প্রজ্ঞার শাসন ও আবেগের সংহতি—এই দুয়ের সম্মিলনে যাঁদের কবিতা রচিত, তাঁদের একজন মাসুদ খান। রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব, সামরিক শাসন ও স্লোগান সর্বস্ব কবিতা রচনার কালে এই কবির আবির্ভাব ও বিকাশ। প্রেমে-দ্রোহ-বিজ্ঞান-ভূগোল-ইতিহাসচেতনা-সভ্যতা-দর্শন-ধর্মের নানা অনুষঙ্গে তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র রচিত। এতে তাঁর কবিতা হয়েছে হৃদয়সংবেদী, আবেগে মথিত।
মাসুদ খান শব্দে-চিত্রকল্পে-উপমায়-উৎপ্রেক্ষায় আপন অনুভূতির অনুবাদ করেন। সেখানে উপকরণ হিসেবে যুক্ত হয় তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে অবিকল্প ও অনিবার্য কল্পনা। কারণ, তিনি কবিতায় ছাপ রাখেন কল্পনার মৌলিকত্বের, অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের। ফলে বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণে জেগে ওঠে এক পরাবাস্তব ভুবন। যেখানে কল্পনা ও বাস্তবের ভেদরেখা প্রায়ই ঘুচে যায়। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন তাঁর সময় ও মনীষার ছাপ। নিজের সময়কে আত্মস্থ করে, সময়ের ভেতর দাঁড়িয়েও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন তিনি। এভাবে তাৎক্ষণিক সংঘটিত ঘটনার প্রতিবেদন রচনা না করে, ঘটনার অভিঘাতসৃষ্ট প্রতিক্রিয়াকে দেন শিল্পিত মহিমা। করে তোলেন কবিতার পঙ্ক্তি। এ কাজটি করতে গিয়ে কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সুষম বিন্যাসে দিকে মনোনিবেশ করেন।
কেবল কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সুষম বিন্যাসেই নয়, এর সঙ্গে মাসুদ খান যুক্ত করেন সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-দর্শনের সত্যও। সামাজিক দায় অনুভবের ছাপ পড়ে তাঁর কবিতায়। ব্যক্তির সমষ্টি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ওঠে নভমণ্ডল, বিশ্বচরাচর। একইসঙ্গে সূর্যটাকেও তিনি বুড়িয়ে যেতে দেখেন। তিনি কবিতাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিকল্প করে তোলেন না, আবার বিলাসিতাঁর উপাচারেও পর্যবসিত করেন না। একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, সরকার ও এর ভৌত-অবকাঠামোর মতো কবিতাকে তিনি করে তোলেন জীবনের সামগ্রিক রূপ-রস-গন্ধ-প্রাণময় সার্বভৌম প্রপঞ্চ।
তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
ক. সময়কে আত্মস্থ করেও সময়-উত্তর চিত্র আঁকা
খ. রাজনীতি-সমাজনীতি, ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস-সভ্যতা, মিথ-ঐতিহ্যের সম্মিলন
গ. প্রতীক-রূপক-উপমা আশ্রয়ী চিত্রকল্পের ব্যবহার
ঘ. ছন্দের বিচিত্র প্রয়োগ
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো সব কবিতায় সমান হারে যেমন নেই, তেমনি সব বৈশিষ্ট্যই সমান গুরুত্বে স্থান পায়নি। মাসুদ খান বিষয়বস্তুর পাশাপাশি প্রকরণকেও সমান গুরুত্ব দেন। বিষয়স্তু অনুযায়ী ছন্দ-আঙ্গিক ঠিক করেন। এমনকি শব্দ গঠন-নির্বাচন-প্রয়োগেও তিনি বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেন।
বিশেষ করে বিষয় নির্বাচনে তিনি সতর্ক। বিচিত্র তাঁর বিষয়। কেবল প্রথাগত নারীপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেমেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, ছড়িয়ে দেন দেশ-বিশ্বপ্রেম ও ভূগোলের দিকেও। নিছক নারীপ্রেমকে উজিয়ে প্রকৃতি-নিসর্গ ও জনপদের প্রেমেও পড়েন তিনি। বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জনপদের কথাও। আবার ওইসব জনপদের মধ্যে দেখা-অদেখার ভেদ রাখেন না। তিনি জানেন, অদেখার প্রতি মানবমনের আকর্ষণ প্রবল এবং তা সুপ্রাচীন; চিরন্তনও। যা মানুষ কখনো দেখেনি এবং যেখানে সে কখনো যায়নি তাকে জানার ও দেখার এক ধরনের অদম্য স্পৃহা তার চিত্তকে সর্বদা চঞ্চল করে রাখে।একই স্বভাব কবি কিংবা শিল্পীকেও ব্যস্ত রাখে। মাসুদ খান ‘কুড়িগ্রাম’ কবিতায় মানবস্বভাবের সে অমোঘ বৈশিষ্ট্যই এঁকেছেন। বলেছেন, ‘কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।’ অথচ এরপরই বর্ণনা করেছেন ওই জনপদের ভূ-প্রকৃতি, নিসর্গ, মানবচাঞ্চল্য থেকে শুরু করে এর সম্পর্কিত চরাচরের সমস্ত দৃশ্য-ঘটনাও।
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যকর্ষণ।
তাঁরপর তাঁর ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।
আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল
ছোট গ্রাম আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের মুখে তিল।
অনেকক্ষণ একা-একা ভাসে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে।
(কুড়িগ্রাম)
আবার ‘চেরাগজন্ম’ কবিতায় তিনি দেখেন, ‘বাতাসে ভাসিয়া যায় বহু ব্যঞ্জনধ্বনি, ঘ্রাণ আর/ প্রলাপবিলাপবিকিরণ, নিরুদ্ধার, যুগের যুগের। /লণ্ঠন তুলে ধরো চারণপুত্র।’ জাগরণমূলক চেতনায় কবি উজ্জীবিত। কোনো পদপ্রদর্শককে বোধ করি কর্তব্যকর্মে সচেতন হওয়ার আহ্ব্বান জানান। বলেন, তুমি তোমার আলোকস্বভাব দিয়ে মানবজন্মের উপকার করো। না হলে তোমার এই জীবন অনর্থক। নাহলে, ‘চারণ, তোমার চেরাগ জন্ম বৃথা যায়, যায়।’ এখানে ‘চেরাগ’ কেরোসিনের কুপি। কিন্তু এই চেরাগ আলোকবর্তিকারই প্রতীক। কবি চেরাগ প্রতীকের আশ্রয়ে সমাজের অগ্রসর চিন্তাঁর তরুণদের আপন-আপন কর্তব্যে ব্রত হওয়ার প্রেরণা দেন। তিনি বলতে চান, এই জ্ঞানদীপ্ত তরুণদের সামনে এখন ঘোর অন্ধকার নেমে আসতে পারে। কিন্তু সে অন্ধকার দেখে, ঘাবড়ে গেলে চলবে না। অন্ধকারকে দূর করতে হবে এই চেরাগরূপী তরুণদেরই্। নাহলে তাদের চেরাগ জনমই বৃথা।
আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, বিষয় নির্বাচনে মাসুদ খান নির্বিচারী নাহলেও বিচিত্রমুখী। নারী-প্রকৃতি থেকে শুরু করে সাংসারিক নিত্য-অনিত্য অনেক অনুষঙ্গই তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। চরাচরে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের অভিঘাত শিল্পীকে আলোড়িত করে, শিল্পী সঙ্গে সঙ্গে তাতে সাড়া দেন না। কিংবা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না। এরজন্য তিনি কিছুটা সময় নেন। যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা আত্মস্থ করতে তাঁর সময় প্রয়োজন, ততক্ষণ। এরপরই তিনি সে বিষয়টিকে শিল্পে রূপ দেন। সেটা হতে পারে শব্দে, হতে পারে রঙে-রেখায়। এক্ষেত্রে নারী, প্রেম, প্রকৃতির কোনো বিশেষ মুহূর্তের মুগ্ধতার চিত্রায়ন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এরই আলোকে মাসুদ খানের দুটি কবিতার প্রসঙ্গ আসতে পারে। একটি ‘একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার’ অন্যটি ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’।
ক.
বনের কিনারে বাস, ছিল এক রূপবর্ণদাসী
আর ছিল বনে বনে একা ঘোরে সেই এক বিপিনবিহারী।
অসবর্ণ তাঁরা, অসমান, অসবংশের জাতক
একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক।
তবু সেতু গড়ে ওঠে সন্ধ্যাকালে দূর দুই তটে
সেতু, দেহকথনের গোধূলিভাষ্যে তা ফুটে ওঠে।
(একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার)খ.
দূর মহাকাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন–
সেইসব এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,
ঘোর মধ্যরাতে
এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।
সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।
(বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা)
‘একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার’ কবিতায় কবি একজন নিম্নবর্গীয় এক রমণীকে দেখে মু্গ্ধতা প্রকাশ করেছেন। বর্ণনা করেছেন তাদের বাসস্থানের করুণ দৃশ্য। বলেছেন এরপরও তার রূপযৌবন ঠিকরে পড়ছে। এই দৃশ্যকল্প কবিকে মোহিত করে, আর তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় সেই মুগ্ধতার কথা। এদিকে, ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’টির শিরোনামে প্রেমের প্রসঙ্গ থাকলেও, এটি কেবল প্রথাগত প্রেমেই সীমাবদ্ধ নেই। এতে যুক্ত হয়েছে, মহাবিশ্বের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সংঘর্ষের ঘাত-প্রতিঘাতও। কবি আবিষ্কার করেন, ‘দূর মহাকাশে/ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন।’ আর সেখানে ‘এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,/ ঘোর মধ্যরাতে/এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।/সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।’ বিজ্ঞান-দর্শন এসে এখানে প্রেমে একাকার হয়ে যায়। দীর্ঘ এক কবিতায় মাসুদ খান চরাচরের বিভিন্ন অনুষঙ্গ তুলে এনেছেন, কখনো প্রেমের অনুষঙ্গে, কখনো ব্যবহারিক জীবনের অনুষঙ্গে। তিনি বাতাসকে দেখেন বিব্রত হতে, আর ‘আদিগন্ত কুয়াশা-মোড়ানো সেই তৎকালীন রৌদ্রের মধ্যেই’ ‘গোলকেরই এক অপূর্ব রূপ’ আবিষ্কার করেন। আর সবশেষে এসে বলেন, ‘তোমার সাহিত্যে দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।’ এই শেষ পঙ্ক্তি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের বোধে নাড়া দেয়, এই তুমি তাহলে কোনো নারী নয়? তাহলে কে সে? এই তুমি আসলে কবির আরাধ্য পরাবাস্তব এক সত্তা। যার সন্ধানে চলেছেন তিনি, সেই সত্তা-ই এই তুমি। আর তারই সাহিত্যে এভাবে তাঁর বেলা বয়ে যায়। ‘মৌমাছি’ মূলত প্রতীক-রূপক আশ্রয়ী কবিতা। ‘মৌমাছি’র আড়ালে মূলত অস্তিত্ববাদের চিত্র আঁকা হয়েছে। যার কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নেই, আশ্রয় নেই, তবু বেঁচে থাকার, তবু টিকে থাকার রয়েছে দুর্মর বাসনা। কখনো রূপ-স্বভাবের রূপান্তরের ভেতর দিয়েও সে টিকতে থাকতে চায়। স্বভাবে বণিক হলেও শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব সংকটের চিন্তা তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ফলে সে বেঁচে থাকার তাড়নায় বিনির্মিাণ বিবর্তনেও আস্থা রাখতে চায়। অর্থাৎ মানুষের যত রূপ-বৈচিত্র্যই থাকুক, সে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করে। এবং এটাই তাঁর স্বভাবের মূল বৈশিষ্ট্য। এবং বলে, ‘ডাকি পূর্ণনাশ, ভাঙি বিনির্মাণ, চুম্বকীয় ঝড়ে/কোলাহল থেকে দূরে, হলাহলে, অস্থির প্রহরে।’
বিষয়বস্তু অনুযায়ী অলঙ্কার প্রয়োগে মাসুদ খান সতর্ক। উপমা-চিত্রকল্প-প্রতীক-রূপক-অনুপ্রাসেও তিনি স্বচ্ছন্দ্য। চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি উপমা-প্রতীক-রূপককে গুরুত্ব দেন। এ কারণে প্রতীক-উপমা আশ্রয়ী চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিষয় ও অলঙ্কার হিসেবে তাঁর একটি প্রিয় অনুষঙ্গ প্রজাপতি। এটি কখনো প্রতীক, কখনো রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। `প্রজাপতি’ শব্দের প্রয়োগে তিনি বেশ কুশলী। প্রজাপতি প্রতীকের আড়ালে প্রাণচাঞ্চল্য-রঙের বিচিত্র ব্যবহারকে যেমন গুরুত্ব দেন, তেমনি মানবসমাজের বহুবর্ণিল, বর্ণচোরা স্বভাবকেও প্রকাশ করেন। এ কারণে ‘প্রজাপতি’ শব্দটি এর বাগর্থকে অতিক্রম করে, একাধিক ব্যঞ্জনার্থ ধারণ করে।
যেমন—
ক.
প্রজাদের ঋতুরক্ত রেণুকায়
ভূগোল ভিজতে থাকে
সীমানাবিলাস ভণ্ডুল হয়ে যায়।
এমন জননদিনে কোথায় রইলে প্রজাপতি?
(প্রজাপতি)খ.
কাগুজে তাসের গায়ে আঁকা বহুবর্ণ রাজা
রাজ্য আর রাজত্বের পরমার্থ তিনি, প্রজাপতি,
প্রজাদের পরি, ফুরফুরে রূপকে ও রহস্যে রঙিন।
(প্রজা, প্রজাপতি, চোর ও যম)গ.
শুধু মননেই, শুধু দর্শন বা স্পর্শনেই, এমনকি স্রেফ
হাঁচিতেও হয়েছে সম্ভব, আগে জীবের জনম
তাঁরপর কী মায়া লাগালে প্রজাপতি, আহা কী লীলা লীলালে-মিথুনে মৈথুনে অবলীলাক্রমে জীবের সৃজন
ঔরসে গর্ভের কোষে কিমাশ্চার্য রসায়ন।
(সংসার)
উদাহরণ আরও বিস্তৃত করা যাবে। কিন্তু সে উদাহরণ কেবল একটি বিষয়কেই প্রতিপন্ন করবে, তাহলো মাসুদ খান একটি বিষয়কে নানাভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে একটি প্রতীক সৃষ্টি করেন, যে প্রতীকের সাহায্যে তিনি সমাজ, সংসার, ব্যক্তি, দর্শন ও ধর্মকে প্রকাশ করেন।
মাসুদ খান কবিতায় বলার চেষ্টা করেন, তিনি সভ্যতা দর্শক মাত্র নন, নিবিড় পর্যবেক্ষকও। তাই মানুষ, সভ্যতা, ইতিহাস, নদী, মৌমাছি, দেশ-রাষ্ট্র, রাজনীতির প্রচল সংজ্ঞার্থ হাজির করেন। একইসঙ্গে এসব সংজ্ঞার্থকে কখনো কখনো ইঙ্গিতপূর্ণ, কখনো কখনো সাংকেতিক করে তোলেন। মাঝেমাঝে করে তোলেন সব্যাখ্যেয়। এরই অংশ হিসেবে তিনি সমাজ, সমাজপতি, রাজনীতির পাশাপাশি দর্শন ও আধ্যাত্ম চেতনাকেও কবিতার অনুষঙ্গ করে তোলেন। জাগতিক-বৈষয়িক লাভালাভ, ক্রোধ, হিংসা, লোভ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুচিন্তা ও দর্শনকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। এরই আলোকে তিনি স্বসমাজ ও স্বকালের চিত্র এঁকেছেন। কিন্তু সে সময়ের মধ্যে নিজে আবদ্ধ থাকেননি। কারণ তিনি জানেন, ‘মানব সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন অনবরত ঘটে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ পরিবর্তন আসে না। উপস্থিতকালে জীবিত বুদ্ধিজীবীরা সবাই ভাবেন যে, রাজনীতির পরিবর্তন মানুষের চিন্তাঁর রাজ্যেও বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। পরিবর্তন হয়তো আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আসে না।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা, শব্দের অনুষঙ্গে: সৈয়দ আলী আহসান)। তাই মাসুদ খানও সময়কে অতিবাহিত হতে দেন। নিজে কেবল পর্যবেক্ষণ করেন সময়ের রাজনীতি, অর্থনৈতিক স্রোতধারা। তিনি দেখেন ‘আজ এই পাখিতীর্থদিনে, খোলা জানালাদিবসে/ নিদারুণ এ অশনবনের ক্লেশ।/ দাউদাউ দুর্ভিক্ষের সামনে হা-দাঁড়ানো হতভম্ব মিকাইল।’ যার হাতে কাঁপতে থাকে ‘ভিক্ষামাপনযন্ত্র’। এভাবে চিত্রকল্প ও প্রতীকের আড়ালে তিনি সভ্যতাঁর ক্ষয়িষ্ণু একটি ছবি আঁকেন। কিন্তু কোথাও তিনি স্পষ্ট করে বলেন না তা। ঘটনা-চিত্রকল্প বর্ণনার পর বর্ণনা করে যান। এভাবে অনেকগুলো চিত্রের কোলাজ করে তিনি দেখান, সভ্যতার বর্তমান অবস্থান কোথায়।
তাঁর কবিতায় সমান গুরুত্বে স্থান পেয়েছে মিথ ও পুরান। কখনো কখনো দর্শন-আধ্যাত্ম্যচেতনা ও মিথপুরাণের ভেদরেখা মুছে যায়। বৈশ্যদের কাল কবিতায় এমনই একটি চিত্র আঁকা হয়েছে। যেখানে আবহমান বাংলার লোকবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্যকে এক করে দেখার বর্ণনা রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের বিশ্বাসকে আশ্রয় করে কবি দেখিয়েছেন বাস্তবে মানুষ যা দেখে, তা ঘটনা হিসেবে সত্য, কিন্তু মানুষ সবসময় সঠিক ঘটনার স্বরূপ শনাক্ত করতে পারে না। তাই এক ঘটনাকে অন্য ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়, কখনো কখনো প্রচারও করে। অপবিশ্বাস-লোকবিশ্বাসকে জানে সত্য হিসেবে, বৈজ্ঞানিক সত্যকে জানে ভৌতিক সত্য হিসেবে। ফাঁকিটা এখানে। এরকম একটি বহুল ঘটিত-পরিচিত ঘটনা হলো, অন্ধকার রাতে ফসলের ক্ষেতের আগাছা কিংবা স্তূপিকৃত আবর্জনা থেকে মিথেন গ্যাসের আলো। ওই আলোকে গ্রামের সাধারণ মানুষ ভূতের আলো হিসেবে জানে এবং প্রচারও করে। অনেকেই তাতেই আস্থা রাখে। আর এই অপবিশ্বাসের সুযোগ নেন সমাজের ধূর্তরা। কবি এই দৃশ্যটাই বর্ণনা করেন এভাবে:
ওইখানে হইহই রইরই পঞ্চকাণ্ড মেলা সে তো
হাজার বর্ষ আগে
আজ শুধু একজোড়া নিরিবিলি জলমগ্ন বৃক্ষ বাস করে।
দূরে ওই বৃক্ষমিথুনের থেকে, থেকে-থেকে মিথেন জ্বলে উঠলেই
ছেলেরা ও মেয়েরা একালে বলে ওঠে, ওই যে ভূতের আলো দেখা যায়।নীল-নীল আলো দেয় ছেলেটির শরীর অশরীর।
(বৈশ্যদের কাল)
পুরো কবিতাটি গ্রামীণ বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মিথআশ্রয়ী চিত্রকল্পপূর্ণ। মিথটা এমন, কোনো এককালে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ একজন মারা যান। তারপর কেটে যায় হাজার বছর। একসময় সেখানে অন্ধকার রাতে আবর্জনা থেকে সৃষ্ট মিথেনের আলো জ্বলে। লোকে ভাবে হাজার বছর আগে মৃত ’মুখ দিয়ে অবিরল তেজ বের হয়ে’ ভূ-খণ্ড ভাসানো ওই ছেলেটার শরীর ও আত্মা থেকেই ওই আলো জ্বলে।
এমন মিথ-আধ্যাত্ম্যসংকটের মিশ্রণে রচিত আরেকটি কবিতা ‘কবরের উপকথা’। এই কবিতায় মাসুদ খান দেখিয়েছেন, মানুষ যতই স্বপ্নচারী হোক, শেষপর্যন্ত তাকে আধ্যাত্ম্যচেতনা বিচলিত করে। মৃত্যুচিন্তা ও মৃত্যুর পূর্ববর্তী নানা অনুষঙ্গ তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাকে ভাবতে বাধ্য করে, অন্তিম মুহূর্তের কথা, মৃত্যুপরবর্তী পরিণতির কথাও। আর এভাবনা সাধারণত ব্যক্তির স্ব-স্ব সমাজ ও স্বধর্মের রীতি অনুযায়ীই হয়। এক্ষেত্রে দশ জন সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিল্পী কিংবা কবিরও মিল রয়েছে। ‘কবরের উপকথা’য় এমন বিশ্বাস ও আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। ‘কবরের উপকথা’র মতো ‘তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ’ও আত্মজিজ্ঞাসাজারিত রচনা, তবে এ কবিতায় মৃত্যুচেতনা নেই। এর পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে আত্ম-অন্বেষণের নতুন উদ্যোগ-উদ্বেগ।
একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে।
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে।আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে…, কিংবা কীসের টানে
লোকগুলি আহা ঘরছাড়া হয়ে যায়!
(তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ)
কবি কামনা করেন ‘একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা/ যেইদিন থেকে হারানো মানুষ আসে।’ এরপরই কবি বলছেন, মানুষ নানা কারনে গৃহত্যাগী হয়। একইসঙ্গে তারা সর্বস্বত্যাগীও হয়। আবার একসময় অভিমান ভুলে প্রত্যাবর্তনও করে। কিন্তু সে প্রত্যাবর্তন তার জন্য সবসময় সুখকর নাও হতে পারে। হারানো গৃহ আর নাও ফিরে পেতে পারে। সে অনেক ‘না’ যুক্ত ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জন্য সরাইখানা হোক বিশ্রামস্থল। অর্থাৎ মানুসের খোঁজা অন্তহীন। মানুষ যা খোঁজে তা অনেক সময় তার ভেতরেই বাস করে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিনতে পারে না তাঁরা। তাই পেয়েও হারিয়ে পেলে। তাই ‘বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে।’ তবে তাতেও সম্ভাবনার দ্বার দেখা যায়। সেখানেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। লক্ষণীয় যে, ‘কবরের উপকথা’য় যতটা পরিণতিবাদী মাসুদ খান, ‘তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ’ কবিতায় ঠিক ততটাই আশাবাদী।
ক.
তার কবিতার বিষয় বিচিত্রমুখী। আবেগ প্রকাশে তিনি নিয়ন্ত্রিত, চিন্তায় প্রজ্ঞাশাসিত। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক—
দশটিপথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা, ক্ষয়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুনরাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে।
(ছক)খ.
হঠাৎ মায়ের স্তন্য থেকে, আজই, উৎখাত হয়েছে শিশু
ঘুরে ফিরে বারে বারে যায় তবু মায়ের নিকট
বকা খায়, কিছুটা অবাক হয়, তবু শিশু যায়…অবুঝ কী আর বোঝে কী-বা অর্থ হয় এই উৎখাতলীলার!
(প্রত্যাখ্যান)গ.
উদগান।
এই উদগান সখার উদ্দেশে।অদেখা অচেনা এক সখার জন্যে আকাঙক্ষা–
যে রঙিন। যে বহুদূর।
দূর কোনো অজানায় যার অবস্থান।
(সখাসংগীত)ঘ.
অদিনে অক্ষণে এসেছ ভেসে ভেসে
এ-কোন ঠিকানায়, প্রযত্নে
অঙ্গে ধরে রাখি রূপের মতো করে
হৃদের মতো করে সযত্নে।
(পূর্বা, পূর্ববাহিনী)ঙ.
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে আকাশ ঢাকা
গায়ে তাঁর জ্বলে কোটি-কোটি প্লাংক্টন
তাঁরই মাঝে একা একটি শ্যামলা মেঘে
সহসা তোমার মুখের উদ্ভাসন।
(নির্বাসন)চ.
এখন বিদেশে বৃষ্টি হচ্ছে, অতিদূর আর নিকট-বিদেশ।
ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগে থেকে থেকে অপর দেশের।
এ গ্রীষ্মসন্ধ্যায় আহা এমন বিষাদ আর রূপের অনুশীলন আজ
বিদেশি আকাশে!
(বৃষ্টি-১)ছ.
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে
জাল ফেলে নিশ্চুপ। এ ধৈর্যের রূপ
আহা কোথাও তো দেখি না রে।
(ধীবর)জ.
কন্যা বারবার ঘুমিয়ে পড়ছে নদীতীরে
আজ সকাল থেকেই।
বারবার কেন ঘুমিয়ে পড়ছে?
যদিও নদীকূলেই বাস চিরদিন আমাদের,
একেবারে নদীতীরে নয়, একটু দূরে।
তবে কি বিশ্বের সব বিস্ময়ের শুরু এই ঘুমবিন্দু থেকে?
(নদীকূলে করি বাস)
উদ্ধৃতিগুলো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যাবে, মাসুদ খানের কবিতার বিষয় বহুরৈখিক, আঙ্গিকেও তিনি বিচিত্রমুখী।
ছন্দ নির্বাচন-প্রয়োগে মাসুদ খান বেশি স্বাধীনতাকামী। ছন্দের প্রচলিত রীতিকে মান্য করেও তিনি শৃঙ্খলমুক্তির সাধনা করেছেন। আবার কেবল ছন্দস্পন্দ বজায় রাখতে গিয়ে মাত্রা-পর্ব-পঙক্তি-অনুপ্রাসেই আটকে থাকেননি। প্রাঞ্জলতা ও স্বচ্ছন্দ গতির স্বার্থে মাত্রা-পর্বের সাধারণ রীতিকে কিছুটা বদলেও নিয়েছেন। মাঝেমাঝে নিরূপিত ছন্দেও তিনি চড়িয়ে দিয়েছেন গদ্যের চাল, গদ্যের স্পন্দন। নিরূপিত ছন্দ ও গদ্য স্পন্দন প্রসঙ্গে আবিদ আনোয়ার ‘কবিতার শিল্প-উপকরণ: বিবর্তনের ধারা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একটিও গদ্য কবিতা লেখেননি, জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু প্রত্যেকের গদ্য কবিতার সংখ্যা নগণ্য। আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শহীদ কাদরি প্রমুখ স্বীকৃত ও জনপ্রিয় হয়েছেন ছন্দোবদ্ধ কবিতা দিয়েই।’ এ বিষয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন আরও কঠোর। তাঁর মতে, কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য; এবং মূল্য নির্ণয় যেহেতু মহাকালের ইচ্ছাধীন আর আত্মগৌরবের আবিষ্কর্তা অনাগত সমধর্মী, তাই সমসাময়িক কাব্যজিজ্ঞাসার নির্বিকল্প মানদণ্ড ছন্দবিচার।’ এ দুটি বক্তব্য ছাড়াও এই দুজন কবির সমগ্র কাব্যপ্রচেষ্টা পর্যালোচনায় দেখা যাবে, এই দুজনই ছন্দসিদ্ধিকেই কাব্য জিজ্ঞাসার গুরুত্বপূর্ণ এমনকি কবিত্বশক্তির একমাত্র পরিচায়ক মনে করেছেন। বাংলা কবিতার প্রধান কবিদের কাব্যপাঠেও এমন যুক্তির প্রমাণ মেলে। এরই আলোকে মাসুদ খানের কবিতা পাঠ-বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এ কবিও ছন্দ-প্রয়োগে সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্তের প্রতিটি প্রকরণে তিনি সচেতন। তবে প্রচল রীতিকে তিনি নিজের মতো করে পরিবর্তন করে নিয়েছেন। কখনো কখনো ভেঙে দিয়েছেন ধরাবাঁধা নিয়মের ছাঁচ। ফলে অপটু চোখে তাঁর কবিতাকে ছন্দহীন বলে ভুল হতে পারে। আবার কোনো কোনো কবিতাকে তিনি স্বেচ্ছায়ই ছন্দহীন করেছেন। এরপক্ষে নিশ্চয় তাঁর যুক্তিও রয়েছে। ক্নিতু রসপিপাসু-কাব্যপাঠকের কাছে ছন্দহীনতার যুক্তি শতভাগ গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কবিকে মনে রাখতে হয়, তিনি যুগের হুজুগের দাস নন। তিনি নতুন রুচি-নতুন যুগের স্রষ্টা-দ্রষ্টা। সুতরাং যিনি শিল্পী, আপন রুচি যাকে শিল্পের মহাসড়কে চালিত করে, তিনি সহস্র প্রলোভনকে উপেক্ষা করে, নিয়মের শৃঙ্খলাকে মুক্তি সনদ করে তুলবেন। এমন শর্ত ও বক্তব্যের নিরিখে মাসুদ খানের অধিকাংশ কবিতাই ছন্দবদ্ধ। একইসঙ্গে অন্যান্য শর্তপূর্ণও।
এখানে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।
ক.
মধ্যরাতে ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে দেখি
অসংখ্য প্রিজম ফুটে আছে পুনর্ভবা নদীতীরে
আর ঠিক ডাঙায়, জলের সমতলে
হাওয়ায় হাওয়ায় করতালি—
অবিশ্রাম, বর্ষণের মধ্য দিয়ে
তুখোড় অধ্যাপক আলোকের অধ্যাপনায়ে ভেসে যায়।
ধীরে ধীরে বিবর্তিত হতে থাকে রং
এত রং, এত আলোবিচ্ছুরণ,
লোভাক্রান্ত ছোট্টমাছ আমি, তাই দেখি
সমস্ত স্মারক ভেঙে ভেঙে
ঘেঁষটে ঘেঁষটে উঠে এসেছি ডাঙায়।
(ত্রিজ)খ.
মৃত্যুতে নয় টানেলে ঢুকবে এক
স্মরণকালের বিব্রত মৌমাছি
আগুন অসুখ দুই হাতে সব খায়
পাঁক থেকে ওঠা ক্ষিপ্ত সব্যসাচী
লুব্ধ শ্রবণ ঢেকে দেয় বারবার
জন্তুর মতো উলঙ্গ সন্ন্যাসী
কাল থেকে আমি বিলুপ্ত হয়ে যাব
কাল থেকে আমি টানেলের অধিবাসী।
(টানেল)গ.
ডাঙার দেহে ঢেউ স্মারকের
প্রতীকগুলির মানে
হচ্ছে লেখা ডাঙা-নদীর
প্রেমের উপাখ্যান।
ডাঙাটা তো জন্মবোকা
ভোলাভালা হাবা
নদীটা কি তাঁর কারণেই
তরঙ্গ স্বভাবা?
(নদী ও ডাঙার কাহিনী)
প্রথম উদাহরণটি অক্ষরবৃত্তের। কবিতার বিষয়বস্তু জলস্বভাবি ও জল-অন্তপ্রাণ এক সত্তার আত্মপ্রবোধ ও আত্মউদ্বোধনের। পুরো কবিতাটি উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে রচিত। বাস্তব দৃশ্য থেকে পরাবাস্তব দৃশ্যে দ্রুত অভিগমনের সংকেতে হঠাৎ অভিভূত হতে হয়। একইসঙ্গে বিস্ময়ও জাগে—এক ঘোরাচ্ছন্ন মুহূর্তে ব্যক্তি কী করে নিজেকে লোভাতুর মাছের প্রতীকে আবিষ্কার করেন! দুর্বোধ্য কোনো প্রলোভনে পড়ে যে মাছ জলসীমা ভুলে ডাঙায় উঠে আসে, সে অপরিণামদর্শী কৌতূহলী মাছের ভেতর ব্যক্তি নিজেকে দেখেন, অসহায় ও অস্তিত্বরক্ষার যুদ্ধরত। অর্থাৎ সভ্যতার চরম প্রকর্ষণার যুগেও ভেতরে ভেতরে মানবসমাজে বয়ে চলে স্খলন, পতনের স্রোত। যদিও মানুষ সামষ্টিক কোলাহলের ভেতর তা টের পায় না। কিন্তু নিঃসঙ্গ ব্যক্তি সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। বুঝতে পারে সমাজে কোথাও পচন ধরেছে। এ থেকে আপাতত মুক্তির পথ খোঁজা দরকার। কবি দেখেন, ‘তুখোড় অধ্যাপক’রূপী বুদ্ধিজীবীরা তথাকথিত আলোয় ভেসে ভেসে যায়। বাস্তবতা তাঁরা বুঝতে পারে না। তাঁরা কখনো টের পায় না, সমাজের ভেতরে ভেতরে কতটা পতনের সুর বাজে। কারণ তাঁরাও পতনকুশীলবদের দলে—কেউ সজ্ঞানে, কেউ নির্জ্ঞানে। উত্থান-পতন ও প্রচল স্রোতে গা ভাসানোর ত্রিভুজ সংকটের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে অমিল অক্ষরবৃত্তের ‘ত্রিজ’ কবিতায়।
এ কবিতায় দেখা যায়, বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বর্ণনার বিশিষ্টতা সাবলীলতার স্বার্থে কবি পঙ্ক্তি-পর্বসাম্য রক্ষা করেননি। এমনকি অন্ত্যমিলও বর্জন করেছেন। তবে, চরণ-পঙ্ক্তিবিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রচলরীতির পর্ব গঠন ও বিন্যাস ভেঙে দিয়েছেন। এ কবিতায় স্বরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্তের মতোই পর্বসন্ধি-মধ্যখণ্ডনের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
দ্বিতীয় উদাহরণটি মাত্রাবৃত্তের। প্রতিটি পঙ্ক্তি তিন পর্বের। প্রথম দুই পর্ব ছয়মাত্রার, শেষ পর্ব অপূর্ণ। কবি বলছেন, ‘মৃত্যুতে নয় টানেলে ঢুকবে এক/ স্মরণকালের বিব্রত মৌমাছি।’ এখানে প্রথম পঙ্ক্তি মাত্রাবৃত্তের স্বাভাবিক মাত্রায় রচিত, কিন্তু দ্বিতীয় পঙ্ক্তি দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব ব্যতিক্রম। সেখানে দ্বিতীয় পর্বে পূর্বাংশ শেষপর্বের সঙ্গে সন্ধি করে সৃষ্ট। অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্বে ছয়মাত্রা পূরণ করা হয়েছে এভাবে: ‘বিব্রত মৌ/মাছি’ প্রথম পর্বে শেষাংশ ‘মৌ’ মধ্যখণ্ডন ও সন্ধি করে তৃতীয়পর্বে ’মাছি’র সঙ্গে প্রথম অংশের ধ্বনিসাম্য রক্ষসহ পর্ব পূরণ করেছে, আর শেষ পর্বে ‘মাছি’ শব্দটি দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশকে গ্রহণ করে ভিন্নার্থ ও ভিন্নরূপ গ্রহণ করেছে। এতে কেবল মাত্রাবৃত্তের মাত্রা-পর্ব-ধ্বনিগত সাম্যই রক্ষিত হয়নি, একইসঙ্গে শব্দের বাগর্থও পরিবর্তিত হয়েছে। আর বিশেষণ ’বিব্রত’ যুক্ত হয়ে সেই ‘মৌমাছি’কে দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়বাদীর অমোঘ সত্তার।
তৃতীয় উদাহরণটি স্বরবৃত্তের। এখানে দ্বিতীয় স্তবকে শেষচরণ, ‘নদীটা কি তাঁর কারণেই তরঙ্গ স্বভাবা?’য় দেখা যায় দ্বিতীয় উদাহরণের মতোই, মধ্যখণ্ডন ও পর্বসন্ধিসহযোগে গঠিত। এই চরণেও প্রথম দুটি পর্ব যথারীতি স্বাধীন ও চারমাত্রায় পূর্ণ। কিন্তু তৃতীয় পর্বের চারমাত্রা পূর্ণ হয়েছে চতুর্থ পর্বের সঙ্গে সন্ধি করে মধ্যখণ্ডনের মাধ্যমে। অর্থাৎ- ’তরঙ্গ স্ব/ভাবা’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, তরঙ্গ শব্দের সঙ্গে স্বভাবার, স্ব যুক্ত করলে চারমাত্র মেলে। আবার ধ্বনিসাম্যও বজায় থাকে। শেষে কেবল বা, শব্দাংশ যুক্ত করে, নদীর নারী স্বভাবকে পরিষ্কার করা হয়েছে।
মাসুদ খান কবিতায় শব্দের বাগর্থ ছাড়িয়ে শব্দকে দেন বহুমাত্রিক অর্থের ব্যঞ্জনা।এ কারণে বহুল ব্যবহৃত শব্দও অভিনব মনে হয়। বহু পুরনো শব্দও বহুলব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যায় না। বরং প্রয়োগগুণে নবজন্ম পায়। তাঁর অলঙ্কার দৃশ্যগ্রাহ্যতার পাশাপাশি শ্রুতিগ্রাহ্যও। এছাড়া তিনি বর্ণনাধর্মী পঙ্ক্তি রচনার পাশাপাশি উক্তিপ্রধান পঙ্ক্তিতেও সমান আগ্রহী। একইসঙ্গে প্রতীক-রূপকের আশ্রয়ে ইঙ্গিতপ্রিয় পঙ্ক্তিও সমান গুরুত্বে সৃষ্টি করেন। তিন নিরূপিত ছন্দেই তিনি লিখেছেন। এরমধ্যে মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি প্রচল রীতিকে মেনে নিয়ে, এর ভেতরেই ভাঙচুর করেছেন। দেখিয়েছেন, অতিপর্ব, ঊনপর্ব, অমিল-সমিলের বহুমাত্রিক ব্যবহার।মুক্তাক্ষরের চেয়ে যুক্তাক্ষরপ্রধান শব্দ গঠন ও নির্বাচনে তাঁর আগ্রহ বেশি। এ কারণে তাঁর কবিতায় কেলাসিত দেখা যায় না। বরং উচ্চারণের গাম্ভীর্য-আভিজাত্য তাঁকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এতে তাঁর আবেগ হয়েছে সংহত, কল্পনায়ে এসেছে শৃংখলা এবং বক্তব্য হয়েছে প্রজ্ঞাশাসিত। সর্বোপরি তাঁর কবিতায় ঘটেছে ছন্দের বিচিত্র প্রয়োগ-স্পন্দন।
তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্য ৭টি। এগুলো হলো, ‘পাখিতীর্থদিনে’ (১৯৯৩), ‘নদীকূলে করি বাস’ (২০০১), ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’ (২০০৬), ‘আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি’ (২০১১), ‘এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায়’ (২০১৪) ও ‘দেহ-অতিরিক্ত জ্বর’ (২০১৫)। তাঁর কাব্যযাত্রা দুই যুগের বেশি। আর এই অভিযাত্রার শুরু ‘পাখিতীর্থ দিনে’ দিয়ে, আপাতত বিশ্রামপর্ব ‘দেহ-অতিরিক্ত জ্বর’। দীর্ঘ এ কাব্যযাত্রায় তিনি বিষয়-প্রকরণে নিজেকে বারবার বদলেছেন। ভূগোল, দেশ, নারী প্রেম থেকে ক্রমাগত তিনি পৌঁছেছেন দর্শন, ধর্ম, সভ্যতা, ইতিহাস ও মিথের ভুবনে। দূর পৃথিবীর দেশ-মহাদেশ ঘুরে, কল্পলোকে বিচরণ করেও কাব্যসত্যে স্বপ্ন দেখেন, বগুড়াবর্ষ। অর্থাৎ আপন স্মৃতিজাগানিয়া একটি বিশেষ অঞ্চলকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেন, মননে লালন করেন। ফলে তাঁর কাছে ছোট একটি জেলা শহরও হয়ে ওঠে উপমহাদেশ। এটি একজন কবির নিজেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার একটি প্রয়াস।
আসলে তিনি কোথাও পৌঁছান না। সৃষ্টি করেন এক জগৎ নির্মাণ শেষে আরেক জগৎ। এজন্য তিনি ছন্দে-অলঙ্কারেও ক্রমাগত পরিবর্তন আনেন। নিত্যনবায়নপ্রিয় স্বভাব তাকে রেখেছে সর্বদা রূপান্তরশীল; পরিবর্তনকামী। তাঁর ইতিহাস চেতনা-সভ্যতাচিন্তার পাশাপাশি দর্শন-বিজ্ঞানচিন্তাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ফলে ‘আতাফল’ কবিতায় তিনি সূর্যকে দেখেন, ‘সূর্য ডুবে যাচ্ছে পরিষ্কার হারাবতী নদীর ওপার’ সেই সূর্যকেই ‘লোকান্তর’ কবিতায় দেখেন বয়স বেড়ে যেতে। বুড়ো হয়ে যেতে। বলেন, ‘বুড়িয়ে গিয়েছে সূর্য/দুরারোগ্য দেহ ফেটে বিকীর্ণ হচ্ছে প্রাণঘাতী সব রশ্মি।’ এভাবে মাসুদ খান অতীতের সঙ্গে বর্তমান-ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ রচনা করেন। এই সেতুবন্ধ রচনায় তিনি কেবল আবেগের ফল্গুধারায় ভেসে যান না, অন্যকেও ভাসিয়ে নিয়ে চলেন। তবে, সে আবেগ প্রজ্ঞাশাসিত, সুনিয়ন্ত্রিত। একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, আবেগ-প্রজ্ঞা-মনীষার নিরিখে বাংলা কবিতায় তাঁর একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত বাক্যের শেষ যতিচিহ্ন—দাঁড়ির মতোই সুদৃঢ়-প্রোজ্জ্বল।