কবিতার জন্মলগ্ন থেকেই এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রেম। বিরহ যন্ত্রণা। আজ পর্যন্ত প্রেম কবিতার এক চিরায়ত বিষয় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, প্রেমের সংজ্ঞাকে যদি মানব-মানবীর সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আরেকটু দীর্ঘায়িত করি, তাহলে বলা যায়, পৃথিবীর সব কবিতাই প্রেমের কবিতা।
যদিও প্রেম বলতে প্রচলিত অর্থে আমরা মানব-মানবীর প্রেমের কথা বুঝে থাকি। প্রেমের কবিতা বলতে, যেখানে বিরহ, ব্যথা, কারও প্রতি ভালো লাগা, মুগ্ধতা প্রকাশ পায়, তাকেই আমরা প্রেমের কবিতা হিসেবে চিনে থাকি। সম্প্রতি ‘চিন্তাসূত্র’ প্রেমের কবিতা নিয়ে একটি সংখ্যা করেছেন, যেখানে প্রকাশিত হয়েছে একঝাঁক তরুণ কবির প্রেমের কবিতা। তাদের কবিতা প্রেম বর্ণিল আঙ্গিকে ফুটে উঠেছে।
একটি পয়ারে, অন্য চারটি কবিতা স্বরবৃত্তের নূপুর পরা। প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য হৃদয়ের আকুতি কবিতাগুলোতে বাণীরূপ পেয়েছে উপমা, চিত্রকল্পের মিশ্রণে।
খাদিজা ইভের কবিতায় উঠে এসেছে প্রেমের যন্ত্রণা এবং প্রেমিককে ফিরে পাওয়ার তীব্র বাসনা। প্রেমিক তার কাছে রহস্যময় এক পুরুষ। ‘তিলোত্তমা: ছয়’ কবিতায় দেখি, ‘খেলতে নাকি খেলাতে ভালোবাসো বুঝি না।’ পরের চরণেই লিখেছেন, ‘রহস্যাবৃত তোমাকে শরত আকাশে দেখতে চাই।’ শরতে আকাশ যেমন স্বচ্ছ। মেঘহীন। তেমনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত মানুষকে কোনো রহস্য আবরণ ছাড়া দেখতে চেয়েছেন। বুঝতে চেয়েছেন। ভালোবেসে কখনো ঝিনুকের মতো তিনি মুক্তা ফলাতে চেয়েছেন। কখনো প্রেমিককে নিয়েই সুখী হতে চেয়েছেন। কৈশোরিক প্রেমের যে অস্পষ্টতা, আবেগ, তা তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। খাদিজা ইভ তার কবিতায় প্রচলিত কোনো ছন্দ ব্যবহার করনেনি। গদ্য ছন্দে লেখা কবিতাগুলোকে উপমা ও চিত্রকল্প দিয়েই সজ্জিত করেছেন।
প্রেমের স্মৃতি বিষাদের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে বিশ্বজিৎ দেবের কবিতায়। একদিন ছিল কেউ, আজ নেই। প্রেমের কবিতায় এই এক চিরায়ত দৃশ্য। যাকে চাইলেও ভোলা যায় না। নানাভাবেই মনে পড়ে। বিশ্বজিৎ দেব লিখেছেন,
তারারা তোমার কথা বলে
ঝলসে আছে সারা গায়ে
যাকে তুমি চিহ্ন দিয়েছ
আলোকবর্ষ থেকে এনে
ছোট ছোট পঙ্ক্তি নিটোল গদ্যে লেখা প্রতিটি কবিতায় উঁকি দিয়ে গেছে বিষাদমাখা সুখ।
প্রিয়তমাকে পাওয়ার তীব্র পিপাসা নিয়ে সানাউল্লাহ সাগর ছুটেছেন চতুর্দশপদী কবিতার পদে পদে। পর্ব বিন্যাস ও অন্ত্যমিলে স্বাধীনতা নেওয়া কবি পঙ্ক্তি পঙ্ক্তি নির্মাণ করেছেন উজ্জ্বল কিছু চিত্রকল্প। বোধের জগতকে ছোঁয়ার আগে যা ভালো লাগার পৃথিবীকে ছুঁয়ে যায়। নারী প্রেমে পর্যবসিত হয়ে প্রকৃতি প্রেমে কখনো কখনো। কখনো কখনো প্রেম প্রকৃতি একাকার হয়ে গেছে সানাউল্লাহ সাগরের কবিতায়।
প্রণব আচার্য্য প্রেয়সী পাওয়ার এক অদম্য বাসনায় ছুটে বেড়ান। কাছ থেকে চলে যেতে চাইলে বলে ওঠেন,
শুভ্রা, যেও না।
দেখ আমি বৃক্ষের গায়ে
উৎকীর্ণ হয়ে আছি।
প্রণব আচার্য্যের পৃথিবীজুড়ে প্রেয়সীর আনাগোণা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।’ প্রণব আচার্য্যের কবিতার জগৎও সেই সর্বনাশা জগতেরই সহোদর। তাই তিনি বলেন,
আসলে ফণার ঢেউয়ে তুমি বিষ জমা রাখো
আমি কী করে বোঝাই ওই বিষে
আকণ্ঠ ডুবে আছি—রাত দিন
হৃৎপিণ্ড বরাবর চলে গেছে ছুরি।
এমরান কবির পুঁজিবাজারের যখন সব কিছুই পণ্য হয়ে গেছে, তখন তিনি তার প্রিয়তমাকে খুঁজেছেন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে।
তুমি তো এখন কাশফুলের ওই ঢেউ
চরপলরি ওই মুক্তযানে জানে না যে কেউ
কিছু অনুভূতি, কিছু কথা কখনো পণ্য হয় না। থাকে হৃদয়ের গভীরে, অকৃত্রিম। গীতিময়তা এমরান কবিরের কবিতার মূল শক্তি। মূলত গদ্যছন্দে অনেক বেশি স্বাধীনতা পাওয়া গেলেও ছন্দই শব্দকে দেয় ওড়ার আকাশ। কবিতার নৈকট্যলাভের সুযোগ।
প্রসঙ্গক্রমে মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘লালরাত্রির গান’ শিরোনামে প্রকাশিত একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা থেকে ‘অবজ্ঞা’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা যাক,
পুড়ুক তারা, পুড়ুক হৃদয় কবির
তোমার তাতে কীই-বা আসে যায়
ভাঙুক কবির একলা হৃদয় পুড়ুক
বিরান রাতে তোমার প্রতীক্ষায়!
পঙ্ক্তিগুলো বিষয়ের জন্য যতটা না হৃদয়ে অভিঘাত সৃষ্টি করে, তারচেয়ে বেশি ছন্দ, অন্ত্যমিল ও যথাশব্দের ব্যবহারের কারণে হৃদয়ে একটা অনির্বচনীয় দোলা দিয়ে যায়। মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রতিটি কবিতায় ছন্দের ডুরিতে বাঁধা। একটি পয়ারে, অন্য চারটি কবিতা স্বরবৃত্তের নূপুর পরা। প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য হৃদয়ের আকুতি কবিতাগুলোতে বাণীরূপ পেয়েছে উপমা, চিত্রকল্পের মিশ্রণে। ‘আবহমান’ কবিতায় দেখিয়েছেন, ‘চতুর বালিকা’ যতই বণিকের সন্ধান করুক না কেন, প্রেম যেমন ছিল, তেমনই আছে। প্রেমের শাশ্বত অনুভূতি কখনো ম্লান হওয়ার নয়।
আহমেদ শিপলু অভিমানের আয়নায় বিম্বিত করেছেন তার হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনগুলোকে। সোনালি মুহূর্তকে। পারস্পারিক বৈপরীত্যের পরও ভোলা যায়নি আজও তার স্মৃতি। তাই তো বুকের গহীনে আটকে রাখা কান্নাকে চিত্রিত করেন, ‘কেবল চোখ থেকে জল গড়ালেই আগুনের নাম হয় হিমবাহ’ বলে। টানাগদ্যে লেখা ‘টান সিরিজ’ এর বেশ কিছু চিত্রকল্প মনে অভিঘাত সৃষ্টি করে।
কখনো কখনো এমন হয়, মনে হয় বিশেষ কেউ একজন ছাড়া জীবন শূন্য, বিরান, খা-খা। সে যখন ছিল না। জীবন চলেছে। কিন্তু এখন? সে নেই, তবু মনে হয় চারদিকেই তার ছায়া। মাহবুব মিত্র লিখেছেন,
‘তুমি যখন ছিলে তখনো মানুষ সাঁতার কাটতো। তুমি নেই; তবুও ধানের দুধে মৌমাছির গুঞ্জন ওঠে। আয়নায় ফলিত হয় তুমি বিম্ব; বিজ্ঞানের সূত্রগুলো আরও উজ্জ্বল হয়েছে। তুমিহীন এই চরাচররূপ আয়নায়; আরও আলোকিত প্রেমালয়।’
তাই অভিমানী কবি ভুলে যেতে চাইলেও ভুলে যেতে পারেন না কিছুতেই। পেছনের রাস্তায় তার পদচ্ছাপ কিছুতেই আড়াল হয় না কবির মন থেকে।
প্রেমের একই অনুভূতি একের কবির স্বরে, ভাষায় একেকভাবে চিত্ররূপ লাভ করে। তোলে পাঠকের মনে ব্যঞ্জনার ঢেউ।
অঞ্জন দত্ত মনে করতেন প্রেম বলতে কিছু নেই। তাই গেয়েছেন, ‘রঞ্জনা, আমি আর আসবো না।’ কবি ফেরদৌস মাহমুদ, তার বিপরীত স্রোতে অবস্থান করেন। প্রেমের জন্য দয়িতার বড় ভাইয়ের কাছে অপমানিত হয়েও বলেন,
আমি চশমাপরা বোকা প্রেমিক।
বাইসাইকেলের বেল বাজিয়ে
মুখোমুখি আবার ওই কিশোরীর।
লায়লীকে মজনু বিয়ে করতে গিয়ে লায়লীর কুকুরকেই লায়লি মনে করে জড়িয়ে ধরেছিল লায়লী মনে করেই। সুফিতত্ত্বে এর অন্য একটি ব্যাখ্যা আছে। সে কথা থাক। সরল দৃষ্টিতে বলা যায়, মজনুকে লায়লিকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতো, লায়লীর কুকুরের মাঝেও সে লায়লীকে দেখতে পেয়েছিল। ফেরদৌস মাহমুদের কবিতায় পাই,
তোমাদের পাড়ার কুকুরগুলোকে
নাটি বিস্কুট খাওয়াতে খাওয়াতে
বানিয়ে ফেলব একদিন ছোট ভাই।
মিষ্টি প্রেমের আবহ ফেরদৌস মাহমুদের কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তি বেজে যায়। গীতিময় কবিতাগুচ্ছ পাঠে আনন্দ আছে। ছোট ছোট পঙ্ক্তিতে প্রেমকে নদীর মতো বইয়ে নিয়েছেন তিথি আফরোজ। আবেগের সঙ্গে যুক্ত করেছেন কিছুটা শরীরী অনুষঙ্গ। ছোট ছোট চিত্রে তিনি নিয়ে যান বোধের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কখনো কখনো কোনো ইমেজ ভীষণভাবে আলোড়ন তোলে বুকে।
প্রেমের কবিতায় অতীতের স্মৃতি রোমন্থন একটি পরিচিত অনুষঙ্গ। নানা কবি নানানভাবে তা চিত্রিত করেন কবিতায়। ফারহানা রহমান অতীতকে তুলনা করেছেন শঙ্খচিলের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন,
বিম্বিত প্রাচীর ভেঙে তবে কতদূর যায় চোখ
বেছে নেয় কখন কে কাকে
ঊর্মির বানের মতো ভেসে
আসে অতীতের শঙ্খচিল
তখন মানসপটে ভেসে ওঠে ওই আকাশে উড়ে বেড়ানো নিঃসঙ্গ শঙ্খচিলে দৃশ্য। অতীতের মতো যে বহুদূর। ফারহানা রহমান শব্দে শব্দে দৃশ্যগ্রাহ্য উপমা তৈরি করেন। যার ফলে খুব সহজেই তার কবিতার সঙ্গে পাঠকের একটা নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়।
প্রেম ছিল। থাকবে। তেমনি থাকবে প্রেমের কবিতা। প্রেমের একই অনুভূতি একেক কবির স্বরে, ভাষায় একেকভাবে চিত্ররূপ লাভ করে। তোলে পাঠকের মনে ব্যঞ্জনার ঢেউ। পাঠক সেই কবিতাকে আশ্রয় করে, যা তার অজান্তেই নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ‘চিন্তাসূত্রে’র বর্তমান আয়োজনে পাঠক তাঁর মনের কথা, হৃদয়ের আর্তি খুঁজে পাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।