মহীবুল আজিজের কবিতার বিষয় হিসেবে নির্দিষ্ট একটি ছক আঁকা সম্ভব নয়। তিনি বহুবিধ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। যেসব বিষয় আমাদের ভাবনায় খেলে না, সেসব বিষয়ও তার কবিতার উপাদান। কোনো কোনো কবিতা পড়তে পড়তেই বোঝা যায়, আবার কোনো কোনোটা গভীর মনোযোগ দাবি রাখে ভেতরের কথা উদ্ধারে। কবিতার ভেতরে ঢুকে করতে হবে ময়নাতদন্ত, কবিতা যেন এটাই চায়; উপরিভাগে বিশ্বাসী নয়। সাধারণ পাঠে কবিতায় তেমন কিছু নাও পাওয়া যেতে পারে, হিসাবটা তলায় পৌঁছালে দেখা যাবে, বেশ স্পষ্ট সমাজ-বাস্তবতার নিরীক্ষণ। কখনো সহজভাবে, কখনো বক্রাকারে, কখনো বা ব্যঙ্গ আকারে বলা আছে কবিতায় ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের ক্ষত প্রসঙ্গ।
বিষয় ভাবনার খোঁজে পাঠক কবিতা পাঠে চলে যাবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, যাবে জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য ঐতিহাসিক স্থান ও চরিত্রের সন্ধানে, ফিরে আসবে দেশীয় সংস্কৃতিতে; যে সংস্কৃতি রঞ্জিত প্রেম, নিম্নবর্গ, খুন, গুম, মৃত্যু-চিন্তা, সত্যের আহ্বান ও মুক্তির সম্ভাবনায়। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সান্তিয়াগোর মাছ’ থেকে শুরু করে শেষ কাব্য ‘ওগো বরফের মেয়ে’তেও এই বিষয়-ভাবনা অটুট রয়েছে। এর সঙ্গে বাড়তি পাওয়া কবিতায় থাকা বিনির্মাণ বা অনুসৃতি। এ নিবন্ধে কবির বেশ কিছু কবিতার বই আলোচনা করা হবে এবং আলোচনা থেকেই উঠে আসবে তার কাব্যপ্রবণতা।
সান্তিয়াগোর মাছ
কাব্যগ্রন্থটি শুরু হয়েছে প্রিয়া চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রিয়া কবির কাছে না গিয়ে ভুল গন্তব্য পৌঁছায়, যা কবির কাছে বেঠিক মনে হলেও প্রিয়ার কাছে তা-ই ঠিক। প্রিয়া চলে গেছে অন্যের কাছে, তার ঘরণী হতে। গেছে এমন একজনের কাছে, যে তার জন্য অপেক্ষারত নয়, ভেতর কিংবা বাইরে তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও নেই। অসহায় মুহূর্তে কবি নিজেকে সামাল দিতে সান্ত্বনা খোঁজেন একটি প্রশ্নে: ‘তখন কি তুমি আবার ফিরে যাবে সেই অসম্ভব দীর্ঘ/পথের পশ্চাদময়তায়’ (অতপর তোমাকে)। কবি এও জানেন, যে চলে গেছে, সে আর আসার নয়।
তিনি আমাদের শোনান ‘চিড়িয়াখানার গল্প’। যে গল্পে ক্যাঙ্গারুর অসহায়ত্ব স্পষ্ট। তার কবিতা আমাদের নিয়ে যায় ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণে ও ব্যক্তির সন্ধানে। এটি তার কবিতার একটি স্টাইল ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ইতালি, গ্রাৎসিয়া, ফিনল্যান্ড থেকে অ্যান, কানাডার ফ্রান্সিস, যেখানে গ্রীষ্মের জল ক্রীড়া বেশ জমে, সেখানে নিয়ে যান, তারপর রূপসী ক্যামে নিয়ে যান, যে রূপসী হেসে সবাইকে বলে, ‘গুড মনিং’। সেখান থেকে আমাদের যেতে হয় রচেস্টার দুর্গের সীমানায়, তারপর আমরা দেখতে পাই, মিডওয়ে নদীর বয়ে যাওয়া। আমরা জেনে ফেলি, শেষবার নিদ্রিত হওয়ার আগে মেরিলিন মনরোর শেষ হাসি প্রসঙ্গে, জানি জোসেফিনার মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞায় নাপোলিও বোনাপাটের চোখ বন্ধ হওয়া বিষয়ে।
মরে গেলে কেবল মানুষের কদর বাড়ে, জেনারেল মারা গেলে তার জীবনী পাঠ্য হয়। দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাকে দেওয়া হয় নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, হয় শোকসভা, অথচ মৃতের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রকাশে গড়িমসি।
প্রথামত সেই শবদেহ মর্গে পাঠানো গেল
আজো তার সুরতহাল রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি।
(ময়নাতদন্ত: ১৯৭৫)
বর্তমানেও আমরা এমন দেখতে পাই, তনুর মৃত্যুর ২ মাস পার হয়ে যাওয়ার পরেও প্রকাশিত হয়নি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। অথচ সাতদিনের ভেতরই প্রকাশিত হওয়ার কথা এই রিপোর্ট। পেছনে রয়েছে শক্তিধরের হাত, রাঘববোয়ালের হাত, তাই বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই বেতিব্যস্ত। যেমন হয়ে আসছে দশকের পর দশক।
কবি নিয়ে আসেন তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে, যেখানে সময়ের অভাবে যেতে পারেননি জেলেপাড়া দেখতে। ‘আমি বলেছি যাবো/ কিন্তু হয়নি সময় কখনও/ অতপর তুমিও ভুলে গেছো নদীর স্বপ্ন’ (বিপর্যয়)। বন্ধুর মৃত্যুতে ব্যথিত হন কবি। বন্ধু সুবিমলের জায়গা হয় না জলস্থল, নদনদী, রাস্তাঘাট, গাছপালা কোথাও। যে বন্ধু কবিকে বলেছিলেন, ‘কলকাতা এলে অবশ্যই আমার বাসায় উঠবি।’(আমার বন্ধু সুবিমল)। এরপর কবি তাকে রেখেছেন কবুতরের মতো মনের মধ্যে, সযত্নে রেখেছেন বুকের মধ্যে। বন্ধুর মৃত্যুর শোক কমতে না কমতে তিনি টের পান গৃহপ্রবেশ মানে আরেকটা মৃত্যুর অভ্যর্থনা।
মার খাওয়া মানুষের প্রতি আমাদের পক্ষপাত সহজেই হিসাব রসঘন করে। কবির বেলাও তাই ঘটে। যে লোকটা জল বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতো, মিছিল-মিটিং কমে যাওয়ায় জল বিক্রি করতে না পেরে তার যে অসহ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়, তা দারুণভাবে ব্যথিত করে কবিকে। যেমন ব্যথিত হন শ্বেতাঙ্গের আক্রমণে বিপর্যস্ত কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে দেখে। যে আওয়াজ তুলে বলছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, মা বসে আছে আমার পথ চেয়ে।’(বর্ণবাদ)। কিন্তু লাভ হয় না সেই আওয়াজে, চিৎকারে, অসহায়ত্বে। ততক্ষণে তার কপাল বেয়ে দরদর করে রক্ত ঝরতে থাকে।
কবি বেদনায় সিক্ত করে হাঁপিয়ে ওঠেন না, তিনি এ অন্যায়ের প্রতিবাদে জড়ো করেন বঞ্চিতদের। যারা প্রতিবাদ করে, আদায় করতে চায় নিজেদের অধিকার। বলেছেন, বাঁচার কথা, সম্ভাবনার কথা, নতুনের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা:
ডাইনি বুড়ির শাদা চুলগুলো
ঘৃণার কাঁচিতে কুচিকুচি কেটে দাও
অদ্য তোমার নতুন জন্মদিনে।
হরপ্পার চাকা
কবি প্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করতে করতে বিরক্তি জন্ম নেয়। কবি একঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন, এই সময়ের ভেতর কবি দেখতে পান, ‘মেঘেরা একের পর হাতি, বাঘ, ভালুক, ঘোড়া/হয়ে হাঁটতে-হাঁটতে চলে যাচ্ছে বহু দূর। কতবার/ উঠছে-নিভছে রোদ।’ অসম্ভবও সম্ভব হচ্ছে এই অপেক্ষার সময়টুকুতে, কেবল প্রিয়ার দেখা নেই। এই সময়ের ভেতর হয়ে যেতে পারে মাইন কাম্ফের ছোট সংস্করণ। আর প্রিয়া বলে যায়, ‘একঘণ্টা কেন, ভালো প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনে/এক শত এক হাজার কিংবা এক লক্ষ ঘণ্টাও অপেক্ষা/ করতে হতে পারে, অপেক্ষা করতে শেখো।’ (একঘণ্টা বড় দীর্ঘ সময়)। প্রিয়া যদি এমন অপেক্ষায় থাকতো তাহলে নিশ্চিত কবির জীবন দিয়ে সে রচনা করে ফেলতো আরেকটি মহাকাব্য। যান্ত্রিক জীবন কেড়ে নিচ্ছে এবং নিয়েছে আমাদের প্রেম-ভালোবাসা।
কবি খেয়াল করেন পরিবর্তন, পরিবর্তনে কেবল অস্থিরতা। মানুষ সুখের বদলে অসুখ, অস্থিরতা নিয়ে বেঁচে আছে। পরিবর্তমান বিশ্বে ‘ছুরিরা ঘুরে বেড়ায় মানুষের খোঁজে’। গুম, খুন, নষ্ট রাজনীতি, চাপাতির ব্যবহারে মানুষ আতঙ্কিত, কবিও জেনে ফেলেন: ‘এই শহরে মৃত্যুই কি তবে স্তব্ধতার একমাত্র কাব্যানুবাদ।’ (হ্যালুসিনেশন: এই শহরে)। দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন মানুষের মুক্তি নেই। ভালোর সন্ধান নেই, দেখা নেই। অ-ভালোর চাদরে ঢেকে আছে সমস্ত আকাশ, চাঁদ, জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্নার আলো পড়া পৃথিবীর মানুষের মন-মগজ। সেখান থেকে মুক্তি নেই, আছে কেবল আচ্ছন্নতা।
হতাশ কবি হিসাব কষে ফেলেন, বলেন, ‘নিঃস্বের আবার কিসের লেনদেনের শর্ত/আমি তাই ফিরে এলাম নিঃস্বই!’ (সহজ কবিতা)। কবি অনাচার থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান, সত্যের পথে এগোতে বলেন। দীর্ঘ কবিতায় সত্যের সন্ধানে নামার কথা বলেছেন। বলেছেন অনুশোচিত হতে, অনুশোচিত হয়ে আত্মার সমৃদ্ধি দিতে পারলে, নিজেদের উন্নত করতে পারলে, জীবন হবে সুখপূর্ণ। ‘আশা করা যায়, প্রেমর জোয়ারে একদিন প্লাবিত/হবে আরবের বালি।’ (প্রেম বিষয়ে কূটতর্ক)। কবি দেখতে পান ‘বিজয়ের লাল পতাকা’ উড়ছে।
পৃথিবীর সমস্ত সকাল
গ্রন্থের শুরুতেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের শহর নিয়ে বিদেশী বন্ধুর সঙ্গে আলাপ’ করতে গিয়ে পুলিশের অকাজে সক্রিয়তা ও সু-কাজে নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে বলেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ কাজে খুব বেশি ভূমিকা রাখে না, অ-কাজে খুবই তৎপর। তাদের সামনে সাধারণেরা হাঁটলে ধরে নিয়ে যায়, কিন্তু খুন, ছিনতাই হয়ে গেলে তারা কেবল হয়ে থাকে নীরব দর্শক। তাদের ভূমিকার মতোই রাষ্ট্রের ভূমিকা ও সময় ব্যয় করা। যেখানে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের অন্তর্বাস্তবতা নিয়ে বই লিখলে কর্তৃপক্ষ সেই বই নিষিদ্ধ করে। সমালোচনা গ্রহণের ক্ষমতা নেই, আছে কেবল প্রতিক্রিয়া (নির্বাপণ-তৎপরতা)।
রাষ্ট্রের পর ব্যক্তি মানুষের মতি-গতিও কবি বোঝেন না, বোঝেন না প্রিয়ার মনও। প্রিয়ার জন্য সভ্য থেকে অসভ্য হতে গিয়ে তিনি পান চোর খেতাব। আবার পাহাড়, সমুদ্র, আকাশ এনে দেবার পরেও ভরে না তার মন। আমরা কেবল কাজের মধ্যভাগ নিয়ে ছোটাছুটি করি, কিন্তু শেষটায় মনোযোগী নই। ফলে সফলতা আসার সম্ভাবনাও থাকে জিরো। এই হিসাব-নিকাশে ক্লান্ত কবি তাই শান্তি কামনা করেন, ‘তবে এখনকার মতো আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।’ (মানুষ নামক এই)।
নিরানন্দপুর
কবি চারপাশের বিদঘুটে পরিবেশে বিরক্ত, কোনো কিনার দেখতে পান না, কেবল বক্রাকারে ঘুরছে সবই। ক্ষমতাসীনদের হাতে থাকে পুষ্প, যারা দুর্নীতিপরায়ণ, হত্যাকারী তারাই সমাজে সমাদৃত: ‘যারা কাল রাতে বহু-ক্ষণ ধরে/পরখ করেছিল ভোঁতা ও ধারাল ছুরির ধার,/আজ ফুল ফুটে আছে তাদের হাতে।’ (সাম্প্রতিক)। ধর্মের নামে চাপাতির ব্যবহার করছে যত্রতত্র। হত্যা করছে মানুষ, যে প্রবণতা এখন বেশি। এতটাই বেশি যে, চাপাতির কোপ থেকে রেহাই পাচ্ছে না মসজিদের ইমাম থেকে নাস্তিকও। অথচ কোনো ধর্মই হত্যা সমর্থন করে না। তাদের বীভৎসতাকে কবি নির্মাণ করেন ব্যঙ্গভরে:
লৌহময় হাতে যারা একদিন পশু উৎসর্গ
করেছিল ঈশ্বরের নামে, আজ দেখি
তাদের ছুরির নীচে মানুষ গড়ায়।
সৃষ্টিকর্তার নামের আদ্যাক্ষরকে তারা খুব করে
বালিতে শাণিয়ে নেয় দীর্ঘক্ষণ ধরে,
শাণিয়ে তাকে ছুরির মত করে বসিয়ে দেয়
মখলুকাতের গলায়।
শেষে প্রার্থনাগারের মিহি-মখমল গালিচায়
রক্ত মুছে সেটি রেখে দেয় পবিত্র বস্ত্রের নীচে।
(বেঁচে থাকার আকাঙক্ষা)
নীতি থেকে মানুষ বিচ্যুত হয়, হচ্ছে ক্রমাগত। আদর্শ থেকে সরে আসছে। সমাজে যারা ধনপতি, মালিক, ক্ষমতাসীন তারা নিজেদের পৃথিবীর সুখ-সমৃদ্ধির স্তরে রেখে একা একাই ভোগ করছে নানাবিধ দামি-দামি খাদ্য। যে খাদ্য সমাজের নিম্নবর্গ কখনোই পায় না, জানেই না সেসবের স্বাদ কেমন।
খেতে না পেয়ে, জীবন সংসার পরিচালনা করতে যুবক চলে যায় ভুল পথে, সমাজ তাকে যেতে বাধ্য করে। দেশে যে হারের বেকারের সংখ্যা বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। দেশে লাখ লাখ মানুষ বেকার। বেকারত্বের অভিশাপ জীবনকে গ্রাস করে ফেলে। আবছা আবছা আলোয় জীবনকে কলমদানিতে রাখতে চায় সামনে আসন্ন অন্ধকার জেনেও। তারা ফেরিওয়ালা সেজে ফেরি করে গুলি, বোমা, চাকু, পিস্তল। মায়েরাও এতে বাধা দেয় না। জানে সংসার প্রদীপ জ্বালাতে অর্থ প্রয়োজন, এ না হলে শরীরে প্রাণ থাকতে থাকতেই ঘাস গজাবে। তারা এটাকে ব্যবসাই মনে করছে, কবির ভাষ্যে:
মায়েরা ভাবে মন্দ কী,
বেকারত্বের চাইতে এ-যে ঢের ভালো,
সত্যি কথা বলতে কী,
এ-তো এক ধরনের লোহা-তামার ব্যবসাই বটে।
(নগযুগের ফেরিঅলা)
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এনজিওগুলোর শোষণ দেখে কবি ব্যথাহত। সাহায্যের নামে তারা ঢুকে যায় সংসারের ভেতর, সেখান থেকে উদ্ধার করে নিজেদের ক্রেডিট। সামান্য সহায়তা আশ্বাস পেয়ে ব্যক্তি দিয়ে দেন সবই তাদের হাতে।
মোটকথা এরা তোমার
সর্ব-সরবরাহকারী,
বিনিময়ে তোমরার মনটা ওদের চাই,
শুধু সেটাই দরকারী।
(এনজিও)
অসুস্থ মানুষের আশ্রয় হাসপাতাল, মানুষ বলতে যাদের টাকা পয়সা নেই তাদের কথা বলা হচ্ছে, ধনীরা তো নিজের বাড়িতেই তৈরি করে ফেলেছে হাসপাতাল। সেখানে ডাক্তার যায় কাজ ফাঁকি দিয়ে, টাকাও পায় ভালো। আর সাধারণের হাসপাতালে থাকে না বিছানা, শোয়ার জায়গা। কাতরাতে কাতরাতে আরও বেহাল দশা তৈরি হয় রোগীর। কবি অনুভব করেন: ‘হাসপাতালে আসনের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে,/ অথবা বাড়াতে হবে হাসপাতালের সংখ্যা।’ (আরোগ্য-নিকেতনের সংখ্যা)। এমন বহু রৈখিক বক্র জীবনে কবি ক্লান্ত। তিনি কামনা করেন সরল জীবন, যেখানে থাকবে অন্তত কিছুটা হলেও শান্তি। এই সারল্যে তিনি একেবারে না হোক ভিন্ন-ভিন্ন বারে, মাঝে-মাঝে দম নিয়ে, ছোট ছোট বিরতিতেও পৌঁছতে চান।
বৈশ্য বিশ্বে এক শূদ্র
আবুল হাসান বলেছিলেন, ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা।’ মূলত মানুষ একাই; সে নিঃসঙ্গ, শত মানুষের ভিড়েও মানুষ নিঃসঙ্গ, এই শেয়ার প্রকৃতিও নিতে চায় না। কবি জেনে ফেলেছেন এই হিসাব, যে হিসাব বুঝিয়েছে সমুদ্র, সে আন্দাজ করতে পেরে নিজেকে ক্রমেই সরিয়ে নিচ্ছে, ‘সমুদ্র-তটরেখা দূর থেকে/ দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমে-ক্রমে।’ সমুদ্র ছেড়ে প্রকৃতির অন্য উপাদানের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে বিড়াল-কুকুরও হয়ে উঠেছে কবিতার বিষয়। যেখানে মানুষের সঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায় তাদের সাদৃশ্য।
এ সিদ্ধান্তে শেষে পৌঁছানো হয় যে
নিজেদের নিয়ে আছে সকলেরই প্রাতিস্বিক চিন্তা-ভাবনা,
এবং তা নিয়ে তারা ভেতরে-ভেতরে ঠিকই সচেতন।
(আমাদের প্রাণীজগত বিষয়ে কয়েকটি কথা)
চিন্তা-ভাবনায় তারা সচেতন, নিজেদের হিসাব ঠিকই রাখেন পাকাপোক্ত। এই প্রাণীকূল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করলেও মানুষেরা তা করে না, একটা না একটা ফ্যাসাদ লেগেই থাকে, লাগিয়ে রাখে। যন্ত্র কেড়ে নিয়েছে তাদের সহমর্মিতা, ভালোবাসা, এমনকি ঈশ্বরকে পূজা করার উদ্দেশ্যে ঢুকেছে ভেজাল। বাড়িতে তুলসী গাছ রেখে পূজা করায় বদল আসে। এ গাছে কোনো অর্থ আসে না, তাই তুলসীর জায়গা দখল করে নেয় ডালিম গাছ। গেরস্থ এ গাছ লাগিয়ে খুঁজে অর্থের সমৃদ্ধি। কষে ফেলে হিসাব:
গতকাল তোমাদের বাড়ি দেখে এসেছি
প্রথমেই বলে রাখি, তোমার আশঙ্কা সত্য-
তুলসী গাছের কাহিনী শেষ, ডালিম গাছের কাহিনী শুরু,
ডালিম এখন প্রতি কেজি দুইশত চল্লিশ করে,
অর্থাৎ সবটাই এক প্রবল অর্থমনস্ক ব্যাপার।
(গতকাল তোমাদের বাড়ি)
কবি বন্ধনহীন থাকতে চান, প্রিয়াকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাবেন বহু দূরে। যেখানে থাকবে না বাড়িতে ফেরার তাড়া। তারা ভুলে যাবেন বাড়ির ঠিকানা; সারাজীবন রাস্তায় কাটিয়ে দিতে চান। কবি অনুভব করেন মাঝে মাঝে ব্যথিত হওয়া ভালো গুণ এবং এ দরকার। বন কেটে লোকালয় বানিয়ে বসবাসের জায়গা সংকটাপন্ন করায় কবি বিস্মিত। একদিকে হারাচ্ছে প্রকৃতি তার ভারসাম্য, অন্যদিকে মানুষের জীবনাচলও হারাচ্ছে গতি, বনের পশু লোকালয়ে আসায় মানুষ হচ্ছে বিপদাপন্ন। ‘নাগ আর বাঘেদের সম্মিলিত প্রহরায়,/ জঙ্গল তো কোন্ ছার, নগরেও টেকা দায়।’ (চতুর্পদী)।
দেশ, সমাজ, মানুষের সুরক্ষায় নিয়োগ দেওয়া হয় পুলিশ, যদিও বসে ও দাঁড়িয়ে থাকতেই আমরা তাদের সবসময় দেখি। এই পুলিশের মনস্তত্ত্ব পাওয়া যায় ‘আমদের পুলিশেরা’ কবিতায়। এখান থেকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হয় মুক্তিযুদ্ধের দিকে। ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক কাহিনী আমাদের ব্যথিত করে, সঞ্চয় করে চেতনা। সেসময় চরিত্র বুঝতো না আসলে দেশে হচ্ছেটা কী? কোথায় যেতে হবে নিজেদের সেভ রাখতে এবং কেন যেতে হবে সেই হিসাবও মেলাতে পারে না। দেশে মিলিটারি ঢুকেছে, না সুন্দরবনের বাঘ ঢুকেছে সে বুঝতে পারে না। মানুষের হাউকাউ কেবল বুঝতে পারে, মানুষের বাইরে বেরোনোর তাগাদা কেবল টের পায়। টের পেতে পেতে দেখে তার মাথায় রক্ত, বলে:
ও চন্দ্রার মা, মাথায় কী য্যান পড়ল এট্টা!
এহে, রক্ত বারাচ্ছে গো! হে হে মনু, মরে গেনু মুই!
আমারে ফ্যালায়ে সব বডারে চলে গিয়েছে…এ এ এ…
অ বউ, অ চন্দ্রা…আর পারি না বাপু…
ঘুম পাতিছে আমার, বড় ঘুম…
(তোমরা সব যাতিছো ক’নে)
এমন পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছিল সেই সময়। কেবল নিজেকে বাঁচিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা সবার ভেতর ছিল, কিন্তু পেরেছেই বা কতজন? যেমন পারেনি সংসারে কর্তা লোকটি। সে তার মেয়ে, বউকে ডেকেও পায়নি, কেউ আসেনি তাকে বোঝাতে দেশে হচ্ছেটা কী। মরতে মরতে সে জেনে গেছে দেশের অবস্থা ভালো নয়, যা সে মেনেছে এটাই সেই সময়ের চরম বাস্তবতা।
এ বইয়ে রয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবণী বাড়ি আছ’র কবিতার অনুসৃতি। যার শিরোনাম: নলিণী বাড়ি আছ। এটা হয়ে উঠেছে বিনির্মাণও।
অসুস্থতা থেকে এই-মাত্র
কবিতায় শাণিত হয় ব্যঙ্গ, চরিত্র ম্যাক্সি আর অন্তর্বাসের ব্যবহারের হিসাব মেলাতে না পারলে। ম্যাক্সি ছিল রাতে পরার জন্য, কিন্তু তা না বুঝেই মানুষ এই বস্তুটি পরে রাস্তায় বেরোতো। গাভী বুঝতে পেলেও মেয়েরা বোঝে না।
গম-চাল-দুধ এলে ঠিক-ঠিক খায়,
তা-সে আসুক বিশ্বের যে-প্রান্ত থেকেই
সহজাত প্রতিভায় জানে, গাভী যদি
ডাকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়, তবু তার দুধ
দেশে দোওয়া হয়।
(যখন প্রথম দেশে)
গাভী বুঝে ফেলে গম-চাল-দুধ যে দেশ থেকেই আসুক তা খেতে হবে, হজম করতে হবে, হজমে ব্যবহার করতে হবে সঠিক কৌশল, যেন বদ হজমের ঢেকুর বারবার না ওঠে। কেবল মেয়েরোই সে হিসাব বুঝতে পারে না, বিদেশ থেকে যাই আসুক না কেন তা কিনবে এবং কিনবে কোথায়, কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা না জেনেই। যেমন বোঝে না ম্যাক্সির মতো অন্তর্বাসের ব্যবহারবিধি। তাই কবি ব্যঙ্গ জোরদার করেন:
নগ্ন থাকা ভালো, সবাই প্রাকৃতিক,
ইনডিজেনাস। পোশাক সওয়ার হলেই
তার ঘাড়ে চাপে কত রঙ-রূপ-রেখা।এখন ক্বচিৎ ভ্রম হয়। বিদেশীরা
উদ্ভাবন করে যদি, মুহূর্তেই তার
ছবি ছাপে দেশময়, পাতায়-পাতায়।আজ সকলেই জানে, কোনটি অন্তর্বাস
আর কোন্টি পরে বাইরে বেরোতে হয়।
(ঐ)
এদেশের জিনিস অন্য দেশে পাঠানো, আর সিলযুক্ত হয়ে ফেরত আসলে তা হয়ে যায় অন্য দেশের, এতেও কবির ব্যঙ্গ। ধানের বেলায় সেই একই কথা। এদেশের ধান নিয়ে যায় ভিন দেশের গবেষকরা, তারা যে নাম দেয় সেই নামেই চলে এরপর থেকে (ধান দেখবে বলে)। সবই যে প্রকাশিত হয় তা নয়, কিছু গোপন থাকে তাদের নিজস্ব হিমাগারে (প্রথম বার বিলাতে গিয়ে)। শহরের ঘোড়া নিয়েও প্রকাশিত ব্যঙ্গ। যারা ঘোড়ার পিঠে আরোহী ওঠে না, তারা দাঁড়িয়ে থাকে এফডিসির বাইরে, প্রতীক্ষা করে কখন ডাক পড়বে বাংলা সিনেমায়।
ব্যঙ্গের বাইরে কিছু কবিতায় প্রকাশিত প্রিয়ার ভুল ঠিকানা ও সেই ঠিকানা অনুযায়ী খুঁজতে গিয়ে কবির পণ্ডশ্রম, পাহাড় কেটে ঘরবসতি নির্মাণ প্রসঙ্গ, যেখানে এখন আর পাহাড়িদের নিয়ে ভয় নেই, কারণ বর্তমানে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বিপদে-আপদে ঘোষণা দেওয়ার নানা রূপ বন্দোবস্ত আছে, বলেছেন শহীদুল জহির, মামুন হোসাইন, মঞ্জু সরকার প্রভৃতি গল্পকার প্রসঙ্গে ও বর্তমানে লেখা গল্পের অন্তঃসারশূন্যতা বিষয়ে, যেখানে গল্প লেখায় বিরতি টেনে তিনি নিজে কিছুকাল কবিতা লিখতে চান।
এই নাও দিলাম সনদ
আপনার পবিত্র ধড় থেকে নেমে যাচ্ছে মাথা আর
শুভব্রত’র সমস্ত পৃষ্ঠা, লাল পৃষ্ঠাবলী পরতে পর
পরত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
(আপনার পবিত্র ধড় থেকে)
এখনকার সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ হলো গলাকাটা, মাথা থেকে ধড় সরিয়ে দেওয়া, মৃত্যু নিশ্চিত করা চাপাতির কোপের পর গুলি চালিয়ে। কে বা কারা হত্যা করছে, এর সন্ধান দিতে পারছে না প্রশাসন। তারা দেখতে কেমন? কেনই বা এই খুনে তৃপ্তি খুঁজছে, এর রহস্য উদঘাটন সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের সামনে চাপাতির ব্যবহার হচ্ছে, খুন হচ্ছে অমল বা কামালরা, তারা নীরব দর্শক। তাদের মুখচ্ছবি আঁকিয়ে দেখতে চাওয়া বা খুনের মামলার তদারকি বা আসামীকে গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ঢিলেঢালাভাবে চলছে এর তদন্ত। কোনো কোনো খুনের বয়স ২ বছর বা একযুগ হয়ে গেলেও এর কোনো সমাধান নাই। বিচার নাই। খুন হচ্ছে, নিরাপত্তাহীনতায় থাকছে মানুষ এটা সত্য। অন্য কিছু বা বিচার প্রক্রিয়া অনেকটাই মিথ্যা।
মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার উপায়গুলোও অসহায় হয়ে পড়ছে। কবি বিরক্ত এমন কাজে। তিনি সাদার বদলে তাই অন্য রং খোঁজেন। কারণ সাদার সাথে মৃত্যুর প্রসঙ্গ জড়িত। মরার পর সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয় শরীর, যা প্রচলিত। এমন অস্থিরতার মধ্যে কবি দেখতে পান ব্যক্তিমানুষের নিঃস্ব হওয়া, শোষণে পিষ্ট হওয়া।
চঞ্চুর টানে সবটা অমৃত টেনে নিয়েছো।
যেরকম সামন্ত-প্রভুরা সেকালে গড়গড়ায় নিংড়ে নিতো
তামাকের প্রাণ। বর্তমানে প্রায় একই কায়দায়
লৌহনলে অমৃতের ভাণ্ড শুষে নেয় সামরিক প্রভু
আর পরিচিত অর্থলগ্নী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
(চঞ্চুর টানে)
বাইরের দেশে কুকুরেরা যত আরাম আয়েশে দিনযাপন করে, অনাহারী, দারিদ্র্যক্লিষ্ট এদেশের মানুষ তা পায় না। কুকুরের থাকে আলাদা শোবার ঘর, খাদ্যদ্রব্য রাখার জন্য পৃথক সেলফ। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ যে ঘরে খাদ্যদ্রব্য রাখে, সেখানেই ঘুমায়। এ নিয়ে ব্যঙ্গ প্রকাশিত ‘বিলেতে যেসকল কুকুর’ কবিতায়।
কিছু কবিতায় রয়েছে প্রেম প্রসঙ্গ। কবি বলেন প্রিয়া তাকে গ্রহণ করে শত বিবেচনা শেষে, এবং কবি চান প্রেমের পিষ্টতা থেকে মুক্তি।
আমরা যারা স্যানাটরিয়মে
এই কাব্যে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি কবির দৃষ্টিপাত লক্ষণীয়। কবি বলেন তাদের কথা, তারা কাঁচা মরিচ খায়, পেটের শূন্যস্থান ভরে জল ঢেলে:
যারা মাছ-মাংস আর অন্য-অন্য তরকারির ভাগ্য-
বঞ্চিত তারা এসব কাঁচা মরিচকে রাগে-বিক্ষোভে দাঁতে
ফেলে কচ্ কচ্ করে খায়; মরিচও তখন ফুঁসে ওঠে
স্ব-তেজের অগ্নিতে, তখন সেই আগুনের প্রশমনে
মাছ-মাংস-ডিম আর অন্য-অন্য তরকারি থেকে বঞ্চিত
লোকেরা এখনও মোটামুটি সুলভ জল ঢকঢক ঢেলে
দেয় গলার সুড়ঙ্গ-পথে। সে-জলে লঙ্কার ঝাঁজ কমে;
পরন্তু, পেটের ক্ষুধাতুর শূন্যস্থান জলে ভরে ওঠে।
(কিছু নধরকান্তি কাঁচা লঙ্কা)
সমাজে শ্রেণী বিভাজনই সত্য। আমরা একই রাস্তায় হাঁটলেও উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ বিভাজন থাকেই ভেতরে ভেতরে। এই সত্যকে কখনোই এড়ানো যায় না। নিম্নবর্গ কেবল মার খায়। আমরা থার্ডওয়ার্ল্ডের মানুষ, তাই এখানে আমাদের পরিবর্তন প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের মানুষের মতো দ্রুত আসে না, আসার সম্ভাবনাও থাকে কম। কূট নৈতিক পরিবর্তন, জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন কেবল আসতে পারে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের সহযোগিতায়, থার্ড ওয়ার্ল্ডের নিয়ম-নীতি, পরিবর্তন অন্যের দিকে তাকিয়ে; তারা পরনির্ভরশীল।
…এবং থার্ডের
কাজ আজীবন চাতকের মত করুণ তাকানো
ফার্স্ট আর সেকেন্ডের দিকে!
(ফাস্ট-সেকেন্ডে-থার্ড)
ফলে নতমুখী এই মানুষেরা ‘সবুজ বা বিভিন্ন বৃক্ষের মত আলোহীনতায় কালো/অন্ধকার অর্থাৎ রাতের কারণে দৃশ্যমান হচ্ছে না।’ (প্রত্যাবর্তনের কালে রাতে)। কবি জেনে ফেলেছেন বয়স বাড়লে, বৃদ্ধ হলে তখন ভালোবাসার বদলে কাগজই হয় বড়, পরম সত্য। যেখানে কর্তা কতটুকু সম্পত্তি রেখেছে, পরিবারের সদস্যরা কতটুকু পাবে সেই হিসাবেই স্থির, অন্য বেলায় তার উপস্থিতি খুবই কম। বৃষ্টি রোমাঞ্চ জাগালেও সে হয়ে ওঠে ক্ষতির কারণ, যে হিসাব কবিতায় স্পষ্ট। ভূমিকম্পের সময় মানুষের ভেতর এমনই আতঙ্ক থাকে, এর ভেতর ধর্ষণের ঘটনা আরও অস্থির করে তোলে। বাজারে বরফে ঢাকা প্রাণহীন মানুষও কবিকে ভাবায়। প্রেমিকা প্রেমের ফাঁদে ফেলে ছিনতাই করে, সে গল্পও বলেন আমাদের। তিনি ‘ছিনতাই ছিনতাই’ বলে চিৎকার দেন, কিন্তু সেই আওয়াজ কারো কানে প্রবেশ করে না (এসবের মর্ম)। প্রেমিকার কাছেও ব্যক্তি নিরাপদ নয়। ফলে মানুষ হয়ে ওঠছে অবিশ্বাসী। মানুষ হয়ে যাচ্ছে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। আমাদের ভেতরের প্রেম-ভালোবাসা ঘুমিয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে ফিকে। বিকেল ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে আমাদের সময়াভাবে।
অথচ সময় দিতে পারলে বিকেলগুলি অনায়াসে সন্ধ্যা
কিংবা রাত্রি হয়ে যেতে পারতো।
(বহুদিন পর)
ওগো বরফের মেয়ে
বরফের মেয়ে কবির প্রেমিকা, তার জন্য ঝলসাতেও রাজি, তার সঙ্গে কাছাকাছি দাঁড়াতে চান। ঝরা পাতার রূপকে কবি প্রিয়ার অনুপস্থিতিকেই বোঝান। মাঝে মাঝে প্রিয়াকে টেস্ট করার জন্য তাকে পোড়ান, ওড়ান, আবার তাকে জড়ান। বরফের মেয়েকে কবি আহ্বান জানান সে যেন তার অস্তিত্ব নিয়ে কবির কাছে থাকে, দেখা দেয় সবসময়। বরফের মেয়ের সঙ্গে মিলে কবিও হতে চান নদী, সমুদ্র।
এসো তুমি নিরুদ্বেগে তটিণীর বেশে।
আমিও নদী হবো নিসর্গ-নিরিখে,
দু’য়ে মিলে যাবো ছুটে সমুদ্রের দিকে।
(তুমি-আমি নদীতে)
মাঝে মাঝে সে ডুব দিলে কবি ছটফট অনুভব করেন, তাকে খুঁজতে যান নাটোরে, সেখানে গিয়েও তাকে খুঁজে না পেলে অভিমান জমা করেন নিজের ভেতর, প্রশ্ন রাখেন: ‘অথচ নাটোর গিয়েও তোমাকে পাই না।/ কোথায় তুমি।’ (কোথায় তুমি)।
বরফের মেয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেই সকাল শুরু হতো, নিয়মের চলাচল ঘটতো এ শহরে। সে কাছে এলে কবির ভেতরে অবস্থান করা সমস্ত হিংস্রতার পার্ট চুকে যায়। বরফের মেয়ে কবির কাছে আলো, সেই আলো গোধূলির দিকে যায় এবং সন্ধ্যা হয় :
তুমি চলে গেলে আমি গাঢ় অন্ধকারে বসে-বসে অনুভব করি
তুমি আলো ছিলে, আলোই গোধূলির দিকে যায়।
আর, আলো-ই তো সন্ধ্যাও হয়ে যায়।
(এক মেঘেই)
প্রকৃতির মিলনে কবি বরফের মেয়েকে খোঁজেন, চান :
আমি তাই জোছনার ছুটোছুটি দেখবার ফাঁকে
তোমারও প্রত্যাশা করি।
(তুমিহীন চিত্রকল্পের কবিতা)
কিন্তু প্রিয়া কাছে না থাকায় কবি প্রকৃতির আয়োজনে কোনো তৃপ্তি পান না, তৃপ্তি পান না চাঁদ দেখে, জ্যোৎস্না পোহানোয়। কবি জানেন বরফের মেয়ে কাছে থাকলে নিঃস্বার্থ চাঁদের আলো পড়তো তার শরীরে।
কবি ছোটবেলার কথা স্মরণ করেন, যেসময় তার মা বান্ধবীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন ঘোড়ার গাড়িতে। তার মা রান্না ঘরেই অর্ধেকটা সময় কাটিয়েছেন সে কথাও বলেন। মায়েদের বঞ্চিত জীবন কবিকে ব্যথাহত করে। মায়ের বেদনা নিঃসৃত অশ্রু চাল ধোয়ার জলে, আর ভাতের ভাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে নাই হয়ে যেতো, যা কবির বাবাও টের পেতেন না।
আমার মেয়ে শহুরে মেয়ে ছিলেন তবু একদিন
চালধোয়া জলে তাঁর সমস্ত অশ্রু বিলীন হয়ে গেছে
বাকি যেটুকু ছিল তা ভাত হতে-হতে ভাপের সঙ্গে মিশে
চলে গেছে ঊর্ধ্বাকাশে।
(অশ্রু)
মায়েরা এমন বঞ্চিতই হয় এবং এ জীবনকে মেনে নেয় কষ্ট করে হলেও সংসার ও সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
আবার এখন সন্তানরাও হচ্ছে বঞ্চিত মায়ের বুকের দুধ খাওয়া থেকে। মায়েরা আধুনিক হয়ে ওঠতে চাওয়ার ফল হিসাবে সন্তানরা হচ্ছে এর চরম শিকার। এ সময়ের মেয়েরা সন্তান ধারণ করতে চায় কম এবং যাও জন্ম দেন সন্তান তাদের সেবার নিয়োগ করতে চান না নিজেদের ফিগার নষ্ট হওয়ার ভয়ে। এতে করে সন্তানকে ফিডার খেয়ে নানা দিক থেকে প্রতিবন্ধি হতে হয়, যা আমাদের জন্য কষ্টের ও লজ্জার (একটি অমার্জিত কবিতা)। সমকাল কবির কবিতায় চলে আসে নানাভাবে। অন্য কাব্যগুলোতে যেমন আছে তেমনি আছে এই বইয়েও। যেখানে সেখানে মানুষ খুন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে কবির উচ্চারণ : ‘তুমি জানতে না মৃত্যু তোমার-ও অধিক স্বাধীন,/ পিছু নেয় হন্তারক ছন্দ নিয়ে তাধিন-তাধিন।’ (নিরন্ন হেল্পার তুমি)।
কবির কাব্যের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ঐতিহাসিক চরিত্র নির্মাণ, সব কাব্যের মতো শেষ কাব্যেও রয়েছে :
ক. রেমব্রান্টের বরাত দিয়ে আমি তা বুঝতে চেয়েছিলাম
খ. উটের গ্রীবা ছুঁয়ে কবি আর্তুর র্যাঁবো
মরুভূমির বালিতে কেবলই দগ্ধ হতে থাকেন,
(আর ঘুমাবো না)
‘বৈশ্য বিশ্বে এক শূদ্র’ কবিতার বইয়ে যেমন রয়েছে বিখ্যাত কবিতার প্যারোডি, ‘ওগো বরফের মেয়ে গ্রন্থেও রয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্যারোডি। এ কবিতাগুলো হলো, ‘মনলতা সেন’, ‘বাংলার মুখ’ প্রভৃতি। প্যারোডি তাঁর কবিতায় একটা নতুন ধরন হিসেবে জায়গা পেয়েছে।
কবি মহীবুল আজিজ বিষয়-ভাবনায় প্রথম কবিতার বইয়ে যে বৈশিষ্ট্য দিয়ে শুরু করেছিলেন, সেই বৈশিষ্ট্য শেষ বইয়েও ঠিক রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলো হল, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট নির্মাণ, ঐতিহাসিক স্থান ও চরিত্রের ব্যবহার, ব্যঙ্গ, প্রেম, নিম্নবর্গ, দেশের গুম-খুন, মৃত্যু-চিন্তা, সত্যের আহ্বান ও মুক্তির সম্ভাবনা। এর ভেতর কিছু বিষয় কোনোটাতে বেশি যোগ হয়েছে, যেমন, আমরা যারা স্যানাটরিয়মে দেশ, সমাজের দিকটা বেশি নির্মিত। অসুস্থতা থেকে এই-মাত্র কাব্যে সমাজবাস্তবতার ক্ষত দেখাতে ব্যবহার করেছেন ব্যঙ্গ। ওগো বরফের মেয়ে’তে কবি পুরামাত্রায় প্রেমিক; প্রেমের নানা রূপ উপস্থাপিত হয়েছে। ‘বৈশ্ব বিশ্বে এক শূদ্র’- তে একটি প্যারোডি কবিতা ছিল, আর ‘ওগো বরফের মেয়ে’- তে সংখ্যা বেড়েছে। এক বইয়ে ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অনুসৃতি, অন্য বইয়ে রয়েছে জীবনানন্দ দাশের।
মহীবুল আজিজের কবিতাও এক প্রকারের গল্প; পড়তে পড়তে গল্পের স্বাদ চাগার দেয়; পাওয়া যায়; সময় ও সমাজের গল্পে কবি আমাদের নিমগ্ন রাখেন। তিনি পূর্ববর্তী কবিদের থেকে আলাদা হতে চেয়েছেন বিধায় নতুন বিষয় নির্মাণে সচেতন থাকতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি তিরিশের অমিয় চক্রবর্তী, জীবনান্দ দাশ, ষাটের আবুল হাসানের কাছে কিছুটা ঋণী। ঋণ হতেই পারেন, তারাও ঋণী থেকেছেন পাশ্চাত্যের কবিদের কাছে। বলছি এজন্য যে, কবি সব ঋণের কথা স্মরণ করেন। তিনি তাঁর দশক থেকে আলাদা হতে চেয়েছেন, নির্মাণ করতে চেয়েছেন নিজস্ব স্বর, যে কারণে সাধারণ বিষয়ও তার কবিতায় অসাধারণ হিসেবে নির্মিত; স্মরণীয়।