লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতার সুবাস প্রাপ্তির আগে আমাদের জাতীয় জীবনের যে উথাল-পাতাল সময়, অস্থিরতা, রক্ত, হত্যা, আন্দোলন এবং সুদিনের স্বপ্ন জেগে উঠতে থাকা, আর সেইসঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব সব মিলিয়ে এক নতুন দিনের দিকে এগিয়ে যাওয়া— সেই সময়ের কবি মাহমুদ কামাল। যে সময়ের কবিতাকে চিৎকার-চেঁচামেচির কবিতা বলে গালাগাল করে শান্তি পান অনেকে। সে সময়কে বহির্মুখী রাজনীতিনির্ভর কবিতার কাল বলেও চিহ্নিত করতে চান অনেকে। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের মনে হয় একটি কালখণ্ড সম্পর্কে ঢালাও অভিযোগ যেমন সত্য নয়, তেমনি শেষ কথা বলার জন্যও সময়ের প্রয়োজন। সময়কে থিতিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়— ঘোলা জল শান্ত হওয়ার জন্য সময়ের হাত ধরে বসে থাকতে হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে যারা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, তাদের সবার কবিতায় রাজনীতি নেই-যা আছে তা রয়েছে শিল্পের মোড়কে। বরং অর্ন্তুমুখী ব্যক্তিক অনুভূতির প্রকাশ অনেকাংশে প্রবল।
এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন মাহমুদ কামাল। বাংলাদেশের কবিতায় মাহমুদ কামাল আবির্ভূত হয়েছেন অর্ন্তবৃত্ত সত্তা নিয়ে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পরকীয়’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৯২ সনে। গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি পাঠ করি:
তোমাকে খুঁজেছি আমি পৃথিবীর সকল বিবরে
এইবার পেয়ে গেছি নারী তুমি কার ব্যবহারে
ব্যবহৃত হয়ে আছো পরাজিত নদীটির চরে।
প্রজাপতি ডাকে যদি তবে কেন নীরবে জড়াও
নদীর যৌবন নেই চিহ্নটুকু নিয়ে আছে যদি
কী লাভ সহজ সত্যে ভেলা তবু পাবে না তো পানি
আশেপাশে পড়ে আছে কিছু কিছু অচির উপল
এই নিয়ে সুখে আছ, হায় নারী, হৃদয়ে অসুখ
সেই আদিকাল থেকে খুঁজে খুঁজে পেয়েছি তোমাকে
হারাতে চাই না আমি, এ আমার অপরোক্ষ দাবি।অবনি বহিয়া যাক হোক যত অকাল সময়
তোমার যৌবন তবু চুপচাপ হবে না তো ক্ষয়।
এখানে, এই কবিতায় যে মাহমুদ কামালকে পাওয়া যায়, সেই মাহমুদ কামালই কবিতার ভুবনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ‘তোমাকে পেয়েছি আমি পৃথিবীর সকল বিবরে’- পঙ্ক্তিতে জীবনানন্দ দাশকে ধারণ করে, আত্মস্থ করে করেই মাহমুদ কামাল এগিয়ে চলেন কবিতার দশ দিগন্তে। যখন তিনি বলেন, ‘সই আদিকাল থেকে খুঁজে খুঁজে পেয়েছি তোমাকে/হারাতে চাই না আমি, এ আমার অপরোক্ষ দাবি।’ সেই দাবিকেই যেন নিজের ভেতরে আত্মস্থ করেন তিনি। নারীর উপমায় সৃষ্টিশীলতার সন্ধান করেন প্রতিনিয়ত—সেখান থেকে পর্যবেক্ষকের মতো তুলে আনেন কবিতার পঙ্ক্তি।
সেই পঙ্ক্তিতে থাকে প্রেম, প্রকৃতি ও ইতিহাস। যা পাঠকের মন উচাটন করে। মাহমুদ কামালের কবিতায় নিটোল বর্ণনায়—কখনো অন্ত্যমিলে—কখনো মুক্তক ছন্দে কখনোবা নিখুঁত নিরূপিত ছন্দের মাত্রা বিন্যাসে মাহমুদ কামাল নিজেকে উপস্থাপন করেন পাঠকের দরবারে। তবে তাঁর কবিতায় প্রেমই প্রধান—প্রেমকে আধেয় করে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। নতুন-নতুন দুয়ার উন্মোচন করতে থাকেন পাঠকের সামনে। কখনো সে প্রেম বৈষ্ণব ধারায়—কখনোবা রাধা-কৃষ্ণের মতো লৌকিক এবং আধ্যাত্মিকতায় মোড়ানো। কখনোবা সে প্রেম কামজ। তাই তিনি বলতে পারেন:
ঘুমতো আসে না প্রিয় সারারাত এপাশ-ওপাশ
এপাশে স্বামীর বাহু ওইপাশে কঠিন কপাট
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে ক্লান্তিহীন কত অনুতাপ
ছাদের কপোল তলে দুই চোখ সারারাত ঘুরে
পরিত্রাণ খুঁজে ফিরি পাই নাতে সহজ কৌশল
একটি জোনাক পোকা জ্বওে নিভে দেখি কতবার
এ আঁধার মাঝে যদি খুঁজে পাই পরমায়ু পথ
চাই না হরেক আলো হে জোনাক জ্বলো তুমি জ্বলো
কখনো নিজের মুখ একবার দেখে নেবো আমি
আর কত দুঃখ পাবো কতটুকু চিহ্ন আছে মুখেহাজার রকম দুঃখ পাবো জানি তবুও পৃথিবী
ভালো লাগে যদি দেখি আয়নায় অভিভূত ছবি।
কবিতা পাঠের পর এক ধরনের নীরবতা ভর করে। চুপচাপ বসে থাকার পর কবির তীব্র হৃদয়াবেগকে অনুভব করা যায়। হাজার রকম দুঃখ পাওয়ার পরও তীব্র আকাঙ্ক্ষায় তাই তাঁর পৃথিবী ভালো লাগে—কারণ তিনি অনুভব করেন, স্বপ্ন দেখেন, আশা করেন। সেই আশা তাঁকে পালায়নবাদী করে তোলে না। বরং তিনি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন—যেখানে নিরাশা নয়—প্রাণের আকুলতা ধ্বনিত হয়। প্রেমের অভিব্যক্তি নারীর মোহিত রূপে, প্রকৃতির ছন্দে তাঁকে স্বপ্ন দেখায়—যে স্বপ্ন তিনি ছড়িয়ে দেন পাঠকের মনে:
সমুদ্র শুকিয়ে গেলে নদীরা বাঁচবে না
নদীরা শুকিয়ে গেলে পুকুর মরে যাবে
পুকুর মরে গেলে কেঁদে উঠবে যুবতীর কাঁখের কলস।সমুদ্র বেঁচে থাকলে নদী মুখ প্রবাহিত হবে—
নদীরা বেঁচে থাকলে সুকী হবে পুকুরের জল
পুকুর বেঁচে থাকলে উথলে উঠবে যুবতীর কাখের কলস।
…
আসুন, নবীন, প্রবীণ, বৃদ্ধ ও তরুণ
আসুন, নবীনা, প্রবীণা, বৃদ্ধা ও তরুণী
আমরা বাঁচার চেষ্টা করি।
(জীবন: কবিতার মতো কিছু কথা)
মাহমুদ কামাল আত্মস্থ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশকে। অনুভবের প্রগাঢ়তায় তিনি পূর্বজদের ধারণ করেই নিজের স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন:
স্মৃতিকে কি ভুলে থাকা যায়?
সে কি আজ ছোট ছেলে
বাবা, সোনা, লক্ষ্মীটি বলে
ঘুমিয়ে রাখা যায়?
সমস্ত স্মৃতির পর দুঃখ বোধ হয়
কেননা পুনরায় অই খানে যাওয়া
সম্ভব নয়
যা পেয়েছি সে কি ছিল পরম পাওয়া?
যে কোন স্মৃতির কাছে খুব কষ্ট পাই
তোমারও কি একটুও দুঃখ বোধ নাই?
এখানে কি জীবনানন্দ দাশকে মনে পড়ে? মনে পড়ে বিনয় মজুমদারকে? এখানেই মাহমুদ কামালের কৃতিত্ব। তিনি এই মনে পড়ার মাঝে নিজের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই মনে পড়ার মাঝেই তিনি, চিনিয়ে দিতে সক্ষম হন নিজের স্বাতন্ত্র্য। যা তাকে ভাব, ভাষা ও আঙ্গিকে আলাদা করে উপাস্থাপন করে। ফলে তিনি এই মনে পড়া এবং পূর্বজকে আত্মস্থ করে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নেন। যেখানে মাহমুদ কামালকে আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
বাংলা কবিতায় যে একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, আত্মমগ্নতা, স্মৃতিকাতরতা, রাজনীতি সচেতনতা, কোথাওবা পুরোপুরি নির্মোহ, কোথাও ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল—এর সবই ফুটে ওঠে মাহমুদ কামালের কবিতায়। এর সঙ্গে আরও যে বিষয়টি পাঠককে আকৃষ্ট করে তা হলো ছন্দ সচেতনতা। সব ছন্দেই লিখেছেন তিনি। কখনো বা ছন্দ নয় শুধু অন্ত্যমিলের দিকেও ঝুঁকে পড়েন তিনি। অন্ত্যমিলের প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ করার মতো। অন্ত্যমিলে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য চোখে পড়ার মতো। আর ছন্দের ক্ষেত্রে তিনি পয়ারের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন।
আপদমস্তক প্রেমিক কবি মাহমুদ কামাল। প্রেমকে বহুবর্ণিলভাবে দেখিয়েছেন তিনি। প্রেমের— নারীর রহেস্যর ধারা-উপধারা বেয়ে তিনি কবিতার ভুবনে এগিয়ে যান। নিজেকে ক্রমান্বয়ে অবিষ্কার করেন—প্রকাশ করেন। আর এই প্রকাশের মাঝে তিনি বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। স্মৃতিকাতরতা—পেছনের টান—তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে—
পুরনো কথাই বারবার মনে পড়ে
যত দূরে তুমি থাকো হে প্রথম প্রেম
পেছনে অনেক ভুল গাঁথা পড়ে আছে
জাগরণে তাই মনে কি পড়ে না, হেম?
(প্রথম প্রেম: কবিতার মতো কিছু কথা)
তাঁর এই প্রেম সবসময় নিষ্কাম নয়। কখনো কখনো তা দেহী হয়ে ওঠে:
রাত্রি, আবরণ খুলে ফেলো এইবার সুন্দর হও
তোমার সকল রূপ একবার আমাকে দেখাও।
(ব্যক্তিগত: দুই)
অথবা,
এসো তবে ব্রীড়া ভেঙে ক্রীড়া করি রাতে
তাহলে সকল ভয় দূর হয়ে ওই লজ্জাটুকু
পালাতে বাধ্য হবে পরের প্রভাতে।
(মুহূর্তের কবিতা: ২৮)
শরীর ছাড়া প্রেমের পূর্ণতা হয় না। এই বিশ্বাসে মাহমুদ কামাল নারী-পুরুষের রহস্যময়তা, সম্পর্কের পর্বগুলো উন্মোচন করেন—প্রাত্যহিকতা দিয়ে কবিতায়। প্রেমের অনুষঙ্গের মতোই মাহমুদ কামালের কবিতায় আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তালিকা তৈরির প্রবণতা। তিনি যেমন কবিতায় অন্ত্যমিল দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তেমনি তালিকা তৈরিতেও। কখনো কখনো তিনি একই শব্দ বারবার কবিতায় ব্যবহার করেন, কখনোবা একই পঙ্ক্তি, কখনো সমার্থক পঙ্ক্তিমালার সাহায্যে কবিতায় একটি ঘোর তৈরি করেন।
আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি ফুল ভালোবাসে
তবে তার খোঁপায় আমি ফুল গুঁজে দেব
আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি পাখি ভালোবাসে
তবে আমি পাখি হয়ে তার হৃদয়ে লুকিয়ে রবো।
আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি নদী ভালোবাসে
তবে তাকে হৃদয় নামের সেই বিশাল নদীতে নিয়ে যাবো।
আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি নিসর্গ ভালোবাসে
তবে তাকে নগ্ন কওে আমি বাতি জ্বেলে দেব।
আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি আমাকে ভালোবাসে
তবে ঠিক তাকে আমি তুলে নেব আমারই নিবাসে।
(আমি যাকে ভালোবাসি: বালক বয়সে)
প্রথম যৌবনে লেখা কবিতার মতোই মাহমুদ কামাল পরবর্তী সময়েও তার এই প্রবণতা ধরে রাখেন কবিতায়। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত তাঁর প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে তিনি তালিকা তৈরি করেন—পুনঃপৌনিকতার মাধ্যমে ঘোর তৈরি করেন। শব্দের প্রচলিত অর্থের ভেতরে, অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে নতুন উপলব্ধি জাগান পাঠকের মনে।
মাহমুদ কামাল শুধু যে নারীর হৃদয়, প্রেম নিয়েই কাব্যসাধনা করেন এই ভ্রান্ত ধারণা যেন পাঠকের মনে তৈরি না হয়। হ্যাঁ, যাপিতজীবনের ভেতরে তিনি নারীর-প্রকৃতির বহুমাত্রিকতায় উত্তেজিত হন—তার প্রতিক্রিয়া কলকলিয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়। এর মানে এই নয় যে, তিনি সমাজ-রাজনীতি-বাস্তবতা থেকে দূরে। বরং তিনিও প্রাত্যহিক আচারে, নৈমিত্তিকতার ভেতরে অসঙ্গতি দেখলে অস্থির হয়ে ওঠেন। দিনযাপনের ছকবাঁধা জীবনের অভ্যস্থতার ভেতরে অসংলগ্নতা দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠেন। জীবনের আড়ালে অন্ধকারের কদর্যতায় দুমড়ে মুচড়ে যান। কিন্তু তার এই উপলব্ধি কখনো চিৎকারে রূপ নেয় না। বরং নীরবে-নিভৃতে নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে তিনি নির্মাণ করেন—কিন্তু সেই নির্মাণে থাকে শিল্পের পরিশীলিত রূপ। দিন যাপনের গ্লানি তাকে উত্তেজিত করলেও তিনি বিস্ফোরিত হন না। বরং অন্তর্গত ক্ষরণ ফুটিয়ে তোলেন।
রাজার পুত্র নন তবু রাজপুত্রের মতোই তিনি
আয়নায় প্রতিদিন শুয়োরের মুখ দেখেন।
দেশে কোনও রাজা নেই তবে রাজা কনডম আছে
জমিদারও নেই তাই তিনি রাজপুত্র নন
তবে রাজপুত্রের মতোই তিনি সার্বভৌম
রাজার পুত্রের মতোই তার মুখের আদল
উপমিত সুশ্রী ওই রাজপুত্র
আয়নায় নিজেকে দেখেন না
প্রতিদিন শুয়োর দেখেন।রাজপুত্রের পোষা বেড়ালটি তাকে দেখে মিউমিউ করে
কানে আসে শুয়োর, শুয়োর
আয়নায় ওই ছবি দেখতে দেখতে
ঐ শব্দ শুনতে শুনতে ক্রোধান্বিত তিনি
আয়নাটি ছুঁড়ে মারেন বঙ্গভবনে
আর, কী আশ্চর্য বিদীর্ণ আয়নায়
ভেসে ওঠে অসংখ্য শুয়োর।
(শুয়োরের গল্প: ব্যাকুল শব্দেরা)
প্রেমিক মাত্রই দ্রোহী। তিনি অসঙ্গতিতে ফেটে পড়েন। প্রতিবাদ করেন। সেই প্রতিবাদ কারো বেলায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে—আর কেউ শুধু ঘৃণা প্রকাশেই অন্তরের তীব্রতম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মাহমুদ কামাল দ্বিতীয় পর্যায়ের। ‘অর্ন্তুমুখ এবং বহির্মুখের শিল্পসম্মত উপস্থাপনেই হতে পারে সফল কবিতা।’ এই উপলব্ধি জাগে মাহমুদ কামালের কবিতা পাঠান্তে। মাহমুদ কামাল আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। শিল্প, সাহিত্যে যদিও শেষ কথা নেই, তবু এ যাবৎ প্রকাশিত তাঁর কবিতার বিদীর্ণ আয়নায় দেখা মুখ থেকে বলতে দ্বিধা নেই, তার সময়ের প্রথম সারির কবিদের কাতারে তিনি নিজেকে হাজির করতে পেরেছেন।