একটা সময় ছিল, যখন যা হাতের কাছে পেতাম পড়তাম। তা যেকোনো বই, পত্রপত্রিকাই হোক—পড়ার একটা ঝোঁক ছিল। জ্ঞান কিনতে চাইতাম। চাইতাম সঞ্চয়ে কিছু জমা হোক। এটি ভাবিনি খুব বেশি কিছু লিখব। বাউল গানের প্রতি খুব দরদ ছিল। বেড়ে উঠেছি রবীন্দ্রনাথের বাউল ঘরানার গান শুনে শুনে। এরপরে ক্রমশ মজে যাই আধ্যাত্মিক বাউলদের পদে-চরণে। খুব মনযোগ দিয়ে শুনতাম। মনে হতো আমারও কিছু বলার আছে। তাই শুরু করি বাউল গান লেখা। কিছু শিল্পী গানগুলো গেয়েও প্রচার করেন। শুনি। ভালো লাগে। এই ভালো লাগা থেকেই মনে হয় আরও কিছু লিখি। শুরু করি কবিতা দিয়ে। হেঁটে যাচ্ছি। মানুষকে হাঁটতেই হয়। থেকে থাকলে জীবন চলে না। জগৎ চলে না।
আজকের সমাজে আমরা যে পরিবর্তন লক্ষ করি, তা কি আগে এ রকম ছিল? না। ছিল না। মানুষের মাঝে সহনশীলতা ছিল। এই তো সেই বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার যুদ্ধের সময়ে কমান্ডিং অফিসারদের পাঁচশত টাকা, অফিসারদের চারশত টাকা আর সৈনিকদের একশত টাকা বেতন দিয়েছিল। দিয়েছিল, সেটাই বড় কথা। ষাট-সত্তরের দশকেও মানুষের মাঝে তৃপ্তি ছিল। মানুষ যা পেতো, তা নিয়ে সুখী থাকার কথা ভাবতো। এখন মানুষের হাতে হাতে লাখ লাখ টাকা। ক্যাসিনোতে একরাতে কোটি কোটি টাকা ওড়ায় এই বাংলাদেশেরই মানুষ। কিন্তু রাষ্ট্রের সৃজনশীল কাজে সরকারের বাজেট থাকে না। কেন থাকে না?
একটি রাষ্ট্রে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতিকে যদি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে মেধাবীর মূল্যায়ন হয় না। কেনই বা হবে? কারণ ওই চেয়ারগুলোতে যারা বসে আছে, তারা তাদের পোষ্যদের বাঁচাতেই ব্যস্ত। পোষ্য এখন বহুপ্রকার। যারা গোষ্ঠিভিত্তিক সাহিত্য সংস্কৃতির ধারক, তারা তাদের অনুগামীদের পদাসনে বসাতেই ব্যস্ত।
এই সময়ে ভারতে যে রাজনৈতিক শ্রেণীবিভাজন, হটকারি সিদ্ধান্ত চলছে, তা কি মানবতার কল্যাণ বয়ে আনবে? না
সমাজে এখন শর্টকাটের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, তা বাড়িয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। আপনি যদি একজন নবীন কবিকে বলেন, অমুক কবির কবিতা পড়েছো কি? সে আপনাকে বলবে, আপনি আমার কবিতা পড়েছেন? অমুক অমুক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে! তার কেনার চেয়ে বিক্রির তাগিদ বেশি। নিজেকে অনেক মেধাবী ভেবেই সে বসে আছে! অথচ সে বাংলা কবিতার সিকদার আমিনুল হক, সাইয়্যিদ আতীকুল্লাহ, আবু কায়সারের নামও শোনেনি। আপনি যদি বলেন, তবে বলবে সবার নাম শোনা তো জরুরি নয়! কত বড় ধৃষ্টতা! অগ্রজদের সম্মান করতে না শেখার যে কালচার আজ চালু হয়েছে তাকে কি আমরা শুদ্ধ বিবর্তন বলবো?
আমাদের অনেক কবি, বাংলা বাদ দিয়ে এখন অন্য ভাষায় কবিতা লিখ চেষ্টা করেন। বিশেষ করে ইংরেজিতে। কারণ তারা মনে করছেন, ইংরেজিতে লিখতে খুব সহজে ‘বিশ্বখ্যাতি’ পাওয়া যাবে। কিন্তু তা কি সম্ভব?
অন্য ভাষাভাষি বড় বড় কবি-লেখকদের দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা তাদের নিজের ভাষায়ই লিখেছেন। পরে বাজারিরা তা ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করে বাজারজাত করেছে। তারা তা করেছে, নিজেদের প্রয়োজনেই।
আপনি যদি বাংলা ভাষার মেধাবী লেখক হন, তাহলে আপনিও তো সেই কাতারে উঠতে পারেন। পারেন না? সেই আত্মপ্রত্যয় আপনার নেই কেন?
একজন কবির কাজ হলো, লিখে যাওয়া। লেখক লিখবেন। এছাড়া তার আর কী করার আছে! হ্যাঁ, আছে। আছে আরেকটি কাজ। তা হলো নিজ জাতিসত্তার পক্ষে দাঁড়ানো। এই কাজটি না করতে পারলে, মাটি লেখককে ক্ষমা করে না।
এই যেমন ধরুন, এই সময়ে ভারতে যে রাজনৈতিক শ্রেণীবিভাজন, হটকারি সিদ্ধান্ত চলছে, তা কি মানবতার কল্যাণ বয়ে আনবে? না। আনবে না। তাহলে এই হীন-রাজনীতি কেন? আশার কথা হচ্ছে, কেউ না কেউ এর প্রতিবাদ করছেন। এই প্রতিবাদ শব্দে। এই প্রতিবাদ কঠোর কণ্ঠে।
আমারই হাতের স্নেহে ফুটেছিল এই গন্ধরাজ
যে–কোনো ঘাসের গায়ে আমারই পায়ের স্মৃতি ছিল
আমারই তো পাশে পাশে জেগেছিল অজয়ের জল
আবারও সে নেমে গেছে আমারই চোখের ছোঁয়া নিয়ে
কোণে পড়ে–থাকা ওই দালানে দুপুরে ভাঙা থামে
আমারই নিঃশ্বাস থেকে কবুতর তুলেছিল স্বর
শালবন–পেরনো এ খোলা মাঠে মহফিল শেষে
নিথর আমারই পাশে শুয়েছিল প্রতিপদে চাঁদ।
তোমাদের পায়ে পায়ে আমারও জড়ানো ছিল পা
তোমরা জানোনি তাকে, ফিরেও চাওনি তার দিকে
দুধারে তাকিয়ে দেখো, ভেঙে আছে সবগুলি সাঁকো
কোনখানে যাব আর যদি আজ চলে যেতে বলো।
গোধূলিরঙিন মাচা, ও পাড়ায় উঠেছে আজান
এ–দাওয়ায় বসে ভাবি দুনিয়া আমার মেহমান।
এখনও পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ
এ–মাটি আমারও মাটি সেকথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ।
[মাটি: শঙ্খ ঘোষ ]
এর চেয়ে কঠিন প্রতিবাদ একজন কবি আর কিভাবে করবেন? আমার কেন জানি বার বার মনে হয়, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিতে চরম পচন এখন সামাজিক কর্কটে রূপ নিয়েছে। দেখবেন, যারা ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়কের সমর্থক ছিল, তারাও এখন বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে। তারাও খেটে খাওয়া মুক্তিযোদ্ধার হাতে সাহায্য তুলে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়। কী বিষাদ চারিদিকে আজ!
অথচ বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এখনো আমেরিকা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নাৎসীবাদীদের ধরে ধরে এনে বিচারের কাটগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। আমরা এগুলো দেখি না।
আচ্ছা, আমরা প্রতিদিন যে বাকস্বাধীনতার কথা বলি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি, তা বিশ্বের কোথায় আছে? আমেরিকায়? ইংল্যান্ডে? ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টির সাম্প্রতিক বিজয় তো প্রমাণই করে দিলো বিশ্ব এখনো সামন্তবাদীদের দখলে!
যে নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা আছে ‘সকল সংবাদই প্রকাশযোগ্য’ সেই নিউইয়র্ক টাইমসে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি বিজ্ঞাপন ছাপতে মিলিয়ন ডলার নিয়ে গিয়ে দেখুন না! ওরা ওই বিজ্ঞাপন ছাপবে না। কেন ছাপবে না? তাহলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা’টা কোথায়? এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।
ইয়ামেনে সৌদি আরব যে গণহত্যা চালাচ্ছে, কিংবা মিয়ানমারের সু চির বিরুদ্ধে আজ যে গণহত্যার মামলা, তা নিয়ে বিশ্বের বিবেকবানরা ভাবছেন? ভাবলে তো কাজটি অনেক ত্বরান্বিত হতো।
মানুষকে কিছুই শেখানো যায় না, যদি সে না শেখে। বিশ্ব আজ এগোচ্ছে প্রযুক্তির পথে।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যেদিন থেকে নিজেদের বিকোনো শুরু করেছেন, এই মাটি সেদিন থেকেই তাদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। তা দীর্ঘতর হচ্ছে। একদিকে রাষ্ট্র অবহেলা করছে মেধাবীদের,অন্যদিকে কিছু তালিয়াবাজ কাঠের টুকরো দিয়ে ক্রেস্ট বানিয়ে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে। এ পরিস্থিতি শিল্প সাহিত্যের জন্য খুবই লজ্জার। এই লজ্জা থেকে উত্তরণের পথ যে তরুণদের খোঁজার কথা ছিল, তারাও যেন ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে ভয়ানক কথা হচ্ছে, ওই সিন্ডিকেটধারী করপোরেটরা শিল্প-সাহিত্যকেও বানিজ্যের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। একটি জাতীয় দৈনিকে সাহিত্যের পাতার চেয়ে বাহারি বিজ্ঞাপনের রঙচঙ আকৃষ্ট করছে পাঠককে।
কেন পারেন না? একদা সমাজতন্ত্রের নিশানধারী ওই সম্পাদক কার হাতে জিম্মি? করপোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে? যারা কিডনি ব্যবসা কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে?
বাংলাদেশের সর্বত্র এখন দখল আর লুটপাটের রাজত্ব। এই সুযোগে কেউ কেউ বলবে, দেশে গণতন্ত্র নেই, তাই এই অবস্থা!
গণতন্ত্র বিশ্বের কোথাও নেই। হয় একনায়কতন্ত্র না হয় রাজতন্ত্র। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী যা করছেন তা কি গণতান্ত্রিক? তারা তো মেজরিটি ভোটে পাস করে এসেছেন।
আমি চাই, মানুষ চিন্তক হোক। মানুষের বোধোদয় হোক। ক্লাসের বই পাঠই জ্ঞানার্জনের শেষ পথ নয়। এর বাইরেও একটা জগৎ আছে। আমরা ৭০-৮০ এর দশকে বইপোকা হয়ে লাইব্রেরিতে, লাইব্রেরিতে ঘুরতাম। এখন প্রজন্ম ব্যস্ত ভোগ বিলাসে। তা খারাপ, বলছি না। কিন্তু মেধার চর্চা দরকার।
মানুষকে কিছুই শেখানো যায় না, যদি সে না শেখে। বিশ্ব আজ এগোচ্ছে প্রযুক্তির পথে। কিন্তু প্রযুক্তির বিষাদ কী, তাও তো দেখছি আমরা। বুদ্ধি ও বিবেককে জয়ী করতে হলে শিরদাঁড়া উঁচু করতে শিখতে হবে। এই কাজটি করা না গেলে সমাজ বারবার বিচ্যুত হবে আলোর কক্ষপথ থেকে।