্য পরিণতি দেখান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপে, ভিয়েৎনাম যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুচিন্তা নতুন করে আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করে। ভারত-উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষ, দেশবিভাগ, দাঙ্গা, যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে মৃত্যু দুভাবে আলোচিত হতে থাকে হত্যা এবং আত্ম হত্যা হিসেবে। সাময়িক সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার পরে আবার মৃত্যুচিন্তাকে মানসিক বিকৃতি বলে আড়ালে পাঠিয়ে দিয়ে জীবন ও বাস্তবতা নিযে সমাজ সভ্যতা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সমাজতন্ত্র নামক স্বপ্নের বাজারটি দেউলিয়া হতে শুরু করেছে ভেতরে ভেতরে। এবং বহুমাত্রিক মিডিয়া মানুষের ঈশ্বর হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তি আর প্রগতি নিয়েই মানুষ ব্যস্ত রইল।
কিন্তু চাপাপড়া মৃত্যুচিন্তা আবার সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যা এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ। ব্যক্তি মানুষ সারাজীবন প্রযক্তি এবং প্রণতি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বার্ধক্যে এসে মৃত্যুচিন্তার কবলে পড়ে না জেনে না বুঝে প্রায় বিনা শর্তে ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। এতে ধর্মবাদীরা উৎসাহী হচ্ছিল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নরাজ্যের পতনের পরে ধর্মবাদ হয়ে উঠে দিগ্বিজয়ী ভয়ঙ্কর অভিযাত্রী।
মিডিয়ার আড়ালের সাধারণ মানুষদের ধর্মচিন্তা-মৃত্যুচিন্তা খুব বেশি সংক্রমিত না হলেও তারকাজগতের লোকদের বিশ্বাস খুবই প্রভাবশালী। বিশ্ব পপ গানের সম্রাজ্ঞী ম্যাডোনা একসময় গেয়েছেন Papa don’t preach. ক্রুশকাঠে আগুন লাগিয়ে পোপের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সেই ম্যাডোনা পরে ভারতে এসে কুম্ভস্নানে অংশ নেন; রুমি ফ্যান ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হন। সবশেষে নিজেই কাব্বালা ধর্ম preach করে বেড়ান। মাইকেল জ্যাকসনও মুসলমান হয়েছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে আস্তানা গেড়েছিলেন। এমন অনেক তারকা ধর্মান্তরিত এবং ধর্মে নিমজ্জিত হয়েছেন। পাকিস্তানে ক্রিকেট তারকা ইউসুফ ইউহানা ভারতে সাহিত্যিক কমলা দাশ, গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায় ধর্মান্তরিত হয়েছেন। শত্রুঘ্ন সিনহাসহ অনেক তারকা কট্টর ধর্মবাদে দীক্ষিত হয়েছেন। বামপন্থী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও মানবতাবাদী শিল্পী ভূপেন হাজারিকার বার্ধক্যজনিত পরিণতিও একই রকম।
বাংলা সাহিত্যে অবশ্য এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেচে। সেই উনিশ শতকে বঙ্কিম চন্দ্র আনন্দমঠ সীতারাম আর কৃষ্ণচরিত্র লিখে কট্টর হিন্দু হয়েছিলেন বার্ধক্যে এসে। বিশ শতকের আধুনিকতাবাদের প্রবক্তা বুদ্ধদেব বসু মহাভারত এ অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসে বামপন্থী বিষ্ণু দে ঈশাবাক্য দিবানিশায় ডুব দিয়েছিলেন শেষ বয়সে। শীর্ষেন্দুর অনুকুল ঠাকুরে কিংবা আল মাহমুদের ধর্মে ফেরা একই ধরনের ঘটনা। এসব কর্মকাণ্ড ধর্মীয় মৌলবাদকে শুধু সমর্থনই করে না, প্রচণ্ডভাবে প্ররোচিতও করে।
অবস্থা দেখে মনে হয়, ধর্ম সম্পর্কে তুমুল বিরোধিতার পরে আকস্মিকভাবে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে সারাজীবন রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ধর্মবিশ্বাসী থাকা অনেক ভালো। যেমন ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সুফী মোতাহার হোসেন। তারা ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন সারাজীবন। কিন্তু মৌলবাদকে উৎসাহিত করেননি। এ বিষয়টিই সোরেন কিয়ের্কেগার্দ প্রচার করেছেন। তার মতে, মানুষের জীবন তিনটি স্তর পার হয়। প্রথমত ভোগী, দ্বিতীয়ত নৈতিক, তৃতীয়ত ধর্মীয়। প্রথম জীবনে ভোগবাদী হয়ে কাটানোর পর কঠোর নৈতিক জীবনে যারা প্রবেশ করে, তাদের ভেতর চলে আসে কঠোরতা। সৃজনশীল ধার্মিকতা সবচেয়ে ভালো স্তর। তার দর্শনে অবশ্য খ্রিস্ট ধর্মের মিশ্রণের কারণে অনেকে তা গ্রহণ করতে চান না।
একবিংশ শতকের শুরুতে নাইন ইলেভেনের পরে সারাবিশ্বে আবার প্রশ্ন উঠছে মানুষের মতবাদ নিয়ে। মার্কিন শক্তির সামনে সজামতন্ত্রবাদ চিরকালই চক্ষুশূল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের বিশ্বপঞ্চশক্তির অংশীদার হওয়াটা তারা ভালো চোখে দেখেনি। এরপর কিউবার উত্থান, চে-গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো-চি-মিন-এর নায়কোচিত আবির্ভাবে মার্কিন ও তার মিত্রশক্তি ঠাণ্ডা মাথায়, স্থির সিদ্ধান্তে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। সারাবিশ্বে যত অঘটনা ঘটে, তার দায় চাপানো হয় সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির কাঁধে। এ থিম ধরে অনেক ডিটেকটিভ সাহিত্য লিখিত হয়েছে। সিনেমা তৈরি হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত থেকে আফগানিস্তানকে উদ্ধারের নামে পাকিস্তান-আফগান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্টবিরোধী বিভিন্ন বাহিনী গড়ে তুলে সশস্ত্র যুদ্ধে নামায় মার্কিন শক্তি। সোভিয়েত শক্তির পতন ঘটে। এরপর মার্কিন এবং তার মিত্রশক্তি মধ্য এশিয়ার তেলসম্পদ ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। দেশে-দেশে সরাসরি মার্কিন সেনাঘাঁটি স্থাপন করে।
এসব অঞ্চলের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর বেশির ভাগ নাগরিক ধর্ম হিসেবে ইসলাম বিশ্বাস ও পালন করে। তারা ছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজের আন্তর্জাতিকতাবাদী। কিন্তু মার্কিন আগ্রাসনের মুখ থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদী হওয়ার চেষ্টা করে। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাবাদ অত্র অঞ্চলে দানা বেঁধে ওঠার আগেই মার্কিন মিত্রশক্তির গণমাধ্যম তাদের পরিচয় তুলে ধরে উগ্রধর্মীয় মতবাদ হিসেবে। গণমাধ্যমে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরার জন্য তাদের পূর্ব-পরিকল্পিত বিভিন্ন জঙ্গিবাদী সংগঠন তো রয়েছেই। সশস্ত্র মুজাহিদদের ছবি দেখালেই যথেষ্ট।
নাইন ইলেভেনের ঘটনা এবং পরবর্তী ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে হিসাব মেলাতে পারেনি। মার্কিন ও মিত্রশক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা সত্ত্বেও কোনো জঙ্গিবাদী সংগঠন মস্কো, ক্রেমলিন, লেনিনগ্রাদ, বেইজিং কোথাও হামলা করতে পারেনি, ধর্মীয় বিশ্বাসগত ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও। সবরকম সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে দুর্বল এসব সংগঠনের পক্ষে পেন্টাগন ভবনে হামলা করা সম্ভব কি না? মার্কিন স্থলভূমিতে প্রবেশ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জাপানও হামলা করতে পারেনি। এরপরে মার্কিন মদদপুষ্ট সরকার দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদী হামলা হচ্ছে, হুমকি চলছে।
আর মার্কিন মিত্রশক্তির গণমাধ্যমে যত অঘটনের দায় চাপায় সেই পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর ও আশির দশকের কেজিবির মতো আল-কায়েদা নামক একটি জঙ্গিবাদী সংগঠনের ওপর। ঘটনাগুলোর ব্যাপকতা, শক্তিময়তা আকস্মিকতা, সূক্ষতা এবং সম্ভাব্যতা বিচার করলে মনে হয় আলকায়দা একটি বায়বীয় সংগঠন মাত্র; এবং ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামক আয়োজনটি কমিউনিস্টবিরোধী প্রকল্পের পরে মার্কিন প্রশাসনের দ্বিতীয় প্রকল্প মাত্র। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট ফিস্ক তো সংশয় প্রকাশ করেছিলেন আদৌ আল-কায়েদা বলে কোনো সংগঠন আছে কি না। এভাবেই দেশে দেশে মৌলবাদী বিশ্বাসের সঙ্গে জঙ্গিবাদী হিংস্রতা একাকার করে দেওয়া হয়। এভাবে পাইকারি হারে দোষারোপ করার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা মুখ লুকোবার সুযোগ পাচ্ছে।
পেন্টাগন ভবনে হামলার ঘটনা বাদ দিয়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা করতে ভালোবাসে। আর তার দেশের দুটি বিল্ডিং ধ্বংসের প্রতিশোধে এশিয়ার দু’টি দেশ ধ্বংস করা হয়। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অজুহাতে সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। এখন বলা হচ্ছে অনুমান মিথ্যা ছিল। সাদ্দামকে যমের দুয়ারে ঠেলে ঢোকানের পেছনের কারণগুলো স্পষ্ট। প্রথমেই তার অপরাধ জাতীয়তাবাদী শক্তি সংগঠিত করা। দ্বিতীয়ত তার পার্টির নাম বাথ সোশ্যালিস্ট পার্টি হওয়া।
মধ্যপ্রাচ্যের এসব ঘটনার ঢেউ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে মানবাধিকার সম্পর্কে স্পর্শকাতর সমাজে ইসলামি জঙ্গিবাদী সন্ধানের নামে যখন-তখন যাকে-তাকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা, বাড়ি-অফিস, কাগজ-পত্র তছনছ করার অধিকার দেওয়া হচ্ছে পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে। ক্রসফায়ার-এনকাউন্টারের নামে বিনা বিচারে নরহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। পাকিস্তানতো বটেই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিদার ভারতেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে। বাংলাদেশে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বেশ মজার। উগ্রবাদী কমিউনিস্টদের এভাবে হত্যা করা হলেও উগ্রবাদী ইসলামপন্থীদের করা হতো না। যা সমকালীন বিশ্ব থেকে ব্যতিক্রম। বরং এখানে জঙ্গিবাদীরা গ্রেপ্তার হলেই মাথায় বুলেটপ্রুফ হেলমেট আর গায়ে জ্যাকেট পরিয়ে সুরক্ষা করা হতো। আর একেই তাদের সহযোগী এবং সমর্থকরা আল্লাহর রহমত বলে প্রচার করতো। সরল বিশ্বাসী মানুষের মনে তা গ্রহণযোগ্যতাও পেত। এ ধরনের নাগরিক অধিকার হরণের ঘটনা ইন্দোনেশিয়া-জাপান-অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ঘটছে। তবে সম্প্রতি এ ধরনের পরিস্থিতির পরিবর্তন এদেশেও ঘটেছে। কোনো উগ্রপন্থীকেই এখন আর সুরক্ষা দেওয়া হয় না। বরং তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ সশস্ত্র অভিযান চলে।
সুসভ্য দেশে মানুষের প্রাণ-সম্মান-সম্পদ কোনো কিছুই এখন আর নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনেও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নিউইয়র্ক এয়ার ফোর্টে ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা কমল হাসানকে নগ্ন করে চেক করা হয়েছিল তিনি হিন্দু না মুসলিম নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। এরপর ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে কালামকে একটি মার্কিন কোম্পানির বিমানে দেহতল্লাশি করা হয়। এ ঘটনায় ভারতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পশ্চিমা সমাজে শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে, এমনকি মুসলমানদের মতো নাম থাকার কারণেই যখন-তখন হেনস্থা হতে হচ্ছে। এর বিপরীত ক্রিয়া ঘটছে মুসলিম অধ্যুষিত দেশের সমাজে। সেখানে মুক্ত চিন্তার, মুক্তবুদ্ধির ও মুক্তচর্চার যে কাউকে হেনস্থা করার সুযোগ পায় উগ্রবিশ্বাসীরা। তারা মনে করে ইসলামের শত্রুদের হাতের কাছে পাওয়া গেছে। এভাবে চর্চিত হচ্ছে বর্বরতা।
বর্তমান সময়ের এই অস্থিরতা মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে কোন মতবাদ? বর্তমানে প্রচলিত মতবাদগুলো নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে।
নানা পথ, নানা মত
ধর্মীয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক এবং সাহিত্যিক মতবাদ একইসঙ্গে দ্বান্দ্বিক এবং সমন্বয়মূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছে। প্রাচীন যুগ থেকেই অবশ্য সংস্কৃতির রূপান্তরের ভেতর দিয়ে এটা ঘটে আসছে। সার্বিক জটিলতার কারণে চলমান পরিস্থিতিতেও বেশ জটিল। যেমন:
ধর্মীয় তন্তুজাল
ধর্মীয় পরিস্থিতি মাকড়শার জালের মতো, কোথাও একটি অপরটিকে ভেদ করে যাচ্ছে, কোথাও রয়েছে ফাঁকা শূন্যতা; প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সর্বত্রই ধর্মীয় মতবাদ প্রচলিত আছে। এগুলো দুই ভাগে বিভক্ত। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক। অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে আপাত নিরীহ মনে হলেও তার ভেতরে অনেক শ্রেণীবিভাগ আছে। কেউ বিশুদ্ধ আত্মাবাদী, কেউ আচারে স্বাতন্ত্র্যবাদী। পীরবাদ-গুরুবাদ, সন্ন্যাসবাদ আবার উগ্র ও নম্র আছে। জীবনমুখী ও জগৎ বিমুখও রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও উদার ও উগ্র দুই ধরনের দেখা যায়। পাশ্চাত্যে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক, সোশ্যালিস্ট পার্টি ইত্যাদি রয়েছে যেমন, তেমন প্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোতে রয়েছে নানারূপ সংগঠন। কেউ মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পার্থিব স্বার্থে রাজনীতি করে; যেমন, মুসলীম লীগ। কেউ কুরআনের নামে দেড় হাজার বছরের পুরনো মূল্যবোধ সমাকালীন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেমন জামায়াতে ইসলামী। এমন হিন্দু-মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টান নানা ধর্মের হাজার হাজার সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। গড়পড়তা এসব সংগঠনের লক্ষ্য স্বসম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষা করা। অন্যদের ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। কোনো কোনো সংগঠন ক্ষমতায় গেলে অন্য ধর্মের লোকদের স্বার্থ দেখবে বলে তাদের গঠনতন্ত্রে কিছু আশার বাণী লিখে থাকে। সেসব লোকভুলানো হোক অথবা সদিচ্ছায় হোক ক্ষমতায় একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হলে অন্য ধর্মগুলো অবহেলিত হয় পরিস্থিতির কারণেই।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মতবাদের ব্যর্থতা থেকেই ধর্মীয় মতবাদে মানুষের আস্থা বাড়ে। একথা সত্য যে, ধর্মীয় সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে লোভনীয় প্রস্তাব না এলেও মানুষের বিশ্বাসের কাঁটা সেদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে পতনের পরে মানুষ অনেক বেশি খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি কিংবা বৌদ্ধ হয়েছে সারাবিশ্বে। যেসব শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত মতবাদ সোভিয়েত শক্তির শিরা-উপশিরা হিসেবে সচল ছিল, সেগুলো একসময় বিকল হয়েছে বলেই এমন পরিণতি।
নাইন-ইলেভেনের পরে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। মার্কিন মিত্রশক্তির ইহুদি-খ্রিস্টান শক্তির প্রচারে অপ্রচারে ইসলামি শক্তি সভ্যতার শক্র হিশেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছে উগ্রপন্থী মুসলমানরা। অন্য ধর্মবিশ্বাসীরা মুসলমানদের উত্থানে শঙ্কিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভেঙে পড়ছে এতে।
রাজনৈতিক ছক
রাজনৈতিক মতবাদগুলোর মধ্যে বর্তমানে বিশ্বে তিনটি ধারা শক্তিশালী। গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ, সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং সংকীর্ণ ধর্মীয় রাজনৈতিক মতবাদ।
ধর্মীয় দলগুলো শুধু স্বসম্প্রদায়ের কথা ভাবে। গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ যদি সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে পারে, তা হলে মানুষের কিছুটা মু্ক্তি দিতে পারে। আর যদি অর্থনৈতিক মতবাদ ধনতন্ত্রের সঙ্গে সমন্বয় করে তাহলে শুধু শাসকশ্রেণীর স্বার্থেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ সীমার বাইরে চলে গেলে তা অতি উগ্র হয়ে ওঠে। যেমন নাৎসি, ফ্যাসিস্ত ইত্যাদি। জাতীয়তাবাদ শুধু স্বজাতির স্বার্থ সংরক্ষণ করে। স্বজাতির লোকের জীবনের সমান মনে করে না অন্য জাতির জীবনের মূল্য। তাই মৃত্যু সেখানে অতি সস্তা। কত সহজে আত্মহত্যা করলেন জাপানের দুই মহান সাহিত্যিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাত আর ইয়কিও মিশিমা; স্বদেশের চেয়ে নিজেদের প্রাণ সস্তা মনে করে। জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে; কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত হলে তা রাষ্ট্রে ভাঙন ধরায়। বহুজাতিক রাষ্ট্রে উগ্রজাতীয়তাবাদ এ ধরনের ক্ষতি করে খুব বেশি।
আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই জাতীয়তাবাদী। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আর বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী। লীগপন্থীরা মনে করেন বিএনপি উগ্রজাতীয়তাবাদী, পূর্বতন শাসক পাকিস্তানিদের দোসর, তাদের মধ্যেকার ধর্মীয় উপাদান পাকিস্তানকে আকর্ষণ করে। আবার বিএনপিপন্থীরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদী, তাই তারা শুধু বাঙালির স্বার্থ দেখে, এদেশে বসবাসরত অবাঙালিদের স্বার্থ তাদের দ্বারা রক্ষা পায় না। উপরন্তু প্রতিবেশী দেশের বাঙালিদের আকর্ষণ করে। তাই এ দলটি ভারতপ্রীতি রক্ষা করে স্বদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে।
এ ধরনের পারস্পরিক সন্দেহমূলক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সীমান্ত প্রসঙ্গে কার্যকর থাকে। যেমন ভারত-পাকিস্তান, চীন-রাশিয়া, জাপান-কোরিয়া, আরব-ইরান, ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র, রুশ-জার্মান প্রভৃতি।
জাতীয়তাবাদ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মতবাদকে শাসন করে এবং সমন্বয় সাধন করে বেশি। জাতীয়তাবাদী মক্তি পরিচালিত রাষ্ট্রে দল বদল হলে সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও উন্নয়নে উত্থান-পতনের মতো তীব্র পরিবর্তন ঘটে। ভারতে গুজরাটে দাঙ্গা কিংবা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাও এসব কারণে ঘটে। শ্রীলঙ্কায় সিংহলিদের শোষণে পীড়িত তামিলদের নেতা প্রভাকরণকে হত্যা এবং তাদের আন্দোলন দমনের পেছনেও জাতীয়তাবাদের বিকৃতি সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশের জন্মও হয়েছে জাতীয়তাবাদী সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে।
সম্প্রতি জেগে ওঠা দার্শনিক মতবাদ উত্তর-আধুনিকতাবাদ যেভাবে ভাঙনের কথা বলে এবং বৃহত্তর ও কেন্দ্রের বিপক্ষে কথা বলে তা বৃহৎজাতীয়তা ভেঙে ক্ষুদ্র জাতীয়তার সমর্থন জোগাবে। এভাবে তা রাষ্ট্রের ভেতর প্রচলিত সব অসাম্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে। এ মতবাদ মানবতাবাদের সমর্থন করে কিন্তু তা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়।
মানবতার জন্য জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে কমিউনিজম, সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র। এ মতবাদ কার্যত মাওবাদ, লেনিনবাদ, স্ট্যালিনবাদ হলেও তত্ত্বগতভবে মার্কস-এঙ্গেলসের যৌথ সৃষ্টি মার্কসবাদের প্রয়োগ। লেনিনের হাতে কাগজের তত্ত্ব বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদ রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পরে স্ট্যালিন ক্ষমতায় এসে সমাজের চেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকেই প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ পদ্ধতি মানুষকে অসহিষ্ণু করে তোলে। মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের পক্ষে মানুষ মুক্তির জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সমর্থন ও সহযোগিতা করলেও স্ট্যালিন মৃত্যুকে অতি সস্তা করে দেন। এখন প্রশ্ন উঠছে: দলীয় ও আমলাতান্ত্রিক সুবিধাভোগী লোকজন ছাড়া অন্য কেউ স্ট্যালিনকে সমর্থন করতেন কি না? কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের জন্মগত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে বুকে গুলি চালানো কিংবা মুখে সুই-সুতো চালানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় সৃজনশীলতা থেমে গিয়ে বিশ্ব পঞ্চশক্তির অংশীদার হওয়ার শক্তি ও সাহস সঞ্চার করাই তার মূল কাজ ছিল।
তবে স্ট্যালিনবাদই মার্কসবাদের পূর্ণাঙ্গ উদাহরণ নয়। বলা যেতে পারে বিকৃতিমাত্র। মার্কসবাদ বিজ্ঞানসিদ্ধ বলে এটা পুরোপুরি পদ্ধতিনির্ভর। অন্য মতবাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংহতি তারও আছে। যেমন: মার্কস ১৮৫৩ সালে ভারতে ব্রিটিম শাসনের বিশ্লেষণে এশীয় অর্থনীতির ধারণা আলোচনায় লেখেন:
ক.
এ কথা সত্যি যে, ইংল্যান্ড তার স্বার্থসিদ্ধির প্রক্রিয়ায় ভারতে সমাজ-বিপ্লবের কারণ সৃষ্টি করছে এবং জোর করে তা ঘটানোর ধরণটাও বোকামি ছাড়া কিছু নয়। তবে তা প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন হচ্ছে, এশিয়ায় একটি মৌলিক সমাজবিপ্লব ছাড়া মানবসভ্যতা কি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে? যদি না পারে তা হলে সেই বিপ্লব বহন করে আনার অচেতন ঐতিহাসিক হাতিয়ার হয়ে উঠলে যা খুশি অপরাধ হোক না ইংল্যান্ডের।
এবং তিনি আরও লিখেছেন:
খ.
ভারতে ইংল্যান্ডকে দু’টো দায়িত্ব পালন করতে হবে। একটি ধ্বংসাত্মক. আরেকটি পুনরুৎপাদন জাতীয়। অর্থাৎ একটি হলো এশীয় সমাজের বিলোপ, অন্যটি হলো এশিয়ায় পশ্চিমা সমাজের বস্তুভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা।
মার্কসের এসব উক্তি অর্থশাস্ত্রের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিভিত্তিক হলেও সবার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। মার্কসের ভাবশিষ্য অ্যাডোয়ার্ড সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজম-এ প্রাচ্যবিদ্যার অংশ হিসেবে দেখেছেন। শুধু ওরিয়েন্টালিজম নয়, ভারতের জাতীয়তাবাদ, উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদ, ধর্মীয় মতবাদগুলো এবং এশিয় ধারণার কন্টিনেন্টালিজম কিংবা উত্তর আধুনিকতাবাদ সবাই একযোগে এর তীব্র বিরোধিতা করে। এই বিরোধের সুযোগ গ্রহণ করে ধর্মীয় মতবাদগুলো এবং পাশ্চাত্যের আরেক শক্তি উদার বুর্জোয়া ও পুঁজিবাদ। তারা প্রশ্ন করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী ঢুকতে পারলে মার্কিন সৈন্য ঢুকলে আপত্তি কেন? এ দুই শক্তির তত্ত্বগত ভিত্তিতো সাধারণ মানুষ বোঝে না।
ধর্মীয় মতবাদগুলো যেমন শিয়া-সুন্নি-কুর্দি, ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্ট-লুথেরান প্রভৃতি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত, জাতীয়তাবাদ যেমন, নানা উপজাতীয়তাবাদে বিভক্ত তেমনি মার্কসবাদও নানা দলে উপদলে বিভক্ত। মার্কসবাদ অনেক সময় জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছে যেমন, সোভিয়েত ইউনিয়নে; এবং যুগোশ্লাভ ইউনিয়নে আবার কখনো জাতীয়তাবাদকে গ্রহণও করেছে। চীন যে তাইওয়ানকে নিজের দাবি করে, তা কিসের জোরে?
শক্তিশালী রাজতন্ত্র মানুষের মুক্তির পথে বাধা বলেই এখন তা বিলুপ্তির পথে।
অর্থনীতির নানা স্রোত
বর্তমান বিশ্বে কোথাও বিশুদ্ধ কোনও অর্থতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত নেই। মার্কসবাদ ও পুঁজিবাদ এদুটি অর্থতত্ত্বের বাইরে আর কোনও শক্ত আর্থিক মতবাদ নেই। দুয়ের মিশ্রণে আছে মিশ্র অর্থনীতি, আরেকটি মুসলমানদের আবিষ্কার ইসলামি অর্থনীতি। মার্কসবাদী অর্থতত্ত্ব মার্কবাদী রাষ্ট্র ছাড়া প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এমনকি মার্কসবাদী রাষ্ট্রেও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। ব্রেজনেভের যুগের অর্থনৈতিক দুর্নীতি দূর করতে গর্বচেভ পেরোস্ত্রাইকা আর গ্লাসনস্ত-এর নামে পুঁজির জন্য জানালা খুলে দিয়েছেন। আর চীনতো এখন পুঁজিবাদীদের চেয়েও বেশি পুঁজিবাদী। সেখানে ধনীদরিদ্রের বৈষম্য আকাশ পরিমাণ। পয়সা থাকলেই নয়াচীনের রঙিন দুনিয়ায় বাস করতে পারে যে কেউ। মার্কসবাদ সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তি দিতে পারেনি সেখানে। পারেনি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে। প্রতিবিপ্লবে সোভিয়েতের পতনের পরে ভূমি পুনর্বণ্টিত হলে দলীয় নেতারাই নতুন ভূস্বামী হয়েছেন। ভূমিহীনরা ভূমিহীনই রয়ে গেছে।
পুঁজিবাদ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নয়। এখানে সবার প্রবেশাধিকার স্বীকৃত, কিন্তু সে অধিকার শুধু বিত্তবানরাই পায়। এ জগতে অর্থের সমুদ্রে ডুবেই অনেকে মারা যায়। মিশ্র অর্থনীতির দেশে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা মুক্ত এবং নিয়ন্ত্রিত দু’টি পদ্ধতিই নিয়ন্ত্রণ করে। ইসলামি অর্থনীতির নামে প্রচলিত অর্থ পদ্ধতিও একটি মিশ্র অর্থব্যবস্থা। টিকে থাকার স্বার্থে অনৈসলামিক দেশের সঙ্গে কথিত হারাম পদ্ধতিতেও তাদের লেনদেন করতে হয়। ধর্মপ্রাণ সরল মানুষের আস্থা আর আমানত নিয়ে পুঁজিপতি-শরীয়তপন্থীদের ব্যবসার পথ এটা।
আরও কিছু
সম্রাটশাসিত সাম্রাজ্যের বিস্তারের কর্মকাণ্ডকে সাম্রাজ্যবাদ বলা হলেও বর্তমান বিশ্বে কার্যকর সম্রাট নেই বলে সাম্রাজ্যবাদ নেই, তা নয়। ব্রিটিশ ও তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য ছিল শেষ প্রথাগত সাম্রাজ্যবাদ। অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতনের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদ্যানুরাগী সম্রাট হিরোহিতোর জাপানও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে লিপ্ত হয়। শিগগিরই তার পতন ঘটে। সম্রাটের শাসন না থাকলেও রাজ্যবিস্তার করেছিলেন জার্মানির হিটলারও। উভয় শক্তির পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অপ্রতিহত শক্তিতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের ঘটনায় নতুন শতাব্দীর একমাত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে আছে সে। সাম্রাজ্যবাদ ঘৃণিত হলেও উগ্র জাতীয়তাবাদ তা সমর্থন করে। সাদ্দামের কুয়েত দখল এমনই ছিল।
উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদ মূলত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মতবাদ। সব রকমের দখলদারীর বিরুদ্ধে সজাগ। এখানেও চূড়ান্ত সত্য নেই। দখলদারী শক্তির কল্যাণকর কর্মকাণ্ডে এ মতবাদ অস্বীকার করে। এ মতবাদ প্রগতিবাদকে ছেদ করে এগিয়ে যায়।
আবার প্রগতিবাদ পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিদ্যাভিত্তিক আলোকবর্তিকার ধারণাকে গ্রহণ করে। এ মতবাদ পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদ বা বিশ্বায়নকে সমর্থন করে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে প্রগতিবাদের কাঁধে চড়ে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ চলে আসতে পারে। এটি জনপ্রিয় মতবাদ হলেও উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্ম এর বিরুদ্ধে অবস্থান করে। সাম্প্রতিক জনপ্রিয় উত্তর-আধুনিকতাবাদও তাত্ত্বিকভাবে এর বিরোধী। প্রগতিবাদ মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে বিদেশি শক্তির অনুপ্রবেশে সহায়তা করে।
মানবতাবাদ অনেকটা অস্পষ্ট মতবাদ। সর্বভূক ও সর্বগ্রাসী প্রাণী মানুষের স্বার্থভিত্তিক এ মতবাদ পরিবেশ ও প্রাণী বৈচিত্র্য ধ্বংস করে। মানবসৃষ্ট সভ্যতার অভিযানে বিশ্বকে মানুষকেন্দ্রিক জগৎ মনে করে। মানবতাবাদ একা কিছু করতে পারে না। পুঁজিবাদ অথবা মার্কসবাদ অথবা কোনও ধর্মবাদের সঙ্গে মিশে থাকে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করলে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করলে শোষণের পথ সৃষ্টি হয়। ধর্মবাদের সহায়তা নিলে সমাজ হয়ে ওঠে মৌলবাদী।
প্রাচ্যবাদ প্রাচ্যের স্বার্থে প্রাচ্যকেই গুরত্বপূর্ণ মনে করে। এ মতবাদ যদি অনিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে পাশ্চাত্যের পরীক্ষিত জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন এবং শিল্পকলা কিংবা যন্ত্রশিল্পকে প্রত্যাখ্যান করে মানবমুক্তির পথকে রুদ্ধ করে দেয়। সমাজ ও রাষ্ট্র সমকাল থেকে পিছিয়ে পড়ে।
সমকালীন জনপ্রিয় আরেকটি মতবাদ—নারীবাদ। নারীর আত্মপরিচয়, তার অবস্থান এবং পরিবেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। নারীর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণে সহায়তা করে। সর্বস্তরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন করে। কিন্তু উগ্র হলে এ মতবাদ পুরুষের অধিকার অবহেলা করে। মানুষকে খণ্ডিতভাবে দেখার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এ মতবাদকে সহানুভূতি জানানোর সুযোগে সাম্রাজ্যাবাদ, উপনিবেশবাদ অনুপ্রবেশের সুযোগ পায়। নারীবাদ অন্য মতবাদের সঙ্গে যতটা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, ততটা সংহতি রক্ষা করতে পারে না। যেমন ভারতবর্ষে ক্ষুদিরামের ফাঁসিকে সমর্থন করে, কারণ ক্ষুদিরাম দু’জন নিরীহ নারীর হত্যাকারী পুরুষ। ইতিহাস পুনর্গঠন করতে গিয়ে এভাবে জাতীয়তাবাদকেও আঘাত করে। যেমন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পতনকেও কেউ কেউ সমর্থন করে। কারণ সিরাজ ঘসেটি বেগমের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তার ব্যক্তিগত স্বার্থের বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক বল প্রয়োগ করার পরেই ঘসেটি বেগম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সিরাজের শত্রুদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। সামাজিক জীবনে দেখা যায়, গৃহকর্ত্রীর হাতে কাজের ছেলে নির্যাতিত হলে নারীবাদ চুপ থাকে। কিন্তু গৃহকর্তার হাতে কাজের মেয়ে নির্যাতিত হলে সরব হয়। কিংবা নির্যাতিত কাজের ছেলে গৃহকর্ত্রীর গায়ে হাত তুললে বা মুখ খুললে তখনই নারীবাদ সরব হয়। এভাবে নারীবাদ খণ্ডিতভাবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে।
অস্তিত্ববাদের কথা আগেই কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। এ মতবাদকে আপদকালীন মনে হতে পারে। মৃত্যুচিন্তা থেকে এ মতবাদের সৃষ্টি। যুদ্ধ, দাঙ্গা, মহামারী, ভূমিকম্প, সড়ক বা নৌ দুর্ঘটনা ইত্যাদি পরিস্থিতিতে মানুষ অস্তিত্ব নিয়ে অীতমাত্রায় চিন্তাশীল হয়। সাঁর্ত্রের বা কিয়ের্কেগার্দের মতো ইতিবাচক হলে এ মতবাদ মানবমুক্তির পথ খূঁজতে সাহায্য করে। নেতিবাচক হলে মানুষকে আত্মঘাতী করে তোলে। সার্বিকভাবে এ মতবাদ বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগ্রত করে, মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে নিঃসঙ্গ এবং স্বার্থপর করে তোলে। ফলে সমাজ-সভ্যতায় আঘাত আসে। মানবতাবাদের সঙ্গে সমন্বয় করলে অস্তিত্ববাদ কিছুটা তরল হয়, তবে মানবজীবনকে সার্থক করতে পারে।
এ কথা সত্য—ব্যক্তিমানুষ একই সময় নানা মতবাদের আশ্রয় নিতে পারে। নিয়মের নিগড়ে মানুষকে বাঁধা যায় না। কর্মক্ষম সময়ে সমাজ-সভ্যতা, রাষ্ট্র ও জাতি কিংবা বিশ্বসভ্যতার স্বার্থে নানা মতবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বার্ধক্যে কিংবা পীড়াজনিত কারণে মৃত্যুচিন্তায় অস্তিত্ববাদই চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়ায়। বাঁচার আকুল আকাঙ্ক্ষায় কিংবা স্বেচ্ছামরণের প্রবল ইচ্ছায় অস্তিত্ববাদ উদ্ভট উটের গ্রীবার মতো ঘাড় তুলে তাকায়। অসহায় মানুষ যদি শূন্য আকাশে তাকায়, আর সেখানে বিশ্বাসযোগ্য আশ্রয় নেই। তা হলে মানুষের মতবাদ কী?