বাংলা উপন্যাসের সফল যাত্রা শুরু হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। এর আগে বাংলা উপন্যাস সৃষ্টি হলেও সার্থক উপন্যাস পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বঙ্কিম পর্যন্ত। হ্যানা ক্যাথেলিন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ উপন্যাস হিসেবে মর্যাদা না পেলেও শুরুর আলোকরেখা ঠিকই নির্মিত হয়েছিল এ রচনার মাধ্যমে। এরপর কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ও প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা উপন্যাসের অভিযাত্রায় বিরাট ভূমিকা পালন করে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে প্রথম উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করে। বলা যেতে বাংলা উপন্যাসের প্রকৃত যাত্রটি এখান থেকেই। যদিও একটি উপন্যাস সার্থক হতে হলে যেসব গুণাবলি থাকা অপরিহার্য, সেসবের বেশ ঘাটতি এ উপন্যাসে থাকলেও, কিছু গুণও বেশ সফলতার সঙ্গেই উপস্থাপিত হয়েছে।
প্যারীচাঁদ মিত্র উপন্যাসের বিষযবস্তু, ভাষা, চরিত্র, সংলাপ সব কিছুই বাঙালির নিজস্বতা থেকে গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে কলকাতা-জীবনকেই তিনি উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন। এখানেই তাঁর মৌলিকত্ব ও সাফল্যের ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত। সে কারণে বাংলা উপন্যাসের প্রথম ও সফল ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান অসামান্য। বঙ্কিমচন্দ্র এ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই বাংলা উপন্যাসের সার্থক রূপায়ণ ঘটান। ইতিহাস ও রোমান্সকে তিনি উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলা ভাষা-ভাষী পাঠক বঙ্কিমের উপন্যাসের মাধ্যমে এক নতুন জগতের সন্ধান পান। যে জগত তাদের নিজস্ব। কিন্তু তা অচেনা ও অজানা ছিল। অথবা প্রকাশের আড়ালেই পড়ে ছিল।
রীতি-বিরুদ্ধ যে মানবসম্পর্ক সমাজ-ধর্মকে তোয়াক্কা না করে সমাজ-ধর্মের ভেতরেই বেড়ে উঠছিল, বঙ্কিমচন্দ্র সেটিকে উপন্যাসের উপজীব্য করে পাঠকের সম্মুখে তুলে আনেন। ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন বার্তা হয়ে ওঠে। বিধবাদেরও যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, আবেগ, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব, স্বপ্ন ও স্বপ্নঙ্গের যন্ত্রণা, ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় যে থাকে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক যে তাদের জীবনেরও অংশ—তার অসাধারণ রূপায়ণ ঘটান কুন্দনন্দিনী ও রোহিনী চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। নগেন্দ্র বিবাহিত জীবনে স্ত্রী সূর্যমুখীকে সুখী জীবন কাটানো অবস্থায় কুন্দনন্দিনী তাদেও জীবনে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে বলার চেয়ে বোধ হয় এটা বলাই যৌক্তিক হবে যে, নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীর প্রতি অসম্ভবরকম মুগ্ধ হয়ে কৌশণগতভাবে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিয়েছে। যা তাদের সংসার জীবনে বিষবৃক্ষের জন্ম দেয়। যা সমাজজীবনের রীতির বিরুদ্ধে প্রবল একটা ধাক্কাস্বরূপ। যেখানে রূপ লাবণ্য মোহ প্রধান শক্তি হয়ে ধর্ম ও রীতিতে বন্দি স্বামী-অন্তপ্রাণ সূর্যমুখীকে সংসারচ্যুত করেছে, যদিও সে পওে ফিওে এসেছে। কিন্তু বাঁচতে পারেনি কুন্দ।
নগেন্দ্রনাথের অদম্য মোহের বলি হয়েছে সে। নগেন্দ্রকে বিশ্বাস করে বিধবা কুন্দ তাকে ভালোবেসেছে, বিয়ে করেছে এবং বিষপানে তাকে হত্যা করা হয়েছে। নগেন্দ্র সুখী দাম্পত্যজীবনে থেকেও কুন্দ নন্দিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে সে সময়কার রীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংসারে অশান্তির আগুন জে¦লে কুন্দকে নিয়ে যে ভোগে মত্ত হয়েছে, সে মোহ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সামান্য কয়েকেদিনের ব্যবধানেই সে কুন্দ নন্দিনীর প্রতি মোহচ্যুত হয়ে সূর্যমুখীর প্রতি ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। মনস্তাতাত্ত্বিকভাবে সূর্যমুখীর প্রগাঢ় ভালোবাসা ও দায়িত্বের থেকে কুন্দনন্দিনীর রূপশ্রীতা তাকে ভেবেছে অনেক বেশি এবয় তা পাওয়ার জন্য সমাজ-সম্মান-পারিবারিক রীীত ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। কুন্দ তার অপ্রতিরোধ্য মোহের অনিবার্য শিকার হয়েছে।
কুন্দনন্দিনীর প্রেমে যে উজ্জ্বল স্নিগ্ধ পবিত্রতা ছিল, মোহের ছুরিতে তা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের যখন প্রথম দেখা, প্রেমটা সেখান থেকেই হতে পারতো অথবা হয়েছিল সেখানেই। কিন্তু তার বিকাশ ঘটাতে হয়েছে অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে। সেই সমাজে বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে কুমারী মেয়ের প্রেম-পরিণয় হয়তো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতো না, সেকারণেই কুন্দকে নগেন্দ্রনাথের জীবনে যুক্ত আগেই তাকে বিয়েতে বসানো হয়েছে এবং সেই দাম্পত্যজীবন গভীর ও দীর্ঘতর হয়নি। বলা যেতে পারে, দ্রুততার সঙ্গে তাকে বিধবাতে পরিণত করা হয়েছে। বিধবা বিবাহ নিয়েও সেখানে যুক্তিতর্কের ব্যাপার দেখানো হয়েছে। বিধবাবিবাহ সামাজিক সমস্যা হলেও নৈতিকতার দিকে থেকে তা পাপের ছিল না। কিন্তু সমাজে তখন বিধবাবিবাহ একটা আন্দোলনের ব্যাপার ছিল। নৈতিকভাবে যা-ই হোক বিধবা বিবাহ ঘটলে তাতে যে সামাজিকভাবে শাস্তিবহন করতে হবে, তা কুন্দনন্দিনীর মৃত্যুও ভেতর দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে।
নগেন্দ্র বিধবা কুন্দকে বিয়ে করে সমাজ-রীতিবিরুদ্ধতার শক্ত পরিচয় রাখলেও তার দৃঢ়তার অভাবে, মোহগ্রস্ততা ও মোহহীনতার কারণে তা ভেঙে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র রীতির পক্ষে নীতির পক্ষে সমাজের পক্ষেই দাঁড়িয়ে থেকেছেন, যেখানে জীবন তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। নীতিবাদী বঙ্কিমের কাছে শিল্পী বঙ্কিমের মৃত্যু হয়েছে। দেবেন্দ্রের পাপাচারি যে জীবন সে জীবনও সমাজবিরুদ্ধ। দেবেন্দ্রের জীবনের জটিলতা, নারীর প্রতি অদম্য নির্লজ্জ লোভ, হীরার অপ্রতিরোধ্য প্রেমাকাঙ্ক্ষা, ঈর্ষার আগুনে ভস্মিভূত মন, প্রতিশোধপরায়ণতা—এ সবই সেই সমাজের রীতি ভাঙার দুঃসাহসী প্রয়াস। একই ঘটনা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসেও ঘটেছে। ভ্রমরের সঙ্গে গোবিন্দলালের যে দাম্পত্যজীবন ছিল, তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। বরং সুখেরই ছিল। রোহিনীকে কেন্দ্র করে তাদের দাম্পত্যজীবনে ভয়াবহ সংকট ও সমস্যা তৈরি হয়েছে।
গোবিন্দলাল সমাজ-ধর্ম রীতি-নীতি সব ভেঙে তছনছ করে রোহিনীর সঙ্গে থেকেছে। তাকে সেবাদাসী করে রেখেছিল। স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। শেষপর্যন্ত তাকে হত্যাও করেছে। রূপজ মোহের কাছে সব ভেঙে পড়েছে। সে সময়ে পরিবার-সমাজ-ধর্মেও বাইরে বেরিয়ে এসে কোন নারীর সঙ্গে এভাবে অবাধ থাকাটা সহজ বিষয় ছিল না। যেটা গোবিন্দলাল করে দেখিয়েছে। এতে গোবিন্দলালের ভোগবাদী মানসিকতার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু রোহিনীর স্বপ্ন ছিল একটি সংসার, শুধু শরীরী ভোগ-পিপাসা নয়। সে কারণে রোহিনী গোবিন্দলালের সঙ্গে প্রসাদপুরে গিয়ে থেকেছে। প্রসাদপুরকে একেবারে আলাদা এক ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গোবিন্দলালের সঙ্গে সেখানে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন ভোগ করলেও বাস্তবে স্বামী-স্ত্রী হতে পারেনি তারা। রোহিনী নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও তা লাভ করতে পারেনি। কারণ দুজনের চাওয়া ছিল দুরকমের। একজন পরিবারে বন্দি হতে চেয়েছে স্ত্রীর অধিকারে—পরিপূর্ণ একটি সংসার লাভে বৃহৎজীবনে।
অন্যদিকে, গোবিন্দলাল সম্পূর্ণভাবে ভোগে মত্ত থেকেছে—শরীরলোভী। সেখানে পরিবার-সমাজ-ধর্ম-রীতি-নীতির কোন ধার ধারেনি সে। কিন্তু তার মনের ভেতরে পুরোটাই থেকেছে ভ্রমর। রোহিনী যখন বুঝতে পেরেছে বাস্তবে গোবিন্দলালকে স্বামী হিসেবে পাওয়া সম্ভব নয়, গোবিন্দলালে সেবাদাসী ভিন্ন সে অন্য আর কিছু নয়, তখুনি সে নিশিকান্তের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে, সেখানেও স্বপ্ন ছিল স্বামী-সংসার। আর এটাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ভোগবাদী গোবিন্দলালের কাছে। যার শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে মৃত্যু। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে রোহিনী তার মনের বাসনা স্পষ্ট করে গোবিন্দলালকে জানিয়েছে। কিন্তু গোবিন্দলাল তাতে কোন গুরুত্ব না দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। সমাজবিরুদ্ধ এ ধরণের উপন্যাসের ভিত মূলত বঙ্কিমের হাতেই প্রথম প্রতিষ্ঠা পায়। যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। তিনি এ ধারাতেই সৃষ্টি করেন জটিল মানবসম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিকভিত্তিক উপন্যাসে ‘চোখের বালি’।
মনোজাগতিক ব্যাপারটি এখানে ভয়াবহরূপে এসেছে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে তা কাজ করেছে। ভয়াবহ মনোদ্বন্দ্ব এ উপন্যাসে প্রমত্ত ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে, কিন্তু তা বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অথচ ভেতরে ভেতরে ভাঙচুর হয়েছে, মস্তিষ্কের খেলা হয়েছে। আর এসব ঘটছে পরিবারের ভেতর থেকেই। পারিবারিক উপাদানেই। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র, আশা, বিনোদিনী ও বিহারীর পারস্পরিক মনস্তাত্ত্বিক যে সম্পর্ক একথায় তা অভিনব। পরিবারের ভেতরে থেকেই তাদের মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি-প্রতিশোধপরায়ণতা—সবকিছু চলেছে। কিন্তু বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। বাংলা সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে ‘চোখের বালি’ প্রথম সফল উপন্যাস।
পরিবারের ভেতরে থেকেও পরিবারহীন, দাম্পত্যজীবনের ভেতর থেকেও দাম্পত্যহীন—স্ত্রীর পাশে থেকেও মহেন্দ্র বিধবা বিনোদিনীকে পেতে ব্যাকুল, বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর নীরব গভীর ভালোবাসা থাকলেও বিহারী বন্ধুপত্নী আশাতে দুর্বল থেকেছে, আবার আশা স্বামী মহেন্দ্রকে ভালোবাসলেও, মহেন্দ্র তাতে মগ্ন থাকে নি। বিহারীর প্রতি ভেতওে ভেতওে অনুরাগে ধাবিত হয়েছে। অথচ বাইওে থেকে এসবের প্রকাশ ঝড়োবাতাসের মতো পাগলাটে হয়ে ওঠেনি। সবকিছুই মন ও মস্তিষ্কের ভেতর ঘটেছে। অনুভব করা গেছে, প্রকাশের ছায়া অনুভব করা গেছে, কিন্তু তা অধরা ও দূরের থেকে গেছে। পরিবার ও সমাজরীতি বাইরে ভাঙতে ভাঙতেও ভাঙেনি, ভেতরে ভেঙে তছনছ হয়েছে, বাইরের কাঠামোটা ঠিকঠাক রয়ে গেছে।
এখানে রবীন্দ্রনাথ সমাজের রীীত-নীীত ভাবনায় বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসেও মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যঅপারটি যেমন এসেছে, ঠিক তেমনি মধুসূদন কুমুর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই পরকীয়ায় মত্ত থেকে সমাজ-রীতিকে যেমন ভেঙেছে, তেমনি নীতিকেও গলা টিপে হত্যা করেছে। সেখানে মধুসূদনের ভেতর মূলত কুমুর বাবার পরিবারের সঙ্গে মানসিক এক প্রতিশোধের ব্যাপার ছিল, যার ফলে মধুসূদন কুমুকে অসম্মানিত অবহেলিত ও অবজ্ঞায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কুমু কিন্তু মনের সমস্ত পূজার অর্ঘ্য দিয়ে সংসারটা করতে চেয়েছিল। প্রাপ্য সম্মান সেখানে তার জোটেনি।
মধুসূদনের মানসিকতাও কুমু অনুধাবন করতে পারেনি। কারণ মধুসূদন চেয়েছে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে, তার পূর্বপুরুষরা কুমুদের পরিবারে কাজ করতো। সেকারণে কুমুকে বিয়ে করে অত্যাচার করে নীরব প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চেয়েছে নব্যধনী মধুসূদন। এতে তার অসুসস্থ মানসিকতা তীব্ররূপ নিয়েছে। আর একটা ব্যাপার হলো, যারা দরিদ্র থেকে শ্রম-সাধনায় ধনী হয়ে ওঠে তাদেও মধ্যে প্রভুত্ব একটা ব্যাপার চলে আসে। তারা সবকিছুতেই স্বেচ্ছাচারি ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এদেও ভেতর মূল্যবোধ আদর্শ ও নৈতিকতা কাজ কওে না। সমাজকেও তারা অর্থের ক্ষমতা খাটিয়ে নিজের অনুকূলে নেয়।
মধুসূদনের ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটেছে। তবে একথাও ঠিক, কুমুর প্রতি মধুসূদনের মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল। তার অনিন্দ্য যৌবনশ্রীর প্রতি মধুসূদনের সম্মোহন ভাবও ছিল। আবার শ্যামাসুন্দরীর সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসেও পরিবারে-সমাজে থেকেওে বিমলার সঙ্গে সন্দীপের যে সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে, তাতেও হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের কাছে পাবিারিক ও সামাজিক বিধিনিষেধ এবং দেশমুৃক্তির বিপ্লব একপর্যায়ে পরাভূত হয়েছে। নিখিলেশ সবকিছু অনুধাবণ করেও স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসায় অপেক্ষা করেছে মানসিক এক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে। অবশেষে বিমলা নিজের ভুল বুঝতে পেওে নিখিলেশের কাছে ফিরেছে সমস্ত ভুলভ্রান্তি ছুড়ে ফেলে ভালোবাসার আকাশে। এখানে বলা যেতেই পারে, বঙ্কিমচন্দ্র দ্বারা যেভাবে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত, ঠিক একইইভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি এ আদলেই রচনা করেন নিজেই নিজের বৃত্ত ভেঙে ‘গৃহদাহ’। যা শরৎসাহিত্যে ব্যতিক্রম সাহিত্যকর্ম। এ ধারায় তিনি অন্য আর কোন উপন্যাস রচনা করেননি। আবার এ ধারাটির এখানেই যবনকিা ঘটেনি।
‘শরৎচন্দ্রের কোনো উপন্যাসে যদি মনন ও হৃদয়াবেগের সমন্বয় হয়ে থাকে, তা হলো গৃহদাহ।’ গৃহদাহ শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাস থেকে ভিন্নতর এক সৃষ্টি। ব্যতিক্রমও বটে। শরৎ উপন্যাসে যে সব নারী চরিত্র রয়েছে তাদের মধ্যে মূল দ্বন্দ্ব হলো প্রবৃত্তি ও সংস্কারের। এসব চরিত্র কখনোই সংস্কারের প্রাচীর অতিক্রম করতে পারেনি। যেমন ধরা যাক শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মী, চরিত্রহীনের সাবিত্রী, পল্লীসমাজের রমা, দেনাপাওয়ার ষোড়শী, পরিণীতার ললিতা ও দত্তÍ বিজয়া। এরা সবাই সংস্কারের কাছে পরাজিত চরিত্র। এক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন অচলা, গৃহদাহের অচলা। সংস্কারের প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা সে করেছে, ভেঙেছেও। প্রবৃত্তির দ্বারা যেমন সে পরিচালিত হয়েছে, তেমনিভাবে সংস্কার ভাঙার দুঃসাহসিকতাও লক্ষণীয়। সমাজ-সংস্কারে বাস করেও, এসবের ভেতর থেকেই সমাজ-সংস্কারকে তুচ্ছজ্ঞান করে নিজের মতো করে নিজেকে এগিয়েছে, নিজের ভবিষ্যৎ—ভালো-মন্দ—নীতি-নৈতিকতা এমনকি পাপ-পুণ্য এসবের তোয়াক্কা করেনি। শরৎ-সাহিত্যে একেবারেই আলাদা এক সত্ত্বাধারী নারী হয়ে-উঠেছে অচলা।
শরৎচন্দ্রের শিল্প-সাফল্যের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে। এ উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি নানাদিক থেকেই প্রচণ্ড হিসেবেী ছিলেন। অতিকথন, ভাবালুতা, ভাষাগত শৈথিল্য ত্রুটিমুক্ত এ উপন্যাস। চরিত্র নির্মাণে বৃত্তভাঙা, বিষয়বস্তুতে অভিনবত্ব, সমাজ-সংস্কার রীতি-বিরুদ্ধ পরকীয়া সম্পর্ক- এ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক। শরৎ-এর কোনো উপন্যাসে একই সাথে মনন ও হৃদয়াবেগের সমন্বয় দেখা যায় না। গৃহদাহের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। এখানে মনন ও হৃদয়াবেগের সমন্বয় লক্ষণীয়। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে মূলত নিষিদ্ধ সমাজ-অনুমোদিত প্রেম এবং সমাজের রীতি-নীতি ও সংস্কারের কঠিন সমালেঅচনা থাকে। এসব কারণে তাঁর উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা অবিশ্বাস্যরকম। কিন্তু একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে ‘সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ প্রেমকে শরৎচন্দ্রই প্রথম উপন্যাসের উপজীব্য করেননি।’ বিদেশে যখন উপন্যাসের গোড়াপত্তন হয়েছে সেসব দেশেও সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ প্রেমকেই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
আমাদের দেশেও যখন উপন্যাসের গোড়াপত্তন ঘটে, সেক্ষেত্রে দেখা গেছে নিষিদ্ধ প্রেমই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুযত্ব পেয়েছে। এখানে আরো পরিষ্কার করা দরকার এই নিষিদ্ধ প্রেম সমাজ-বিগর্হিত। মধ্যযুগীয় রোমান্সের নিষিদ্ধ প্রেম নয়।এ দুইয়ের ভেতর পার্থক্য আছে ঢের। এ প্রসঙ্গে একজন গবেষক-সমালোচকের বক্তব্য স্মর্তব্য: ‘মধ্যযুগীয় রোমান্সের নিষিদ্ধ প্রেম অপেক্ষা ঔপন্যাসিকের ব্যবহৃত নিষিদ্ধ প্রেমের তাৎপর্য অনেক । এবং এই গভীরতাটুকুর জন্য উপন্যাসের অঅধারের কোনো বিকল।প নেই। মধ্যযুগের নিষিদ্ধ প্রেমের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এই প্রেম সম্বন্ধে কোনো দ্বন্দ্ববোধ ছিল না। নিষেধটা আরোপিত ছিল বাইরে থেকে। রোমিও-জুলিয়েটের পরস্পর প্রেমে কোনো সংশয় ছিল না। নিষেধ বা গোপনতা প্রয়োজনীয় হয়েছিল বাইরের বাধার জন্য। কিন্তু ভ্রন্স্কি এবং আনার-র প্রেমের মধ্যে নিষিদ্ধতা বাইরের দিক থেকে থেকে প্রকাণ্ড নয়। মনের দিক থেকে থেকেই সে বাধা অতিকায়।ব্যক্তি সচেতনার একটি আশ্চর্য পরিণাম হল এই যে, মানুষ বুঝল সমাজ নামক ব্যাপারটি লোক-সমষ্টির যোগফলে বিরাজিত নয়।
লৌকিক সম্ভ্রমের খাতিরে রামবাবুর অনুরোধে অনিচ্ছায় সুরেশের শয্যাসঙ্গিনী হয়, সুরেশের নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানে ভেঙে পড়ে, আবার তারই প্রতি সহানুভূতিতে ব্যাকুল হয়।
সমাজই বলা হোক, বা জীবন সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার প্রচলিত মানই বলা হোক, এ সমস্ত কিছুর বাঁধন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মানসের নিভৃতে।’ নিষিদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে রচিত কালজয়ী উপন্যাসের দৃষ্টান্ত বিদেশি সাহিত্যে অনেক আছে। ‘আনা কারেনিনা’, ‘মাদাম বোভারি’ কিংবা ‘লোডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ এখানে উল্লেখযোগ্য। আমাদের সাহিত্যে সফল শিল্প-সার্থক উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিও নিষিদ্ধ প্রেমকেই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিলন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘চন্দ্রশেখর’ উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ গোবিন্দলাল যে রোহিণীকে ভালোবেসেছিল একথা বহুভাবে উল্লেখ আছে। এ ভালোবাসা সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ ভালোবাসা। আর ধারায় রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ও ‘নষ্টনীড়ে’র নাম অবধারিতভাবেই আসে। ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনী যে বিহারীকে ভালোবেসেছিল তাওতো নিষিদ্ধ প্রেম।
এমনকি মহেন্দ্রের বিনোদিনীর প্রতি গভীর অনুরাগ, প্রবল হৃদয়াবেগ তা তো সমাজ-সংস্কার বিরুদ্ধ প্রেমই। একটু আগেই তা আলোচনা করেছি। শরৎচন্দ্র এ-রকম প্রেম নিয়ে লিখেছেন এঁদের পরে। ‘বিনোদিনী ও শরৎচন্দ্রের অসংখ্য নায়িকাকুলের মর্ধ্যে একটা আপাতত সাদৃশ্য বিদ্যমান।…শরৎচন্দ্র গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে বিনোদিনীর চরিত্রের প্যাটার্নের বাইরের সসীমারেখাকে অনাহত রেখেছিলেন। বিনোদিনীর মতো বাকপটু, রসিকা, গৃহকর্মনিপুণা, সেবাপরায়ণা এবং পরকে আপ্যায়ণে-শুশ্রুষায় পারদর্শিনী শরৎচন্দ্রের সমুদয় নায়িকা। …শরৎচন্দ্রের অধিকংশ নায়িকাই সেদিক থেকে বিনোদিনীর ছায়ায় গঠিত। রবীন্দ্রনাথও এই চরিত্র বিন্যাসের জন্য বঙ্কিমের কাছে ঋণী। রোহিণী ও বিনোদিনীতে বিস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও দেখা যায় রোহিণী মাঝে মাঝে বিনোদিনীতে পরোক্ষ এবং সুদূর প্রভাবসম্পাতী।রোহিণী গৃহকর্মনিপুণা, রন্ধনে দ্রৌপদীবিশেষ, ফুলের গহণা,খেলনা রচনায়, চুল বাঁধার বিভিন্ন কৌশলে অদ্বিতীয়া।’
রোহিণী যে প্রবলভাবে বিনোদিনীতে প্রভাব বিস্তার করে আছে, তা এড়িয়ে যাবার অস্বীকার করার উপায় নেই। বিনোদিনী সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের রোহিণীকে স্মরণে রেখেছিলেন তা স্পষ্ট। তবে এ চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে ব্যক্তিসত্বার বিকাশ ঘটানোই ছিল মূল। বিনোদিনীল যে সমস্যা সে-সমস্যাকে প্রেম-কাতরতা এক নারীর সমস্যা হিসেবে ভাবা যায় না। বিনোদিনীর সমস্যাটি ছিল সে সারাজীবন অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে। সমাজ-সংস্কৃতির এক কঠিন ছকে বাঁধা তার জীবন। এই ছকের বিরুদ্ধে সে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছিল বিহারীকে নিয়ে। রোহিণীও তো চেয়েছি গোবিন্দলালকে নিয়ে ছকেবাঁধা সমাজ-সংসকার ভেঙে নতুন জীবনের দৃঢ়তায় মাথা তুলে দাঁড়াতে। অচলা চরিত্রে এই দৃঢ়তা অতোটা না থাকলেও, সেও সমাজ-সংস্কার ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছিল।
‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের সাথে ‘ঘরে-বাইরে’র ফ্রেম বা প্যাটার্নেরও কিছুটা মিল বা সাদৃশ্য রয়েছে। গৃহদাহ বের হয় ১৯২০ সালে। ঘরে-বাইরে বের হয় এর বছর চারেক আগে। অর্থাৎ ১৯১৬ সালে। ফলে শরৎচন্দ্র গৃহদাহ রচনার আগে ঘরে-বাইরে স্মরণে রাখবেন এটা অনুমান করা অস্বাভাবিক নয়। এ দুটি উপন্যাসই ত্রিভূজ প্রেমের। দুক্ষেত্রেই নারী প্রধান। নারীকে ঘিরেই উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে। দুটি উপন্যাসেই সামাজিক ও হৃদয়গত সমস্যার নানাকৌণিক বিশ্লেষণ রয়েছে। গৃহদাহের অচলার সাথে মিল রয়েছে ঘরে-বাইরে’র বিমলাকে। আর মহিম ও সুরেশের পাশে দিব্যি দাঁড় করিয়ে দেয়া যায় নিখিলেশ ও সন্দীপকে। তবে ‘আধুনিক নারী ও পুরুষের আত্মচিন্তাা, দাম্পত্য নিয়ে পুরুষের আত্মজিজ্ঞাসা, নারীর আত্মশুদ্ধি যে-ভাবে ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে শিল্পরূপ পেয়েছে, ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে তার সমর্থন নেই। গৃহদাহে শরৎচন্দ্র তাঁর নিজের মতো করে চরিত্রগুলোকে গড়েছেন।
‘ঘরে-বাইরে’র উম্মাদনাপূর্ণ রাজনৈতিক পটভূমি গৃহদাহে নেই, ব্যক্তিত্বের অনুকূল বিকাশক্ষেত্রও নেই, অঅছে জীবন-সমস্যার তীক্ষ্ণ রূপায়ণ।’ আধুনিক নরনারীর মধ্যে যে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা বিরাজিত, তা শরৎচন্দ্র ধরার চেষ্টা করেছেন। আধুনিক জীবনের বড় সমস্যা সে কী করতে করতে চায় তা সে নিজেই জানে না। নিজের চাওয়া-পাওয়া এবং নিজের নির্দিষ্ট গন্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা থাকে না। যে কারণে অঅধুনিক জীবনে স্ববিরোধী আচরণ চরিত্রের বড় এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর এ কারণে তাকে মর্মান্তিক পরিনতি বরণ করতে হয়। এ ব্যাপারটি ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে শিল্প-নৈপুণ্যে চিত্রিত হয়েছে।
আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র (১৯০৩) প্রভাব ‘গৃহদাহ’-তে রয়েছে। যেমন চোখের বালিতে ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র প্রভাব আছে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ বিধবা তরুণী রোহিনীর সঙ্গে গোবিন্দলালের বিবাহবর্হিভূত সম্পর্ক, রক্ষিতা করে রাখা, স্ত্রীর মর্যাদা না দেয়া এবং শেষে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এটি শিল্পসত্ত্বাকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে যেমন, তেমনি রোহিনীর নারীহৃদয়ের যে চির চাওয়া স্বামী-সংসার তা হয়ে ওঠেনি—বিধবা হওয়ার কারণে। কিন্তু বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তার শরীর সম্ভোগ ঠিকই করেছে গোবিন্দলাল। সমাজ সে-সময় বিধবা-বিবাহ অনুমোদন করবে না বা বিধবা বিবাহ দেয়ার মতো সাহস ‘নীতিবাদী’ বঙ্কিমবাবু নিজেও দেখাতে পারেননি। তিনিও সমাজ-অনুগত মানসিকতা দেখিয়েই রোহিনীকে হত্যা করে সমাজ রীতি-নীতিকে উর্দ্ধে তুলে ধরেছেন। এক তরুণী বিধবা নারী-হৃদয়ের স্বপ্ন-সাধ মূল্যহীন হয়ে গেছে।
‘চোখের বালি’তে বিধবা সুদর্শনা বিনোদিনীকে রোহিনীর মতো হত্যা করেন নি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তার স্বপ্ন-সাধ ভরা ঘরও দেন নি। সুকৌশলে পাঠিয়ে দিয়েছেন কাশিতে। সমাজ-সংস্কৃতিই বড় হয়ে উঠেছে এখানেও। বিনোদিনী বিহারীকে ভালোবাসতো। মহেন্দ্র ভালবোসতো বিনোদিনীকে। বিহারীর সাথে তার ঘরটা হতে পারতো। অথবা সমাজ-সংস্কার ভেঙে মহেন্দ্রও তো তাকে বিয়ে করতে পারতো। এসবের কিছুই ঘটে নি। কারণ বিনোদিনী বিধবা। বিধবার বিবাহ সমাজ গ্রহণ করবে না। এই বৃত্তভাঙলেন না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ বিধবাবিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের পরেই তার অবস্থান। তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথের সাথে বিধবা প্রতিমা দেবীর বিবাহ দিয়েছিলেন।
‘চোখের বালি’ যেমন নারীকেন্দ্রিক, ‘গৃহদাহ’ও তাই। বিনোদিনীকে ঘিরেই যেমন ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি গতিপ্রবাহ এগিয়েছে. শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে, ‘গৃহদাহ’-এর ক্ষেত্রে অচলা। বিনোদিনী না থাকলে যেমন মহেন্দ্র থাকে না, বিহারীও থাকে না, গৃহদাহেও ঠিক তাই—অচলা যেখানে মহিম ও সুরেশ সেখানে, অচলাহীন মহিম সুরেশকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুটি উপন্যাসই সমাজ-সংস্কৃতি ও হৃদয়াবেগ সম্পর্ক —পরকীয়া প্রেমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। তবে দুটো উপন্যাসে চিন্তা চেতনা, শিল্প-সুষমা ও বিষয়বস্তুতে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান ।
‘গৃহদাহে’র কাঠামোগত দিকটি একটু দেখা যাক। এ উপন্যাসে চুয়াল্লিশটি পরিচ্ছেদ আছে এবং তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব ১ থেকে ১৯ পরিচ্ছেদ। এ পর্বে রয়েছে সুরেশ ও মহিমের গভীর বন্ধুত্ব। মহিম ও অচলঅর প্রেম ও বিয়ে। এ-বিয়েতে সুরেশের প্রবল আপত্তি। অচলার প্রতি সুরেশের অন্ধ মোহ। মহিমের গ্রামের বাড়িতে সুরেশের আকস্মিক যাত্রা। মহিমের ঘরে আগুন। দ্বিতীয় পর্ব হলো ২০ থেকে ৩৭ পরিচ্ছেদ। অচলার প্রত্যাবর্তন। মহিমের অসুস্থতা। সুরেশের বাড়িতে মহিমের চিকিৎসা। মহিম ও সুরেশ-দুজনের প্রতিই অচলার আকর্ষণ। জব্বলপুরের পথে ট্রেনে মহিমকে নিয়ে অচলা। সঙ্গে সুরেশ। এলাহাবাদ থেকে অচলাকে সুরেশের নামিয়ে নেয়া। ডিহরীতে রামবাবুর বাড়িতে দুজনের স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাস। ঝড়-জল-দুর্দিনের এক রাতে সুরেশকে অচলার দেহদান। তৃতীয় পর্ব হলো ৩৮ থেকে ৪৪ পরিচ্ছেদ। এ পর্বে রয়েছে সুরেশের মোহমুক্তি। অচলাকে মুক্তি দেবার প্রতিজ্ঞা। প্লেগ রোগীর সেবা এবং নিজে আক্রান্ত হয়ে সুরেশের মৃত্যু। প্রাণহীন সুরেশের পাশে অচলা ও মহিম এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন। শেষে উপদ্রুত-অপমানিত, ক্ষতবিক্ষত নারী-হৃদয় অচলার ভয়াবহ একাকিত্ব ও দুঃসহ শূন্যতার ভেতর দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি।
‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে জীবনের সমস্যাকে নানকৌণিকভাবে রূপায়ণের একটি ব্যাপার রয়েছে এবং এটিই মূল ব্যাপার। নারীর অবৈধ প্রেমকে সমাজ-সংসার-ধর্ম কখনো ভালো চোখে দেখেনি। বরং এটিকে সামাজিক সমস্যা হিসেবেই দেখা হয়। সাহিত্যেও এই প্রবণতাটি মারাত্মকরকমের বেশি। গৃহদাহ-এর মতো উপন্যাসকে এ দোষে আক্রান্ত করা হয়—‘গৃহদাহের মতো উপন্যাসের আলোচনায় সতীত্ব ও নৈতিকতার দিক থেকে সমাজ নিয়ে প্রায়ই টানাটানি হয়ে থাকে।’ জীবন ও সমাজের নানাকৌণিক মনঃস্তত্ব-রসায়ন যে কঠিন হয়ে উঠেছে, আধুনিক জীবন সমাজের বিধি-নিষেধ মেনে চলে না, নিজস্ববোধে চলতে চায়—তখনই সমস্যাটি খাঁড়া হয়ে দাঁড়ায়। এ উপন্যাসে এ সমস্যা প্রবলতর হয়ে উঠেছে। আধুনিক জীবনের এসব সমস্যা শিল্পনৈপুণ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। সবকিছুর পরেও জীবনে যেটি বড় সত্য তাহলো সবকিছুতে জোর বা জুরাজুরি বা শক্তি প্রয়োগ করা গেলেও ভালোবাসার ক্ষেত্রে এটি একদমই খাটে না। ছলে-বলে-কৌশলে অনেক কিছুই পাওয়া সম্ভব হতে পারে, কিন্তু প্রেম নয়। প্রেম পেতে হলে সাধনাটি মূল। ছলে-বলে-কৌশলে যদি প্রেম পাওয়া সম্ভব হতো, তাহলে সুরেশ অচলার প্রেম পেতো। পায় নি। শত চেষ্টাতেও সুরেশ অচলাকে নিজের করে পায় নি। অচলার শরীর পেলেও অচলার মন তার পাওয়া হয় নি। বরং এর পর অনুশোচনায় সে দগ্ধ হয়েছে, যা তাকে মৃত্যুর কাছে সমর্পিত করেছে। উপন্যাসের মূলভাব তো এটিই—ভালোবাসা জোর করে হয় না, ভালোবাসার উপর জোর খাটে না। এই সত্যটিই এ উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত।
‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অচলা। বলা যেতে পারে, উপন্যাসটিই অচলাকেন্দ্রিক। এ উপন্যাসে সুরেশ ও মহিম গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্র। দুজন বন্ধুও। স্বভাব-চরিত্রে দুজন দুরকমের। এ দুজনের ভেতরে একসময় অচলা চলে আসে এবং অচলাকে ছাড়া দুজনকে আর পাওয়া যায় না। ‘গৃহদাহে’র নায়িকা অচলা। কিন্তু নায়ক কে—সুরেশ না মহিম— নাকি দুজনেই! যদি দুজনেই হয় তাহলে প্রথম কে—নাকি দুজনেই কেইই নায়ক নয়! নায়কহীন উপন্যাস! এ প্রসঙ্গে একজন সমালোচকের বক্তব্য স্মরণযোগ্য: ‘মহিম কিন্তু উপন্যাসের নায়ক নয়। সুরেশও নয়। গৃহদাহে নায়ক নেই, এটি নায়িকা-প্রধান কাহিনী। গল্পে-উপন্যাসে নায়ক থাকলেই নায়িকা থাকতে হবে এবং নায়িকা থাকলেই নায়ক, এই কুসংস্কার দূর না করলেই নয়। কখনও হতে পারে, কিন্তু হতেই হবে তারও কোন মানে নেই। এই উপন্যাসে অচলা ১ নং চরিত্র, তুলনায় অনেক পরে থেকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান মহিম ও সুরেশের। কে ২ নং কে ৩ নং তা নিয়ে তর্ক হতে পারে।’
তর্কের সুযোগটা এখানে আছে। গোটা উপন্যাসে অচলা যেখানে, সেখানেই সুরেশ কিংবা মহিম অথবা দুজনেই। অচলার কারণেই যেন সুরেশ ও মহিমকে আবিষ্কার করা হয়েছে। সুরেশ ও মহিম অচলা-নির্ভর। কিন্তু তাদের উপর নির্ভর করে অচলা চলেনি। অচলার পথ অচলার মতোই। নিজস্বতায় বিকশিত। অচলার চরিত্র নিয়ে নানা কথা আছে। শরৎ-সৃষ্টিতেও অচলা এক ভিন্নমাত্রিক সৃষ্টি—একথাও সমালেঅচক গবেষকরা বলেছেন যুক্তি-তর্ক নানাভাবেই। আবার অনেকে বলেছেন, অচলা শরৎ-সৃষ্টির চরিত্রগুলোর ধরা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। একই ধারায় পর্যবসিত হয়েছে। দুরকম কথাই সমালোচকরা বলেছেন। শরৎ-এর উপন্যাসে ‘প্রধান নারীদের মধ্যে প্রায়ই একটি মাতৃ-প্রতিমার প্রতিষ্ঠা ঘটান হয়—আদি মাতার আর্কিটাইপ এবং সহজাত নেতৃত্বের এক দৈবী ক্ষমতা।’ অচলার মধ্যে এ ব্যাপারটি লক্ষ করা যায় না। এ প্রসঙ্গে একজন সমালোচকের বক্তব্য: ‘অচলার মধ্যে কোথাও এই মাতাকে, এই নেত্রীকে—যিনি শাসন করেন পালন করেন এবং ধারণ করেন, তাঁর সরল বা বক্র কোনরূপ প্রতিফলন দেখি না। অচলা কোন বুভুক্ষ প্রেমিকের সামে ন সযত্নে খাদ্যের থালা ধরে দেয় নি। নায়কেরা যখন ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রণে বেসামাল, সে অসামান্য পটুতায় কোন সংসারের হাল ধরেনি।
আবার এর উল্টো কথাও আছে। অচলা শরৎ-সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলোর মাতৃ-দেবী প্রতিমার বাইরে বেরুতে পারে নি। শরৎ- তাঁর উপন্যাসে অন্য নারীদের যেভাবে মমতাময়ী সেবাপরায়ণবতী করে চিত্রিত করেছেন, অচলা তাইই। আলাদা কিছু নয়। নিজস্ব ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি অচলা। বাঙালি নারীদের চিরাচরিত মমতাময়ী ও সমাজ-অনুসৃত ও অনুরক্ত যে রূপ তাইই হয়ে উঠেছে অচলা। ‘অচলা-চরিত্র নির্মাণে শরৎচন্দ্র তাঁর অভ্যস্ত ছকের বাইরে যেতে পারেন নি। করুণা, সমবেদনায় সে ক্ষুধার্ত বা অসুস্থ সুরেশের সেবা করে, রোগা মানুষ মহিমের বিপদাশঙ্কায় ব্যাকুল হয়। লৌকিক সম্ভ্রমের খাতিরে রামবাবুর অনুরোধে অনিচ্ছায় সুরেশের শয্যাসঙ্গিনী হয়, সুরেশের নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানে ভেঙে পড়ে, আবার তারই প্রতি সহানুভূতিতে ব্যাকুল হয়।’
অচলাকে দ্বিচারিণী বা দোলাচল নারী হিসেবে বড় একটা দোষ বা কলংকের ভার তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়। সত্যিকার অর্থেই কী অচলা দ্বিচারিণী ছিল। অচলা কী সত্যিকার অর্থেই কাউকে ভালেঅবাসতে পেরেছিল বা সে সময় কী সে পেয়েছিল! অচলা তো ঘটনার-দুর্বার অপ্রতিরোধ্য তোড়ে এগিয়ে গেছে। নিজেকে বোঝার বা নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সে পায় নি। ‘অচলা ঘটনা-তাড়িত, আকস্মিকতায় লাঞ্ছিত। অচলার জীবনে মহিমের প্রয়োজন কতোটা, সুরেশের ভূমিকা কতোটা, তা প্রমাণের জন্য যে অবকাশ প্রয়োজন ছিল, তা লেখক দেন নি।’
অচলা-চরিত্র নানামাত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এসবের যথাযথ মূল্যায়নের একটি প্রয়াস পাবো। অচলার প্রেম, অস্থির হৃদয়াবেগ, দূরদর্শিতার অভাব, সংস্কার ভাঙা, সহানুভূতি, অনুতাপ, ভয়ানক শূন্যতা ও দুঃসহ একাকিত্ববরণ এবং এসবের ভেতর দিয়ে অচলা আদৌ তার ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল কীনা—এসব বিশ্লেষণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এসব নিয়ে রয়েছে বহুমুখী জিজ্ঞাসা। একইভাবে বহুমুখী জিজ্ঞাসাবৃত্তে বন্দি মহিম ও সুরেশও। অবাধ্য অগ্নিতে দগ্ধীভূত অচলা এবং সুরেশ ও মহিমের জীবন-সমস্যার তীক্ষè রূপায়ণ ঘটেছে এ উপন্যাসে। শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ এ কারণে তাঁর অন্যান্য উপন্যাস থেকে ব্যতিক্রম। একই সাথে একথাও স্মরণযোগ্য, ‘নিষিদ্ধ প্রেমের বিষয়-সংবলিত উপন্যাস হিসেবে ‘গৃহদাহ’ শরৎচন্দ্রের সর্বেপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ রচনা।’
অচলাকে পাবার জন্য সুরেশের যে উন্মত্ততা হিংস্রতা ও নানা কৌশলগত আশ্রয় ছিল। কিন্তু সেটিকে কার্যকরিতা দিতে সাহার্য করেছে বৃদ্ধ রামবাবু। তার সনির্বন্ধ আবেদন ও নিবেদন ও বারংবার তার রাগান্বিত রূপ অচলার আত্মদান সহজ করে তোলে।
‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অচলা। শরৎচন্দ্রের এক সযত্ন সৃষ্টি অচলা হলেও, অচলা জীবনে সার্থকতা পায় নি। মাতৃহীন অবস্থায় বাবার কাছে বড় হয়েছে সে। পারিবারিক আদর্শ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, নীতিবোধ, জীবন সমাপর্কে স্পষ্ট ধারণা সে বাবার কাছে থেকে লাভ করতে পারেনি। পিতা কেদারবাবুও তাকে সেভাবে আদর্শবৃত্তে বেঁধে বাস্তব-জীবনমুখী করে গড়ে তুলতে পারে নি। সেকারণে অচলা নিজের জীবন সম্পর্কে নিজেই পরিষ্কার কোন ধারণা লাভ করতে পারে নি। তার হৃদয় সত্যিকারভাবে কী চায় তাইই বুঝে উঠতে পারে নি অথবা সে জানার চেষ্টা করে নি। তার বয়সও যে খুব বেশি তাও নয়। উপন্যাসের শুরুতে অচলা মাত্র আঠার বছর বয়সী এক তরুণী। সেই সময়ই তার জীবনে আসে দুই বিপরীত মেরুপ্রতিম সুরেশ ও মহিম। তাদেরকে আকর্ষণ করে ধরে রাখার ক্ষমতাও তার মধ্যে দেখা যায়। অচলার মধ্যে ব্যক্তিত্ববোধেরও খানিকটা ঘাটতি থেকে থাকবে। দৃঢ় মানসিকতায় তাকে দাঁড়াতে দেখা যায় নি। নিজের কাছে নিজে অস্পষ্ট—অমীমাংসিত। মহিমকে ভালেঅবাসে, কিন্তু সুরেশকে উপেক্ষা করার সাধত্তার নেই। সুরেশকেও সে ভালোবাসে। সুরেশকে ভালেঅবেসে মহিমকে যে সংস্কার ভেঙে নতুন এক জীবন গড়ে তুলবে সে ক্ষমতাও অচলার ভেতর দেখা যায় না। অদ্ভুত এক অন্ধকারেই যেন অচলা সারাটা পথ হেঁটেছে—কিন্তু সে জানে না তার গন্তব্য কোথায় কোন দিকে।
সুরেশ যখন তার দুই হাত নিজের বুকের উপর টেনে ধরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘অচলা, ভূমিকম্পের এই প্রচণ্ড হৃৎস্পন্দনে নিজের দুটি হাতে অনুভব করে দেখ—কী ভীষণ তাণ্ডব এই বুকের ভেতরটায় তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। এ কি পৃথিবীর কোন ভূমিকম্পের চেয়ে ছোট? বলতে পার অচলা, পৃথিবীতে কোন্ জাত, কোন্ ধর্ম, কোন্ মতামত আছে, যা এই বিপ্লবের মধ্যে পড়েও ডুবে রসাতলে তলিয়ে যাবে না।’ সুরেশের মুখে এমন প্রেমার্ত-আকুলিত কথা শুনে অচলা নিজের ব্যক্তিত্ব-মেরুদণ।ড সোজা করে দাঁড়িয়ে সুরেশকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। বরং নিজেই ভেঙে পড়েছে। এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করেছে সে। মহিমের অনুপস্থিতিতে অচলার সুরেশের প্রতি আকর্ষণ বোধের প্রকাশও ঘটে যায়। যখন অচলা বলে ফেলে ‘আমি কোনদিনই বাবার অবাধ্য নই। তিনি আমাকে তো তোমার হাতেই দিয়েছেন।’ অচলার মুখে এরকম অনুগত ও আত্মসমর্পিতা ধরণের কথা শোনার পর সুরেশতো ভাবতেই পারে অচলা তারই। এর প্রকাশও আমরা সুরেশের মধ্যে লক্ষ করি। অচলার হাত মুখের উপর টেনে নিয়ে বারবার চুম্বন করেছে সুরেশ। অচলা কোন বাধা দেয় নি, আপত্তিও করেনি।
মহিমের অর্থনৈতিক অবস্থা, নিরুত্তাপ আচরণ, মৃণালের সাথে হাসি-তামাশা—এসবই কী অচলাকে মহিমকে থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল, তার প্রতি আকর্ষণ ক্রমে কমে যাচ্ছিল! মহিমের সাথে মৃণালের হাসি-তামাশা অচলার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় নি। মহিম ও মৃণালের সম্পর্ক তার কাছে অশ্লীল ঠেকেছে। অচলার মনে হয়েছে তার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত। এই নারী আর কেই নয়—মৃণাল। মৃণালকে নিয়ে তার তীর্যক প্রশ্নও আছে মহিমের কাছে—‘মৃণালদিদি যা করে আজ চলে গেলেন, তাকে কি তোমাদের পাড়াগাঁয়ের সমাজে অপমান করা বলে না?’ মৃণাল যাবার সময় অচলার রান্না না খেয়ে যাওয়াতে অচলার মনে নানাবিধ যে প্রশ্ন তৈরি হয় তার প্রকাশ ‘নির্নিমেষচক্ষে চাহিয়া মহিমের বুকের ভিতর পর্যন্ত যেন তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টি প্রেরণ করিতে লাগিল।’ মৃণাল যে একটা বড় সমস্যা অচলা ও মহিমের মাঝে, মহিম সেটিকে বড় করে না ভাবলেও অচলার মনস্তাত্তিবকে সেটি বড় রকমের সমস্যা। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই ঠাণ্ড হয়ে অঅসার পেছনে মৃণাল তো একটি বড় কারণ। এরকম যখন মানসিক সংকটের শিকার অচলা, সেই সংকটই অচলাকে সুরেশমুখী করে তুলেছে। সুরেশের উপস্থিতিতে স্বামীর অর্থনৈতিক দীনতা, দারিদ্রের নির্লজ্জ ছাপমারা ঘরবাড়ির শ্রীহীন অবস্থা অচলাকে বিব্রতবোধ করে।
অচলা মুখ ফুটে বলেই ফেলে ‘গৃহই নেই, তাই আবার গৃহিনী! এই দুঃখীদের কুঁড়ের মধ্যে কি করে আজ অঅপনার রাত্রি কাটবে, সেই হয়েছে আমার ভাবনা।’ বিষয়টি আরো গুরুতর হয়ে ওঠে যখন অচলা মহিমকে বলে-‘আচ্ছা, নয়নবাবুকে ধরে চন্দ্রবাবুর বাড়িতে অঅজ রাতটার মতো ওঁর শোবার ব্যবস্থা করা যায় না? তাঁদের পাকা বাড়ি—বসবার ঘরটাও অঅছে, ওঁর কষ্ট হত না।’ সৌজন্যের আবরণে অচলা ও মহিমের মধ্যে ‘শ্লেষের এই-সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত-প্রতিঘাত’ একে অপরকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। মহিমের দারিদ্র অচলার মনে কতোটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছিল এসব শ্লেষপূর্ণ বাক্য থেকেই অনুধাবন যোগ্য। অচলার মনের ঘরে প্রবেশের পথটা এভাবেই তৈরি হতে থাকে সুরেশের। অকপটে একসময় অচলঅ সুরেশকে বলেও ফেলে, ‘সুরেশবাবু আমাকে তোমরা নিয়ে যাও—যাকে ভালবাসিনে, তার ঘর করবার জন্য আমাকে তোমরা ফেলে রেখে দিয়ো না।’ সুরেশের জন্য এ এক বড় পাওয়া ছিল। এটির বাস্তবায়নের সুযোগ ঘটে মহিমের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হলে।
অচলা নিজেই নিজেকে বোঝেনি কখনো। নিজের সাথে নিজেই যেন পালিয়ে বেড়িয়েছে। তা নাহলে মহিমকে নিয়ে হাওয়া বদল করতে পশ্চিমে যাওয়ার পূর্বে সুরেশকে অনুরোধ করবে কেন! দুজনকেই তো সে ভালেঅবাসে। কারো থেকে কি দূরে সরতে চেয়েছে অচলা! কিন্তু একই সঙ্গে দুজনকে জীবনে বেঁধে তো জীবন চলতে পারে না—এই সহজ অংকটি অচলা কখনোই বোঝেনি, বোঝার চেষ্টা করেনি। তানা হলে পথিমধ্যি থেকে অসুস্থ মহিমকে রেখে সুরেশের সাথে কিভাবে পালায় সে! যে সুরেশ তাকে পাবার জন্যে এতো উম্মাদ, আবার যে সুরেশের সামনে অচলার অনেক অহংকার ও গর্ব ছিল। একপর্যায়ে সে সবতো থাকে না দুজনের কারোরই। অচলা যদি সুরেশকে নিয়ে প্রথমে খেলে থাকে, শেষটা খেলেছে সুরেশ-ভয়ঙ্কর খেলা। ‘সুরেশ হাত ছাড়িয়া দিল, কিন্তু চক্ষের পলকে উঠিয়া বসিয়া দুই ব্যগ্র বাহু বাড়াইয়া অচলঅকে তাহার অঅসন হইতে টানিয়া অঅনিয়া নিজের বুকের উপর সজোরে চাপিয়া ধরিয়া অজস্র চুম্বনে একেবারে আচ্ছন্ন অভিভূত করিয়া ফেলিল। একমুহূর্ত পূর্বে যেমন মনে হইয়াছিল, এই অঅবেগ-উচ্ছ্বাসহীন নাটকের পরিসমাপ্তি হয়ত এমনি নিস্পন্দ মৌনতার ভেতর দিয়াই ঘটিবে, কিন্তু নিমেষ না গত হইতেই আবার বোধ হইতে লঅগিল, এই উন্মত্ত নির্লজ্জতার বুঝি সীমা নাই, শেষ নাই, সর্বদিক সর্বকাল ব্যাপিয়াই এই মত্ততা চিরদিন বুঝি এমনি অনন্ত ও অক্ষয় হইয়া রহিবে—কোনদিন কোন যুগেও ইহার অঅর বিরাম মিলিবে না, বিচ্ছেদ ঘটিবে না। অচলা বাধা দিল না, জোর করিল না, মনে হইল, ইহার জন্যও সে প্রস্তু হইয়াই ছিল, শুধু কেবর তাহার শান্ত মুখখানা একেবারে পাথরের মত শীতল ও কঠোর হইয়া উঠিল।’
অচলাকে পাবার জন্য সুরেশের যে উন্মত্ততা হিংস্রতা ও নানা কৌশলগত আশ্রয় ছিল। কিন্তু সেটিকে কার্যকরিতা দিতে সাহার্য করেছে বৃদ্ধ রামবাবু। তার সনির্বন্ধ আবেদন ও নিবেদন ও বারংবার তার রাগান্বিত রূপ অচলার আত্মদান সহজ করে তোলে। চরম এক মিথ্যাকে সমাজ-সংসারে সত্য হিসেবে দাঁড় করায় অচলা। পৃথিবীতে কতো বড় বড় সত্য তো মিথ্যের মহত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। অচলাও চরম মিথ্যের উপর এক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। ‘কাল অসহ্য অপমানে, লজ্জার গভীরতার পঙ্কে তাহার আকণ্ঠ মগ্ন হইয়া যাইবে, ইহা সে চোখের উপর স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, কিন্তু তবুও আজিকার মতো ওই মিথ্যাটার জয়মাল্য পরিয়া তাহাকে কোনমতেই সত্য প্রকাশ করিতে দিল না। আজ জীবনের এই চরম মুহূর্তে অভিমান ও মোহই তাহার চিরজয়ী হইয়া রহিল। সে বাধা দিল না, কথা কহিল না, একবার পিছনেও চাহিয়া দেখিল না—নিঃশব্দে ধীরে ধীরে সুরেশের শয়ন-কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল।
বাহিরের মত্ত প্রকৃতি তেমনি মাতলামি করিতে লাগিল, প্রগাঢ় অন্ধকারে বিদ্যুৎ তেমনি হাসিয়া উঠিতে লাগিল, সারারাত্রির মধ্যে কোথাও তাহার লেশমাত্র ব্যতিক্রম হইল না।’
সুরেশ শারীরিকভাবে অচলাকে পেলেও সত্যিকারের অচলাকে তার পাওয়া হয়নি-এটি বুঝেছে তার শরীর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই। সুরেশের এই পাবার ভেতর যে একরকম ক্ষোভ ও ক্রোধ এমনকি প্রতিশোধপরায়ণতা ছিল তা তার কথাতেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে—‘স্বামীর ঘরে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখের উপরে বলেছিলে, একজন পরপুরুষকে ভালেঅবাসো—সে কি ভুলে গেছ? যে লেঅক ঘরে অঅগুন দিয়ে তোমার স্বামীকে পোড়াতে চেয়েছিল বলে তোমার বিশ্বাস, তার সঙ্গেই রচলে অঅসতে চেয়েছিলে এবং এলেও তাই; সমÍণ হয়? তার ঘরে তার আশ্রয়ে বাস করে গোপনে কেঁদে তাকেই সঙ্গে অঅসতে সেধেছিলে মনে পড়ে? তার চেয়েও কি এটা বেশি অপরাধ? আর ও কত-কি প্রতিদিনের অসংখ্য খুঁটিনাটি! তাই আজ আমার এত সাহস! আসলে তুমি একটা গণিকা, তাই তোমাকে ভুলিয়ে এনেছি।’
অনেক মূল্য দিয়ে এই উপলব্ধি যখন তার এলো তখন সত্যিই সে অচলাকে মুক্তি দিয়ে মুক্ত হতে চেয়েছে। শেষপর্যন্ত মৃত্যুর ভেতর দিয়েই সুরেশের সে মুক্তি মিললো।
সুরেশের কাছে অচলা সতীত্ব বিসর্জন দিয়েছে আবার এই সুরেশের কাছ থেকেই তাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে, হতে হয়েছে চরম অপমানিত। কিন্তু এই অচলারও একদিন সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতি-স্বীকৃত নারীর সতীত্ব নিয়ে অহংকার ছিল। ভারতীয় চিরন্তনী নারী যে স্বামী ছাড়া আর কোনো পুরুষের ভোগ্যা হিসেবে নিজেকে ভাবতে পারে না, অচলার মতো আধুনিকা নারীর মধ্যেও সে ভাবনা বেশ শক্তভাবেই গ্রোথিত ছিল। ‘সংসারে শুধু মৃণালই একমাত্র সতী নয় সুরেশবাবু। এমন সতীও অঅছে, যারা মনে মনে একবার কাউকে স্বামীত্বে বরণ করলে, সহস্র কোটি প্রলোভনেও অঅর তাদের নড়ানো যায় না।’ যদিও অচলা তার চারিত্রিক এই দৃঢ়তা প্রমাণ করতে পারে নি। যে সুরেশকে সে সতী-অহংবোধের কথা বলেছিল, সেই সুরেশের সাথেই তার সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ সঙ্গম সংঘটিত হয়েছে।
এ ঘটনার পরই তার জীবনে ভর ভয়ানক একাকিত্ব ও দুঃসহ শূন্যতা। অচলা বেঁচে থেকেও যেন মৃত হয়ে উঠলো। তার মুখ মৃত মানুষের মতো শাদা হয়ে উঠলো। দুচোখের নীচে গাঢ় কালিমা যুক্ত হয়েছে। বিমর্ষ ফ্যাকাশে চোখ থেকে অশ্র“ ঝরছে। উপন্যাসের প্রথমেই যে অচলাকে ‘ব্যধভীত হরিণী এবং সুরেশ তাহাকে ছোঁ মারিয়ে ধরিতে চায়।’ উপন্যাসের শেষপর্যায়ে তারই যেন বাস্তবায়ন।
অচলাকে নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হতে পারে এবং হয়েছেও। প্রথম থেকেই অচলার ব্যক্তিত্ব গঠনেই সমস্যা রয়েছে। মাতৃহীনভাবে বেড়ে ওঠা। পারিবারিক আদর্শ তার ভেতর গড়ে ওঠেনি। যেকারণে মানসিক অসম্পূর্ণতার একটি ব্যাপার তো তার মধ্যে থেকে গেছে। অচলার মধ্যে সবসময় একটা তাড়াহুড়ো ভাব থেকেছে। মহিমকে যে বিয়ে করলেঅ সেটাও তাড়াহুড়ো করেই। অনেকটা ‘ব্যধভীত হরিণী’র মতোই। ব্যধভীত হরিণী যেমন উপায়ন্তর না দেখে নিস্তরঙ্গ জলে ঝাঁপ দেয়, অচলার ব্যাপরটিও এখানে তাই ঘটেছে। মহিমের সঙ্গে সংসার-জীবন ভালো করে শুরু করতে না-করতেই সুরেশের প্রতি আসক্তি ও তাকে প্রশ্রয় দেয়া। অস্থির ও অসুস্থ এক মানসিকতা যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। মহিমের ভেতরের প্রখর ব্যক্তিত্ব যেমন নে অনুধাবন করতে পারে নি, অঅবার সুরেশ যে পুরোটাই প্রবৃত্তিগতভাবে তাড়িত-সেটাও ধরতে পারেনি। কারণ অচলা নিজের সম্পর্কেই নিজে জানতো না সে আসলে কী চায়। যেন ভয়াবহ এক অন্ধকারের দিকে সে কেবল। দৌড়িয়েছে, আলো খোঁজেনি কোথাও। অসুস্থ মহিমকে ট্রেনে ফেলে রেখে সুরেশ অচলাকে নিয়ে ঝড়-বৃষ্টির রাতে পালিয়ে যাওয়া—প্রবল প্রবৃত্তিগত কারণেই যা সম্ভব হতে পারে। এখঅনে যে অচলার প্রতি সুরেশের ভালেঅবাসা নেই —এটুকু বোঝেনি সে, বুঝতে চায়ওনি।
অচলা যদি নিজের ইচ্ছেয় না যেতো সুরেশ কি তাকে নিয়ে যেতে পারতো! যে প্রবল ঝড়-বৃুষ্টির রাতে সুরেশ ও অচলা শারীরিক সম্পর্ক সংঘটিত হলো, সেখানে অচলা বাধাও দেয় নি, সাড়াও দেয়নি। সামাজিক-সম্ভ্রমের ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে রামবাবুর অনুরোধে অচলা সুরেশের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিল। কিন্তু এটিকে সত্য মানলে তার ব্যক্তিত্ব থাকে কোথায়! নিজস্বতা বলেও তো কিছু থাকে কী! আরো অবাক হতে হয় যখন সুরেশ তাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করে তখন সে ভেঙ্গে পড়েছে। আবার এই সুরেশের জন্যেই সহানুভূতিতেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। সুরেশের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল, ভালোবাসা কী ছিল! সুরেশ তার জীবনে কতোটা অপরিহার্য ছিল তাও তো অন্ধকারই থেকে গেছে উপন্যাসে। সুরেশের মৃত্যুর পর তার মুখাগ্নি করার কেউ ছিল না। তখন কিন্তু অচলা বলেছে‘মুখাগ্নি আবশ্যক হয় ত আমি করতে পারি।’ আবার এই অচলাই তো বলেছে, ‘আমি তাঁর স্ত্রী নই।’ শরৎ-সাহিত্যে এই প্রথম কোন নায়িকা সমাজ-সংস্কৃতি ভাঙার স্পর্ধা দেখাতে পেরেছে। আবার মহিমকে অচলার শেষ কথা বলতে শুনি ‘তোমার হাত ধ’রে যত দূরে বলো যেতে পারবো।’ দ্বিধা-বিদীর্ণ ক্ষতবিক্ষত অচলা। অচলা বেঁচে থেকেও যেন মৃত— বক্ষভরা তিক্ততা, দুঃসহ শূন্যতা ভয়ঙ্কর একাকিত্ব ভরা শুধু একটা অর্ধমৃত-শরীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে সুরেশ ও মহিম দুজন বন্ধু। কিন্তু দুজনের স্বভাব-চরিত্র একে অপরের উল্টো। সুরেশ স্বভাবে অস্থির, বাকপটু, প্রবল হৃদয়াবেগসম্পন্ন, কৌশলী এবং অর্থ-সম্পদের মালিক। মহিম শান্ত স্বভাবের। কম কথা বলে। ব্যত্বিসম্পন্ন। তাকে এককথায় ধীর-স্থীর-নিস্তব্দ-নিশ্চুপ চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করা যায়। উপন্যাসের প্রায় শুরুতেই দেখা যায় মহিম ও অচলঅর বিয়ের মাঝে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সুরেশ। ‘তুমি সমস্ত জগতের বরেণ্য পূজনীয় হিন্দুর সন্তান হয়ে কিনা একটা রমণীর মোহে জাত দেবে? মোহ!…তোমার অসময়ে সে কি বাটনা বেটে, কুটনো কুটে তোমাকে একমুঠো ভাত রেঁধে দেবে? রোগে তোমার কি সেবা করবে? সে শিক্ষা কি তাদের আছে? ভগবান না করুন, কিন্তু সে দুঃসময়ে সে যদি না তোমাকে ছেড়ে চলে আসে তো আমার সুরেশ নামের বদলে যা ইচ্ছে বলে ডেক, আমি দুঃখ করবো না।…মহিম, তুমি তো জানো আমি তোমার মঙ্গল ভিন্ন কখনো ভুলেও অমঙ্গল কামনা করতে পারিনে।’
এর পরেও অচলা-মহিমের বিয়ে রোধ হয়নি। সুরেশ-মহিমের বন্ধুত্বে যে নীরবে গভীর ফাঁক নির্মিত হয়ে গেছে, তার মূলেও অচলার—অচলার প্রতি সুরেশের দুর্বার আকর্ষণ। অচলাও সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের সুরেশ ও মহিম দুজনকেই আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। সুরেশের ব্যাপারটি সাদামাঠা চোখে দেখলে কী দেখা যায় —বন্ধুর বাগদত্তাকে নিজের করে নেবার চেষ্টা করেছে। এজন্যে অচলার বাবা কেদারবাবুর সামনে প্রচুর টাকা ছড়িয়েছে। এতে সফলও হয়েছে সে। সুরেশের প্রতি অচলার দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, আকর্ষণ অনুভব করেছে। অচলাকে বিয়ে করে মহিম নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। সুরেশ সেখানে গিয়েছে। তাদের দাম্পত্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছে। মহিমের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা, বাড়িঘরের শ্রীহীন অবস্থা-সবকিছুতে দারিদ্রের চিহ্ন। এতে সুরেশ যেমন অবাক হয়েছে, বিব্রত হয়েছে অচলাও। এর পর তাদের বাড়িতে যে অগ্নিসংযোগ ঘটে—ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়-সে আঙুলও সুরেশের দিকেই। অসুস্থ মহিমকে চিকিৎসার নামে নিয়ে যেয়ে পথিমধ্যে তাকে ফেলে রেখে, তার স্ত্রী অচলাকে নিয়ে পলায়ন এবং তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন। ঘটনাপ্রবাহে মূলদাগ মূলত এগুলোই।
বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে কী দাঁড়ায়! সুরেশ দৃঢ় মনে বিশ্বাস করতো অচলা তাকে ভালোবাসে। অচলাকে সে জয় করতে পেরেছে। মহিমের নিরুত্তাপ পুরুষ চিত্তের কাছে উন্মত্ত আবেগভরা হৃদয়াবেগপূর্ণ বাকপটু সুরেশের পৌরুষ সহজেই অচলাকে প্রবলগতিতে টান দিবে এটিই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। আবার অচলার বাবাকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে তাকে ঋণমুক্ত করা এটিও অচলার মনে সুরেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও হৃদয়বৃত্তিক অনুরাগ জন্মাতেই পারে। অচলার ক্ষেত্রে সেগুলোর ইতিবাচক প্রকাশও ঘটেছে। মহিম ও অচলার বিয়ে হলেও তাদের ভালোবাসার মধ্যে দূরত্ব আছে, সুরেশের তা মনে হয়েছে। এ সুযোগটিও সুরেশ গ্রহণ করেছে। অচলাকে পাবার জন্য সুরেশের যা যা করা সম্ভবপর এর কোনটিই করতে বাদ রাখেনি। মহিমের বাড়িতে এসে দুজনের সম্পর্কে যখন টানাপোড়ন সুরেশ বুঝতে পেরেছে, মহিমের দরিদ্রতা নিয়ে আচলার অস্বস্তি, অচলার ভাবনায় মৃণালের সাথে মহিমের অশ্লীল সম্পর্ক—এসবই অচলার প্রতি সুরেশের আকর্ষণ আরো দুর্বার করে তোলে। সুরেশ আরো স্পর্ধাময়ী হয়ে ওঠে যখন অচলা স্বামীগৃহ থেকে তারে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্য কাতর অনুরোধ করে।
সুরেশ অচলার সব কথাকেই সত্য বলে গ্রহণ করেছে। যে কারণে অচলাকে নিজের করে পাওয়া, নিজের করে নেয়া—এ স্বপ্নসৌধ তার মধ্যে তৈরি হতেই পারে এবং হয়েছিলও। কারণ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সুরেশ অচলাকে উন্মাদের মতো ভালোবেসেছিল। সেকারণে সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতি এসবের কোন মূল্য তার কাছে ছিল না। এসবের কোন মূল্যও সে দেয় নি। অচলা ছিল তার সর্বস্ব জুড়ে। প্রবল প্রবৃত্তিগত ভাবেই সে অচলার দিকে অবাধ্য অপ্রতিরোধ্য গতিতে ধাবিত হয়েছিল। অচলাকে নিয়ে যখন সে ট্রেন বদল করে অন্য ট্রেনে উঠলো, সুরেশ এখানে পেশিশক্তির জোর না খাটায় নি। ভালোবাসার প্রগাঢ় বিশ্বাস থেকেই করেছে। অচলাও তো এতে বাধা দেয় নি। বরং ‘অচলারও সেই একই রকম প্রবল আসক্তি, সমাজ-সংসার ও সংস্কারের মোহগ্রস্ত আবরণ সরিয়ে যা আত্মপ্রকাশ করতে পারছিল না। তাকে এর দ্বারা মুক্তি দিল সুরেশ, স্বভাবত যার রাজরানী হবার কথা তাকে সে কঠিন দারিদ্র থেকে উদ্ধার করল।’ অচলাকে যখন সুরেশ একেবারে নিজের নিয়ন্ত্রণে পেলো, একেবারে নিজের করে পেলো, তখনি সে বুঝতে পারলো আসলে অচলাকে পাওয়া হয়নি তার। অচলার দেহ সে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু মন পায়নি। তার অনুভবে তখন এলো সে শুধু নারীকে হরণ করেছে, তার হৃদয় পায়নি। সে এও বুঝতে পারলো, অচলা তাকে নয়, মহিমকেই ভালোবাসে।
সুরেশ যে এতোদিন মনে করে এসেছিল অচলা মহিমকে নয় তারই অনুরাগিনী— সুরেশের এ ধারণা ভেঙে যায়। অচলাকে পাবার জন্যে, তার সুখের ভোগের আযোজনে সুরেশ যে এতোদিন অক্লান্ত ও বিরামহীন ছিল, সুরেশ অচলাকে বোগ করার পরই বুঝলো তার সব আয়োজন সাধনা বাসনা সবই ভুল। সুরেশ আসলে মোহের শিকার, সে অস্থিরতা ও অসংযমের শিকার। অচলাকে পাওয়ার জন্য সে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, আর সুরেশেকে প্রত্যাখ্যানের শক্তিও অচলার ছিল না। প্রবৃত্তি আর সংস্কারের একটা ভয়াবহ দ্বন্দ্ব এখানে ঘটেছে। আর তাতে প্রবৃত্তিই জিতেছে। কিন্তু এ জয়ে কোনও আনন্দ যেমন নেই,এতমনি নেই কোনো তৃপ্তিও। আসলে ব্যাপরটি হলো, ভালোবাসায় জোর খাটে না। সুরেশের ক্ষেত্রে এ কথাই প্রমাণিত হলো। অচলার উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়াই ছিল সুরেশের বড় ভুল। অচলার মনতো সে পেলোই না, বরং অনুশোচনার ভয়ানক আগুনে দগ্ধ সুরেশ অচলাকে মুক্তি দেবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ যখন সে অনুধাবন করলো ‘মন ছাড়া যে দেহ, তার বোঝা এমন অসহ্য ভারী, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।’ অনেক মূল্য দিয়ে এই উপলব্ধি যখন তার এলো তখন সত্যিই সে অচলাকে মুক্তি দিয়ে মুক্ত হতে চেয়েছে। শেষপর্যন্ত মৃত্যুর ভেতর দিয়েই সুরেশের সে মুক্তি মিললো।
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে রীতিবিরুদ্ধ মানবসম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বিশেষধারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতেও অতিক্রম করতে হয়েছে বহুধরনের প্রতিবন্ধকতা।
মহিম সম্পর্কে একজন সমালোলোচকের উক্তি, ‘সাংসারিক বা ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে মহিমের অনভিজ্ঞতা তার প্রথম ত্র“টি। আর সেক্ষেত্রে এক ধরণের নিষ্ক্রিয় অসন্তুষ্ট ভাব দ্বিতীয় ত্র“টি। মহিমের অসহিষ্ণু অতি-সংযত স্বার্থপর মনোভাব তৃতীয় ত্র“টি। তার আত্মকেন্দ্রিক দুর্গের ভিতরে সে কোনও দিন কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি।’ এ দুঃখ ক্ষোভ অচলারও। মহিমের দুঃখ দুঃশ্চিন্তায় দুঃসময়ে সে কখনো তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পাারে নি। মহিম কখনোই কাউকে বুঝতে দেয়নি তার অভাব কোথায় তার ব্যথা কোথায়। ঘরবকাড়ি পুড়ে যখন ভস্মীভূত হলো তখনো সে নির্বিকার—কাউকে বুঝতে দেয় নি সর্বস্ব হারানো যন্ত্রণা কতোটা গভীর। নিজের দুঃখ সম্পর্কে একবারই প্রকাশ করেছিল। তাও অচলার কাছেই। তার চিকিৎসার জন্যে জব্বলপুরে যাবার যখন আয়োজন চলছে, তখন অচলাকে বলেছিল, ‘অচল, ভেতরে ভেতরে আমি বড় দুর্বল, বড় অসুস্থ।’ অচলা নিজেও একথায় অবাক হয়েছিল। যে লোকটা মুখফুটে কোনদিন নিজের দুঃখ কষ্ট বেদনার কথা বলেনি, তার এই বেদনার্ত আর্তি অচলার ভেতর গভীর এক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
মহিমের জন্যে তার ভেতরের পুরোটা যেন আর্তনাদ করে ওঠে। ‘যে মুখ ফুটিয়া কখনো কিছু চাহে না, কখনো নিজের দুঃখ অভঅব ব্যক্ত করে না, তাহারই মুখের উপর এই আকুল ভিক্ষা ঠিক যেন শূলের মত আঘাত করিয়া অচলার হৃদয়ে যত স্নেহ, যত করুণা, যত মাধুর্য এতদিন রূদ্ধ হইয়া ছিল, সমস্ত একসঙ্গে এক মুহূর্তে মুখ খুলিয়া দিল। সে নিজেকে আর ধরিয়া রাখিতে না পারিয়া পাছে অসম্ভব কিছু একটা করিয়া বসে এই ভয়ে চক্ষের জল চাপিতে চাপিতে একেবারে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। মহিম হতবুদ্ধি মত অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিস্ময়ে ব্যথায় সেই উন্মুক্ত দ্বারের দিকে নির্নিমেষে চাহিয়া থাকিয়া অঅবার ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল।’
এখানেই দারুণ একটা ব্যাপার ঘটে যেতে পারতো। মহিম ও অচলা এতোটা কাছাকাছি এসেছিল, দুজনের হৃদয়ই দুজনের জন্যে যেভাবে কেঁদে উঠেছিল—এরকমটি এদের দুজনের ক্ষেত্রে আর কখনো হয় নি। মহিমের জন্যে অচলা হৃদয় মন যেভাবে ভেতরে ভেতরে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠেছিল, মহিমের জন্য তার সব স্নেহ করুণা মাধুর্য ভালোবাসা যেভাবে প্রবল আবেগাশ্রুতে উথলে উঠেছিল, মহিম তা বুঝতে পারেনি। অচলার মানসিক প্রতিক্রিয়া মহিমের বুঝতে না পারায় অচলা যে দূরে চলে গেলো-সে-দূল আর কাছের হয়ে আসেনি।
মহিমের চরিত্রের বড় দিক নিষ্ক্রিয়তা। সুরেশ যখন তার গ্রামের বাড়িতে এসে থাকছে, তখনো তার ভেতর এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কিন্তু মনের ভেতরে সে ঠিকই ক্ষুব্ধ ও ঈর্ষান্বিত হয়েছিল। কিন্তু তার ক্ষুব্ধতা, ক্রেধি ও ঈর্ষা বাইরে থেকে বোঝা কঠিন ছিল। সুরেশের বাড়িতে নিরূপায় হয়ে তার যে চিকিৎসা চলছিল, সেটাও মহিম আর এক যন্ত্রণা হিসেবেই জেনেছিল। কিন্তু এসবে তার বাহ্যিক কোন প্রকাশ ছিল না। সুরেশের সঙ্গে অচলার যে হৃদয়বৃুত্তিক এতকিছু ঘটছে, মহিম সে সবের যেন কিছুই জানে না। অদ্ভুতরকমের নিজের ভেতর নিজেকে আত্মস্থ করে রাখে মহিম। নিজের ক্ষোভ দুঃখ কষ্ট বেদনা সবই যেন নিজের ভেতর বন্দি করে রেখেছে সে। তাকে দেখে এসব বোঝার কোন উপায় নেই। ডিহরীতে অচলা আর সুরেশকে যখন একসঙ্গে ‘স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দেখেছে, তখন ঘৃণায় অপমানে গ্লানিতে লজ্জায় ক্রোধে অবজ্ঞায় সে পুরোপুরি একজন মানুষ—যার রাগ দুঃখ উত্তেজনা অঅছে—আছে তার নিজের মতো, কিন্তু মানুষের মতো, দৈবী দূরত্বে সে নরলোক থেকে নির্বাসিত নয়।’ মৃণালের সাথে তার যে সম্পর্ক-এ সম্পর্ক-ধরেই অচলা যখন সুরেশের দিকে ধাবিত হয়েছে, মহিম তখনো নীরব, নিশ্চুপ।
সুরেশের মৃত্যুর পর অচলা যখন মহিমের হাতটি ধরেছে, মহিম তা গ্রহণ করেছে। অচলা বুঝেছিল মহিমের হাতই এখন তার ভরসা, তাই প্রচণ্ড দুর্বল শরীরেও মহিমের হাত ধরে নতুন করে বাঁচার শক্তি পায়— ‘আর আমি দুর্বল নই, তোমার হাত ধরে যত দূরে বল যেতে পারব।’ তখন ‘চল’ বলে অচলাকে নিয়ে মহিম রঘুবীরকে অগ্রবর্তী করে যাত্রা করলো। ‘আশ্চর্য মানুষের মন, কুলটা গৃহত্যাগিনী স্ত্রীকে করুণার আড়ালে গ্রহণ করার ব্যাকুলতা মুদ্রিত করে রাখল।’
এই উপন্যাসের সবটুকু জুড়েই অচলা। অচলা ভালোবেসেছিল মহিম ও সুরেশ—দুধারার দুপুরুষকে। সুরেশের সাথে তার সম্পর্ক সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ প্রেমের। মহিমের সাথেও বিস্তর মানসিক দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব। তিনজনের জীবনই এখানে জীবনকে ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে, পীড়িত হয়েছে, পাপবোধে জ্বলেছে। অচলা যেমন নিজের ভুলের জন্য ক্ষতবিক্ষত মানসিক পীড়নে পর্যুদস্ত, ভুল আছে মহিম ও সুরেশেরও। তবে সবকিছু মিলিয়ে এ উপন্যাস হয়ে উঠেছে জীবন-সমস্যার তীক্ষ্ণ রূপায়ণ।
পরবর্তী সময়েও এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে যার মূলে মূলত রয়েছে মানবসম্পর্কের বহুবিচিত্রতা। এ ধরনের রীতিবিরুদ্ধ উপন্যাস মূলত মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের ধ্যান-ধারণাকেই বহন করে। তবে এসব নিয়েও তর্ক করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলতে যা বোঝা যায় সেখানে রীতিভাঙার প্রবল শক্তির ঢেউ আছড়ে পড়ে। ফলে এ দুটোকে একসঙ্গে যেমন সহজেই মেলানো যায়, আবার যুক্তিতর্কে এ দুটোর মধ্যেই বিস্তর দূরত্বও আবিষ্কার করা যাবে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে যে অবক্ষয় তৈরি হয় তার প্রতিফলন ঘটে বাংলা সাহিত্যে কল্লোলগোষ্ঠির হাতে। তাদের উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটি অত্যন্ত সার্থকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ত্রয়ী উপন্যাস ‘অন্তঃশীলা’, ‘আর্বত’, ‘মোহন’ নিঃসন্দেহে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।
মানিক-তারাশঙ্করের উপন্যাসেও মনস্তাত্ত্বিকতা এসেছে গুরুত্বের সঙ্গে। মানবসম্পর্কের বহুমাত্রিকতা এসব লেখকদের উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। যেখানে সমাজে রীতি দুমড়েমুচড়ে গেছে। মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, তারাশঙ্করের ‘কবি’ ও সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। কল্লোলের পরেও এ ধারা প্রবহমান। মানবসম্পর্ক, নিরবচ্ছিন্ন ভাবনাপ্রবাহও মনস্তাত্ত্বিকতা নানাভাবে উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো, চাঁদেও অমাবস্যা, গোপাল হালদারের ‘একদা’, ‘অন্যদিন’, ও ‘আর একদিন’, বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’, শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’ —এসব উপন্যাসে লক্ষ করা যায়।
প্রথাবিরোধী উপন্যাসের কথা যদি স্পষ্ট করে বলা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে যে নামটি শক্তভাবে আসে তিনি জগদীশ গুপ্ত। সমকালীন বা গতানুগতিক বিষয়কে গ্রহণ না করে তিনি মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি, যৌন বিকারগ্রস্ততা, গণিকাবৃত্তি অনায়াসে উপন্যাসে গল্পের বিষয় করে তাঁর সময়কালে নিন্দিত হয়েছেন। রীতিবিরুদ্ধ ও মনস্তাত্ত্বিকদ্ব›দ্ধ তাঁর উপন্যাসে নতুন মাত্রা লাভ করে। তাঁর ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ ও ‘লঘুগুরু’ উপন্যাস এর বড় দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে জগদীশ গুপ্তের উপন্যাস নিন্দিত অবস্থা থেকে নন্দিত হতে পেরেছে। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে রীতিবিরুদ্ধ মানবসম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বিশেষধারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতেও অতিক্রম করতে হয়েছে বহুধরনের প্রতিবন্ধকতা। এর পরেও গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক ঔপন্যাসিকই উপন্যাসে রীতিবিরদ্ধ মানবসম্পর্কের গভীর রহস্য উদঘাটনের প্রয়াস গ্রহণ করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।