সাপের খেলা দেখবেন গো, সাপের খেলা
এই দাঁতের পোকা উঠাই, পিঠের ব্যথা,
পেটের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথায় শিঙ্গা লাগাই, শিঙ্গা-আ…
এই শিঙ্গা টানি, মাজা টানি, মাজা ব্যথা,
দাঁতের ব্যথা, দাঁতের পোকা ফেলাই-ই-ই…
এই সুর করে যারা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারাই আমাদের কাছে বেদে বা বাইদ্যা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী একটি বিস্ময়কর পেশাভিত্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এই বিস্ময়কর জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানতে আজও আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় ইংরেজ সিভিলিয়ানদের রচনার কাছে। এই সব গবেষকদের রচনায় সেই গভীরতা নেই যা দিয়ে আমরা আমাদের এই ভূমিপুত্রদের যথার্থ পরিচয়টি পেতে পারি। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত হয় জেমস টেলরের Topography of Dhaka। বইটিতে বেদেদের সম্পর্কে খুবই সংপ্তিভাবে বর্ণনা রয়েছে। তিনি বেদেদের Inpure cust বলে অভিহিত করেছেন।
অন্য আর এক ইংরেজ গবেষক জেমস ওয়াইজ। তিনি তাঁর Notes on the Races and Traders of EasternBengal (১৮৮৩) বইতে বেদেদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তিনিই খুব সম্ভব একমাত্র ব্যক্তি যিনি বেদেদের সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা দিয়েছেন অন্য সিভিলিয়ানদের তুলনায়। তিনি নাথ ও কঞ্জরদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বেদেদের মিল খুঁজে পেয়েছেন এবং জিপসিদের সঙ্গে এর দৈহিক সাদৃশ্য স্বীকার করেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের বেদেদের মোট সাতটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা —ক) বাজিয়া খ) বাজিকর গ) মাল ঘ) মীর শিকার ঙ) শামপেরিয়া চ) শানদার ছ) রাসিয়া। জেমস ওয়াইজ সংস্কৃত ব্যাধ শব্দ থেকে বেদে শব্দটি এসেছে বলে মত প্রকাশ করেন।
তারা আর নৌজীবন ত্যাগ করতে পারেনি
জেমস টেলর ও বেদেদের শিকারজীবী সম্প্রদায় বলেই মনে করেন। জেমস টেলরের মত, William Wilson Huntes তার A Statistical Account of Bengal Vat-s-এ বেদেদের একটি ভ্রাম্যমাণ ব্যাবসায়ী জাতি বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের বেদেদের তিনি জিপসিদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বেদেদের জিপসীর মতো যাযাবর জনগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করেছেন Datlan. E. T. এছাড়া, Richard son, D. তার An Account of Bazeegurs A Ssiatic Research, Vol (V111) এ বেদেদের সম্পর্কে যে আলোচনা করেন তা থেকে এদেশের বেদের সম্পর্কে বিস্তাড়িত কিছু জানা যায় না। তা সত্ত্বেও বেদে প্রসঙ্গে কিছু জানার ক্ষেত্রে তারাই হলেন গবেষকদের অগ্রজ।
আমাদের দেশে বিশ শতকের মাঝামাঝি কতিপয় গবেষক বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। তাদের মধ্যে কাজি আবদুর রউফ অন্যতম। তিনি এই জাতি গোষ্ঠীকে নিয়ে বিস্তাড়িত গবেষণা করেন। ১৯৮৭ সালে ’বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়; একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সমীক্ষা’ নামে এম.ফিল থিসিস সমাপ্ত করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় প্রতিবেশ সমাজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতি’ নামে পিএইচডি., থিসিস সমাপ্ত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু দুটো থিসিসই অপ্রকাশিত। তিনি বেদেদের মোট সতেরোটি গোত্রের কথা উল্লেখ করেন। বেদে সম্প্রদায় নিয়ে এম.ফিল থিসিস করেছেন আর এক গবেষক নাজমুন নাহার লাইজু। তিনিও তার অভিসন্দর্ভ ‘বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়’ এ পূর্ববর্তী গবেষকদের নীতি অনুসরণ করেছেন ফলে বেদেদের নৃতাত্ত্বিক উৎস সম্পর্কে জটিলতা থেকেই গেছে। কাজি আব্দুর রউফ জানান বেদেরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে বা যুদ্ধের প্রয়োজনে বা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য ঘরবাড়ির মায়া ত্যাগ করে দেশান্তরী হয় এবং বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।
কাজি আবদুর রউফ-এর মতো ড. অসীত বরন পালও মনে করেন—ব্রাহ্মণ্যবাদে নিপীড়িত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বৈরী পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং শেষ পর্যন্ত কয়েকশ বছর নৌকায় কাটানোর ফলে তারা আর নৌ জীবন ত্যাগ করতে পারেনি।
জাহানারা হক চৌধুরী Pearl-Women of Dhaka বইটিতে শান্দার বেদেনীদের প্রসঙ্গে আলোক পাত করেছেন, কিন্তু তিনিও বেদে সম্প্রদায়ের শেকড়ের সন্ধানটি দিতে পারেননি। তিনি বেদেদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে তাদের বক্তব্যকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। They claim that the word `Bedey’ has Originated Srom `Bedouin’.They further add that as a result of their war with king Abraham(Abraha?) they were expelled from Arabia….
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের উৎপত্তি সম্পর্কে বেদে বিষয়ক গবেষকগণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টানতে তো পারেনইনি এমনকি একমতও হতে পারেননি। কেউ বলেছেন, বেদেরা আরাকানের মনতং মান্তা নৃগোত্র থেকে এসেছে। কেউ বলেছেন, না, খ্রিস্টীয় সাত শতকের শেষদিকে তারা আরবের আলবাদিয়া নামক স্থান থেকে এদেশে এসেছে। কেউ বলেছেন, খ্রিস্টীয় এগারো শতকে ইরানে তাদের উপস্থিতি ছিল। আবার কেউ বলেছে, না তারা মূলত খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মাঝামাঝি পূর্বভারত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
বেদেদের গায়ের রং গভীর কালো, চুল কোকড়ানো
তবে নৃবিজ্ঞানীরা একেবারেই একমত যে, বাংলাদেশের বেদেদের মধ্যে আরবদের সেমিটিক কোনো লক্ষণ নেই। ড. অতুল সুর মনে করেন, ‘বাংলায় আদি অস্ত্রাল ও ভূমধ্যসাগরের সংমিশ্রণেই এদেশের নৃতাত্ত্বিক বুনিয়াদ গঠিত হয়েছে। অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বেদে সম্প্রদায়টিও সংমিশ্রনেরই অর্ন্তভূক্ত’। বেদে জনগোষ্ঠীর উৎপত্তির ব্যাখ্যা একমাত্র নৃবিজ্ঞানেই সম্ভব এবং এটাই হতে পারে একমাত্র আশ্রয়। ‘দৈহিক দিক বিচার করলে বেদে জনগোষ্ঠী আদি অস্ট্রাল বংশোদ্ভূত। বেদেদের গায়ের রং গভীর কালো, চুল কোকড়ানো এবং ঢেউ খেলানো। তাদের দৈহিক গঠন সুঠাম, উচ্চতা মাঝারি ধরনের, চোখ আয়ত ও কৃষ্ণ। এ-সব দৈহিক লক্ষণ আদি অস্ট্রালদেরই পরিচয়বাহী।
ড. সমরেন্দ্রনাথ মল্লিক বলেন, ‘এরা অনার্য। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আশায় কিছু কিছু আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব এদের মধ্যে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃতি ধর্মে, বেশভূষায়, আচরণে এরা এখনও সেই আদিম বন্যস্তরের। এরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। সাপখেলা দেখায়, বিভিন্ন ভেষজ বৃক্ষের শিকড় বিক্রি করে।‘
বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী সম্পর্কে এই সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে সাহিত্য একটি বিশেষ প্রামান্য দলিল। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই বাংলাদেশের বেদেরা যে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, এদেশীয় সাহিত্যেই। ইংরেজ সিভিলিয়ানদের তথ্য প্রমানের চেয়ে তা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও সত্য। বিচিত্র সংস্কারচ্ছন্ন আদি কৌম গোষ্ঠীগুলোর একটি হলো বেদে জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর যথার্থ পরিচয় জানতে তাই হাত বাড়িয়েছি বাংলা সাহিত্যের দিকে। এছাড়া, আমরা বেদে জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়টি জানতে সম্পন্ন করেছি ‘বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’। সেখানে আমরা বলার চেষ্টা করেছি যে-এদেশে বেদে বা ব্যালগ্রাহী বলে যারা পরিচিত তারা পারস্য বা আরব দেশ থেকে আসা কেউ নয়। এরা এদেশেরই ভুমিজ। বহু খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকেই তারা এদেশে সর্পজীবী হিসেবেই ছিল। খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ঐতিহাসিক দলিল পুরানগ্রন্থে তার প্রমান সুস্পষ্ট।
আমরা বেদেদের মধ্যে মোট তিনটি মূল গোত্রের সন্ধান পেয়েছি সাতটি, নয়টি বা সতেরোটি নয়। এই মূল গোত্র থেকেই আবার নানারকম উপগোত্র এবং উপ-উপগোত্র সৃষ্টি হয়েছে। মূলগোত্র তিনটি হলো—মাল বেদেগোত্র, শান্দার বেদেগোত্র, এবং বাজিকর বেদে গোত্র। নিচে এই তিনটি গোত্রের উপগোত্র, উপ-উপগোত্র এবং তাদের পেশা বা কাজ সারণীর মাধ্যমে দেখানো হলো।
গোত্র | উপগোত্র | উপ-উপগোত্র | |
মালবেদে | সাপুড়িয়া | x | সাপ ধরে বিক্র করে, সাপের খেলা দেখায়, সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসা করে, তন্ত্রমন্ত্র জানে ও চর্চা করে। |
বেবাজিয়া | তৈরি | গাছ-গাছরা বিক্রি, বাচ্চাদের খেলনা বিক্র করে (মালগোত্র) | |
ব্যাজ | ফেরি করে চুরি ফিতা, মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করে। (মাল গোত্রে এরা ব্যাজ) | ||
লাউয়ো/ বৈরাল | তাবিজ-কবজ বিক্রি ও মাছ ধরার সঙ্গে সম্পর্ক। | ||
শান্দারবেদে | রায়েন্দা | নাগারচি | চুড়ি-ফিতা আলতা বিক্রি করে, (শান্দার গোত্র নাগারচি) |
কুড়িন্দা | হারানো জিনিস খোজা, বিশেষ করে ডুবিয়ে যারা পানি থেকে হারানো জিনিস খোজে। | ||
রাসিয়া | x | ধাতুর তৈরি মাদুলি তৈরি ও বিক্র করে, পাথরের আংটি ও অষ্ট ধাতুর আংটি, চুড়ি তৈরি করে ও বিক্রি করে। | |
পাখমারা | বহুরূপী | বহুরূপী সেজে জীবিকা ধারণ করে, সঙ নয়। বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। | |
পটুয়া | পট এঁকে বা ছবি একে জীবিকা নির্বাহ করে, যেমন গাজীর পট নিয়ে ভিক্ষা করা ইত্যাদি। | ||
বাজিকর | বান্দুরে বেদে | x | সার্কাস খেলা দেখায়, ভাল্লুক নাচায় বানরের খেলা দেখায়, টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গননা করে ইত্যাদি। |
(রঞ্জনা বিশ্বাস, বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় পৃ:১২৫-২৬)
*নাগারচি নামে একটি আলাদা সম্প্রদায়ও রয়েছে যারা একসময় রাজাবাদশা ও জমিদার পরিবারের সেবা কাজে নিয়োজিত ছিল।
বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সত্য উদঘাটনের প্রামান্য দলিল এদেশের সাহিত্য। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই বাংলাদেশের বেদেরা যে এঅঞ্চলে বসবাস করে আসছে তার প্রমান পাওয়া যায় এদেশীয় রচনায় যা ইংরেজ সিভিলিয়ানদের তথ্য প্রমানের চেয়ে অনেক বেশি সত্য ও নির্ভরযোগ্য। তাই আমি এই বিচিত্র জনগোষ্ঠীর প্রকৃত পরিচয় জানতে হাত বাড়িয়েছি সাহিত্যের দিকে।
ভাসমান বেদে জনগোষ্ঠীর পরিচয় বিধৃত হয়েছে সাহিত্যে
সাহিত্যে গোষ্ঠী ভিত্তিক নিম্নবর্ণের পরিচয় মেলে ১৯২৩ সালের পরে। নিম্ন বর্গের সাহিত্য অর্থাৎ উপন্যাস গল্পে নিম্নবর্গের প্রাধান্য বলতে যা বুঝায় তার প্রকাশ ১৯২৩ এর পর। এর আগে তারা গল্প উপন্যাসের পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে বিচ্ছিন্ন ভাবে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ১৯২৩ সালে কল্লোল পর্বে এসে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে ঢোড়াই তাৎমা-শবর-মূন্ডা, ঝালো-মালো প্রভৃতি গোষ্ঠীর রীতি নীতি আচার-আচরন, বিশ্বাস সংস্কার, ভাষা-বুলি, লোক-ইতিহাস-মিথ সাহিত্যে এক ভিন্ন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে থাকে। উদঘাটিত হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের মর্মমূল। এই পর্যায় অস্থায়ী ভাসমান গৃহহীন যাযাবর সম্প্রদায়কে নিয়েও রচিত হয়েছে ছোটগল্প এবং উপন্যাস। সেসব উপন্যাস ও গল্পে তারা ঠাঁই পেয়েছে প্রধান চরিত্র হিসেবেই। বাংলাদেশে এইসব যাযাবর সম্প্রদায়কে বলা হয় বেদে, ভারতে তারা বাদিয়া। ভাসমান এই বেদে জনগোষ্ঠীর’ পরিচয় বিধৃত হয়েছে সাহিত্যে। এই দুঃসাহসিক কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তারাশঙ্করের হাতেই। ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন তাদের আত্মীয়। তার রচিত উপন্যাস নাগিনী কন্যার কাহিনী’ ছোট গল্প-‘বেদেনী’ ,‘বদের মেয়ে, ‘সাপুড়ে’, ‘যাদুকর’ ইত্যাদি উপন্যাস ও গল্পে বেদের জীবন অঙ্কিত হয়েছে তার চুড়ান্ত ভালোবাসা ও দরদের আশ্রয়। এরপর তাঁর আত্মজীবনীতেও তারা বাদ পড়েনি।
এধারা বাহিকতায় পল্লী কবি জসিমউদ্দিন এর রচনা ‘বেদের মেয়ে’ নাটক, তাঁর আতœকথায় এবং কবিতায়ও আছে বেদের উপস্থিতি। জীবনানন্দদাশের একটি কবিতায় আছে বেদে মেয়ের রোমান্টিক উপস্থিতি। উপন্যাস রহুচন্ডালের হাড়’ এবং ‘গড় শ্রীখন্ডে’ও বেদে জীবনের নির্যাস। এর আগে মধ্য যুগের পালা ‘মহুয়ায়’ বেদেদের পরিচয় বিধৃত হয়েছে দেখতে পাই। সুতরাং একেবারেই অপ্রতুল নয় ‘সাহিত্যে বেদে জনগোষ্ঠীর পরিচয়’ এবং তাদের তথ্য উপাত্তের বিষয়টি।
উল্লেখ্য যে-‘গোষ্ঠী’ শব্দটির অর্থ বহুত্বব্যঞ্জক। বিভিন্ন বাংলা অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে পরিষদ, সভা, পরিষদগন, পোষ্যবর্গ, জ্ঞাতি, বংশ, কুল ইত্যাদি। আবার গোষ্ঠী বলতে কৌমকেও বোঝায়। অথচ- কৌম বা কুল হলো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজ ব্যাবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কৌম বা কুল হলো এক কল্পিত পূর্ব পূরুষ থেকে আত্মীয়তার সম্পর্কে গড়ে ওঠা গোষ্ঠী যা এক রৈখিক বংশানুক্রম নীতির ভিত্তিতে তৈরি হয়।
A kinship group normally comprising everal lineages its members are related by a unilineal descent rule lent it is too large to enable members to trace actual biological links to all other members. (সামাজিক সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান/ড. সুমহানবদোপাধ্যায় পৃ:৮৯)
এই অলোচনায় দেখা যায় কুল বা কোম কতগুলো lineage নিয়ে গঠিত এরা বহির্বিবাহকারী গোষ্ঠী এবং এক রৈখিক বংশানুক্রমের নীতিতে গঠিত আর কল্পিত পূর্বপুরুষ থেকে প্রতিষ্ঠিত।
আর বংশ বা lineage হল বাস্তব পূর্বপুরুষের একরৈখিক আত্মী গোষ্ঠী। রেমন্ড ফার্থ বলেন, A lineage, meaning primarily a line of descent in now taken also to mean a unilineal descent groupall members of which trace their geneological relationship back to a founding ancestor’
এদিকে ইংরেজি `Commune’ এর অর্থে বলা হয়েছে যে a group of people living together and sharing possessions and responsibilities, শব্দটির বাংলা প্রতি শব্দ হল গোষ্ঠী। Marry G. Ross বলেন `Community means a commonlife. of some kind, and that there is value in indentifying one self with and sharing in this commond life .
গোষ্ঠী হল-যখন কিছু মানুষ ভৌগোলিক পরিসরে তাদের ধর্ম ভাষা, পেশা, জাতিয়তা সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে চুড়ান্ত ভাবে একটি সমউপলদ্ধিতে পৌছায় তখন তাদের পুরোদলকে গোষ্ঠী বলা হয়। এই গোষ্ঠী কখনো কাল্পনিক পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী (আদিবাসী) আবার কখনো বাস্তব পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী (সাধারণ-বাঙালির) হতে পারে। ‘বেদে হচ্ছে সেইরকম একটি গোষ্ঠী যারা ভাসমান যাযাবর শ্রেণীর গোষ্ঠী বলে পরিচিত। এরা প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
এক গোষ্ঠীর জীনপুল অন্য গোষ্ঠীর মতো হয় না
মানুষের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় খুঁজে পেতে নৃ-বিজ্ঞানীগণ মানুষের দৈহিক অবয়ব এবং জীনগত বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু এখন মানুষের জাত নির্বাচন অতটা সহজ নয়। জাতের সংজ্ঞায় বিজ্ঞানী কোহেন বলেন—জাত হচ্ছে এক ধরনের জনগোষ্ঠী, যাদের ভিতর একটি নির্দিষ্ট ধরনের জীন বা জীনগুচ্ছ সঞ্চারমান থাকে”। এই জিন মানুষের দেহের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে। যার ফলে এক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রবহমান জীনপুল অন্য একটি গোষ্ঠীর অনুরূপ হয় না।
এদিকে ক্রমেই মানুষ স্বগোত্র ত্যাগ করে নানাকারণেই ভিন্নগোত্রের সাথে আন্তঃপ্রজননিক সঞ্চারণ ঘটাচ্ছে ফলে মূলজাতির বৈশিষ্ট্যসমূহে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন জাত। তারপরেও প্রতিটি দেশের ন্যায় এখনও বাংলাদেশে নিজেদের বংশধারা টিকিয়ে রেখেছে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন একেবারে প্রান্তিকপর্যায়ে আছে বেদে সম্প্রদায়। নানা সংমিশ্রণ পেশাগত রূপান্তর, ভাষাগত তারতম্য এবং যাযাবর মানসিকতার পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখন তাদের গোষ্ঠীকে মূল আদিবাসী গোষ্ঠী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই বিচ্ছিন্নতা এখন আরো বেশি জটিলতার সৃষ্টি করেছে তাদের জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এই বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে কেউ বলছেন মাঙতা, মান্তা কেউ বলছেন বেদিয়া বা বেদে। এছাড়া তাদের নিয়ে শৌখিন গবেষকগণ আছেন বিপাকে। তাদের সঙ্গে আরো কিছু ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পেশাগত সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য আচরণ ও ভাষাগত পার্থক্য বা সাদৃশ্য এই জটিলতাকে উস্কে দিয়েছে কিভাবে তা পটভূমিতে আলোচিত হয়েছে এবং এ অধ্যায়ও আমরা দেখব। বর্তমান গবেষণায় কেবলমাত্র বেদে জনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আগেই বলেছি বেদে জনগোষ্ঠী আদিবাসী একটি সম্প্রদায়। কেন আমরা তাদের আদিবাসী বলব? এপ্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুসরণ করা যাক। যে সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে শনাক্ত করে আমরা আদিবাসীদের চিহ্নিত করব তা হলো—
ক) স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী জনগোষ্ঠী যারা নিজেদের আদিবাসী বলে মনে করে এবং অন্যরাও এই পরিচিতির স্বীকৃতি দেয়।
খ) বৈচিত্র্যপূর্ণ আবাসভূমি কিংবা বাসস্থানের বৈচিত্র্যপূর্ণতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে সম্পৃক্ততা।
গ) দেশের বৃহত্তর সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে প্রথাগত সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পার্থক্য।
ঘ) একটি আলাদা ভাষা যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা কিংবা ঐ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা থেকে আলাদা।
এই সকল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকও তার নীতিমালায় ওই বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে।
বাংলাদেশে আমরা যাদের বেদে সম্প্রদায় বলছি—তারা নিজস্ব পরিমন্ডলে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম। নদীর তীর ঘেষে তাবু টানিয়ে কিংবা টঙ ঘর তৈরি করে অথবা বিচিত্র নৌকায় দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে আগ্রহী জনগোষ্ঠী সাপের খেলা দেখানো, সাপধরা, দাঁতের পোকা তোলা ইত্যাদি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। যেহেতু নদী বা জলাশয়ের কাছাকাছি বাস তাই মাছ ধরা বা ডাহুক ও বক শিকার তাদের পেশার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে কৃষি কাজ তাদের পছন্দ নয় বরং ঘৃণা করে। ভারতে এ গোষ্ঠীকে বলা হয় বেদিয়া। অনেকের মত মিথুশিলাক মুরমু বলেন—“অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় এরা বেশি যাযাবর, আর্থিক কারণেই তারা এরূপ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছে”।
প্রচলিত ধারায় বেদে বা বেদিয়ারা কথা বলে বাংলায়
এদিকে বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, নোয়াখালি ছাড়া আর কোথাও বেদিয়া নাই বলে জানান অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।১৪ অথচ রীজলে সাহেবের বরাত দিয়ে মিথুশিলক জানান যে কেবল সিরাজগঞ্জে তাদের দেখা মেলে। এদের অলঙ্কার পরার ধরণ ও বৈশিষ্ট্যও বেদেদের মতই—এরা বালা, বাজু, হাঁসুলি, পায়ের মল বা খাড়–, নাকছাপ, কোমরে বিছা পরে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য অন্যান্য আদিবাসী গোত্রের সাথেও সম্পর্কযুক্ত। এছাড়া এদের নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে। প্রচলিত ধারায় বেদে বা বেদিয়ারা কথা বলে বাংলায়, টানটা নিজস্ব রীতির। তবে একদলের ভাষা ঠার অন্য দলের সাদরী যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে তাদের পৃথক করেছে।
আমরা যাদের বেদে বলছি—তারা বাংলাদেশে মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং মান্তা নামে পরিচিত এরা যাযাবর শ্রেণীর জনগোষ্ঠী। তুক তাক করা, মন্ত্রতন্ত্র জানা সর্পবিদ্যায় পারদর্শী জনগোষ্ঠী হল বাংলাদেশের বেদে। ভারতে এরা বাদিয়া বা বেদিয়া নামে পরিচিত। ড. অসিতবরণ পাল বলেন—নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মদের অত্যাচারে নৌজীবন বেছে নেয়। এবং অদ্যাবধি তারা তা ত্যাগ করতে পারে নি। এ তো সেন আমলের ঘটনা। তারও পূর্বে এই শিকারী যাযাবর গোষ্ঠী মূলত: কোথা থেকে আবির্ভূত হয়েছিল? নৃ-বিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে জিপসী নামে যে যাযাবর জাতি আছে “তাদের জন্মভূমি ভারতবর্ষ, মধ্যযুগে তারা ইউরোপে আসে”।
এ অবস্থায় যাযাবর শ্রেণির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ রাখতে হয় আর তা হল—“অভিযোজন ক্ষমতা।” পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলবার ক্ষমতা এদের চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটি সংস্কৃতির অংশ তবে বাংলাদেশের বেদে-ই বলি আর ভারতের বেদিয়া কিংবা লাউয়ো গাইন কিংবা পোদ বা মান্তা এরা মূলত ‘আদি অস্ট্রাল’ উপজাতের অংশ সাঁওতালদের বিশ্বাস কিংবা বক্তব্য ধরে নিয়ে একথা বলা যায় যে “এরা সাঁওতালদের হারিয়ে যাওয়া একটি অংশ।
মান্তা ও বেদে জনগোষ্ঠী
পটুয়াখালির আগুনমুখা—গলাচিপা কিংবা বরিশাল, বরগুনা, ভোলা ও পিরোজপুরের উপকূলীয় এলাকার নদীতে যে মৎস্য শিকারী সম্প্রদায়ের দেখা পাওয়া যায় তারা নিজেদের পরিচয় দেয় মান্তা বলে। তাদের প্রধান বাসস্থান হল—নৌকা যা বেদেদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এছাড়া তাদের ধর্মাচার, পোশাক পরিচ্ছদ, বিচার ব্যবস্থা, সাংগঠনিক কাঠামো, ভাষা ইত্যাদি বেদেদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কেবল পেশাগত পার্থক্যে দুটি সম্প্রদায় ভিন্ন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন ওঠে বেদে মান্তা কি জেলে মান্তাদের পূর্বসূরী নাকি তার উল্টোটা?
মান্তা সম্প্রদায় বেদেদের একটি গোত্র
গবেষক শঙ্করলাল দাশ—তার মানতা সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেন—“সাংস্কৃতিক আচার আচরণে মানতা সম্প্রদায়ের জীবনধারায় বেদেদের ছাপ সুস্পষ্ট। বেদেদের সাথে এদের মূল্যবোধের মিল যথেষ্ট। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের আত্মিকটান প্রবল। বহর বেধে চলা, সর্দার প্রথা, সালিশ, বিয়ে, ধর্মীয় চিন্তা চেতনা, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান প্রভৃতি ক্ষেত্রে মান্তাদের সাথে বেদেদের হুবহু মিল রয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করে ধারণা হচ্ছে মান্তা সম্প্রদায় বেদেদের একটি গোত্র। বেদে সম্প্রসায় থেকেই এর উৎপত্তি হতে পারে” ।
শঙ্করলাল দাশ মান্তাদের বেদে সম্প্রদায়ের একটি গোত্র বলে ধারণা করেছেন। আমরা অবশ্য এর পক্ষে তো নয়-ই এর উল্টোটাও বলতে চাই না। বরং আমরা দেখতে চাই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের যাযাবার এই মৎস্য শিকারী” মান্তা সম্প্রদায়ের সাথে বেদেদের সম্পর্ক কতটুকু।
সাভারের সকল বেদে নিজেকে মান্তা বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এ অবস্থায় শব্দটির উৎস সন্ধান জরুরি হয়ে ওঠে।
আমরা বল্লাল রাজের সঙ্গে আগত মনতংদের প্রধান বিবেচনা করেই এগুতে চাই। গবেষকগণ মনতংদের আরাকানের অধিবাসী বলে মনে করেন। সে হিসাবে আরাকান প্রদেশ এবং বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের ব্যবহৃত শব্দাবলীর মাধ্যমেই এই শব্দ জট খোলার প্রচেষ্টা আমাদের। চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি। গবেষকগন মনে করেন- এসব আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা ভাষী আদিবাসীদের সাথে মিথ এবং শব্দগত সাদৃশ্য রয়েছে মানতা শব্দের। গবেষকগণ ইতিপূর্বে যে মনতং আদিবাসী সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন তাতে শব্দটি’র বুৎপত্তিগত ব্যাখ্যায় তেমন মনোনিবেশ করেননি। ফলে শব্দটির যথাযথ আভিধানিক অর্থ কি তা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তবু চট্টগ্রামে বসবাসরত ভোটবর্মী ভাষাভাষী আদিবাসীদের মধ্যে শব্দটির ব্যবহারিক অর্থ খুঁজে দেখার চেষ্টা ছিলো আমার ‘বাংলাদেশে বেদেজনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়’ গ্রন্থে।এখানে তারই পুনরাবৃত্তি করা হলো।
মন এবং তং শব্দ দুটি আলাদা শব্দ। চাকমা ভাষায় তং-এর অর্থ পাহাড়। আবার পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসীরা Tong বলতে বুঝায় পাহাড়ে বা গাছের উপর তৈরি কুঁড়েঘর। বাংলায় এ জাতীয় ঘরকে টোঙঘর বলা হয়।
আবার তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘তৈন’ শব্দের অর্থ হল নদী। এই শব্দটি মূল ধরলে দাঁড়ায় তৈন>তং কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় তং শব্দের অর্থও পাহাড়। এদিকে চাকমা তান বা তন বা Tan অর্থ জল। যেমন—তানজাং বা Tanjan শব্দের অর্থ জলপ্রপাত। অন্যদিকে ককবোরাক ভাষী ত্রিপুরা ‘তৈ’ শব্দের অর্থও জল।
এদিকে Mon শব্দটি চাকমা মেং বা ম্যাং শব্দ থেকে এসে থাকতে পারে যার অর্থ হল “রাজা”। মেং>মং>মন। অন্যদিকে রাখাইন ভাষায় কিন্তু অবিবাহিত পুরুষেরা নামের আগে মং শব্দটি ব্যবহার করে।
পাহাড়ের রাজা নামে পরিচিত হয় মেনতং আদিবাসী
মনে রাখা দরকার যে ভাষা বিচারে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সাদৃশ্য থাকলেও এদের ভাষা অন্যান্য আরাকান অথবা অন্য যে কোন ভাষায় পারিপার্শ্বিক প্রভাব এড়াতে পারেনি। “শব্দ”টি নানা গোত্রের মধ্যে ব্যবহৃত হতে হতে নিজেকে বর্তমান গড়হ ঞড়হম নামে রূপান্তরিত করে নিয়েছে যা বর্তমানে বিকৃত মান্তা বেদে নামে সমাজে প্রচলিত হয়েছে।
আমরা এবার পুরো শব্দের সম্ভাব্য পরিচয় শনাক্ত করব।
শুরুতেই চাকমা মেং বা ম্যাং শব্দের মূল ঠিক রেখে দেখতে পাই—Mon Tong/ †gs Zs > Mon Tong/ মং তং এখানে মেং অর্থ রাজা আর তং অর্থ পাহাড়। তাহলে পাহাড়ের রাজা নামে পরিচিত হয় মেনতং আদিবাসী।
সে হিসেবে পাহাড়ের শিকারজীবি আদিম অধিবাসীদের পরিচয় পাই আভিধানিক অর্থে। যা কালক্রমে মেং তং > মং তং > মন্তন > মান্তা।
আবার তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার ‘তৈন’ অর্থ নদী। সে বিচারে দাঁড়ায় মেং তৈন > মংতন > মন্তন> মান্তা। অর্থ দাঁড়ায়—নদীর মানুষ/রাজা। অন্যদিকে চাকমা শব্দে মেংতান > মেংতং> মনতন > মান্তা। এখানে মেংতান অর্থ দাঁড়ায় জলের রাজা। আবার ত্রিপুরা তৈ শব্দ যুক্ত হলেও অর্থ একই দাঁড়ায়। মেং তৈ > মেংতৈ > মান্তা।
ফলে শব্দটি যে একটি বিশেষ অর্থ দ্যোত্যক শব্দই থাকে এ কথা কিন্তু অস্বীকার করা যায় না নানা বিবর্তনের পরেও। শব্দটি যা-ই হোক পাহাড়ের রাজা, জলের রাজা কিংবা জলের পুরুষ তাতে কিন্তু ‘বেদে’ দের অতীত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটের একটি চমৎকার ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। আবার শব্দটির আভিধানিক অর্থের অস্বচ্ছতা যেন ‘বেদে’ মনস্তত্বের অসচ্ছ্বতার মতই জটিল। তাদের জন্য শব্দটি তাই যথাযর্থ।
তারা হয়ত এককালে পাহাড়ে বিচরণকারী মানুষই ছিল কালক্রমে নেমে এসেছে নদীর কাছে হয়ে উঠেছে নদীর মানুষ জলের রাজা জলের পুরুষ।