॥পর্ব-৫॥
‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ গ্রন্থের জন্য বিষ্ণু দে অনেক প্রশংসিত হয়েছেন, পুরস্কৃত হয়েছেন। এর কারণ কি প্রেমে ফিরে আসা? বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী কবিতার ধারায় পুনরারোহণ? যে সময় প্রিয় বন্ধু সুধীন্দ্রনাথ প্রেমে আস্থা হারাচ্ছেন তখন বিষ্ণু দে প্রেমে আস্থা পুনঃস্থাপন করছেন। অথচ দু’জনেই বুদ্ধিবাদী কবি। সুধীন্দ্রনাথ বয়সে আট বছরের বড় ছিলেন এটাই কি একমাত্র পার্থক্য?
বড় কবিরা সমকাল-মহাকাল একসঙ্গে ধারণ করেন। দৈনন্দিন জীবনের বাজারদর, পোষা কুকুর-বেড়ালের আনন্দ- বেদনার মতো সামান্য বিষয় থেকে শুরু করে জাতীয় সংকট, জাতীয় বা সীমান্ত যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ, বা সভ্যতার বড় বড় সংকট, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় বা আইনের বা আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস ও ব্যর্থতা সব কিছু বড় কবিদের কবিতায় স্থান পায়। বিষ্ণু দে’র কবিতায়ও সব কিছু উঠে এসেছে। দায়সারা গোছের কাব্যরূপে নয়; আন্তরিক উপলব্ধিতে। তবে বিষ্ণু দে’র চিন্তা গণমুখী হলেও কবিতার ভাষা গণমুখী নয়। তবে শেষ বয়সে তিনি সহজিয়া ভাষার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ গ্রন্থে সেই সহজিয়া সুর সুন্দরভাবে বেজে উঠেছে।
এ গ্রন্থের ‘অনুপ্রাস অন্তমিল’ কবিতায় বিশ্বপ্রকৃতিতেই কবিতার মিল-অনুপ্রাস খুঁজে পেয়েছেন। বয়সের অভিজ্ঞতা, অকৃত্রিম চোখ, স্বদেশ-স্বভূমিকে আপন করে দেখার মধ্য দিয়েই এই অনুভব। যেমন আমাদের সর্বমহান উপমা রবীন্দ্রঅনুভূতি। ‘উজ্জীবনের স্বপ্নসদ্য চোখে’তে নারী শরীরেই খুঁজে পান প্রেম এবং জীবন।
উদয়াস্তের সূর্যে তোমাতে বিবাদী চক্ষুকর্ণ;
অথচ তোমাকে প্রত্যক্ষেই দেখা যায়,
প্রত্যহ তুমি মূর্ত প্রকৃতি মুখরিত সত্তায়,
এর মধ্যে বিষ্ণু দে’র বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। যৌবনে লেগেছে ভাটা। প্রেমের সন্ধান করছেন নারী শরীরে। কিন্তু শরীর মানেই যৌনতা নয়, কামের তাড়না নয়। শরীর হল অস্তিত্বের প্রমাণ। শরীরী সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও নিজের শরীর দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন।
তুমি যে সত্য সে কথা বুঝেছি রক্তে সপ্তবর্ণ
ইন্দ্রিয় মননে অস্থিমজ্জায়,
অথচ তোমার হাতে দশমিক পলাশে সদা হিরণ্য
আমার হৃদয়, জরাযৌবনে, নবান্নে কিবা চৈতে
কিংবা আষাঢ়ে ঝুলন আশার পুলকে
কামনা যখন বৈদেহী ওড়ে দ্যুলোকে।
জানি তুমি স্বীয় স্বভাবে দোদুলপ্রিয়া,
মেদিনীরই তুমি অগোচর আইডিয়া।
এখানে দেখছি রবীন্দ্রবিশ্বের এবং বিশ্বাসের জয়কার। দেহ ছেড়ে ঊর্ধ্বে উঠেছেন বিষ্ণু দে। বস্তুজগতের সীমায়িত আয়তন ছাপিয়ে উঠছে তার মহত্তর অনুভব। এর মধ্যে রবীন্দ্রপ্রভাবও দেখতে পাই ‘সুচিত্রা মিত্রের গান শুনে’ কবিতাটিতে। মানুুষ ও প্রকৃতির মধ্যে কবি পাচ্ছেন ঘনসংযোগ। মানুষের সংকল্পে, প্রেমে ও শ্রমে আছে বিশ্বাস আর আশ্বাসের অলিখিত বাণী। রবীন্দ্রসঙ্গীত মনে রঙ ধরে, সুগন্ধ ঘনায়। এখানে এসে লোকায়ত জীবন থেকে লোকোত্তরে, অলৌকিকে আস্থা দেখতে পাই। এ বিষ্ণু দে বাঙালির মূল পথেরই পথিক। অচেনা পোশাকের অজানা পথিক নন।
অলৌকিক বাগানে অন্দরে অন্ধকারে পাথরে কাদায় ভিজে
অন্তরে অন্তরে গানে গানে মাটিতে কাঁকরে জীবনের ভিতে।
কবি নিজের পাশ্চাত্যপ্রভাবিত আধুনিক সত্তা আর লোকায়ত জীবনের বাঙালিসত্তাকে মুখোমুখি এনেছেন ‘এ আর ও’ কবিতায়। তখনো কবির মনে দোদুল্যমানতা রয়ে গেছে। একজন তাত্ত্বিক বক্তৃতা দেন, অন্যজন লাঙলে, চাকায় নীলাকাশের মুক্তি খোঁজেন। ‘অন্ধ বাঁকে’ কবিতাটি মানসিক সংকটের। আত্মহত্যার কথা দেখলাম এই প্রথম। স্নায়বিক ঘোরে, অন্ধের ঝোঁকে চলার পরে এ ধরনের চরম উৎকণ্ঠায় পৌঁছে যায় মানুষ। গ্রামীণ জীবনের সুখ আর শেক্সপিয়ারের কোনো শ্লোকই সন্ধ্যারূপ অন্ধকার থেকে শহরের ঝলমলে আলোতে পৌঁছে দেয়। যত কবি-লেখক আত্মহত্যা করেছেন, যারা করেন তাদের মানসিক অনুভূতির কাছে পৌঁছে গেছেন কবি, এ কবিতায়। ‘সুস্থ থাকে মন’ কবিতায় জানান, বৃক্ষ প্রতিবেশে বনেই সুস্থ থাকে মন।
আবার আত্মদ্বন্দ্ব, তীব্র আত্মদ্বন্দ্ব দেখতে পাই ‘অয়রিডিকে’ কবিতায়। ‘লুসিয়া, প্রকৃতি, আমরা’-তে দেখি আদিবাসী নারীর মুক্তির কথা।
প্রকৃতির মেয়ে তার অপ্রকৃত ঘোর
কবে যে কাটাবে ভাবি।
তাই চলি, অবশ্যম্ভাবী দিন পৃথিবীতে
নামাই সবাই, নীলাকাশ নিত্য করে সেই দাবি।
অমর পাহাড় নদী পিপুল পলাশ চাষি
আমরা প্রাকৃত পুণ্য চাই, চাই সত্য রূপ তার
প্রকৃতির সে মেয়ের, যাকে নব্যসভ্যতার স্বপ্নে ভালোবাসি।
‘সুস্থ থাকে মন’ কবিতারই যেন বর্ধিতাংশ ‘খয়ের বন’ কবিতাটি। জীবনের অন্তিম ভয়-ভীতি দূর করে বন।
কিসের ভয়? এ নয় সখী অপ্রাকৃত শহর;
কুটিল নেই, ইতর নেই, গৃধœু নেই বনে।
এ শুধু বন, পাহাড়, বালি ঝরনাধোয়া নদী,
কিসের ভয়? শোনো পাখির গান আটপ্রহর,
বরা-র ডাক দুপুর ভর শুনতে চাও যদি
জেনো সে ছুটে বেরিয়ে যাবে, রেখো না ভয় মনে।
‘সার্কাসের বাঘ’ কবিতায় নাগরিক জীবন, পুঁজিপতি ও সুবিধাবাদীদের সার্কাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন সার্কাসের একটি বাঘের গল্পের ভেতর দিয়ে। তার প্রশিক্ষিত চতুরতা, কোটিপতি লোভ ও তৃপ্তিহীন চিরদুস্থ প্রতিযোগিতা আর বিশ্বের শিকারের লোভের কাছে পরাস্ত জন্মবুনো বাঘেরাও।এখানে বিষ্ণু দে’কে আধুনিকতাবাদী কবিদের বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসুর নাগরিক চেতনার বিপরীতে দেখতে পাই।
বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ আর বিষ্ণু দে’র ‘সাহিত্য পত্র’ এক সময় ছিল প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। বুদ্ধদেবের ভক্তদের বলা হতো ‘বৌদ্ধ’ আর বিষ্ণু দে’র ভক্তদের ‘বৈষ্ণব’। বুদ্ধদেব বসুর আধুনিকতাবাদী চেতনা ছিল প্রবলভাবে নাগরিকচেতনানির্ভর। যে কারণে তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রামজীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোকে আধুনিক সাহিত্য বলে মানতে পারেননি। বুদ্ধদেবের নিজের উপন্যাসগুলো আধুনকতাবাদী, তাই নাগরিক রুচির। কিন্তু তার উপন্যাসের চরিত্রেরা প্রায়ই নিষ্কর্মা আর ড্রইংরুমের বাচাল চরিত্র। কথা বলা ছাড়া তাদের আর কাজ নাই। তারাশঙ্করের সাহিত্যের বুদ্ধদেবীয় সমালোচনার তীব্র সমালোচনা করেন বিষ্ণু দে ‘রাজায় রাজায়’ নামক প্রবন্ধে। এই সংঘাতের অবশ্য অবসান হয়ে যায়।
অবসান হয় সুধীন্দ্রনাথের সাথে অবনত সম্পর্কেরও। বিষ্ণু দে’কে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চিঠি লিখেছেন প্রায়ই। বিষ্ণু দে’র অনুবাদ কবিতার বই ‘হে বিদেশী ফুল’, ‘মাও ৎসে তুং: আঠারোটি কবিতা’, নতুন কবিতার বই ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’, ‘আলেখ্য’, প্রবন্ধগ্রন্থ ‘এলোমেলো জীবন ও শিল্পসাহিত্য’ এবং ‘দি পেইন্টিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ পেয়ে চিঠি লিখেছেন, প্রশংসা করেছেন, ঈর্ষা হয় বলে জানিয়েছেনও। বিষ্ণু দে’র সৃজনীশক্তিতে নিজে ধন্য বলেও স্বীকার করেছেন। মারা যাওয়ার মাস খানেক (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মারা যান ২৫জুন, ১৯৬০) আগে ১৯৬০ সালের মে মাসে এক সাহিত্যসভায় সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী এবং বিষ্ণু দে। সুধীন মাঝে মাঝে দ্বিতীয় স্ত্রী রাজেশ্বরী দত্তকে নিয়ে প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোডে বিষ্ণু দে’র বাড়িতেও যেতেন। জুন মাসের ১৬ তারিখে বিষ্ণু দে’কে শেষ চিঠি লেখেন সুধীন্দ্রনাথ। লেখেন, ‘যদি কোনও দিন উত্তাপ কমে, তবে আসবেন আমাদের এখানে। অনেক কাল দেখা হয়নি।’
বিষ্ণু দে নিজেকে কোনো সংগঠন বা কোনো আদর্শের কাঠামোতে বন্দি রাখেননি। প্রচ- অভিমানে তিনি বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে স্থায়ীভাবে সরেও থাকেননি।
‘নৈঃশব্দ মধুর এত’ কবিতায় আবার রবীন্দ্রভাবনায় লীন দেখতে পাই বিষ্ণু দে’কে। ‘রবীন্দ্রআলোকে আমাদের জন্ম’ স্বীকার করেন। ‘তাই শিল্পে পাই জীবনদর্শন। ‘এই ভালো’ কবিতায় দেখি কলকাতার প্রতি তীব্র ঘৃণার প্রকাশ। কলকাতা মহানগরীরর নাম উল্লেখ করেই ঘৃণা উগরে দিয়েছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর বিশ দিন পরে লেখেন ‘বন্ধুস্মৃতি: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ কবিতাটি। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে রাজেশ্বরী দত্তকে উৎসর্গ করেন ‘পরকে আপন করে’ কবিতাটি। কবিতায় বিষ্ণু দে পাঞ্জাবি মেয়ে রাজেশ্বরীর কণ্ঠে বাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়কীর প্রশংসা করেন।
‘গ্রীষ্ম নিসর্গ’ কবিতায় লেখেন,
স্নিগ্ধ ঘাসে মাথা রাখি
আকাশে বিছাই কান
এখানে রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’রই প্রতিধ্বনি মনে হলেও বয়স্ক বিষ্ণু দে’র দেশের প্রতি নিজস্ব অনুরাগই প্রকাশিত হয়েছে। ‘বরং জেনো’ কবিতায় লেখেন ‘হৃদয় দিয়ে হৃদয় নিয়ে বাড়াতে চাই পুঁজি’। পুঁজির প্রয়োজনীয়তা, হৃদয়ের সম্পন্নের কথা বলেছেন সমাজতন্ত্রী বলে পরিচিত কবি। ‘চেনা পাথর’ কবিতায় ‘শহরের পলাতকহৃদয় বিলাস—যাতে ক’টা দিন সভ্যতার ভুলভ্রান্তি’ বিষ্ণু দে’কে রিখিয়ার বাড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড় বড় পাথরের কথা পাই। অরুণ সেনের ‘বিষ্ণু দে-র কথা’ গ্রন্থে বিষ্ণু দে’র সেই বাড়ির কাছের বড় পাথরগুলোর ছবি দেখা যায়। এই পাথরগুলের জন্য বিষ্ণু দে’ তাঁর বাড়িকে বলতেন সেজানের বাড়ি। বিষ্ণু দে বিশ্বখ্যাত চিত্রকর পল সেজানের চিত্রকলার অনুরাগী ছিলেন। এ কবিতায় সেই পাথরগুলোর কথাই আছে।
‘৩০ শে জানুয়ারি’ কবিতায় বার্ধক্যের অসুস্থতা, নিদ্রাহীনতা, দুশ্চিন্তা, ক্লান্তির রাত জেগে আশা নিয়ে বসে থাকার কথা আছে। ‘মানবলোকে ভবিষ্যতে চেপে’ কবিতাটি আগের কবিতাটি রচনার মাত্র চার দিন পরে লেখা। এর মাঝের চার দিন কবির মনে ও মগজে মৃত্যুর চিন্তাচ্ছন্নতা থাকার কথা ছিল বলেই ধারণা হয়। বাঁচার আকাক্সক্ষা, পৌত্র-প্রপৌত্রদের মাঝে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এই কবিতায়। এর চার দিন পরেই কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু নিয়ে লেখেন, ‘এ মৃত্যু সংবাদে’ কবিতাটি। লিখেছেন, ‘এ মৃত্যুসংবাদে মরে গেল মনের বকুল’।
অনেক বছর পরে কবি নিজের চোখের অশ্রুর কথা পেলাম ‘লণ্ঠন জ্বেলে’ কবিতায়। কবির অবর্তমানে কি প্রিয়তমা অমাবশ্যার রাতে লণ্ঠন জ্বেলে পড়বে কবির কথা? ‘যেমন জেনেছে চণ্ডীদাস বা দান্তে’ কবিতায় প্রেমিকহৃদয়ের মিল মেলাতে বাংলার মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাস আর মধ্যযুগের ইতালিয়ান কবি দান্তেকে একত্রে মিলিয়েছেন। ‘সনেট’ নামক কবিতায় ঐশীভাবনার সাক্ষাৎ মেলে। সংশয়ের ভেতর দিয়েও সন্ধান করে যাচ্ছেন।
যখনই আকাশে বহু সুর তোলে সন্ধ্যার পশ্চিম
তখনই তোমার মুখ সত্তা পায় স্পষ্ট অবয়বে,
‘এসো নেপথ্যের নিরাপত্তা ছেড়ে প্রত্যক্ষ নাটকে’ পঙক্তিতে যদি ঝড় ওঠে উঠুক, কবি ভাবেন হৃদয়ের বন্ধ্যাত্ব ঘুচে যাবে, বন্যায় ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠবে। কবি সংশয় ঘোচাতে চান। ইতিবাদে পৌঁছে গেলে যদি এতকালের চেনা পাঠক ভুল বোঝে? বলেন, ‘কিবা আসে যায় কিছু ভাবে যদি তোমার পাঠকে’ ॥
রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে তিনটি এবং ‘শতবার্ষিকী’ নামের একটি কবিতায় রবীন্দ্রভাবনার ভেতর দিয়ে সাহস সঞ্চয় করে নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়।
‘সেই অন্ধকার চাই’-গ্রন্থটি বিষ্ণু দে’র কবিজীবনের আরেকটি বাঁক। যিনি বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, যুক্তি ও বুদ্ধির প্রজ্ঞার আলোকে প্রগতির প্রতীকরূপে দেখেছেন তিনি যেন বদলে গেলেন! বিজ্ঞান-সভ্যতা এবং সমাজপ্রগতির আলোকসন্ধানী কবি হঠাৎ কেন ঘোষণা দিলে অন্ধকার চান? এটা কোন অন্ধকার? কেন অন্ধকার? এ বইয়ের অনেক কবিতা আগের বইয়ের সমকালে রচিত। ভিন্ন চিন্তা¯্রােতের কারণেই কি পৃথক গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন?
অন্য অন্ধকার আছে? তা-ও চেনা, থেকেছি নিবিড়
ঘন নীল অন্ধকারে, স্পন্দমান ছন্দে অতল স্মৃতির হর্ষে ভয়ে
কাব্যের আদিম গর্ভে যেখানে করেছে মহাভিড়
লক্ষ লক্ষ জীবন-মৃত্যুর ক্ষিপ্র দিব্য অন্ধকারে।
এখানে দিব্য অন্ধকারের কথাই কবি বলেছেন। এর আগে অবশ্য সমাজের প্রচলিত অন্ধকারের উৎপাতের কথা বলে নিয়েছেন। সেই অন্ধকার থেকে বাঁচার জন্যেই এই অন্ধকারের অনুসন্ধান। এ অন্ধকার যেন মগজের কোষ থেকে আসা, যেখানে কবিতার আদিরূপের গর্ভসঞ্চার হয়। যেখানে গেলে তীব্রতা থেকে মুক্তির প্রয়াসে নতুন পথের ইশারা পাওয়া যায়। ‘তাকাবে জাগাবে’ কবিতায় দেখি ধ্যানের মৌনতার জন্য হিমালয়ে তিব্বতের হিম কপিল গুহার কথা বলেছেন। বলেছেন অতল দিঘির জলে ডুব দেওয়ার কথাও। এখন বোঝা যায় সেই অন্ধকার যে অন্ধকার আমাদের কাক্সিক্ষত। চোখে যা দেখি চোখ বুজে দেখি আরো বেশি। অনুভবের গভীরে চোখ খুলে রেখে যাওয়া যায় না। এক ধরনের অন্ধকার লাগে। তিব্বতি হিম মানে কী? বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মৌনতা? ‘সে কখনও’ কবিতায় আরো স্পষ্ট করে দেখতে পাই প্রাচীন বাঙালির ধর্মবিশ্বাসগুলো নতুন করে বিবেচনা করছেন। ‘এ কেবল ভাষার যন্ত্রণা’য় বুদ্ধির উপযোগী নয় ভাষা, তাই লেখেন,
আমার জাগর স্বপ্নে দ্বৈতছন্দে অদ্বৈত নৃত্যনে
—সে কি সৃষ্টিময় বৃদ্ধ স্বভাবের দুরন্ত কল্পনা?
এ কবিতায় অনেক প্রশ্ন উৎকলিত হয়েছে থরে বিথরে।
প্রশ্ন কেন, কোথা শেষ? অন্তিমের নেই কোনো শেষ।
আদিরই বা উৎস কোথা?, কেন খোঁজা অন্তেই নির্দেশ?
আমি আছি বর্তমানে, দীর্ঘায়িত ঐশ্বর্যে বিধুর
অপর্যাপ্ত স্মৃতিভারে তোমার জীবন্ত ব্যক্তিত্বের
স্তরে স্তরে গড়ে তুলি ভাস্কর্যের চিত্রল প্রেরণা
জরিষ্ণুর তীব্র হাতে শক্তি ঢালি সংহত চিত্তের।
তুমি কি অবাক, ভাবো, এ কেমন ভাষার যন্ত্রণা?
এখানে আছে মানবজীবনের সভ্যতাবিচ্ছিন্ন কিছু মৌলিক প্রশ্ন? যে প্রশ্ন তারুণ্যের স্বাভাবিক জাগরণ। কিন্তু নান্দনিকতার মোড়কে কিংবা আবিষ্কারের ঔৎকর্ষের ভেতরই তারুণ্য সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়। কিন্তু বয়স বাড়ার পরে মনে হয় আগের উত্তর সন্তোষজনক নয়। নতুন করে অনুসন্ধান চলতে থাকে। এ কারণে শেষ বয়সের কবিতায়, শিল্পে নান্দনিকতার চেয়ে চিন্তার ওজন থাকে বেশি। রবীন্দ্রনাথ দিবসের শেষ সূর্যের প্রশ্নেও উত্তর পান নাই। এর পরেই তিনি চোখ বুজেছেন। জীবনে উত্তর মেলে না। বিষ্ণু দে-ও পঞ্চাশ পেরিয়ে সেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন।
‘প্রশ্নপত্র’-তে দু’জনে নতুন কলকাতা প্রেম দিয়ে রচনা করার কথা বরেছেন। ‘কোনো পেত্রফ যেন পেত্রফার জন্য’ কবিতায় অশুভকে মূর্খ অন্ধকার বলেছেন। তাহলে কি শিক্ষিত অন্ধকারও আছে? গভীর ধ্যানে বা অনুধ্যানে চোখ বুজলে যে অন্ধকার দেখি তাই সে অন্ধকার। বিষ্ণু দে’কে অমিয় চক্রবর্তীর ধ্যানের রাজ্যে দেখতে পাচ্ছি কি? আসলে ধ্যান প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্নভাবে থাকে। এখানে অমিয় চক্রবর্তীর ধ্যান নয়, বিষ্ণু দে’র নিজস্ব অন্ধকারেই ডুব দিতে দেখি। তিনি বন্ধ চোখ থেকেই আলো তুলে আনেন।
চোখ বোজো দেখ মুঠি মুঠি আলো পেড়ে
তোমার হৃদয় ভরে আমিই দিলাম।
এ কবিতার শুরুতেই বলেছেন বয়স বাড়লেও হার মানা নয়। ‘প্রশ্ন’-তে সমস্ত নিসর্গে দেখি তারই প্রতিধ্বনি। ঐশী অনুসন্ধানও। ‘পৃথিবী অচল নিত্য’ কিন্তু ‘নিসর্গের আয়ু অন্তহীন’।
ঘন ঘন কবিতা এলে এলোমেলো চিন্তা শব্দের রাজ্যে ধরা পড়ে যায়। বিষ্ণু দে’কে এখন এক দিনে দু’টি এমনকি তিনটিও লিখেছেন। তাঁর কিছু কবিতায় তা চোখে পড়ে। তবে ‘শবরী’তে দেখি প্রগতির এক নতুন সংজ্ঞা। ‘এদের যে মনে হওয়া’ কবিতায় একজোড়া তরুণ তরুণীর মনে বিশ্বময় সমৃদ্ধ শূন্যতা বোধ হওয়ার কথা এসেছে। বহু বছর পরে প্রতীচ্যপুরাণে দেখা গেল কবিকে ‘বেয়াত্রিচে’ কবিতায়। ইতিহাসচেতনা প্রশ্ন আর যুক্তি হয়ে বুদ্ধির বিবেকে ধরা দেয় ‘অতীত যদি ভুল’ কবিতায়। প্রথমেই প্রশ্ন রেখেছেন,
সমস্ত অতীত যদি ভুল বল, তাহলে কী থাকে?
বর্তমান চড়া-পড়া, প্রতিবিপ্লবের মতো ভবিষ্যৎহীন।
যে কোনো বিপ্লবের ভেতরই প্রতিবিপ্লবের বীজ লুকানো থাকে। এটা সরল যুক্তির কথা। কিন্তু বিষ্ণু দে যিনি রুশ বিপ্লব নিয়ে এত আশাবাদী ছিলেন এমনকি প্রত্যাশায় ছিল, সেই তিনি এখন বলছেন প্রতিবিপ্লবের মতো ভবিষ্যৎহীন। তিনি কি ততদিনে বুঝতে পেরেছেন যে রুশ বিপ্লবের দেশেও প্রতিবিপ্লব হবে? যা বাস্তবে ১৯৮৯ সালে মিখাইল গর্ভাচেভের শাসনকালে ঘটেছে বিষ্ণু দে’র মৃত্যুর সাত বছর পরে। ‘ভাবী যন্ত্রণা’তে দেখি নেতিবাদী সমকাল। কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন,
আমি ভাবি, অনেকেই ভাবি যন্ত্রণায়
মিথ্যাই কি সত্য আর সভ্য চিরকাল?
‘ওরে বাছা’তে প্রেমের নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করেছেন। ‘সনেট’ নামক কবিতায় আত্মপক্ষে দাবি করেছেন কবি ‘আমি সময়ের দাস।’ এ কথা কি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কবির পক্ষে লেখা সম্ভব? তিনি তো সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার, সময় ভেঙে নতুন সময় সৃষ্টি করার কথা বলেছেন। এখন দেখি বিপরীতে। এ তো প্রেমের কাছে সমর্পিত কবির উচ্চারণ।
প্রেমের শক্তি কতদূর? তরুণ প্রেমিককে ছাড়িয়ে যান পঞ্চাশোর্ধ্ব কবি ‘সত্য উদ্ভাসিত হোক’ কবিতায়।
যে প্রেমে প্রত্যেক দিন সূর্য ফেরে, ফেরে সন্ধ্যাতারা
আশাবাদী কবিতার মাঝে মাঝে আশাহীনতাও উঁকি দেয়। এটাই সময়ের বাস্তবতা। অনুভবের এ দিকগুলো কাব্যরূপ না পেলে বিষ্ণু দে’র এই বয়সের কবিতা কৃত্রিম মনে হতো। ‘যত দিন যায়’ কবিতায় যন্ত্রণার কথাই প্রকটভাবে এসেছে। দেখতে পাচ্ছি আশা-নিরাশা যেন পালা করে আসে এই বয়সে।
প্রেম কখন শিল্প হয়ে ওঠে? ব্যক্তিকতার সীমানা ছাড়িয়ে নৈর্ব্যক্তিকতায় উত্তীর্ণ হলে? ‘সে কেন’ কবিতায় এই চিন্তাই বাণীরূপ পায়। ‘মেটে কি এই সাধ’ কবিতায় দেখি,
বহুদিন দেখেছে সে, দেখে শুনে মেটে কি এ-সাধ?
বহুদিন দেখে দেখে হয়ে গেল মরমী সাধক।
ধ্যানের ভেতর ডুব দিতে দেখেছি, এবার মরমী সাধক হয়ে যাওয়ার কথাও পেলাম। এই তো সেই হাজার বছরের বাংলা কবিতার মূল ধারার কথাই। এখন বড়ই অচেনা মনে হয় সেই আর্টেমিস, কাসান্ড্রার মতো প্রতীচ্যপুরাণ কিংবা এলুয়ার, আরাগঁ, এলিয়টপ্রভাবিত বিষ্ণু দে’র প্রথম দিকের সেই কবিতাগুলো। কত হাজার মাইল দূর থেকে তিনি ফিরে এসে হাজার বছরের গভীরে প্রবেশ করেছেন।
কয়েক বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি কলকাতা এলে নেতিতে ভরে যায় বিষ্ণু দে’র মন। ‘তখনই সে- প্রেম সাজে’ কবিতায়ও তাই দেখতে পাই। অনেক বছর পরে আবার একটি দীর্ঘ কবিতা লিখলেন ‘শীলভদ্র পঞ্চমুখ’। এটি একটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাময় কবিতা। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বাংলার নগর-বন্দর সভ্যতা গড়ে ওঠে আবার একদিন ভেঙে যায়। সভ্যতা ভেঙে গেলে এই দেশে কিছুই চিহ্ন থাকে না। কোথাও সামান্য লতাগুল্ম অথবা বট-অশত্থের শেকড়ে জড়িয়ে থাকে প্রত্নস্মৃতি। নদীর বহুমাত্রিক উপযোগ এবং বৃক্ষের ব্যক্তি থেকে সভ্যতার স্মৃতিবাহী অস্তিত্ব নিয়ে এই কবিতা।
একজন লেখকের মনে যে ভাব ও ভাবনা জাগে, অভিজ্ঞতার যে সারবত্তা ভাষার কাঠামো ধারণ করতে চায়, তা আসলে লেখকের গ্রহণপদ্ধতি বা ইনপুট সিস্টেমের মতোই বহুমাত্রিক। আমরা নানা রকমের গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক-ছড়া-জীবনী-আত্মজীবনী-স্মৃতি-ভ্রমণকাহিনিসহ সংবাদ, প্রতিবেদন ইত্যাদি পড়ি। কান দিয়ে গান ও ঘটনার বিচিত্র সুর গ্রহণ করি। চোখ বন্ধ করে অনুভব করি। নাকে বিভিন্ন রকমের ঘ্রাণ লাভ করি। ইন্দ্রিয় এবং অতিন্দ্রীয় চেতনার গ্রহণপদ্ধতিতে বহুমাত্রিকতা আছে। আমাদের প্রকাশপদ্ধতি বা আউটপুট সিস্টেমেও বহুমাত্রিকতা থাকা স্বাভাবিক। আমার ইচ্ছা হতেই পারে মনের মতো ছবি আঁকার, অভিনয় করার, চলচ্চিত্র নির্মাণ করার, গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখার, কিংবা গান গাওয়ার।
কিন্তু চাইলেই তো সব ধরনের প্রকাশপদ্ধতিতে যে কেউ দক্ষতা দেখাতে পারেন না। নিরন্তর চর্চা লাগে। তাই দেখতে পাই অন্তর্গত প্রেরণা আর চেতনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকেন এবং পাবলো পিকাসো কবিতা লেখেন। দক্ষতা না থাকলে সাফল্য আসে না।
কিন্তু একটিমাত্র প্রকাশপদ্ধতি নিয়ে থাকলে সেখানে অন্তর্গত বহুমাত্রিকতার প্রভাব পড়ে। জীবনানন্দ, নজরুল, বুদ্ধদেব ঘটনাসংস্থান ও ভাবনাগুলো কথাসাহিত্যের রূপ দিয়েছেন। সুধীন্দ্রনাথও গল্প লিখেছেন; তাঁর অসম্পূর্ণ উপন্যাসও আছে। বিষ্ণু দে’র কবিতা নিয়ে কথা বলতে গিয়েই এত কথা এসে গেল। তাঁর প্রকাশপদ্ধতি কবিতা আর প্রবন্ধ। অন্য অনেক কিছু তাঁর কবিতায় লুকিয়ে আছে। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার ভেতরেও প্রচুর গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ এসে ঢুকে পড়েছে। সেখানে প্রবেশ করেছে অনেক পূর্ণাঙ্গ জলরঙে ও তেলরঙে আঁকা চিত্রকলার পূর্ণ ক্যানভাস। অনেক আলোকচিত্র। নাটক এমনকি অনেক সুরেলা সঙ্গীতও এখানে প্রত্নসম্পদ হয়ে লুকিয়ে আছে। এক ধরনের প্রকাশপদ্ধতিতে যাঁরা শুধুই কবিতা লেখেন তাদরে কবিতায় বিশুদ্ধ কবিতার ভিড়ে অন্য জিনিসও থাকে। বিষ্ণু দে’র পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবনের কবিতায়ও তাই দেখি।
‘উত্তর’ কবিতায় রবীন্দ্রজিজ্ঞাসা ‘কে তুমি’র পুনর্ব্যক্ত হওয়া এবং উত্তর না পাওয়ার কারণ সন্ধান করা হয়েছে। লোকসাহিত্যের গাজিকালু আর দক্ষিণ রায় মূলত প্রশ্নের কারণ হয়ে আছেন এখানে, যদিও তাঁদের মৃত বলেই জানেন কবি।
এ গ্রন্থের শেষের দিকে বিষ্ণু দে’কে হতাশাবাদী মনে হয়। ‘মহা নির্বাচন’ কবিতায় দেখি আর্থিক সংকটের কথা উঠে এসেছে। বিষ্ণু দে’র কবিতা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত না, আবার নৈর্ব্যক্তিকও না। ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকতায় অবাধ চলাচল রয়েছে। মনোযোগ না দিলে বোঝাও যায় না অনেক সময়। একান্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা আর্থিক সংকটের কথা আগে কবিতায় আনেন নাই। আর্থিক বিষয়টা এই প্রথম এসেছে। তবে সেখানেও আছে ব্যক্তিগত ভাষার আড়ালে নৈর্ব্যক্তিকতা। কবির নিজের সংকট বলে মনে হতে পারে। যে কোনো কবির আর্থিক সংকট বলেও মনে হতে পারে। শিল্পশ্রমে আর্থিক লাভালাভের বিষয়টাই উঠে এসেছে। ‘ইয়েটসকে, এলিয়টকে’ কবিতায় মৃত্যুভীতিকে পাশ কাটিয়ে আয়ুর সীমানাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সীমিত আয়ু নিয়ে বেশি কিছু করা যায় না বলে হাতাশা ব্যক্ত করেছেন। যদিও কবিতার শুরুতেই বলেছেন, ‘এদেশ বৃদ্ধের দেশ নয়’। এর পরেই ব্যক্ত হয়েছে বার্ধক্যের নেতিবাচকতা। মৃত্যুমুখী যাত্রাপথের নৈরাশ্যই প্রবলভাবে ঘিরে আছে।
আমি নই মহাজন, জীবন্ত বা মরণের পথে,
বাংলার বৃদ্ধ মাত্র, সর্বদাই অশীতির পথে,
অশান্ত অতীত আর ভবিষ্যৎ আদি-অন্তহীন ॥
‘শোনে না সে’ কবিতায়ও নিজের প্রতিভা ও মনীষার মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। হতাশাও ব্যক্ত করেছেন।
মনীষা কি এ-কালে এদেশে তিলে তিলে শ্বাসরুদ্ধ মনের মরণ?
এ ধরনের কবিতা বুদ্ধদেব বসুরও আছে। তিনি ১৯৩৭ সালে উনত্রিশ বছর বয়সে রচনা করেন ‘নিজের কবিতার প্রতি’ কবিতাটি। সেখানে বুদ্ধদেব পাঠককে দায়ী না করে নিজের নিয়তিকে অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু বিষ্ণু দে’ পরিণত বয়সে রাগ দেখিয়েছেন পাঠকের প্রতি। ‘স্বদেশী কবিতা’টিতে আছে হৃদয়ের সেই তীব্র সংক্ষোভ। আত্মমর্যাদার টানে আত্মমূল্যায়নে জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে মনে হয় পেয়েছেন উপেক্ষা-অবহেলা। লিখেছেন,
গলাবাজি অনেক করেছি, যাতে শোনে বোকা ও বজ্জাত।
জনতাকে, পাঠককেই বোকা ও বজ্জাত বললেন তিনি? নিজের দীর্ঘকালের শ্রমনির্ভর সাহিত্যকর্মকে পাঠক যথাযথ মূল্যায়ন করেনি বলেই কি এই রাগ পাঠকের প্রতি? ধৈর্যের সীমা ভেঙে তিনি গালিই দিয়ে বসলেন? এখন তিনি যোগ্য শ্রোতা অনুসন্ধান করছেন। তাদের কাছে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবেন বলে আশা করেন। কিন্তু তারা কবির কথা শুনতে চায় না। তাই কবি নিজেকে মনে করেন, ‘দিব্যোন্মাদ আমার হৃদয়’ ।
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-৪॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-৩॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-২॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-১॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ