নুরুল হক বেশ কিছুকাল যাবত কবিতার চর্চা করে আসছেন। তার লেখা মোটামুটি সাচ্ছন্দ এবং স্বাভাবিক। তার কবিতার দিক দর্শন প্রেম, প্রকৃতি এবং দৃশ্যমান বাস্তবতা। এ জন্য একজন কবিকে তার দেশ জনগণ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর আস্থা রেখে এগোতে হয়। আমার ধারণা, নূরুল হক এই কথাটিতে আস্থা রেখে কাব্যচর্চা করে চলেছেন।
কথা হলো কোনো না কোনোভাবে লেখককে তার পরিবেশ প্রকৃতি এবং গণমানুষের আচরণ অভ্যাস এবং সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর ভর রেখে চলতে হবে। লেখার বিষয় অবশ্যই দেশের খুঁটিনাটি অনেক আলোড়ন বিলোড়নের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এবং সাহিত্যের আদর্শ মূলত সাহিত্যই এটা উপলব্ধি করা। এগিয়ে যেতে হলে পেছনে ফিরে দেখারও একটা অভ্যাস রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে আমি স্থানু নই। চলছি, দেখছি একইসঙ্গে লেখারও চেষ্টা করছি। লিখতে হলে দৃষ্টির পরিচ্ছন্নতা একান্ত কাম্য। কবির প্রকৃত কাজ হলো চলতে-চলতে ভালোবাসার কথা বলতে থাকা। কেউ শুনুক বা না শুনুক প্রেমের ঘোষণা কখনো নিস্তব্ধ হয় না। এই যে একজন কবি লিখতে থাকেন এবং দেখতে দেখেতে শিখতে থাকেন তার পরিবেশ প্রকৃতি এবং বাতাসে দুলছে লতা গুল্ম এর ভেতর যে চৈতন্য সৌন্দর্যের রুপ ধরে বিরাজ করে সেটা উপলব্ধি করা এবং একই সাথে অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা।
চলতে চলতে বলা। বলতে বলতে একটি ঐকতানকে ধরার চেষ্টা করা। এ কাজ কবির কাজ বটে। তবে একইসঙ্গে মানবতারও সমর্থনে সক্রিয় থাকা। কথা হলো দেখা, শেখো এবং লেখো। এভাবেই চলতে থাকো। কেউ যদি আঙুল তুলে বলে ওই তো কবি। তাহলে একবার তাদের চেহারাটা দেখে নিয়ে হাসি মুখে নিঃশব্দে এগুতে থাকো। যেন বাতাসে ভাসছে হাসের ডানা।
নূরুল হক একজন প্রেমিক মানুষ তো বটেই। তাছাড়া তার চলার পথে দুপাশে যে দ্রষ্টব্য আছে এর একটা বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। এটা একটা দুরুহ কাজ। যা ভাঁজ করে রাখার কোনও নিয়ম নেই। যা লেখা হলো, সেটাই মানবভাষার অত্যন্ত আন্তরিক শিল্প হয়ে বিজ্ঞপিত হওয়ার ইচ্ছা নিজের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্ত রেখেছে।
নূরুল হক মূলত একজন অভিজ্ঞ চাষীর মতো তার জমি উর্বর রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। তার হাতে শষ্যের বীজ তার অবয়বে ফসলের গন্ধ এবং সমগ্র সত্ত্বায় স্বপ্নের আনাগোনা যেন মৌমাছির চাকের মতো একটা কিছু চারপাশে নিজেকে জাগ্রত রেখে গুনগুন করছে এক ধরনের অদৃশ্য শক্তি। যার নাম আমরা দিয়ে থাকি কাব্যের কোলাহল। নূরুল হক আমার বিবেচনায় একজন প্রকৃত কবিরই নাম। তার লেখায় আনন্দ আছে। ছন্দ আছে। গন্ধও আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো একটি চাঞ্চল্যের আবহাওয়া তাকে ঘিরে ক্রমাগত উচ্ছ্বসিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে। এ ব্যাপারে সাধারণত কেউ কবিকে কোনো উপদেশ দিতে চান না। আর চাইলেও কবি তা গ্রহণ করবেন কি না, সেটাও তো একটা প্রশ্ন। যা দ্বিধা এবং দ্বন্দের সৃষ্টি করে। তার চেয়ে উত্তম হলো কবির রচনা পাঠ করা। যদি তা হয় কাব্য, তাহলে উচ্চারণ করে পাঠের আনন্দ নিজের ভেতরে সঞ্চারিত রাখা।
কবিতার আবহাওয়া নিঃসন্দেহে একটি কাজ, যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। কিন্তু বাতাস ঘূর্ণি তোলে তা যেখানেই সঞ্চারিত করুক, সেখানেই কম্পন-শিহরণ এবং আলোড়ন-বিলোড়ন ও সমর্পণ চলতে থাকে। কবি প্রেমের কাছে সহজ হয়ে সরল এবং আন্তরিক হয়ে ধরা দেন। আমরা একে বলি সমর্পণ। এবং একই সঙ্গ সন্তরণ, সাঁতার। নূরুল হক বলেছেন- ‘জন্মসূত্রে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ প্রেমিক ও কবি’। এই উপলব্ধি নিঃসন্দেহে কবিরই আন্তরিক আস্থার প্রকাশ।
নূরুল হক কেবল কবিতার চর্চার মধ্যেই আবদ্ধ থাকবেন না। এ প্রতিশ্রুতি তার কবিতার ভেতরেই খুঁজলে পাওয়া যাবে। কবিতার কাজ হলো মানুষকে সর্বদা জাগরিত রাখা। যেন চৈতন্যের একটা উদ্দেশ্যের মতো। কাঁপছে-নড়ছে, অথচ না কিছুই। এই প্রলোভন চতুর্দিকে মথিত করে কবির দেহের ওপর স্পর্শ রেখে চলে যাচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে। নদী কিংবা সময়ের প্রবাহে তরঙ্গে ঢেউ তুলে নৃত্যের আবেগে, উচ্ছ্বাসে। যেন কোথাও একটি সংগোপন উদ্দেশ্য এবং আনন্দ কোলাকুলি করে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে দেখছে। এই দেখার কোনো সমাপ্তি বা শেষ নেই। তার কোনো প্রকৃত পক্ষে দেশও নেই। চির আন্তর্জাতিক এবং আনন্দের ফল্গুধারা।
নূরুল হকের কাব্যে সনেটের আধিক্য দেখে আমার ধারণা হয়েছে, তার আঙ্গিকসিদ্ধি বেশ আনন্দের রূপ ধারণ করতে প্রস্তুত হয়েছে। তার কবিতার সীমা নির্ধারণ করার ছন্দের গাঁথুনি দেখে তার উদ্দেশ্যটি বুঝতে চেষ্টা করব। কবি নূরুল হক আমার বিশ্বাস একজন প্রকৃত কবি হৃদয়েরই মানুষ। তার কল্পনার ডানায় রোদ্রের ঝিলিক দেখে সকলেরই আনন্দের ধ্বনি করা উচিত।
আমরা এ কবির চর্চায় সাধনায় এবং সৃষ্টিতে আস্থা রাখতে পারি। আমরা বিশ্বাস করি, নূরুল হক এমন কিছু কাব্যানুভূতি তার দেশের মানুষের কাছে উত্থাপন করবেন, যা তাকে প্রতিভাবান কাব্যের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত করে তুলবে। আমরা কবির সাফল্যের জন্য আমাদের হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে অপেক্ষা করতে থাকবো। মনে হয় নূরুল হকের প্রতিভার স্বীকৃতি অচিরকালের মধ্যেই তার গালায় মালা হয়ে ঝুলবে।