যেকোনো বিষয়ের পরিধি বলতে বোঝায়, সেই বিষয়টি অধ্যয়ন করে কোন কোন বিষয় সম্পর্কে কত দূর অবধি জানা যায়, তাই। হাতের শ্রেষ্ঠ ঘটনাপঞ্জির মাধ্যমে ইতিহাস লেখক রাজা-বাদশার কাহিনি, যুদ্ধ ও বিদ্রোহ, রাষ্ট্রের উত্থান-পতন এবং কোন ঘটনার পর কোন ঘটনা ঘটেছে, যার মাধ্যমে সমাজ বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তার হদিশ দিয়ে যান। এই প্রচলিত ইতিহাস আলোচনাকে পণ্ডিতগণ গুরুত্ব দিলেও এটা যে সাধারণের জ্ঞানের সীমা লোকসমষ্টির জ্ঞানের সীমাকে অতিক্রম করবে, সেই বিশ্বাস তারা রাখেন না। আজ তাই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৃবিজ্ঞান, লোকসংস্কৃতি, যুক্তিবিদ্যার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।
সমাজ যেহেতু নানা প্রক্রিয়া, নিয়ম-নীতি, কর্তৃত্ব, পারস্পরিক সহায়তা, নানারকম গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ, বিভাজন ও স্বাধীনতা দানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা, সেহেতু সমাজকে বুঝতে বিজ্ঞানীগণ ÔRoyal QuartertÕ অর্থাৎ—অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও আত্মীয়তার প্রসঙ্গে কথা বলেন।(ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা-২০০৯,পৃ:২৯।) অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম ও আত্মীয়তার ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাসের ফলে সমাজের গড়ন ও ধরনও ভিন্ন ভিন্ন হয়। সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানের যে সম্পর্ক, তা সাধিত হয় ভাষা দ্বারা। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা তার বস্তুগত সংস্কৃতির ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।
বস্তুগত সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সব ক্রিয়াশীলতা রয়েছে, তার মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি প্রধান। এভাবে সংস্কৃতি ও নৃ-বিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে ইতিহাসে অবস্থান নেয় এবঙ একটি সমাজের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে পরিস্ফুট করে। ‘রবীন্দ্রনাথ প্রামাণ্যপঞ্জির ইতিহাসকে মেনে নিতে পারেননি। কেননা প্রচলিত সেই ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে শাসকরাই ছিল একমাত্র নায়ক। কিন্তু রঙ্গমঞ্চের নিচে যে বিশাল জনতা ছিল, তাদের সুখ-দুঃখ, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় তাদের ব্যথা-বেদনা ও জ্বালা-যন্ত্রণার কথা কিছুই লিখিত হয়নি। এই জনপ্রবাহের ইতিহাসই রবীন্দ্রনাথের কাছে দেশের প্রকৃত ইতিহাস ছিলো।’ (ড. অতুল সুর, বাঙালা ও বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতি, সাহিত্যালোক, কলকাতা-২য় সংস্করণ-২০১৪, পৃ: ৯।)
রবীন্দ্রনাথ বলেন—‘যে ইতিহাস দেশের জনপ্রবাহকে অবলম্বন করিয়া প্রস্তুত হইয়াছে, যাহার নানা লক্ষণ, নানা স্মৃতি আমাদের ঘরে-বাইরে নানা স্থানে প্রত্যক্ষ হইয়া আছে, তাহা আমরা আলোচনা করি না বলিয়া ইতিহাস যে কী জিনিস, তাহার উজ্জ্বল ধারণা আমাদের হয় না।’ (প্রাগুক্ত, পৃ: ৯)। বলা বাহুল্য, এই উজ্জ্বল ধারণার জন্য ঐতিহাসিককে লোকসংস্কৃতির দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। নৃতত্ত্বে লোকসংস্কৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ মযহারুল ইসলাম বলেন, ‘সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ফোকলোর এমনকি সাহিত্যের অঙ্গন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে স্পর্শ করেছে নৃ-তত্ত্বের ভাবনা-চিন্তা ও ধ্যানধারণা। নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান ব্যতিরেকে মানব সভ্যতার মূল্যায়ন আজ প্রায় অসম্ভব।’ (ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত,পৃ: ২১)। তিনি জানতেন নৃ-বিজ্ঞান ব্যতীত লোকসংস্কৃতি সম্ভব নয়।
নৃ-তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ, কিংবদন্তী, লোকগাথা-প্রবাদ-ধাঁধা, লোকছড়া-কবিতা-গান এসবকে—Verbalart বলা হয়। লোকসংস্কৃতিকে কোনো কোনো নৃ-বিজ্ঞানী সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব আবার কেউ কেউ ‘কৃষিজীবীদের নৃতত্ত্ব’ বলেও অভিহিত করেছেন। পণ্ডিতগণ ফোক বলতে গ্রামীণ বা আদিবাসী সম্প্রদায়কে শনাক্ত করেছিলেন। আদিবাসী গ্রামীণ সংস্কৃতিই হচ্ছে মূলত ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতি। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেন—‘প্রামাণিক ঘটনা হইতেই ইতিহাসের আরম্ভ।…পিতামহের সময় হইতে আগত বিশ্বাসের মূল পরীক্ষা করিয়া যেই পুরাতন অট্টালিকাগুলি ক্রমাগত নির্মমভাবে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহাদের স্থানে নতুন নতুন গৃহ রচিত হইতেছে। সভ্যতা, সমাজ ও বিশ্বাসের বৃদ্ধি ও পরিবর্তন ইতিহাসের বিষয় মধ্যে বটে।’ ইতিহাস সময়ের দিক থেকে ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করে যা নৃবিজ্ঞানকে ইতিহাসের কাছাকাছি নিয়ে আসে। বিংশ শতকের প্রথমদিকে নৃবিজ্ঞানীরা মৌখিক ঐতিহ্য অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি, ঐতিহাসিক অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্রিয়াগুলোকে নৃতত্ত্বে ঠাঁই দিতে আপত্তি প্রকাশ করে ছিলেন।(প্রাগুক্ত, পৃ: ২৬)।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাজ নৃবিজ্ঞানী বলেন—‘ইতিহাসের মহাপরীক্ষায় স্থান না পাওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি পর্যাপ্তভাবে বোঝা যায় না।’ তারা বলেন—‘যারা ইতিহাসকে উপেক্ষা করে তারা বর্তমানকে না জেনেই নিজেদের নিন্দা করে, কারণ বর্তমানের উপাদান তাদের নিজ নিজ সম্পর্ক পরিমাপ ও মূল্যায়ন করতে ঐতিহাসিক বিকাশ একাই আমাদের অনুমোদন দেয়।’(ই.ই. ইভান্স প্রিচার্ড, সমাজ নৃবিজ্ঞান, অনু-সাদাত উল্লাহ খান, বাংলা একাডেমি,ঢাকা-২০০৯, পৃ: ১২৯)।
প্রচলিত ইতিহাস থেকে জনগণের প্রথাগত ইতিহাস অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা জীবন্ত মানুষের চিন্তার অংশ নিয়ে গঠিত। ঘটনার স্মৃতি দিয়ে জনসমষ্টির জীবনের ভূমিকা থেকে, মৌখিক ও লিখিত ঐতিহ্য থেকে অতীতের ইতিহাসকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থেকে যায়। আবার বর্তমানের চিন্তার পরিবেশ দিয়ে যেহেতু অতীতের ইতিহাস ঢাকা থাকে একইভাবে বর্তমানের চিন্তার বিষয়াবলি বিশ্লেষণ করে একটি জাতি ও সমাজের মনস্তাত্ত্বিক গঠন অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
প্রাচীন বাঙালির ‘বঙ্গ’ দেশ বলতে যে সীমারেখা হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নির্ণীত হয়েছিল সেই সীমানায় অসংখ্য জনপ্রবাহের ধারা বিদ্যমান ছিলো। প্রাচীন ‘বঙ্গ’ দেশের সীমা নির্দিষ্ট হয়েছিলো প্রাকৃতিক সীমা দ্বারা। শুধু তাই নয় এই প্রাকৃতিক সীমার মধ্যে একটি জাতি ও ভাষার ‘একত্ব- বৈশিষ্ট্য’ গড়ে উঠেছিলো। প্রাচীন এই বঙ্গদেশের বাঙালির একত্ব বৈশিষ্ট্যই ১৯৭১-এ এসে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটায় এবং পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে এক অখণ্ড ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যে আবদ্ধ হয়। সেই থেকে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির নিজস্ব ভূখণ্ড হয়ে যায় বাংলাদেশ। বাঙালিকে এই ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন যে মানুষ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রামে অংশ গ্রহণ ও ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের যে আকাঙ্ক্ষা তাকে উস্কে দিয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনাসমূহের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ এক অনিবার্য নাম। কোনো লেখকই ‘বঙ্গবন্ধু’কে পাশ কাটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার কথা ভাবতে পারবেন না। এমনকি দলীয় সংকীর্ণতা নিয়েও যেসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা আমরা পাই সেখানেও ‘বঙ্গবন্ধু’ অনিবার্য। কিন্তু ঐতিহাসিক এই চরিত্রের মূল্যায়নের প্রশ্নে এসে তৈরি হয়েছে নানারকম বিতর্ক। এ বিতর্ক বিভ্রান্ত করছে নতুন প্রজন্মকে। দলীয় সংকীর্ণতা নিয়ে যেসব লেখক বই লিখেছেন তারা এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিকরচনাগুলোতে। একটি চরিত্র, কিংবা দর্শন মূল্যায়নের প্রশ্নে এ বিতর্ক স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫শে মার্চ কালো রাত, ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এম.এ হান্নানের স্বাধীনতা ঘোষণা, ২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে একই ঘোষণা পুনঃপাঠের ঘটনাকে সংরক্ষণ করেছে। একজন যথার্থ ঐতিহাসিক কারো অবদানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন না।
এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও যথার্থ বক্তব্য রাখেন রাশেদ খান যেমন— ‘আজ যখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এতো বিতর্ক এতো দাবি—পাল্টা দাবি তখন একটা কথা না বললেই নয়। স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেখ মুজিবুর রহমানের পাঠানো ইপি আর এর ওয়ারলেস বার্তা অথবা কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা সেই সময় কজন ব্যক্তির কাছে পৌঁছে ছিল? অল্প কিছু লোক ছাড়া জানতে পারেনি। তারপরও এগুলো নিশ্চয় ইতিহাসের ঘটনা। কোনো নীতি নির্ধারক ঘটনা নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল মানুষের মনে। ২৫ মার্চের কালো রাত্রির ঘটনা তাকে ত্বরানি¦ত করেছে। কিন্তু বাংলার মানুষ আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। ২৬ মার্চ থেকে তারা আর পিছ-পা হয় নি।’ (মো. কামরুল হুদা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উৎস সন্ধান, পৃ:১৬৪)।
রাশেদ খান মেনন ২৬ বা ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ঐতিহাসিক বললেও নির্ধারক ঘটনা বলতে চান না। কেননা বাংলার মানুষ আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো। সেই সিদ্ধান্ত লোককবির কবিতা ও গানে আমরা পাই। সেই নির্ধারক ঘটনা ৭ই মার্চ, সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু’ পূর্ব পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র নামে উল্লেখ করে বলেন—‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ বাংলাদেশে কোট, কাচারী, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।…তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সব কিছু। আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
অতএব, ২৬ শে বা ২৭শে মার্চের বেতারে ঘোষণা একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মানুষের মনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নির্ধারণ যে হয়ে গিয়েছিল তা ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই। এই সত্যের যথার্থ প্রকাশ লোককবির গান ও কবিতায় আমরা পাই—
শেখের ডাকে সারা দিয়্যা
মুক্তিযুদ্ধে গেনু।
আবার—
স্বাধীন বাংলা বলে মুজিব করিল ঘোষণা।
কিংবা—
৭১-এ শেখ মুজিব দিল বজ্রসারা
বাঙালিরা হইয়া উজ্জীব যুদ্ধে নামলো তারা।
অথবা—
মুজিবের ডাকে সারা দিয়া বাঙালির সন্তান
মুক্তিফৌজ হইল, যাইয়া হিন্দুস্তান।
ইতিহাস রচনায় বুদ্ধিজীবী মহল যেখানে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে—মৌখিক ও লৌকিক ইতিহাসে লোককবিগণ সেই সংকীর্ণতার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলেছেন। এ যাবৎ যতগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লোকছড়া, কবিতা ও লোকগানের সন্ধান পাওয়া গেছে তার কোথাও জিয়াউর রহমানকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় মেজর জেনারেল (অব.) এম. এ. মতিনের বক্তব্য— ‘আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে শেখ মুজিব নেতা কিংবা সেনাপতি—তার কোনো দায়িত্বই পালন করেন নি। ঐতিহাসিক সে দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জিয়াউর রহমান।’ (ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ১৬৪)। অথচ বাঙালির চেতনার জগতে তখন বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালনকারী কাণ্ডারীর নাম পাওয়া যায় না। তাঁরা মুজিবকে বলছেন— ‘সল্লাহ পোরধান; বলছেন— ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌকার মাঝি হইল।’
লোককবির বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর পরিচয়টি যেভাবে বিধৃত হয়েছে তা পাঠ করলে— ইতিহাস রচনায় দলীয় সংকীর্ণতা দূর হবে বলেই বিশ্বাস। ভাট-কবি ইদ্রিস আলীর রচনায় আমরা দেখতে পাই,
ওরে মালেক ঠেডা তুমি কেডা কোথায় তোমার বাড়ি
বাপ দাদার নাম নাই পুটকি ভরা দাড়ি।
হইছিলে গভর্ণর নাই খবর বাপের চৌদ্দগোতে
যার দাপে এহিয়া কাঁপে ঘরে বইসা মুতে
তুমি তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলা কেমন করি
যাঁর ঠেলায় নূরুল আমীন হইলে দেশান্তরী
সে যে বঙ্গশার্দুল নাই সমতুল নাই সারা বিশ্বে আর
কোথায় গেল চীন মার্কিনের দেওয়া বিপুল হাতিয়ার।
… …
খেয়ে বাঘের থাপা বাপরে বাপ করছ কেন আজ
চাইসনারে বাংলার দিকে যদি থাকে লাজ।
লোক মানসে বঙ্গবন্ধু বাংলার বাঘ যার থাবা খেয়ে—পাকিস্তানিরা বাপ বাপ করে পালিয়েছে। এই বাঘ—রাওয়ালপিণ্ডির জেলে বন্দি থাকলে কি হবে তার তো থাবা দেবার জন্য পনের কোটি পা ছিলো। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন, তখন লোককবির বয়ান থেকে আমরা পরিষ্কার হতে পারি যে— ২৫ শে মার্চের হত্যা যজ্ঞের প্রতিক্রিয়াতে মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি। এর সঙ্গে ২৫শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর এরেস্ট হবার ঘটনা ছিলো বাঙালির ক্ষোভকে মুক্তি সংগ্রামের দিকে ধাবিত করার অন্যতম একটি প্রধান কারণ। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশ স্বাধীন করার অর্থ হয়ে যায় দেশকে শত্রু মুক্ত করা নয় বরং বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে, পাকবাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করা।
লোককবির বক্তব্য—
আল্লা আমার সহায় আছে
আইসো কমর বান্দি।
ইয়াহিয়া টিক্কা ভুট্টো
যাইবে এবার কান্দি।
ওমাক ক্যারাকাত ফ্যালেয়া
শত্রু দিমু যে খ্যাদেয়া।
বাংলাক স্বাধীন করিয়া
বঙ্গবন্ধুক হামরা এবার
মুক্ত করমো ভাই।।
দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে যারা উঠতে পারেন নি তাদের ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির মৌখিক ইতিহাসের পঠন পাঠন জরুরি যা জনপ্রবাহের দিক থেকে রচিত। সাধারণ মানুষের সৃষ্টিমুখী আবেদনকে অস্বীকার করে যে ইতিহাস রচিত তা দুর্বল। সেখানে রক্ষণশীল চেতনা, ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা প্রাধান্য লাভ করে। সে তুলনায় লোকসমাজের মৌখিক ঐতিহ্যের ভেতর আমরা আবিষ্কার করি সংগ্রামের উপযুক্ত কারণ।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণ ও আত্মত্যাগই যেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে সেখানে তাদের উদ্দীপ্ত করার গানে অবদান রেখেছেন লোক কবিরা। মুক্তিযুদ্ধে মেজর কর্ণেলরা অংশ গ্রহণ করলেও সেখানে রণতুর্য বাজেনি বরং ক্যাম্পে ক্যাম্পে অর্ধ-শিক্ষিত অশিক্ষিত চারণ-কবির গান তাদের উজ্জীবিত করেছে। আর এসব গানের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ এসেছেন নানাভাবে। শুধু তাই নয়—মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহ দিতে যে সব গণ-সঙ্গীত গীত হত লোক সুরে সেই সব গানের বাণীতে সঙ্গত কারণেই উঠে এসেছেন বঙ্গবন্ধু—
বাংলার নামে আজ শপথ নিলাম
মুজিবের নামে আজ শপথ নিলাম
বাংলাকে করবই মুক্ত। (সাইম রানা, বাংলাদেশের গণসঙ্গীত, বাংলাএকাডেমি,পৃ: ২৫৩)।
অথবা—
মুজিবের বাংলায় আজ কোন কথা নয়
সংগ্রাম শুধু সংগ্রাম। ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৫৩।
কিংবা—
বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছে চলো মুক্তিযুদ্ধে
গোলাম হয়ে বাঁচার চাইতে মৃত্যু বহু ঊর্ধ্বে। ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৪৬।
অথবা—
মায়ের রক্ত বোনের রক্ত ভাইয়ের রক্তকে
ওরে মুক্ত করতে মুজিবরের বঙ্গভূমিকে
বাঙালি তুই দাঁড়া অস্ত্র নিয়া। ঐ প্রাগুক্ত, পৃ: ২৬০।
অথবা—
সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম—মুজিবুর। ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৬১।
কিংবা—
শোন ঐ শোন বাংলাদেশের
শিকল ভাণ্ডার গান,
জয়তু মুজিব। কোন সে মন্ত্রে
জাগালে লক্ষ প্রাণ।। ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৬২।
এভাবে বিচারগানের কবি আবদুল হালিমের গান—
জাতির পিতা মহান নেতা (তাঁরে) ছাড়বি কিনা বল
বন্দিশালার ভাঙব তালা বাঙালি ভাই চলরে চল।।
শোন বলিরে ভুট্টো মিয়া শেখ সাহেবরে দাও ছাড়িয়া
না হয় থাক সাবধান হইয়া আসিতেছে পাগলা ঢল।
ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৬৩।
আর এক চারণ কবির গানে—
বাঙালিরা জানের জান
রাখতে হবে বাঙালিদের মান।
ওরে কাঙালের দরদি এলো
শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালিদের নয়ন মণি
শেখ মুজিবুর গুণের গুণি
আল্লা মোদের সহায় আছেন
রাখবোনা দালালের জান।
ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৬২।
এভাবে আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে—মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ইতিহাস জুড়ে জনপ্রবাহের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা’—একটি অভিন্ন চেতনা। লোককবিরা সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে কখনো-মহানায়ক বলেছেন কখনো বলেছেন অবতার। আর এভাবে লোকসমাজে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হয়েছে নিরক্ষর ও অর্ধশিক্ষিত—লোককবির মাধ্যমে সেই ইতিহাসে তিনি হচ্ছেন অবতার, সার্বভৌমিক পুরুষ প্রধান।
এ গবেষণায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত ইতিহাস সর্বজন গ্রাহ্য লোক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। লোকসংস্কৃতির ভিত্তিতে সমাজতাত্ত্বিক মতবাদসমূহের আলোচনা ও ইতিহাসের প্রত্যয়গুলো ব্যাখ্যা করতে হলে উপযুক্ত তথ্য আবিষ্কার জরুরি। ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ¡ দূর করা সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করি। এ জন্য এ বইয়ের পরিশিষ্টাংশে লোক সংস্কৃতির কতিপয় উপাদান সংযুক্ত করা হল।
এ যাবৎ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও ‘বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক’ যে সমস্ত গ্রন্থ রচিত হয়েছে তাঁর মান যাচাই-এর ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতিভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা জরুরি বলে আমি মনে করি। কেননা লোকসংস্কৃতির ব্যাপকতম চর্চাই আমাদের জাতীয় চরিত্র, জাতীয় ঐক্যও দর্শন নির্মাণে বিশেষ সহায়তা করতে সক্ষম। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে বাঙালির মধ্যে যে বিতর্ক যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে মুক্তি দিতে পারে সাংস্কৃতিক অধ্যায়ন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সংস্কৃতি অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি ব্যাপক সময়ও স্থান জুড়ে আছে।
লোককবির সঙ্গে আমার চিরন্তন বিশ্বাস—
ও মাঝি ও, ওরে ছয় দাঁড়েতে
নৌকা চলেমুখে আল্লাজী
ওরে বাঁকা নায়ের হাল ধইরাছে
গোপালগঞ্জের মাঝি।
ও মাঝি ও, গোপালগঞ্জের নায়ের মাঝি
বাংলাদেশের নাইয়া
সে যে সব দুখীরেপার কইরা দেয়,
জয় বাংলা গান গাইয়া।।
ঐ প্রাগুক্ত,পৃ: ২৬৫।
একদিন সময় ঠিকই আসবে, যখন লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানের অমূল্য সম্পদ সমন্বয়ের মাধ্যমে রচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনগ্রাহ্য পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। যেখানে বঙ্গবন্ধু বিতর্কের ঊর্ধ্বেই থাকবেন। বাঙালির মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় সর্বাধিনায়ক হিসেবে কেবল নয়,বঙ্গবন্ধু পূজিত হবেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ঈশ্বর হিসেবেও।