ছোটগল্পে ব্যক্তির বিচিত্র রূপই কেবল চিত্রায়িত হয় না, প্রকৃতি-সমাজেরও স্বরূপ অঙ্কিত হয়। কারণ ছোটগল্পের কুশীলবকে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র বিষয়ে যেমন সচেতন-সতর্ক থাকতে হয়, তেমনি মনস্তত্ত্ব, তাঁর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও অনুসন্ধানী হতে হয়। এই স্বভাববৈশিষ্ট্যের লেখকদের একজন নাহিদা আশরাফী। ছোটগল্পকে তিনি কেবল সামাজিক সংঘর্ষ-সংকটের চিত্র আঁকার মঞ্চ হিসেবেই দেখেন না, ব্যক্তির মনোজগৎ বিশ্লেষণেরও মোক্ষম অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২০২৩ সাল পর্যন্ত নাহিদা আশরাফীর গল্পগ্রন্থ সংখ্যা সাকূল্যে তিনটি। এগুলো হলো: মায়াবৃক্ষ (২০১৬), জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা (২০১৯) ও ঝুলবারান্দা তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয় (২০২২)। এই তিনটি গ্রন্থে মোট গলেপ সংখ্যা ৩৬। মায়াবৃক্ষ-এ গল্প সংখ্যা ৯, জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’য় ১৪ এবং ঝুলবারান্দা তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয় গ্রন্থে গল্প সংখ্যা ১৩। এরমধ্যে প্রথম গল্পগ্রন্থের ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’ ও ‘ডায়েরি’ গল্প দুটি দ্বিতীয় গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে। এই হিসাবে মোট গল্পসংখ্যা-৩৪। এই নিবন্ধে উভয় বইয়ে থাকা গল্প দুটিকে দ্বিতীয় গ্রন্থের গল্প হিসেবে গণ্য করা হবে। কারণ দ্বিতীয় গ্রন্থে গল্পই পরিমার্জিত ও চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই নিবন্ধের বিষয় ও কলেবর বিবেচনায় এখানে সাকূল্যে ছয়টি গল্পের বিশ্লেষণের প্রয়াস থাকবে। এর আগে তার গল্পের প্রধান প্রবণতাগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা থাকবে।
নাহিদা আশরাফীর গল্পে প্রধান লক্ষণ মূলত দুটি। এগুলো হলো:
১. সামাজিক চিত্র রূপায়ণ
২. নারী-পুরুষ সম্পর্কের রূপভেদ ও মনস্তত্ত্ব
সামাাজিক বাস্তবতা চিত্রায়ণ গল্প লেখকের স্বতঃপ্রণোদিত প্রধান দায়। তাই প্রত্যেক গল্পকারের গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য সাধারণত সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা। সামাজিক চিত্র বিধৃত করতে গিয়ে লেখককে একইসঙ্গে স্রষ্টা ও দ্রষ্টা হতে হয়। এই নিবন্ধের আলোচ্য গল্পকার নাহিদা আশরাফীও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি সমাজকে বুঝতে, সেই বোধিলব্ধ-ধারণাসম্ভূত জ্ঞান সমাজকে বোঝাতে স্রষ্টা ও দ্রষ্টায় নিজেকে পরিণত করেছেন। সমাজচিত্র অঙ্কনের অভীপ্সায় স্রষ্টা ও দ্রষ্টা হয়ে ওঠার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন তার গল্পে। এই ধারার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হলো, ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’, ‘ডায়েরি’ ও ‘খুনী’।
সামাজিক বাস্তবতার ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’ গল্পটি প্রথমেই আসে। এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, বর্তমান সময় ও সমাজের রূঢ়চিত্র। সেই চিত্র আঁকতে গিয়ে লেখক বেছে নিয়েছেন প্রতিনিধিত্বশীল কয়েকটি চরিত্র। যে চরিত্রগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিত্যচেনা। এই চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে লেখক বলেছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে কেবল ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখা হয়। সেখানে মায়া-মমতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভক্তির কোনো স্থান নেই। লেখক দেখিয়েছেন চাকরিপ্রার্থী নারীর কোথাও চাকরি হয় না। যদি হয়ও তাহলে মামা-চাচা-বাবার খুঁটির জোরে। আর যারা চাকরি দেয়, তারা কিন্তু নারীর যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করে দেয় না। এমনকি সুপারিশকারীর সম্মানের দিকে তাকিয়েও দেয় না। তারা দেয়, তাদের লালসা চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্যে। যা চাকরি পাওয়ার পর নারীরা ধীরে ধীরে টের পায়। কিন্তু ততদিনে তাদের না থাকে প্রতিবাদের শক্তি, না থাকে অন্য কোনো কাজ করার অবলম্বন। ফলে তারা মুখ বুজে সহ্য করে যেতে বাধ্য হয়।
এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, প্রধান চরিত্র সবিতা পড়াশোনা শেষ করার পরও চাকরি পায় না। একসময় তার বাবা তাকে একটা চিরকুট দিয়ে বলে বাবারই বসের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সবিতা যায়। চাকরিও হয়। মাস শেষে বেতন তুলতে যাবে, ক্যাশিয়ার তাকে বলে বসের রুমে যেতে। সে অবাক হলেও যায়। ভেতরে গিয়ে বেতনের সঙ্গে পায় অযাচিত স্পর্শ, নোংরা ইঙ্গিত। সঙ্গে প্রমোশনের লোভ। গল্পে উঠে এসেছে এভাবে:
স্যালারির সাথে বাড়তিও কিছু পাওয়া গেলো। উপদেশ, নোংরা চোখের কুতকুতে চাহনি, প্রমোশনের লোভ আর স্পর্শকাতর জায়গায় হাতের অযাচিত স্পর্শ। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হলো। সবিতা চিৎকার করতে পারতো, কিন্তু দিন শেষে বাজার, মায়ের ওষুধ, বাড়িভাড়া, মুদি দোকানি বিল—এসবের চিন্তা ওকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে উচিত-অনুচিতের ভাবনার আগেই টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠলো।১
নিম্নবর্গের নারী চাকরিজীবী হলেও তার অর্থসংকট দূর হয় না। কারণ তাকেই পুরো সংসার টানতে হয়। তাকেই চারদিকের ঝড় মোকাবিলা করতে হয়। মুদি দোকানি পাওনা টাকার চাওয়ার সময় আম্মাজান সম্বোধন করে বটে। কিন্তু টাকা দিতে না পারলে তার জন্য অশ্লীল ইঙ্গিত করতেও ছাড়ে না।
বর্তমান সমাজের আরেকটি চক্ষুশূল ‘একাকী’ বা ‘অবিবাহিত নারী’। এই অবিবাহিত নারীকে সমাজ সহ্য করতে পারে না। তার নানারকম দোষ খুঁজে বের করাই এই সমাজের প্রধান উদ্দেশ্য। অবিবাহিত পুরুষ যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে, অবিবাহিত নারী তার একশতাংশও পারে না। তাই নারীকে অবশ্যই বিয়ের বন্ধনে জড়াতেই হয়। কারণও স্পষ্ট করেছেন নাহিদা আশরাফী। বলেছেন, ‘একা তরী বাওয়া পুরুষদের জন্যে কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু এই সমাজে মেয়েদের জন্য ব্যাপারটা একরকম অসম্ভব।’২
তাই সবিতারও বিয়ের প্রয়োজন। আর বিয়ের জন্য পাত্রও বেশিদূর খুঁজতে হবে না। কারণ দীপনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বহুদিনের। তবে, তারা দীর্ঘদিন যাবত স্বামী-স্ত্রীর মতো চললেও দীপনের বিধবা বোন পরমার বাধায় তাদের বিয়ে হচ্ছে না। এসব নিয়ে সবিতার মনে ঝড় বহে যায়। এরই মধ্যে একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখে তার মা কাঁদছেন। কিন্তু কেন কাঁদছেন, তা বলছেন না। সবিতার রত্না পিসি ঘটনা খুলে না বললেও প্রথমে ইঙ্গিত দেয়—‘কী হইছে? কপাল পুড়ছে। তোর মায়ের কপাল পুড়ছে। আর কী জানবি? পুরুষ জাত আর কুত্তা সমান।’৩ রত্না পিসি যখন সবিতার বাবাকে কুত্তা বলে গালি দেয়, তখনো সবিতা বুঝতে পারে না, বোন হয়ে ভাইকে এমন গালি দিচ্ছেন কিভাবে। শেষপর্যন্ত বাবার লেখা একটি চিরকুট পায় সবিতা। চিরকুট পড়ে জেনে যায়, দীপনের বিধবা বোন পরমাকে নিয়ে তার বাবা পালিয়েছেন। চিঠি পড়ে একবার ভাবে, দীপনকে জিজ্ঞাসা করবে, সে কিছু জানে কি না? আর তাদেরই বা এখন ভবিষ্যৎ কী? কিন্তু না দীপনকে কিছুই জিজ্ঞাসা করে না। যথারীতি সকালে অফিসে যায়। অন্যদিন বাসের ক্ন্ডাক্টর-হেল্পার যখন তার শরীর স্পর্শ করতো, তখন ক্ষোভ জন্মাতো মনে, কিন্তু সেদিন সবিতা সবকিছু শীতল চোখে উপেক্ষা করে। কোনো প্রতিবাদ করে না। অফিস শেষে বাসার উদ্দেশে বের হয়। সামনে দেখে, পথের একদিকে সাদা বাস, যেখানে কন্ডাক্টর-হেল্পারের অযাচিত স্পর্শ অনিবার্য, অন্যদিকে বসের কালোগাড়ি, যেখানে প্রলোভন, প্রমোশনের টোপ—শেষপর্যন্ত শরীরের প্রতিই বসের লোভ। সবিতা এসব নিয়ে আর ভাবে না, এখন তার চোখে কন্ডাক্টর, বাসের হেল্পার, অফিসের বস ও নিজের বাবা—সব পুরুষই এক। লেখক বিষয়টিকে এভাবে চিত্রায়িত করছেন—
সবিতার কাছে এখন বাবা, অফিসের বস, মোড়ের দোকানি, বাসের হেলপার, ড্রাইভার—সব তো একই রকম। এরপর হয়তো আর তার বাসে ওঠাই হবে না। অফিসে ছুটির পর তার গন্তব্য কোন দিকে? অফিসের সামনে দাঁড়ানো সাদা বাস, না ডান গলিতে রাখা বসের কালো গাড়ি? সে শুধু সময়ই জানে।৪
লেখক গল্পের শেষবাক্যটি দিয়ে সবিতাকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ এক ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে প্ররোচিত করেছেন। এর আগে বলেছেন, হয়তো আর বাসে ওঠা হবে না। যে নারী নিজের প্রেমিককে হারালো, প্রেমিকের বোনের জন্য বাবাকে হারালো, যার চোখে বাবা-হেলপার-দোকানি—সব চরিত্রেরই একই চেহারা সে আর বাসে উঠবে না, এটাই স্বাভাবিক। সময়ের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হলে কৌশলী হতেই হবে। আর কৌশলী হওয়ার জন্য অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার মালিক হওয়া জরুরি। ক্ষমতাবান হতে হলে সাদাসিদে জীবন-যাপন আর বাসে চড়ে অফিস করা যাবে না। তাতে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। নিজেকে সমর্পণ যদি করতেই হয়, এক ও চূড়ান্ত ক্ষমতার কাছেই করা শ্রেয়। তাহলে বাকিদের শায়েস্তা করা সহজ হয়। নারীকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হলেও তার অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার সমর্থন এবং সামর্থ্য থাকাও আবশ্যক। না হলে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করেই তাকে বেঘোরে প্রাণটা হারাতে হবে। এই গল্পের ভেতর দিয়ে একজন সর্বংসহা-সর্বস্বান্ত নারীর অসহায়ত্ত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু তার ভেতর কোনো প্রতিবাদী স্বভাব সৃষ্টি করা হয়নি। লেখক দেখিয়েছেন, সংসারে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানরাই সবকিছুর কেন্দ্রে। সমাজ-সংসার এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত চলে তার ইচ্ছায়। তাদের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাবত সংসার নিজেকে সপে দেয়—নিঃশেষিত হয়। কিন্তু প্রয়োজনের সময়ও প্রতিবাদ করে না। তবে, সরব প্রতিবাদ না করলেও ভেতরে ভেতরে কৌশল সৃষ্টি হতে থাকে। সেই কৌশল দুর্বল একদিনেই প্রতিশোধ নিতে পারে না, তাকে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। সবিতা চরিত্রের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রস্তুতি ও আত্মনির্ভরশীলতার দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি এঁকেছেন নাহিদা আশরাফী। এই গল্পে অতিবিপ্লবের যেমন দুঃসাহস দেখাননি, তেমনি অশুভ শক্তির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে নীতিহীনতার দিকেও প্রধান চরিত্রকে ঠেলে দেননি। চরিত্রকে স্রষ্টার ইচ্ছায় পরিচালিত না করে পথ বেছে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ফলে উপযুক্ত সময়ে চরিত্র তার যথাযথ পথ বেছে নেবে।
‘ডায়েরি’ গল্পের মূল চরিত্র সুতপা। সহ-চরিত্র দুর্বার। গল্পের শুরুতে দেখা যায়, পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের পাশে ছোট্ট একটি দোকানের পাশে বসে থাকে। তার ভাই সান্নিধ্যের ফিরে আসার অপেক্ষায়। সান্নিধ্য গেছে কারাগারে, তার বন্ধুকে দেখতে। বসে থাকতে থাকতে সুতপা দেখে তারে দিকে বখাটেরা তাকিয়ে আছে। কেবল অল্প বয়সী নয়, বৃদ্ধও অশ্লীল ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। এই দৃশ্য এখন তার গা-সহা। তার মনে পড়ে দুর্বারের সঙ্গে টিএসসিতে কোনো একদিন বসেছিল সে। তখন একদল বখাটে তার দিকে তাকিয়েছিল বিশ্রীভঙ্গিতে। তা দেখে ভড়কে গিয়েছিল। তার এমন কুঁকড়ে যাওয়া দেখে দুর্বার বলেছিল, তাকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে থাকতে।
শোনো, একটা কৌশল শিখিয়ে দিই তেমাাকে। যখনই এমন কোনো বাজে অবস্থায় পড়বে, কাঁচুমাচু আর বিব্রত না হয়ে শীতল আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানোয়ারগুলোর দিকে তাকাবে। কেন বোঝো না, তোমাদের বিব্রত আর আড়ষ্ট ভাবটাকেই ওরা পুঁজি করে। একটা কথা মাথায় রাখবে, অন্যায় যে করে, সে দুর্বল।৫
এখানেও পুরুষ নারীকে সরাসরি প্রতিবাদে উৎসাহিত করে না। বরং কৌশল শেখায়। নাহিদা আশরাফী এখানেও দেখিয়েছেন, অস্ত্রের ক্ষমতাবান, বিত্তের ক্ষমতাবান, পেশীশক্তির ক্ষমতাবান—সব ক্ষমতাবানই এক। ফলে তাদের সঙ্গে দুর্বলের সরাসরি সংঘাতে জড়ানো ঠিক নয়। কারণ সংঘাতের ফল তার জন্য ভালো হয় না। তাই দুর্বার তাকে মনে করিয়ে দেয়, মেয়েদে দুর্বলতাকে বখাটেরা পুঁজি করে। সুতরাং সুতপার উচিত সরাসরি প্রতিবাদ নয়, আবার কুঁকড়ে যাওয়া নয়, নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বখাটেদের দিকে তাকানো। তাতেই তারা দমে যাবে। দুর্বারের এই কৌশল ভদ্রমানুষের অতি আগ্রহকে দমিয়ে জন্য যথেষ্ট হলেও বখাটেকে থামানোর জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। কারণ বখাটে যে, সে নারীর কৌশল কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে তার ওপর আক্রমণ চালায় না। কিংবা নারীকে উত্যক্ত করার সময়ও নারীর সামাজিক অবস্থান-চালচলন মাথায় রাখে না। বখাটের কাজ বখাটেপনা করা, নারীর আক্রমণাত্মক ভাব কিংবা নিস্পৃহ বা শীতল ভাব তার কাছে তুচ্ছ বিষয়। বখাটে যে, সে সবসময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে।
সুতপার জীবনেও তাই ঘটেছে। দুর্বার একদিন সুতপার কাছে জানতে চেয়েছিল তারা কবে বিয়ে করবে। সুতপা বলেছিল যোগ্যতার পরিচয় দিতে। এই ঘটনার পরদিন সুতপাকে একটি শাড়ি উপহার দেয় দুর্বার। বলে, ওই শাড়ি পরেই যেন সুতপা পহেলা বৈশাখের দিন টিএসসি আসে। সুতপা পহেলা বৈশাখে সেই শাড়ি পরেই টিএসসিতে যায়। কিন্তু ওইদিনই ঘটে জীবনের চরম দুর্ঘটনা। বখাটেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সংজ্ঞাহীন হয়ে যায়। তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় দুর্বার। সুতপা কিছুটা সুস্থ হলেই দোষীদের খুঁজে বের করতে বের হয় দুজনই। সুতপা একজনকে শনাক্ত করে। এরপরই হঠাৎ দুর্বার নিখোঁজ হয়ে যায়। দুর্বার কেন তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়, সেই কারণ খুঁজে পায় না সুতপা।
গল্পের শুরুতে যেখানে বসেছিল সুতপা, সেখানে একটি শিশুর কাছে সে পানীয় পানি চায়। শিশুটি দৌড়ে তাকে ঠাণ্ডা পানি এনে দেয়। তখন তার অতীতের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে দুর্বার তাকে ঠাণ্ডা পানি খেতে দিতো না। সে আনমনা হয়ে যায়। ঘামতে থাকে। সে হারিয়ে যায় অতীতে। দুর্বার কেন তার জীবন থেকে দূরে সরে গেলো, ভাবতে থাকে সুতপা। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে পানি এনে দেওয়া ছেলেটার ধাক্কায়—‘কেমন ঘামতেছেন, অস্থির হওয়া শ্বাস ফেলতেছেন, কী হইছে গো আফা? শইল খারাপ লাগতাছে?৬
এই সময় ছেলেটি একটি ডায়েরি হাতে নিয়ে সুতপাকে বাতাস করার চেষ্টা করে। সুতপা ছেলেটির কাছ থেকে ডায়েরিটা চেয়ে নেয়। সেই ডায়েরি পড়তে গিয়ে সুতপা চমকে ওঠে। হাতের লেখা দেখেই চিনতে পারে, এই ডায়েরি দুর্বারের। ডায়েরিতেই লেখা আছে, সুতপাকে যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের একজন দুর্বারের ছোট ভাই। দুর্বার নিজের ভাইকে জেলে ভরে নিজেও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। ‘সুতপার বুকটা জ্বলছে। ভেতরটা মুহূর্তেই কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ডায়েরিটা বুকে চেপে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে ওর।’৭ এরপর সুতপা সংকল্প করে যেমন করেই হোক দুর্বারের ঠিকানা তাকে সংগ্রহ করতেই হবে।
এই ধারার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘খুনী’। গল্পটি উত্তমপুরুষে রচিত। এর প্রধান চরিত্র সিলিংফ্যান। কিন্তু সিলিংফ্যান যে প্রধান চরিত্র, সেই সংবাদ গল্পের শুরুতে কিংবা অর্ধেকের বেশি পথেও পাওয়া যাবে না। গল্পজুড়ে দুই পুরুষ বন্ধুর কথা আছে। একজন গৃহকর্তা, অন্যজন তার বন্ধু। গৃহকর্তাকে কথক প্রথমে ঘরের মানুষ, পরে শান্তা-কান্তার বাবা হিসেবে পরিচয় করে দেয়। এছাড়া গৃহকর্তার বন্ধুটির কোনো নাম দেয় না। তবে, গৃহকর্তার বন্ধুটিকে কথকের শুরুতে পছন্দ হয়েছিল সেটি বলে রাখে। পুরুষকে পছন্দ করা এবং গৃহকর্তাকে প্রথমে ঘরের মানুষ, পরে শান্তা-কান্তার বাবা বলার মধ্যে কথক চরিত্রের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। এখানে পাঠক প্রথমে কথককে গৃহকর্তার স্ত্রী ভেবে বসতে পারেন। যতক্ষণ না বাইরে থেকে আনা নারীকে দুই বন্ধু বিছানায় নিয়ে ব্যবহার শেষে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার সময় গালি দেয়। ফ্যানের তিনটি ব্লেড প্রথমে ছুটে এসে একবন্ধুকে হত্যা করে। এরপর বিয়ারিং-কয়েলসহ হ্যাঙ্গার পড়ে আরেক বন্ধুর মাথা থেতলে মগজ বের করে আনে। হত্যাকাণ্ডের পর ফ্যান স্বস্তি পায়, নিজেকে প্রবোধ দেয়, ধর্ষকদের হাত থেকে নারী-তরুণীদের বাঁচাতে সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ফ্যানটি স্বপ্ন দেখে, এখন তার নবজন্ম হবে। আবার তাকে মেরামত করে নতুন রূপ দেবে হয়তো কোনো কারিগর। আবারও যদি এমন ধর্ষকদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে, তাহলে সে কী করবে?
এখন আমার নবজন্মের পালা। আগুনে গলে আমি নতুন রূপে ফিরে আসবো। আসবোই। আর ফিরে এসে যদি এমন কোনো ঘটনার মধ্যে আবারও পড়ি, তবে?
তবে আর কী? গল্প টু বি কন্টিনিউড…৮
একই ধরনের ঘটনার জন্ম সেও দেবে—এমন ইঙ্গিত দিয়েই গল্পের সমাপ্তি টানা হয়েছে। এখানে লেখক দেখিয়েছেন—অপরাধের জন্ম যেখানে, সেখানেই যুগে যুগে জড়বস্তুও সপ্রাণ হয়ে পরশুরামের কুঠারের মতো আসে। পরশুরাম যেমন তার কুঠারের আঘাতে পৃথিবীকে বারবার নিঃক্ষত্রিয় করে গেছেন, তেমনি যেখানে অন্যায়-যেখানে অবিচার যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকে না, সেখানে জড়বস্তুও তার ভেতরে প্রাণের অস্তিত্বকেও জাগিয়ে তোলে। আর তখনই নেয় প্রতিশোধ।
গল্পটি তিনটিতেই নারীজীবনের কষ্ট, লাঞ্ছনা, প্রবঞ্চনার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। গল্পে দেখানো হয়েছে পুরুষতন্ত্র সবসময় নারীকে ভোগ্যপণ্যই ভেবে এসেছে। আর সেভাবেই নারীকে ভোগ করে, ব্যবহার করে। ব্যবহার শেষে তার মূল্য নষ্ট হয়ে যাওয়া ‘রদ্দি মাল’ সিলিংফ্যানের মতোই বদলে ফেলে। কারণ কী? এর নেপথ্যে রয়েছে এই সমাজের অর্থনৈতিক শিক্ষা, নৈতিকশিক্ষার অভাব। বর্তমান সমাজ তথ্যপ্রযুক্তিগত দিক থেকে যতটা এগিয়েছে বলে সমাজপতিরা দাবি করছেন, ততটা নারীর মুক্তি ঘটেনি। বরং নারীকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে পায়ে শিকল পরিয়ে আধুনিক দাসিতে পরিণত করেছে ‘মহান পুরুষতন্ত্র’। পুরুষতন্ত্রের কুটিল যন্ত্রের পাকে পড়ে নারী হাত থাকতেও কারও হাত বাড়িয়ে হাত ধরতে পারে না, পা থাকতেও পা বাড়িয়ে পথ চলতে পারে না, মাথা থাকতেও মাথা খাটিয়ে স্বাধীন চিন্তা করতে পারে না। সে প্রতি মুহূর্তে ভাবে—এই বুঝি স্বাধীন চিন্তা করতে গেলে তাকে স্বৈরিণী অপবাদ দেবে সমাজ, পথ চলতে গেলে লোকে তাকে অসতী ভাববে, হাত বাড়ালে সেই হাতে কলঙ্কের খুন্তির ছ্যাঁকা দেবে সাধের ‘পুরুষ সমাজ’। তার ভয় অনেকটা গরু-মহিষের অভ্যাসের মতো। অর্থাৎ গরু বা মহিষের বাছুরকে যে সরু দড়িতে বেঁধে রাখা হয়, সে দড়িতে পরিণত বয়সেও বাঁধে গৃহস্থ। বাছুর শিশুকালে ওই সরু দড়ি ছিঁড়ে পালানোর বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তাই পরিণত বয়সে পূর্ণশক্তি দেহে থাকার পরও দীর্ঘদিনের অভ্যাসের বশে সরু দড়ি ছিঁড়ে বন্ধনমুক্ত হওয়ার সাহস তার হয় না। আমাদের সমাজের নারীরাও তেমন। তারাও শৈশবে মা-নানি-দাদির কাছে সবক পায়—স্বামীই স্বর্গ, পতিই সতী নারীর গতি’। তার আর সেই মন্ত্রের বাইরে যাওয়ার সাহস পায় না। যেমনটি দেখা গেছে—‘সাদা বাস কালো গাড়ি’ গল্পের সবিতার ভেতর। সেখানে তার ভাবনা এমন, ‘সিঁথিতে সাইনবোর্ড একটু ঝুললে তবু কিছুটা বাঁচোয়া।’ এই চিন্তা থেকেই মূলত নারী আত্মনির্ভরশীলতার পরিবর্তে পুরুষকে তার কর্তা ভাবতেই পছন্দ করে। আর পুরুষতন্ত্রও সেই সুযোগে তাকে দাসিতে পরিণত করে।
একই চিত্র ‘খুনী’ গল্পের নাম না জানা নারীদের ক্ষেত্রেও। তারাও অসহায়ভাবে নিজেদের সমর্পণ করে গেছে কান্তা-শান্তার বাবা আর তার বন্ধুর ‘লালসা’র কাছে। অভিন্ন দৃশ্য মেলে ‘ডায়েরি’ গল্পেও। সুতপাকে পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় একা পেয়ে পুরুষতন্ত্রের বখাটেরা লাঞ্ছিত করে, ধর্ষণ করে। অর্থাৎ নারীকে সর্বত্রই ভোগ্যপণ্যই ভাবা হচ্ছে। ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’ ও ‘ডায়েরি’ গল্প দুটি নারীপ্রধান, আবার ‘খুনি’ গল্পও। কিন্তু প্রথমোক্ত গল্প দুটিতে নারীদের অসহায়ত্ব ও মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা যেভাবে দেখানো হয়েছে, ‘খুনী’তে সেভাবে দেখানো হয়নি। এখানেও নারীদের সমর্পিত বরং বলা চলে এই গল্পে নারীদের বেশি করে জিম্মি ও সমর্পিত দশায় দেখানো হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রমটা অন্যজায়গায়। ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’র নায়িকা নিতান্তই সময়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে, ‘ডায়েরি’ গল্পের নায়িকার আসামিকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে প্রেমিকই। সেখানে নারীর ভূমিকা কেবল একজন ফরিয়াদির। আবার খুনিতে নারীকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভোগ্য হয়ে উঠলেও প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখা যায় না। অথচ নারীর পক্ষ নিয়েই চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিতে দেখা যায় সিলিংফ্যানকে। এখানে কথাশিল্পী প্রতিবাদের অভিনব কৌশলটি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের ভেতর নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে তা চারিয়ে দেন বৃহত্তর পাঠকসমাজে। সমাজের এহেন চিত্র পরিবর্তনের স্বপ্ন শিল্পী মাত্রই দেখেন। কিন্তু সে পরিবর্তনের হাওয়া তার প্রবলবেগে বইয়ে দিতে পারেন না। তারা সমাজ পরিবর্তনের সূচকগুলোকে উসকে দেন, তাতে সমাজের সংবেদনশীল সদস্যরা অনুপ্রাণিত হয়। আর তখনই সমাজ পরিবর্তনের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে।
কথাশিল্পী যখন জীবনশিল্পী, তখন তার শিল্পের রসদ হয়ে অনিবার্যভাবেই আসে নারী-পুরুষ সম্পর্কের রূপভেদ ও মনস্তাত্ত্বিক দিক। যিনি শিল্পী, তিনি এই বিষয় দুটিকে উপেক্ষা করতে পারেন না। বরং এদুটি বিষয়ের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন যে-সব উপকরণ, সেগুলো দিয়েই মার্গলাভের চেষ্টা করেন। মানবমনের রহস্য, সামাজিক অসঙ্গতি, মানবমনে সেই অসঙ্গতির বিরূপ প্রভাব যেমন গল্পের উপকরণ হতে পারে, তেমনি প্রেম-ভালোবাসা-স্মৃতিরোমন্থন, অকারণে ফেলে আসা ঘটনায় নিমজ্জন, অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবও হতে পারে একটি নিটোল গল্পের অনুষঙ্গ। এই ধারার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হলো: ‘সহযাত্রী’, ‘পার্সেল’, ও ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’।
মায়াবৃক্ষ গ্রন্থের ‘সহযাত্রী’ গল্পটিতে রোমান্টিক ও মৃত্যুচেতনাবাহিত কাহিনি বিধৃত হয়েছে। এই গল্পে সমাজ-ব্যক্তির আচরণ ও কর্ম, পাপ ও পুণ্য, কার্যকারণ সম্পর্ক ও এর পরিণতি বর্ণিত হয়েছে। গল্পের চরিত্র মাত্র দুটি। গগন ও তার স্ত্রী লক্ষ্মী। গল্পের কালসীমা কয়েক মুহূর্ত মাত্র। লক্ষ্মীকে সাপের ছোবল থেকে বাঁচাতে ধাক্কা দেয় গগন। কিন্তু তাতে এমনভাবে পড়ে আঘাত পায় লক্ষ্মী, তার মৃত্যুঘটে। লক্ষ্মীর মৃত্যুতে দিশাহীন হয়ে পড়ে গগন। অনুশোচনা-অনুতাপে দগ্ধ হতে থাকে। আর তখনই জোছনা এসে ঘরে ঢুকে। সেই জোছনা সহ্য হয় না গগনের। সে পালাতে চায়। পালাতে পারে না। তীব্রভাবে প্রেসার বাড়ে। আর তখনই ভাবতে থাকে, তার এতদিনে সম্মান, তিলে তিলে গড়ে ওঠা সামাজিক মর্যাদা খোয়াতে বসেছে সে। রাত পোহালে লোকে তাকে খুনি ভাববে। এসব ভাবতে ভাবতে অবচেতন মনে তার মনে হয়, লক্ষ্মী এসে তাকে তেঁতুলের শরবত করে দিয়েছে। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। লক্ষ্মীর সঙ্গে মনোজগতে আলাপে-আলাপে একসময় গগনও প্রাণ ত্যাগ করে। দরোজায় দুটি লাশ হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
দুই প্রাণহীন শরীর হাত ধরে ঘরের দাওয়ায় হেলান দিয় আছে। মন ভাসানো জোসনা তার সবটুকু আলো দিয়ে জড়িয়ে আছে তাদের। হাসনাহেনা গাছটা তার সৌরভ বিলাচ্ছে। প্রকৃতির এই উৎসবের আয়োজন কার জন্যে কে বলবে? শুধু বেড়ালটা একটু দূরে গিয়ে করুণ সুরে কাঁদছে।৯
এই গল্পে একদিকে মানবপ্রেমের জয়গান গাওয়া হয়েছে, অন্যদিকে সমাজের অবক্ষয় ও অসঙ্গতিরও সমালোচনা করা হয়েছে।।
যথার্থ ছোটগল্প জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। সে প্রতিচ্ছবিতে কোনো মেকি রঙের প্রলেপ নেই। যা থাকে, তা জীবনের নানাবাঁকে জড়িয়ে থাকা অস্থিমজ্জারই অসংস্কৃত-অপরিমার্জিত-অক্ষত রূপ। সংস্কারের অভাবে জীবনের বহিরঙ্গে ও অন্দরমহলে এসব অনুষঙ্গ বাড়তি রঙের মতো মাঝে-মাঝে চমকে চমকে ওঠে বটে। তবে, তাতে জীবনের যে কঠিন রূপ, তার ওপর কোনো রেখাপাত করে না। তেমনই একটি গল্প ‘পার্সেল’। গল্পের প্রধান চরিত্র তহমিনা বানু। বয়সে প্রৌঢ়ত্ব এসে গেছে। গল্পের শুরুতে দেখা যায় তহমিনা বানুর বাসায় একটি পার্সেল আসে। যে পার্সেলের ওপর প্রাপকের নাম তনু লেখা। তহমিনা বানু পার্সেলটি ধরে দেখেননি। কাজের মেয়েকে বলেছেন, তার কেবিনেটে রেখে দিতে। এরপর চলে গেছেন অফিসে। অফিসে বসেই তার ভেতর অস্থিরতা শুরু হয় পার্সেলে লেখা নাম নিয়ে। তার নাম তহমিনা বানু হলেও ছাত্রজীবনে তার প্রেমিক নিখিল তাকে ডাকতো তনু নামে। এই পার্সেলে ‘তনু’ নামটি লেখা দেখে তহমিনা বানু স্মৃতির রেখা ধরে পেছনে চলে যান। মনে পড়ে অতীতের খণ্ডচিত্র। মনে পড়ে এতকাল পর নিখিল হয়তো ‘তনু’কে পার্সেল পাঠিয়েছে। এরপর ভাবেন দ্রুত বাসায় ফিরবেন। ফিরেও আসেন বাসায়। বাসায় ফিরে এঘর-ওঘর করে পার্সেলটি খোঁজেন। কিন্তু কোথাও পান না। শেষে সেজ মেয়ের কাছে জানতে চান, কাজের মেয়েকে দেওয়া পার্সেল কোথায়। সেজ মেয়ে মৃদু তিরস্কারের পাশাপাশি তার বয়স হওয়ার বিষয়টিও মনে করিয়ে দেয়। একইসঙ্গে এ-ও জানায়, তনু পাশের বাসার পুত্রবধূর নাম। পার্সেলটি তারই। তহমিনা বানুর নয়। ছোট একটি ভুল তহমিনা বানুর মনে প্রাক্তন প্রেমিক নিখিলকে আবার জাগিয়ে তুললো। এটি একটি নিটোল প্রেমের গল্প। যদি সেই প্রেমে মিলন নেই, বিরহই চিরস্থায়ী হয়ে আছে তহমিনা বানুর জীবনে। সেই ভুলে যাওয়া, ফেলে আসা মানুষকে ছোট্ট একটি ভুল আবারও সামনে নিয়ে এলো।
পূর্ব-পশ্চিম নয়, মূলত নামটা দেখেই তো পার্সেলটা নিয়েছিলেন তিনি—একথা মেয়েকে কী করে বলা যায়? স্থবির তাহমিনা বানু ভাবেন, একটা ভুল এত বছর পর নিখিলকে কেমন করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো। [. .. ] একটা পার্সেল তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো বয়স শরীরে দানা বেঁধেছে বটে, কিন্তু তাঁর অপেক্ষা আজও তনুতেই স্থির হয়ে আছে।১০
মানুষ তার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছু ভুলে যেতে পারে না। বিশেষত নর-নারীর জীবনের পারস্পরিক কিছু ঘটনা, কিছু স্মৃতি মানুষকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। নারী তার বিশেষ কোনো পুরুষকে, পুরুষ তার বিশেষ কোনো নারীকে আমৃত্যু মনের মন্দিরে লালন করে। সংসারের বহুমাত্রিক কাজের ভিড়ে আপাত মনে হয়, সে ভুলে গেছে, কিংবা ভুলে থাকার চেষ্টা করে। বাস্তবে সব স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ কিছু কিছু ঘটনা তাকে অতীতের কোনো কোনো মানুষ কিংবা কোনো ঘটনার কাছে ফিরিয়ে নিয়েই যায়। এটা অমোঘ নিয়তির মতোই। এখানেই মানুষ অসহায়, আবার আনন্দিতও। নারী-পুরুষ দৃশ্যত একসঙ্গে ঘর না করলেও মনের ঘরে ঠিকই তাদের বসবাস একই ছাদের নিচে। এই সত্যই এই গল্পের বিন্দুরেখা। এখানেই শিল্পী তার সমস্ত কৌশল নিয়ে হাজির হন ছোট্ট ক্যানভাবে বিশাল কোনো পটভূমি আঁকার জন্য, কিংবা বিশাল কোনো ক্যানভাসে আঁকতে চান ছোট্ট অথচ উজ্জ্বলতম কোনো বিন্দু। তাহমিনা বানুর ‘তনু’ নামকরণের স্মৃতিকে জাগিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নাহিদা আশরাফী সেই উজ্জ্বলতম বিন্দু এঁকেছেন। আর পাঠককে দিয়েছেন সেই উজ্জ্বলতম বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকার সীমাহীন বিস্ময়।
নারী-পুরুষ সম্পর্কের রূপভেদ ও মনস্তত্ত্বের ধারার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’। এই গল্পে নারীপুরুষের সম্পর্কের রূপভেদের চেয়ে মনস্তত্ত্বই প্রাধান্য পেয়েছে। গল্পের প্রধান চরিত্র হাওলাদার সাহেব। প্রচণ্ড হিসাবী-সংসারী ও চাকরিজীবী মানুষ। বিশ টাকার হিসাব মেলাতে না পেরে তার মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। সেই অস্থিরতা মনে রেখেই হাওলাদার ঘুমোতে যায়। রাতে এক অদ্ভুতদর্শন লোককে স্বপ্নে দেখে। লোকটি বিশ টাকার একটি নোট টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে এক গ্লাস পানিতে গুলে হাওলাদারকে দেয়। হাওলাদারও কিছু না ভেবেই গ্লাসটি হাতে নেয়। এরপরই আঁতকে ওঠে। গ্লাসভরা ঘন নীল রঙ, বিষ। লোকটি ঠা ঠা করে হাসছে আর বলছে, ‘বিশ না বিষ…বিশ না বিষ…বিশ না বিষ…খা…খা…খা।’১১ একদিনে টাকার হিসাব মেলাতে না পারা, অন্যদিকে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা—দুইয়ে মিলে হাওলাদারের মনের অবস্থা ত্রিশঙ্কু। এরই মধ্যে রাত পার হয়ে দিন আসে। তারও অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে আসে। পথিমধ্যেই আগের দিনের সবজিঅলাকে দেখে, যার কাছ থেকে খুচরো বিশ টাকা ফেরত নেওয়া হয়েছিল কি না, হাওলাদার মনে করতে পারে না। তাকে দেখেই রাস্তা পার হতে যায়, আর অমনি মনে হয়, সবজিঅলার চেহারার সঙ্গে রাতে স্বপ্নে দেখা অদ্ভুতদর্শন লোকটির মিল। আর তখনই উল্টোদিকে ফিরে আসতে গিয়ে টেম্পুর নিচে পড়ে পা ভাঙে তার। ফল—হাসপাতালে ভর্তি। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে হাসপাতালের নার্স পর্যন্ত তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। সবার তিরস্কারের বিষয় একটাই—বিশ টাকার জন্য ঝুঁকি নিয়ে পঙ্গু হতে হলো। কিন্তু হাওলাদার জানে, বিশ টাকার জন্য সে ঝুঁকি নেয়নি, তার দুর্ঘটনার জন্য দায়ী রাতের অদ্ভুদদর্শন লোকটি।
শুধু হাওলাদার সাহেব জানেন টাকার জন্যে নয়। স্বাচ্ছন্দ্যেই রাস্তা পার হতে পারতেন তিনি। কিন্তু অর্ধেক পথ যাওয়ার পর সবজিওয়ালা তার দিকে তাকাতেই থমকে গেলেন। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয় আর আতঙ্কের তীব্র স্রোত নেমে গেলো। তিনি সবজিওয়ালার কাছে না গিয়ে উল্টো ফেরত আসতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাউকেই বলতে পারেননি ভয়, অস্বস্তি আর আতঙ্কের কথা। বললেও কি কেউ বুঝতে বা মানতে চাইতো? কাকে বোঝাবেন তিনি সবজিওয়ালা দেখতে হুবহু কাল রাতের স্বপ্নে দেখা অদ্ভুতদর্শন লোকটির মতো।১২
এখানে এসেই পরিষ্কার হয়—সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটির কল্পনা-পরিকল্পনা ও তার কর্মফল সমাজ বুঝতে পারে না। এমনকি তারই সংসারের উপকারভোগীরাও বোঝে না। বরং সম্মিলিতভাবে সমাজ সংসারের ভারবহনকারী ব্যক্তিটিকে ভুল বোঝে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে উপার্জনকারী ব্যক্তি যদি নারী হয়, তাহলে তার পুরুষটি তাকে যথাযথভাবে বুঝতে চায় না। আবার উপার্জনকারী ব্যক্তি যদি পুরুষ হয়, তাহলে তার সঙ্গী নারীটিও তাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারে না। চায়ও না। জগৎসংসার মূলত শ্রমের। সেই শ্রম কায়িক হতে পারে, আবার বুদ্ধিবৃত্তিকও। সমাজ কায়িক শ্রমের মূল্য হয়তো দৃশ্যত মিটিয়ে দেয়, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের মূল্য তাৎক্ষণিক তো বুঝিয়ে দেয় না, পরন্তু বহুকাল পরও দেয় না। বরং শ্রমিককে নানাভাবে তিরস্কার করে। স্বার্থের প্যাচে পড়ে আপনজনও শ্রমজীবী মানুষটির অন্তরের কথা বুঝতে পারে না। কখনো কখনো বুঝতে চায় না। ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’ গল্পে হাওলাদের ক্ষতস্থানের ওপর মাছি বসলে যে সেখানে চুলকানি অনুভূত হয়, সেই অনুভূতির কোনো মূল্য নার্সের কাছে নেই। পরন্তু নার্সের কাছে সেই অভিযোগ অবিশ্বাস্য। তেমনি বিশ টাকার হিসাব মেলাতে না পারার জন্য হাওলাদার সাহেবের মনে সে উদ্বেগ, সে উৎকণ্ঠার মূল্য তার স্ত্রী কিংবা সন্তানদের কাছে নেই। তার অনুভূতি-হিসাবীপনা উভয় স্বভাবই নার্স ও স্ত্রী-সন্তানদের কাছে হাস্যকর। উপহাসের।
গল্পকার নাহিদা আশরাফী উপস্থিতকালের ছবি এঁকেছেন উপস্থিতকালকে চিত্রায়িত করেছেন। আবার বর্তমান যুগের চিত্রকে ভবিষ্যতের মানবজাতির জন্য উন্মুক্তও করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি যুগসন্ধির কাজটি করেছেন সন্তর্পণে। কারণ তিনি জানেন,
যে-কোনো যুগসন্ধির প্রতিক্রিয়া ঘটে দুদিকে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের ভিতর। তাই সংশয় ও বেদনার যুগের ফসল ছোটগল্প একাধারে ব্যক্তিমূলক ও সমাজমূলক। এই ব্যক্তিমূলক গল্পগুলির মর্মোদ্ধারই সব চাইতে কঠিন কাজ। এই সব গল্পের মধ্যে কখনো আত্মতান্ত্রিক বিষণ্নতা, কখনো অবচেতনার ছায়া সঞ্চরণ। পাঠককে অনেকখানি গভীরে প্রবেশ করেই ব্যক্তি-প্রধান গল্পের গুহানিহিত তাৎপর্য এবং সামাজিক অবস্থার সঙ্গে স্পষ্ট সংযোগটিকে নির্ণয় করতে হবে।১৩
নাহিদা আশরাফী জীবন ও শিল্পের যৌথ ক্যানভাস তৈরির মাধ্যম করে তুলেছেন গল্পকে। ছোট, অতিতুচ্ছ বিষয়কেও তিনি গল্পে রূপ দিতে পারেন। এর প্রমাণ ‘খুনী’ ও ‘পার্সেল’ গল্প দুটি। আবার জীবনের মহৎ ও বৃহত্তর দিককেও গল্পের অনুষঙ্গ করে তুলতে পারেন। এর প্রমাণ ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’ ও ‘হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা’। নাহিদা আশরাফী দেখিয়েছেন, জগৎ-সংসার মূলত নারী-পুরুষের বৈষম্যের কারণেই অশান্তিতে ভরে ওঠেনি, বিশ্ব বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিত্তহীনের দুর্ভাগ্যের পাল্লা দিনদিন ভারী হওয়ার মধ্য দিয়ে। জগৎ পুঁজির দাস। বাকিরা পুঁজির দাসত্ব করে চলেছে। পুঁজি যার, ইচ্ছা তার। আর পুরুষতন্ত্র ও পুঁজি যখন একই সূত্রে গাঁথা, তখন যে নারী পুঁজিহীন, দরিদ্র, তাকে পুঁজির মালিক পুরুষতন্ত্রের ভোগ্যপণ্যে পর্যবসিত হতেই হবে। এর ব্যত্যয় আপাতত নেই।
জীবনকে নাহিদা আশরাফী ছেঁকে দেখেছেন সূক্ষ্ম চালুনি দিয়ে, আর সেখান থেকে বের করে এনেছেন অতিসূক্ষ্ম রসদ। ফলে তার গল্প একদিকে হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য, অন্যদিকে হয়ে হয়ে উঠেছে মানবচিন্তার সূক্ষ্ণকণাকে উসকে দেওয়ার রসদও। এখানেই নাহিদা আশরাফীর গল্প সমকালের প্রতিচ্ছবি হয়েও হয়ে উঠেছে উত্তরকালের দিকে তাক করা বিস্ময়কর ধারালো-উজ্জ্বল তীরের ফলা!
তথ্যসূত্র
১. নাহিদা আশরাফী, জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা, জলধি, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ৯
২. তদেব, পৃ.১১
৩. তদেব, পৃ.১১
৪. তদেব, পৃ.১৫
৫. তদেব, পৃ.১০৩
৬. তদেব, পৃ.১০৮
৭. তদেব, পৃ. ১১০
৮. নাহিদা আশরাফী, ঝুলবারান্দা তিনটি মাছ আর একটি বিন্দুবর্তী জলাশয়, বিদ্যাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০২২, পৃ. ২৮
৯. নাহিদা আশরাফী, মায়াবৃক্ষ, একাত্তর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ৪৬
১০. নাহিদা আশরাফী, জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা, জলধি, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ৩৩
১১. তদেব, পৃ. ৯৬
১২. তদেব, পৃ. ৯৭
১৩. নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যে ছোটগল্প, ডিএম লাইব্রেরি, কলকাতা, পৃ: ৩০৫