আল মাহমুদের গল্পকৃতি অবাক করার মতো, বিস্ময়করও বটে। বাংলা গল্পসাহিত্যের হ্রস্ব তালিকায়ও অনায়াসে উঠে আসবে তার কিছু গল্প। আবু রুশদের ‘বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতূল্য অন্য কোনো কবির হাত থেকে এতটা ভালো গল্প বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই’ মন্তব্যের সঙ্গে আমাদের একমত না হয়ে বেউপায় হওয়ার জো নেই। নিজের সময়কে, স্বকাল-স্বজাতিকে কত নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করলে এরকম গল্প সৃজন হয়, তার উপমা আল মাহমুদের গল্পসাহিত্য।
নদী তার কাছে স্বদেশকে ধরার মোক্ষম দরজা; প্রকৃতির ভেতরে তিনি দেখে ওঠেন তাবৎ বিস্ময়ের বাস্তবিক ফসিল, নারীকে আশ্চর্য প্রদীপ মেনে আল মাহমুদের গল্পচর্চা প্রকারান্তরে এ ব-দ্বীপেরই জীবনচর্চা। ফলে নারীর সঙ্গে নদী, নদীর সঙ্গে রাজনীতি, মানুষের সঙ্গে মানবীয় নানা রূপের বিপুল সম্মিলনে তার একেকটা গল্প মানবিক দলিল হয়ে ওঠে বটে কিন্তু গল্পকারের উদ্দেশ্য ভিন্ন। তিনি দেখার চোখকে জিজ্ঞাসার বাইরে রাখেন না; প্রশ্নের সমান্তরালে দৃশ্যকাব্য এঁকে তিনি এখানকার জীবনভাষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির চিরায়ত ক্ষেত্রটি প্রসারিত করার সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে যান নানা কীর্তি; যা মানুষেরই সৃষ্টি। ওপরতলার জীবন-জিজ্ঞাসা নয়, প্রান্তিক শ্রেণীর খেটে খাওয়া দিনলিপির সঙ্গে লোকজ টানে তুলে আনেন বঙ্গীয় জীবনারের বিবিধ সংস্কার। গল্পে তিনি তৈরি করেন অসম্ভবরকমের এক ঘোর, গল্পের ইঙ্গিতবাহী ব্যবহারে পাঠক উপভোগ করে গদ্য ও কবিতার দ্বৈতস্বাদ।
আল মাহমুদের অসংখ্য স্বার্থক ছোটগল্পের ভুবন থেকে ‘পশর নদীর গাঙচিল’ নিয়ে আলাপ পাড়তে চাই এক্ষণে। তার অসম্ভব জনপ্রিয় গল্পগুলোর কাতারে হয়তো গল্পটি আলোচিত হয় না। এর অন্তর্গত সৌন্দর্য ও বাহ্যিক প্রভাব উচ্চমার্গের। নদী নিয়ে মাহমুদের অসংখ্য গল্প আছে; নানাভাবে নদীর প্রভাব বাংলার জনজীবনে প্রোথিত, এটা গল্পে সফলভাবে দেখিয়েছেনও। এটা অবশ্য মাহমুদের গল্পপাঠ ও তৎবিধ আলোচনার অন্যতম প্রধান ডিসকোর্স হিসেবে পরিগণিত। তবে এই গল্পে সুন্দরবনঘেঁষা মানুষের জীবন, নদী-নৌকা-জাহাজ ইত্যাদির সংগ্রামমুখর দিনের জ্যান্ত ছবি এঁকেছেন গল্পকার। প্রকৃতির সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়া শব্দস্কেচে সম্ভবত নতুন দিনের সঙ্গে নতুন কিছুরই ইঙ্গিত দেন মাহমুদ। আজকের সকালটা প্রতিদিনের হয়েও আলাদা—‘কর্পূর ধড়মড় করে বিছানায় ওঠে বসলো, কোনো গা মোড়ামুড়ি নয়, সোজা খাড়া’—কিশোরী কর্পূরীর ‘সোজা খাড়া’ শব্দ দিয়ে গল্পকার শুভ সূচনার ইঙ্গিত দিয়েও পাঠকদের বিধৃত করেন—‘কাইমারী গাঁ থেকে বাঘের ডাক আজকাল আর শোনা যায় না।’ বন্যসম্পদ নষ্ট করে, বন্যপ্রাণী বিপন্ন করে আমাদের তথাকথিত অগ্রগতির রাজনীতি যেন আলগা করে দেন আল মাহমুদ! অথচ কর্পূরীর মতো কিশোরীর এ ধারণা বদ্ধমূল—‘না খেয়ে মরে নাকি কেউ? মরে তো ঐ হারামজাদা গাঙ পাহারাদারওয়ালাদের দাবড়ানিতে।’ মানুষের কাছে মানুষ অনিরাপদ, ক্ষমতা আর অর্থের কাছে কত ঠুনকো মানুষের অবস্থান তা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বটেই, দেশীয় অবস্থাতেও আঁচ করা যায়।
কঠিন বাস্তবতার নিঙ্ক্তিতে কর্পূরী নিজেকেও মাপতে শুরু করেছে কিন্তু দাবড়ানির পরেও খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য তাকে টালাই নিয়ে যেতে হয় পশর নদীর বুকে। ছাগল নিয়ে, বাবুদের লাল নিশানয়লা জাহাজের কাছে। এতে সংসার চলে, পেটে পরে দানাপানি। জাহাজের বাবুরা দেশি ছাগল পেয়ে যারপরনায় খুশি হয়েও ঠকিয়ে দেয় কর্পূরীদের। ওই যে, শোষণের নিম্নমুখী প্রবাহ!
কর্পূরী আল মাহমুদের মানসকন্যা—যার বুকে প্রীতিলতাদের উত্তরাধিকার। বয়সকে তুড়ি মেরে কর্পূরী বলে—‘হারামজাদার তর সইছে না। ছাগলগুলো সাজা।’ হারামজাদা শব্দের দিকে নজর দিলে নিশ্চয়ই অবাক হওয়ার কথা। বড় জাহাজের পাশে নিতান্তই ক্ষুদ্র টালাই-এ দুই কিশোর-কিশোরী হারামজাদা উচ্চারণের সাহস পায় কোথাই? জীবন সংগ্রামে তাদের জারিত হওয়া, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ধারণা, প্রতিকূলতা জয় করার কঠিন মানসিকতার দরুন ভিন্ন এক স্পন্দন সেঁটে দেন কর্পূরী-রতনের অন্তরে। ফলে ছাগল নেওয়ার পর বাবুরা বিনিময় না দিলে কর্পূরী উঠে যায় জাহাজে, একা। প্রতিবন্ধক পরনের শাড়িটাকেও ছুড়ে দেয় সে। সাহস, কেবল সাহস আর নিজের অধিকার আদায়ের স্পর্ধা নিয়ে কর্পূরীর এ যাত্রায় ‘বেণীটা বাতাসে একটা কালো তরবারির মতো লাফিয়ে উঠছে।’ তার শব্দ প্রক্ষেপণের জোরে বেণী হয়ে ওঠে ‘কালো তরবারি’ এবং কর্পূরী এ ব-দ্বীপেরই সাহসী যোদ্ধা। যার বিস্তৃতি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে আজতক সব ন্যায়যুদ্ধেই দৃশ্যমান। কর্পূরী সাধ্যমতো জিনিসপত্র নিয়ে নেমে আসে টালাইয়ে, একা, বাবুদের ফাঁকি দিয়ে। দারুণ ক্ষীপ্রতায় কর্পূরীর এ অভিযান সফল হওয়ার পরেই যেন রতনের মুখ থেকে আসে স্বীকৃতি, ‘তুই বাদার বাঘিনী’। কিশোরীর শরীরের বর্ণনা বরাবরের মতোই মাহমুদ দিয়েছেন, যে পরম্পরা বজায় থাকে অন্যান্য গল্পেও। মাহমুদ সচেতনভাবে এখানে কর্পূরীর ‘স্তন দুটি অপুষ্ট ফলের’ তকোমা দিয়ে নিরাপদ রাখেন। ও দিকে রতনের নৈ মনোভাবে ঘি ঢেলে যখন কর্পূরী বলে—‘তোকে আমি রোজ নিয়ে আসব রতন। তোকে আমার ভালো লাগে।’ নারীপুরুষের যুদ্ধক্ষেত্রকে একই অন্বয়ের যূথবদ্ধ প্রণোদনা বলে মনে করা স্বাভাবিক কিন্তু মাহমুদ চিরায়ত স্বভাবে পুরুষকে দিয়ে নয়, নারীকে দিয়েই বলায় প্রেমের কথা। প্রেমময় পৃথিবীর ইশতিহার নিয়ে মাহমুদ কর্পূরীকে সৃজন করেন বাংলার সমাজজীবনের প্রায় বিরুদ্ধে গিয়ে। এখানেই সম্ভবত ফোকাসড হয় গল্পটা!
এই সমাজের অর্থনীতি, ধর্মের ভেতর দিয়েই কর্পূরীকে নির্মাণ করে মাহমুদ তার কল্পিত ভূবনের অধিশ্বর করেন। ভোরের আজানের সঙ্গে কর্পূরীর বাবার নামাজ আদায়ের সঙ্গে হাজার বছরের পার্থিবতার যোগ আছে বটে, কর্পূরীকে প্রায় ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশর নদীর দিকে যাওয়ার আগে গল্পকার বাবার মতো কর্পূরীকে নামাজে খাড়া করান না! একইসঙ্গে এই বিচিত্র অনুষঙ্গের সমান্তরালে হয়তো আমরা ভাবার সুযোগ পাবো, পেটের তাগিদের কাছে বাকিটা গৌণ। বাণিজ্যলক্ষীর সঙ্গে কর্পূরীর দুঃসাহসিক বসবাসে বিশ্বমোড়লদের দখল আর অবরোধের ছায়া-চিত্র এঁকে ভবিতব্যের দিকে ঠেলে দেন। যেখানে নারীর ছায়ায় পুরুষ সাহস পায়। নিয়মের ভেতরে থেকেও মাহমুদ তার সময়ের সঙ্গে দূর-ভবিষ্যতের যে যোগসাজেশ দেখান তা মহৎশিল্পী বিনে অসম্ভব। এক গল্পে এভাবে ধর্ম, অর্থনীতি, সমাজনীতি, নর-নারীর সম্পর্ক বির্নিমাণের সংগ্রামকে মুখর করার অছিলায় আল মাহমুদ গোটা বাংলাদেশকেই দৃশ্যমান করেন।