বীরেন মুখার্জী’রও ৫০ বছর হয়ে যাচ্ছে জীবনের আয়ুষ্কাল—এই সময়ে—চমকে যাই! অনুভব করি—বয়স থেমে থাকে না! আশ্চর্য এক রেলগাড়ি—চলছে তো চলছেই, থামে না! রেলগাড়ি ছুটছে বীরেন মুখার্জীও ছুটছেন কিন্তু খালি হাতে না—আটের অধিক কাব্যগ্রন্থ, পাঁচের মতো প্রবন্ধের বই, গল্পগ্রন্থ একটি, সেইসঙ্গে গবেষণা গ্রন্থ আরও একটি। সম্পাদনা করছেন দীর্ঘদিন হলো ‘দৃষ্টি’ নামের একটি শিল্প-সাহিত্যের ছোট কাগজ। ইদানিং তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঘোর’ রচনা ও পরিচালনা করছেন। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশনার কাজেও যুক্ত রয়েছেন। এইসব মিলে বীরেন মুখার্জী’র পথচলা বেশ আলো ঝলমলে বলা চলে। নব্বইয়ে অন্যতম কবি তিনি। সুলুকসন্ধান করে মনে হচ্ছে—এই কবি আটঘাট বেঁধে শিল্প-সাহিত্যের পথে কম সময় ধরে চলছেন না, এখনো প্রবলভাবে সক্রিয় ও সচল। তার এই সৃজনশীলতার স্পর্ধা আরও বিস্ময় তৈরি করবে, তা বলা যায়। এমন নিবেদিত কবি ও সৃজনশীল মানুষের কারণে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের মূলভূমির উজ্জ্বলতা আমরা অনুভব করি।
বীরেন মুখার্জী’র সৃজনশীল কাজের প্রতি আমারও মনোযোগ আছে, পর্যবেক্ষণও আছে। সবকিছু নিয়ে আলোচনার বৈজয়ন্তী এখন বিস্তৃত না করে তার কবিতার উজ্জ্বলন আবিষ্কার করি কিছুটা হলেও। আমরা জানি- এই যুগ একক কবির যুগ নয়, সম্মিলিতভাবে অনেক কবি- কবিতায় নিবেদিত থেকে কবিতা লেখেন, তাদের একেকজনের কবিতা একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বোধের উন্মোচন ঘটায়, বিভিন্নভাবে অনুরণিত করে। বীরেন মুখার্জী’র ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা ‘আত্মজৈবনিক’। এই কবিতাটি তিন খণ্ডে রচিত, প্রথম ক’লাইন-
‘বর্ণক্রম ভেঙে এখানে এসেছি
ভাঙছি এখনও
ভেঙে ভেঙে অবনত দাঁড়িয়েছি
সময়ের কাছে’
কী সেই বর্ণক্রম, যা ভেঙে সময়ের কাছে দাঁড়াতে হয়? এই বর্ণক্রম এক ধরনের প্রতিকী ব্যঞ্জনায় পাঠককে নিয়ে যায় ধীশক্তির কাছে- চৈতন্যের কাছে এবং তার ভেতর দিয়ে এক ধরনের বোধ জেগে ওঠে। এই কবিতায় খণ্ড খণ্ড অনুভবের ইন্দ্রজাল তৈরি হতে থাকে। এক ধরনের বাস্তববিম্ব ধরা দেয় খুবই পরোক্ষভাবে।
বিপরীতমুখী ভাবনার সাজুয্যে কবি এই কবিতায় উচ্চারণ করেছেন, কবিতাটির প্রথম খণ্ডের শেষ স্তবক-
‘মৃত্যুপাতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তবুও
দৌড়ে যাচ্ছি ক্রমে
প্রসঙ্গের অন্তরালে
হতাশার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সংগোপনে …’
ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে দিয়ে এক ধরনের সংবেদ তৈরি করে পাঠককে আর এক রিয়েলিটির দিকে নিয়ে যায় এই কবি। মনে হয় অল্প অল্প আলোতে তার বিচ্ছুরণ। এইভাবে বীরেন মুখার্জী তার কবিতার জগৎ রচনা করেন।
আরও পড়ুন: বীরেন মুখার্জী: সময়ের সচেতন ভাষ্যকার ॥ চাণক্য বাড়ৈ
খণ্ড খণ্ড ব্যক্তিক অনুভূতির বিপরীতে ‘সাডেন ডেথ’ নামে প্যারিসের রক্তাক্ত ঘটনার স্মরণেও কবিতা লেখেন কবি, এই কবিতায় তিনি এই সময়ের একজন কবি হিসেবে তার সুচিন্তাকে কবিতায় প্রাণ দেন। কেন দেন, কবি মাত্রই জানেন, কবি শুধু নিছক অক্ষরজীবী নন, তিনি এই সভ্যতারই বাসিন্দা, যে সভ্যতা ছিন্ন-ভিন্ন করে যে অন্ধকারের বলদর্পী কীটেরা, তাদের প্রতিরোধ করা বিবেকতাড়িত কবির নৈতিক দায়, সে-কারণে এই কবিও উচ্চকিত হন, এইভাবে-
‘চোখের সামনে ফালি দীর্ঘশ্বাস; মেঘভাঙা দিন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে রাতের
উপহাসে। সহজাত অন্ধকার চারিদিকে; উড়ে যাচ্ছে সবকিছু। দূর
বিকেলের চোখ, অন্ধ করিডোর, ভাঙা ঘরবাড়ি, পানশালা আর শাদা
চোখে রাঙা হয়ে ওঠা গভীর সান্ত¡না! বিষাক্ত নখরে রক্তাক্ত হচ্ছে
জনপদ। মস্তিষ্কে ঢলে পড়ছে দেখো, সহস্র শোকবার্তা। সাডেন ডেথ!
কবিদের কবিতায় পাওয়া যায় পর্যবেক্ষণ আর দার্শনিকবোধ, যা কবিতায় সিলমোহর হয়ে মানুষকে প্রজ্ঞান দিয়ে জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে, সেকারণে পাঠক কবিতায় মনোনিবেশ করে, কবিতাকে কাছে টানে—কবিতা হয়ে ওঠে কৌতূহলোদ্দীপক। তেমন একটি কবিতা লিখেছেন- বীরেন মুখার্জী। কবিতাটির শিরোনাম- ‘জীবন যেন এক সমঝোতা স্মারক’। এই কবিতার শেষ স্তবক-
‘এভাবে প্রতিদিন নিজেকে খুন করি বহুবার
এরপর ডুবে যাই আগাম কোনো দৃশ্যের গভীরতায়
যাকে আমরা স্বপ্ন বলে গায়ে জড়িয়ে বাঁচি
অথচ, প্রত্যুষের আলো ছুটে চলা জীবন যেন এক সমঝোতা স্মারক
যার অনুবাদ মুখস্ত হয় না কোনওকালে… ’
অনেক দার্শনিকই বলেছেন আপোষ করে মানুষকে চলতে হয়, বাঁচতে হয়। একারণে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়, নিজের স্বাধীন অবস্থানও ভেঙে পড়ে অনেক সময়ে। প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধ করে ব্যক্তিজীবন রক্ষা করা সম্ভব হয় না। একারণে আপোষ বা সমঝোতা করে বাঁচতে হয়। এই সত্যকে এই কবিও তার কবিতায় ইশারায় দৃশ্যমান করেছেন।
আর একটি কবিতা, ‘আজ খুব গান হোক’। এই কবিতায় কবি বেশ আশাবাদী হয়ে এক দৃশ্য সংবেদী করে তুলেছেন। কবিরা তো আশাবাদী হয়ে জীবনের মহিমাকে উন্মুখ করে বেঁচে থাকার প্রণোদনাকে ইন্দ্রিয়গোচর করে তোলেন-
‘কস্তরী গন্ধমাখা রোদ্দুর ফলবতী হয়ে ওঠে আজ
চারিপাশে দূরন্ত-সাবলীল হাত, পাশাপাশি হাঁটে
আকাক্সক্ষার ডানা মেলে বনে-বনে উচ্ছল ছোটে
মধুকর; মৃত্তিকাও মুখর- তারও মোহনীয় সাজ।’
শেষে আর একটি কবিতার উদাহরণ দিই- যেখানে কবি আষাঢ়ে গল্প বাদ দিয়ে এমন এক ব্যাপ্তি ঘটাতে চান, তাতে রূপক-মাধুর্য্যে এক পার্থিব জগতের পূর্বাভাস জেগে ওঠে- কবিতার শিরোনাম ‘লিলিথ যদি জেগে ওঠো’-
‘লিলিথ, যদি জেগে ওঠো ফের
নিরঙ্কুশ প্রতিবাদে আবার দাঁড়াবো;
দৃষ্টিকটু ঘুম ছেঁকে-ছেনে-
কথা আর কবিতায়
হেঁটে হেঁটে মিশে যাবো দ্রোহে-
সমতা ও সময়রেখায়’
বীরেন মুখার্জী’র কবিত্ব ও তার কাব্য বৈচিত্র্য আমাদের বাংলা কবিতার অংশ হয়ে উঠেছে; এই কবির আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবুকতা, অভিব্যক্তি ও কালসচেতনা আমাদের কবিতার মূলভূমিকে উজ্জ্বল করেছে। তাঁর কাব্যশক্তির প্রতি আমাদের রয়েছে আস্থা ও পক্ষপাত। নব্বইয়ের অন্যতম কবি হিবেবে সেই আশা জাগানিয়া কাব্যজগতের অধিকারী তিনি। তার ৫০তম জন্মদিনে শুধু কবিতা নয়, তার অন্যান্য সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখছি। তিনি আরও সৃজনশীল স্পর্ধায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠুন; এই কামনা করি।