২ আগস্ট মামুন রশীদ, ৪ আগস্ট জাকির জাফরান ও ৭ আগস্ট শামীম হোসেনের জন্মদিন। এই তিন কবির জন্মদিন উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের বিশেষ আয়োজন।
এই সময়ে অনেকেই কবিতা লিখছেন। আমি একজন কবিকে তার সময়ের প্রতিনিধিই মনে করি। হ্যাঁ, যিনি নবীন, তিনি প্রবীণের চেয়ে বেশি দেখেননি, এটা আমি মানি। তবে একজন নবীন তার চোখ দিয়ে একটি নতুন পৃথিবী দেখেন। যা একসময় একজন প্রবীণ কবিও দেখেছিলেন। নবীনের বাড়তি পাওনা হচ্ছে, আজকের তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময়কর উত্থান। নবীন এই সিলিকন ভ্যালির রশ্মিতে দাঁড়িয়েই লিখছেন আজকের কবিতা। এটা একজন নবীনের জন্য গর্বের বিষয়!
আজ আমি তিনজন তরুণ কবির কবিতার জ্যোতির গল্প আপনাদের শোনাব। তারা তিন জনই ধ্যানী কবি। লেখেন-ভাবেন-লেখেন।তাদের কবিতায় আমি এই সাক্ষ্য পাই। আর পাই বলেই তাদের কবিতার কয়েকটি আমি বেছে নিয়েছি। এই তিন জন হলেন শামীম হোসেন, মামুন রশীদ ও জাকির জাফরান। আমি তিনটি ভিন্ন পরিচ্ছেদে তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করব।
শামীম হোসেন: পাথরে পাখির কণ্ঠে যে কথা ফোটে
আলোর সংকেত দিয়ে বাজে নদী। বয়ে যায় ঢেউ। কখনো উজানে। কখনো ভাটির গন্তব্যে। একজন কবি নদীতীরে দাঁড়িয়ে দেখেন, সেই দৃশ্য। আঁকেন নিজের মাঝে পঙ্ক্তির বিভাস। আর তা বিলিয়ে দেন মানুষের মাঝে। এই যে শব্দের আদান, তার নামই কবিতা। প্রেম ও পরিণামের সফল কালচিত্র। কবি শামীম হোসেন পাখির কণ্ঠে কথা ফোটাতে চান। তিনি লেখেন:
অন্ধকার প্রতিমার সামনে দাঁড়াই।
চশমার ফ্রেম মুছে রাখি পাতার ওপর-
অনেক শুকনো পাতা; যায় বসন্তদিন।
পাথরে পাখির কণ্ঠে কথা ফোটানোর আগে
আলোবিনাশী প্রবণতা ছুঁয়ে যায়-
কাঠ-কয়লার তামাটে শরীর…
কে আমাকে আজ দাঁড় করিয়েছে-
শ্মশানের মতো নীরব এই ভিটের ওপর!
সামনে আঁধারপ্রতিমা-
আলোর বিপরীতে আত্মহননের পথ…
উপড়ানো চোখ হাতে নিয়ে-
কার সামনে দাঁড়াবো এখন!
(অন্ধত্ব: শমীম হোসেন)
আলোর বিপরীতে আত্মহনন আজ পৃথিবীর সর্বত্র। তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি মানুষ পাচ্ছে? না কি পাবে না কোনোদিনই! অনেক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠছে মানুষের শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন। মানুষের জামার ভেতর বকুলের ঘ্রাণের বদলে আজ বারুদের গন্ধ। তবে কি আদমবোমা হয়েই দেশে দেশে বিস্ফোরিত হচ্ছে এই মানুষই। কবি লিখছেন:
জামার ভেতর লেগেছিল বকুলের ঘ্রাণ
তাই পেছনের দিকে হেঁটে হেঁটে-
সবুজ গ্রন্থের পাতা শুঁকে শুঁকে
লাগিয়ে দিয়ে আসি কুয়াশার সিঁদুর…
মাঝে মাঝে আলনার দিকে তাকাই
আর পুরোনো বাক্সের ঝাপ খুলতেই
ন্যাপথালিনের গন্ধে ভেসে যায় ঘর
দেখি জামার বদলে বেরিয়ে আসে-
শুকনো বকুল…
(খোঁজ: শামীম হোসেন)
শামীম হোসেন কবিতায় নিজেকে সমর্পণ করেন বড় সাহসের সঙ্গে। মাটির প্রতি মমতা দিয়ে লেখা। তিনি জানেন, এই মাটিই সব শক্তির উৎস। আর সব শক্তি সেই মাটিতেই ফিরে যায়। না, জীবনের প্রতি তার কোনো খেদ নেই। আর সাহিত্য তো এটাই আমাদের জানান দিয়ে যায়, একজন কবির প্রকৃত বন্ধুই হচ্ছে তার আত্মা। তার সূর্য। তার তপস্যা। পড়া যাক তার এই কবিতাটি:
পুরনো জুতার মতো অনাদরে থাকতে নেই।
আমার সমুখে যখন ঘাসের মানচিত্র-
মেলে ধরে সমূহ সবুজ; মনে হয়
আবার শিশুর মতো গুঁটি গুঁটি পায়ে
লাগিয়ে রাখি ভোরের শিশির!
যে বয়সে চুরি হয়ে যেত পাড়ার সমস্ত গোলাপ
আর রাত জেগে আলপনা এঁকে লেখা হতো-
বুকের গভীরে জমে থাকা বর্ণের গোপন স্মারক
সেই বয়সটা এখন খুঁজি অন্যের ভেতর…
আমার তো ইশকুল নেই- তাই মালগাড়ি
গুনে গুনে কাটিয়েছি নামতার ভুল-
তাসের জীবনে তোমাদের দিয়েছি মেঘের দোহাই
আর বর্ণমালা ছাড়া আজীবন কিছু শিখি নাই।
এ জীবনে আমার কোনো পাখি ছিল না
পুরনো জুতার মতো পড়েছিলাম একটি পালক!
(পুরনো জুতার মতো: শামীম হোসেন)
শামীম হোসেনের কবিতা যতই পড়েছি, একটি প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে বার বার। আধুনিক কাব্যরীতি ও বাউলিয়ানা; এই দুই ধারার কোনটা বেছে নিতে চেয়েছেন এই কবি? একজন কবি বেঁচে থাকবেন তার মৌলিক কৃতকর্মের মাঝে। মিশেল ভাবনার দ্যোতনা তখনই স্বীকৃতি পায়, যখন কোনো কবি বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন। শামীম তার কবিতায় আত্মান্বেষণ করেছেন এভাবে:
আমাকে বাঁধার আগে বেঁধো তুমি স্বরের কুসুম
এই মাটিগন্ধী মন প্রজাপতি হবে—
নৌকার গলুই ধরে পাড়ি দেবে সমুদ্রের পথ
কুয়াশাপ্রবণ সন্ধ্যায় জমে যাবে ঘাসের বরফ
নিজেকে গুটিয়ে শামুক হবে কাদার ভেতর।
আমাকে ছোঁবার আগে ছুঁয়ে দেখো সূর্যের রোদ
এই ছায়াশরীর বাঁচে শুধু আলোর দয়ায়—
বোধের কর্পূর কবে নিয়ে গেছে মাতাল হাওয়া
তুমি তবে নাগরিক চশমা খুলে দেখে যাও—
মহুয়ার ডালে ঝুলে থাকা এক মৃত কোকিল!
(আত্মকেন্দ্রিক: শামীম হোসেন)
কবি মানেই গহীন সমুদ্রের নাবিক। তিনি তার গন্তব্য কখনো জানেন, কখনো জানেন না। তারপরও ডিঙা ভাসিয়েই যেতে হয় মহাকালের উৎস বরাবরে। শামীম হোসেন সেই কাজটি করেই যাচ্ছেন, তার কাব্যবন্দনায়।
মামুন রশীদ: যে মানুষ ফেরি করে সমুদ্রস্মৃতি
মনকে শাসন করে স্মৃতি, না কি মন শাসন করে স্মৃতিকে। আমরা ভাবি। একা ভাবি। যৌথভাবে ভাবি। যে শরীর আমরা বহন করি, তা সইতে পারে অনেক সুখ, অনেক যাতনা। আমরা নিমগ্ন হই। দেখি। লিখি। এঁকে রাখি কখনো প্রিয় মুখ। প্রিয় স্মৃতির আভা। তা হতে পারে কবিতায়। হতে পারে রঙ-তুলিতে। ভর দুপুরে নদীকূলে দাঁড়িয়ে আমরা যে টলমল ঢেউচিত্র দেখি, তা মনে করিয়ে দেয়, বহমান সৌন্দর্যের কথা। জোয়ার আসে, জোয়ার যায়। কিন্তু নদী থেকে যায় সাক্ষী হয়ে অগণিত স্রোতের। একজন কবিও তেমনি তার পঙ্ক্তিতে বপন করে যান সমুদ্রের ঢেউকথা। না, তা প্রতীকী নয় কেবল, বাস্তবেও।
কবি মামুন রশীদ খুব জোর দিয়েই বলেন, সমুদ্র রাখে না কিছুই। তাহলে কী রেখে যায় সমুদ্র! শিহরণ? দ্রোহ? ভালোবাসা? সহমরণ?
সমুদ্র রাখে না কোন স্মৃতি
হাজারো ফটোগ্রাফ গেঁথে দেয় মানুষের বুকে।
খোলা শঙ্খের হাওয়ায় কান পেতে
আসমানী নীলের সাথে যারা
মেলে দেয় পাখা, তাদেরও থাকে মনে
নোনাজলে ভেসে যাবার বাসনা।
ইতিহাসের পাতা খুলে কবে কোন মোহমুগ্ধ সন্ত
সফেন ফেনার মাঝে খুঁজেছিল প্রিয়মুখ
ভয়ার্ত প্রেয়সী তার- নির্বাক, বিস্ময়ে লুটিয়ে
পড়তে দেখেছিল নিজেরই জমানো ছায়া।
অন্ধকারে প্রতিদিন মানুষ আজও
ফেরি করে সমুদ্র স্মৃতি ।
সমুদ্র রাখে না কিছুই—
গেঁথে দেয় হাজার ফটোগ্রাফ।
(সমুদ্র রাখে না কিছুই: মামুন রশীদ)
আমি এই কবির কবিতার একজন মুগ্ধ পাঠক। তার বর্ণনায় এমন এক নিটোল চিত্রকল্প পাই, যা হয়ে ওঠে আপামর মানুষের কণ্ঠধ্বনি। তার নান্দনিক বর্ণনার বিশদে প্রতিটি মানবসত্তাই হয়ে ওঠে একেকটি রূপের প্রতিমা। প্রেমকে ছুঁয়ে যায় তার কবিতার কালিকভাবনা অথবা স্থানিক বুনন। চলমান সময়ে কবিতার কারুকাজে কী নিসর্গ স্থান পাচ্ছে তাও আমাদের জানান দিয়ে যায় মামুনের কবিতা। জানায় কবিতার অগ্রযাত্রার কথা।
দূরে আছো, এতোটা দূরে জ্যোৎস্না যেমন
মানুষের কাছে, হাতবাড়ালেও হয় না লণ্ডভণ্ড।
পরচর্চা যেমন একটি শব্দ- শিখতে হয় না-
বাইসাইকেলের চাকায় যাকে বাঁধতে হয় না-
ইতিউতি নজর রেখে, অথবা না রেখেই
আঁঁকাবাঁকা আলপথে বানায় বসতি।
অভিমানের ধান কাটা মাঠ থেকে শুষ্ক গলায়
আচ্ছন্ন কাক আর্বিভাবের উত্তাপ ছড়ায় কবিতার মতোই।
দূর কি চিরকাল দূরই থাকে। লাস্যময়ী
প্রজাপতির মতো হঠাত্ ঢুকে পড়ে না
নগন্য ব্যক্তিবর্গের ঘরে। কিন্তু
বৃষ্টিরও তো কিছু বলার আছে, না হলে
সে তাড়া করবে কেন ফড়িংকে
ভিজিয়ে দেবে কেন ফুলের গন্ধ।
(দূরে আছো, এতোটা দূরে: মামুন রশীদ)
না, মামুন রশীদ আবেগতাড়িত কবি নন। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন মনে করি। তা হচ্ছে-ইমোশন হ্যাভ নো মোশনের যৌক্তিকতা। এ বিষয়ে মার্কিন কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘স্থির নদীও একটি স্পন্দনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর তা হচ্ছে জলের অন্তরালে চন্দ্র-সূর্যের কিরণ।’ আমি বলি আবেগই গতি। যে গতি নিয়ন্ত্রণ করে মানবশক্তির প্রেমসত্তা। মামুন তার কবিতায় ইস্পাতদৃঢ় পাঁজর দেখিয়েছেন। যেতে চেয়েছেন, কিন্তু যাননি। আমরা জানি, কবিরা যেতে পারেন না। তারা স্থানান্তরিত হন মাত্র।
ভাবছি চলেই যাবো, চারদিকে অমাবশ্যার ঘণ্টাধ্বনি
বুকের মধ্যে জমা হওয়া ব্যর্থ বোমাবর্ষণের স্মৃতি
প্লাবনের মতো ধেয়ে আসা অন্ধকার
বুঝিনি এসবই ছিল ছলনার আবরনে মোড়া
আকাশজোড়া এক জ্যোসনার ভেলা।
ঔপনিবেশিক পৃথিবীকে কখনো রাঙাতে পারে না সকালের সূর্য
জীবনজোয়ারে যে ফেলে আসা কদমবৃক্ষ, আমারই সমান বয়সী,
ক্রমে ক্রমে ছোট হয়ে আসা আকাশের গায়ে বাধা পেয়ে তুমুল
প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভেতর নির্মাণ করে আলাদা শৈশব।
ঢাকির ঢাকের বাদ্যে, চৈত্রে, ওড়ে তুলোবীজ
সেখানে কি আবরণ থাকে? থাকে নির্জনতা?
মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে চাঁদ? বিশ্বনাথ?
রহিত হয় জন্মান্তর?
আমি জানি না। মুখ থুবড়ে পড়ে বৈরী বাতাসের ভেতরে শুনি
নিশিডাক, ভাবি চলেই যাবো। শুধু ঠিকানা জানি না বলে
অলীক বনভূমিতে আজ বিপিনবিহারী।
(ভাবছি চলেই যাবো: মামুন রশীদ)
কবিতা অনন্ত সময়ের ধারক। মহৎ কবিতাগুলো কালে কালে হৃদয় জয় করতে পারে পাঠকের। কবিতার প্রসারিত বাহুর সঙ্গে সমৃদ্ধ হয় পাঠকের মননও। ঈপ্সিত আলোর কাছে একটি মন যখন সমর্পিত হয়, তখনই কবিতার উত্তীর্ণ আকাশ ছায়া দেয় তাকে। বুকে ঘাঁই দিয়ে যাওয়া সেই শব্দগুলো বলে যায়, লিখিত লতাগ্রহ সবুজের আভা নিয়েই সাজায় সংসার, সংবেদ। প্রেম ও মানুষ একে অন্যের পরিপূরক মাত্র। মামুন রশীদ সেই গ্রহে মাটি নিয়ে খেলছেন। আমরা দেখছি। দেখছে আকাশ। সাক্ষী থাকছে সবুজ বৃক্ষ।
কবি লিখছেন:
সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানো শূন্যতা শুধু।
এ এক শরীরি ভ্রমণ। দেহ থেকে দেহান্তরে, চক্রাকারে।
শূণ্যতায় কোলাহল-বোবা অনুভূতি-দিনমান অস্থিরতা
শূন্যতায় ফিসফিস-কলকল ছলছল-স্বপ্নময় স্পর্শ।
একাগ্রতায়, আনমনে শুধু ঘুরিয়ে দেখানো নয় নিজেকে।
প্রতিবিম্ব অশরীরী মতো চলমান।
অভিমান-অনুরাগ-ভালোবাসায় দীর্ঘ দিবস।
এ শুধু ভ্রমণ নয়। এক শরীরী যাপন।
(সময়: মামুন রশীদ)
এটা আমিও মানি সময় বলে কিছু নেই। সকল শূন্যতার ভেতর আয়ুর আসা যাওয়া মাত্র। এই চিত্র, সফল চিত্রকরের মতোই এঁকেছেন মামুন রশীদ। তার কৃতিত্ব সেখানেই।
জাকির জাফরান: জলের একাকীত্বে পাখি ও নদীদের সংসার
সাহিত্যের স্বরূপ নিয়ে ভাবতে হয় যেকোনো কবিতাকর্মীকেই। কোথায় কী হচ্ছে, সেই সময়কে জানা ও জানানোরও একটা দায় থাকে কবির। কবি জাকির জাফরান এই কাজটি করছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গে। মৃত্তিকার সঙ্গে তার যোগাযোগ বেশ রোমান্টিকতার সঙ্গেই উঠে এসেছে তার কবিতায়।
আমরা জানি, কালের গতি সবসময়ই অনুভবের। কালমগ্ন চেতনা ধারণ করে শুদ্ধাচারী কবিই পারেন পৌঁছে যেতে যাপিত প্রেমের গহীনে। তিনি তা পেরেছেন, তা বলা যায় সানন্দে।
ফিরে এসো গুম হয়ে যাওয়া পাখি
বসন্ত-গোধূলি থেকে পালিয়ে আসা রমণীদের
পাড়ি দিতে হবে এক দীর্ঘতম কৃষ্ণচূড়া-সেতু।
হাতের তালুতে জাগে আগুন-সমাধি,
ক্ষমা করো চাঁদ, আর শীতলক্ষ্যা নদী,
জলের একাকীত্বের মধ্যেও ঢুকে গেল এতগুলো পাখি!
ফিরে এসো অপহৃত সূর্যাস্তমন্ডলী
ফিরে এসো অগ্নিদগ্ধ দেহমাদল
যে কোনো নিদ্রাহরণের আগে
রক্তজলে শয্যা পাতার আগেই ফিরে এসো।
ক্ষমা করো নিখোঁজ মানুষ
ক্ষমা করো পুড়ে যাওয়া সবুজ শৈশব,
ঝিঁঝিঁ পোকাটিও আজ তার জানালা খোলেনি।
গভীর ঘুমের অভ্যন্তরে কে আছে সাপিনীসম
আমরা বুঝিনি, ক্ষমা করো অহেতু নির্দেশমালা,
আমরা শুনিনি কিছু, আমরা কিছুই দেখিনি।
(অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী: জাকির জাফরান)
গ্রহণের আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকে মাটি। কবি, মাটির বরপুত্র। তাই তারও প্রাণে আনন্দ জাগে গ্রহণের নবম ঋতুতে। যে ঋতু কাব্যঋতু। কবি জাকির জাফরান কালে কালে পাঠকের কাছে গৃহীত হবেন, আপন দ্যোতনা, আমি সে প্রত্যাশা করি। কেন করি, তার কিছু উদাহরণ দেই। প্রথমত তার কবিতায় আধ্যাত্মিক চেতনার যে স্ফূরণ আমরা দেখি, তা আমাদের। পাঁজরকে বাজায়। কানে লাগে তার অমোঘ উচ্চারিত শিল্পসুর:
ক.
কোমরের নিচে গান
ঘুঘুডাক
ভাসমান মেঘ
সংখ্যাপতনের আর্তরবে
আমি মীন এঁকে যাই দেহে
(দেহ)
খ.
এসেছি শিরস্ত্রাণ পরে, দুটি চোখে পাখি,
চেনা যায়?
— কে গো তুমি?
আমি জাফরান, তোমার পশ্চাদভূমি,
— কেন এলে?
আয়ুর কৌটায় দাঁত বসাতে এসেছি,
— কিন্তু দাঁত তো ফেলে এসেছ বেদেনীর ঘরে।
(অস্তিত্ব বিষয়ক)
গ.
আমার এ জীবন-নকশা
বৃথা যায় প্রভু,
শুকনো পাতার নিচে আজ
চাপা পড়ে গেছি
আমি আগুন আগুন।
(আমি)
ঘ.
মাথার ওপর থেকে ঠিক
শুরু হয় আকাশের ঠিকানা।
যে-মানুষ যত বেশি বড়
তাঁর আকাশ ততোটা ছোট।
মৃত মানুষরা থাকে পৃথিবীর নিচে
সবচেয়ে বড় আকাশ কেবলি মৃত মানুষের।
(আকাশ)
একজন পরিশুদ্ধ মানুষ আত্মার যে চিত্র আঁকেন, তা হতে পারে রঙ-তুলিতে, রঙের ডানায়। ভর দুপুরে নদীকূলে দাঁড়িয়ে আমরা যে টলমল ঢেউচিত্র দেখি, তা মনে করিয়ে দেয় বহমান সৌন্দর্যের কথা। ভরাযৌবনে জোয়ার আসে, জোয়ার যায়। কিন্তু নদী থেকে যায় সাক্ষী হয়ে অগণিত স্রোতের ধারায়। একজন কবি তেমনি তার পঙ্ক্তিতে বপন করে যান যে দেহের সুরত, দেহের ভেতর জেগে থাকা অস্ফূট কথা, দেহের ভেতর কে কথা বলে; দেহের ভেতর কে জেগে রয়, কে বংশী বাজায় পঞ্চমপ্রহর, তা কি কেবলই প্রতীকী? না, জাকির তা শব্দে শব্দে তুলে আনেন। তুলে আনেন জিকিরে জিকিরে।
একদিন তুমি তরমুজ কেটে নিয়ে এলে
খেতে খেতে ভাবলাম—
তরমুজ কাটলে দু’ভাগ হয়ে পড়ে থাকে তার লাল আকাশ।
কিন্তু হৃদয় দু’ভাগ হলে মাথার ওপরে কোন আকাশ থাকে না।
আজ তুমি নেই
আমি আলো আঁধারির মধ্যে বসে কাঁদলাম
কেউ আর তরমুজ কেটে নিয়ে আসে না এখন
আজ সত্যি সত্যি মাথার ওপরে কোনো লাল আকাশও আর থাকলো না।
(লাল আকাশ: জাকির জাফরান)
কবি তাকিয়ে থাকেন। পাঠ করেন। একটা ভালোবাসার সাম্পান বয়ে যায়। খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায় একখণ্ড মেঘ। উত্তপ্ত মাটির ছোঁয়া কবিকে দেয় প্রভাতের দীপশিখা। কবি জাকির জাফরান ভোরের কবি। তার মাথার ওপর সূর্য আর পদরেখায় নদীর স্রোত। আমাদের চারপাশে সময়ের অনেকগুলো বৃক্ষ আর বোধের ঝরাপাতা। আমার কেন জানি বার বার মনে হয়, মানুষ যদি অনন্তকাল বেঁচে থাকতো!
না, তা হয় না। যেতে হয়। নতুনকে ছেড়ে দিতে হয় জায়গা। ভূমির স্বত্ব। যারা আসে, তারা বয়ে আনে নতুনের পুষ্পকুঁড়ি। জাকির জাফরান সেই নতুনের পূজারী হয়ে বার বার এসে দাঁড়ান কবিতার পাশে। তিনি বলে ওঠেন:
আমাদের নিঃশ্বাসের তাবু ছিঁড়ে চন্দ্রিমা-পেরেকে।
যারা রাত জেগে জোনাকীর কুচকাওয়াজ দেখে
ভোর হলে মিশে যায় জনসমুদ্রের জলে, যারা
মৃত্যুর পরেও কফিনের ছিদ্র দিয়ে প্রেমিকার
মুখ খুঁজে ফেরে, তারাই আমার নিজ সম্প্রদায়।
বিপর্যয়ে, যে কোন অন্তিম ডাক চিনে নেবে তারা,
তমসা পেরিয়ে আসা পাখিদের সম্ভ্রম বাঁচাতে
তারাই আমার শিঁরদাড়া, যে কোন সৃষ্টির ত্রাতা।
চন্দ্রাহত জলের ওপর ভাসে কৃষ্ণচূড়া-সেতু।
ঝিনুকের গোপন পৃষ্ঠায় ভ্রমণের অবসরে
তোমাকে নিয়েই ভাবি, তুমি গোত্রমাতা, বুদ্ধিমতী,
হরিণের ছাল দিয়ে ঢেকে রাখো আমার প্রণয়।
ঘুমন্ত ঠোঁটের কাছাকাছি এসে স্বপ্ন থামে, সখা,
আমাদের নিঃশ্বাসের তাবু ছিঁড়ে চন্দ্রিমা-পেরেকে।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়: জাকির জাফরান)
আমাদের সম্মিলিত পথ এসে মিশে যায় রাজপথে। হাত ওঠে। হাত নামে। আমরা উজানে যাই। যাই ভাটির বিশদে। যে গভীর মমতা আমাদের প্রান্তপরিবেশকে লালন করে, তার নাম কবিতা। আমাদের নিঃশ্বাস। একদা ভালোবাসার আশ্রয়। একদা বিরহযাপন। জাকির নিজস্ব মাত্রামঞ্জরি ছড়িয়ে এভাবেই বুনে যাচ্ছেন কবিতার বীজ।
জাকির জাফরান রাজনীতি সচেতন কবি। তার কবিতায় অধিকারের উচ্চারণ আমাদের পেশীকে বলিষ্ট করে। ভাবায়।
নিঝুম নিশিতে দেখি নিশিহারা স্ট্রিট
তার মায়াবী বিন্যাস নিয়ে চলে গেছে
অনন্তের দিকে, হেলেদুলে, মৃদুলয়ে।
অনেকটা এলিফ্যান্ট রোডের মতন,
গণজাগরণ সঙ্গে নিয়ে মিশে গেছে
যেন তৃষিত নয়নে, বত্রিশ নম্বরে।
(সাকুরা সাকুরা: জাকির জাফরান)
কবিতা সময়কে লিখে রাখে। আঁকে সৃজনের ছাপচিত্র। অথবা বিনষ্ট কালের পথ ধরে চারপাশে যে সামাজিক অবক্ষয় ঘটে যায়, তারও সাক্ষী থাকে কবিতা।
পাদটীকা- আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে আমি তরুণদের কবিতা নিয়ে লিখি না। মনোযোগ দেই না। এ বিষয়ে আমার কোনও প্রতিবাদ নেই। আমি কবিতা পড়ি। কবিকেও পড়তে হয় সঙ্গত কারণে। যে তিনজনের কবিতা নিয়ে লিখলাম, তাদের একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তিনি জাকির জাফরান। বাকি দু’জনের সঙ্গে দেখা হয়নি কখনো। আচ্ছা, এক জীবনে সব মানুষের সঙ্গে কি সবার দেখা হয়? না, হয় না। তবে কবিতার সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হয়ে ভোরের জ্যোতির সঙ্গে।