কিশোর বয়সে মনে হতো সমাজটা নিষেধের দেয়ালে ঘেরা একটা কারাগার, চারদিকে শুধু না আর না; এই না-এর শেষ নাই যেন! তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে বই পড়ার কুঅভ্যাসটার ধারাবাহিকতায় দেখতে পাই সেই না-এর অনুভূতি শুধু আমার একার না, আরও অনেকের, বরং পৃথিবীর বেশিরভাগ তরুণেরই। এই না-গুলোর প্রতি ভেতরে ভেতরে একটা দ্রোহের সুর গুনগুন করত, মাঝে মাঝে কাঠের বিবর থেকে বেরিয়ে আসা ভোমরার মতো সে গোপন বিদ্রোহের গুঞ্জন সশব্দে প্রকাশও করত। বিদ্রোহের সেই সুর ছিল সযত্নেলালিত এবং গোপনগৃহে পালিত, এ কারণে এর প্রতি একটা পক্ষপাতও ছিল। আর সে পক্ষপাতের বলেই কোনও নির্বিরোধী বন্ধু এবং বন্ধুভাবাপন্ন সমবয়সী বা সামান্য কমবেশি বয়সের পরিচিত তরুণদের মনে হতো ‘ল্যাদাগ্যাদা’, বইয়ের ভাষায় গড্ডলিকা প্রবাহের শব্দ ধার করে বলতাম ‘ভেড়া’, কেউ কেউ পূর্ববাংলার ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মেনে অপিনিহিতি ঘটিয়ে বলত ‘ভেউড়া’; তবে আমরা সে শব্দটা শুধু স্ত্রৈণদের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছিলাম। আরেকটু বড় হওয়ার পরে বাজারিপণ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে একেবারে সুবোধ বালকদের নতুন কিছু শব্দেও অভিহিত করতাম ‘ফার্মের মুরগি’ এবং ‘ব্রয়লার পোলাপান’ ইত্যাদি।
এই না-গুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশে রচিত হয়েছে অনেক গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, আঁকা হয়েছে অনেক চিত্রকর্ম, গঠিত হয়েছে অনেক ভাস্কর্য, মঞ্চায়িত হয়েছে নাটক, চিত্রায়িত হয়েছে সিনেমা। তবে আজ জীবনের অর্ধশতকের অভিজ্ঞতায় দেখি এই না-বিরোধী বিদ্রোহের স্বরূপটা জানা না হওয়ায় বুঝতেই পারি না, মা-খালাদের মুখে শোনা আঞ্চলিক প্রবাদটি কেন এত সত্য হয়ে ওঠে, শত শত বইয়ের অমোঘ বাক্যসমষ্টিকে মিথ্যা করে দেয়—“রাগ গাঙে চর পড়ে আগে”—, এক কালের উগ্র বিদ্রোহী আর বিক্ষুব্ধরা পরে শান্ত হয়ে যায়। ধর্মের বিরুদ্ধে জাগা প্রবল বিদ্রোহী একদিন হয়ে যান ধার্মিক পুরোহিত বা পরহেজগার, কেউ কেউ হাজি; রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে ওঠা বিদ্রোহী হয়ে পড়েন আপোষকামী, করেন লেজুরবৃত্তি; সমাজের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা বিদ্রোহী হয়ে পড়েন রীতিনিষ্ঠ সালিশ ও নীতিবান সমাজপতি। কেন এমন হয়, অনেক ভেবেছি, অল্প বয়স থেকে বিদ্রোহীদের এই পতন কিংবা পরিবর্তন আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল বলে সর্বদাই ভেবেছি, জীবনে যেখানেই থাকি, স্ববিরোধিতার এমন বিপরীতস্রোতের অভিগমন যেন কখনও আমাকে মানুষের কাছে এমন হাস্যকর করে না তোলে।
সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি’ নামের বর্ণবোধ পাঠ্যপুস্তক দিয়ে শিক্ষাজীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে, ওই বইয়ের উগ্র ভাব ভালো নয় কথাটি শাশ্বত বলেই মনে হতো ছোটবেলা থেকে, আর সেই প্রবাদপ্রতিম বাক্যের নিরিখে বলা যায়, যে কোনও উগ্রপন্থা শেষ পর্যন্ত বিপরীতমুখী যাত্রা করার আশঙ্কা ভেতরে লুকিয়ে রাখলেও কালে কালে তা প্রকাশিত হয়ে যায়। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের (বর্তমানের কবীর সুমন) চালশের গান’টি মানুষের এই বিপরীতযাত্রা সম্পর্কে মোটামুটি সতর্ক করতে সহায়তা করেছে,
আজকে যে বেপরোয়া বিচ্ছু
শান্ত-সুবোধ হবে কাল সে।
…
আজকে যে মুখে মারে বিশ্ব
চুপচাপ হয়ে যাবে কাল সে
…
আজকে যে প্রতিবাদী কণ্ঠ
সর্বংসহা হবে কাল সে
এ কি শুধু চালশের প্রভাব! নাকি আরও কিছুর যৌগ?
না-গুলোর ধর্ম, বর্ণ, ওজন, আয়তন, মাত্রা ও শ্রেণীপরিচয় সম্পূর্ণ জানা সম্ভব না হলেও দেখা যায়, সব না কিন্তু এক পাতিলের ভাত না, বরং বলা যেতে পারে এক ঝুড়ির ফল; সেখানে শীতের দেশের আপেল-কমলা-আঙুর, গরমের দেশের আনারস-বাঙ্গি-তরমুজ কিংবা নাতিশীতোষ্ণ দেশের আম-জাম-কাঁঠাল-কলা ও পেয়ারার সমাবেশ ঘটেছে। সেই শিশুবেলা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম বন্দে আলী মিয়ার জঙ্গলের খবর নামের কিশোর উপন্যাসের আরিফ-রকিব-লতিফ ও সাঈদের আফ্রিকার নিষিদ্ধ অরণ্যে প্রবেশ করার রোমাঞ্চকর বর্ণনায় দেখেছি না-এর বিরুদ্ধে তারুণ্যের অভিযান, আরেকটু বড় হয়ে রকিব হাসানের ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের এক গল্পে দেখেছি নিষিদ্ধ বনের ভেতর প্রবেশ করে কিশোর, রবিন এবং মুসা অপরাধীচক্রের সন্ধান লাভ করে, না-এর বিরুদ্ধে এগিয়ে চলার কারণেই তা সম্ভব হয়। সর্বশেষ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ আবুল হুসেনের প্রবন্ধ নিষেধের বিড়ম্বনায় দেখি না-এর বিরুদ্ধে সেই ত্রিশের দশকের ঔপনিবেশিক যুগের সামাজিক ক্ষোভের প্রকাশ। আবুল হুসেন প্রবন্ধের শুরুতে, প্রথম বাক্যে লিখেছেন, “ধর্মশাস্ত্রসমূহ আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মই কতকগুলি ‘নিষেধ’ এর সমষ্টি মাত্র।”১ এটুকু পড়লে মনে হয় আবুল হুসেন বুঝি প্রবন্ধের শিরোনামের সাথে মিল রেখে না-গুলোর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি পাঠ করলে দেখা যায়, আসলে তা নয়, বরং তিনি না-গুলোকে বাঙালি মুসলমানের জীবনে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে উন্নত জাতির স্তরে উন্নীত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি না-নিয়ে অনেক রকম আলোচনা করার পর উপসংহারে পৌঁছে লিখেছেন,
তার জন্য নিষেধগুলো কতখানি বর্তমান অবস্থায় কার্যকরী হতে পারে তার বিচার করতে হবে; এবং সেই কার্যকরী নিষেধগুলো পুরোপুরি যাতে পালিত হয় অর্থাৎ যাতে সেগুলো পালন করবার ক্ষমতা প্রত্যেকেই লাভ করতে পারে, তারও ব্যবস্থা করতে হবে। মুসলমান সমাজকে আর একপেশে হ’য়ে ধর্মের সারশূন্য অনুষ্ঠানগুলির পূজা করলে চলবে না; তাকে সর্বজ্ঞান, সর্বরুচির বৈচিত্র্য-বিপুল ভাণ্ডারী হ’তে হবে; জন্তুধর্মী মুসলমানের চিত্তের ক্ষুধা মিটাবার জন্য সামর্থ্য অর্জন করতে হবে।১
আবুল হুসেন প্রবন্ধের শুরুর দিকে প্রথম বাক্যটির পরেই নিষেধগুলোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করতে গিয়ে আদিম যুগের জন্তুধর্মী মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁদের জন্য এসব নিষেধের আগমন ঘটেছে।
না-দুই
কোথায় যেন পড়েছিলাম একজন মানুষ দুই বছর বয়স থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত কমপক্ষে তেরো হাজার বার না কথাটি শুনতে বাধ্য হয়, “এটা করো না”, “ওটা খেয়ো না” ইত্যাদি। এই সব না-এর নানা মাত্রা আছে, শ্রেণী আছে, স্বভাবও আছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়:
ধর্মীয় না:
১। হারাম/ নিষিদ্ধ জিনিস খেয়ো না।
২। শাস্ত্রবিরোধী কথা বলো না।
৩। মহাপুরুষদের নিন্দা করো না।
৪। ধর্মের সীমালঙ্ঘন করো না।
৫। ধর্মকে অস্বীকার করো না।
৬। আল্লাহ/ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হইও না।
৭। অন্য ধর্মের উৎসবে যেও না।
রাজনৈতিক না:
১। দলের বিরুদ্ধে কথা বলো না।
২। নেতাদের গোপনীয়তা প্রকাশ করো না।
৩। পার্টির সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করো না।
৪। বিরোধীপক্ষের সভায় যেও না।
৫। দলের কারও সমালোচনা করে পোস্ট দিও না।
৬। অমুককে সভা করতে দিও না।
৭। দলের ভেতর ভাঙন সৃষ্টি করো না।
সামাজিক না:
১। খারাপ মানুষের সাথে মিশতে যেও না।
২। পচা কথা বলো না।
৩। জানালা দিয়ে বাইরে কিছু ফেলো না।
৪। কাউকে গালি দিও না।
৫। বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থেকো না।
৬। খারাপ জায়গায় যেও না।
৭। বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িও না।
অর্থনৈতিক না: (ব্যষ্টিক এবং সামিষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়ে থাকে)
১। ওই জামাটা কিনতে চেও না।
২। এই খাবারটার আশা করো না।
৩। বেহিসাবি খরচ করো না।
৪। এত দামি উপহার দিতে যেও না।
কিংবা,
৫। এইসব সস্তা জিনিস কিনতে যেও না।
৬। ওই নোংরা শিশুদের সাথে খেলতে যেও না।
৭। ওদেরকে ঘরে প্রবেশ করতে দিও না।
৮। ওই বাজে নোংরা জায়গায় যেও না।
৯। ওদের সাথে খেলতে যাবে না।
বৈজ্ঞানিক না:
১। এটা কুসংস্কার, বিশ্বাস করো না।
২। এটা পয়জনাস, খেও না।
৩। এই নিয়মটা লঙ্ঘন করো না।
৪। এই সূত্রটা অবিশ্বাস করতে পারে না।
৫। ওই আবিষ্কারটা অস্বীকার করতে পার না।
৬। এ ওষুধটা খাওয়া বন্ধ করবেন না।
৭। এটা সত্য না, ওটা বাস্তব না।
এই রকম অনেক ধরনের না আমাদের সামনে আছে, পেছনে আছে, ডানে-বামে সবদিকে আছে। শ্রেণীগত না, আদর্শগত না, প্রাতিষ্ঠানিক না, পারিবারিক না ইত্যাদি। ছোটবেলা দেখেছি অনেক দরিদ্র পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদের ইচ্ছাপূরণের ব্যর্থতাগুলোকে আর্থিক-না দিয়ে প্রকাশ করেন (ওপরের উদাহরণে আছে), আবার বড় হয়ে দেখি সমাজের ধনবান এবং ক্ষমতাবানরা তাদের স্বার্থসুরক্ষার জন্য কতগুলো না-কে ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠা করে নেয়, সকলের ওপর পাথরের মতো চাপিয়ে দেয়।
এটা ভুল যে শুধু বিশ বা পঁচিশ বছর কিংবা ছাত্রকাল পর্যন্ত না-গুলো শুনতে হয়, বরং সারাজীবন, চাকরি, ব্যবসা বা পেশাগত জীবন, সামাজিক জীবন এবং প্রৌঢ় জীবন হয়ে আমরণ না-এর ভেতর দিয়ে যেতে হয়। শৈশবে একটি শিশু যখন হাঁটতে শেখে তখন “ওখানে যেও না।” “এটা ধরো না”—এমন না দিয়ে শুরু হয়, স্বাভাবিক জীবনকে যাপন করে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে “ওষুধটা ফেলে দেবেন না।” “কান্না করবেন না, কষ্ট পাবেন না, উঠবেন না”; এমন লাখ লাখ না দিয়ে জীবন অবসিত হয়।
তরুণ বয়সে মনে হয়, না-গুলো শক্ত ইট হয়ে বাস্তিল দুর্গ রচনা করে মানুষের স্বাধীনতাকে বন্দি করে রাখে। এসব সশস্ত্র ও ধারালো সারি সারি না-এর ফাঁক দিয়ে অনায়াসে চলার দক্ষতা, সাহস ও বুদ্ধি ঐ সচ্ছল পরিবারের আপেল আপেল লুতুপুতু কিংবা ওমলামুর্গির মতো গৃহবন্দি কিশোরদের মধ্যে থাকে না।
এই না-গুলো অল্পতে হয় আচার, মাঝারিতে হয় শিষ্টাচার কিন্তু আতিশয্যে হয়ে ওঠে অত্যাচার। না-এর বিরুদ্ধে পাল্টা-না গড়ে ওঠে। এর পেছনে থাকে নানা কারণ। সাহিত্যে না-বিরোধী রচনা দেখা যায় কবিতায়, গল্পের-উপন্যাসের-নাটকের এবং সিনেমার সংলাপে। বাস্তবসমাজে এই না-বিরোধী কিংবা পাল্টা-না এর পথে চলা মানুষদের আমরা প্রথমে বলি বেআইনি, তারপর বলি সন্ত্রাসী, কখনও হয়তো প্রতিবাদী যুবকও বলি।
না-তিন
না-গুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সমাজে আলোচনা হয়, গবেষণা হয়েছে, কারণ, এসব না-এর ভেতরে নিহিত থাকে সমাজের গতি ও প্রকৃতি। মানুষের চলমান জীবনের দিক ও দিশা এখানেই লুকানো থাকে। বিভিন্ন দিক তেকে আসা না-গুলোকে মানবশাসনের সংঘ বা সংগঠনের দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
১। ধর্মীয় না: ধর্ম মানবশাসনের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন। ধর্ম মানুষকে নানা কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, এসব না-কে লঙ্ঘন করলে পাপ হয়। পাপীকে ধর্মীয় বিধান অনুসারে সৃষ্টিকর্তা শাস্তি প্রদান করেন।
২। সামাজিক না: সমাজও প্রাচীন সংগঠন, সমাজও নানা প্রকার না সৃষ্টি করে থাকে মানুষের অবাঞ্চিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, এসব না-কে অমান্য করার নাম হলো অন্যায়। অন্যায়কারীকে মানুষ ঘৃণা করে।
৩। রাষ্ট্রীয় আইনের না: রাষ্ট্র আধুনিক যুগের সৃষ্টি হলেও প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন রাজ্যে লিখিত কিংবা মৌকিক আইন প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় হাম্মুরাবির আইন ছিল লিখিত, রোমানদের আইনও লিখিত ছিল, এসব আইন মূলত নানা রকম না-এর সমষ্টি। আইন কোনও নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকদের বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য, গর্হিত আচরণের জন্য এবং নিষিদ্ধ উক্তির জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করে থাকে, এসব না-এর বিরুদ্ধে অবস্থান করাকে বলা হয় অপরাধ।
দেখা যাচ্ছে না-গুলোর সাথে ধর্ম, সমাজ এবং আইনের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। এসব না নিয়ে নানা শাস্ত্র আলোচনা করে আসছে। না-গুলো যখন ব্যক্তির স্বাধীনতাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করে তখন ব্যক্তিমনে প্রক্ষোভের জন্ম হয়, প্রক্ষোভ থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে বিক্ষোভ, এরপর বিদ্রোহ ইত্যাদি। নজরুল যে বলেছেন আমি মানি নাকো কোনো আইন—এই আইন অমান্য করার কারণ কোথায়? এমন বিদ্রোহীবাক্য কোথা থেকে আসে, কেন আসে?
না-নিয়ে শাস্ত্রীয় আলোচনা করা যায় এভাবে,
১। মনোবৈজ্ঞানিক দিক থেকে: এত না কোথা থেকে আসে? আদিম সমাজের ইতিহাসে দেখা যায়, প্রাচীনকালে মানুষের সভ্যতার শুরু থেকেই না-এর পদযাত্রা শুরু হয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর টোটেম ও ট্যাবু গ্রন্থে এই না-এর উৎপত্তির জন্য আদিম সমাজের ট্যাবুকেই উৎস বলে দেখিয়েছেন। ফ্রয়েড লিখেছেন, “নির্জ্ঞান মনে যা-কিছুর প্রতি প্রবল ঝোঁক আছে বহির্জগতে এরূপ কাজকে নিষিদ্ধকরণই হচ্ছে টাবুর মূল সূত্র।”৩
ফ্রয়েড মনে করেন, ‘টাবুর বাধানিষেধগুলি ধর্ম সম্পর্কীয় ও নৈতিক আপত্তি থেকে ভিন্ন। টাবুর বাধা-নিষেধের সঙ্গে দৈবের কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে নিষেধগুলি মানুষ নিজেদের ঘাড়ে নিজেরাই চাপিয়ে দিয়েছে।’৪
আলোচনাপ্রসঙ্গে ফ্রয়েড সমকালীন মনস্তত্ত্বদিদের পূর্বধারণাও উদাহরণহিসাবে টেনে এনেছেন। ভুন্ড (Wund)-এর উদ্ধৃতিতে দেখা যায়, “টাবুকে মানবতার সবচেয়ে পুরানো অলিখিত আইন বলে বর্ণনা করেছেন। টাবু দেবতাদের চেয়েও পুরানো এবং প্রাক-ধর্মযুগের বলে সাধারণত ধরে নেওয়া হয়।”
এরপর ফ্রয়েড নৃতত্ত্ববিদ নর্থকোট ডব্লিউ টমাসের লেখা এনসাইক্লোপিডিয়ার ‘টাবু’ নামক প্রবন্ধ থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন, সেখানে ট্যাবু ব্যবহারের দশটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে:
১। প্রত্যক্ষ টাবুর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ক) দলপতি গুরু প্রভৃতি প্রখ্যাত ব্যক্তি ও বস্তুকে বিপদ থেকে রক্ষা করা; খ) দুর্বলকে আশ্রয় দান— যেমন স্ত্রীলোক, শিশু ও সাধারণ লোককে সর্দার এবং গুরুদের কবল থেকে রক্ষা (জাদুকরী বিদ্যার প্রভাব থেকে) রক্ষা করা; গ) কতকগুলি বিপদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া—যেমন মৃতদেহ নাড়াচাড়া করা বা তার সংস্পর্শে আসা, কোনো খাদ্য খাওয়া প্রভৃতি ব্যাপারজনিত বিপদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা; ঘ) জন্ম, উপবীত, বিবাহ, যৌনক্রিয়া প্রভৃতি জীবনের প্রধান প্রধান কাজকে বিপত্তি থেকে রক্ষা করা; ঙ) দেবতা ও প্রেতাত্মাদের ক্রোধের বিরুদ্ধে মানবকে অভয় দান করা; ভ্রƒণস্থিত শিশু ও চোট ছেলেমেয়দের সংরক্ষণ; বিশেষ করে যেসব ছেলেমেয়ে তাদের মাতাপিতার সঙ্গে খুব সহৃদয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের কতকগুলি কাজের অবশ্যম্ভাবী ফল থেকে, বিশেষ করে খাদ্যবস্তু থেকে সংগৃহীত কতকগুলি গুণাগুণ সঞ্চালনের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করা। ২। চোরের হাত থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, খেত-খামার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি রক্ষার জন্যও ‘টাবু’ আরোপিত হয়ে থাকে।৫
এখানে দেখা যাচ্ছে মানবসমাজে না-গুলোর উৎপত্তির পেছনে মানবকল্যাণের একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানুষকে নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থাটা এক সময় কারও কারও নিকট শৃঙ্খলিত দশা মনে হয়। তারা মনে করে না-এর শেকলে বন্দি করার ব্যবস্থা ট্যাবু থেকে সৃষ্ট, বনের পশুকে যেভাবে গলায় শেকল পরিয়ে, দড়ি লাগিয়ে কিংবা খাঁচায় আটকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, মানুষকেও না-এর ধারালো বর্শার সারিতে বন্দি করে রাখার ব্যবস্থাটা ওখান থেকেই এসেছে। এই না-এর শেকলছেঁড়া মানুষগুলো কি নীতিগতভাবে সৎ হয়ে থাকেন, নাকি তাদেরকে অসৎ বলে গণ্য করা উচিত? এই নীতিবাদী দিকটা একটু পরেই পাচ্ছেন। তার আগে মনোবিজ্ঞানের দিকের আলোচনাটা শেষ করা যাক।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর সভ্যতা ও তার অসন্তোষ গ্রন্থেও এ দিকটি নিয়ে আলোচনা করেছেন,
আমাদের জটিল মানসিক গঠন বিভিন্ন প্রভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন, নোদনা (ড্রাইভস) পরিতুষ্ট হলে মানুষ সুখী হয়; কিন্তু বহির্জগতের শক্তি যদি নোদনাকে বিরুদ্ধ করে বা আমাদের চাহিদা পূরণ না হয় তাহলে সেটা যথেষ্ট মনোবেদনার কারণ হয়। সেজন্য এইসব প্রবৃত্তিগত আবেগগুলিকে প্রভাবিত করে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত রাখতে চায়।৬
ফ্রয়েডকন্যা আনা ফ্রয়েড শিশুর মনঃসমীক্ষণ করতে গিয়ে দেখেছেন কোনও কোনও শিশু স্বাভাবিক মার্জিত আচরণ না করে অমার্জিত ও অভদ্র আচরণ করে থাকে মনস্তাত্ত্বিক কারণে। তিনি সেসব শিশুর আচরণে পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হন। এর মানে হলো, যে সব শিশু না-কে ধারণ করে, সামাজিক দিক থেকে সেই না-গুলোর গ্রহণযোগ্যতা নাই, তাই সেগুলো পরিবর্তন করা আবশ্যক। এভাবে মনঃসমীক্ষক আনা ফ্রয়েড শিশুকে না-এর জগৎ তেকে বের করে হ্যাঁ-এর জগতে বিচরণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।৭
২। নীতিবিজ্ঞানের দিক থেকে: নীতিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এই না-গুলোকে ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই বলা যেতে পারে নিয়ন্ত্রণবাদের কথা। নীতিশাস্ত্রবাদীগণ নৈতিক নিয়ন্ত্রণকে ক) বহির্নিয়ন্ত্রণ এবং খ) অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, এভাবে দুইভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করেন। জেরেমি বেন্থামের মতে মানুষ চার প্রকার বহির্নিয়ন্ত্রণ দ্বারা চালিত হয়। এগুলো হলো, ক) পার্থিব বা প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ, খ) রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, গ) সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং ঘ) ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ।৮
এ চারটি উৎস থেকে না-গুলোর উৎপত্তি ঘটে থাকে। বেন্থাম অভ্যন্তরীণ বা অন্তরের নিয়ন্ত্রণকে বলেছেন বিবেক। তবে তিনি নিয়ন্ত্রণবাদের সাথে সুখবাদের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এই চার প্রকার বহির্নিয়ন্ত্রণের দ্বারা মানুষ আত্মসুখের চেয়ে পরসুখের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
আবার অন্য দিকে আত্মসুখবাদের সাথে বিধিবাদের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে বহির্বিধিবাদ মনে করে মানুষের ওপর কতগুলো না চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা আত্মসুখ সৃষ্টি এবং উপভোগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।৯
৩। শিক্ষাবিজ্ঞানের দিক থেকে: শিক্ষাচিন্তা দিয়ে যদি আমাদের আলোচ্য না-গুলো ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, শিশুর মানসিক বিকাশের সাথে সাথে তার অভ্যন্তরে এবং বাইরে না-গুলোর জন্ম হয়। এর কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে জ্যাঁ পিঁয়াজে (১৮৯৬-১৯৮০) বলেছেন,
জ্ঞানীয় বিকাশের শেষ স্তর হলো রীতিবদ্ধ প্রায়োগিক কাল (Formal Operational Period)। এই পর্যায়ের বিকাশ আরম্ভ হয়ে ১১ বছর হতে এবং তা প্রায় ১৫/১৬ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পিঁয়াজের মতে এই স্তরের সূচনা হয় শিশুর আত্মকেন্দ্রিক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে। এসময়ে তাদের সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে। এর ফলে শিশুর সামাজিক জীবনে এক নতুন পরিবর্তন ধরা পড়ে।১০
শিক্ষাবিজ্ঞান মানবসন্তানকে সভ্য, ভদ্র, সামাজিক, মার্জিত এবং আদর্শ নাগরিকহিসাবে গড়ে তোলার দায় শিক্ষা বিভাগের। কাজেই মানবসন্তান যখন ঐ নির্দিষ্ট বয়সে নতুন এক পরিবর্তিত সামাজিক জীবনে প্রবেশ করে তখন তাকে নানা রকম না-এর ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। এই না-গুলোর প্রয়োজনীয়তা শিক্ষকেরা উল্লেখ করেন, পাঠ্যপুস্তকে তা লিখিত থাকে, আবার কিছু বিষয় অলিখিতও থাকে। এসব না-এর বিরুদ্ধে গেলে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদেরকে এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদেরকেও নানা রকম লঘুদণ্ড প্রদান করা হয়ে থাকে। দেশ-বিভেদে তার রকমফেরও আছে, বেত্রদণ্ড, মৌখিক তিরস্কার, দাঁড় করিয়ে রাখা এবং পরীক্ষা থেকে সাময়িক বহিষ্কার এমনকি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের মতো গুরু শাস্তিও তাদেরকে দেওয়া হয়ে থাকে।
৪। অপরাধবিজ্ঞানের দিক থেকে: অপরাধবিজ্ঞান সমাজে এবং রাষ্ট্রে প্রচলিত না-গুলোর প্রতি নাগরিকদের প্রশ্নহীন আনুগত্য আশা করে, এবং তা বাস্তবায়নের দিকটা প্রাধ্যান্য দেয়। এসব না-এর বিরুদ্ধে চলা নাগরিকদের, পাল্টা-না সৃষ্টিকারীদেরকে অপরাধী বলে সনাক্ত করে।
অপরাধবিজ্ঞান মনে করে সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি কোনও দেশের প্রচলিত আইন এবং সমাজে বিদ্যমান বিধি ও বিধানগুলো অমান্য করে, সে বৈধ পথের বাইরে চলে যায়, তখনই সেখানে অপরাধের জন্ম হয়। এ ব্যাপারে অপরাধবিজ্ঞান গ্রন্থের লেখক হামজা হোসেন বলেন, “মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণ। বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, নৈতিকতাবোধ মানুষের আছে, মানুষ তবুও অপরাধ করে কেন এ প্রশ্নটি খুবই জটিল এবং সহজ সরল উত্তর দেওয়া কঠিন।”১১
এখানে অপরাধবিজ্ঞানের লেখক মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা ও সহানুভূতিশীলতা রক্ষা করেই আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে চান, এটা বোঝা যায়, মানুষ অপরাধ করে কেন অর্থাৎ না-গুলো লঙ্ঘন করে কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিধাগ্রস্ততার পেছনে অনেকগুলো বাক্য, অনুচ্ছেদ আলোচনা চালিয়ে গেছেন, এরপর তিনি লেখেন, “দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে যে কাজকে অন্যায় বলে ধরা হয়ছে এবং যা ভঙ্গ করলে রাষ্ট্রীয় শাস্তি বিধানের বন্দোবস্ত রয়েছে তাকে আমরা ক্রিমিনাল বলতে পারি।”১২
এখানে অন্যায় এবং অপরাধের মধ্যে হামজা হোসেন পার্থক্য বিলীন করে একাকার করে দেখিয়েছেন। কিন্তু অন্যায় এবং অপরাধের সংজ্ঞা এক নয়। এ ব্যাপারে মনীষী ড. আহমদ শরীফ তিনটি বিষয়কে পৃথকভাবে দেখিয়েছেন,
কৃত্রিমতার অনুশীলনই হচ্ছে মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও সাধনা। এই জন্যই স্বভাবকে তার দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং বরণ করতে হয় “বাঁচ ও বাঁচিতে দাও”; নীতি। যুগে যুগে বহু মানুসের চিন্তা-ভাবনা-প্রয়াসের ফলে রচিত হয়েছে নিয়মনীতি, বিধিনিষেধ—সবটাই পারস্পরিক ব্যবহার-নীতি। এই আচরণ বিধি-ব্যবহার তিন শাখা—শাস্ত্রবিধি, সমাজবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। প্রথমটা লঙ্ঘন পাপ (Sin), দ্বিতীয়টার অবহেলা নিন্দনীয় (Vice) এবং তৃতীয়টার ব্যতিক্রম অপরাধ (Crime)।১৩
আহমদ শরীফ যা মনে করেন তা সমাজে প্রচলিত কথার অনুরণন, ধর্মের অবজ্ঞা মানে পাপ, সমাজকে উপেক্ষা মানে অন্যায় আর আইনকে লঙ্ঘন করলে হয় অপরাধ।
৫। সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে: সমাজবিজ্ঞানই সমাজ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকেও মানুষ ধর্মের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের বিদ্যমান না-গুলো মেনে চলবে তা আশা করে এবং সে সম্ভাবনার সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে নানা রকম গবেষণা করে এর ভেদ, মাত্রা ইত্যাদি আবিষ।কার করে এর করণীয় নির্ধারণ করে। সমাজবিজ্ঞানে প্রচলিত না-গুলো অস্বীকার করে মানুষ পল্টা-না-এর দিকে ধাবিত হয় কেন, সে আলোচনা অনেক হয়েছে। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান সমাজের নানা উৎস থেকে উদ্ভূত না-গুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। পাল্ট-না এর পথে চালিত মানুষগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছে, যেমন, ক) অপরাধ, খ) পাপ, গ) বিচ্যুতি এবং ঘ) নীতিহীনতা।
ড. মো. নূরুল ইসলাম অপরাধের উৎসহিসাবে কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, ১। দারিদ্র্য, ২। বেকারত্ব, ৩। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, ৪। সাংস্কৃতিক শূন্যতা, ৫। আইনের অপব্যবহার, ৬। হতাশা ও ব্যর্থতা, ৭। শিক্ষাহীনতা, ৮। আগ্রাসন, ৯। পিতা-মাতার অজ্ঞতা, ১০। চাপ ও নিয়ন্ত্রণহীনতা।১৪
পাপের বৈশিষ্ট্যহিসাবে তিনি কয়েকটি দিক উল্লেখ করেছেন, যেগুলো আমাদের আলোচ্য পাল্টা-নাগুলোর অন্যতম কারণহিসাবে গণ্য করা যায়।
১। মুখাপেক্ষিহীনতা, ২। স্ব-ইচ্ছায় তাড়িত হওয়া, ৩। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, ৪। নিষ্ঠুরতা ও ৫। ধর্মদ্রোহিতা।১৫
বিচ্যুত আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলো নূরুল ইসলাম আলোচনা করেছেন এভাবে, ১। সামাজিক আদর্শের পরিপন্থী, ২। বিশ্বজনীনতা, ৩। বিভিন্নতা, ৪। শাস্তিযোগ্য, ৫। অপ্রত্যাশিত, ৬। সামাজিক সমস্যা, ও ৭। সংশোধনযোগ্য।১৬
বিচ্যুত আচরণের কারণগুলো নূরুল ইসলাম পাঁচটি ধরনে আলোচনা করেছেন, সে ধরনগুলোর ভেতরে আধুনিক সমাজের অনেক ধরনের সামাজিক বিচ্যুতি উঠে এসেছে। বর্তমান আলোচনা পূর্ণাঙ্গ করার লক্ষ্যে সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন। যেমন,
১। জৈবিক কারণ ছয়টি: বংশগতি, ক্রোমোজমের ত্রুটি, জিনগত ত্রুটি, অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন, অসুস্থতা এবং অক্ষমতা।
২। মানসিক কারণ আটটি: মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চনা, পরিবেশগত বঞ্চনা, পারিবারিক ভাঙন, ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ, সামাজিক আঘাত, হতাশা (চাপ, অক্ষমতা), অপরিপক্কতা এবং প্রেমজনিত ভাঙন।
৩। সমাজ-সাংস্কৃতিক কারণ তেরোটি: সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি বা প্রতারণা, সাংস্কৃতিক ল্যাগ এবং দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, যথাযথ সামাজিকীকরণের অভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নৈতিক শিক্ষার অভাব, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, মাদকাসক্তি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং নারীশিক্ষার অভাব।
৪। অর্থনৈতিক কারণ পাঁচটি: কর্মসংস্থানের অভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অর্থের সুষম বণ্টনের অভাব, অর্থিৈনতক নিরাপত্তার অভাব এবং নারী কর্মসংস্থানের অভাব।
৫। রাজনৈতিক কারণ চারটি: রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের অভাব।১৭
ওপরের আলোচনায় অনেকগুলো দিক উঠে এসেছে, তবে কিছু দিক অনালোচিত রয়ে গেছে, যেমন ভৌগোলিক কারণ, এর মধ্যে আছে আঞ্চলিকতাবাদ; কিছু মানুষ আঞ্চলিক কারণে নিজেদের উঁচুমানের বলে গর্ব করে, আবার অন্য মানুষকে নিচু বলে ঘৃণা করে। এখানে গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব, মূলভূমি ও চরাঞ্চলের দ্বন্দ্ব, ঐতিহাসিক স্থান বা বিখ্যাত-অখ্যাত স্থানদ্বন্দ্ব রয়েছে। “অমুক জেলার পোলা, আশি টাকা তোলা”, বা “বিএনসিসির (বরিশাল-নোয়াখালি-কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম) মানুষ ভালো না”—এমন ঘৃণাসূচক বাক্যও সমাজে প্রচলিত রয়েছে। গায়ের রঙ বা বর্ণবৈষম্যের কারণেও মানুষ ঘৃণার শিকারের কথা সবাই জানে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক ফ্লয়েডকে গলা চেপে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেশ আলোচিত। এসব প্রবণতা এবং ঘটনার পেছনে নানা রকম না-প্রচলিত থাকে, সেখানে নতুন পাল্টা না-ও সৃষ্টি হয়।
সাংস্কৃতিক সংঘাতের ভেতর ক্রীড়ানুষ্ঠান নিয়েও দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এক সময় আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল খেলা নিয়ে মারামারি হতে দেখেছি। এখন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, আবার ক্রিকেট খেলায় দেখি ভারত-পাকিস্তানের টুর্নামেন্টের সময় এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘৃণা করে, শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে আঘাতও করে। গ্রামাঞ্চলে এমন ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডু, নৌকাবাইচ, সাঁতার এমন নানা খেলা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং ঘৃণা করতে দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে অনেকগুলো না রয়েছে, সেসব মেনে চলাকে মানুষ অপমানজনক মনে করে। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার ভক্তকে পছন্দের দেশের পতাকা ওড়াতে, বিজয়ের স্লোগান না দিতে, জার্সি পরে চলতে না-করা হয়ে থাকে।) এসব কারণে মানুষের মনে অনেক পাল্টা-না এর জন্ম হয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব এসবে লাইক দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে, কমেন্ট নিয়ে, শেয়ারিং নিয়েও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তরুণ মনে নানা রকম না-এর চাপ দেখা দেয় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা-না এর সৃষ্টি হয়।
টীকা ও তথ্যনির্দেশ:
১। আবুল হুসেন, নিষেধের বিড়ম্বনা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা-৫৭
২। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-৫৭
৩। সিগমুন্ড ফ্রয়েড, টোটেম ও টাবু (ভাষান্তর-ধনপতি বাগ), সুবর্ণরেখা প্রকাশনী কলকাতা, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা-২৮
৪। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-২৯।
৫। সিগমুন্ড ফ্রয়েড, টোটেম ও টাবু (ভাষান্তর, ধনপতি বাগ), সুবর্ণরেখা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা-১৭-১৯
৬। সিগমুন্ড ফ্রয়েড, সভ্যতা ও তার অসন্তোষ, (অনুবাদ- মঞ্জুলেখা বেরা), ‘সিগমুন্ড ফ্রয়েড’ (পুষ্পা মিশ্র সম্পাদিত), এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০১৪, পৃষ্ঠা-৫৫৫
৭। ক) আনা ফ্রয়েড, শিশুর মনঃসমীক্ষণ (পদ্ধতি ও প্রয়োগ প্রসঙ্গে), অনুবাদ-রিফ্ফাত সামাদ, অবসর, ঢাকা, ২০২৩, পৃষ্ঠা-০০
খ) আনা ফ্রয়েড, শিশুর মনঃসমীক্ষণ (শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য), অনুবাদ-রিফ্ফাত সামাদ, অবসর, ঢাকা, ২০২২, পৃষ্ঠা-০০
৮। লেখক অজ্ঞাত, নীতিবিজ্ঞান, (প্রকাশনী ও প্রকাশকাল অজ্ঞাত), কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৭২-৭৩
৯। শ্রীপ্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত, নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন, ব্যানার্জী পাবলিকেশন, কলকাতা, ১৯৫০, পৃষ্ঠা- ৪৭-৫২
১০। মুহাম্মদ নাজমুল হক ও মনিরা জামান, শিশুর জ্ঞান বিকাশের ধারা: পিঁয়াজে তত্ত্ব, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৮২
১১। হামজা হোসেন, অপরাধ বিজ্ঞান, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা-৭৩
১২। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫
১৩। আহমদ শরীফ, সামাজিক উপদ্রব ও রাজনৈতিক উপসর্গ, যুগ-যন্ত্রণা, চৌধুরী পাবলিশিং হ্জা, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা-১৫
১৪। নূরুল ইসলাম, (ড. মো.), অপরাধ ও সমাজ, তাসমিয়া পাবলিকেশনস, ঢাকা, ২০২০, পৃষ্ঠা- ১৪-১৬
১৫। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪-২৬
১৬। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮-৩০
১৭। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩০-৩২