মহাদেব সাহা—অন্তর্মুখী ও নিম্নকণ্ঠের কবি। তার কবিতার মূল উপজীব্য প্রেম, প্রকৃতি ও নারী। কবিতায় চিরায়ত এ বৈশিষ্ট্যের অন্তরালে রয়েছে সূক্ষ্ণ রাজনীতি ও বিপ্লবনির্ভরতা। দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও তার অভিঘাতে সৃষ্ট সমাজবাস্তবতা। মিতভাষী এই কবি অবিরত লিখে চলেছেন পৃথিবীর কঠোর-কঠিন বাস্তবতা। তার কবিতায় নগরবাস্তবতা যেমন হাতছানি দেয়, তেমনি বিপ্লবী চেতনাও জাগিয়ে তোলে। ‘প্রেম’ বিষয়টি তার কবিতায় শুধু জোরালোই নয়, ব্যঞ্জনার ক্ষেত্রে তা বহুমাত্রিকতাসম্পন্নও। কবির প্রেম কখনো প্রেয়সীর প্রতি, কখনো নিজের জীবনের প্রতি, কখনোবা জাতির প্রতি। কবিতায় যেমন তিনি সৃষ্টি করেছেন পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব, তেমনি নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়েও বার বার হয়েছেন দ্বিধান্বিত। ব্যক্তিক উক্তি যেমন করেছেন, তেমনি করেছেন মনোজাগতিক বিশ্লেষণও। আবার চিন্তিত হয়ে পড়েছেন দেশের, বিশ্বের, আপামর জনতার শঙ্কিত অবস্থা নিয়ে। তাই মহাদেব সাহার কবিতাকে কোনো একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ সমীচীন নয়।
মহাদেব সাহা যুগের অসুখকে ধারণ করেও যুগোত্তরের স্বপ্ন দেখেন, দেখান। কবিতায় মূর্ত করে তোলেন মানুষের চিরায়ত জীবন। রোমান্টিক আবহে সৃষ্টি করে চলেছেন প্রেম, জীবন, সমাজ আর নিজস্ব দর্শন। মানবের চিরায়ত প্রেমের পাশাপাশি তিনি রক্তে ধারণ করেন বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা—
তার চেয়ে আমাদের ফিরে দাও রাজবংশ, রাজকীয়
অলীক বিশ্বাস
রাজকুমার তোমার রক্তে জন্ম নিক
জান্তব যৌবন, যুদ্ধ করে মরি।
(ফিরিয়ে দাও রাজবংশ)
কিংবা,
তাই এই কবিতার অক্ষরগুলো লাল, সঙ্গত কারণেই লাল
আর কোনো রঙ তার হতেই পারে না—
অন্য কোনো বিষয়ও নয়
তাই আর কতোবার বলবো জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই
অধিক সুন্দর!
(জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর)
‘ফিরে দাও রাজবংশ’ কবিতায় তিনি যুদ্ধ করে বাঁচার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। ‘জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর’ কবিতার ‘লাল’ হচ্ছে বিপ্লবের প্রতীক। মহাদেব সাহার কবিতার স্বর উচ্চগ্রামে বাঁধা না হলেও পাঠক বুঝতে পারে এই কবিতার চেতনাপ্রবাহে খেলা করে শোষিতের আর্তনাদ। ‘শাদা ভাত’ রূপকটি সুকান্তের ‘ঝলসানো রুটি’র মতোই উজ্জ্বল ও হৃদয়গ্রাহী।
বলাবাহুল্য, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদি রাজনৈতিক অনুষঙ্গ তাকে অনেক বেশি যন্ত্রণাবিদ্ধ করে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে তার কবিতায়। তিনি রোমান্টিকতার প্রচলিত ধারা ও চল্লিশীয় ধারার বিপরীতে তৈরি করেছেন অন্য এক রোমান্টিক দর্শন। রোমান্টিকতার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য—ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও কল্পনাপ্রতিভা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল হচ্ছে অহম বা আত্মবোধ। এটি এমন একটি বোধ যাতে ব্যক্তিই হবে আলোচ্য। যেন ব্যক্তি সূর্য আর বাকি সবকিছু গ্রহ-উপগ্রহের মতো তার চারপাশে আবর্তিত। আর তাই রোমান্টিক কবিদের বোধের রঙে পান্না হয় সবুজ আর চুনি হয়ে ওঠে লাল। মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী সমাজের কবিতায় সমাজের প্রতি মানুষের নতিস্বীকার লক্ষণীয়। কিন্তু আধুনিক রোমান্টিকতায় মানুষই বড়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে দেয় স্বাধীনতা। তাই রোমান্টিক কবি বাহ্যজগতে আশ্রয় না খুঁজে, যুক্তি-শৃঙ্খলার আশ্রয় না নিয়ে শরণ খোঁজেন নিজেরেই মনোবিশ্ব ও কল্পনাপ্রতিভার মধ্যে। অস্থিরতা তার নিত্য সঙ্গী, এক অদৃশ্য আগুন তাকে সর্বদা দগ্ধ করে। রোমান্টিকতার অন্য বৈশিষ্ট্য কল্পনাপ্রতিভা। রোমান্টিক কবিরা বড়বেশি কাল্পনিক হয়ে থাকেন। এই কল্পনাপ্রতিভা দিয়ে তারা সৃষ্টি করেন তাদের আপন বিশ্বলোক। যার ভিত্তি অহমিকা, যেখানে থাকে কেবল ব্যক্তি-অহমের আবেগ অনুভূতিবোধ। মহাদেব সাহার কবিতায় ব্যক্তি-অহম, আবেগ অনুভূতিবোধের পারম্পর্য লক্ষণীয়, আর এখানের মহাদেব সাহার সার্থকতা।
ভাবলাম অশ্রু কখনো মিথ্যা হয় না, তাই বিশ্বাস
করলাম অশ্রু,
কিন্তু শিশিরের চেয়েও আগে তা শুকিয়ে গেলো
সেই চোখের দিকে চেয়ে মনে হলো পৃথিবীতে এর
চেয়ে বড়ো মিথ্যা আর হয় না;
মানুষের চোখের জল দেখে ভাবলাম দুঃখ কখনো
মিথ্যা হয় না,
আমি তার বুকভরা দুঃখ বিশ্বাস করলাম,
কিন্তু সেও আমাকে মিথ্যা গল্প শুনিয়ে গেলো।’
(সব এতো মিথ্যা)
মানবচিত্তে নৈঃসঙ্গ্যচেতনা সৃষ্টির পশ্চাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ। আধুনিক সভ্য সমাজের তীক্ষ্ণ ও দ্রুত সংক্রমণে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব, বৈপরীত্য, সংঘর্ষ সবকিছু একই কক্ষপথে আবর্তনরত মানুষগুলোকে সমচুম্বকীয় টানের মতো পরস্পর থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দেয়। দৃশ্য কিন্তু অস্পৃশ্য এই মানুষগুলো তখন সৃষ্টি করে বেদনা ও মিলনের আকাঙ্ক্ষা। ফলে তখন সেই বেদনা দূরীভূত না হলে এবং মিলন সফল না হলে মানুষ ভোগে হতাশায়, আক্রমণ করে একাকিত্ব, নৈঃসঙ্গ। আর তখনই দেখা দেয় লুকিয়ে যাওয়ার, পাশ এড়ানোর প্রবণতা। রোমান্টিক চেতনার অন্যতম প্রতিভাস এই নিঃসঙ্গতা, যা থেকে জন্মায় পলায়নপর মনোভাব। কবি পালিয়ে যান নিজ থেকে, সমাজ থেকে। জীবনসংগ্রামে ব্যর্থতা, প্রণয়ে ব্যর্থতা, মানুষ হিসেবে ব্যর্থতা এই সব কিছু একটা সময় কবিচিত্তকে দুর্বল করে দেয় আর তা থেকেই কবি পালিয়ে বেড়ান।
শোকের শহরে আমি যার কাছে চাই ফুল, কিছু মনোরম শোভা,
যেসবের বিস্তৃত বর্ণনা আমি আপনাকে লিখতে পারি,
সে আমার হাতে শুধু তুলে দেয় দুঃখের বিভিন্ন টিকিট।
…বুকে কাশি, অবিরাম জ্বর-আমার রুক্ষ চুলে বিলি কাটে
দুঃস্বপ্নের হাত,
এসব খবর কি দৈনন্দিন লেখা যায়। কি করে লিখবো বলুন,
ঘরে একা দুঃসংবাদে কাঁদবে জননী। আজীবন লিখেছি,
তাই একই চিঠি, সেই মিথ্যে মর্মহীন একই চিঠি।
কবি নিত্যদিনের ‘দুঃখের বিভিন্ন টিকিট’ হাতে নিয়েও মাকে লিখে যান মিথ্যে ভালো থাকার বৃত্তান্ত। পুঁজিবাদী সমাজে অবক্ষয়ের সার্বিক কর্কটরোগে মানুষের পারিবারিক বন্ধন বিনষ্ট হয়েছে, ছিন্ন হয়ে গেছে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সম্পর্কের সনাতন সেতুবন্ধ। সমস্যাসংকুল পারিবারিক জীবন ব্যক্তির কাছে হয়ে ওঠে দুঃসহ এবং এ অবস্থায় সে ভালোবাসে একলা সময় কাটাতে; যে সমাজ তাকে শিখিয়েছে ‘অর্থ হলো প্রথম ঈশ্বর’। তারপর মানুষ একেবারে নিরস্ত্র হয় না, তাই কবি কামনা করেন নারীকে, নারীর ভালো লাগাকে, ভালোবাসাকে, ‘মায়ের মতো ভালো’ নারীর আশীর্বাদকে এই কামনাতে তিনি লুকিয়ে রাখেন হৃদয়ক্ষত।
ইচ্ছাকৃত নির্জন বিষাদ রচনা রোমান্টিক কবি মহাদেব সাহার চিরায়ত প্রবৃত্তি। তার কণ্ঠ নির্জন, অনেক বেশি অন্তর্মুখী—
আমি যাই, একা চলে যাই, শূন্য হাতে
আনন্দ বিষাদে বর্ষারাতে ধূসর জ্যোৎস্নায়
সব দুঃখ কখনো যায় না বলা, কখনো যায় না বলা
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিতে খুঁজেছেন জীবন-নির্যাস, সত্যের সহজ সুন্দর প্রকাশ, আদি জন্মের সুর। জীবনানন্দ খুঁজেছেন প্রকৃতির আঁধারে জীবনের প্রতীতি, কখনো বা প্রতীক। আর মহাদেব সাহা খুঁজলেন ‘এক নিরিবিলি বকুল’ কে। কবির সাধনা প্রকৃতির মাঝে জীবন-প্রেমকে খোঁজা, কোনো রূপক বা প্রতীক নয়, সরাসরি খোঁজা। তাই মহাদেব সাহা দেখেন শহরের বৃষ্টিতে আজ প্রিয়া নেই। এই নঞর্থক জীবনবোধই হলো প্রকৃতির হাসির আদলে অন্যকিছু—
এ শহরে বৃষ্টি এলে আমি ভেসে যাই কান্নার করুণ ভেলায়
হাতে নিয়ে তোমার একদা দেয়া উপহারের গোপন গোলাপ
মহাদেব সাহা নিসর্গ দিয়ে প্রকাশ করেছেন প্রিয়ার আলিঙ্গন-স্বাদ, কখনও জীবনের ব্যর্থতার হতাশ্বাস, আবার কখনো অতিলোকের কোনো কথা। এই নিসর্গের স্বর্গানুভূতি হয়েছে কবির পলায়নপর মানসিকতার অন্যতম অবলম্বন। যেখানে নেই প্রিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, নেই কোনো ঘাত-প্রতিঘাত। হতাশা, ব্যর্থতা, অপূর্ণতা কবি অকুণ্ঠচিত্তে প্রকাশ করেছেন নিসর্গের বর্ণনায়।
কবিতার জন্য আমি একযুগ কেঁদে
ভাসিয়েছি,
একযুগ কাটিয়েছি স্বেচ্ছানির্বাসনে
আরো একযুগ বনবাসে;
এই কবিতার জন্য আমি সব দুঃখ
মাথা পেতে নিজেই নিয়েছি।
(কবিতার জন্য আমি)
সব কিছু ছাপিয়ে মহাদেব সাহার কবিতায় রোমান্টিকতার জয়জয়কার। বাংলা কবিতায় রোমান্টিকতার রাজ্যে তিনি তুলে ধরেছেন ধীর-স্থির সুরে হৃদয়ের কথামালা। সহজবোধ্য ভাষায় অনেক রূঢ় সত্যকে তুলনা, প্রতিতুলনার মাধ্যমে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। যে কারণে তীব্র কোনো উপমা, রূপক কিংবা ব্যঙ্গোক্তি তার কবিতায় খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে তার কবিতায় সংঘর্ষ ও সংগ্রামের সুর আছে, যা বিপ্লবকে সমর্থন করে। তবে তীব্র আক্রমণ নেই। মহাদেব সাহার কবিতায় চলমান জীবনের অসঙ্গতিগুলোর স্বাভাবিক উপস্থাপন লক্ষণীয়। যা নীরব রোমান্টিকতার পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে সহায়ক। মহাদেব সাহার কবিতার রোমান্টিকতায় আবর্তিত হয় প্রেম, নিসর্গ, লুকানোবৃত্তি আর সমাজ বদলের চিন্তা। ফলে একথা বলা বোধ করি অসঙ্গত হয় না যে, মহাদেব সাহা যুগপৎ ‘প্রেমিক ও সন্ন্যাসী, প্রেমিক ও বিপ্লবী’ কবি। তিনি যাপিত জীবনের নান্দনিক আবেগ অনুভূতি, রাজনীতি ও দর্শনের মানবিক উপস্থাপনা করলেও সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে তার প্রেমিক ও বিপ্লবীসত্তা। যার উৎসস্থল কবিমনন, প্রকৃতি ও মানুষ।