এক.
আধিপত্যবাদী মানসিকতা থেকে পুরুষের জন্ম হয় না। আমাদের ভাষা-চেতনায় প্রচলিত পুরুষ যে চৈতন্যময় মানবসত্তা নয়, তা নিশ্চিত বলা যায়। পুরুষ ও তার বিপরীতে নারী; উভয়ই ভাষাবোধের জটিল সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে, যা থেকে এ শব্দদ্বয়ের ভেতরে চেতনাশ্রয়ী অস্তিত্বকে টের পাওয়া যায় না। প্রচলিত অনেক শব্দই এমন হীনচর্চার ফলে তার সজ্ঞান অস্তিত্ব হারিয়ে বসেছে এবং বহুল চর্চা ও প্রয়োগের ফলে ভুলেই গেছি ভাষা-রাজনীতির আড়ালে হারাতে বসা অর্থবহতাকে। পুরুষ ও নারী এমন দু’টি শব্দ, যা বৌদ্ধিক ও আত্মিক উভয়ক্ষেত্রেই আজ দুর্বল ও সাংঘর্ষিক; একের বিপরীতে অন্যের শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও আধিপত্যের আচারসর্বস্বতা, পৃথিবীকে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। উভয়ের নিকটবর্তী হওয়া ও দূরে সরে যাওয়াও হয়ে উঠেছে নিতান্ত মামুলি ব্যাপার।
কথা হচ্ছে পুরুষ ও নারী নিয়ে, নারী-পুরুষের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে নয়। প্রথমে পুরুষ নিয়ে বুঝতে হবে যে, এ কেবল শব্দ নয়, লিঙ্গ বা বর্ণও নয়, এটি একটি অভিজ্ঞান, অভিযাত্রা—নরস্বভাব থেকে পুরুষভাবের দিকে। কিন্তু পুরুষভাব কী? প্রচলিত জ্ঞানে যা আধিপত্যবাদী, যা থেকে নিস্তার নেই কিছুর, মুখ্যত নারীর, তাই কি? যদি তাই হয়, তবে পৌরুষ বা বীরত্বসূচক উপমাগুলোর ভবিষ্যৎ কী? এ কেবলই নরের অধিকার, নারীর নয়? কেন জগতে নারীর বীরত্ব অবলোকন করিনি? দেখিনি সে নারী যে সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতাকে বীরের ন্যায় সেবা করেছে? তাহলে বীরত্ব কি একা নর বহন করে, নারী নয়? ভাবতে হবে ভাষারাজনীতির বুদ্ধি ডিঙিয়ে অন্তর্গত মর্ম দিয়ে, যেখানে নারী-পুরুষ প্রেমময়, শ্রীময়, অভিলাষী, আত্মানুভবের সঙ্গী।
সে তাড়নশীল, সৃষ্টিতে যেমন ধ্বংসেও। আর? আর যাই হোক সে একটি কাজ খুব যত্নের সঙ্গে সম্পাদন করে থাকে, তা হলো নারীর ওপর প্রাধান্যবিস্তার, নারীকে সে জয় করে ঠিক কিন্তু অধিকারবলে, সাধনবলে নয়। আবার যে নারীকে সে জয় করছে সে নারী কেমন নারী?
কী তা? এ প্রশ্ন বড় অভিনব শোনায়, কিন্তু কী নয় সে? আর যা বলতে চাইছি, তা নতুনও নয়, সৃষ্টিলীলার সঙ্গে যুক্ত, ধ্বংসলীলার সঙ্গেও। কে এই পুরুষ? আর নারীই বা কে?
দুই.
পুরুষের যে দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে ক্ষমতাবিশ্বে, সে কি প্রকৃত পুরুষ? নারীর যে অন্তঃপুর নির্মাণ করা হয়েছে এ ক্ষমতারই মহাবিশ্বে, সেও কি প্রকৃত নারী? আমরা পুরুষ শব্দটিকে আপাতত ব্যবহার করবো না, তার বদলে একটি মৌলিক শব্দ যা উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য সে অতিপরিচিত ‘নর’ শব্দটিকেই পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করবো। এক সাংঘাতিক ভাষা-অপরাজনীতির বলি হওয়া পুরুষ শব্দটি হতে হতভাগা নরকে বের করে আনার চেষ্টা করি।
কী দেখতে পাই? মানুষ হিসেবে নর কেমন? তার পরিচয়? ঠিক আর দশটা প্রাণী যেমন, তার ভেতরের নরপশু যেমন, তাই নয় কি? যে সবসময় দেখা যায় প্রভাব বিস্তারে, যার দৃশ্যমান বীরত্ব যেন তার জীবনযুদ্ধকে অতিপরিচিতি দান করে। সে হিংস্র, সদাচঞ্চল, প্রগলভ। সে তাড়নশীল, সৃষ্টিতে যেমন ধ্বংসেও। আর? আর যাই হোক সে একটি কাজ খুব যত্নের সঙ্গে সম্পাদন করে থাকে, তা হলো নারীর ওপর প্রাধান্যবিস্তার, নারীকে সে জয় করে ঠিক কিন্তু অধিকারবলে, সাধনবলে নয়। আবার যে নারীকে সে জয় করছে সে নারী কেমন নারী? তারই বা কি পরিচয়? সে না হয় আপাতত থাক। এই বুদ্ধিনির্ভর বীরত্বসূচক ‘নর’, যার রয়েছে পেশীশক্তি, দখলদারিত্বের অপরিসীম দক্ষতা, সে হলো সেই সত্তা যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে দুর্বল নারী, যে নারী তার ক্ষমতার ও দাসত্বের কারাবরণে রুগ্ন, সে নারী আবার তাকে ছাড়া অচল, এক নির্দিষ্ট সীমা অবধি সে নুয়ে পড়ছে নরের প্রকৃতিগত হিংস্র বীরত্বের কাছে, ভয়ে বা কামনায়।
নর-নারী উভয়কেই পার হয়ে যেতে হবে এ সত্তাযুগলের পুরুষ ও প্রকৃতিময় সচেতন দীপ্তি দিয়ে। নইলে নর হতে বাধ্য নরপশু, নারীও হতে বাধ্য অবলা, দুর্বল।
এই যে নর, তার পরিচয় কিন্তু পুরনো, চৈতন্যের বিপরীত সত্তা, সৃষ্টিলীলার সঙ্গে যুক্ত অথচ স্রষ্টা নয়। যে জোগান দিতে জানে কিন্তু নির্মাণ জানে না। যে কারিগর কিন্তু শিল্পী নয়। যে কেবলই প্রকৃতির অন্তর্গত এক অচেতন সত্তা, যার চেতনা সুদূরপরাহত; সে নর, তারই হাতে বন্দি নারীর নর।
তিন.
নরস্বভাবের বিচিত্র ও পরাভব পরিচয়ের বিপরীতে আমরা একটু নারীর সুলুক সন্ধান করি। ভাষারাজনীতির বলি হওয়া ‘পুরুষ’ শব্দটির বিপরীতে নারীকে খাড়া করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা দীর্ঘকালের। কিন্তু কে এই নারী? যে অচেতন নরের চাইতে আরও অনেকখানি অচেতন। তার চেতনার প্রদেশ এত দূরে যে, তাকে ধরার কোনও চেষ্টা করেও সে হদিস পায় না। সে নরের কামনায় বন্দি। যেখানে একটি ধর্ম প্রধান হয়ে ওঠে, সে হলো ‘যৌনতা’। যৌনতা সে ধর্ম যা নারীকে নরের হাতে, নর-কে নারীর সঙ্গে আমৃত্যু অচেতন করে রাখে। যুগপৎ সুদীর্ঘ অচেতনা হতে শেষমেষ বিকশিত হয় নরতন্ত্র। আর এ নরের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে যে নারীরা নরের স্বভাবকে বুঝতে পেরেছে এবং তার হাত থেকে বাঁচার সুযোগ করতে চাইছে তারা নরের প্রকৃতিপ্রদত্ত আদিম বীরত্বকে নিজের করে নিয়ে তার স্বভাব দিয়েই তাকে আঘাত করতে চাইছে। নরতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে ‘নারীতন্ত্র’। আধুনিক নারীবাদের পনের আনাই এ নরতন্ত্রস্বরূপ নারীতন্ত্র, এ অস্বীকার করার উপায় নাই।
কিন্তু এ নারী আসলে কী? এ তো ‘প্রতিনর’, নরের বিপরীত ক্ষমতালিপ্সু নারী। এই কি তার পরিচয়? না। আমরা পুরুষভাবের কথা বলছিলাম, তেমনি নারীভাবের কথাও বলবার সময় এসেছে। পুরুষভাব-বিচ্ছিন্নতা কেবল নরের অপরাধ তা নয়, আর নারীভাব-বিচ্ছিন্নতাও যে কেবল নারীরই অপরাধ সেও কিন্তু ভুল। পুরুষভাব ও নারীভাব সে চৈতন্য যেখানে প্রবেশ না করা পর্যন্ত নর-নারী উভয়ই অচেতন আমৃত্যু; সত্তার সঙ্গতিহীন এই অভাগা দুই সত্তার আত্মোন্মোচনের দায় তাদের নিজেদেরই। কিন্তু উভয়েই লিপ্ত মিথ্যা যাপনের প্রভাববিস্তারী স্বভাবধর্মের দ্বন্দ্বে। সে দ্বন্দ্ব চলছেই। থামছে না।
তাই বোঝা জরুরি পুরুষসত্তা ও নারীসত্তার প্রকৃত স্বরূপ। নর-নারী উভয়কেই পার হয়ে যেতে হবে এ সত্তাযুগলের পুরুষ ও প্রকৃতিময় সচেতন দীপ্তি দিয়ে। নইলে নর হতে বাধ্য নরপশু, নারীও হতে বাধ্য অবলা, দুর্বল।
চার.
এই যে স্বভাবের প্রকৃতি যার কাছে সত্তা গুটিয়ে আসে, তার বাইরেও আরেকটি অস্তিত্ব থাকে, তা হলো ‘প্রকৃতির স্বভাব’। নর-নারীর স্ব-স্ব স্বভাবের প্রকৃতি যদি পরমাপ্রকৃতির নিজস্ব স্বভাবের মোক্ষম পরিণতির দিকে ধাবিত না হয় তবে সত্তা বিকশিত হয় না। মানুষ হওয়া কঠিনতম সাধনা। আগে মানুষ হও এই বক্তব্য যারা দিতে চান তারা ঠিক ভুলে যান যে মানুষ হওয়া কত কঠিন, এ স্বভাব-প্রকৃতির হাতে বন্দি নর-নারী কি করে মানুষে পরিণত হবে সে নিয়ে তারা চিন্তাও করেন না—হস্ত-পদ-মস্তকাবৃত একটি দেহসত্তাকেই যদি মানুষ জ্ঞান করতে হয় তবে এই মানুষের সঙ্গে সৃষ্টির অন্য প্রাণিজগতের পার্থক্য নাই, দেহে কি মনে। কিন্তু মানুষ হতে হয়, শেষমেষ; নইলে মানবসত্তার পরিণতি আসে না। কোন সে পরিণতি? যা একটি সত্তাকে দিতে পারে তার সর্বোচ্চ বিকাশ, আত্মমুক্তি।
আবার স্বভাবের প্রকৃতি এতই বলশালী, এতই প্রভাব তার যে মানুষ স্বভাবনিষ্ঠ নর ও নারীবৈশিষ্ট্যকেই উদযাপন করে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে, কোনো স্বভাববিরুদ্ধ অবস্থানে নিজেকে দাঁড় না করিয়ে। স্বভাবের বিরুদ্ধে যেতে হবে কেন? এ এক চমৎকার প্রশ্ন হতে পারে। কেন? কারণ, মন নামক এক শক্তিশালী অস্তিত্ব পরমাপ্রকৃতির নিজস্ব স্বভাবের সঙ্গে অস্বাভাবিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে যায় নিত্য। এ দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। পরমাপ্রকৃতি সর্বদা অখণ্ড তৌহিদ বা একত্ববাদের পরমভাবে লিপ্ত থাকে, সেখানে শেরেক নেই, অংশীবাদ নেই, খণ্ড খণ্ড অস্তিত্বের বিরোধও নেই, কিন্তু মন সেই অস্তিত্ব যা সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার দূরত্ব ও বিভাজনকে নির্দিষ্ট করে এবং নিজের জন্য তৈরি করে একটি বলয়, সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বেচ্ছাচারে ভরা। এ বলয়কে মন সাংঘাতিকভাবে রক্ষা করতে চায়, একটু সংকটে পতিত হলেই সে হিংস্র হয়ে ওঠে, বের হয়ে আসে তার স্বভাবসুলভ পশুত্ব, নর বা নারী উভয়েই সে পশুত্বকে প্রকৃতির অচেতন নিয়মের ধারাবাহিকতায় বরণ করে নেয়।
নরের মন কেবল সাময়িক আস্বাদনের স্বাদ মেটায়, একসময় নারীস্বভাবকে অচেনা রেখেই তাকে অধিকার করতে চায়। যে বিষয়টি এখানে বলার তা হলো, নর বা নারীস্বভাব যতদিন স্বীয়-স্বভাবে আচ্ছন্ন থাকে ততদিন একে অপরের অচেনাই থেকে যায়, একের প্রতি অন্যের প্রেম হয়ে ওঠে না সর্বাত্মক, যৌনতা হয়ে ওঠে প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার, আত্মসংগ্রামের বদলে পরস্পরের বিদ্রোহ ও দমন প্রাণিজগতের বৈশিষ্ট্যকেই যেন পরিচিত করে তোলে।
প্রকৃতির যেমন নিয়ম আছে তেমনি অনিয়মও। আমরা বলতে পারি না বা ঠিক জানি না, প্রকৃতির নিয়মগুলি আসলে কী? কত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আশ্চর্যময় তা! সুদীর্ঘকাল ধরেই এ প্রকৃতির নিয়মগুলোকে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে, অনিয়মকেও। নিয়ম-অনিয়মের এ পরমাপ্রকৃতিকে অথচ বাগ মানানো যাচ্ছে না। কেউ হয়তো চেষ্টা করে দেখেছে, নিয়মকে ধরবার চেষ্টা করেছে, ফের অনিয়মে পতিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এ মহাপরাক্রম অস্তিত্বকে কেউই অধিকার করতে পারেনি। সামান্যতম সে অধিকারও প্রকৃতি ছিনিয়ে নিয়ে যায় অসীম শক্তিময়তায়। কিন্তু প্রকৃতিকে অধিকার করতে চায় কে? সে আর কেউ নয়, মন। মন হচ্ছে সে সত্তা যার প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর দ্বন্দ্ব। মন তার নিজের স্বভাব দিয়ে প্রকৃতিকে দেখতে চায়, আর প্রকৃতির নিজস্ব স্বভাবের সঙ্গে ঘটে তার নিত্য সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষের উৎসমূলে নর-নারীর অচেতন অস্তিত্ব ক্রিয়াশীল। নর মূলত নারীকে নয় তার নিজের অসহায়ত্বকে প্রভাববিস্তারের বৃথা অভিনয় দ্বারা দূর করতে চায়—নারীও সে প্রভাববিস্তারকে অভিনয় দিয়েই হয় মেনে নেয়, নয়তো প্রতিরোধ করে করে হারিয়ে যায় অতল গহবরে। এমন প্রতিরোধ সত্তাকে প্রগতি দিতে পারে না, নর-নারীর যুগপৎ মিলনকে এ প্রতিরোধ যুগপৎ অন্ধকারে পতিত করে রাখে, কারণ সে বুঝতে পারে না যে, উভয়ের মিলিত শক্তিই কেবল প্রকৃতিকে জয় করতে পারে, একা নয়, কোনোভাবেই নয়।
পাঁচ.
প্রকৃতিগতভাবে নারীস্বভাবে এমন কিছু আছে যা নর কোনোদিন অতিক্রম করতে পারে না। কিছুতেই না। সে চেষ্টা করে তার ভেতরে প্রবেশ করতে, মরীচিকাসম ধাঁধাঁয় পতিত হয়। এ নারী কে? প্রকৃতিগতভাবে নরস্বভাবে যা আছে তা এ দুর্ভেদ্য জগতে প্রবেশ করতে পারে না, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত সে প্রবল বাসনায় চেষ্টা চালায় এবং তার স্বভাবগত অগভীরতার কাছে কোনোমতেই নারীস্বভাবের জটিল ও প্রপঞ্চময় গভীর মন পরাজিত হতে চায় না। নরের মন কেবল সাময়িক আস্বাদনের স্বাদ মেটায়, একসময় নারীস্বভাবকে অচেনা রেখেই তাকে অধিকার করতে চায়। যে বিষয়টি এখানে বলার তা হলো, নর বা নারীস্বভাব যতদিন স্বীয়-স্বভাবে আচ্ছন্ন থাকে ততদিন একে অপরের অচেনাই থেকে যায়, একের প্রতি অন্যের প্রেম হয়ে ওঠে না সর্বাত্মক, যৌনতা হয়ে ওঠে প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার, আত্মসংগ্রামের বদলে পরস্পরের বিদ্রোহ ও দমন প্রাণিজগতের বৈশিষ্ট্যকেই যেন পরিচিত করে তোলে। কিন্তু মানুষ প্রাণি বা পশু যে নয়, এ কথা সে বিশ্বাস করতে চায় এবং নিজের ভেতর ধারণ করে থাকে সৃষ্টির বিচিত্র ও সাংঘর্ষিক সত্তাগুলির বৈশিষ্ট্য—সে মানবিক আবার অমানবিকও, দয়াশীল আবার হিংস্র, অনুরাগী আবার ক্রোধোন্মত্ত, উদার আবার কৃপণ, বন্ধুবৎসল আবার চরমশত্রু; এই যে তার সত্তার নানারূপ, সে নিজেও জানে না কোথায় তার আত্মপরিচয় মেলে? কোন পরিচয়েই সে পরিণতি পাবে, সঙ্গতি হবে তার জানা নেই।
নর-নারীর সীমাহীন অন্ধকারে সামান্যতম প্রদীপশিখার প্রজ্জলন ঘটিয়ে ঠিকই সূর্যকে আড়াল করে রাখা হয়—কিন্তু সূর্য কি আড়ালে থাকে? না, মানুষের মনের চোখ তখন অন্ধ হয়ে যায়, সে চোখে সে দেখতে পায় না আলো, দেখে একে অন্যের অন্ধকার, লুফে নেয় একে অন্যেরর অন্ধকার, গিলে খায় একে অন্যেরই অন্ধকার।
জানে না বলেই সে হাতড়ায়। জলের নিচে কাদায় হাতড়ে মাছ ধরা সহজ, অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে হাতসই করাও সহজ, শ্বাসরোধ করে দীর্ঘসময় জীবিত থাকাও সহজ, মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে আনন্দে ফিরে আসাও সহজ কিন্তু সহজ নয় নিজের স্বভাবের বিচিত্র বহুগামিতাকে বুঝতে পারা, তার লাগাম টেনে ধরা। কিন্তু নর-নারী একে অপরের লাগাম টেনে ধরতে চায় বুদ্ধি দিয়ে—এই তো? সেই বুদ্ধির জয়, বুদ্ধি দ্বারা কেউ শক্তিমান হয়ে ওঠে কেউ হয় ছলনাময়ী।
মানুষকে জানতে হবে নিজের পরিচয় এবং তা ধাপে ধাপে। তার ভেতর দিয়ে বিবর্তনমূলক সত্তার বিকাশ ঠিক কী উপায়ে ঘটছে, যদি সে না জানতে পারে, তবে অচিরেই সে পথ হারাবে। জগতের সব আচারধর্মই মানুষকে এই বিকাশের কথা বলে কিন্তু ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের যথেচ্ছাচারের ফলে যখন বহির্জগতের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায় তখন হারিয়ে যায় অন্তর্ধর্ম। অন্তরের সে আত্মধর্ম তখন শত্রু হয়ে ওঠে আচারধর্মেরই। নর-নারীর সীমাহীন অন্ধকারে সামান্যতম প্রদীপশিখার প্রজ্জলন ঘটিয়ে ঠিকই সূর্যকে আড়াল করে রাখা হয়—কিন্তু সূর্য কি আড়ালে থাকে? না, মানুষের মনের চোখ তখন অন্ধ হয়ে যায়, সে চোখে সে দেখতে পায় না আলো, দেখে একে অন্যের অন্ধকার, লুফে নেয় একে অন্যেরর অন্ধকার, গিলে খায় একে অন্যেরই অন্ধকার।
ছয়.
নারী তখনই স্বাধীন যখন সে পৌরুষকে চিনতে পেরেছে, নরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোকে নয়। কথা যদি হয় পুরুষতন্ত্র নিয়ে; আমি পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করি, নরতন্ত্র বা নারীতন্ত্র নয়; পুরুষতন্ত্রে এখনো সভ্যতা পৌঁছাতে পারেনি, নরতন্ত্রের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে; নারীবাদ যে নারীতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে তা আজকের নরতান্ত্রিক সভ্যতারই ছায়াস্বরূপ। নারী বা নর পুরুষ না হতে পারলে এমনটা ঘটতে থাকবে, কাপুরুষের সভ্যতা যাকে বলে, দেখা যাবে একটা পতিত নারীতন্ত্রের জন্ম হয়েছে অধঃপতিত নরতন্ত্রের ধাঁচে। প্রচারসর্বস্ব অধুনা পশ্চিমা নারীবাদের যে প্রধান দু’টি শরিয়ত, একটি অবাধ যৌনতার স্বাধীনতা আরেকটি সমকামের; আমি স্বাধীনতাকে মাঝে মাঝে বড় ভয় পাই—ইচ্ছাশক্তি আর স্বেচ্ছাচারকে আজ এক কাতারে আনা হচ্ছে না তো?
আবার পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে নারী সুকৌশলে নিজেই নর হয়ে উঠছে; পৃথিবীর সংকট পুরুষতান্ত্রিকতায় নয়, নবরূপে সম্প্রসারিত নরতান্ত্রিকতার।
কিন্তু পুরুষ হতেই হবে, জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্যে কিংবা মানবিক উপলব্ধির উচ্চতাকে ধারণ করার জন্য। কাকে পুরুষ বলবো, যে নেতৃত্ব দেয় নাকি দাস বানিয়ে রাখে? নারীর ধর্ম ও নরের ধর্ম এক নয় বলেই তো পুরুষ শব্দটি আজ চূড়ান্ত সাম্রাজ্যবাদী। আবার নারীর হাতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব, এও এক ভ্রান্ত ধারণা; পরিচালকের ভূমিকায় নর বা নারী যেই আসীন হোক না কেন সেও এক অর্থে পুরুষ।
সাত.
সক্রেটিস যে নারীর কথা বলেছেন তা ছিল নারী নামক বৈষয়িক প্রপঞ্চ আর ওমর খৈয়াম যে নারীর কথা বলেছেন তা পরমপ্রিয় মাশুকের প্রেয়তত্ত্ব। নারীচেতনাকে ধারণ করতে না পারলে নারীবাদ অর্থহীন রাজনৈতিক পদক্ষেপমাত্র। কিন্তু নারীচেতনা কী? তা নারীকে বুঝতে পারার বা ধারণ করার জ্ঞান নাকি নারীবিশ্বকে সামগ্রিক জীবনে অনুধাবন করার পদ্ধতি? আমি একটা কথা বলি, ভালো না লাগলেও বলি। নারীর জন্য যা নারীবাদ, নরের জন্য তেমনি নারীচেতনা। আধুনিক নারী যখন নারীবাদের কোনো না কোনো আশ্রয়ে তার চিন্তাকে প্রবাহিত করতে চায়, তেমনি নরসত্তাকেও নারীচেতনা দিয়েই তার মুক্তির পথ বের করতে হয়। কেন?
নারীচেতনার সঙ্গে যুক্ত না হওয়া একটি নরসত্তা যে কতখানি পাশবিক, তার হিসাব করার জন্য। মনে রাখতে হবে, নারী আর নারীচেতনার ফারাকটি হলো মনোজগতের; মানসগতভাবে নর নারীকামী কিন্তু চেতনাগতভাবে একজন নরের কাছে নারী বিকশিত হওয়ার সোপান। আর ক্ষমতায়নের কথাই যদি বলতে হয় তবে নারী নরের স্থান দখল করবেই, তাতে কারও জ্বালা-যন্ত্রণা হলে সেটা প্রশমন করার দায়িত্বও তার। আবার পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে নারী সুকৌশলে নিজেই নর হয়ে উঠছে; পৃথিবীর সংকট পুরুষতান্ত্রিকতায় নয়, নবরূপে সম্প্রসারিত নরতান্ত্রিকতার।
এক জ্ঞানী সাধু বলেছিলেন, ‘যে নারী কেবল দেহমনেই নারী সে বন্ধ্যা, যে নর দেহমনেই নর সে পশু—তোমাকে আত্মময় হয়ে উঠতে হবে, কেবল তখনই বুঝতে পারবে যে তুমি নারীও নও নরও নও, তোমাকে অর্জন করতে হবে সে পৌরুষ, যা কালাকালের অধীনতামুক্ত ও আত্মবিপ্লব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পুরুষ শব্দটি নরপশুরা কলঙ্কিত করেছে এতকাল। তুমি পরমপুরুষের দিকে যাত্রাপথ তৈরি করবে। এ পুরুষের চাইতে আরও বড় হলো মাতৃচেতনা, জগতের সকল মহাপুরুষের মা যিনি সেই পরম আলোকময়তাকে অনুধাবণ করবার চেষ্টাই আমাদের নিরন্তর সাধনা।’
নরবর্জিত অবস্থানকে যে কোনো প্রকারে হাসিল করা তার চাই। অন্তত তার অন্তঃপুরের জীবনে যেন নরের অধিকার না থাকে, সে নিশ্চিত করা। কিন্তু নর-সমকামীর ক্ষেত্রে? সে কেন তবে ঘর বাঁধছে? মনে হচ্ছে এই ক্ষেত্রে নারীবাদ সমকামী নরের ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করছে।
মা সন্তানের জন্ম দেন কিন্তু পুরুষের জন্ম দিতে পারে কেবল নারী; যুগপুরুষ তাকে বলে যে নিজেই নিজের নারীত্ব সম্পর্কে জেনেছে এবং মুক্ত হয়েছে। নারী না হয়ে কারো পক্ষে পুরুষ হওয়াও সম্ভব নয়, নর-নারী নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের নারীভাবকে সর্বাত্মকরূপে জাগ্রত না করে পুরুষ হওয়া কঠিন। শক্তি অর্জন করলে কেউ পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, নর বা নারী যে কেউ তা অর্জন করতে পারে; কিন্তু নর-নারীর স্বভাবগত দুর্বলতায় সে পুরুষ ক্লীব হয়ে যায়।
আট.
সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতাতেই কারো মাতৃত্বের বোধ জেগে উঠবে তা নয়। মাতৃত্ব নারীশিল্পের সর্বোত্তম শিল্পবোধ। নরতন্ত্র তাকে জন্মকল আর নারীবাদ তাকে শৃঙ্খল বলে ভাবতে পছন্দ করে। যতদিন সমাজ, পরিবার, বিষয়, সম্পদ, চিন্তা, ধর্মের অধীনতা ততদিনই নারীত্ব। আমি নারী, আমার নারীত্বের বোধ আছে; আমাকে হতে হবে সে নারী যে নরবলি দিতে জানে, আপন নরপশুত্বকে। তবে কথা হচ্ছে লিঙ্গবিচারেও নারীশক্তির জাগরণ অবশ্যম্ভাবী, তা নরের মতো হোক বা তার নিজের মতোই; নারীর মোহ-মায়া নর ত্যাগ না করতে পারলেও নারী নিজেই তা করুক এমন আশা করতে ক্ষতি কী? কিন্তু অধিকারের বঞ্চনা যতদিন আছে ততদিন নারীবাদ থেকে যাবেই, তথাকথিত নারীবাদ নিয়ে মুখে ফেনা তোলার মতো বিরোধিতা করবোই বা কেন, যেখানে প্রচলিত নরতান্ত্রিকতা নারকীয় ও অমানবিকতায় ভরা; অপেক্ষা করতে হবে নারীর ক্ষমতায়নের, তখনই এই ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে প্রকৃত বিরুদ্ধাচারণ সম্ভব। যে বিদ্রোহ ও অবদমনে আক্রান্ত নারীবাদ নরতান্ত্রিকতারই উল্টোপিঠ।
স্বাধীন যৌনতার সঙ্গে যৌনযথেচ্ছাচারের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। স্বাধীন যৌনতা বিকৃত যৌনাচারের জন্ম দিতে পারে নাও পারে কিন্তু যৌনযথেচ্ছাচার বিকৃতিকেই আমল করে থাকে। সে বিকৃতি পরিবারে হোক বা ব্রথেলে—সমকামে হোক বা বিপরীতকামে তাতে কি যায় আসে? কিন্তু কথা হচ্ছে সমকামিতার প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রসঙ্গে। কেন সমকামীকে বিয়ে করতে হবে? অবাধ যৌনতার যুগে বিয়ের মতো একটি অতিপ্রাচীন তথাকথিত নরতান্ত্রিক প্রবণতাকে মেনে নেওয়া কেন? কোন প্রেরণাবলে একজন সমলিঙ্গ আরেকজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চায়? কারণ কী?
একটি কারণ হয়েতো খুঁজে পেতে পারি। সে হলো নারীবাদ। প্রলয়ংকরী নরতন্ত্রের বিপরীতে নতুন করে গড়ে ওঠা নারীবাদ হয়ে উঠছে নরবিদ্বেষী ও হিংসাপ্রবণ। নরবর্জিত অবস্থানকে যে কোনো প্রকারে হাসিল করা তার চাই। অন্তত তার অন্তঃপুরের জীবনে যেন নরের অধিকার না থাকে, সে নিশ্চিত করা। কিন্তু নর-সমকামীর ক্ষেত্রে? সে কেন তবে ঘর বাঁধছে? মনে হচ্ছে এই ক্ষেত্রে নারীবাদ সমকামী নরের ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করছে। এইবেলা তুরুপের তাস নারীবাদের হাতে, নর-সমকামীর চাইতে নারী-সমকামী তাই অধিকতর শ্রেণীসচেতন, আদর্শিক, দার্শনিকতাপূর্ণ ও উত্তম সেক্যুলার।
আর শেষে যে প্রশ্নটি করতে হয়—পুরুষতন্ত্র বলে কিছু আছে পৃথিবীতে, নারীবাদ বলেও কিছুর প্রতিষ্ঠা হবে; যা কিছু দেখছি তা কেবল নারী ও নরের দূরত্বের ফসল না তো?
নরের বক্তব্যের প্রতিবাদই আগামী কয়েকদশকের নারীবাদ, এরপর নারীর বক্তব্যের প্রতিবাদে কাটবে পরবর্তী কয়েক দশকের নরবাদ; বোধকরি আরো বহুবছর কেটে যাবে এভাবে, নর এবং নারী তাদের নিজেদের খোলস হতে না বেরিয়ে আসা পর্যন্ত।
নয়.
যে মসজিদ হতে নারীকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, যে মন্দিরে কোন নারীর প্রবেশাধিকারই নেই, সেখানে নারীকে যাওয়ার জন্য কমবেশি লড়াই করতে হয় আজকে। কিন্তু কেন? নারীর এ অধিকার প্রতিষ্ঠা কি তার অধ্যাত্মবোধক না কি রাজনৈতিক সচেতনা? প্রার্থনাগৃহের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় নর যে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রদর্শন করে থাকে নারীও কি তবে তাই চাইছে? এটা অধিকারের অস্তিত্বনির্ভরতা না দখলদারির অভিসন্ধি?
কিন্তু লোকসমাজে, লোকসংকৃতি ও লোকধর্মে—নানান সম্প্রদায়ের ভেতরেও দেখতে পাই আত্মজাগরণের পথে নারী সেখানে সহাবস্থানই করছে। সেখানে তার দখলদারির, ক্ষমতাপ্রদর্শনের প্রচেষ্টা দেখা যায় না। মসজিদ বা মন্দির নরতান্ত্রিকতার আদর্শ লীলাভূমি হয়ে ওঠে যখন, তখন একে প্রশ্ন করার জন্য যেসব নারীরা সংগ্রাম করে যাচ্ছে তারাও নর হয়ে উঠছে না তো? আর এভাবে নর-নারী এক কাতারে এসে যুক্ত হয়ে শেষে নারীই হারিয়ে যাবে না তো নরমানসের ভেতর?
আর শেষে যে প্রশ্নটি করতে হয়—পুরুষতন্ত্র বলে কিছু আছে পৃথিবীতে, নারীবাদ বলেও কিছুর প্রতিষ্ঠা হবে; যা কিছু দেখছি তা কেবল নারী ও নরের দূরত্বের ফসল না তো?