রহস্য সাহিত্যের প্রতি তথাদীক্ষিত পাঠক-সমালোচকের উন্নাসিকতা থাকলেও নিবিড় পাঠকের রয়েছে তুমুল আগ্রহ। নিবিড় পাঠক যেকোনো বিষয় পাঠ করেন নীরবে, প্রতিক্রিয়াও জানান নিজের কাছে। লেখকের দোষগুণ নিয়ে নিজের মনেই সমাধান খোঁজেন, পেয়েও যান। তার মহত্তম সমাধান নিজ গুণে লেখকের ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া ও নীরবেই। আর গুণ নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে অন্যের বোধের সঙ্গে নিজের বোধের সম্পর্ক রক্ষা করাও তার স্বভাব। এই নিবিড় পাঠকই মূলত সাহিত্যের নির্বিচারী পাঠক। তার লক্ষ্য নির্বাচন করে পাঠ নয়; আনন্দ লাভ। তাই দরকারি রচনার চেয়ে রসসমৃদ্ধ সাহিত্যই তার আরাধ্য। সঙ্গত কারণে এ ধরনের পাঠকের কাছে রহস্য সাহিত্য গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ওয়েস্টার্ন, ভৌতিক ও থ্রিলারও রহস্য সাহিত্যের বিষয়।
বিশ্বসাহিত্যে বোধ করি স্যার আর্থার কোনাল ডয়েলের শার্লক হোমসই আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা কাহিনী বলে স্বীকৃত ও পঠিত। রহস্য সাহিত্যের মধ্যে শুরুতেই গোয়েন্দা কাহিনীর প্রসঙ্গ আসে। রহস্য কাহিনীর ক্ষেত্রে কোনো গোয়েন্দার উপস্থিতি না থাকলেও চলে। কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীর জন্য দরকার একজন গোয়েন্দা; যার কাজ, সংঘটিত ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনসহ চোর বা খুনি শনাক্তকরণ। রহস্যের জট যত কঠিন, গোয়েন্দার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও তত তীক্ষ্ন। রহস্য কাহিনীর জট যে খোলে, সে-ই মুখ্য; কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীতে মুখ্য অপরাধী। তাকে কেন্দ্র করেই কাহিনী আবর্তিত হয়। ফলে তার গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করাই গোয়েন্দার মুখ্য কাজ।
বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনির শুরু উনিশ শতকের শেষ দিকে। সেই ১৮৯২ সালে। লেখক প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ছিলেন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্য। অপরাধী, পুলিশ ও গোয়েন্দার কাজের ধরন সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। তবে প্রিয়নাথের গোয়েন্দা কাহিনীগুলো যতটা পুলিশি অনুসন্ধানের বিবরণ, ততটা সাহিত্যগুণসম্পন্ন নয়। প্রিয়নাথের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘অদ্ভুত হত্যা’। শুরুর দিকে গোয়েন্দা সাহিত্যের এ উপন্যাসে একজন নর্তকির খুন হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করাই কথক গোয়েন্দার মুখ্য কাজ। কিন্তু কথক যে প্রক্রিয়ায় রহস্য উদ্ঘাটন করে, সে প্রক্রিয়াকে কোনোভাবেই গোয়েন্দা-প্রক্রিয়া বলা যায় না। সত্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দার কাজ গোপনে ও প্রকাশ্যে তদন্ত; উকিলের কাজ আদালতে উপস্থিত সাক্ষীকে জেরা করা। উভয়ের কাজের ধরন ভিন্ন। তবে গোয়েন্দা মাঝেমধ্যে আসামি ও সাক্ষীকে জেরার সুবিধা নেন; উকিলের পক্ষে অপরাধীকে জেরার সুযোগ নেই। সেদিক থেকে গোয়েন্দার অনুসন্ধানী ক্ষেত্র বিস্তৃত। প্রকারান্তরে উকিলের ক্ষেত্র সীমিত। এ পর্যবেক্ষণের আলোকে বলা যায়, প্রিয়নাথের ‘অদ্ভুত হত্যা’ উপন্যাসটি সর্বাঙ্গীন গোয়েন্দা সাহিত্য নয়। খুনের ঘটনাশ্লিষ্ট একটি পুলিশি মামলার স্বাভাবিক পরিণতির ধারাবিবরণী মাত্র।
গোয়েন্দা তার বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল অবলম্বন করে হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করে না, বরং ঘটনা স্বাভাবিক গতিতেই চলে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই বের হয়ে আসে প্রকৃত হত্যাকারীর পরিচয়। সেখানে গোয়েন্দার বিশেষ কোনো ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। তবে প্রথম দিকের গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে এ দুর্বলতা ধর্তব্য নয়। কোর্টে উকিলের তীক্ষ্ন জেরায় যে বিষয়টি ধীরে ধীরে প্রমাণিত হয়, সে বিষয়টিই প্রিয়নাথের কাহিনীতে গোয়েন্দার জেরায় প্রমাণিত। প্রকৃত গোয়েন্দার কাজ এ নয়।
প্রথম মৌলিক গোয়েন্দা সাহিত্যের স্রষ্টা সম্ভবত পাঁচকড়ি দে। পাঁচকড়ি দের ‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘মনোরমা’, ‘মায়াবী’, ‘হত্যাকারী কে?’ গোয়েন্দা কাহিনীগুলো সুখপাঠ্য। এই লেখক শুরুর দিকে ছিলেন উইল্কি কলিন্স ও এমিল গাবোরিয়লের অনুসারী। পরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল থেকেও উপাদান গ্রহণ করছেন। তবে উপাদানটুকু নিয়েছেন কেবল ধারণার প্রয়োজনে। লিখেছেন বঙ্গীয় পটভূমির উপযোগী ভাষায়। পাঁচকড়ি দে’র সমসাময়িক লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়। তার ‘রহস্য লহরী’ও বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত। তার গোয়েন্দা কাহিনীজুড়ে ছিল বিদেশের ভূগোল। চরিত্রও অনেকটা বিদেশি ধাঁচের।
পাঁচকড়ি দে’র গল্প ‘চিঠিচুরি’। ছোট ভাই অক্ষয়ের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করার স্বপ্ন দেখাটা মেনে নিতে পারে না দাদা বিনয় কুমার। ইতোমধ্যে বিনয় কুমারের ড্রাফট করা চিঠিটি হারিয়ে যায়। চিঠিটি উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ে অক্ষয় কুমারের ওপর। অক্ষয় একপ্রকার বিনা তদন্তেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, চিঠিটি নিজের অজান্তেই দাদা বিনয় কুমারই হারিয়ে ফেলেন। শেষপর্যন্ত ওই চিঠির সন্ধান মেলে বিনয়ের ছেলে সুশীলের সখের ঘুড়ির লেজুড়ে। এখানে নিছক বুদ্ধির জোরেই অক্ষয় চিঠিটি উদ্ধার করে তার দাদাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে। আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যের মান বিচারে এ কাহিনীকেও সর্বার্থে সফল গোয়েন্দা কাহিনী বলা চলে না। তবে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক গোয়েন্দা গল্পের রচয়িতা হেমেন্দ্রকুমার রায়। তার সৃষ্ট গোয়েন্দার নাম জয়ন্ত, হেমন্ত ও রবিন। বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও গোয়েন্দা কাহিনী হিসেবে গল্পগুলো উতরে যেতে পারেনি।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সত্যান্বেষী’ উপন্যাসে ব্যোমকেশ প্রথম গোয়েন্দা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ব্যোমকেশ নিজের পরিচয় গোপন করে, কলকাতার চীনাবাজার কুলিপাড়ার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব নেয় পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে। আর থানা পুলিশ ঘটনাচক্রে তাকেই গ্রেপ্তার করে ঠিকই, পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেয়। এতেই অপরাধী ডাক্তার অনুকূল বাবুর চোখে সে ধরা পড়ে। গোয়েন্দা হিসেবে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয় মেসমেট অশ্বিনীবাবুর খুনের ঘটনায় জানালা রহস্যের বিষয় নিয়ে কথা বলে। একজন গোয়েন্দা তার আবিষ্কৃত সূত্র জনসম্মুখে এভাবে প্রকাশ করবে কেন? তবু শেষ পর্যন্ত তার বুদ্ধিমত্তার জোরেই অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয় পুলিশ।
শরদিন্দুর একটি বিখ্যাত গল্প ‘রক্তমুখী নীলা’। এ নীলা চুরির রহস্য উদ্ঘাটনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খুন ও ডাকাতির ঘটনাও। কিন্তু নীলাচুরির রহস্য উদ্ঘাটন গোয়েন্দাপদ্ধতির পরিবর্তে উকিলের জেরার ধাঁচে উদ্ঘাটিত হয়, যা গোয়েন্দা গল্পের রস কিছুটা ম্লান করে দেয়। এদিক বিবেচনায় এ গল্পটিও ষোলোআনা গোয়েন্দা গল্পের অভিধা পেতে পারে না।
এভাবে ব্যোমকেশ ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমান্ত হীরা’, ‘মাকড়সার রস’, ‘চোরাবালি’, ‘অগ্নিবাণ’, ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’, ‘আদিম রিপু’, ‘রক্তের দাগ’, ‘লোহার বিস্কুট’ গল্পে একজন শৌখিন গোয়েন্দার কর্মযজ্ঞ চিত্রায়িত করেছেন। এ গল্পে দেখানো হয়েছে, বাইরে যেসব চোরাই সোনা ভারতবর্ষে আসে, তা সংগ্রহ করা। কম মূল্যে কিনে বেশি মূল্যে বিক্রিই তার পেশা। সংগৃহীত সোনা অক্ষয় ঘরে রাখে না, রাখে ছাদের পানির ট্যাংকে। তার সহকর্মী হরিহর তাকে ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি ধরতে পারায় অক্ষয় তাকে খুন করে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সে। কিন্তু যাওয়ার সময় নিজের সংগৃহীত সব সোনা নিয়ে যেতে পারে না। তাই রাতের অন্ধকারে সোনাগুলো সরাতে চায়। কিন্তু তার এ কাজে আপাতত বাধা হয়ে দাঁড়ায় কমল। এ কমল বাবুকে বাড়ি পাহারায় দায়িত্বে বসিয়ে যায় অক্ষয়ই। কিন্তু কমল যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন সে কমলকে বাড়ি ছাড়া করার জন্য বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। ছলচাতুরির বিষয়টি সন্দেহের কারণ হয় ব্যোমকেশের। তাই ব্যোমকেশ রাতের অন্ধকারে বাড়ি পাহারা দিতে গিয়েই ধরে ফেলে অক্ষয়কে। অক্ষয় মণ্ডল সোনার বিস্কুট বাড়ির ছাদে পানির ট্যাঙ্কে রাখত। রাতের অন্ধকারে সে যখন বিস্কুট তুলতে যায় পানির ট্যাংকি থেকে, তখনই ধরা পড়ে ব্যোমকেশের হাতে। এভাবে ব্যোমকেশ একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে চোরাচালানের রহস্যও উদ্ঘাটন করে। প্রকৃত গোয়েন্দার কর্মপরিধির মধ্যে পড়ে এ ধরনের কাজ। এ অর্থে সার্থক গোয়েন্দা কাহিনি ‘লোহার বিস্কুট’।
সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গোয়েন্দা সাহিত্যের আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত চরিত্র। প্রতিটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দার পেশাদারিত্বের প্রমাণ রাখে ফেলুদা। ফলে ফেলুদা হয়ে ওঠে আধুনিক যুগের রহস্য উন্মোচনকারী একজন দক্ষ পেশাদার গোয়েন্দা। ‘গোলক ধাম রহস্য’ গল্পে ফেলুদা একজন গবেষকের গবেষণাকর্মসংক্রান্ত একটি চুরির ঘটনা তদন্ত করে। চুরির রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে উদ্ঘাটন করে রনজিতের চোরে পরিণত হওয়ার কারণ। আরও মর্মান্তিক সত্য, স্বয়ং অমোঘ নিয়তির শিকার বৈজ্ঞানিক নীহাররঞ্জনের জিঘাংসার কারণও। এখানে ফেলুদা কেবল প্রথাগত গোয়েন্দা নয়, তার কার্যকারণ সম্পর্কের বিশ্লেষক।
‘লন্ডনে ফেলুদা’ উপন্যাসেও দেখা যায় একটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অন্য ঘটনারও রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। ফলে দেখা যায় মানবজীবনের ঘটনাবলি বিচিত্র স্বভাব ও অমোঘ নিয়তিনির্ভর। অপরাধী একটি অপরাধের চিহ্ন মুছে দিতে গিয়ে অন্য একটি অপরাধের জন্ম দেয়। অপরাধজগতে একটি অপরাধের সঙ্গে অন্য একটি অপরাধের সম্পর্ক অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রজাপতির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম’ একইসঙ্গে রোম্যান্টিক ও গোয়েন্দা গল্প। দাম্পত্য কলহের জের ধরে বিচ্ছিন্ন থাকা ভজন বাবু আর বিভাবরি সম্পর্কের পুনর্জন্মই এ গল্পের প্রতিপাদ্য। একটি খুনের মামলার সূত্র ধরেই পরস্পরের মধ্যকার দূরত্ব ঘুছে যায়। শেষপর্যন্ত গোয়েন্দা শবরের চেষ্টায় দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়, আর আরোপিত খুনের দায় থেকে মুক্তি পায় ভজন।
ঘনাদা প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাড়া জাগানো গোয়েন্দা চরিত্র হলেও পরাশর বর্মাও নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। ‘গোয়েন্দা হল পরাশর বর্মা’ গল্পে দেখানো হয়েছে নিছক সম্পত্তির লোভেও মানুষ মানবিক সম্পর্ককেও অস্বীকার করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওই সব চেষ্টা চাতুর্য হিসেবেই পরিগণিত হয় এবং প্রকাশ পেয়ে যায় সব ছল। এ ছাড়া গোয়েন্দাবৃত্তির সঙ্গে মানবিক সম্পর্কও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে বিষয়টিও এখানে স্পষ্ট। কেবল পেশাদারিত্ব আর সামাজিক শিষ্টাচারই জীবন নয়, সেখানে মানুষের বিচিত্র চাওয়া-পাওয়াও রয়েছে। রয়েছে এসব চাওয়া-পাওয়ার যৌক্তিক ব্যাখ্যাও।
আরও উল্লেখযোগ্য গোয়েন্দা কাহিনী হলো, অখিল নিয়োগীর ‘তিব্বত ফেরত তান্ত্রিক’, অজিতকুমারের ‘গোয়েন্দা কৌস্তভ’, অদ্রীশ বর্ধনের ‘গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ’, অনীশ দেবের ‘তীর বিদ্ধ’, অভ্র রায়ের ‘গোয়েন্দা বৈজ্ঞানিক’ অরুণকুমার দত্তের ‘সেরা রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা কাহিনী’, অশোককুমার মিত্রের ‘সবাই যখন অন্ধকারে’, অসীম চট্টোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা গোরাদা’, আবীর গুপ্তের ‘রাজুর গোয়েন্দাগিরি’, কালকেতুর ‘শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা গল্প’, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পূজনীয় দস্যু’ গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘রেশমী ফাঁস’, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা গার্গী’, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘রবার্ট ব্লেক রহস্য অমনিবাস’, নারায়ণ সান্যালের ‘কাঁটায় কাঁটায়’, নীহাররঞ্জন, গুপ্তের ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘কিরীটী অমনিবাস’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘পরাশর সমগ্র’, ‘গোয়েন্দা পরাশর বর্মা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ছায়া কালো কালো’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘নীলু হাজরার হত্যা রহস্য’, শেখর বসুর ‘রহস্যের জাল’, সমরেশ মজুমদারের ‘অর্জুন সমগ্র’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবুর অভিযান’, ‘কাকাবাবু সমগ্র’, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা’, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা সমগ্র উল্লেখযোগ্য গোয়েন্দা কাহিনি।
আর বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো হলো: অজিতকুমার পুততুণ্ডর কৌস্তভ, অদ্রীশ বর্ধনের ইন্দ্রনাথ রুদ্র, অনীশ দেবের এ.সি.জি, অসীম চট্টোপাধ্যায়ের গোরাদা, কৃষাণু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসব, গৌতম রায়ের নীল ব্যানার্জী, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গার্গী, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রবার্ট ব্লেক, ধীরেন্দ্রলাল ধরের গোবিন্দ, নলিনী দাসের গোণ্ডালু, নারায়ণ সান্যালের পি.কে.বাসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাদুড়ীমশাই, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়, প্রণব রায়, প্রভাবতী দেবীর কৃষ্ণা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরাশর বর্মা, পাঁচকড়ি দের দেবেন্দ্রবিজয় ও অরিন্দম, বিমল করের কিকিরা, বুদ্ধদেব বসুর চঞ্চল, মানবেন্দ্র পালের বাপ্পা, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হুকাকাশি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী, শিবরাম চক্রবর্তীর কল্কেকাশি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বরদাচরণ, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা, বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু ও বিচ্ছু, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, সমরেশ বসুর গোগোল, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, সুজন দাশগুপ্তের একেনবাবু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি, হিমানীশ গোস্বামীর গর্জন, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের জয়ন্ত, মানিক ও ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবু এবং হেমন্ত, রবিন ও ইন্সপেক্টর সতীশবাবু। রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দার কিশোরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলেন। ফলে লিখেছিলেন একটি পারিবারিক প্রেমের গল্প ‘ডিটেকটিভ’। ডিটেকটিভ নামটাই সার; ভেতরে ভিন্ন প্রসঙ্গ: গল্পটি দাম্পত্যকলহ জড়িয়ে পারিবারিক ঘটনাবৃত্তান্ত মাত্র। এ গল্পকে কোনোভাবে ডিটেকটিভ গল্প বলা সঙ্গত নয়।
এসব গোয়েন্দা কাহিনীর পাশাপাশি বাংলায় শিকার কাহিনী, রহস্য কাহিনী, থ্রিলার, ওয়েস্টার্ন কাহিনীরও সুপ্রচুর প্রমাণ মেলে। বাংলা ভাষায় রহস্য সাহিত্য সৃষ্টিতে কাজী আনোয়ার হোসেনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার সৃষ্ট চরিত্র মাসুদ রানা’য় ফুটে উঠেছে বহুমাত্রিক পরিচয়, যা একই সঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সত্তারও পরিচায়ক। বাংলায় প্রথমেই স্পাই থ্রিলারের সূচনা করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এ মাসুদ রানাকে কোনোভাবেই গোয়েন্দা বলা যায় না; বলা যায় না সম্পূর্ণ রোম্যান্টিক কোনো চরিত্রও। দস্যুও নয়। তবে এসবের এক সম্মিলিত রূপ ও তার চরিত্র এঁকেছেন এর স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানা সিরিজের মাসুদ রানা চরিত্রটি একাধারে গোয়েন্দা, দস্যুতা ও রোম্যান্টিকতারও প্রতীক।
দস্যুবৃত্তি নিয়ে একটি অমর চরিত্র বনহুর। সিরিজটির নাম দস্যু বনহুর। কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই তার কর্মক্ষেত্র। এর স্রষ্টা রোমেনা আফাজ। বনহুর মূলত দস্যু; কিন্তু তার কর্মকাণ্ড একজন নিখাদ প্রেমিকের। সঙ্গত কারণে বনহুর সিরিজ প্রকৃতপক্ষে রোম্যান্টিকতায় আকীর্ণ দস্যুতার কাহিনী। ‘ডাকাত নোটন সর্দার’ নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা দস্যুবৃত্তির গল্প। এ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, ডাকাত জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল নোটনের ছোট ভাই ঝোটন দস্যুদের হাতে মারা যায়। নোটন সেই থেকে নিখোঁজ। কেউ তার সন্ধান দিতে পারতো না। অনেক বছর পর কাজলার বিলে গভীর রাতে এক ভয়ানক দস্যুর আগমন ঘটে। এত নির্দয় আর ক্ষিপ্র তার হাত থেকে কেউই রক্ষা পায় না। সে নিষ্ঠুর নোটন সর্দারও অবুঝ শিশুর দাদা ডাক শুনে গলে যায় মোমের মতো। মনে পড়ে তার মৃত ভাই ঝোটনের কথা। ছেড়ে দেয় দস্যুতা। রহস্যগল্পের ধারায় দস্যুবৃত্তির কাহিনিও একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। পশ্চিমে যেমন ওয়েস্টার্ন কাহিনিতে ওয়াগন, ট্রেইল আর পিস্তল-রাইফেলের ছড়াছড়ি, তেমনি বাংলায় দস্যুতার গল্পে মাঝি, নৌকা আর কোচ-বল্লমের সাক্ষাৎ মেলে প্রায়।
পচাব্দী গাজি শিকারি হিসেবে খ্যাতিমান। তার বাঘ শিকারের কাহিনী নিয়ে লেখা ‘সুন্দরবনের মানুষখেকো’। অবাক হওয়ার বিষয়, এ বইটি পচাব্দী গাজি নিজে লেখেননি। তার কাছে শুনে শুনে অনুলিখন করেছেন সাহিত্যিক হুমায়ুন খান। আরেকজন শিকার কাহিনিকার আবদুর রহমান চৌধুরী। শিকার করেছেন ডজন খানেক বাঘ। আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন তিনটি বই। ‘জানোয়ারের খাসমহল’, ‘শিমুলতলার নরখাদক’ও ‘মানিগার নরখাদক’। ‘শিমুলতলার নরখাদক’ বইয়ে একটি মানুষখেকো বাঘের কথা রয়েছে। বাঘটির কিছু অলৌকিক গুণের কথা রয়েছে সে বইয়ে। বিবরণ দেওয়া হয়েছে যে বাঘটি অলৌকিক শক্তির অধিকারী ও অবাধ্য বলে পরিচিত হয়েছিল।
ভাষার দিক থেকে পাঁচ কড়ি দে, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভাষা পুলিশি প্রতিবেদন থেকে সাহিত্যিক গদ্যে উত্তরণ ঘটেনি। শুরুর দিকের কাহিনি হওয়ায় এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াই সঙ্গত। আবার শরদিন্দুর ব্যোমকেশের ভাষা পুলিশি প্রতিবেদন, জজের রায়ের ভাষা ও সাহিত্যিক গদ্যের সংরাগে সৃষ্ট নতুন ভাষা। পুরোপুরি সাহিত্যিক গদ্য নয়; কিন্তু পুলিশি প্রতিবেদন ও আদালতের রায়ের ভাষা থেকে ভিন্নতর। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভাষা সাহিত্যিক গদ্যের; কিছুটা কাব্যিক গন্ধও লেগে আছে তাঁর গোয়েন্দা গল্পের ভাষায়। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়ের ভাষায় পরিপূর্ণ সাহিত্যিক গদ্যের ভাষা। এদিক থেকে সত্যজিৎ রায় যথার্থ সাহিত্যিক গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা। তেমনি শিকার কাহিনির ক্ষেত্রে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শিকার গল্পের ভাষাও ষোলোকলাপূর্ণ সাহিত্যিক গদ্য। পরবর্তীকালের কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজে যে ভাষা সৃষ্টি করেছেন, সে ভাষা যেমনি চিত্তাকর্ষক তেমনি স্নায়ু উত্তেজকও। তাঁর গল্পপাঠে পাঠক সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠিত, উদ্বেল আর আতঙ্কিত থাকেন। কাহিনীর বর্ণনা অনেকটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রায় সিনেম্যাটিক ভাষা তার মজ্জাগত। সঙ্গতকারণে কাজী আনোয়ার হোসেন পাঠকের সঙ্গে নিজের ভাবনার যোগাযোগ ঘটান অতি দ্রুত। রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুরের ভাষা গতানুগতিক হলেও মাঝেমধ্যে ভাষার ব্যবহার এমনই আকস্মিক গুণঋদ্ধ যে, পাঠক হঠাৎ চমকে ওঠেন। আবার হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিসির আলী কিংবা শুভচরিত্রকেন্দ্রিক গল্পগুলোও রহস্য সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। এসব গল্পের ভাষাও ঝরঝরে। পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে ভাষার সম্মোহক শক্তি।
ভাষা-চরিত্র সৃষ্টি ও গল্পের বুনন বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর মধ্যে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ এবং সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাই মুখ্য। বাকি চরিত্রগুলো লেখকের কল্পনা ও চরিত্র সৃষ্টির কৌশলের কারণে যথার্থ গোয়েন্দা হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যোমকেশ চরিত্র খুব সাদামাটা। ব্যোমকেশের বিশেষ কোনো বেশভূষা নেই; চালচলনও সহজ-সরল। তার চেহারায় এমন কোনো বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে না, যা দেখে তাকে সমাজের দশজন থেকে আলাদা করা যায়। সহজে সে উত্তেজিত হয় না। তীক্ষ্নবুদ্ধি ও ধীশক্তির জোরে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম ব্যোমকেশ। তাকে কেউ খোঁচা না দিলে, কেউ জাগিয়ে না তুললে খুব সহজে তার ভেতরে বিশেষ সত্তার পরিচয় সহজে পাওয়া যায় না। ব্যোমকেশ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আপন বুদ্ধিমত্তার চেয়ে পুলিশি জেরার আশ্রয় গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। অপরাধীকে সরাসরি জেরা করে মানসিকভাবে দুর্বল করে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করাই তার মৌল প্রবণতা। ব্যাপক অনুসন্ধান শেষে নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের জোরে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা ব্যোমকেশে বিরল। সঙ্গত কারণে ব্যোমকেশকে স্বভাবগোয়েন্দা বলেও মনে হয়। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা এদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার গোয়েন্দা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা সুপ্রচুর। বিপুল পাঠ তার ভূগোল-ইতিহাস ও নৃতত্ত্বেও। ফলে তার পক্ষে সম্ভব ব্যাপক অনুসন্ধান শেষেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো। ফেলুদার কাজও তাই প্রমাণ করে। একেকটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষেত্রে ফেলুদা প্রচুর অনুসন্ধান করে, অনুসন্ধানলব্ধ ধারণার ওপর ভিত্তি করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তার স্বভাব। এদিক থেকে ফেলুদাকে শার্লক হোমসের বঙ্গীয় সংস্করণ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
কোনো গোয়েন্দাই গল্প বলে না। গল্প বলে সঙ্গীয় চরিত্র; দুই গোয়েন্দার সহকারী। সহ-চরিত্র অজিত বর্ণনা করে ব্যোমকেশের গোয়েন্দাবৃত্তান্ত, তাপস বর্ণনা করে ফেলুদার। ফলে গোয়েন্দার সব গতিবিধি কথকের জানা থাকে না। কিছু প্রত্যক্ষণ, কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করে গল্প এগিয়ে চলে। অথচ এ কথকের আড়ালে রয়েছেন স্বয়ং কাহিনীকার। এই কাহিনীকারই প্রকারান্তরে গোয়েন্দা, অপরাধী, পুলিশ ও পার্শ্বচরিত্র। শেষ পর্যন্ত লেখকই একাধিক চরিত্রের ভেতর নিজেকে তুলে ধরেন। বাংলায় অধিকাংশ গল্প উপন্যাসই সহজ ও সরল। জট পাকানো গল্প বাঙালি পাঠকের পক্ষে বোঝা কি খুব কঠিন? বাঙালিপাঠক মাত্রই কি হালকা ও সহজ গল্প পছন্দ করেন? শরদিন্দু শুরু করেছেন অজিতের মুখে গল্প বলে, কিন্তু শেষের দিকে নিজেই কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন নীহাররঞ্জন গুপ্তও। তার সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটী। এই কিরীটীও বিচিত্র ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে।
ইংরেজি সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্প আর বাংলায় গোয়েন্দা গল্পের পার্থক্য অনেক। পশ্চিমাদের সঙ্গে বাঙালির জীবনযাত্রা সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই প্রকট। সঙ্গত কারণে কোনাল ডয়েল যে প্রক্রিয়ায় শার্লক হোমস সৃষ্টি করেছেন, সে প্রক্রিয়ায় বাংলায় কোনো গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। এর কারণও স্পষ্ট। পশ্চিমের জীবনযাত্রার সঙ্গে বাঙালির জীবনযাত্রা এবং রুচিবোধ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাঙালির জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ-সরল। এখানে সংশয় কম; বিশ্বাস বেশি। সামান্য সকাতর মিনতিতে বাঙালির মন গলে। রূঢ় রূপ সে দেখায় কালেভদ্রে। চাতুর্য তার মজ্জাগত নয়; কূটচালেও সে অদক্ষ। বাঙালি খুন করলে কথাবার্তা ও আচার-আচরণেই সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রায় প্রকাশ করে। ফলে খুনি বাঙালির কৃতকর্ম উদ্ঘাটন করতে সাধারণ পুলিশ থেকে শুরু করে কোর্টের উকিল, কাউকেই গলদঘর্ম হতে হয় না। আসামি গ্রেপ্তারের পরই পুলিশি জেরার মুখেই বাঙালি খুনি দোষ স্বীকার করে বসে। তাকে কঠিন রিমান্ডের মুখোমুখি হতে হয় কখনো কখনো। রাজনৈতিক ঘটনার সূত্র ধরে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির প্রসঙ্গ ভিন্ন। সে সব স্বীকারোক্তি পরবর্তী সময় সংশ্লিষ্টজনেরা অস্বীকারও করেন। তাই রাজনৈতিক বিবেচনায় আটক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি সন্দেহমুক্ত নয়।
সাধারণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পেশাদার খুনিও পুলিশি জেরার মুখে অপরাধ স্বীকার করে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে খুনের পাশাপাশি জাল টাকা তৈরি, প্রতারণা, গুম, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁসসহ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেরও চেষ্টা হয় মাঝেমধ্যে। এসব ঘটনা জাতীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু এসব ঘটনা চিত্রায়িত করতে শক্তিমান কথাশিল্পীর আবির্ভাব জরুরি। কেবল শক্তিমান কথাশিল্পী হলেই সার্থক গোয়েন্দা কাহিনী লেখা সম্ভব নয়। শিল্পশর্ত পূরণে সক্ষম কথাসাহিত্যিক মাত্রই গোয়েন্দা গল্প না-ও লিখতে পারেন। গোয়েন্দা গল্প লিখতে হলে, কেবল জীবনবোধ, শিল্পবোধ থাকলেই চলে না, সেই সঙ্গে আইনি জটিলতা, পুলিশি কৌশল, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, অপরাধের ধরন, অপরাধীর মনস্তত্ত্বসহ গোয়েন্দার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ ধারণা ও অভিজ্ঞতা থাকা চাই। গোয়েন্দা গল্পের লেখককে হতে হয় একাধারে মনস্তত্ত্ববিদ, আইনজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানী। না হলে গোয়েন্দা কাহিনী কেবল খুন ও চুরি-ডাকাতির সংবাদভাষ্যে পর্যবসিত হবে। সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠবে না। এরপর আসে রহস্য গল্পের কথা। রহস্য গল্প লেখার জন্যও কেবল সাহিত্যবোধ আর জীবনবোধই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে থাকতে হয়, রসবোধ ও রসসৃষ্টির অনন্য স্বভাবও। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা এবং রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর পাঠে সে ব্যঞ্জনাঋদ্ধ রসের সন্ধান মেলে।