বাঙালি মানসকে আনকোরা সাহিত্যরস আস্বাদনে যে-কজন কথাসাহিত্যিক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং আজীবন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেও বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে যে বিস্ময়কর সিদ্ধিলাভ তিনি করেন, তা সাধারণ মানুষের ভাবলোককে তুমুলভাবে আন্দোলিত করে। তাই একথা বলা বাহুল্য যে, বাংলা উপন্যাস-রাজ্যে তাঁর আবির্ভাব যেমন আকস্মিক, তেমনই বিস্ময়কর। তাঁর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাসের জগতে যে নব-মহারথির আগমন ঘটেছে; তার দিক-চিহ্নায়ক হিসেবে পথের পাঁচালী (১৯২৮), অপরাজিত (১৯৩২), দৃষ্টি-প্রদীপ (১৯৩৫), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪১), দেবযান (১৯৪৫) ও ইচ্ছামতী (১৯৫০) প্রভৃতি উপন্যাস প্রমূর্ত। এ সব উপন্যাস পাঠকসমাজের চেতনালোককে এক মোহাচ্ছন্ন প্রতিবেশে আবিষ্ট করে ফেলে সমকালে।
০২.
বিশ্বযুদ্ধোত্তর অবক্ষয়, হতাশা, অবসাদ, ক্লেদ, রিরংসা, বিকৃতি, অনৈতিক অস্থিরতাসহসমূহ নেতি ধারণ করে পরবর্তী তিনের দশকের কথাসাহিত্যিকরা যে মূলবিচ্ছিন্ন নাগরিক হীন-সংকীর্ণতার শিল্পাদর্শ নির্মাণ করেন, সেখানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবাহন ঘটান মৃত্তিকা সংলগ্ন লোকায়ত জীবনযাপনে অভ্যন্ত গ্রামীণ মানুষের সহজ-সরল-সাবলীল অনাড়ম্বর ও অবহেলিত পতিত জীবনচর্যার অফুরন্ত সম্ভার। নিভৃত গ্রামীণ জীবনে সংক্ষিপ্ত এসব অন্ত্যজ মানুষ, হাদ্য মমতায় ও অকৃত্রিম ঝদ্ধতার উঠে আসে তাঁর সাহিত্যসিঁড়ি বেয়ে। তাদের শান্ত-মৃদুমন্দ জীবনপ্রবাহের আটপৌরে সব অনুষঙ্গই প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যে। পতিত সেসব মানুষের অনাবৃত বিড়ম্বিত দিনলিপি, নির্মম যাপিত জীবনপ্রণালী, দারিদ্র্য সমাকীর্ণ আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দ্বিধাদীর্ণ সংবলিত ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত নির্লিপ্ত নিরাসক্তিতে ভাস্কর হয়ে ওঠে তাঁর সৃজিত সাহিত্যকীর্তিতে। যদিও প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক নৈরাজ্যের অস্থিতিশীলতা, দ্বান্দ্বিক ধর্মযুদ্ধ ও আর্থ-সামাজিক অসমতার চিত্র তাঁর উপন্যাসে কালেভদ্রে দৃষ্টিগোচর হয়। মূলত গ্রামীণ সাধারণ মানুষের নিত্য-নৈমিত্যিক সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার এক নির্মেদ এটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই প্রকৃতিনিমগ্ন আত্মতার শৈল্পিক চিত্রপট নির্মিত হয় দক্ষিণ বাংলার স্থির শান্ত, নির্জন অথচ সম্মোহন প্রয়াসী প্রকৃতি এবং প্রকৃতিলালিত অনাড়ম্বর মানুষকে কেন্দ্র করে। ঋতুবৈচিত্র্যের বহুমাত্রিকতায় বহুবর্ণিল নৈসর্গিক মোহমায়া সেখানে উৎপূর্ণরূপে পরিবৃত্ত থাকে।
০৩.
আরণ্যক উপন্যাস কোনো শাশ্বত বাঙালি গার্হস্থ্য অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান নয় বরং অনাবিষ্কৃত সভ্যতার এক ভিন্নমাত্রিক প্রতিচ্ছবি এবং সহস্রাধিক কালব্যাপী ভারতবর্ষীয় মানবজীবনচর্যার মূল সামাজিক প্রেক্ষণপটের প্রকাশক্ষেত্র। ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য :
‘এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো—একটা কঠিন শৌর্য্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি। এই বন, নির্জ্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার—এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপড়ি বেঁধে থাকা। মাঝে মাঝে যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে শুঁড়িপথটা ভিটে টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েছে দেখা গেল, ঐ রকম উড়িপথ এক বাথান থেকে এর এক বাথানে যাচ্ছে- পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র্য, সরলতা, এই verile, active life, এই সন্ধ্যার অন্ধকারে ভরা গভীর বন । ঝাউবনের ছবি—এই সব।’
[ হায়াৎ মামুদ, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা.)। ২০১৪ : ৮৮৩]
মূলত সুবিশাল অরণ্য-প্রকৃতির সান্নিধ্যলগ্ন মানুষের রহস্যময় সংলিপ্ততার নিভৃত-নিবিড় অনুভূতির স্বরূপ প্রতিভাসন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রাতিস্বিক বৈশিষ্ট্য। আর আরণ্যক উপন্যাসে সেই রহস্যময়তার অপূর্ব নিসর্গলোক সৃজন করেন তিনি। সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে পরিপ্রেক্ষণা ঘৃত হয় যে :
বিভূতিভূষণের দৃষ্টিভঙ্গিমা কোন কোন দিক দিয়ে রোমাঁ রোলাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে তুলনীয়। সেই প্রকৃতি ও মানুষের আসিম সম্পর্ক, ভূলোকের মধ্যেই দ্যুলোকের ব্যঞ্জনা, যা ফরাসী মনীষার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য, বিভূতিভূষণের পরিকল্পনা কতকটা সেই ধরনের। ড্রয়িং রুমের কৃত্রিমতা, অতিসূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক ভাব, সমাডা ও নীতিঘটিত কোন প্রথম প্রশ্ন বিভূতিভূষণকে বিচলিত করেনি, চরিত্রের মধ্যে বিভিন্ন প্রবৃত্তির বিধা-দ্বন্দ্ব এবং সেই মানসিক সংঘাত- সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চরিত্রের বিবর্তন-এসব চিরাচরিত ঔপন্যাসিক কৌশলও তাকে আকৃষ্ট করেনি। […] ঘটনা, অন্তস্বর্বস্ব, তাত্ত্বিক সংঘাত, সামাজিক প্রশ্ন, তাঁর উপন্যাসে এসবের বিশেষ বাহুল্য নেই। আছে চেনা পৃথিবীর মধ্যে, পরিচিত মানুষের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনধারণের মধ্যে, অচেনা অরূপ জগতের মধ্যে সৌন্দর্যময় ইঙ্গিত, রহস্যময় ব্যঞ্জনা। সে দিক থেকে বিভূতিভূষণ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিশেষ স্থান অধিকার করবেন।
[ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১২ (৫৫৯-৫৬০)]
‘আরণ্যক-এর পটভূমি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। কুশী নদীর অপর পারে এরূপ দিগন্ত-বিস্তীর্ণ অরণ্যপ্রান্তর পূর্বে ছিল, এখনো আছে।’ আরণ্যক উপন্যাসের গ্রস্থভূমিকাতেই একথা বলা হয়েছে।
আরণ্যক উপন্যাসের অরণ্যচারী মানুষের জীবনপ্রবাহ সতত প্রবাহিত এক সাহজিক সত্যের প্রাঞ্জল-পেলবতায়। অরণ্য-প্রদেশের মানুষের প্রধান খাবার কলাইয়ের ছাতু। কেননা, ধান উৎপাদন উপযোগী উর্বর জনি না থাকায় ধানের প্রাচুর্য তেমন পরিলক্ষিত হয় না। ফলে ভাত খাওয়ার বিষয়টাও দস্তুরমতো বিলাসিতা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয় এদেশের মানুষের কাছে। অরণ্যসমাজের গণ্যমান্য বৰ্গীয় গুটিকতক মানুষই কেবল অন্যান্য ফসল বিক্রয় করে ধান কেনার সামর্থ্য রাখে, তবে সে সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা যায়। তাদের বাসগৃহের অবস্থাও সঙ্গীন।
অধিকাংশ বাড়িই জঙ্গলের কাশ ছাওয়া, কাশডাঁটায় বেড়া, কেহ কেহ তাহার উপর মাটি লেপিয়াছে, কেহ কেহ তাহা করে নাই। এদেশে বাঁশগাছ আদৌ নাই, সুতরাং বনের গাছের, বিশেষ করিয়া কেঁদ ও পিয়াল তালের বার্তা, খুঁটি ও আড়া দিয়াছে ঘরে।
[হায়াৎ মামুদ, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা.)। ২০১৪ : ৬৭২]।
ধর্মপালনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে গোচরীভূত হয় যে, সনাতন হিন্দু ধর্মানুসারীই সবাই-তবে তেত্রিশকোটি দেবতার মধ্য থেকে এরা হনুমানজীর জয়ধ্বজাকেই সুউচ্চে তুলে রাখে। প্রত্যেক বসতভিটাতেই একটা করে হনুমানজীর ধ্বজা থাকবেই। বিষ্ণু, শিব, কালী, দুর্গা, সরস্বতী এমনকি রাম-সীতার প্রচারও তেমনভাবে কর্ণগোচর হয় না, কেবল হনুমানজীরই রীতিমতো পূজা এদেশে পরিদৃষ্ট হয়। আর শোনা যায় বন্য নহিষের দেবতা টাড়বারোর উপকথা। উৎসবের মাঝে আছে কার্তিক মাসের শেষে ছট পরব। এই ছট পরবই এই অরণ্যভূমির মানুষের প্রধান উৎসব। ঝুলন উৎসব নামে আরেকটি উৎসব মহাসমারোহে উদযাপিত হয় এখানে। এছাড়াও বিবিধ সময়ে ফসল তোলার মৌসুম হলে, তাকে কেন্দ্র করে ছোটো ছোটো মেলার মতো আয়োজনই এসব বণ্যচারী প্রান্তিক মানুষের আনন্দের পার্বণ বলে বিবেচিত হয়। আর এভাবেই আরণ্যক- এর অরণ্যদেশে বহুবর্ণিল মানবসম্প্রদায়ের বহুভঙ্গিন জীবনধারা ক্রমাগ্রসরমানভাবে প্রবাহিত হতে থাকে গিরি-প্রস্রবণধারার মতো সম্মুখপানে।
০8.
আরণ্যক উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র মূলত অরণ্যই, তথাপি উপন্যাসের প্রধানতম প্রটাগনিস্ট চরিত্রটি হোলো সত্যচরণ। আধুনিক কালের তরুণ এই যুবক কলকাতায় কর্মসংস্থানের বহু প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে শেষ অব্দি পূর্ণিয়া জেলায় অবস্থিত ডাঙ্গল-নহালে ম্যানেজারির চাকরি নিয়ে নিভৃত বনবাসী হয়। আর তার এই বনে গিয়ে জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মূলত তথাকথিত আধুনিক সভ্যভাগতের সাথে নিভৃত নিবিড় আদি অরণ্যভূমির সখ্যতা গড়ে ওঠে। আরণ্যক উপন্যাসে যে সত্যচরণকে আমরা পাই, সে স্বয়ং ঔপনিবেশিক মানসিকতার আধুনিক মানুষ। তাই তো অরণ্যানীর প্রতি মন্ত্রমুগ্ধতা, ভালোবাসাবোধ সক্রিয় থাকলেও সেই অরণ্যের জমিবষ্টন তাকে করতেই হয়। মূলত নগর থেকে জাঙ্গল-নহালে জমি বিলি-ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যেই তার নাড়া বইহারে আগমন। উপন্যাসের সত্যচরণ প্রথমদিকে উৎকণ্ঠাতাড়িত হতে থাকে- এই অপরিচিত অরণ্যভূমি ও তার মানুষের সান্নিধ্যপ্রাপ্তির আনকোরা ও ভিন্নমাত্রিক অভিজ্ঞতালব্ধ পারিপার্শ্বিকতার মধ্য দিয়ে। সে আসলে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগতে থাকে, কেননা তার বেড়ে ওঠার জগত আর এই অরণ্যানীর জীবনের বিস্তর তফাৎ তার কাছে প্রকটভাবে প্রমূর্ত হয়ে ওঠে। কথা বলার মতো একজন মানুষ সে এই অরণ্যে খুঁজে পায় না, অথচ এই অরণ্যবাসী আদি মানুষও যে মানুষ এ বোধ তার মাঝে তখনো জাগ্রত নয়। বলা যায় সত্যচরণের এমন অনুভব একজন মানবিক ঔপনিবেশিকের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন । মূর্খ, বর্বর মানুষ সম্বন্ধে এ অসহিষ্ণুতা মূলত সেই ঔপনিবেশ আক্রান্ত মনন-মানসিকতা থেকে উৎসারিত হয়। কিন্তু পূর্ণিমা রাত্রির মুগ্ধ রূপ সমগ্র চৈতন্য ভরে উপলব্ধির মধ্য দিয়ে সত্যচরণ এই যান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষার বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় :
নিঃশব্দ অরণ্যভূমি, নিস্তব্ধ অনহীন নিশীথরাত্রি। সে জ্যোৎস্না রাত্রির বর্ণনা নাই। কখনো সে রকম ছায়াবিহীন জ্যোৎস্না জীবনে দেখি নাই। চক্চকে সাদা বালি মিশানো জমি ও শীতের রৌদ্রে অর্ধশুষ্ক কাশবনে জ্যোৎস্না পড়িয়া এমন এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করিয়াছে, যাহা দেখিলে মনে কেমন ভয় হয়।
[তদেব ৫৫৭ ]
উল্লিখিত ভয় কোনো আনাড়ি আগন্তুকের নয়, এ ভয় প্রবল আকর্ষণের ভয়। মূলত বন্ধনহীন মুক্তি যার অস্তিত্বে আর বিরাজ করে না-ঔপনিবেশিক শোষণের যাতাকলে পিষ্ট তেমন একজন মানুষ হঠাৎ করেই প্রকৃতির এমন মায়াচ্ছন্ন মন্ত্রমুগ্ধ সৌন্দর্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, এ বোধ থেকেই তার ভয়ের উৎসারণ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রান্তিক অন্ত্যজ মানুষের জীবনধারা পরিবর্তন তথা পরিবর্ধনের জন্য সত্যচরণকে অরণ্য অঞ্চলে পাঠান, অথচ কিছুদিন না যেতেই সত্যচরণই মোহনীয় অরণ্য প্রকৃতির প্রতি প্রেনাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে
এ এক আলাদা জীবন, যারা ঘরের দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকিতে ভালোবাসে না, সংসার করা যাদের রক্তে নাই, সেই সব বারমুখো, বাপছাড়া প্রকৃতির মানুষের পক্ষে এমন জীবনই তো কাম্য। কলিকাতা হইতে প্রথম আসিয়া এখানকার এই ভীষণ নির্জনতা ও সম্পূর্ণ বন্য জীবনযাত্রা কি অসহ্য হইয়াছিল, কিন্তু এখন আমার মনে হয় এই ভাল, এই বর্বর রুক্ষ বন্য প্রকৃতি আমাকে তার স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছে, শহরের বাঁচার মধ্যে আর দাঁড়ে বসিয়া থাকিতে পারিব কি? এই পথহীন প্রান্তরের শিলাখণ্ড ও শাল-পলাশের বনের মধ্য নিয়া এই রকম মুক্ত আকাশতলে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় হু-হু ঘোড়া ছুটাইয়া চলার আনন্দের সহিত আমি দুনিয়ার কোনো সম্পদ বিনিময় করিতে চাই না।
জ্যোৎস্না আরো ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালোবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়া ডাকে নাই, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো কালেই। [তদেব : ৫৭৮-৫৭৯]
আরণ্যক-এর সাধারণ মানুষের উন্নতি সম্পর্কে সত্যচরণের অভিমত, ‘আমার কাছে কি অদ্ভুত ঠেকিতেছিলো ইহাদের বৈষয়িক উন্নতির কথা। উন্নতি সম্বন্ধে ইহাদের ধারণা অভাবনীয় ধরনের উচ্চ নয়- ছ’টি মহিষের স্থানে দশটা নহিষ না হয় বারোটা মহিষ’ [তদেব : ৬৬৮] এই হলেই তারা সন্তুষ্ট।
আরণ্যক উপন্যাসে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে অরণ্যভূমিকে এবং অরণ্য-সংলগ্ন জীবনকে উন্মোচন করা হয়। সত্যচরণের স্বপ্নলোকের যে অরণ্য-তা তাকে বিমোহিত করে সুদূরপ্রসারী মন্ত্রমুগ্ধতা দিয়ে, অথচ অরণ্যজীবনে তাকে মুখোমুখি হতে হয় বহুমাত্রিক বাস্তবতার। তথাপিও ঔপন্যাসিকের কাছে রোমান্টিক চেতনার মায়াজাল নিয়ে প্রকৃতির আবির্ভাব ঘটে, নারীর চিত্রকল্পে পরাবাস্তব সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতিদেবী তাঁর হৃদয়ে প্রচ্ছন্ন প্রশান্তির প্রচ্ছায়া ফেলে যায় : ‘কত রূপে কত সাজেই যে বন্যপ্রকৃতি আমার মুগ্ধ অনভ্যস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া আমায় ভুলাইলো!’ [তদেব : ৫৫৭] । এখানে প্রকৃতিকে নিতান্তই ছল ক্রীড়ায় পারদর্শী প্রেয়সি বলে বোধ হয়। তিনি আরও বলেন :
কত সন্ধ্যা আসিল অপূর্ব রক্তমেঘের মুকুট মাথায়, দুপুরের খরতর রৌদ্র আসিল উন্মাদিনী ভৈরবীর বেশে, গভীর নিশিথে জ্যোৎস্নাযরণী সুরসুন্দরীর সাজে হিমস্মিগ্ধ বনকুসুমের সুবাস মাথিয়া, আকাশভরা তারার মালা গলায়-অন্ধকার রস্তানীতে কালপুরুষের আগুনের বড়গ হাতে দিগ্বিবিদিক ব্যাপিয়া বিরাট কালীমূর্তিতে।
[তদের ৫৫৭]
এই আরণ্যক কুহক-মন্ত্রণা ব্যতিরেকেও সেখানের মানুষদের দুঃখ-দারিদ্র্যপীড়িত জীবনচর্যা, তাদের নির্মেদ সারল্যে দ্রবীভূত হতে থাকে সত্যচরণ। প্রকৃতির সাথে সংক্ষোভ-সংগ্রাম-সৌহার্দে বেঁচে থাকা এসব মানুষকে ভালো লাগতে শুরু করে তার। এমনই ভিন্নমাত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনপ্রণালীর মাঝেই সত্যচরণের হৃদমাঝারে দোলা দিয়ে যায় আদিম সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্না বীরবদীর নাতির মেয়ে রাজকন্যা ভানুমতী। তাইতো বিদায়লগ্নের প্রাক্কালে সত্যচরণের মনে হতে থাকে :
এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম! ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম। এই মাটির ঘরের জ্যোৎস্না ওঠা পাওয়ায় সরলা বন্যবালা রাঁধিতে রাঁধিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষি গল্প করিত—আমি বসিয়া বসিয়া শুনিতাম। আর শুনিতাম বেশি রাত্রে ওই যনে হুড়ালের ডাক, বনমোরগের ডাক, বন্য হস্তীয় বৃংহিত, হায়েনার হাসি। ভানুমতী কালো বটে, কিন্তু এমন নিটোল স্বাস্থ্যবতী মেয়ে বাংলা দেশে পাওয়া যায় না। আর ওর ওই সতেজ মন! দয়া আছে, মায়া আছে,
স্নেহ আছে, তার কত প্রমাণ পাইয়াছি। … ভারিতেও বেশ ভালো লাগে। কি সুন্দর স্বপ্ন। কি হইবে উন্নতি করিয়া? বলভদ্র সেঙ্গাৎ গিয়া উন্নতি করুক। রাসবিহারী সিং উন্নতি করুক।
[তদের ৬৮২]
অর্থাৎ এক মন্ত্রমুগ্ধ স্বপ্নাচ্ছন্নতায় বিভোর হয়ে থাকে সত্যচরণের মন। তথাপি, তাকে বিদায় নিতে হয় সেই অরণ্যের মায়াময় পরিবেশের সান্নিধ্য থেকে। কিন্তু এই মর্মবেদনা তাকে ক্রমাগত পীড়িত করতে থাকে যে, নাড়া বইহারের বনভূমি কেটে যে জনপদের আসর জমান ঔপন্যাসিক- তাতে করে অনতিবিলম্বেই যে প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের অভিশাপ সুস্পষ্ট হয়ে যায়; তা সত্যচরণের অনুধাবন করতে তেমন বেগ পেতে হয় না, তাইতো প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আপাত যে উন্নতি সাধন করা গেলো নাড়া, বইহারের অরণ্যভূমিতে- সেই প্রকৃতির কাছেই ফিরে যাওয়ার প্রাকলগ্নে সে নার্জনা প্রার্থনা করে যায় : ‘হে অরণ্যানীর আদিন দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়। বিদায়!’ [তদেব : ৬৮৪]
আরণ্যক-এ একদিকে যেমন অন্ত্যজ শোষিত শ্রেণির অবস্থান যারা, অসহায় এবং বনের সামান্য সুযোগ- সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তেমনি অন্যদিকেই অবস্থান করে আপাত অভিজাত মহাজন শ্রেণি। রাজপুত জাতিভুক্ত রাসবিহারী সিং এমনই একজন- যে কিনা একাই কয়েক হাজার বিঘা জমির মালিক, তার অনুগত লাঠিয়াল বাহিনীকে সকলে সমীহ করে চলে। কারো নদী তীরবর্তী গবর্নমেন্ট খাসমহলের সে প্রজা। কাছারি থেকে বারো-চৌদ্দ নাইল উত্তর-পূর্ব কোণে, মোহনপুরা রিজার্ভের গা ঘেঁষে তার গ্রাম। অত্যন্ত দাম্ভিক ও রাসভারী স্বভাবের মানুষ রাসবিহারী সিং। মান-সম্মানের ব্যাপারেও তার সজাগ দৃষ্টি, ‘পান হইতে চুন খসিলেই রাসবিহারী সিং-এর মান যায়’ [তদেব : ৫৯৪]। লবটুলিয়া বইহারের প্রায় সকল প্রজাই তার অধীনস্থ খাঁতক। তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস সচরাচর কেউ রাখে না।
নন্দলাল ওঁঝা এমনই আরেকজন মহাজন। জাতিতে ব্রাহ্মণ, স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের জন্যে হেন কোনো কাজ নেই- যা সে করতে না পারে। তথাপি এই মহাজন শ্রেণির সকলে আবার ম্যানেজার বাবুকে খাতির করে চলে। কেননা ম্যানেজার বাবু লেখাপড়া জানা আধুনিক শিক্ষিত মানুষ। কলকাতার সভ্য সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে ম্যানেজার বাবু- তাকে সমীহ না করলে যে চলে না, এইটুকু বোধ তাদের বন্যবিবেচনাতেও সক্রিয় থাকে।
মহাজন চরিত্রের মধ্যে ধাওতাল সাহু সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তার কাছ থেকে লোকে টাকা ধার নেয় বটে কিন্তু তা ফেরত দেওয়ার কোনোপ্রকার তাড়া তাদের মাঝে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না, বরং ধাওতাল সাহুর কাছে রেখে যাওয়া দলিল-পত্রাদি সব তামাদি হয়ে যায় এবং একসময় গিয়ে তা সে নিজেই ছিঁড়ে ফেলে দেয়। লক্ষাধিপতি ধাওতাল সাহু চলতি পথে বনের মধ্যে বসে থান কাপড়ের প্রান্তে ছাতু মেখে খায় । এমনই সাদাসিধে যাপিত জীবনে অভ্যস্থ ঘাওতাল সাহু তাকে দেখে এটা অনুমান করা দুরূহ যে, সে এতো অর্থবিত্তের মালিক। সত্যচরণের অভিমত : ‘বিত্তে নিস্পৃহতা ও বৃহৎ ক্ষতিকে তাচ্ছিল্য করিবার ক্ষমতা যদি দার্শনিকতা হয়, তবে ধাওতাল সাহুর মতো দার্শনিক আমি তো অন্তত দেখি নাই।” [তদেব : ৫৭০]।
একবার কাছারির প্রয়োজনে সত্যচরণ তার কাছ থেকে টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। আর এর ফলে ধাওতাল সাহু পরবর্তী ছয়মাস কাহারির দিকে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়, কারণ তার মনে হতে থাকে- সে ওদিকে গেলে যদি কাছারির লোক মনে করে যে সে পাওনা টাকার তাগাদা দিতে এসেছে। এমনই অমায়িক এবং বিনয়ী। চরিত্রের অধিকারী ধাওতাল সাহু। ‘বিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের লোক যে আছে, না দেখিলে বিশ্বাস করা যায় না।’ [তদেব : ৫৬৯]। তার নিজের মাঝে এমন দার্শনিক বোধ জাগ্রত থাকে যেখান থেকে সে অনুধাবন করে; অর্থ-বৈভব দিয়ে কী হবে যদি তা মানুষের উপকারেই না আসে।
আরণ্যক উপন্যাসের একটি প্রত্ন চরিত্র সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্না বীরবর্তী। সাঁওতাল বিদ্রোহতে ভারতবর্ষের অনার্য গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে অবতীর্ণ ছিলেন দোবরু পান্না। তারাই মূলত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের ভল্কা বাজায়। রাজা দোবরু পান্না ১৮৬২ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা এবং এককালের ক্ষমতাধর রাজাদের বংশধর এই দোবরু পান্না। অথচ বর্তমান সময়ে এই রাজা বয়সের ভারে এবং দৈন্যতার দায়ে ন্যুব্জ ও পীড়িত। তথাপি, বনে বাসরত আদিম অধিবাসীর সকল জাতিই তাকে রাজার প্রাপ্ত সম্মান দেয়। এককালে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, রাজ্য সবই ছিলো; কালের রথচক্রে রাজা দোবরু পান্না কেবল পদবির মাঝে সীমাবদ্ধ নামে মাত্র রাজা। তথাপি, বিগত সে গৌরবদীপ্ত শৌর্যবীর্যের স্মৃতি রোমস্থনে সে প্রদীপ্ত ও উদাসীন দুইই হয়ে যায়:
আমাদের বংশ সূর্যবংশ। এই পাহাড় জঙ্গল, সারা পৃথিবী আমাদের রাজ্য ছিল। আমি যৌবন বয়সে কোম্পানির সঙ্গে লড়েছি। এখন আমার বয়স অনেক। যুদ্ধে গেলাম হেরে। তারপর আর কিছু নেই।
[তদের ৬২৯]।
বর্তমান আধুনিক সভ্য দুনিয়ায় তার না আছে রাজ্যপাট, না আছে শৌর্যবীর্য, না-ই বা আছে প্রভাব-প্রতিপত্তির জৌলুস। সত্যচরণের সাথে যে রাজার সাক্ষাৎ হয়, সে রাজা গরু চরিয়ে এবং পাহাড় থেকে আনা শিলাখণ্ডের প্রাচীরে ঘেরা ঘরে জীবনযাপন করেন। অর্থাৎ রাজার লেশমাত্র লক্ষ্মণ কোথাও আর অবশিষ্ট নেই, যা আছে তাহলো বিগত রাজ্যের গরিমা, বংশমর্যাদা সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন বর্তমান দীনহীন রাজা দোবরু পান্না।
তাইতো সত্যচরণ যখন জানতে চাইলেন চাষবাস আছে কিনা- তখন খুব তাচ্ছিল্য ভরে দোবরু পান্না বলেন, ওসব তাদের বংশে নেই। বরং তাদের কাজ বর্শা দিয়ে শিকার করা, আজকাল অনেকে বন্দুক দিয়ে শিকার করে কিন্তু সেটা তার বিশেষ পছন্দ নয়।
আরণ্যকের একটি অন্যতম চরিত্র যুগলপ্রসাদ। যুগলপ্রসাদকে অভিহিত করা যায় একজন ঐতিহাসিক মানুষ হিসেবে। সে-ই সত্যচরণের কাছে এই খবর নিয়ে যায় যে : ‘বাবুজী, একটা গুহা আছে পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে কোথায়—তার গায়ে সব ছবি আঁকা আছে- কত কালের কেউ জানে না, সেটাই বুজছি।’ [তদেব : ৬৬৫]। হয়তো স্বতঃসিদ্ধ অর্থে ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বলতে যা বোঝায় তা যুগলপ্রসাদ নয় কিন্তু সে প্রতিনিয়ত যে অন্বেষণ কাজে রত থাকে তাকে লোক-ঐতিহাসিকের কাজই বলা যায় বটে। যুগলপ্রসাদ এক অন্যভুবনের মানুষ, বৈষয়িক কোনো চিন্তা-ভাবনা তার মাঝে বিরাজ করে না। ঔপন্যাসিকের ভাষ্যে : ‘ও আর এক ধরনের ব্রাত্য মন লইয়া পৃথিবীতে আসিয়াছে— জমিজমা, গোরু-মহিষের আলোচনা করিতে ভালও বাসে না, তাহাতে যোগও দেয় না। [তদেব : ৬৬৮]। বিশ শতকে সভ্যতার ভরা মৌসুমের সময় প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে যখন সভ্যতার পর্দা উন্মোচন হয়, ঠিক সেই সময়ে অবস্থান করেই যুগলপ্রসাদ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিবিধ ফুল-ফল-বনস্পতির বীজ এনে রোপন করে লবটুলিয়া, বইহারে; সমৃদ্ধ করে তোলে এর বনবৈচিত্র্যের সম্ভারকে। বলা বাহুল্য যে, অরণ্যক্রোড়ে বেড়ে ওঠা যুগলপ্রসাদ অকৃত্রিমভাবেই ভালোবাসে নৈসর্গিক প্রকৃতিকে।
রাজু পাড়ে, যুগলপ্রসাদের ব্রাত্য মনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ সমান্তরাল দ্বৈরথে অবস্থিত এই চরিত্রটি। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের ঘেরাটোপে নির্ধারিত পরিধির মাঝে রাজু পাড়ের জগৎ সুবিন্যাস্ত। হিন্দি লেখাপড়া জানে, সংস্কৃতও অল্পবিস্তর জানতো রাজু। ধরমপুর পরগণা থেকে আগত রাজু পাঁড়েকে একরকম বিনামূল্যেই লবটুলিয়া বইহারে সত্যচরণ নিতান্ত ভালোলাগার বশেই জনির বন্দোবস্ত করে দেয়। কিন্তু বৈষয়িক কাজের প্রতি তেমন একটা মনোযোগ তার ছিলো না, বরং উদাসীনতাই তার চরিত্রের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে সংযোজিত। ঔপন্যাসিকের ভাষ্যানুযায়ী : ‘সত্যকার সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক রাজু। [তদেব : ৫৮৬] । নিতান্ত ধর্মপরায়ণ মানুষ, কিছু পুঁথিগত বিদ্যা সে আত্মস্থ করেছে আর তাতেই তার সম্পূর্ণ আস্থা, সমর্থ বিশ্বাস আপাদমস্তক প্রোথিত। বৈজ্ঞানিক বিশ্বতত্ত্ব দিয়ে রাজুর কোনো মাথাব্যথা নেই। লেখক তাকে এটা বোঝাতে গিয়ে অথৈ জলে পড়েন যে, কেনো প্রত্যুষে সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয় এবং সায়াহ্নে পশ্চিমদিকে অন্তমিত হয়! গাঙ্গোেতা গৃহস্থরা অবশ্য রাজু পাড়ের কথাই কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করে। একদিক থেকে বিচার করলে অবশ্য রাজু পাড়ের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাসই এই অরণ্যজীবনের জন্য শুভকর ছিলো, কেননা ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি জ্ঞান-অভিজ্ঞান এই কল্পবনের লোকপরম্পরায় আনে ক্রমক্ষয়িষ্ণু সর্বনাশ, বিচ্ছেদ ও শোষণের দিগন্ত-উজাড়ি হুতাশন।
উপন্যাসে গিরিধারীলাল প্রান্তিক গাঙ্গোেতা জাতির অন্তর্গত এক নিদারুণ দরিদ্র মানুষ। তার বাড়ি কড়ারী তিনটাঙা। অতি গরিব এই মানুষটার একমাত্র ছেলে ব্যতীত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ নেই। রোজকার খাবার ও দৈনিক চার আনা বেতনে সে নেলায় দোকানের আদায়কারী কর্মচারী হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে ম্যানেজারবাবু এই সৎ, নিঃস্ব ও নিরীহ মানুষটাকে বিনা সেলানিতে লবটুলিয়াতে বাস করার জন্য জমি দান করে। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখকের ভাষ্য :
অনেক ধরনের মানুষ দেখিয়াছি, কিন্তু গিরিধারীলালের মতো সাচ্চা মানুষ কখনো দেখি নাই। কত কাল হইয়া গেল, কত লোককে ভুলিয়া গিয়াছি, কিন্তু যাহাদের কথা চিরকাল মনে আঁকা আছে ও থাকিবে, সেই অতি অল্প কয়েকজন লোকের মধ্যে গিরিধারীলাল একজন।
[তদেব : ৫৭৭ ]
এমনই দীন-নম্র, অমায়িক চরিত্রের অধিকারী ছিলো অন্ত্যজ গাঙ্গোতা জাতির গিরিধারীলাল। দক্ষিণ দেশে খরার প্রকোপে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ঐ অঞ্চলের মানুষেরা জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে বিবিধ অঞ্চলে নাচ দেখিয়ে অর্থোপার্জনের জন্য বের হয়। ধাতুরিয়া এমনই একটি নর্তক দলের সাথে কাছারিতে আসে । তখন সে বারো-তেরো বছরের কিশোর ছিলো। তবে ঔপন্যাসিকের বক্তব্যানুযায়ী : ‘ধাতুরিয়া শিল্পী লোক—সত্যিকার শিল্পীর নিস্পৃহতা ওর মধ্যে আছে। [তদেব : ৫৯৫]। কেবল চীনা ঘাসের দানা এবং ভাঙ্গলে প্রাপ্ত বনজ সবজির বিনিময়েই সে এই দলের সাথে থাকতো, নাচ দেখিয়ে আয়কৃত অর্থের কোনো অংশ তাকে দেওয়া হোতো না। আর ধাতুরিয়ার মাঝে এ নিয়ে কোনো আক্ষেপও পরিদৃষ্ট হয় না।
আরণ্যক উপন্যাসে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের চরিত্রে আবির্ভূত নটুকনাথ পাঁড়ে। তার গ্রামের টোল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং একদিন কাহারিতে সত্যচরণের অফিসে এসে উপস্থিত হয় কাজের সন্ধানে। যদিও সেখানে তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না কারণ এসব বৈষয়িক কাজের কোনোকিছু সম্পর্কেই সে ওয়াকিবহাল নয়। তথাপি সে সত্যচরণের অনাপত্তির দরুণ কাছারিতে কিছুদিন থেকে যায়। সত্যচরণের ভাষ্যানুযায়ী,
মটুকনাথ টোলঘরের ডান্য জমি ও ঘর বাঁধিয়া দেওয়ার প্রার্থনা ছাড়া আমার কাছে কোনোদিন আর্থিক সাহায্য চায় নাই। কোনোদিন বলে নাই, আমার চলে না, একটা উপায় করুন না। কাহাকেও সে কিছু জানায় না, সিপাহীরা নিজের ইচ্ছায় যা দেয়। [তদের ৬১০ ]
পরবর্তীতে এই কাছারির পণ্ডিত নটুকনাথ পাড়ে গোলাবাধার পর থেকেই তার পাণ্ডিত্যের খাতির বহুগুণে বৃদ্ধি পায় ।
বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ অরণ্যভুমির একজন স্থানীয় কবি। ভাঙ্গলের কাছেই এই কবি তার সহধর্মিনীর সাথে বাস করে। কবি যশপ্রার্থী এই মানুষটি একবার তার স্বরচিত কবিতা শোনাতে সত্যচরণের অফিসে আসে এবং পরবর্তীতে সত্যচরণও তার বাড়িতে যায় এবং কবি ও কবিবন্ধুর আত্মিক আতিথেয়তা গ্রহণ করে।
০৫.
আরণ্যক উপন্যাসে মূলত গাঙ্গোেতা ও দোষাদদের বহুভঙ্গিন অন্ত্যজ জীবনের কাহিনি প্রতিফলিত। কৃষিকাজ ও পশুপালন দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীর প্রধানতম উপজীবিকা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় দেহাতী, গাঙ্গোতা, কাটনী-নজুর বৃদ্ধ নকহেদী, তার প্রথমা স্ত্রী তুলসী, দ্বিতীয়া স্ত্রী তরুনী মঞ্চী, কন্যাযুগল ভুরতিয়া, ছনিয়া, দেহাতী বনে পাওয়া বাঈজী কন্যা কুন্তাকে নিবিষ্ট চিত্তে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের অন্তর-বাহির আপন প্রজ্ঞাসত্তা দিয়ে অনুধাবন করেন। প্রকৃতি পরিবেষ্টিত সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের দৈন্যদশা ও বেদনাকে তিনি প্রতিভাসিত করেন উপন্যাসে বর্ণিত অন্ত্যজ গাঙ্গোেতাদের জীবনচিত্রের মধ্য দিয়ে। ধীমান বিভূতিভূষণ গন্ধবিদ্যা ও অর্জিত অভিজ্ঞানের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেন আরণ্যক উপন্যাসের নারী চরিত্রসমূহ। সমাজ ব্যবস্থার সব দিক থেকেই পশ্চাৎগামী এবং নিপীড়িত গাঙ্গোেতা নারী সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক দৈন্যের সঙ্গে-সঙ্গেই ধর্মীয় নাগপাশেও তারা বন্দি-শৃঙ্খলিত। সমাজের নিম্নশ্রেণীতে অবস্থান করায় তাদের নেই কোনো সামাজিক মর্যাদা ও ধর্মীয় অধিকার। তাই চারিত্র্য বৈশিষ্ট্যেও এরা নিম্নমার্গেরই হয়। তথাপি, এই অস্পৃশ্য শ্রেণী থেকে উঠে আসা কিছু চরিত্রের মাঝে কখনো-সখনো ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের বিচ্ছুরণ পরিলক্ষিত হয়। নঞ্চী, কুন্তা ও ভানুমতী তেমন চরিত্রেরই প্রতিভূ।
নাড়া বইহারের রাজপুতেরা ক্ষমতাশীল ও অত্যাচারী মানুষ। গাপোতা সম্প্রদায়ের মানুষের উপর এরা নিয়ত অত্যাচারে লিপ্ত থাকে। এখানে কুন্তার কথা বলা আবশ্যক। কুন্তার স্বামী রাজপুত দেবী সিং। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর তার দৈবাকাশে দুর্দিনের ঘনঘটা প্রকট হয়ে ওঠে। সহায়-সম্বলহীন বিধবা কুন্তার দুটি সন্তান নিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন অতিবাহিত হয়। অথচ একথাও সত্য যে:
এক সময়ে ও লবটুলিয়া থেকে কিংখাবের ঝালর দেওয়া পালকি চেপে কুশী ও কলবলিয়ার সঙ্গমে স্নান করতে যেত, বিকানীয় মিছরি খেয়ে ডাল খেত-আড্ডা ওর এই দুর্দশা!
[তদের ৫৭২]
আর এই সুযোগেই কুন্তাকে ভোগ করতে উদ্যত হয় রাসবিহারী সিংয়ের সহোদর হুটু সিং। তেজস্বিনী কুন্তা সেই নীচ-প্রস্তাব ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করে এবং হুটু সিংয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, নব উদ্যমে। শুরু করে তার জীবনসংগ্রাম।
শীতকালে ফসল তোলার সময় হলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে ফসল কাটতে লোক সমাগম ঘটে। ফসল তোলা শেষে তারা আবার ফিরে যায়। এমনই একটি পরিবারের সঙ্গে আগমন ঘটে মঞ্চীর। বৃদ্ধ নকছেদী ভকতের প্রথম স্ত্রী তুলসী ও দ্বিতীয় স্ত্রী তরুণী মঞ্চী। উচ্ছ্বল চরিত্রের অধিকারী মঞ্চী একজন গাঙ্গোতা তরুণী। মঞ্চীর সারল্য, স্বভাবসুলভ উচ্ছলতা, প্রকৃতির মতো সজীবতা সত্যচরণকে প্রভাবিত করে। মঞ্চীর অদ্ভুত সব গল্প শুনতে তার ভালো লাগে। সস্তা মনোহারি ও প্রসাধনী সামগ্রীর প্রতি তার আগ্রহ প্রবল। মঞ্চীর সরলতার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে সামান্য সাবান, চিরুনি বিক্রি করে অত্যধিক অর্থ হাতিয়ে নেয় তার মধ্য দিয়ে। একদিন হঠাৎ করেই মঞ্চী উধাও হয়ে যায় এবং সত্যচরণ ভাবতে থাকে হয়তো কোনো মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী তাকে প্রসাধনীর প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছে, আর তার শেষ পরিণতি নির্ধারিত হয়ে আছে আসামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোনো চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে জীবন অতিবাহিত করা ।
ভানুমতী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনবদ্য সৃষ্টি মহিমায় ভাস্বর আরণ্যক উপন্যাসের একটি অনন্য নারীচরিত্র। অরণ্যচারী চঞ্চল অথচ সরলা বালা ভানুমতী। অরণ্যের নিবিড় সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা নারীর গভীরতর জীবন বাস্তবতা, অবচেতনের কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা, প্রচলিত সমাজবীক্ষার বাইরে থেকে যাপিতজীবন অনুধ্যান, মনোলোকের একাকীত্ববোধ এবং হৃদয়স্থ নিভৃত প্রদোষের সূক্ষ্ম রোমান্টিক বেদনাবোধের বিকশন সাধিত হয় এই অরণ্যনন্দিনী ভানুমতীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে।
অন্যতম প্রধান চরিত্র এবং কাহিনিকথক সত্যচরণ নিতান্তই ঝোঁকের বশে শাল ও বিড়িপাতার জঙ্গলে গিয়ে কাঁটালতার ঝোঁপের মাঝে আপাত আড়ালে থাকা প্রস্তর স্তস্তে বিকট বোদাইকৃত মুখের অবয়বের পুরাকীর্তি আবিষ্কার করেন। কৌতূহলবশত নির্জন-নিভৃত বনপ্রদেশে প্রাচীন শিল্পমূর্তি নির্মাণের সূত্র অন্বেষণরত সত্যচরণ অবগত হন যে, সেখানে কোনো এক সুপ্রাচীনকালে সভ্যতাবিবর্জিত বন্যবাসী মানুষের রাজ্যপাট সুসজ্জিত ছিল। আর এটা সম্ভবত সেই বন্য আদিবাসীদের দ্বারা নির্মিত সীমানা-পরিধি নির্ণায়ক প্রস্তর স্তম্ভ। সে আরও জ্ঞাত হয় যে, মোহনপুর ফরেস্টের নাতিদূরে একটা অনতিবৃহৎ বস্তির চকমকিটোলায় তাদের অধস্তন উত্তরসুরিরা বসবাস করে। তাদের মধ্যে বর্তমান রাজা হিসেবে বস্তির সবার দেখভালের দায়িত্ব অর্থাৎ প্রজাপালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ আছেন দোবরু পান্না বীরবর্তী। আর ভানুমতী হলো এই বন্যরাজা দোবরু পান্নার নাতির কন্যা। যার সাথে প্রথম সাক্ষাতেই সত্যচরণের আত্ম-উপলব্ধি :
ভানুমতী নিটোল স্বাস্থ্যবতী, সুঠাম মেয়ে লাবণ্যমাথা মুবশ্রী-তবে পরনের কাপড়, সভ্যসমাজের শোভনতা রক্ষা করিবার উপযুক্ত প্রমাণ মাপের নয়। মাথার চুল রুক্ষ, গলায় কড়ি ও পুঁতির লানা। [তদেব : ৬২৮]
অধুনা ধনহীন, দীনহীন হলেও আতিথেয়তা ও সত্যচরণের প্রতি গোপন অনুরাগপ্রবণতা ভানুমতী চরিত্রকে ভিন্নমাত্রিক ও চিত্তাকর্ষক করে তোলে। মর্যাদাপূর্ণ আচার-ব্যবহারে ও প্রাপ্ত প্রাচীন আভিজাত্য চেতনার উদ্ভাসনের মধ্য দিয়ে ভানুমতী যথার্থই রাজকন্যা হয়ে ওঠে উপন্যাসে :
বিভূতিভূষণের মনে ইচ্ছা ভোগেছিল- ‘ভাঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখব। একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ গতিশীল ব্রাত্য জীবনের ছবি।” এই প্রতিশ্রুতিকে মূল প্রেক্ষণবিন্দুতে রেখে তিনি অরণ্য ও অরণ্যের মানুষগুলোর প্রবাহিত জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করেছেন নিবিড় আন্তরিকতায়। বন্য ও ব্রাত্যজীবনের মৌল প্রেরণায় সৃষ্ট ভানুমতী সত্যিই তাঁর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। আরণ্যক এর অরণ্যের কাহিনীতে সত্যচরণ প্রধান চরিত্রোচিত ভূমিকায় যদি নায়ক হন, তবে এই কাহিনীর কাহিনীর নায়িকা ভানুমতী। অরণ্যের গম্ভীর, ভয়াল ও রহস্যময় চরিত্র রূপায়ণে ভিন্ন মাত্রা লান করেছে সত্যচরণের প্রতি রাজকন্যা ভানুমতীর অকথিত ও অঘোষিত রোমান্টিক প্রেমানুভূতি। [ড. নাসরীন আখতার : ২০১৩ ৭৫] আরণ্যক উপন্যাসে ভানুমতী চরিত্রের শৌভিক শুচিস্নিগ্ধতা সত্যচরণের হৃদয়পটে এক নির্ণিমেন মুগ্ধতা ও ভালোলাগা বোধের উন্মেষ ঘটায়। কেবল একটি সাধারণ সাঁওতাল রমনীর নিতান্ত স্বাভাবিকতা নিয়ে ভানুমতী সত্যচরণের কাছে প্রকটিত হয়নি। সত্যচরণের উপলব্ধি :
এ-দেশের প্রান্তর যেমন উদার, অরণ্যানী, মেঘমালা, শৈলশ্রেণী যেমন মুক্ত ও দূরচ্ছদা-ভানুমতীর ব্যবহার তেমনি সঙ্কোচহীন, সরল, বাধাহীন। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারের মতো স্বাভাবিক। আদিম নারী আছে, সভ্য সমাজে সে নারীর আত্মা সংস্কারের ও বন্ধনের চাপে মূর্ছিত। ভানুমতীর মধ্যে যে
[হায়াৎ মামুদ, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা.)। ২০১৪ : ৬৪৪]
উল্লিখিত ভাব ব্যতিরেকেও তার মনভূমিতে অঙ্কুরিত হয় এমন বোধ যে ‘মূর্তিমতী বনদেবীর সঙ্গলাভ করিয়া ধন্য হইয়াছি। কৃষ্ণ-বনদেবী। রাজকুমারী তো বটেই।’ [তদেব : ৬৭৯]। রাজা দোবরু পান্না ঝুলন উৎসবে সত্যচরণকে নিমন্ত্রণ করলে সেখানে সত্যচরণের অভ্যর্থনায় ভানুমতীর যে আন্তরিক ও অনুরাগলিপ্ত পারিপাট্যের প্রতিফলন দেখা যায় তা ঔপন্যাসিকের চাপিয়ে দেওয়া বলে মনে হয় না বরং তা যেনো অরণ্য-নন্দিনীর হৃদয়ের প্রস্রবণ ধারাস্নাত হয়ে স্বতস্ফুর্তভাবে প্রকাশিত। সাধারণ খড়ের ঘর- গিরিমাটি দিয়ে যা লেপা, সে ঘরেই পদ্ম ও ময়ূরশোভিত অলঙ্করণ ভানুমতীর হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসার নির্যাসে ঋদ্ধ। পান-সুপারি ও ফলমূল-দুধ দিয়ে প্রিয়ের আপ্যায়ন শাশ্বতকালের প্রেয়সিমনের নিবিড় নিভৃত সমর্পণের ইশারা সমন্বিত ঈঙ্গিত প্রয়াস। সলজ্জ সাঁওতাল কন্যা ভানুমতী সত্যচরণের ভালোলাগার বিষয়-আশয়গুলো আত্মস্থ করে পরম সযত্ন-সাবধানতার সাথে। যদিও সত্যচরণের মনের অজান্তেই ভানুমতী তার মনোযোগ আকর্ষণ করে নিতে সক্ষম হয়। ঝুলন উৎসবে সত্যচরণের দৃষ্টি আলোকে ভানুমতীর রূপবর্ণনা :
ভানুমতীর পরনে একখানা জাম-রঙের খাটো শাড়ি হাঁটুর উপরে উঠিয়াছে, গলায় সবুজ ও লাল হিংলাভোর মালা। খোঁপায় ডালডা স্পাইডার লিলি গোঁজা। আরো স্বাস্থ্যবতী ও লাবণ্যময়ী হইয়া উঠিয়াছে ভানুমতী-তাহার নিটোল দেহে যৌবনের উচ্ছলিত লাবণ্যেও যান ডাকিয়াছে, [তদের ৬৪৪]।
প্রেমজনিত বেদনা বিরহবিধুর হয়ে তার চরিত্রে সংরন্ধ সংকটের ঝঞ্ঝা নিয়ে আবির্ভূত হয়নি; তথাপি প্রেনলিপ্সা আভাসে-ইঙ্গিতে প্রতিভাসিত হয় উপন্যাসে, যেখানে অন্যান্য সকল প্রণয়িনীর মতোই অভিন্ন সত্তার বিকিরণ করেন ঔপন্যাসিক। তবে কখনোই ভানুমতীর প্রেমচেতনা শরীরসর্বস্বতার দিকে ধাবিত নয়। মূলত তার চরিত্রে নেই কোনো অন্তপীড়ন, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব-সংকট, সমাজদহন, মনোজাগতিক বিকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক সামূহিক বিপর্যয়। আর একারণেই সে অন্যান্য সকলের চেয়ে পৃথক, প্রাতিস্বিক রূপায়ণে প্রমূর্ত । ভানুমতী তার জ্যাঠামশাই রাজা দোবরু পান্নাকে ভীষণ ভালোবাসতো। ফলে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভানুমতীর অন্তর্ভূবনে এক ধরনের বিষাদ, নিঃসঙ্গতা ও শূন্যতাজনিত ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর এই অবসাদজনিত শূন্যতার স্থান থেকেই সত্যচরণকে সে আস্থাসম্পন্ন ও ভরসাপ্রদায়ী একজন সহচর হিসেবে মনে করতে থাকে। মূলত কোনো সম্পর্করহিত এই মানুষটির কাছে সে অজান্তেই প্রিয়জন হারানোর বিষাদভার লাঘব করতে চায় এবং মানসিক মুক্তির সংশয়স্থল হিসেবে একান্ত নির্ভার অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চায়।
আবাল্য সরলা ও কোমল প্রাণের ভানুমতী আধুনিক সভ্য সমাজের শান্তিবিঘ্নিত, নৈরাজ্যময় কালপটে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, ফলশ্রুতিতে রিরংসাপীড়িত, বিবমিষাগ্রস্ত, মানবিকতাহীন বাস্তব সমাজপ্রেক্ষিত সম্পর্কে অজ্ঞাত এই অরণ্য-লালিতা কন্যা তার জ্যাঠামশাইয়ের সমাধিস্থল সত্যচরণকে দেখাতে নিয়ে গিয়ে অশ্রুবিজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে : ‘জ্যাঠামশাই চলে গেল, সংসারে আমার আর কেউ রইল না, বাবুজী—‘ [তদেব : ৬৫৪]। এখানে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনা ও কালের বিবর্তনে ভানুমতীকে আত্মসচেতন ও সমবেদনাকাঙ্ক্ষি করে তোলার ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক মুনশিয়ানার সাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। ঔপন্যাসিকের হাত ধরে এভাবেই ভানুমতী বাস্তব ও মানবিক সম্ভাবনার অভেদ্য প্রাচীরের কাঠিন্যকে ছেদ করে সহজ স্বপ্নালোকের দ্বারস্থ হয়ে পৌঁছে যায় তার কান্য ভাবকল্পলোকে। মূলত, উপন্যাসে ভানুমতী চরিত্রের স্বল্পায়তনিক স্থিতির মধ্য দিয়েও যাপিত জীবনসংরাগে বোধের অন্তপ্রদোষকে সে অনুরণিত করে তুলতে সক্ষম হয়।
পরিপ্রেক্ষণাধৃত হয় যে, ভানুমতী চরিত্রের মন্ত্রমুগ্ধতা, সংরাগলিপ্ততা ও মাধুর্যময়তা উৎপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়ে ওঠে সত্যচরণ যে মুহূর্তে লবটুলিয়ার নাড়া বইহার থেকে বিদায় নিতে প্রয়াসী তখন। ভানুমতীর কাছ থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়ার ঈঙ্গায় সত্যচরণ তার যাওয়ার বিষয় ভানুমতীর কাছে গোপন করে রাখে। কেননা তার অন্তর্গত অনুধাবন যে, তার অনাকাঙ্ক্ষিত আবির্ভাবে ভানুমতীর বন্ধ মনজানালার কপাট খুলে গিয়েছে, ফলে বাহিরের প্রতিবেশের এবং ভেতরের অন্তর্দেশের যে আকস্মিক সংলিপ্ততা সেখানে সাধিত হয়- তা আনন্দানুভূতির আলোকধারা হয়ে শতদিকে বিচ্ছুরিত হতে চায়। অকারণ কারণেই ভানুমতী সত্যচরণের সর্বদিকে সর্বাধিক খেয়াল রাখতে উদ্বিগ্ন। রাজা দোবরু পান্নার মহিষ কেনা, সেই মহিষকে বাঘে ধরা, প্রভৃতি গল্প বলে সত্যচরণের মনে নিজের সরল প্রতিনা প্রতিস্থাপন করে রাজকন্যা ভানুমতী ।
সাঁওতালদের প্রথানুযায়ী একান্ত কাছের মানুষ ব্যতীত অন্য কাউকে তাদের সমাধিস্থল পরিদর্শন করানো যায় না, অথচ ভানুমতী সাদর সান্নিধ্য আহ্বানেই সত্যচরণকে তার জ্যাঠানসাই দোবরু পান্নার সমাধিতে ফুল দেওয়ার জন্য নিয়ে যায়। অর্থাৎ সত্যচরণের প্রতি তার যে একান্ত ভালোবাসার ভাব তা এখানে অনুমিত হতে কোনো দ্বিধা থাকে না, তথাপি সেই সত্যচরণের বিদায়বেলায়ও তার মনের এই বাসনার কথা অব্যক্তই থেকে যায়, শুধু বনবাসী পাখির স্বভাব-সারল্যে বলে ওঠে : ‘আজ যেতে দেব না বাবুজী—’ [ তদেব : ৬৮৩] অথচ ভানুমতীর না বলা বহুকথার কথকতা রূপেই প্রকাশ ঘটে এই কথাটুকুর।
শাহরিক চতুর শাব্দিকতা, ক্লেদজ জীবন সংশ্লেষ, সংরক্ত প্রেমবাসনার দ্বিধান্বিত জটিল রূপ, যৌন কামনা- বাসনার রিরংসাতাড়িত উন্মোচনসহ সামূহিক সমাজ বাস্তবতার কোনোকিছুই ভানুমতী চরিত্রকে আচ্ছাদিত বা উদ্ভাসিত করতে পারে না। বরং ঔপন্যাসিক এই চরিত্রকে দীপ্ত আলোকফুটায় প্রতিভাসিত করে তোলেন এর অন্তর্গহীনে প্রোথিত থাকা রোমান্টিক স্বপ্নচারী তপস্যায়, যে তপস্যার ফল এই হিনদীর্ণ বাস্তব পৃথিবীতে পাওয়ার অবকাশ থাকে না। তাই তো প্রথমবার যখন সত্যচরণকে রাজা দোবরু পান্নার সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার জন্য ভানুমতী তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তখন সত্যচরণের মনোগত অনুভব :
মানি বা না-ই মানি, মনে মনে ভাবিলাম যে মেয়েটি আমাদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলিয়াছে, সে সত্যই রাজকন্যা- তাহার পূর্বপুরুষেরা এই আরণ্য ভূভাগ বহুদিন ধরিয়া শাসন করিয়াছিল সেই বংশের সে মেয়ে।
[তদেব : ৬২৮]
উপন্যাসের পারিপার্শ্বিকতায় অন্ত্যজ ও আদিন গোত্রভুক্ত রাজকন্যা কন্যা ভানুমতী দেশকালের সীমানা ছাঁপিয়ে কেবলই এক নিষ্ঠাবতী অরণ্যবাসী নন্দিনী। তার চরিত্রে সংযোজিত সেবা, মানবিকতা, আতিথেয়তা ও অনুরাগের পেলব প্রাঞ্জলতা ভানুমতীকে এক নবমাত্রায় উন্নীত করে- যা আপাত আধুনিক ও সভ্য দুনিয়ার বহির্দেশে অবস্থিত নিবিড় অরণ্য পরিবেশে অকপট বিরল সত্যরূপে প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, উপন্যসে সত্যচরণ ও ভানুমতী এই উভয়ের যতোবার সাক্ষাৎ হয় ততোবারই সত্যচরণের মনে এই উপলব্ধি হয় যে, অন্যান্য সকল নারীদের থেকে ভানুমতী ভিন্ন, ভানুমতী স্বতন্ত্র। ভানুমতীর মনস্তাত্ত্বিক পৃথিবীর ক্রমাগত যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন সাধিত হয় তাও সত্যচরণের দৃষ্টিসাম্যকে এড়িয়ে যায় না। ভানুমতীর আভিজাত্যের পরিচয় তার সাবলীল বেশভূষা, আটপৌরে প্রসাধন ও সাহজিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েও বিকশিত। প্রাচীন ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত অহন ও আভিজাত্যবোধ তাকে সাঁওতাল শ্রেণির বাইরে এক অনন্যতায় উন্নীত করে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আত্মালীন বিরহিণীর প্রমূর্ত প্রতিমা ভানুমতী বিভূতিভূষণের তো বটেই বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসেই এক অবিস্মরণীয় মানবী, এক অনবদ্য সৃষ্টি ।
০৬.
আরণ্যক-এর প্রকৃতি কেবলই পুষ্পশোভিত কোমল রমণীয় পথে এদের হাঁটতে শেখায়নি এটা ঠিক, কিন্তু সত্যকার সংশপ্তক মানুষরূপে গড়ে তুলে মায়া-মমতা-নৃসংশতায়। এই মোহিনী অরণ্যই তাদের চরিত্রের বিবিধমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ সাধনে সহচরের ভূমিকা পালন করে। ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে এখানের মানুষ লড়াইয়ের সমূহ নিয়ামকশক্তিকে নিজেদের স্বাত্মসত্বায় প্রোথিত করে নেয় নির্লিপ্ত গরিমায় । এভাবে অরণ্যভূমিই হয়ে ওঠে এই বনচারী অন্ত্যজ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের একমাত্র সহায়। অরণ্যসান্নিধ্যে প্রতিপালিত হওয়া এই অরণ্যবাসী মানুষের জীবনচেতনা, অনুষঙ্গ ও আচরিত প্রথা সংস্কার প্রকৃতিসনই কোমল-কঠোরের সুষম সংযোজন। প্রকৃতি এদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রবল ভূমিকা রাখে। প্রকৃতির মতোই এরা উদার, প্রকৃতির মতোই ভীষণ ভয়ংকর আবার প্রকৃতির মতো দৃঢ়তায়, সহিষ্ণুতায় ভাস্বর এদের চরিত্র, এদের জীবনপ্রণালী। উপন্যাসে এই বহুবর্ণিল মানুষের বহুভঙ্গিন জীবনসংগ্রামের চিত্রই প্রস্ফুটিত হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে ক্রমধাবমান গতিতে ভারতীয় সংস্কৃতি ও পরস্পরার অবলুপ্তি ঘটতে থাকে । বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষয়িষ্ণু মানবিক মূল্যবোধ আক্রান্ত ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থার মাঝে ইতিহাসের পুনরুজ্জীবন পান না, তাই তিনি প্রকৃতির কাছেই ফিরতে চান। তাঁর কাছে গুরুতপূর্ণ হয়ে ওঠে সেই সমস্ত মানুষ- যারা উপনিবেশের বাইরে যাপিত জীবনে অভ্যস্ত। আরণ্যক-এর প্রকৃতি ও মানুষ তারই প্রতিচ্ছবি। নাড়া বইহার- যেখানে উপনিবেশের এই আধুনিক কালেও মানুষ ঐতিহ্যভিত্তিক জীবন পরিচালন প্রক্রিয়ায় বসবাস করে। অনুমেয় হয় যে, তাঁর প্রকৃতি ও মানুষ এই তথাকথিত আধুনিকতার বিরুদ্ধে নীরব প্রশান্তিদায়ক প্রতিবাদ । নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের অখণ্ড ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র চরিত্র, ও বহুনত্রিক খণ্ড-বিখণ্ডিত ঘটনার সময়েই বহুভঙ্গিন মানবজীবনের সমগ্র রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। আরণ্যক উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবিচিত্র মানবচরিত্রের সেই চিত্রপটকেই প্রতিভাসিত করে তোলেন প্রাঙ্গ জীবনশিল্পীর পারঙ্গমতায়।
তথ্যসূত্র
১. ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত। কলকাতা: মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১২
২. হায়াৎ মামুদ, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা.)। বিভূতিভূষণ বন্ধ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ঢাকা: অবসর, ২০১৪
৩. ড. নাসরীন আখতার। বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করের উপন্যাসে অন্ত্যজ নারীচরিত্রের রূপায়ণ। ঢাকা : ধ্রুবপদ, ২০১৩