পিচ্ছিল গাছের মসৃণ চামড়া বেয়ে গাছের মাথা অব্দি যেতে যতবার পা পিছলে যায়, ততবারই রাখতে রাখতে ব্যক্তিত্বকে আর সমুন্নত রাখা যায় না। ভুল কথা ভুল শব্দে বড্ড বিশ্রীভাবে গলার ক্ষীণ গলিপথ বেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে আদুল গায়ে, বাজখাঁই স্বরে। মানুষ পুনরায় জীব হয় জীবনের স্রোত ভালোবেসে। আবার কখনো কখনো ব্যক্তিত্বের সঠিক সংজ্ঞায়নটাই আমরা ঠিক করে করে উঠতে পারি না, সেখানে ব্যক্তিত্বকে সমুন্নত রাখার বিষয়টি তো আরও কঠিন।
আমরা বেশিরভাগ মানুষই ব্যক্তিত্ব বলতে বুঝি মানুষের পার্সোনালিটি, যা কিনা এর ইংরেজি শব্দরূপ মাত্র, অর্থ বা মানে নয়। তবু অনেককেই দেখেছি ব্যক্তিত্বের অন্য কোনো সহজ প্রতিশব্দ বা মানের ব্যাখ্যা দিয়ে শব্দটিকে বিচার বা ব্যবহার করেন না। এক-একজন এক-একভাবে শব্দটির অর্থ বুঝে নেন (ব্যক্তিগত সুবিধা বা মূল্যবোধ অনুযায়ী) এবং বিচ্ছিন্নভাবে জীবনে শব্দটির প্রয়োগ করেন, যা শুধু নিজের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখে না মানুষ, বরং অন্যকে বিচার করার ক্ষেত্রে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে। অনির্দিষ্টতা ও ব্যক্তিভেদে আপেক্ষিকতা ব্যক্তিত্বের প্রচলিত মানেগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। আর আমরা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর যথার্থ অর্থ বা অর্থের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে চির উদাসীন ভূমিকা পালন করে নিজেদের চরম ব্যক্তিত্ববান বলে দাবি করি। এ যেন বিমূর্ত বিষয় হয়ে বিরাজ করে আমাদের ঘর-দোর-বারান্দায়, শহর-গ্রাম আর মহল্লায়।
ওমুক ব্যক্তি খুব ব্যক্তত্ব সম্পন্ন, তমুকের পার্সোনালিটি আছে! আবার কেউ কেউ দেখেছি অন্যকে ব্যক্তিত্বহীন আর নিজেকে বিপরীতটা দাবি করে অন্যদের সঙ্গে মেশেই না। কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব শব্দটার অর্থ কিংবা মানে যে কী, এটা কি সবাই পরিষ্কার? যদি ব্যক্তিত্ব বলতে ব্যক্তির চরিত্রের কোনো বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়, তবে সেটা প্রকৃত অর্থে কোন বৈশিষ্ট্য? সেটা কি একক কিছু না কি যৌথ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়?
ভাবতে গেলে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী যে সময়টার কথা মনে পড়ে, যেদিন আপনি এই শব্দটা নিয়ে ভেবেছেন, সে সময়টাকে একটু মনে করুন, আপনি কি ভাবছেন ব্যক্তিত্ব বলতে চুপচাপ থাকাকে বোঝায়? আপনি না ভাবলেও অনেকেই তা ভাবেন। যদি তা বোঝায়ও তবে কি নির্বিবাদে চোখের সামনে সব অন্যায় অবিচার আর ভুল ও অমানবিকায় আওয়াজ না তুলে চুপচাপ থাকা এই ভেবে যে, যা হচ্ছে তা তো আর আমার সঙ্গে হচ্ছে না, কে মরছে কে পুড়ছে, কী জ্বলছে, কী পচছে, তাতে আমার কী, সেটা ব্যক্তিত্বের পরিচয়? হলেও হতে পারে, তবে সমস্যা এই যে কোথাও কোথাও অন্যায় করাটা পাপ, আর প্রতিবাদ না করাটা মহাপাপ। অবশ্য বাস্তববাদী সময়ে এসব নিতান্তই ভাববাদী কথা। ভরাপেট হতে এসব বয়ান ঢেঁকুরের মতো বেরোয় আর খালি পেটে তিতোর মতোন বদহজম হয়।
ব্যক্তিত্ব বলতে আবার আপসহীন চির-উন্নত মেরুদণ্ডকেও বোঝান কেউ কেউ, জীবন যাবে তবু মান (?) যাবে না। চির স্বাধীন অথবা আত্মকেন্দ্রিক ওরফে বলতে দোষ-স্বার্থপর, যিনি কারও খান না বলে চিৎকার করে পক্ষান্তরে তাকেও তাড়িয়ে দেন, যে তার কাছে খেতে চাইতে পারে। এই একেবারেই আত্মমর্যাদবান সত্তা, কারও কাছে মাথা নোয়ান না অথবা পরিস্থিতি ভেদে প্রয়োজনে নিজে ছোট হয়ে অন্যকে বড় করেন না। এ ব্যক্তিত্ব সবারই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, যাকে ছুঁতে গেলে অহমের ধারে কেটে যায় নমনীয়তার বাঁধ। তবে বিশেষ প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিত এই ব্যক্তিত্ব যে, সে প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম তা জানেন কেবল ভুক্তভোগী, সিঁধকাটা ঘর হতে যার চাঁদ চুরি গেছে সময়ের বহু আগে। আর প্রয়োজন? ওটা বড় বিচিত্র, কেননা সবার প্রয়োজনটা একরকমের হয় না, সময় পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট ভেদে প্রয়োজনের রূপ হয় ভিন্ন ভিন্ন রকম। অবশ্য এসব কাব্য আবার সবার ভোগে রুচিকর হয় না। এসব রসের কথা, যার যার রোগ তার তার ব্যথা।
ব্যক্তিত্ব শব্দটি নিঃসন্দেহে একটি দুর্লভ ইতিবাচক শব্দ। তাই এ সংক্রান্ত ক্রিয়াশীল প্রত্যয়গুলোর হিতকারী ভূমিকা নিয়ে সচেতন থাকাটাও আজকের জায়গা থেকে জরুরি।
আমাদের এখানে কারও কারও কাছে আবার ব্যক্তিত্ব মানে গাম্ভীর্যতা, সুন্দর আর পৌরষের এমন এক পূজনীয় মুরতি যাকে দূর থেকে সন্মান করা যায়, কাছে এসে বাচালের মতো চাওয়া যায় না। এক জীবনের অযুত নিযুত কথার শব্দ আর প্রকাশ করা ভালোবাসা যার পোষায় না কোনো কালেই। না নিজের কষ্ট বণ্টন করা মানায়, তাদের আর না অন্যের কান্নায় কাঁদা স্বভাব এমনদের। ইংরেজিতে যাকে বলে রিজার্ভ। পূর্বপুরুষের সাধ্য নেই টেনে মাটির শরীরে মাটি মাখায়, থাক তো পাড়ার বয়োবৃদ্ধের পায়ের ছোঁয়ার দোয়া নেওয়া তাদের মানায়। শিষ্য জীবন না কাটিয়েই গুরু বনে যান, না কবিতার কর্ম বোঝেন, না প্রেমে পড়ার মর্ম। দায়িত্বটাকে দায় ভাবছেন, না কি কর্তব্যকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও করণীয়; কোনোটাই বোঝার কোনো উপায় নেই এই ব্যক্তিত্বধারীদের বেলায়। অনেক না বলে একটা কথায় স্বল্পতার গুরুত্ব বোঝান, না কি অল্পের অহম দেখান বোঝাটাই দায়। তবু মধ্যবিত্ত এতেই খুশি। কী দরকার এত বোঝাবুঝির, শ্রোতাহীন এই বধির শহরে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে না বলে অপমানটা হোক না সোজাসুজি! ষাঁড়ের মতোন যে চেঁচায় তার কর্কশ কণ্ঠে কান ধরে আসে যে, অতএব স্বাস্থ্যের পক্ষে সুবিধাজনক হচ্ছে কম বলা, কম শোনা আর কম দেখা। কী লাভ ইন্দ্রীয়শক্তি এতটা খরচ করে!
আরেক ব্যক্তিত্ব সহনশীলতায় দেখতে পায় পেয়ে বসা একদল দোপেয়। ক বংশের খ শিক্ষায় মানুষ, বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। এখানে অবশ্য কাব্যরসের যোগ নেই, এখানে সহজলভ্য হচ্ছে করুণ রস। এই রসে টইটুম্বুর ব্যক্তিত্বধারীরা চাহিদার শীর্ষে। এসব সহনশীল প্রাণী কিন্তু মরে যাবে, তবু লজ্জায় ওহ্ পর্যন্ত করবে না। চোখের জলে নাকের জলে অমৃত বানিয়ে পান করবে গরল। আহা! শত মরণেও মারবে না, আর যুগে যুগে অন্যায় বা জুলুম নামক অপ্রিয় উপাদানে গড়ে তুলবে এক একটা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে যা ধ্বংস করে যাবে, পরবর্তী অসংখ্য প্রজন্মকে। আর তারপর এরা মরণোত্তর পুরস্কার পাবে এক বছর মেয়াদি।
আরও আছে অনেক রকম ব্যক্তিত্বের ধরন। এর মধ্যে সাদা রঙের ব্যক্তিত্ববাদীরা সম্ভ্রান্ত। তাদের দয়ার শরীর, কেবল করে যায়, বিনিময়ে চায় না কিছুই। পারলে সন্মানটুকুও উলঙ্গ করে দাতা সাজেন, কৃতঘ্ন আচরণজনিত অপরাধও তাদের টলাতে পারে না একবিন্দুতে ও। পাছে লোকে বলে বসে, করেও আবার বলেও, হুম করলে বলতে নেই। ভাবখানা এমন, যেন শুধুই করার দায় নিয়ে ধরাতলে এসে এরা উপযুক্ত প্রতি উত্তর দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিয়ে অকৃতজ্ঞদের জন্মহার অবাধে বাড়িয়ে দিয়ে সমাজের বড় উপকার করছেন! মোটেই না। যেকোনো উপায়ে চুপ থেকে পরিকল্পিতভাবে ভালো হয়েই থাকতে হবে এমনটা সমাজের জন্য হিতকর কী? না কি একদল এখানে গাধা আর একদল এখানে রাজা। যদি তাই হয় তবে তর্ক-তর্কই থেকে যাক। বিতর্কের প্রয়োজন নেই। আর যদি মানুষের গুণাবলীর সমন্বয় সব মানুষের কাছ থেকেই কোথাও কারও প্রয়োজন হয় তবে এই তর্ক যুক্তির গহনা পরে বের হবে ঘর থেকে। যাবে বহুদূর।
ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা ব্যক্তিভেদে আপেক্ষিক হতে পারে। তবে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে লোকে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিচয় বলে মনে করেন সে যে যেটাকেই মনে করুন না কেন, সেগুলোকে নিজের বা অন্যকারও গুণাবলীর মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করার আগে সেগুলোর প্রায়োগিক ক্রিয়াশীলতার গতিপ্রকৃতি বা ফলাফল নিয়ে চিন্তা করা দরকার বোধ করি। কারণ ব্যক্তিত্ব শব্দটি নিঃসন্দেহে একটি দুর্লভ ইতিবাচক শব্দ। তাই এ সংক্রান্ত ক্রিয়াশীল প্রত্যয়গুলোর হিতকারী ভূমিকা নিয়ে সচেতন থাকাটাও আজকের জায়গা থেকে জরুরি। চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের নমনীয়তাই (যা নিজের সুবিধায় নিম্নগামী হওয়া ব্যতিত সব কিছুই পারে) হোক সমুন্নত ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রত্যয়, যা ব্যক্তিকে অনেকের মধ্যে আলাদা একজন করে তোলে, যা ব্যক্তিকে দিয়ে বৈরি পরিস্থিতিতে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে নয়, কাজ করায় স্রোতের বিপরীতে, সুন্দরের হিতে।