শুধু বুদ্ধদেব বসুর কথাই বলি কেন, যেকোনো মানুষ জন্মের সময় মাকে হারালে পরবর্তী জীবনে দুঃখের একটা স্থায়ী ছায়া পড়ে তার জীবনজুড়ে। অনেকে নিজেকে মাতৃহত্যায় দায়ী ভেবে একটা অপরাধবোধেও ভোগেন। পুরুষের মধ্যে এটা বেশি হয়। নারীদের মধ্যেও এমনটি দেখেছি। আর এ ধরনের মাতৃস্তন্যবঞ্চিত শিশুরা বড় হলে প্রেমকাতুরে হয়ে থাকে বলে ফ্রয়েড সাহেব মনে করতেন। এদের ঈডিপাস-কমপ্লেক্স আক্রান্ত বলা হয়ে থাকে। ফরাসি কবি বোদলেয়ার নাকি এমনই ছিলেন। কী আশ্চর্য! বুদ্ধদেব বসু সেই বোদলেয়ারের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেলেন, আর আমরা বুঝলাম বুদ্ধদেব বসু মানসিক কারণেই বোদলেয়ারে আত্মানুসন্ধান করেছেন। এক সময় শুনতাম, বুদ্ধদেবের অনুবাদ করা বোদলেয়ারের কবিতাগুলো এতবেশি বুদ্ধদেবীয় যে এগুলোকে ‘বোদলেয়ার বসুর কবিতা বলা যায়।’
ফ্রয়েড সাহেবের কথা বিজ্ঞানসম্মত হোক অথবা না হোক, বুদ্ধদেব বসু যে প্রেমকাতর ছিলেন তা তাঁর সাহিত্যের নানা শাখায় প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বুদ্ধদেব কাউকে সরাসরি প্রেম নিবেদন করতেন না। আসলে তিনি তা পারতেন না; এর কারণও আছে। বুদ্ধদেবের মনে মাতৃহারার চিরনিঃসঙ্গতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল শারীরিক কিছু অযোগ্যতাও। তাঁর শারীরিক খর্বতা, কথার জড়তা বা তোতলামি তাঁর মনে সোশালফোবিয়া সৃষ্টি করেছিল। এ কারণে তিনি সরাসরি প্রেমনিবেদন করতে সাহস পেতেন না বলেই সাহিত্যে প্রেমকে মুখ্য বিষয় করে তুলেছিলেন। আর সমকালে কাছের মানুষেরা তাঁর প্রেমের কবিতার ধারাটির বেশ প্রশংসা করে তাঁকে ঐ ধারা থেকে সরে নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে বাধাই দিয়েছেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন,
‘কবিতায় বুদ্ধদেব বসুর তখনই ঔৎকর্ষ দেখা যায় যখন তার বিষয় থাকে প্রেম। নিজস্ব আবেগের যতো সার্থক ব্যঞ্জনা তিনি দিতে পারেন তার সিকি পরিমাণও সমাজ বর্ণনায় এসে উঁকি দিয়ে যায় না। ভাষার খরধারে বিদ্রূপাত্মক কবিতায়ও তিনি অনেকটা সফল—কিন্তু তাঁর যে-সব রচনা সমাজের প্রতি শুভ ইচ্ছা বহন করে, কবিতার প্রাণ (বা আবেগ) সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।১
বরং তিনি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অনিকেত অনিশ্চয়তা, পেশাগত অনিশ্চয়তা এবং সৎসম্পাদনার কারণে সৃষ্ট ‘আপনশত্রু’দের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় সর্বদা অস্থির ছিলেন।
এখন দেখা যাচ্ছে একজন পাঠকহিসাবে আমার অবস্থান সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বিপরীতে। কারণ, আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা হলো তাঁর ভালো না-বাসার কবিতাগুলো। কারণ, তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো বেশি লুতপুতে। ব্যক্তি বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে এত নিন্দা, ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব সম্পর্কে এত তিতা কথা এবং কবি বুদ্ধদেব সম্পর্কে এত সমালোচনা পড়েছি, শুনেছি এরপরেও আমি প্রায়ই তাঁর কবিতা পড়ি। সেই কবিতাগুলোই পড়ি যেখানে কঙ্কাবতী বা কোনো নারীকে নিয়ে লুতুপুতু প্রেমের প্রস্তাব নেই, যেখানে ব্যক্তি বুদ্ধবে বসুর নিঃসঙ্গতা, হতাশা, ব্যর্থতা, দারিদ্র্য এবং নানা অযোগ্যতার কথা কবিতা হয়ে ফুটে আছে। এটাই আধুনিক কবিতার একটা প্রধান দিক।
০২
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় দেখা যায়, প্রথম বয়সে প্রেয়সীকে খুঁজেছেন আর পরবর্তী জীবনে তিনি ঈশ্বরসন্ধান করে গেছেন। এখানে সুধীন্দ্রনাথের পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব ছিল। অমিয় দেবের লেখা সুধীন্দ্রনাথের জীবনী পড়লে দেখা যায়, প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে অশান্তি, নিঃসন্তান দাম্পত্যজীবন এবং প্রথম স্ত্রী থাকাসত্ত্বেও পরে রাজেশ্বরী দেবীকে বিয়ে ইত্যাদি নানা ঘটনা বড় কষ্ট দিয়েছে সুধীন্দ্রনাথকে।২ আর শেষজীবনে তিনি বেদান্ত দার্শনিক পিতার প্রভাব নিয়ে সংশয়জনিত প্রশ্নাকুল ছিলেন। পক্ষান্তরে বুদ্ধদেব বসু একাধারে লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে যেন ঘরে পেয়েছিলেন। রাণু সোম অর্থাৎ প্রতিভা বসু—কণ্ঠশিল্পী ও কথাশিল্পী উভয় প্রতিভা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর ঘর করেছেন। আর ঘরের সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সব রকম সাংসারিক চিন্তা থেকে স্বামী বুদ্ধদেব বসুকে মুক্তি দিয়ে অবাধ সাহিত্যচর্চার সুযোগ করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে প্রতিভা বসু অসুস্থ হলে বুদ্ধদেব টের পেতেন সংসার চালাতে কী লাগে। নিজের সাহিত্য পত্রিকার অবৈতনিক সম্পাদক হওয়া ছাড়া বুদ্ধদেব বসুর পেশাগত জীবনে সুস্থিরতা ছিল না। সুধীন্দ্রনাথের পিতৃকূল এবং মাতৃকূলের মতো কলকাতায় স্থায়ী বিত্তবেসাত ছিল না তাঁর। তিনি ছিলেন কলকাতায় চড়ুই পাখির মতো।
বুদ্ধদেব বসুকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। অর্থের অনটনে বুদ্ধদেব বসুর প্রবাসী কন্যা এবং জামাতার ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে কিছু উপার্জনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এজন্য তাঁর কাছের মানুষেরা কত নির্দয়ভাবে তাঁকে গালমন্দ করেছেন, সিআইএর দালাল বলে অভিহিত করতেও বাকি রাখে নাই।৩ গাঁটের পয়সায় পরিচালিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তরুণ কবিদের স্থান করে দিয়ে তিনি নতুন যুগের কবিদের কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু একাজেও তাঁর শত্রুর অভাব হয় নাই। সেই কাছের মানুষেরাই তাঁকে আমৃত্যু নানাভাবে আক্রমণ করে গেছেন।৪ এসব বিষয় বুদ্ধদেব বসুর কবিতাকে প্রেমহীন একটি কবিতার ধারা সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
০৩.
জন্মদুঃখী বুদ্ধদেব বসু জন্মের সময় মাকে হারালেন, পিতার স্নেহসান্নিধ্যও পাননি। তিনি বড় হয়েছেন পিতামহের কাছে। তারপক্ষে প্রেমপিপাসা অসীম হওয়ারই কথা, সারাজীবন তিনি কবিতায় শুধু প্রেমকে আরাধ্য বিষয় করে নেবেন বলেই অনেকে মনে করেন। কিন্তু তিনি প্রেমের কবিতা লিখলেও প্রেমের ভেতরে ভেতরে যাপিতজীবনের অভিজ্ঞতাকে শব্দবন্দি করেছেন নানা কবিতায়। যেমন, ‘কঙ্কাবতী’ কাব্যন্থটি সম্পূর্ণই প্রেমের বলা যায়, কিন্তু সেখানে ‘সুখান্বেষী’ কবিতায় দেখি, ‘একটু সুখের তরে দেহ কাঁদে, মনে হাহাকার।’ আবার ‘অন্ধকার সিঁড়ি’ কবিতায় লিখেছেন,
বড়ো অন্ধকার সিঁড়ি, খাড়া খাড়া সিঁড়িগুলি চোখেই পড়ে না।
বেরোবার পথ বড়ো এলোমেলো—ভারি অন্ধকার।
এরপরে দেখি ‘দময়ন্তী’ কাব্যে তিনি জীবনের আদিম যন্ত্রণা, পরিবেশ ও প্রতিবেশজাত নানা সমস্যা, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বসভ্যতার নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কথা কবিতায় তুলে এনেছেন। কখনো তিনি সালঙ্কারভাষায় আবার কখনো নিরলঙ্কার ভাষায় লিখেছেন। এ কারণেই হয়তো সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর সমাজবিষয়ক কবিতাগুলোর মধ্যে ঔৎকর্ষ খুঁজে পান নেই।
বুদ্ধদেবর সমকালীন কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং বিষ্ণু দে সমাজবিষয়ক কবিতা লিখে নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করে গেছেন। এক্ষেত্রে বুদ্ধদেবর ভূমিকা যেভাবে অপাঙ্ক্তেয় ভাবা হয়, আসলে বুদ্ধদেবের কবিতা ততটা অচ্ছুত নয়। সময়ের প্রভাবে পড়ে আমাদের মধ্যে অনেকেরই একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায় পরের মুখে ঝাল খাওয়ার। মনোযোগ দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা না পড়ে, অন্যদের সমালোচনা পড়ে বা শুনে নজরুলকাব্যবিচারের একটা প্রবণতা এদেশে প্রচলিত আছে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতাও সেই অবিচারের পাল্লায় পড়ে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। যাঁরা একবাক্যে তাঁর কবিতাকে বাতিল করে দিতে চান, খারিজ করে দিতে চান তাঁরা যদি একবার মনোযোগ দিয়ে ‘দময়ন্তী’ থেকে পরবর্তীকালে রচিত কবিতাগুলো পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন বুদ্ধদেব বসু এই সমাজেরই অধিবাসী ছিলেন, এবং এ সমাজেরই কবি। তিনি ভিনগ্রহের বাসিন্দা ছিলেন না, তিনি শুধু প্রেমকাননে জীবন কাটিয়ে যান নাই। বরং তিনি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অনিকেত অনিশ্চয়তা, পেশাগত অনিশ্চয়তা এবং সৎসম্পাদনার কারণে সৃষ্ট ‘আপনশত্রু’দের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় সর্বদা অস্থির ছিলেন।
হিন্দিকে সরকারী ভাষা ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করার বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল ইংরেজীর আসন বজায় রাখার জন্য নয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। সমৃদ্ধ ভাষা যে আমাদেও উচ্চতর চিন্তা-ভাবনার জগতে নিয়ে যায় এবং সেজন্য আধুনিক।
‘দময়ন্তী’ কাব্যের উৎসর্গ কবিতা ‘সমর সেন’-এ তিনি লিখেছেন, ‘বিতর্ক-বিরক্ত মন দ্বিখণ্ডিত দর্পণের মতো।’ সঞ্জয় ভট্টাচার্য কি দেখতে পেলেন না, এই বিতর্ক-বিরক্ত মনের একটি চমৎকার উপমা দ্বিখণ্ডিত দর্পণ? ‘হে কাল’ কবিতায় ঐতিহ্যকে বিরাট কঙ্কালের রূপকে রূপকায়িত করেছেন। লিখেছেন,
ঐতিহ্যের বিরাট কঙ্কাল—
এই কি তোমার উপহার
হে কাল, হে মহাকাল?
এ কবিতায় ইতিহাসের হিংস্রতা, কুটিলতা ও নৃশংসতাকে জীবন্ত জন্তুর উপমায় উপমিত করে প্রকাশ করেছেন, ‘ইতিহাস জীবন্ত জন্তুর মতো প্রতিহিংসা খোঁজে।’ ইতিহাসের এই বুনো জানোয়ার এশিয়া, ইউরোপ আফ্রিকাসহ সব মহাদেশেই ধারালো দাঁত, নখ আর শিং বাঁকিয়ে তেড়ে আসে। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষেরাই তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। এই নিরীহ মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্যই সদাপ্রস্তুত ইতিহাসের এই হিংস্র জন্তুরা। বুদ্ধদেব এ কথাটি আরো স্পষ্ট করে লিখেছেন ‘কোনো কবি-বন্ধুকে’ কবিতায়। কবিতাটির শুরুতেই ব্যক্তিগত একটি আটপৌরে ক্লান্তিকর কাজের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,
জীবিকার নিরানন্দ অন্বেষণে ঘুরি রাজপথে
এরপরে তিনি বন্ধুকে জানান,
মূঢ় যারা, ক্রূর যারা,
হিংস্র লোভে অকুণ্ঠলুণ্ঠনকারী, তারাই তো জয়ী।
আমি-তুমি পরাজিত ক্রীতদাস।
‘চলচ্চিত্র’ কবিতায় একটি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্রের মতো একটি কাহিনি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। সেটি জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’-এর মতো জীবনজটিলতার অতলে নিমজ্জিত প্রাণ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। তবে বুদ্ধদেব জীবনানন্দ দাশের মতো কবিতায় রহস্য সৃষ্টি করেন না, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো ছন্দের কঠোর বন্ধনে শব্দকে বাঁধতে পারেন না। তাঁর কবিতার ছন্দ অনেকটা শিথিল। কারণ, তাঁর জীবনও তেমনই ছিল। তিনি জীবনানন্দ দাশের মতো সর্বদা আত্মমগ্ন ছিলেন না কিংবা সুধীন্দ্রনাথের মতো পারিবারিক আভিজাত্যের দূরত্বে বাস করতেন না। তিনি অনেক মানুষের সাথে মিশতেন, হাসতেন, কথা বলতেন আড্ডা দিতেন। এ কারণে তাঁর কবিতার ভাষা এবং ছন্দও অনেকটা সরল। কবিতাটির শেষ ছত্রে লিখেছেন, ‘অন্তত হতাম যদি কেরানি কি ইস্কুলমাস্টার।’
এভাবেই জীবনে ক্ষুদ্রতা চলে আসে। ‘পূর্বরাগ’ এবং ‘কবিজীবনী’ নামে দুটি দীর্ঘ কবিতা রয়েছে। সেখানেও সময় ও সমাজের কামড়ের কথা লিখে গেছেন কবি।
চতুরকৌশল; যতবার নাগরিক প্রলোভনে
উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে আরোহণে সচেষ্ট হয়েছি,
ততবার, পরাজিত, ফিরেছি আপন মূঢ়তায়,
অজ্ঞান স্বধর্মে, জরা-জয়ী কারুকর্মে, ঘর্মক্ষর
কিন্তু ক্লান্তিহর পরিশ্রমে। আমার জীবন এই।
কবি নিজের জীবনকে চিনেছেন। নিজের অবস্থান আবিষ্কার করেছেন।
আমার যে মুক্তি নেই, এই মুক্তি; যে-কর্মের চক্রে
বাঁধা আছি, আবদ্ধ তাতেই—এ যদি সৌভাগ্য হয়
এ সৌভাগ্য জৈব ধর্ম, মানুষ বঞ্চিত শুধু এতে
মানুষেরই লুব্ধ ধূর্ততায়। বসন্তে যেমন গাছ
ফোটায় নতুন পাতা, তেমনি কর্মের প্রেরণায়
মুঞ্জরে মানুষ, এই স্বত্ব এ-বিশ্বে ফিরায়ে আনো।
হাঁটুজলে মাঠে যারা কাটায় আষাঢ়— যারা নামে
খনির তিমিরে, করাল রৌদ্রের দিনে রাজপথে
হাঁটু ভেঙে খাটে যারা, মৃত্তিকার, খনির, যন্ত্রের
ঐশ্বর্য তাদেরই। তাদেরই তা হোক। আনন্দের উৎস
হোক সকলেরই স্বীয় শ্রম— কৃষকের, যন্ত্রীর, কবির।
বুদ্ধদেব বসু নিজেকে দেখতে পেলেন কৃষকের পাশে, যন্ত্রীর কাছে। কবিকেও তিনি এক সারিতে দেখতে পান। এমন কবিতা লেখার পরেও তাঁকে পুঁজিবাদীকবি, বুর্জোয়াকবি এসব গালাগাল শুনতে হয়েছে। অথচ তঁর সমকালের অনেক কবি কৃষক-শ্রমিক তো দূরের কথা সাধারণ একজন শিক্ষিত মানুষের সাথেই মিশতেন না। নিজেকে সেই শ্রেণীর ওপরের তলায় তুলে রাখতেন। এ দিক নিয়েই বুদ্ধদেব বসুর বড় মেয়ে মীনাক্ষী দত্ত আফসোস করে লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুকে সারাজীবন গালাগাল শুনতে হয়েছে।’ এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিরঞ্জন হালদার অনেক কথা লিখেছেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারাশঙ্করের মতো লেখকরা এমন বিষয় নিয়ে লিখেছেন যাকে অশ্লীল বলা যায়, কিন্তু তাদের সাহিত্যকে অশ্লীল বলা হয় নাই, তাদেরকে গালিমন্দ শুনতে হয় নাই, শুনতে হয়েছে বুদ্ধদেব বসুকে। যাঁরা বুদ্ধদেব বসুকে গজদন্তমিনারবাসী বলে মনে করতেন, নিন্দা করতেন তাদের উদ্দেশে নিরঞ্জন হালদার জানান যে, বুদ্ধদবে বসু সমসাময়িক বিষয় এড়িয়ে যান নাই, তিনি বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে তা তুলে ধরেছেন। অনেক প্রবন্ধেও তার প্রমাণ মিলবে বলে জানান নিরঞ্জন। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি জানি না, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন, এমন আর কোন্ বাঙালী কবি এত বেশি সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এত বেশী বিচলিত হয়েছেন। ‘উত্তর তিরিশ’ নামে যে-বইটির গদ্য পড়বার জন্য আমরা ছাত্রজীবনে বইটি নিয়ে কাড়াকাড়ি করতাম, সেই বইটার বিষয় কি সমকালীন নয়? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে দেশকে বাঁচাবার জন্য গান্ধীজী যখন নোয়াখালির গ্রামে গ্রামে তখন কি বুদ্ধদেব বসু চুপ করে থাকতে পেরেছেন? তিনি দেশপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেননি বটে কিন্তু ডায়াসেন্সি স্কুলে কালো-চামড়ার মিস ক্লাসে মি: গান্ধী, নেতাজীকে সুভাষ বসু বলে অভিহিত করলে নিজের মেয়েকে ওই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন, যদিও তিনি নেতাজীর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, গান্ধীজীর ধর্ম-মিশ্রিত রাজনীতি তাঁর খুবই অপছন্দ ছিল। হিন্দিকে ভারতের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে ভারতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এই আন্দোলনকে ইংরেজী প্রীতির আন্দোলন বলে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় যিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তিনি কিন্তু নিজের ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই পড়িয়েছেন। কোনো সত্যিকার কবি ভাষার প্রশ্নে নীরব থাকতে পারেন? বুদ্ধদেব বসুও পারেননি। হিন্দিকে সরকারী ভাষা ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করার বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল ইংরেজীর আসন বজায় রাখার জন্য নয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। সমৃদ্ধ ভাষা যে আমাদেও উচ্চতর চিন্তা-ভাবনার জগতে নিয়ে যায় এবং সেজন্য আধুনিক।৫
এর পরেও বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে সমালোচনা, তীব্র গালাগালি চলেছে। রাজনৈতিক মহল থেকেই বেশি সমালোচনা হয়েছে তাঁর। ব্যক্তিগত সমালোচনার আড়ারে পড়ে গেছে তাঁর কবিতা নিয়ে সঠিক মূল্যায়নের দায়।
তথ্যসূত্র:
১। সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসু; তিনজন আধুনিক কবি, পূর্বাশা লি:, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ, বৈশাখ, ১৩৫১, পৃষ্ঠা ৬৪— ৬৫।
২। অমিয় দেব, (অধ্যায়) ছয়; সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, প্রকাশ, ১১ ডিসেম্বর, ২০০১, পৃষ্ঠা ৯৯—১০৫।
৩। প্রতিভা বসু, (অধ্যায়) ৪৮; জীবনের জলছবি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নবম মুদ্রণ, ফাল্গুন, ১৪১৮, পৃষ্ঠা ২৭৮।
৪। মীনাক্ষী দত্ত, (অধ্যায়) ১২; বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সারস্বত গোষ্ঠী, আজকাল, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি, ২০০৯, পৃষ্ঠা ৯২—৯৩।
৫। সেই কলঙ্কের নিন্দাপঙ্কে: নিরঞ্জন হালদার, বুদ্ধদেব বসু: নানা প্রসঙ্গ (সম্পাদনা: আনন্দ রায়), বর্ণালী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ-১৯৬০, পৃষ্ঠা-১৪৭।