বিনয়, সৌন্দর্য পরিবেশনকারী এমন একটি প্রত্যয়, যা নিজের সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসে একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রকৃষ্ট আচরণের স্নিগ্ধতা। যেখানেই এর বিচরণ সেখানে আচার ও আচরণের একটি সুস্থ বিধান যেন আপনা-আপনি প্রতিষ্ঠা পায়। গ্রহণযোগ্যতায় কাঙ্ক্ষিত প্রত্যয় হিসেবে বিনয় শব্দটি দাড়িয়ে আছে সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষার শীর্ষে।
বিনয় শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কিংবা অন্তর্নিহিত অর্থ যা-ই হোক না কেন, এর লৌকিক অর্থ বোধ করছি সীমাবদ্ধতায় সংকীর্ণ। আর তা হচ্ছে বয়সে প্রবীণদের নিকট নবীনদের বিশেষভাবে নত থাকা, যা এই শব্দটির সম্ভাবনাকে বিস্তৃত পরিসর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
প্রকৃত অর্থে সুস্থ, শোভন, নমনীয়, মার্জিত আচরণই আপেক্ষিকভাবে বিনয়। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ক্রমশই মানবিকতা ভুলে যাওয়া এই প্রেক্ষাপটে সবারই অন্যের কাছ থেকে নমনীয় আচরণ একান্ত কাম্য। কিন্তু সংকটের বিষয় হচ্ছে এই যে, বিনয় প্রদর্শনকে সবাই নবীনদের কর্ম বলে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, প্রবীণ (বয়সে যারা বড়) বা অবস্থানে যারা উঁচুতে, তাদেরও যে বয়সে কিংবা অবস্থানে যারা ছোট, তাদের প্রতি বিনয় প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটা তারা প্রায় ভুলতে বসেছেস। আর শুধু যে এমন, তা তো নয়, বিনয় প্রদর্শনের বিষয়টি যে বয়স বা অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হয় না, এটাই অনেকে জানেন না বোধহয়। আর বিষয়টি নিয়ে ভেবেও দেখে না বেশিরভাগ মানুষ। এটি কেবল বয়সে, জাতে বা পয়সায় ছোটদের ভাবার বিষয় ভেবে বসে থাকেন অনেকেই। অথচ বিনয়ের অন্য নাম নমনীয়তা, ভদ্রতা।
বিনয়ী মানুষ সবার জন্য উদাহরণ। আমরা নিজের জন্য অন্যের পক্ষ থেকে অসামাণ্য বিনয় প্রত্যাশা করি, কিন্তু সেটা অন্যের প্রতি দেখানোর বালাই আমাদের নেই। আমরা বিনয় প্রদর্শন করা বলতে এক বাক্যে বুঝি বয়োজ্যেষ্ঠের সব কথাকে বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নেওয়া (তা তিনি অন্যায় বললেও), আমরা বিনয় প্রদর্শন বলতে বুঝি মুরব্বি বা ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে তর্ক তো দূরের কথা, তার বক্তব্যের বিপরীতে যুক্তি প্রদর্শনও না করা। আমরা বিনয় বলতে বুঝি পূর্বপুরুষের মৌলবাদকে সমর্থন করা। অথবা নিজের সুখ-সুবিধা বিসর্জন দিয়ে অকপটে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিকে গলা টিপে মারা। আমরা বিনয় বলতে বুঝি, গলা না তোলা কিংবা বিচার বিশ্লেষণের নিজস্ব ক্ষমতাকে অকেজো রেখে চুপ করে থাকা। বয়োজ্যেষ্ঠের অপরিণত আচরণের বিরুদ্ধ না দাঁড়ানো আমাদের এখানে শিষ্টাচার কখনো কখনো, যদিও সব বিষয়ে ভিন্ন মতপোষণ করাটা কখনোই যুক্তিযুক্ত নয়। তবে এ কথা সত্য যে, এই প্রতিষ্ঠিত বিনয়ে বিনয়ীরা যেকোনো অমানবিক ঘটনার জন্মদাতা নন, এ কথার সত্যতা নিয়ে সবারই সংশয় রয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, এই সংকীর্ণ বিনয় পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান না রাষ্ট্রকে কতটুকু উদ্ধার করেছে তা খতিয়ে দেখার অবকাশ কি নেই? আর শুধু বয়োজ্যেষ্ঠকে বিনাবাক্য-ব্যয়ে মেনে নিলেই কি বিনয় শব্দটি স্বমহিমায় আলো ছড়াতে সক্ষম? আর যদি তা-ই হয়, তবে যে পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রে এই বিনয় প্রদর্শিত হয় নিয়মিত, সেখানে কি কোনো অসন্তোষ নেই?
আপেক্ষিকতার জায়গা থেকে বলতেই হবে, অবশ্যই আছে। হয়তো লুকানো বিন্দুর রূপে পড়ে আছে পুঞ্জিভূত জীবনের কোনো এক ভাঁজে। সময়ের বাতাসে পৃষ্ঠা উল্টে গেলেই সেই বিন্দু সিন্ধু হয়ে উল্কা বেগে পাড়ি দেবে ভাঙনের চোরাপথ। বালির বাঁধের মতোন ভেঙে যাবে চুপ করে থাকার নড়বড়ে বিনয়ের দেয়াল, ভাঙনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দুর্বল-প্রশ্নবিদ্ধ ইট-বালি ও কাঁকড়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে জেনারেশন গ্যাপ বা দুটো প্রজন্মের মধ্যবর্তী দূরত্ব, বস্তুর আপেক্ষিক সত্তা, বিষয়ের বহুমাত্রিক সত্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে একাল-সেকালের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। তবে কি কথায় কথায় পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত ধ্যান ধারণার বিপরীতমুখী হওয়াই কাম্য? কখনোই না। নবীনের পক্ষে কর্তব্য হচ্ছে প্রবীণের সময়, পরিস্থিতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও জায়গাকে বুঝে চলা ও বলা এবং তার সঙ্গে বর্তমানকে সমন্বিত করার চেষ্টা করা। তবে প্রবীণ কি শত ভাগ প্রস্তুত নবীনকে মেনে নিতে? তবে যে মিথ্যে হয়ে যাবে অভিজ্ঞতার ধার?
প্রশ্নগুলোর উত্তর আপেক্ষিতা ছাপিয়ে কোনদিকে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, তা আজ বিবেচনার বিষয়। কারণ, সচরাচর কিন্তু মনে পড়ে না, বিনয়হীনতা কবে কোন ধার্মিককে মরমের মর্ম বোঝাতে পেরেছে, কোন কর্মীকে কর্ম!
মোটের ওপর কথা হলো এই যে, ছোটকে বা অধীনস্তকে ছোট বা অধীনস্তের মতোই থাকতে হবে, তবেই তো টিকে থাকবে জগৎ সংসার! একটা নিয়ন্ত্রণ তো থাকা চাই! সবাই সবার ওপর বললে তো শোনার কেউ থাকবে না! প্রবীণদের ইত্যাদি ইত্যাদি কথায় সুবিন্যস্ত (?) জীবন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চিন্তা মিশে থাকলেও নতুনের প্রতি বিনয় প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা থাকে কি না, এটা প্রশ্ন হয়ে থেকে যায়। যদিও তাদের তো আর কারও কাছে কোনো বিষয়ে বিনয় প্রদর্শনের প্রয়োজনই নেই। বোধ করি সেই জন্যই চির অবরুদ্ধ গৃহিণীর ছেলে সন্তান জন্ম দিতে চায় এবং তার বড় হওয়ার অপেক্ষায় সব সয়ে যায়। যেন প্রবীণ হলে সেও একই প্রেক্ষাপটের জন্ম দিয়ে কোনো এক পৈশাচিক আনন্দ পেতে চায়, যা তার চারপাশে দৃশ্যমান থেকে তার নবীনকালে তাকে সাপের মতো পৃষ্ঠে রেখেছে, যেখান থেকে নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর ছিল। কারণ, সুযোগ কেবল প্রবীণদেরই। নবীনের অবস্থান সমাজ মতে সেই আশার গুড়েবালি। যদিও অস্বীকৃত এই ধ্রব সত্যটি পরিণামে জন্ম দেয় প্রকৃত বিনয় ভাঙার নতুন অধ্যায়। কী আর করা যাবে, নিয়মের প্রতিষ্ঠিত কাঠামো এর বাইরে কোনো পথ তো দেখায় না, এই ই ঠিক আছে।
এ তো গেলো, ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে পারিবারিক পর্যায়ের মোদ্দাকথা। বিনয় তবে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে কী রূপে ক্রিয়াশীল তা বুঝে দেখার ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু কীরুপে দেখা সম্ভব? সমাজের তো আবার বিনয় প্রদর্শনের জায়গা কেবল সমাজপতিদের পদ যুগল, এ যুগলে বয়োঃপ্রাপ্ত রা থাকলে ভালো, আর না থাকলে তো কিছু করার নেই। সময়ের ব্যবধানে যদি পয়সা আর প্রভাব কচি কারও কাঁধে আসর জমায় তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ! বাচ্চা-বুড়ো সব তখন বিনয় প্রদর্শনে বাধ্য সেই পাতি নেতা বা সমাজপতির প্রতি। কারণ সবাই সবার প্রতি নমনীয় না ভদ্র হবে, এই নিয়ম তো কোথাও নেই! থাকলে না হয় বুড়োও ছোকরাকে মানতো। ছোকরাও মেনে নিতো বয়োজ্যেষ্ঠকে। যেখানে বিনয় জায়গা ও পরিস্থিতি বিশেষ সবার নয়, কারও কারও একার সম্পদ, সেখানে অনাচারের ‘অ’টাকে বাদ দিয়ে সব কিছুকেই আচার হিসেবেই ধরাই শ্রেয়। তবে, এটা অন্য কথা যে, লোকে নিজের ওপর হওয়া (তা সে যেকোনো বয়সে বা অবস্থানে থাকাকালীন) অনাচারজনিত শূন্যতাকে পূর্ণ করতেই নিজস্ব নিয়মে অধীনস্তের কাছ থেকে নমনীয় আচার প্রত্যাশা করে। যেখানেই এর ব্যত্যয় ঘটে, সেখান থেকেই সে একরাশ দুঃখ নিয়ে অভিশাপ বর্ষণ করতে করতে ফেরে। এর সঙ্গে বয়স, ক্ষমতা কিংবা পয়সার সম্পর্ক কম। কারণ, প্রকৃত বিনয় সবার প্রতি সবাই প্রদর্শন করে, কোনো এক পক্ষের দায় সেখানে একা থাকে না। আর সেখানে মালিক-শ্রমিক, সেবা দাতা-সেবাগ্রহীতা, বড়-ছোট, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সবাই সবাইকে বিনয় বা সুস্থ ও নমনীয় আচরণ দিতে বদ্ধ পরিকর। কারণ, মানুষ সেটাই পায়, যেটা সে দিতে জানে।
মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষের যার-যার জায়গা ও অবস্থান থেকে সন্মান, মূল্যায়ন-গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার অধিকার বোধ করি আছে যে, সন্মান, স্নেহ, মায়া-মমতা বা ভালোবাসা, দয়া কিংবা করুণা থেকে একেবারে ভিন্ন। সে সূত্রে পরিবারের বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন ছোট সদস্যের প্রতি সবচেয়ে বড় সদস্যের বিনয় প্রদর্শন অনুচিত কি যদি সে বিপরীতটি আশা করে থাকে?
সমাজের অস্পৃশ্য মানুষটিও কি মানুষ হিসেবে করুণা বহির্ভূত সন্মান ও যোগ্যতা ভেদে মূল্যায়ন পাওয়ার অধিকার রাখে না যা তার ভেতরে সঠিক শিক্ষার বিকাশ ঘটাবে, যে শিক্ষা তাকে অন্যের প্রতি অবনত হওয়া শেখাবে? কিংবা সেই অধীনস্ত কর্মচারিটি, যে কিনা অবস্থানে সবার নিচে সেও কি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে সঠিক সন্মানটি বা বিনয় সূচক আচরণটি আশা করতে পারে না, যা তাকে অহিংস মনোভাব নিয়ে পরিশ্রমী করে তুলবে?
তবেই কি সত্যিকারের বিনয়ে সবাই বিনয়ী হবে না, যে বিনয় ধরাবাঁধা কোনো একক আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে জন্ম দেয় না সংশয়, হীন মানসিকতা, হিংসা; অতপর পরিণামে অবাধ্যতা। প্রশ্নগুলোর উত্তর আপেক্ষিতা ছাপিয়ে কোনদিকে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, তা আজ বিবেচনার বিষয়। কারণ, সচরাচর কিন্তু মনে পড়ে না, বিনয়হীনতা কবে কোন ধার্মিককে মরমের মর্ম বোঝাতে পেরেছে, কোন কর্মীকে কর্ম!