বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতার অঙ্গনে বিমল গুহর আগমন। ওই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কাব্য আন্দোলনে তাঁর ছিল নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। ১৯৮২ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আর একুশ শতকের শুরুতে উন্মোচন করেছেন ‘নির্বাচিত কবিতা’র মোড়ক। মাঝে প্রকাশিত হয়েছে ‘সাঁকো পার হলে খোলাপথ’, ‘স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘প্রতিবাদী শব্দের মিছিল’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়া ‘মেঘ গুড়গুড় বিষ্টি নামে’, ‘আগুনের ডিম’ ও ‘চড়াই ছানা’ নামে তাঁর কিশোর কাব্যগ্রন্থগুলোও উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিনের এই কাব্যযাত্রায় তাঁর লেখায় পরখ করার মতো নিজস্ব মেজাজ ও ভাষাভঙ্গি তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে।
শব্দ নিয়েই কবিতার শিল্প গড়ে ওঠে। প্রতিদিনের প্রচলিত শব্দকে নতুন ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্যমণ্ডিত করেন কবিরা। কবিতার শব্দ অনির্বচনীয় পরিপ্রেক্ষিত রচনা করে পাঠকের মনে, পাঠককে নিয়ে যায় কবির মানস এলাকায়। তখন একজন প্রকৃত কাব্যপ্রেমীর সঙ্গে কবিচিন্তনের বড় বেশি ফারাক থাকে না। একটি ভালো কবিতা একজন পাঠকের মনোলোকে পৌঁছে দেয় জ্যোতির্ময় আলোকণা, জাগিয়ে তোলে তার সুপ্ত বোধকে। এখানে প্রকৃত কবি একজন শব্দস্রষ্টা। তিনি প্রতিদিনের শব্দকে সৃষ্টি করেন নতুন ব্যঞ্জনায় নতুন শব্দে। শব্দ তার অভিধানিক অর্থকে ছাপিয়ে রূপ পায় দীপ্তিময় নতুন শব্দে। এখানে কবির সফলতা। কবি বিমল গুহ তাঁর প্রথম গ্রন্থে শব্দকে নিয়ে খেলেছেন। তাঁর একটি কবিতার নাম ‘শব্দ শব্দ খেলা’। কবি বলেন:
শব্দ বড়ো প্রতিশব্দময়
ধরতে গেলে ধরা দেয় শব্দের জারজ
মুখে চুনকালি মেখে সঙ সেজে থাকে
…
এ বড়ো বিষম খেলা
খেলতে খেলতে বছর বছর কেটে যায়’
(শব্দ শব্দ খেলা : অহংকার তোমার শব্দ)
কবি বলেছেন, ‘এ বড়ো বিষম খেলা’, অর্থাৎ প্রকৃত শব্দ শিকারের কাজ সহজ নয়। এও একধরনের সাধনা। কবি বলেছেন—‘মুখে চুনকালি মেখে শব্দের বদলে শব্দের জারজ এসে ধরা দিতে চায়’। প্রকৃত কবি প্রকৃত শব্দকে চিনে নিতে পারেন। প্রেমের অনুষঙ্গে কবি বলেন:
আগুন আকাশকে ছুঁতে পারে না
বিশ্বাস আকাশকে ছোঁয়
বাতাস পাহাড়কে নাড়াতে পারে না
প্রেম পাহাড়কে নাড়ায়।
(আলোক বর্তিকা : অহংকার, তোমার শব্দ)
এখানে প্রেমের মৌল ভিত্তি—বিশ্বাসের দৃঢ়তা প্রকাশিত হয়েছে। প্রেম মানুষের জীবনযাপনেরও প্রধান স্তম্ভ, আদি দর্শন। কবিতার কয়েক পঙ্ক্তিতে এই দর্শনের প্রকাশ কবির শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করে। বিমল গুহর কাব্যবোধ ও প্রকাশ বরাবরই শক্তিশালী। একই গ্রন্থে ‘স্বদেশী প্রেম-৭৫’ একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের কবিতা। এই কবিতায় কবির কাল ও কালের ক্ষুধা ধরা পড়েছে সার্থক চিত্রকল্পে। এ সম্পর্কে কবি মাশুক চৌধুরী বলেছেন—‘প্রেমের প্রতীক রাধাকৃষ্ণের ইমেজ ভেঙে-গুঁড়িয়ে কবির ক্ষুধার নির্মমতা প্রকাশ করেছেন এ কবিতায়। কবি তাঁর প্রথম গ্রন্থেই উপমা-প্রতীক ও চিত্রকল্প ব্যবহারে যতটুকু কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাতে কবির সম্ভাবনাময় দিকই উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছে। বিষয়বৈচিত্র্যেও কবির অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা বিধৃত হয়েছে।’
বিমল গুহর কাব্যোপলব্ধি আমাদের মুগ্ধ করে, আমরা অবলোকন করি কবির উত্থানকে। কবিতায় তিনি প্রেম-অনুভূতির পাশাপাশি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-সমাজের অসঙ্গতিকে ফুটিয়ে তোলেন নিপুণ দক্ষতায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই কবির এই দক্ষতা পাঠককে আশান্বিত করেছিল। ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁকো পার হলে খোলা পথ’ প্রকাশের পর কবির পরিচিতি বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। এ গ্রন্থের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। সব বাধাকে অতিক্রম করে যাওয়ার ইঙ্গিতবহ এই গ্রন্থে কবির স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে। প্রচলিত পথে না গিয়ে কবি নিজস্ব কায়দায় প্রকাশ করেছেন তাঁর আর্তি। সামাজিক দায়বোধে কবি বলে ওঠেন:
খুন হলো আবাল্য সঙ্গিনী-স্ত্রী, পুত্র সহোদরা
খুন হলো মানবতা
খুন হলো প্রেম—তার অন্বিষ্ট দেবতা
এ কেমন বন্ধন মানুষের!
(কোন স্বস্তি নেই : সাঁকো পার হলে খোলাপথ)
জীবনের বাস্তবতার নিরিখে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। মানুষের সামাজিক বোধ নষ্ট হয়ে পড়ায় বেদনার্ত হয়েছেন, দুঃখবোধে উচ্চারণ করেছেন শাশ্বত পঙ্ক্তিমালা।
‘সাঁকো পার হলে খোলাপথ’ গ্রন্থে কবিকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায়। নিজের সময় ও অবস্থানকে পরখ করেছেন বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে এবং তা প্রকাশ করেছেন কাব্যে। মানুষের চরিত্র, মানবিকবোধ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকেও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন সর্বজনীন অনুভবে। এ গ্রন্থে বিমল গুহর কবিতার পথ নতুন বাঁকে অগ্রসর হয়েছে। আশা ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সাঁকোর পর মুক্ত পথের সন্ধানী হয়েছেন তিনি। তাঁর এই প্রত্যাশার হাতছানি উপলব্ধি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক শুদ্ধসত্ত্ব বসু। এই গ্রন্থ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন—‘বাংলাদেশে সত্তর দশক থেকে কবিতার একটা নতুন চেতনা এসেছে, কাব্যভাষা বদলেছে, বলার কায়দা একেবারে পালটেছে, পুরনোকে একেবারেই স্পর্শ না করে নতুন ধারায় কাব্যচর্চা শুরু হয়েছে। বিমল গুহর এই বইটিকে প্রমাণ স্বরূপ হাজির করা যেতে পারে।…কবি সামাজিক মানুষ; তার পরিচয়ও দিয়েছেন তিনি ‘প্রতীক’ প্রমুখ বহু কবিতায়। প্রেমের কবিতাও তিনি স্বচ্ছন্দে লিখেছেন। সর্বত্র কবির ভাষা বলিষ্ঠ ও সাবলীল। নতুন উপমা প্রয়োগে ভাষা আরো সজীব হয়েছে। বাংলাদেশের আধুনিক কবিদের মধ্যে বিমল গুহ নিঃসন্দেহে একটি বিশিষ্ট নাম—তার পরিচয় এই গ্রন্থে আছে।’
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর’-এ এসে কবির দর্শন আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। শর্তহীন ভোরের প্রত্যয় নিয়ে কবি সামাজিক পরিবর্তন কামনা করেছেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন:
আমার চলার পথে বেড়ি কেটে
রুখতে কি পারো এই গতি?
(অবরোধ: স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর)
‘দ্বৈরথ’ কবিতায়ও একই সুর ধ্বনিত হয়েছে। প্রতিবাদী কণ্ঠে কবি তাঁর শব্দসৈনিকের শক্তিতে বলীয়ান। কবির শব্দের কাছে, কলমের কাছে পৃথিবীর তাবৎ শক্তি অবনত। কবি বলেন:
বাঁচতে কি পারবি তুই
বিষবাণ ছুঁড়ে এই দিকে?
(দ্বৈরথ: স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর)
এই কাব্যে বাংলাদেশ ও জাগতিক বিশ্বের মানুষের মানবিক বোধের স্খলন শিল্পরূপ লাভ করেছে। বর্ণবাদী আফ্রিকার শাসকদের প্রতিও তীব্র ঘৃণা উচ্চারিত হয়েছে অন্য কবিতায়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘প্রতিবাদী শব্দের মিছিল’ গ্রন্থে মান্দেলাকে উপলক্ষ করে লেখা কবিতায় ফুটে উঠেছে মানবিক বোধ।
বিমল গুহ সমাজ, প্রকৃতি, পরিবেশের পাশাপাশি লিখেছেন নিটোল ভালোবাসার কবিতা। ছন্দ সচেতন এই কবি কবিতায় ব্যবহৃত নানা ছন্দের নিরীক্ষাও করেছেন। উপমা, রূপক ব্যবহারে ও চিত্রকল্প নির্মাণের দক্ষতায় তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে চিরন্তন। কবিতায় প্রেমের আর্তি প্রকাশিত হয়েছে এভাবে:
তুমি ছিলে বৃষ্টি মেঘে
বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়
তোমার আঙুল ছুঁয়ে জ্বলে ওঠে বিদ্যুতের জ্যোতি।
অথচ তুমিই আজ
বাদুরের মতো কালো ডানা মেলে
নীলিমায় ছড়ালে সন্ত্রাস।
(দ্বন্দ্ব: ভালোবাসার কবিতা)
আলোকিত ভুবন নিমেষে অন্ধকার কালোয় ডুবে যেতে পারে প্রেমিক মনের অবহেলায়। বিমল গুহর এই যেন চিরায়ত প্রেমেরই উচ্চারণ। অন্যত্র প্রেমিকার অবজ্ঞায় ব্যথিত কবি উচ্চারণ করেন:
তোমার অবজ্ঞা পেয়ে ভালোবাসা তীব্র হলো আরো
তোমার অবজ্ঞা দেখে একটি চড়ুই এসে বেদনাকে
ভাগ করে নেয়।
(অবজ্ঞা: ভালোবাসার কবিতা)
বিমল গুহ সামাজিক মানুষ, আলোকিত মানুষ। তিনি লেখেন নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা নামক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের উচ্চারণ:
আহা! কী অদ্ভুত দিন কাটে আমাদের
জোড়া-খুনে অভ্যস্ত শহর
একমাত্র সন্তানের বুকে ছুরি মেরে
হো হো হেসে ওঠে।
(নষ্ট মানুষ : নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা)
আর কোনো উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি? কবি এই একটি কবিতার শব্দবন্ধে তুলে ধরেছেন সমাজের দুষ্ট ক্ষতের স্বরূপকে। মানুষের বোধে আজ পচন ধরেছে, কবি চিৎকার করে এর প্রতিকার চান। এই গ্রন্থে কবির নব জাগরণ লক্ষ্যণীয়। সমাজের ক্ষত কোন পর্যায়ে এসেছে—তারই আকরগ্রন্থ এই কবিতাবলী।
কবি বিমল গুহ শব্দকে নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন, নতুন শব্দ শিকারের জন্য কবির মনোজগৎ অষ্টপ্রহর উৎকর্ণ হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে অতীত, বর্তমান, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, দর্শন, স্বদেশ কিছুই তার সৃষ্টির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি কেবলই শব্দের পেছনে ছুটেন; শব্দ তুলে আনেন নানা অনুষঙ্গ থেকে। বিমলের কবিতা সত্য সুন্দর বিশ্বাস ও প্রেমে অত্যন্ত প্রত্যয়ী। যা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন ও ন্যায় বলে জেনেছেন তারই প্রতিরূপ ফুটে উঠেছে তাঁর সব উচ্চারণে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সামাজিক অবস্থার কিছুই তাঁর দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনি। প্রতিটি বিষয়কে যেন তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। প্রতিটি ঘটনা তাঁকে আন্দোলিত করেছে। তাই কবির শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার শব্দগুচ্ছকে তিনি প্রতিবাদী করে তুলেছেন। নতুন শতকে পাঠককে উপহার দিয়েছেন—‘প্রতিবাদী শব্দের মিছিল’। গ্রন্থের নাম কবিতায় চাইনিজ কুড়ালের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছে কবির কলমকে। এ যেন চিরকালের সুর ও অসুর, ভালো ও মন্দ, সুন্দর ও অসুন্দরের দ্বন্দ্ব। তার সূত্র ধরে বিমল গুহর প্রতিবাদী শব্দেরা হয়ে ওঠে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ। কবির সমকালের বাস্তবতাকে শৈল্পিক গুণে অন্বিত করে সার্থক শিল্পরূপ দান করেছেন।
কবি কাব্যগ্রন্থের অন্য কবিতা ‘মনুষ্যত্বহীন মানুষের প্রতিকৃতি’ আঁকতে গিয়ে কবি বলেছেন, ‘দুই পা আছে বলে কি আর মানুষ বলে গণ্য হবে।’ আর সেজন্যই সমকাল দর্শনে কবির শিরঃপীড়ার খবর পাওয়া যায়। অন্য কবিতায় বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেন কবি, আর তখন তিনি মগজের ভেতরে বিকলাঙ্গ পশুর চিৎকার শুনতে পান। ‘হিম-অন্ধকার’ নামের কবিতায় বিমল বলেছেন:
সেই কালো বাদুরে পাখা থেকে ধীরে ধীরে
ধীরে ধীরে
ধীরে ধীরে
মাতাল নেশার মতো গাঢ় হিম-অন্ধকার
চতুর্দিকে নামে।
(হিম অন্ধকার : প্রতিবাদী শব্দের মিছিল)
এই গ্রন্থের ‘প্রজন্ম-২০০০’ কবিতাটি একটি প্রত্যাশার কবিতা। মুষ্টিবদ্ধ নবীন বালক পুনর্বার জ্বলে ওঠার প্রত্যাশায় নতুন শতাব্দীর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, নতুন সূর্য ছিনিয়ে আনবে, উর্বর করবে নিজস্ব ভুবন—এ তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। ‘মান্দেলা’ কবিতায় আমরা শুনি মুক্ত মান্দেলার কণ্ঠ :
মান্দেলা কোন একক কণ্ঠ নয়,
মান্দেলা মানে মুক্ত বহ্নিশিখা।
(মান্দেলা : প্রতিবাদী শব্দের মিছিল)
গ্রন্থের অন্য কবিতা ‘বিশাল শূন্যের দিকে।’ কবিতাটিতে কবি এই পৃথিবী নামক গ্রহের অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের পরিণাম সম্পর্কে কৌতূহলী হয়েছেন। শতাব্দীর কবিও বুঝি সে আণবিক পৃথিবীর স্পর্শ—থেকে দূরে, বহুদূরে ছুটে যেতে চাইছেন। এ ছাড়া ‘শতাব্দীর শেষ রশ্মি’, ‘কতদূর নিয়ে যাবে আর’, ‘ছায়াপি-’ ইত্যাদি কবিতায় অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের নানা অনুষঙ্গ ধরা পড়েছে সার্থকভাবে।
তাই বলে বিমল গুহকে শুধু শূন্যতারই দিকনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। তার দর্শন, মনোজগৎ ও কাঙ্ক্ষিত বলয় হলো—বিশ্বাস, প্রেম-পূর্ণতা ও ভালোবাসার চতুরঙ্গ। যেখানে সকল মানুষ সুখী ও সম্পদশালী হবে। একবিংশ শতকে এসে কবি যুক্ত ইস্তেহারে ঘোষণা দেন:
একবিংশ শতাব্দীতে আণবিক যুদ্ধাস্ত্র থাকবে না
পৃথিবীতে মানুষে মানুষে আর হবে না অশুভ বেচাকেনা
লেনিন, মার্কস, মাওসেতুং, গান্ধী ও মুজিব পুনর্বার
জেগে উঠবে, ক্লিনটনও পুষ্পমূল্যে ছেড়ে দেবে অস্ত্রের ভাণ্ডার।
(যুক্ত ইস্তেহারে : প্রতিবাদী শব্দের মিছিল)
এই আশাবাদী কবি কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক ও চিত্রকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে একই সত্য ও সুন্দরের জয়গান গেয়েছেন। অসুন্দর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার শব্দগুচ্ছ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদী শব্দের মিছিল-এ তিনি শব্দের শক্তিতে বিস্ফোরক হিসেবে মাইনের শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি লিখেছেন:
কবিতাকে আজ শুইয়ে দিলাম মন্ত্রবাণে ঘাসের কার্পেটে,
কবিতা শিখেছে ঘাসের আড়ালে
পুঁতে রাখা ‘মাইন’ হয়ে ফেটে যেতে’
(একাত্তরের কবিতা : প্রতিবাদী শব্দের মিছিল)
কবিতায় তীব্র শক্তির প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন কবি। প্রতিবাদী শব্দের মিছিল বলিষ্ঠ কণ্ঠের সার্থক কাব্যোচ্চারণ। প্রতিদিন এই কবি নতুন শব্দ নিয়ে নতুনরূপে আবির্ভাবের সাধনা করেন :
ভাঙা কবিতার টুকরো জড়ো করি রোজ…
এভাবে শুদ্ধ হয়ে উঠি প্রতি ভোরে।
(শুদ্ধ হয়ে উঠি প্রতি ভোরে: প্রতিবাদী শব্দের মিছিল)
বিমল গুহ প্রতি ভোরে নতুন করে জন্ম নিতে থাকেন, সংযুক্ত করেন কবিতার পলায়নপর শব্দরাজি। নতুন শতাব্দীর দোরগোড়ায় এসে শুদ্ধতার প্রার্থনা করেন তিনি। সত্তরের প্রধান স্রোতের শক্তিশালী কবি বিমল গুহ তাঁর অনুভব ও দর্শনকে শব্দে শব্দে গেঁথে তুলেছেন প্রত্যহ। এ কাজে তাঁর সার্থকতা উল্লেখযোগ্য, তিনি সমকালীন কবিদের প্রথম কাতারে দণ্ডায়মান।
বিমল গুহর ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত। জীবন ও জগতের চারপাশকে খুঁটিয়ে দেখার ক্ষমতাও অসাধারণ। তাঁর লেখায় বাক্চাতুর্য আছে, কিন্তু তা পাঠকের কাছে প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল তৈরি করে না। কবি মুক্ত বিহঙ্গের মতো আপন মনে লিখে চলেছেন শাশ্বত কাব্যপঙ্ক্তি, যা স্বাতন্ত্রচিহ্নিত—তাই কবিকে আলাদা করে চেনা যায়। শব্দচয়ন ও বাক্যবলয় নির্মাণে যত্নবান, ছন্দ-অলঙ্কার প্রয়োগে সচেতন এই কবির কণ্ঠ শুরু থেকেই বলিষ্ঠ ও স্বতন্ত্র।