মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব
থেকে যায়;
: জীবনানন্দ দাশ
প্রিয় মাধবীলতা,
সেই কবে পৌষসংক্রান্তির আগে তোমাকে লিখেছিলাম। এখন চৈত্রসংক্রান্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েকদিন পরই বাংলা নববর্ষ। তবু যেন কোনো উন্মাদনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই। কোথাও। শহীদ কাদরী লিখেছিলেন, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’। অথচ আজ কান্নার কাফনে জড়ানো আমাদের স্বদেশ, পৃথিবী। কারণ তোমার কাছে অজানা নেই। এক মহামারী আমাদের অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে রেখেছে। ঘিরে রেখেছে আমাদের স্বপ্নগুলো হয়তো বা। না, ভুল বললাম। এই শত-সহস্রাব্দ বুড়ো পৃথিবীতে কত মহামারী, দূর্যোগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এসেছে, পতঙ্গের মতো মানুষ মরেছে, কিন্তু না মানুষের সম্পূর্ণ বিনাশ তো হয়নি। হবেও না। তাই বুঝি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়।’
ঠিকই তো। মানব থেকে যায়। থাকবে। তুমি আমি থাকবো না। তাকে কী? স্বপ্ন তো থাকবে। যুগে যুগে মানুষ স্বপ্ন দেখবেই। যতই অমানিশার ঘোর অন্ধকারে ঢেকে যাক বিস্তীর্ণ আকাশ, স্বপ্ন দেখা কখনো বন্ধ হবে কি? না। হবে না। জীবনানন্দ দাশের থেকেই মুষ্ঠিভিক্ষা করে বলতে হয়, ‘সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!’ পৃথিবীতে মানব থাকবে। থাকবে মানবের স্বপ্ন। চলো, এই মহামারীর কালে আমরা স্বপ্নের কথা বলি, কবিতার কথা বলি। এই স্বপ্ন, এই কবিতাই হয়তো আমাদের নিয়ে যাবে একটি স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের কাছে।
‘একটি নদী ভাঙতে ভাঙতে
প্রতিরোধের স্বপ্ন জাগায়’
আজ তোমাকে এমন একজন কবির কথা বলব, যিনি ‘পা যে আমার অনড় পাথর’ বলে বাংলা কবিতার জগতে সত্তর দশকে পা রেখেছিলেন। তিনি মুজিবুল হক কবীর (১১ এপ্রিল, ১৯৫২)। প্রথম কবিতা ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হলেও প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। দীর্ঘ দিনের কাব্যদেবীর আরাধনা করার পর। যার ফলে প্রথম কাব্যেই আমরা পাই পরিশীলিত, সিদ্ধহস্ত এক কবিকে। শিল্পের ডুরিতে বাঁধা তাঁর কবিতা। ১৯৭২ সাল থেকে নিরন্তর কবিতা চর্চা, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনে প্রতিনিয়ত তাঁর উপস্থিতি, প্রস্তুতিকাল পেরিয়ে গ্রন্থাকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের কারণে কাব্যপ্রেমীদের সমাদর পেয়েছেন সহজেই। হয়তো জনপ্রিয়তার গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারেননি কিন্তু সহৃদয় হৃদয়সংবেদী পাঠকের মনে ঠিকই ব্যঞ্জনার ঢেউ তুলতে পেরেছেন।
সত্তরের দশক ছিল যুদ্ধোত্তর কাল। সদ্যস্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে চলছিল পাওয়া, না পাওয়ার অনেক হিসেবে নিকেশ। সেই ঢেউ এসে লেগেছিল সাহিত্যের স্বর্ণালি শরীরেও। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, যুদ্ধোত্তর দেশের অনেক ঘটনা বদলে দিয়েছিল কবিতার শরীর, ভাষা, শব্দ। বদলে দিয়েছিল কবিদের দৃষ্টিকোণ। মুজিবুল হক কবীরের কবিতাতেও লেগেছিল সেই ঢেউ, সেই বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ। তাই প্রথম থেকে তাঁর কবিতার প্রবাহ অগ্রসর হয়েছে কখনো মানবীর দিকে, কখনো রাজনীতি অভিমুখে। একটি উত্তাল সময় পেরিয়ে আসার কারণেই হয়তো তাঁর কবিতায় প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক চিন্তা একটি প্রধান স্তম্ভ। তবে প্রেমও প্রবল প্রতাপে প্রবাহিত হয়েছে কবিতার বুকে। প্রেম-প্রেরণা যুগিয়েছে তাকে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, সমকাল ভাবনা দিয়ে নির্মাণ করেছেন তাঁর প্রেমের কবিতার, রাজনৈতিক কবিতার শরীর।
তবে আজ তোমাকে মুজিবুল হক কবীরের প্রেমের কবিতা নিয়ে কিছু বলব। তাঁর কবিতায় মানবী অপরাপর কবিদের কবিতার মতো স্মৃতিকাতরতার অনুষঙ্গ হয়ে এসেছে। যে চলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে স্মৃতিতে। নক্ষত্রের মতো না থেকেও আলো ছড়াচ্ছে। ‘নক্ষত্রের মতো না থেকেও আলো ছড়াচ্ছে’ কথাটির একটু ব্যাখ্যা করি। অনেক নক্ষত্র পৃথিবী থেকে এত এত দূরে অবস্থিত যে, সেই নক্ষত্রের আলো যখন পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়, হতে পারে তার আগেই মারা গেছে সেই নক্ষত্র। কিন্তু আমরা সেই আলো দেখে ভাবি নক্ষত্রটি এখনো জীবিত। তেমনি যে মানবী জীবন থেকে চলে গেছে, কিন্তু স্মৃতিতে সে এত প্রবলভাবে উপস্থিত যে আচ্ছন্ন করে রাখে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে। তাই মুজিবুল হক কবীর লিখেছেন,
স্মৃতির ভিতরে তুমি ব’সে থাকো নক্ষত্রপ্রতিম
দুপুরের জানালায় ক্লান্ত নতমুখ দেখি
আলুথালু চুল দেখি
চোখের শাসন দেখি
দেখি বয়সের জাগরণ;
এই দ্বিধা, এরকম ব’সে থাকা তোমাকে মানায়।
[স্মৃতির ভিতরে তুমি, পা যে আমার অনড় পাথর]
নক্ষত্রের মতো না থেকেও থাকার কারণে কবির মনে এমন বিভ্রম জাগে, অতীত বর্তমান হয়ে ধরা দেয়। কবির কাছে প্রেয়সী আশার প্রতীক। কবির ধারণা প্রেয়সীর আগমনে বদলে যাবে কবির জীবন। যেন সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি বদল করে কবিপ্রেয়সী বদলে দেবে কবিকে। নিরস্তঙ্গ জীবনকে করে তুলবে তরঙ্গায়িত। প্রেয়সীর আগমনে শূন্য ডালে পুনরায় পাখি ডাকবে। ভোরের আলো ফুটবে। কবি পেয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত শুভ দিন।
পরবর্তী সময়ে ইন্দ্র স্বীয় ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলে সেই সহস্র যোনী সহস্র চোখে পরিণত হয়।
‘পা যে আমার অনড় পাথর’ কাব্যের ‘এমন দিনে’ ও ‘স্বৈর মঞ্জরী’ কবিতায় কবি-প্রেয়সী আগমনের চিত্র ফুটে উঠেছে।কবিতা দুটোর কিছু অংশের পাঠ নেয়া যাক। তারপর এর নির্মাণ নিয়েও কিছু কথা বলব।
০১.
এমন দিনে আসবে তুমি
পাতা ঝরার শেষে
নগ্ন ডালে পাখিও নেই নেই
হাহাকারের রেশে
মুখর হ’বে সারাটি দিন
কাটবে নাতো বেলা,
শিশির কণা জমবে তূণে
পুরনো সেই খেলা।
[এমন দিনে]০২.
সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হ’লে তোমার আশ^াসে আমি
পেয়ে যাবো শুভদিন; সত্যিকার ছুটি পাবো
কর্ম-কোলাহল ভিড় থেকে।আত্মগত শব্দবর্ণে ভেসে যাবো একা
সামাজির ছল্ করে তুমি আসবে মৃন্ময়ী;
আমার বোধের অভ্যন্তরে জেগে র’বে মৃগতৃষ্ণা জল।
[স্বৈর মঞ্জরী]
‘এমন দিনে’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্তে লেখা। অর্থাৎ কবিতাটি স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত উভয় ছন্দে নির্ণয় করা যায়। ‘স্বৈর মঞ্জরী’ কবিতাটি লেখা মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। প্রসঙ্গক্রমে বলা রাখা যায়, মুজিবুল হক কবীর একজন ছন্দসচেতন কবি। তাঁর কবিতার শব্দগুলো ছন্দদ্বারা কঠিন ভাবে শাসিত হয়েছে। কিন্তু ছন্দের শৃঙ্খলে পড়ে শব্দগুলো হাফসাফ করে মরেনি, বরং মুক্তি পেয়েছে, স্বাধীনতা পেয়েছে ওড়ার।
যাই হোক, পুরোনো কথায় ফিরে আসি। কবিতা দুটো নির্মাণশৈলীর দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, কবিতা দুটো বলা হয়েছে ফিউচার টেন্সে মানে ভবিষ্যৎ কালে। সাধারণত কবিতার শরীরে ব্যবহৃত শব্দগুলো অতীত কাল বা বর্তমানকে প্রকাশ করে। এখানে ভবিষ্যৎ কালকে প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী হবে, না হবে, তা-ই এখানে বলা হয়েছে। ভবিষ্যৎ কাল ব্যবহার করে খুব কম কবিতাই বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে। গদ্যেও এর উদাহরণ হাতে গোণা। প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘তেলেনপোতা আবিষ্কার’ গল্পে প্রথম ভবিষ্যৎ কালের ব্যবহার করেছেন। সার্থকভাবেই করেছেন। এবং পথিকৃৎ হয়ে আছেন।
আবার কবিতা প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
কবির প্রেয়সী যখন ফিরে আসবে, সত্যিই কি বদলে যাবে দিনযাপন? না। তখন নানা কারণেই প্রেয়সীকে কাছে পেয়েও পাওয়া হয় না প্রত্যাশিত দিন, ক্ষণ। বৈরী সময়, রাজনীতি, জনতার দাবী পৌঁছাতে দেয় না অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কাছে, যেতে দেয় না টকটকে লাল গোলাপের কাছে। উপরিউক্ত কবিতাদ্বয়ের উত্তরভাষ্য পাই আমরা একই কাব্যের ‘এখন আমার নেই প্রয়োজন’ কবিতায়।
এখন আমার নেই প্রয়োজন
শিশির- ধোয়া টকটকে লাল গোলাপ,
এখন আমার নেই প্রয়োজন
একটু হৃদয়, ক্ষুদ্র মনস্তাপ।
আছি আমি, ভালোই আছি
এই জনতার কাছে;
এমন দিনে আসলে তুমি,
যখন আমার একটি পথই
শুধু খোলা আছে।
শুধু কি প্রয়োজনই কাঙ্ক্ষিতকে পাওয়ার পরেও পরিপূর্ণ হতে দেয় না স্বপ্ন, মেটাতে দেয় না পিপাসা? না কি অন্য কারণও আছে? ‘কী জানি কিসের আশায় মন করে হায় হায়’, তেমনি পাওয়ার পরও কেন যেন মনে হয় পাওয়া হয়নি।
তিনি লিখেছেন,
খুব কাছে আছো, তবুও যে কেন
মনে হয়, মৃত মাধুরীর কণা;
আনন্দ আছে, তবুও বেদনা
শুয়ে রয় পাশে নীরাঞ্জনা।
[নীরাঞ্জনা, পা যে আমার অনড় পাথর]
এই কবিতায় ছায়ার মতো মিশে আছেন ত্রিশের এক কবি। খুব সামান্য। তবু বলা যায়, আছেন। তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। মুজিবুল হক কবীর প্রথম থেকে নিজস্ব স্বরায়ণ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তবু ত্রিশের কবিদের কণ্ঠস্বর কোথাও কোথাও অনুরণন তুলেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে যে তার নিকটবর্তী, তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। শুধু কবিতার আমেজ তৈরিতেই নয়, কবিতাকে সৌধের মতো নিটোল করতে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি সুধীন্দ্রনাথের সহচরী। গদ্যেও তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে মান্যবর হিসেবে বরণ করেছেন। কবিতাতে পরবর্তী সময় মুজিবুল হক কবীর নির্মাণ করেছেন নিজস্বকাব্যভাষা। মূলত প্রথম কাব্যেই তার মৌলিক স্বরায়ণের অনুরণন শুনি, প্রভাব অল্প বিস্তর যা ছিল, বেশ ভালোভাবেই তিনি তা কাটিয়ে উঠেছেন। তাঁর স্বনির্মিত ভাষা শুধু একই ধারায় প্রবাহিত হয়নি, ‘শূন্যে বেঁধেছি ঘর’ (২০১৫) কাব্যে এসে বাঁকও নিয়েছে।
নারীকে পাওয়ার পরও যে হাহাকার, শূন্যতা, নৈঃসঙ্গতাবোধ; এই বোধ দ্বিতীয় কাব্য ‘ লোপামুদ্রা ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৯১) পেরিয়ে এসে তৃতীয় কাব্য ‘আমি ও আমার প্রতিবিম্ব’ (২০০০)-তেও পাই। ‘নাই’ কবিতায় আমরা কবিকে বলতে শুনি,
আছে আছে আছে
গব কিছুই আছে
জীবনজুড়ে নারী
ঘর- গেরস্থি খেলনা শিশু বাড়ি,
তবু আমার কি যেনো কী চাই
বুকের ভেতর শোকের মতো
মোচড় খেয়ে ওঠে
কি যেন কী নাই।
এই না পাওয়া বোধ প্রলম্বিত হয়েছে তাঁর পরবর্তী কাব্যগুলোতেও। হয়তো এই হাহাকার, শূন্যতাবোধের জন্যেই কবি কবিতা লেখে, শিল্পী ছবি আঁকে, ভাস্কর ভাস্কর্য সৃষ্টি করেন। তাই এই নৈঃসঙ্গ্যবোধ থাকবেই, হাহাকার থাকবেই।
কবি শুধু অতিন্দ্রিয় মানবীকেই কামনা করেনি, তাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেননি বরং ইন্দ্রিয়স্পর্শ করা নারীকেও কবিতায় তুলে এনেছেন। নারীর অঙ্গ তাঁর কাছে সৌন্দর্যের আঁধার। চিরচেনা নারীও তার কাছে ধরা দেয় অচেনা সৌন্দর্যের ধারক হিসেবে। নারীর স্তন শুধু কবিকেই প্রলুব্ধ করে না, মাছিকেও করে তোলে রমণপ্রিয়।
তিনি লিখেছেন,
ঘুমন্ত স্তনাগ্রে বসে আছে একটি রমণপ্রিয় মাছি
ডানা ঝাড়ছে, যেন স্নানরত চড়ুই, কখনো উড়ছে,
কখনো চক্কর দিয়ে বিমানের মতো বুকের রানওয়েতে
নামছে’
[মাছি, আমি ও আমার প্রতিবিম্ব]
নারী রহস্যময়ী। চিরচেনা হয়ে অচেনা। সৌন্দর্যের ক্ষেত্রভূমি। এ সৌন্দর্য আবিষ্কার করে নিতে হয়। খুঁজে নিতে হয়। আটপৌরে জীবনের নারী হয়ে উঠতে পারে অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের ধারক।
মুজিবুল হক কবীর লিখেছেন,
তোমার মুখ ও চিবুক এবং স্তন
এমন ভঙ্গিতে
কখনো আবিষ্কার করিনি।
রমণপ্রিয় মাছিটি জানে না সে কী এক
অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য-শিখরে বসে আছে।
[মাছি, আমি ও আমার প্রতিবিম্ব]
পূর্বেই বলেছি, কবির প্রেম শুধু অতিন্দ্রিয় নয়, প্রেয়সীকে তিনি কামনা করেন ‘ইন্দ্রিয় ঘরনায়, নগ্ন কলায়, সঙ্গে আসঙ্গে, রঙ্গে বিভঙ্গে’। প্রেয়সীর জন্য কবির মনে সুতীব্র কাম উত্তাল ঝড় তোলে। ব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে দেয়। তাঁর তীব্র কাম বোঝাতে পুরাণের চরিত্রকে বিনির্মাণ করে সাজিয়েছেন। দিয়েছেন নতুন দ্যোতনা।
প্রেয়সীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন,
যদি আসে ব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে বৃষ্টি
যদি হাওয়ায় জাগে কদমরেণুর
মাদকতা,
তবেই তুমি হও কিশোরী রাধা
আর আমি ইন্দ্র।
[ইন্দ্রিয়ের ঘরনায়, রাতের শিরায় আগুন]
বাংলা সাহিত্যে প্রেমের প্রতিমূর্তি রাধা। আর রাধার নাম বললেই অবধারিত ভাবে যার নাম আসে, রাধার সাথে যার জুড়ি ভেবে আমরা তৃপ্ত হই, সে কৃষ্ণ। তবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম যতটা লৌকিক, তারচেয়ে বেশি অলৌকিক, অপার্থিব। পার্থিব মোহ তার কাছে তুচ্ছ। তবে মুজিবুল হক প্রেমিকাকে সরলতার, সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি রাধার সাথে তুলনা করলেও নিজেকে তুলনা করেছেন ইন্দ্রের সাথে। কৃষ্ণের সাথে নয়। স্বর্গের দেবতা ইন্দ্র কামতপ্ত পুরুষ। অপ্সরাগণ যতক্ষণ নাচগান করে তাঁর রেতঃস্খলন করতে না পারেন, ততক্ষণ ইন্দ্র ক্লান্ত হন না, নিরস্ত হন না নাচ গান দেখা থেকে। অনৈতিক ভাবে কামচরিতার্থ করতে গিয়ে অভিশপ্ত হয়েছিল ইন্দ্র। সেই অভিশাপে ইন্দ্রের শরীরে দেখা দিয়েছিলে সহস্র যোনী। পরবর্তী সময়ে ইন্দ্র স্বীয় ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলে সেই সহস্র যোনী সহস্র চোখে পরিণত হয়। তো কবি এখানে নিজের কামের তীব্রতা বোঝাতে গিয়ে নিজেকে তুলনা করেছেন ইন্দ্রের সাথে। আর নিজেকে ইন্দ্রের সাথে তুলনা করে রাধার সাথে ইন্দ্রের যে জোড়ি তিনি নির্মাণ করলেন, সত্যিই তা অভিনব। নিঃসন্দেহে কবি হিসেবে তাঁর এই নির্মাণ শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করে।
যাইহোক, রাস্তা দিয়ে ধূমকেতুর মতো হুস হুস করে গাড়ী যাবার সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে রাত আর বেশি নেই। তাই এখানেই শেষ করছি।
প্রশ্ন জাগতে পারে কবির প্রেম কি শুধু নারীর জন্য। এর উত্তর নিঃসন্দেহে ‘না’। তাঁর প্রেম নারীর জন্য, মানুষের জন্য, জাতির জন্য, দেশের জন্য, পৃথিবীর জন্য, সর্বোপরি, সবেচেয়ে বেশি শব্দের জন্য। শব্দ, কবির কাছে অরাধ্য কুহক। শব্দের মতো চোরস্রোত কবির মনে কেউ তুলতে পারে না। কেউ কবিকে এতটা উন্মাতাল করতে পারে না একটি শব্দ যতটা পারে। মুজিবুল হক কবীর এর ব্যতিক্রম নয়। ‘শব্দ-সুন্দরী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
মধ্যরাতে কী তুমুল কাশফুল- জ্যোৎস্নার ভিড়ে
লঘুপায়ে একা দাঁড়ায় আমার
অদেখা শব্দসুন্দরী
একটি বাক্যের নাতিদীর্ঘ এই কবিতার শেষের দিকে লিখেছেন,
চরাচরে এতো শব্দ
নীরবতার গভীরে শব্দ;
তবু কেনো কবি হাত পাতে ভিখিরির মতো
শব্দ সুন্দরীর কাছে?
একটি কাক্সিক্ষত শব্দ যে কবিকে উদয়াস্ত কেমন মোহগ্রস্ত করে রাখে, তার নমুনা পাই আরেকটি কবিতায়। প্রাসঙ্গিক কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃতি করছি,
চারদিকেতেই শব্দপুঞ্জ
হাত বাড়ালেই পাই,
তবু কেন একটি শব্দ
ঊুকের ভেতর মারছে কেবল ঘাই।
[একটি শব্দ, রাতের শিরায় আগুন]
এই দেখো কথা বলতে বলতে আবার প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছি। গেলাম না হয়। ক্ষতি কী? তোমার কাছেই তো আমার যত শুদ্ধ এবং ভুল করার অধিকার আছে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে তুমি আমি চলে এসেছি পরস্পরকে ভালোবেসে।
মুজিবুল হক কবীরের ভাষায়,
তুমি ও আমি পরস্পরে ভালোবাসায়
টুকরো- করা তরমুজের মতো
রক্তলাল প্রবালে
ও শ্যাওলায় ভাসতে থাকি;
[তোমার আমার প্রেম, রাতের শিরায় আগুন]
এই কবিতার উপান্তে লিখেছেন,
তোমার ও আমার প্রথম প্রেম
সভ্যতার সূচনায়।
যাইহোক প্রসঙ্গে ফিরে যাই। মুজিবুল হক কবীরের ‘জলের অদ্ভুত সংগীত’ (২০১০) ও ‘অগ্নিগর্ভ দিন’ (২০১১) কাব্যদ্বয়ে প্রেমের কবিতার সংখ্যা খুবই কম। নেই বলতে গেলে। ‘জলের অদ্ভুত সংগীত’এ তিনি জল নিয়ে নিজস্ব দর্শন তুলে ধরছেন। ‘অগ্নিগর্ভ দিন’-এ বিম্বিত হয়েছে বিক্ষুব্ধ সময়ের প্রতিচিত্র। তবে ‘শূন্যে বেঁধেছি ঘর’ (২০১৫) কাব্য পেরিয়ে তিনি ‘আধেক হৃদয় দিয়েছি তোমাকে’ (২০১৯) কাব্যে এসে আকণ্ঠ প্রেমে নিমজ্জিত হয়েছেন। কাব্যের নামকরণেই প্রতিফলিত হয়েছে এর মূলসুর। এ কাব্যের প্রথম এবং নাম কবিতায় লিখেছেন,
আধেক হৃদয় দিয়েছি তোমাকে
আধেক হৃদয় ডুবে আছে জলে,
দূরের আকাশ কতো কাছে আজ,
উড়ন্ত মেঘ জড়িয়ে নিয়েছি
আমার আঙুলে।তুমি তো আমার তৃষ্ণাকাতর
অনার্য এক নারী,
ঊ্যবধান বাড়ে, বিচ্ছেদ বাড়ে
তবু অদ্ভুত এক রসায়নে শরীরি-ভাষার টানে
টের পাই
দূরবিস্তৃত ইন্দ্রিয়-ঘরবাড়ি।
এই প্রেমের উচ্ছ্বাস প্রলম্বিত হয়েছে সদ্যপ্রকাশিত ‘আমাকে দাঁড়াতে দাও’ (২০২১) কাব্যতেও। হবে না কেন? ‘আধেক হৃদয় দিয়েছি তোমায়’ বইতে তিনি বলেছেন,
দ্যাখো না, তোমাকে কেমন দাঁড় করিয়ে দিয়েছি
আমার আঁকা কোনো প্রান্তরেখায়
বলেছেন,
ডুবে আছি বলে জেগে থাকি
রঙ নেই, তবু রক্তে মেখে নিই তুলি
শূন্যে ছবি আঁকি।
[ডুবে আছি]
একজন কবি তো শূন্যেই ছবি আঁকেন। শূন্যকে এঁকে পূর্ণ করে তোলেন। আর এই শূন্যকে পূর্ণ করার পেছনে যে আদ্যশক্তি হিসেবে কাজ করে, সে হলো প্রেম। সে হলো নারী।
তুমিহীন রজনীগন্ধার বন
এখন তারাদের গায়ে গভীর রাত। গুমোট বাতাস পায়চারী করছে। ঘুম নেই। তবু নিয়ম মেনে ‘ঘুমহীন নিদ্রার ভেতরে’ যাবার জন্য বিছানায় গা এলাতে হবে। তুমি যখন এ চিঠি পড়ছো, জানি না তখন তোমার চোখে কত রাত, কতটা শ্রাবণ কিংবা কতটা ঊষা।
যাইহোক, রাস্তা দিয়ে ধূমকেতুর মতো হুস হুস করে গাড়ী যাবার সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে রাত আর বেশি নেই। তাই এখানেই শেষ করছি। যাওয়ার সময় তোমাকে আমার খুব প্রিয় একটি কবিতার শেষ দুই স্তবক শুনিয়ে যাচ্ছি,
তুমিহীন এ—ঘর আমাকে পোড়ায়
ঘুমহীন ঘুমের ভিতরে
মৃদুস্বরে ডাকো তুমি,
আমি শুনি।তুমিহীন রজনীগন্ধার বন—তবু
তুমি দিন ও রাত্রির গন্ধ নিয়ে
জড়িয়ে আছো আমার অনুভবে,
শ্বাস-প্রশ্বাসে।
[ কোথাও তুমি নেই, মুজিবুল হক কবীরের কবিতা]