লেনিনের বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায়, তিনি তাঁর অভিজ্ঞান দিয়ে দৃঢ়চিত্তে বলেছিলেন—‘সর্বহারা সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়েনি।’ হ্যাঁ, সেটা অনেকে মনে করেন, আমরাও মনে করি। যাঁরা মার্ক্সবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁরাও লেলিনের উল্লিখিত কথার সঙ্গে একমত হবেন। আর হ্যাঁ—বিভিন্ন দর্শন, অর্থবিদ্যা, সমাজবিশ্লেষণ ও ফরাসি বিপ্লবের কণ্ঠলগ্ন হয়ে মার্ক্সবাদ পুষ্ট হয়েছে। প্লেটো, এরিস্টল থেকে হেগেল পর্যন্ত যে চিন্তাবিদরা তাঁদের যে দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বিশ্ব সৃষ্টি ও সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করেছেন, মার্ক্স ও এঙ্গেলস তা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সাহায্যে ব্যাখ্যা করে আরও দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
মার্ক্স ও এঙ্গেলস ইতিহাস, অর্থনীতি ও দর্শন নিয়ে যত গভীর বিশ্লেষণ করেছেন, শিল্প-সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে ততটা বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেননি। এই দু’জন তাঁদের যৌবনকালে কবিতা লিখেছিলেন। আর এঙ্গেলস তো একসময় কবি হয়ে ওঠার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। মার্ক্স শুধু কবিতা নয়, উপন্যাস ও নাটক লেখায়ও উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে, তাঁরা তাঁদের সময়ের শিল্প-সাহিত্যের বিষয়ে বেশ আগ্রহী ও সচেতন ছিলেন। পল লাফার্গে তাঁর ‘মার্ক্সস্মৃতি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ‘হাইনে’ ও ‘গ্যোয়েটে’ গভীরভাবে পড়েছিলেন তিনি, মূল গ্রীক ভাষায় ‘এস্কাইলাস’ পাঠ ছিল তাঁর আগ্রহের কেন্দবিন্দুতে। আর শেকসপিয়রের সাহিত্যের প্রতি তিনি ছিলেন বেশ শ্রদ্ধাসহ আগ্রহী। আরও অনেকের সঙ্গে দান্তে ও রবার্ট বার্নসও ছিলেন প্রিয়। রুশ লেখক পুশকিন, গোগল, তুর্গেনেভও তাঁর প্রিয় ছিল। জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি ভাষা ভালোমতো আয়ত্বে এনেছিলেন তিনি। এর ফলে এসব ভাষার সাহায্যে মূল বই পড়ে নিজের বোঝাপড়া বাড়িয়েছিলেন। এঙ্গেলসও মার্ক্সের মতোই বিভিন্ন সাহিত্যের প্রতি নিজের আগ্রহ বাড়িয়ে জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিয়েছিলেন।
এই লড়াই থেকে যে শিল্পী-লেখকেরা দূরে থাকতে চান, তারা অজান্তে কোনো পক্ষের উঠানে গিয়ে উপস্থিত হোন অথবা কোনো পক্ষের সেবাদাস হয়ে পড়েন। আর এই ধরনের যে মানুষেরা শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতিবর্জিত করে রাখতে চান, তারা হয়তো জানেন না—রাজনীতি মানে শুধু মিছিল-সভা-স্লোগান নয়। রাজনীতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি—বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।
আর রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমিকায় লেলিনের বিভিন্ন প্রবন্ধ ও চীনের মাওসেতুং-এর ইয়েনান ফোরামে বক্তৃতা মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব বুঝতে আরও বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। মার্ক্স আরও বলেছেন—‘‘সুন্দরের প্রতি আকর্ষণই শুধু মানুষকে ‘মানুষ’ করেনি, মানুষ নতুন করে সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে।’ গোর্কি বলেছেন, “জীবন সংগ্রামে মানুষ আত্মরক্ষার জন্য দুটি হাতিয়ার ব্যবহার করেছে—একটি ‘জ্ঞান’ ও অপরটি ‘কল্পনা’।’’
যেকোনো বড় ধরনের পরিবর্তন বা ধারাকে সংহত করার জন্য সাহিত্য-শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ইউরোপে রেনেসাঁ বা সংস্কৃতির যে পরিবর্তন হয়েছে, তা ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে, আর এই বিপ্লবের ভিত্তিমূল রচনায় ভলতেয়ার, রুশোসহ আরও কিছু লেখক দার্শনিকতায় ও সাহিত্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করেছিলেন, যা মানুষের চেতনায় অভিঘাত হেনেছিল।
শিল্প-সাহিত্যে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন শিল্প-সাহিত্য যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি সমাজের পরিবর্তনের ধারাকে উন্মুখ বা বিকশিত করতে শিল্প-সাহিত্যের এক ধরনের ভূমিকাও থেকে যায়। এইভাবে মিথস্ক্রিয়ায় শিল্প-সাহিত্য ও সমাজ উভয় পরিবর্তিত হয়।
শিল্প ও সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে বহু তাত্ত্বিক প্রগতিশীল দর্শন ও বিবেচনাবোধে নতুন নতুন সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে, প্রগতিশীল নন্দনতত্ত্বের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য কয়েকটি সূত্রে তৎকালীন সোভিয়েতের নন্দনতাত্ত্বিক আনাতোলি ইয়েগেরোভ উল্লেখ করেছেন :
১. এই নন্দনতত্ত্ব জগতকে অতীন্দ্রিয়তা ও ভাববাদ থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞানসম্মত এক অখণ্ড তাৎপর্য দান করেছে।
২. শিল্প-সাহিত্যকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে মানবমনে ও জীবনে শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক ও সক্রিয় প্রভাব অন্বেষণ করেছে—এই নন্দনতত্ত্ব।
৩. সামাজিক অবস্থার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিকে অভিন্ন সূত্রে পর্যালোচনা করাই এই নন্দনতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ইয়েগেরোভ-এর এই সূত্রের ভিত্তিমূল হচ্ছে—দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই সূত্রের তাৎপর্য এখনো শিল্প-সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। তবু এর বিপরীতে নন্দনতত্ত্বের আরও ব্যাখ্যা রয়েছে, তবে নন্দনতত্ত্বের নামে শিল্প-সাহিত্যে যথেচ্ছাচার কাঙ্ক্ষিত নয়।
লেখক-শিল্পীরা সংগঠন সক্রিয়ভাবে করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। তবে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের লড়াইটা কখনো মোটা দাগে বা কখনো সূক্ষ্মভাবে চলতে থাকে। এ থেকে শিল্পী ও লেখকেরা কখনো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। এই লড়াই থেকে যে শিল্পী-লেখকেরা দূরে থাকতে চান, তারা অজান্তে কোনো পক্ষের উঠানে গিয়ে উপস্থিত হোন অথবা কোনো পক্ষের সেবাদাস হয়ে পড়েন। আর এই ধরনের যে মানুষেরা শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতিবর্জিত করে রাখতে চান, তারা হয়তো জানেন না—রাজনীতি মানে শুধু মিছিল-সভা-স্লোগান নয়। রাজনীতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি—বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।
আমরা জানি—শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্নমুখী মত আছে। ভাবুক ও লেখক-সমালোচকের মধ্যে বোঝাপড়ার পার্থক্যও আছে। কোনটা ভালো সাহিত্য বা শিল্প—তা নিয়েও তর্ক আছে। কিন্তু তারপরও বলি—দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি কবি-লেখক ও শিল্পীদের কোনো ভূমিকা থাকবে না? তাঁরা কি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি চাইবেন না? নিশ্চয় চাইবেন। আগেও তাঁরা নিজেদের বিবেক-তাড়িত ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানেও তাঁরা সেই ভূমিকা শাণিত রাখবেন, সেটা অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা।
আমরাও মিলতে চাই—আমাদের ভাবনায়, ঐতিহ্যে ও আগামীর স্বপ্নে; যেখানে সংকীর্ণচিত্তের কুসংস্কার ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকবে, এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটাতে হবে। সাহিত্য-শিল্পের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং তা অবচেতনার তলদেশে ঢুকে পড়ে অনায়াসে। মানুষের মস্তিষ্কে ইতিবাচক সংগ্রামী চেতনার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনেও তা ভূমিকা রাখে। জীবনের প্রাত্যহিকতায় সাহিত্য-শিল্পের যোগ ঘটিয়ে মানুষের আত্মবীক্ষণের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধির জগতকে সমৃদ্ধ করা যায়, রুচিকে নির্মাণ করা যায়, ফিরে আনা যায় বিকার ও অসুস্থতা থেকে মানুষের মানবিক-সুস্থতা।
রাজনৈতিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মীর উদ্দেশ্য ও কর্মসাধনা একইমুখে স্রোতমুখী না হলে মানবিক সংস্কৃতিকে সংহত করা ও বিকাশসাধন করা সম্ভব নয়। শেষে অক্টোবর বিপ্লবের নেতা ও দার্শনিক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেলিন-এর একটি বাক্য উচ্চারণ করি—‘যদি কোনো মানুষের লালন করার মতো স্বপ্ন না থাকে, তবে সে পশুতে পরিণত হয়।’
মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেশের সংকট মোকাবিলার জন্য যে উপলব্ধি, তা লেখক-শিল্পীদের মধ্যে থাকে বলেই তাঁরা পথনির্দেশকের ভূমিকায় থাকেন, আমাদের দেশের ইতিহাসেও তা আমরা লক্ষ করি। আমরা জানি, আত্মকেন্দ্রিকতা ও গোষ্ঠীগত সুবিধা জন-মানুষের কল্যাণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গণতন্ত্রের নামে দলসর্বস্বতা, কর্তৃত্বপরায়ণতা, দুর্নীতি, নৈতিক বিকৃতি বারবার গণতন্ত্রের স্বাভাবিকধারাকে নষ্ট করেছে; তবু এ-দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী লেখক-শিল্পীরা অন্তর্দৃষ্টি ও বোধ জাগ্রত রেখে মানুষের মধ্যে প্রণোদনা সৃষ্টিতে তৎপর থাকেন। লেখক-শিল্পীরা অরণ্যে গিয়ে অরণ্যচারী হয়ে মতিভ্রমের মধ্যে দিন কাটাতে পারেন না—তাঁরা জানেন দেশাত্ববোধ কী? তাঁরা জানেন—রক্তবেদনায় আমাদের অর্জন কী? তাঁরা জানেন—এই সময়ের দৃশ্যপট কী? তাঁরা জানেন—অগ্রগামী মানুষের ভূমিকা কী? তাই, অন্তর্গত তাগিদ থেকেই লেখক-শিল্পীরা নিজের চৈতন্যপ্রবাহ তঁদের লেখা ও শিল্পে প্রবহমান রাখেন। লেখক-শিল্পীদের শক্তির আগুন অনির্বাপিত, কখনো নেভানো যায় না।
২০১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও পালন হয়েছিল। এদিবসটি পালনের জন্য যে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটির মূল প্রতিপাদ্য বা ডাক ছিল—‘ব্যক্তি মালিকানার পৃথিবীকে বদলে দিয়ে সামাজিক মালিকানার মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলুন’—এই ডাকের মধ্যে দিয়ে অক্টোবর বিপ্লবের দার্শনিকতা অনেকটা ফুটে উঠেছে। আমরা জানি, অক্টোবর বিপ্লব অনেক পুরনো ধারণা শুধু ভেঙে দেয়নি, নতুন বাস্তবতা তৈরি করে রাজনীতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিল্প-সাহিত্যসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন পরিধিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, যার প্রভাব সূক্ষ্ম ও মোটাদাগে এখনো প্রবহমান। তা এখনো অনুঘটক বা ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করতে পারে। আজ ধর্ম-কর্ম, নারীবাদ, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষাভাবনা ও অন্যান্য আরও অন্যান্য সামাজিক বিবেচনা আলাদা আলাদা ‘ডিসকোর্স’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, নেই কোনো সমন্বয়, নেই কোনো ঐকসূত্র। অক্টোবর বিপ্লবের দর্শন ও তত্ত্ব এখনো জীবন্ত আছে, তা বহন করা আমাদের জন্য এখন গুরত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। আমরা বিচ্ছিন্ন ভূভাগে পরিণত হয়েছি; যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে—জনগণের সঙ্গে, তত্ত্বের সঙ্গে, প্রয়োগের সঙ্গে, সমাজ ও শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে—তা এই অক্টোবর বিপ্লবের দর্শন ও তত্ত্বের ইন্টার্যাকশনের মধ্যে দিয়ে দূর করে আমাদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মীর উদ্দেশ্য ও কর্মসাধনা একইমুখে স্রোতমুখী না হলে মানবিক সংস্কৃতিকে সংহত করা ও বিকাশসাধন করা সম্ভব নয়। শেষে অক্টোবর বিপ্লবের নেতা ও দার্শনিক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেলিন-এর একটি বাক্য উচ্চারণ করি—‘যদি কোনো মানুষের লালন করার মতো স্বপ্ন না থাকে, তবে সে পশুতে পরিণত হয়।’