চোখ বন্ধ করুন, অতঃপর ভাবতে থাকুন সুখ-সুন্দর একটি দৃশ্য—নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়সের ব্যবধান ভুলে হাত ধরে ছুটছে সামনের দিকে—দ্রুত পায়ে তো নয়ই, দারুণ একটা ছন্দে তারা হাঁটছে আর গাইছে দূরত্ব ভুলে কাছে আসার তীব্র সম্মোহন জাগা গান। তারপর, নিবিড় ছায়া যেখানে এসে জড়ো হয়েছে বিশাল বটের ছায়ায়, সেখানেই বিভিন্ন দিক থেকে আসা মানবমিছিল যুক্ত হচ্ছে, মিলনের গানে সরগরম হচ্ছে তাদের যৌথ ভাবনাবলয়। কী আশ্চর্য, কারও মনে ঘৃণা নেই, মুখে কথা নেই, নেই বেদনার দিনান্তিক চাপ। পরস্পরের আলোয় তারা জ্বলে উঠছে আপন মহিমায়। কেবলই মানুষ পরিচয়কে, বাঙালি পরিচয়ের সংজ্ঞা ধরেই যেন তাদের আজকের সকাল। আচ্ছা, সূর্যটা কি আজ তাই বলেছিল, সকালে ভোরের আলো ভেদ করার সঙ্গে সঙ্গে! কী জানি! মানুষের মনে, এমনকী প্রকৃতিরই অর্ন্তযামে কী লেখা থাকে, তা তো সবার বোধগম্য হয় না, সবার নজরেই আসে না! না আসুক, যদি এরূপ মিলনে সুখ দেয় একটা দিন, তার নাম কী হতে পারে হে মহামান্য মানবসমাজ? নাম যাই হোক, ঘরের একান্তই প্রিয় মানুষটিকে যেমন ভিন্ন নামে ডাকা যায় পরিবেশের তারতম্যে, ঘটনার ঘনঘটায়, তেমনি আমরা দিনটির নাম দেই বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ!
আরে না, আপনি যা ভাবছেন তা একেবারে সত্য নয়। ইতিহাস শোনানোর দায় আমার কাঁধে নেইনি মোটেও। বাদশা আকবর কিংবা তারও পরে যা যা আছে, তা নিজ দায়িত্বে জেনে নেওয়ার দায়িত্ব তো সবারই আছে, না কি! সে যাক চুলোয়, বর্তমানের চেহারাটা দেখা ফরজই হয়ে যায় একরকম—যেহেতু আছি নাগরিক, আরও ঘন করে বললে—সামাজিক জীব হয়ে। সুতারাং স্বীয় ইজ্জতের সীমানা যেমন জেনে রাখা দরকার, নিয়ম-নীতি, এমনকী দেশীয় সংস্কৃতি-মানস এবং শেকড়ের প্রতি খেয়াল না দেওয়াও অমানবিক। না, কূটনৈতিক কথাবার্তা শুনতে মন একেবারে চায় না। সুতরাং ভিন্ন কিছু পারলে শোনান। বৈশাখ হলো গিয়ে—রাস্তা। ধরুন, গ্রীষ্মের কালে, সড়ক ধরে আপনার এগুতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সামনে ধূ ধূ করছে বিল। একা, নিঃস্তব্দ এ সময়ে আপনি হেঁটে চলছেন বিলেরই বুক চিরে সৃষ্টি হওয়া রাস্তা ধরে। কী মজা, একা অথচ সঙ্গ দিচ্ছে বিলের বিশালতা, সঙ্গে দুষ্টামিও করছে হালকা বাতাস। হয়তো বলতে না পারার আনন্দে আপনি গুনগুন করে গান করছেন নিজেরই অজান্তে। ব্যস, অল্পক্ষণ পরেই গন্তব্যে গিয়ে পেছনে তাকালে কেবলি উঞ্চ হাওয়ার বেদিশা বিরহগাথা। মূলত বৈশাখই বিলের মাঝ বরাবর তৈরি হওয়া আইল—যা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয় দ্রুত, নিরাপদে-আনন্দে। বৈশাখের কাঁধে চড়েই আমরা হাসতে থাকি, দৃষ্টি প্রসারিত করতে পারি সমুখের দিকে। পেছনের ইতিহাস উঁকি দেয়, দেয় সামনের ধ্রুব সত্যকে ধরার অধিকারও।
বৈশাখের পূর্ণচরিত্র প্রকাশ পায় দেশের ব্যাপক তারুণ্যে। রঙিন কাপড়ে শুধু নয়, প্রাণের বিপুল চাঞ্চল্যে স্বদেশ জেগে ওঠে সর্বজনীন সুখ-উল্লাসে। শোভাযাত্রাসমেত সোল্লাস আর হৈচৈ তো আসেই আমাদের যাবতীয় স্বার্থপরতা আর হীনমন্যতাকে দূরে তাড়িয়ে দিতে। এরই ফোকরে বাঙালির চোখে প্রতিভাত হয়, হয়তো উঁকিঝুকি দেয় যাবতীয় সন্দেহপনা। গ্লোবাল ভিলেজের অবাধ অংশীদারিত্বে যেকোনো কিছুই আদানপ্রদান হতে পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের তাবৎ উদাহরণ তো আমাদেরই সামনে জ্বলন্ত হয়েই নড়াচড়া করতে থাকে!
উদার হওয়ারও বিপদ থাকে! বাঙালিরা কোনোকালেই অনুদার ছিল না। আকাশ-সংস্কৃতির বিপুল শঙ্কায়, উৎসব-আয়োজনের মাঝেও আমরা হয়তো ভেবে উঠি না, কত পোকামাকড় সদর দরোজা দিয়েই দেশীয় সংস্কৃতিতে যুক্ত হচ্ছে। অবশ্য এ-হওয়ারই কথা, সচেতনতা তাই জরুরি হয়েই পড়ছে আমাদের সময়ে। দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে, তবে মিশেলে পরিমাণটা যদি একপক্ষীয় কিংবা আগ্রাসী হয়, তো বিপদের ঢঙ্কা বেজে উঠতে পারে যেকোনো সময়েই। আমাদের গর্বের ধন, বাপদাদার ইতিহাস আর চিরায়ত সংস্কৃতিকে সঙ্গে রেখে যদি আরও কিছু যোগ করা যায়, খুব ক্ষতি না, যেমনটা যোগ হয় ভাষার ইতিহাসে। নানা গোত্রীয় ও বহুবিভায় ঔজ্জ্বল্য শব্দমালা যোগে বাংলা দিনদিন পুষ্ট হচ্ছে, হবে। সংস্কৃতিও যেহেতু চলমান, সময়ের সঙ্গে যোগ হয়, বিয়োগও হতে পারে; তাই রঙচঙা ব্যাপারটা সহজেই আকর্ষণ করতে পারি, তা করুক—আমাদের কী! দেশীয় রীতিকে আঁকড়ে ধরে যদি ইতিবাচক কিছু করা যায় তো মন্দ হয় না।
জঙ্গি হামলা কিংবা বিশ্বাব্যাপী যে ধ্বংসলীলা, তাতে চোখ আছে আমাদের তরুণ সমাজের। তাদের মনও আনচান করে এসব দেখে, কেউবা বিভ্রান্ত হয়। আসলে কিছু লোক থাকে এসব কাজেই। তরুণদের সবাই তো আর বাইন মাছ নয় যে কাদা গায়ে মাখবে না! পারিবারিক শিক্ষা, ইতিহাস সচেতনতা, ধর্মীয় স্বচ্ছ জ্ঞান ইত্যাদি না থাকলে অনেকেই বিপথগামী হতে পারে, হচ্ছেও। কিন্তু এর বিপরীতে গিয়ে যদি শেকড়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি আমাদের বিপুল সম্ভাবনাময়ী তরুণগোষ্ঠীর তবে এই রক্তে কেনা স্বদেশ শান্ত ও পবিত্র থাকবেই। বৈশাখ মূলত আমাদের মাঝে এই চিহ্নটুকু এনে দেয়। তারুণ্য তার শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আলপনা আঁকেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা করেন, নানাবিধ রঙিন কর্মে তারা জাগরুক থাকে—অশুভ শক্তিকে, চিন্তার বলয়কে ভিন্ন দিকে প্রভাবিত ও প্রবাহিত করতে পারে না। চোখ বুঝে ভাবুন একবার, যে কি না তুলিতে আঁকতে চায় মাঙ্গলিক চিহ্ন, স্বদেশের অনাগত দিনকে দিতে চায় স্বপ্নসুখ তার দ্বারা কি নেতিবাচক কোনো ক্রিয়ায় জড়ানো সহজ হতে পারে? রঙিন পাঞ্জাবি বা শাড়িতে যদি ঢাকতে পারি অতীতের বেদনাহত দিন, পূর্বপুরুষের না পারার বেদনা তো বৈশাখের প্রথম সকালের দাম অপরিমেয়। বস্তুত আমাদের সবটুকু সম্ভাবনার কথা নিয়েই হাজিরা দেয় বৈশাখ কী গ্রামে কী নগরে। মা-চাচীদের পিঠাপুলি, চিরায়ত গ্রামীণ রূপ ও রস; বদলে যাওয়া দিনমানতার সঙ্গে বর্তমানকে মেলাতে শত ব্যস্ততা ভুলে একদিনের জন্যে হলেও মাটির কাছাকাছি যাওয়া দরকার।
বাস্তবতা এই—বাঙালি উপলক্ষ বিনে পা দিতে চায় না কোথাও। অন্যান্য দিনের চেয়ে এর গৌরব এ কারণেই বেশি—বৈশাখের সঙ্গে আমাদের আত্মার খতিয়ান জড়িত, বাপদাদার হাসিকান্নার ইতিহাসও জড়াজড়ি করে আছে এতে। আশার কথা, আমাদের তারুণ্য বিস্মৃত হন না সহজেই, তারা মনেপ্রাণে বৈশাখের স্মৃতিরেখাকে টেনে নিয়ে আসতে চায় স্বার্থপরতার এই আকালেও।
হয়তোবা সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুই বদলে যায়, যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বৈশাখের বাঁশির সুর কিংবা নাগরদোলায় চড়ে যে শৈশব আমাদের ডাক দিয়ে যায় তা কি কম অন্তর ভরা? কেউবা এই সুযোগে স্বরকে বড় করে—হিন্দুয়ানি, বঙ্গয়ানি করে তোলে; আলপনা মুছে দেয় শহরের। তাতে কী, যে হুঙ্কারে রুদ্র বৈশাখ আমাদের দরবারে আসে, তাতে একটু প্রতিক্রিয়া হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদেরও কিছু করণীয় তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় সময়ের প্রেক্ষাপটে। ইংরেজি মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনকেই আমরা পহেলা বৈশাখ পালনের দিবস হিসেবে মেনে নিয়েছি বটে, যার সঙ্গে গ্রামীণতার কোনো সম্পর্কও আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য আমাদের অনাচারে, ব্যাপক নগারয়ণের ঢামাঢোলে আমরা হারাতে বসেছি ঋতুর সৌন্দর্য, সেইসঙ্গে বৈশাখের পরিবেশগত সুসমাচারও। সময় এসেছে, পরিবেশ নিয়ে ভাবার, বৈশাখ আদৌ তার প্রকৃতিগত সময়ে আছে কি না, তাও জেনে রাখা দরকার। আইন আমাদের কল্যাণে হয়, তার ব্যবহারে সর্তক হওয়া আইনের আওতাধীনদের মনে রাখাও জরুরি। সেহেতু, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বৈশাখের গল্প করতে এবং রঙিন শৈশবের গল্প শোনাতে পরিবেশ ঠিক রাখাটাও অতি মাত্রায় দরকারি হয়ে যায়! বাদ্য বাজুক, তালপতার বাঁশি না হোক ভুভুজেলা তো বাজছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা অসঙ্গতির ভেতরেও যদি একটু উপলক্ষ পাই হাসার, পরস্পরকে ভালোবাসার, তাতে মন্দ কই! হাসি ভুলতে বসা, পারস্পরিক হৃদ্য সম্পর্ক ভুলে যাওয়া সময়ে বৈশাখ আসে আত্মীয় হতে, স্বজন বানাতে।
বৈশাখ নিয়ে নানান কাগজের বর্ণিল আয়োজন আর বিশেষ সংখ্যা প্রকৃত অর্থেই আমাদের জাতিগত সরলতা আর উৎসবমুখরতাকে প্রকাশ করে। তারুণ্য জানে এদিনের বিশেষ মানে, তারা গান-কবিতায়, কখনো বা টাসকি দেওয়া কোনো গল্পে প্রকাশ করতে চায় তাদের মনোবাসনা। প্রিয়তমাকে বলতে না পারা আকুতিটুকু বৈশাখের জন্যেই রাখে সঞ্চয় করে। নির্জনতার পাপে নয়, কোলাহলের মুখরতায় সাহসি হয়ে উঠি প্রেমের গভীর অনুরাগে। আবেগে তবে কজনই বা নিজেকে সংযত রাখতে পারে! শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজেরা হয়তো এ কারণেই বৈশাখেরই বিশাল আয়োজনে আমাদের শোনান পূর্বপুরুষদের মহৎ থাকার কথা, স্বাধীনচেতা থাকার কথা—এই বৈশাখে। কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতায় এসে সত্যিই তো দেখতে পাই—রমনার বটমূল যেন এক টুকরো আনন্দমুখর বাংলাদেশ; ডিসি হিল যেন মানুষেরই কল্যাণ কামনায় নুয়ে পড়ে মানুষের ভীড়ে। এভাবে সারাদেশই হয়ে উঠে আনন্দের ফোয়ারাধারা, বৈশাখে। যাবতীয় হীনতার মৃত্যু নাজরানা নিয়েই তো বৈশাখ আমাদের ডাকে প্রেম করতে, পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে। তো প্যাচাল কেন—দুই হাত বাড়িয়ে পান করি আনন্দসুরা, দেশটা নিয়ে ভাবি নতুন করে, তারুণ্য নিয়ে, এই বৈশাখে। রুদ্রের আড়ালে যে শান্তিটুকু নিয়ে আসে মা—তার নাম ভবিষ্যৎ, তার নাম এগিয়ে যাওয়া। বৈশাখ অভিশাপই দেয়, যদি বাঙালি পড়ে থাকি ছোট পুকুরে। একাত্তরে রক্তসাগরে যাদের জন্ম, তারা কেন মহাসাগরের দিকে ইচ্ছাশক্তিকে ধাবিত করবে না? আমরা পারি, পারবো—বৈশাখ এই সাক্ষ্য দিতেই এসেছে আমাদের দরবারে!