একজন কথাশিল্পীর মৌল দায়—যাপিতজীবনের শৈল্পিক রূপান্তর। শৈল্পিক রূপান্তরের পূর্বশর্ত মানবাচরণ পর্যবেক্ষণ। জীবনের প্রতি নিরাসক্তি নিয়ে শিল্পচর্চা চলে না। ছোটগল্পের লেখককে হতে হয় জীবনপ্রেমী। আন্তন চেখভ, তলস্তয়, মোপাসাঁ কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পপাঠে মানবজীবনেরই চিত্র দেখা যায়। নাজিব ওয়াদুদের ছোটগল্প মানবাচরণকে ধারণ করে লিখিত—গল্পে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিকও চিত্রিত। সামাজিক চিত্র যেমন গল্পে স্থান পেয়েছে, তেমনি ব্যক্তির মনোবিকলনও উঠে এসেছে। তার উল্লেখযোগ্য গল্পের বই—‘কাক ও কারফিউ’ (১৯৯৮), ‘নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ (২০০৮), ‘কমরেড ও কিরিচ’ (২০১০) এবং ‘পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’ (২০১১)।
প্রথম বই ‘কাক ও কারফিউ’। গল্পসংখ্যা আট। প্রথম গল্প ‘কাক’। গল্প শুরু হয়েছে, শ্রমজীবী যুবকের নৈতিক স্খলন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র দিয়ে। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বুড়ি। স্বগ্রাম থেকে নির্বাসিত বুড়ি, বাস থেকে নামার সময় তার কণ্ঠ শুনে কন্ডাক্টর ভাবে কোনো তরুণী। কিন্তু তার মুখাবয়ব দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বুড়ি ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখে শহরে রিলিফ দিচ্ছেন দেশের কোনো এক নেতা। ত্রাণপ্রার্থীদের ভিড়ে সেও দাঁড়াতে চায় কিন্তু আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বুড়িকে স্থান দেয় না। একসময় ঢাকা থেকে নেতা এসে পৌঁছান হেলিকপ্টারে। সেদিকে ছোটে অনেকে। বিশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে পুলিশ ত্রাণপ্রার্থীদের লাঠিপেটা শুরু করে। লোক কমতে শুরু করলে বুড়ি লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। কিন্তু রিলিফের খিঁচুড়ি নিতে গিয়ে বুড়ি দেখে সেই জফিরকে। যে জফিরদের আগ্রাসনে তাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। যে জফির একদিন সুযোগ পেয়ে ভালোবাসার কথা বলে তার সম্ভ্রম কেড়ে নিতে চেয়েছিল, সে জফিরই আজ অনেক বড় নেতা। যে জফির বুড়িদের সর্বস্বান্ত করে, সে জফিরই এখন খিঁচুড়ি বিলিয়ে বুড়ির কাছে দোয়া চায়। বিষয়টা বিস্ময়ের, তারও চেয়ে বেদনার। বেদনা কিছুটা বুড়ির, অপমান জফিরের। এ গল্প যেমন রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের চিত্র, তেমনি সামাজিক ব্যাধিরও।
‘অন্ধগলি’ সামাজিক মূল্যবোধ্যের অবক্ষয় এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মফস্বলের চিত্র। যেখানে নিম্নবর্গ অর্ধাহারে বেঘোরে প্রাণ হারায় আর উচ্চবর্গ থাকে ভোগবিলাসে মত্ত। মধ্যবিত্ত বখাটে যুবক ছোটে অন্ধগলিতে। সেখানে ধর্ষণ, খুনই নিত্য অনিবার্য। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কথক। ভালোবাসে মুক্তিকে। মুক্তিদের জন্য খাবারের সন্ধানে বের হয় কথক। খাবার নিয়ে ফেরার পথে অন্ধকার গলিতে শোনে ফিসফিস শব্দ। সেখানে চলে নিষিদ্ধ দরকষাকষি। একসময় মুক্তিদের ঘরে পৌঁছায় কথক। কিন্তু যার জন্য খাবার সংগ্রহ, তার সারা শরীরে ক্ষত, ফাঁস গলায় দিয়ে ঝুলতে থাকে সে। এ গল্পে মানুষের অদম্য প্রেম, রিরংসা আর অসহায়ত্ব একই সূত্রে গাঁথা। মানুষের প্রত্যাশা ও সামথ্যের যুগ্মচিত্র এ গল্প। সেখানে নিয়তির শাসনকেও করে তোলা হয়েছে অনিবার্য। স্রষ্টা হিসেবে নাজিব ওয়াদুদ এখানে তীব্র মানবিক গুণসম্পন্ন।
‘কাক’ গল্পের সমান্তরাল অন্য গল্প ‘কারফিউ’। গ্রাম থেকে শহরে জীবিকার সন্ধানে আসে সখিনা। শহরে থাকে তার খালা গৃহপরিচারিকা রফিজা। তার সঙ্গেই দেখা করতে আসে সখিনা। কিন্তু যে খালার সন্ধানে সে আসে শহরে, সে খালা শহুরে লম্পটের লাম্পট্যের শিকার হয়ে কর্ম হারিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। তাকে খুঁজে না পেয়ে মামা সেরাজকে খুঁজতে যায় সিনেমা হলে। কিন্তু সে সেরাজও জেলে। বিস্ময়ের বিষয়, সখিনা শহরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই টের পায় সেখানে কারফিউ চলছে। গ্রাম থেকে ছুটে আসা সখিনা কারফিউ কী, তা বোঝার আগেই রাতের অন্ধকারে ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর পুলিশের গুলিতে বন্ধ হয়ে যায় তার হৃদস্পন্ধন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও লাম্পট্যের শিকার এক গ্রাম্য তরুণীর বেঘোরে প্রাণ হারানোর ভেতর দিয়ে একটি সমাজের অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার। যেখানে সবাই নিজের স্বার্থে বিভোর থাকে, অন্যকে সঠিক পথ দেখানোর চিন্তা করারও সামর্থ্য দেখায় না। কারফিউ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাবদল এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার মোক্ষম উপায়। সেখানে সাধারণের ভোগান্তি ছাড়া অন্য কিছু নেই। তাই রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ঘোষিত কারফিউতে বেঘোরে প্রাণ যায় নিম্নবর্গের, উচ্চবিত্ত সেখানে নিরাপদ আশ্রয়ে লালিত।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ‘মেঘভাঙা রোদ’। গল্পের বিষয়বস্তু দেশকালের সীমায় হৃদয়গ্রাহী ও মননগ্রাহ্যও।
দ্বিতীয় বই ‘নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ’। এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্প ‘আবাদ’। একজন নারী ও ফসলি ক্ষেতের জন্মদানের যোগ্যতাকে অভিন্ন সমতলে বিবেচনা করার এক অব্যর্থ শিল্পরুচির পরিচয় এ গল্প। এ গল্পের মূল চরিত্র জগলু নিম্নবর্গের মানুষ। রূপাকে ভালোবাসে; বলা হয় না। বলার আগেই সমকালীন নকশাল আন্দোলন দমনের শিকার হয়ে জগলু জেলে চলে যায়। তত দিনে রূপা বিবাহিতা। বন্ধ্যা হওয়ার অপরাধে সংসার ভাঙে। জগলু জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসে গ্রামে। আবার দেখা হয় রূপার সঙ্গে। রূপা বন্ধ্যা—এ কথা জগলু মানতে পারে না। রুক্ষ জমিতে পরিচর্যার জোরে যে জগলু ফসল ফলাতে পারে, সে জগলু রূপাকে বন্ধ্যা বলে স্বীকার করতে চায় না। তাই জগলুর বিয়ের প্রস্তাবে যখন রূপা তার বাবাকে বলে, ‘অখে ঠগাবে ক্যানে? আমি বাঞ্জা তুমি জানো না? আমি বাঞ্জা গো মাঝির ব্যাটা’, তখন জগলু ক্রোধে ফেটে পড়ে, ‘কুন শালা বুলে এই কথা?’ সফল চাষার কাছে বন্ধ্যা জমির অস্তিত্ব যেমন অকল্পনীয়, তেমনি বন্ধ্যা নারীরও।
একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে যারা চিরকাল নিজের সুবিধা আদায় করে এসেছে তাদের প্রতি এ গল্প সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবাদ। এ গল্পের চরিত্রগুলো যেমন বিশ্বস্ততা অর্জনে সমর্থ হয়েছে, তেমনি কাহিনীও স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করেছে। পরিস্থিতির চাপে পড়ে দমে না গিয়ে জীবনকে জয় করার যে প্রত্যয় গড়ে ওঠে একজন সাধারণ কৃষক যুবক জগলুর মধ্যে, তার মাটিলগ্ন ক্রমবিকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ফলে গল্পটি নিছক কাহিনি হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে কয়েকজন মানুষের যাপিত জীবনের শৈল্পিক ক্যানভাসও।
‘জীয়নকাঠি’ও অনেকটা ভাবালুতাসর্বস্ব হয়ে উঠলেও শেষপর্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠতার সঙ্গে স্বাপ্নিক আচরণেরও স্বাক্ষর। ‘কসাই’য়ের ভেতর দেখি মেয়ের বিয়ের জন্য গৃহপালিত গরু বিক্রি করতে গিয়ে সন্তানের রক্তাক্ত লাশের ছবি ভেসে ওঠে হারেজের মানসপটে। তার ছেলে শাহজাহান রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। এ গল্পে সন্তান আর পালিত পশুকে অভিন্ন কল্পনায় রাঙিয়ে তুলেছেন লেখক। এ গল্পের রাজনৈতিক চেতনাটুকু বাদ দিয়ে সর্বপ্রাণবাদের প্রশ্নের শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের সূক্ষ্ণ মিল রয়েছে।
‘খনন’ গল্পের বিষয় মানবচরিত্রের স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ এগিয়ে যায়। কিন্তু অপরিণামদর্শীরা মানুষের উপকারে আসে না। মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানবতার লাঞ্ছনাই এ গল্পের উপজীব্য।
শিল্পের মূল দায় হয়তো মানবসমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে রূপান্তরের কাঙ্ক্ষা পোষণ করা। সে ক্ষেত্রে শিল্পীর সাফল্য নির্ভর করে শিল্পের ক্ষেত্র ও পর্যবেক্ষণশক্তির ওপর। শিল্পী নিজের সমাজব্যবস্থার একজন মনোযোগী পর্যবেক্ষকও। না হলে সমাজব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো শনাক্ত করে তা পরিবর্তনের কাঙ্ক্ষায় তুলির আঁচড় বসানো তার পক্ষে ষোল আনা সম্ভব কোনোকালেও হয় না। বিশেষত, ছোটগল্পের কথককে যখন স্ব-স্ব সমাজের প্রতিচ্ছবি আঁকার দায়িত্ব নিতে হয়, তখন দায়-দায়িত্ব নির্বাচন ও নির্ধারণেও আপন ইচ্ছাশক্তিই তাঁর মৌল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। কোনো বহিঃপ্রেরণা সেখানে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে না। একটি সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে শিল্পীর ভূমিকা দৃশ্যত নগণ্য। পরোক্ষে শিল্পী কী পরিমাণ সমাজ পরিবর্তনে সফল, তার শুমারি কেউ কোনো কালেও করে দেখায়নি বলে, সমাজ পরিবর্তনের রূপকারদের নামের সঙ্গে সমাজচিন্তক হিসেবে শিল্পীর নাম কখনো সাধারণত উল্লেখ করা হয় না। তবু শিল্পী আপন মনে সমাজ পরিবর্তনে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী সাধনা চালিয়ে যান। বিশেষত, কথাসাহিত্যের রূপকারগণ এ পথে অগ্রগণ্য।
‘কমরেড ও কিরিচ’ বইয়ে মোট গল্প পাঁচটি। গল্পগুলো অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ আঙ্গিকের। প্রথম গল্প ‘দখল’। এ গল্পের বিষয়বস্তু একটি গ্রামীণ সমাজের মেয়ে লুৎফার দস্যিপনাকে কেন্দ্র করে একই গ্রামের দুই যুবক আক্কাস ও মাহবুবের বিয়ের আকাঙ্ক্ষা। দুই যুবকের একজন সাহসী। অন্যজন ভদ্র কিন্তু লাজুক। লুৎফা যেমন অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী মাহবুবকে পছন্দ করতে পারে না, তেমনি লাজুক আক্কাসকে নিয়েও সে ভরসা পায় না। তাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। কে হবে লুৎফার স্বামী?
এ নিয়ে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটাতে দুই যুবকের মধ্যে শক্তিপরীক্ষার লড়াইয়ের আয়োজন হয়। কাজটি লেখক কৌশলেই করেছেন। সে শক্তিপরীক্ষার লড়াইয়ে লুৎফা কেবল দুই যুবকের নৈপুণ্যেরই প্রশংসাই করে, কারও পক্ষাবলম্বন করে না। মানবজীবনের এ এক বিস্ময়কর অনুভূতি। এক নারী দুই পুরুষের দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কারণে দুজনকেই পছন্দ করে, কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে কোনো একজনকে বেছে নিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত লুৎফা ভাবে, যে জিতবে তাকেই সে গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে লুৎফা হিসেবি, স্বার্থপর ও বুদ্ধিমতী; দূরদর্শীও। সে বিজয়ীর গলায় বরণমালা দেবে। কোনো মানবিক গুণ এখানে প্রাধান্য পায় না। দুই যুবকের লড়াই অনেকটা পাশবিক হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত লুৎফা যে আক্কাসের ভেতর কেবল সাহসের অভাব লক্ষ করেছিল, সেই আক্কাসই তাকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিলের মতো ছোঁ মেরে কোলে তুলে নেয়। নাজিব ওয়াদুদ স্রষ্টা হিসেবে নিজের নির্দিষ্ট চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতকে লুকিয়ে রাখতে শেষ পর্যন্ত সমর্থ হননি। লেখক নিজে প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও পাঠক টের পেয়ে যাচ্ছেন, লেখকের পক্ষপাত অনেকটাই আক্কাসের দিকে।
এখানে এসে একটি প্রশ্ন জাগে মনে—নারীমন জয় করার মানে কী করে হয় দখল? তার মানে কি মনের ওপরও জবরদস্তি চলে? নারীমন জয় কি আসলে ভূমি দখলের মতো কোনো ঘটনা? নারী কাউকে ভালোবাসবে না, কিংবা কারও প্রতি পক্ষপাত দেখাবে না। একান্ত স্বার্থপর ও নির্দয় আচরণের ভেতর দিয়ে নারী নিজেকে অর্জনযোগ্য সম্পদের মতো আরাধ্য করে তুলবে? হয়তো গল্পকার এই গল্পের মধ্য দিয়ে একটি দর্শন প্রতিষ্ঠার আকাঙাক্ষা করে থাকবে ন। সেটা হলো—কাঙ্ক্ষিতকে কেবল কাঙ্ক্ষা করলেই চলে না, তাকে অর্জন করতে হয়, ‘দখল’ করতে হয়। যেমনটি নিজের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আক্কাস করেছে। অন্যদিকে লুৎফার মধ্যকার দ্বান্দ্বিকতা তার নিজেরই সঙ্গে। সেটা-ই বাঙালি নারীর চিরায়ত সংকট। যদিও লুৎফা শেষপর্যন্ত আক্কাসের মধ্যেই তার কাঙ্ক্ষার পুরুষটির সন্ধান পায়।
‘কমরেড ও কিরিচ’ গল্পে একজন রাজনৈতিক কর্মীর মুখ ও মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাশবিক সত্তাকে উন্মোচন করা হয়েছে। কমরেড শাকু সম্পর্কে জাফরের মূল্যায়ন বেশ চমকপ্রদ। জাফরের মনে হয় ‘শ্যামলা মাঝারী মাপের মানুষ কমরেড শাকু। যৌবন যায়-যায়, তবু বেশ শক্তপোক্ত শরীর, মুখে লাবণ্যের ছটা। গোলগাল মুখ, নাকটাও তেমনি। চোখ দুটো বেশ বড় বড়, উদাস মায়া মাখানো। ইঁদুরের মতো চকচকে সরু সরু দাঁত বের করে হাসলেন তিনি। একটুখানি টোল পড়ল গালে।’ এ বর্ণনা কেবল জাফরের নয়, স্বয়ং লেখকেরও। সমমর্যাদার মানুষের হুকুমে বিব্রত হয় মানব মন। তাই কমরেড শাকু যখন জাফরকে রাতের বেলা তার কাছে আসা-যাওয়া নিয়ে বলে, ‘এভাবে রাতে আর আসবে না’ তখন কমরেডের সে কথা জাফরের ভালো লাগে না। তার কাছে হুকুমের মতো মনে হয়। কমরেড শাকুকে জাফর যেমন ভালো মানুষ মনে করে না, তেমনি রাজ্জাকও। তাই ফেরার পথে হঠাৎ রাজ্জাক জাফরকে বলে ফেলে, ‘ডাক্তার ভাই, আপনে ভালো মানুষ। কিন্তুক কমরেড লোকটা মুনে হয় সুবিধার না।’ জাফরও কি মনে মনে কমরেড শাকুকে খারাপ জানত? না হলে সে চমকে উঠবে কেন রাজ্জাকের কথায়? তবে কি উপলব্ধি ও বোধের সাদৃশ্যের কারণে? কিন্তু গল্পের শেষের ক’লাইনকে অনেকটা পুনশ্চর মতো মনে হয়, যখন গল্পকার পাঠককে সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে কমরেড শাকুর হত্যাকারী সন্দেহে মেম্বারের গ্রেপ্তার-সংবাদ চাউর করে দেয়। গল্পকার কি পাঠকের বোধশক্তির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না? পাঠককে শ্রেণীকক্ষের অমনোযোগী ছাত্র মনে করেন? তাই গল্পের শেষে পরিণতির বিশদ ব্যাখ্যাও তিনি দিতে চান?
‘নোনা প্রেম’ মূলত সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে অসম প্রেমের গল্প, যেখানে ধনী পরিবারের মেয়ে সেরেনা নিতান্তই খেয়ালের বশে ভালোবেসে ফেলে দিনমজুর বাদশাকে। কিন্তু বিয়ের পর বাদশা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তার প্রতি একদিকে যেমন করুণা, অন্য দিকে তেমন নিজের পরিবারের মর্যাদাবোধ ও বিড়ম্বিত ভাগ্যের কথা ভেবে সেরেনার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। মূলত বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটিভরা প্রেমের কাহিনি ‘নোনা প্রেম’। নোনা প্রেমের প্রতি সাধারণ মানুষের আজন্ম পক্ষপাত। সাধারণ মানুষ নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে গড়ে তোলে বলে, প্রতিটি কর্মকাণ্ডে প্রেমের ছোঁয়া পেতে চায়। কিন্তু সে প্রেমের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্র্য। সে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর আচরণে মানব-মানবীর সুখ-স্বপ্নের ঘরে মাঝেমধ্যে অমানিশাও নেমে আসে।
‘কান্না-হাসির উপাখ্যান’ গল্পেও পারিবারিক জীবনের নানা ছোট ছোট ঘটনা ও আত্মীয়স্বজনের আবেগ-উৎকণ্ঠার চিত্র বর্ণিত হয়েছে। এ গল্পে দুটি পরিবারের সম্পর্ক ও সে সম্পর্কের যে গভীর বন্ধন সে বন্ধনকে বহুকৌণিক দিক থেকে আলোকসম্পাত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার সযত্ন চেষ্টা আছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, গ্রামীণ জীবনে সাধারণ পরিবারের মানুষের হাসি-কান্না, বয়োজ্যেষ্ঠের অনুশাসন বয়োকনিষ্ঠের মাথা পেতে নেয়ার ভেতর যে সামাজিক মূল্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায় তা এ গল্প পাঠে বোঝা যায়। এ গল্প কেবল দুটি পরিবারের যাপিতজীবনের প্রতিচ্ছবি বললে ঠিক বলা হয় না; সে সঙ্গে আবহমান বাংলার একটি চিরায়ত ও মাঙ্গলিক দিকের চিত্রও এ গল্প।
‘ভালো এবং মন্দ’ গল্পে সমাজের উঁচুতলার মানুষের বিকৃত রুচিবোধের সঙ্গে নিম্নবর্গের মানুষের খাপ খাওয়াতে না পারার ঘটনাই বর্ণিত।
আখ্যান বর্ণনায় অনেকের ভেতর যে জাড্য লক্ষ করা যায়, সেটি নাজিব ওয়াদুদের মধ্যে নেই। পটভূমি অনেক সময় অলঙ্কারপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘নোনা প্রেম’ গল্পের শুরুটা সেই অলঙ্কারের সহযোগেই। যখন তিনি এভাবে শুরু করেন, ‘বোশেখের আকাশে জ্বলতে জ্বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাতে-তৈরি মাসকলাই-এর রুটির মত বড়ো-সড়ো গোল সূর্যটা এই দুপুর বেলায় কেমন ছোট আর শাদাটে—ধিকধিক করছে মাথার ওপর। ধোঁয়া ধোঁয়া ঘোলাটে দিগন্ত। তাতানো বাতাস ডানপিটে কিশোরের মতো ঝুলঝাপ্পি খেলে বেড়ায়। ইঁটের ভাটার মতো গনগনে আগুন যেন উগলে দিচ্ছে সূর্যটা’ তখন গল্পের ভাষা অলঙ্কারময় হয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু সে অলঙ্কার কবিকল্পনার অলঙ্কারে নিমজ্জিত হয়ে যায় না।
সেখানে কথাশিল্পীর অন্তর্দৃষ্টিই বড় হয়ে ওঠে। সে অলঙ্কার মানবজীবনের ক্ষুধা, দারিদ্র্যকে ফুটিয়ে তোলে। কোনো ভাবুকের হেঁয়ালিপনাকে প্রশ্রয় দেয় না। তবে সংলাপ রচনায় কিছুটা কি কৃত্রিম মনে হয়? সেটি কি গল্পের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে লেখকের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকার ফল? যে জীবন লেখক যাপন করেননি, সে জীবন নিয়ে গল্প বলতে গেলে লেখককে কল্পনাশক্তি, শ্রবণ ও পর্যবেক্ষণশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। এর বেশি কিছু তার জন্য মর্মপীড়ার মনে হয়। হয়তো এ কারণে সংলাপ রচনায় কিছু দৌর্বল্য পাঠকমনে খটকা জাগায়।
তাঁর চতুর্থ গল্পের বই ‘পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’। এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ গল্প নিঃসন্দেহে ‘শহীদ ইদু কানার বউ’। একজন মুক্তিযোদ্ধার বউয়ের যাপিতজীবনের কাহিনি। ইদু কানার অন্তর্ধানের পর তার সুন্দরী বউ জরিনা সমাজের ভূমিগ্রাসীদের লোলদৃষ্টিতে পড়ে। একদিন ইদ্রিস ওরপে ইদু কানার মতো জরিনার অন্তর্ধান হয়। এই-ই অস্বস্তিকর সমাজের বিধান। ‘সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’ গল্পে কথক ট্রেনযাত্রী। পুরো গল্পটি ট্রেনের সহযাত্রী সুন্দরী এক মেয়েকে নিয়ে। তার দিকে কথক এবং অন্য সহযাত্রীর আকর্ষণের কথাই প্রকাশ পেয়েছে। এ গল্পের অন্তর্গত সুর মানুষের অবদমন; আত্মপ্রকাশের ভারও। ব্যক্তির অদম্য কৌতূহল এবং সে কৌতূহল চেপে রাখার মনোযাতনা প্রকাশিত এ গল্পে।
নাজিব ওয়াদুদের বিশেষ কৃতিত্ব—বিষয় ও শব্দের ঠাসবুনটের কারণে গল্পগুলো গতিময়তা ও প্রাণচাঞ্চল্য হারায় না। একটি শান্ত ও সৌম্য আবহে গল্পগুলো পাঠকমনে অন্তর্গত ভাবনা ও সৌন্দর্যচেতনার রূপ চারিয়ে দেয়। নাজিব ওয়াদুদ মানবতাবাদী লেখক। তাই তাঁর গল্পে মানবতার জয়গান বারবার শোনা যায়। শিল্পের জন্য শিল্প নয়, মানুষের জন্য শিল্প। ‘কাক’, ‘কারফিউ’, ‘মেঘভাঙা রোদ’, ‘আবাদ’, ‘খনন’ ‘জীয়নকাঠি’ কিংবা ‘দখল’ প্রভৃতি গল্পের শৈল্পিক উৎকর্ষ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
চরিত্র সৃষ্টিতে নাজিব ওয়াদুদ ক্লাসিক গল্পকারদের মননসঙ্গী। স্রষ্টার সৃষ্ট চরিত্রের প্রতি স্বয়ং স্রষ্টার পক্ষপাতমূলক আচরণ আধুনিক পাঠকমনে পীড়া দেয়। যে চরিত্র স্বয়ং স্রষ্টার বিরাগভাজন হয়ে বেড়ে ওঠে, তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয় না। ফলে পাঠক সে চরিত্রকে করুণা করে। অথবা ঘৃণা করে। এ করুণা ও ঘৃণা ওই চরিত্রের জন্য পূর্বনির্ধারিত। স্রষ্টাই যেখানে ঘোষণা করেন, কোন চরিত্র খল, কোন চরিত্র নায়ক, পাঠক সেখানে নিজেকে অসহায় বোধ করেন মাত্র। তাতে পাঠক লেখককেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মনে মনে জেরা করে নেন। একসময় তিনি লেখককে অপছন্দ শুরু করেন। তার জন্য পাঠককে দোষারোপ করা যায় না।
আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার ফলে আমাদের গল্পকারগণ স্বভাবতই ভিলেন ও নায়ক নির্মাণের দিকে যতটা মনোযোগ দেওয়ার চিন্তা করেন, তার সিকি ভাগও চেষ্টা করেন না প্রতিটি চরিত্রকে ব্যাপ্তি ও স্থান-কালানুসারে বিকশিত করতে। ফলে আমাদের ছোটগল্পের মূল সমস্যা থেকে যায় চরিত্রের মনোদৈহিক বিকাশের পথ বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতায় আচ্ছন্ন হওয়ার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে। আমাদের কথাসাহিত্যিকেরা চিন্তা করেন না, এককালের প্রশংসাযোগ্য কর্মযজ্ঞেরও উত্তরকালে নিন্দাভাগ্য জোটে।
যুগের পরিবর্তনে মানুষের রুচিরও পরিবর্তন ঘটে—এ কথা অস্বীকারের সুযোগ কই? তাই মীর মানসের ঘৃণা-পাত্র ‘পাষ- এজিদ’, রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’, মানিকের প্রাগৈতিহাসিক চরিত্র ‘ভিখু’ অস্তিত্ববাদী ও সম্পন্ন মানবচরিত্রের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। আজকের কোনো সম্পন্ন সমালোচকের চোখে এজিদ আর পাষ- কিংবা পামর নয়। এজিদ একনিষ্ঠ প্রেমিক। সম্ভ্রান্ত সমরনায়ক; রাষ্ট্রনায়কও। কাবুলিওয়ালা এখন আর মুনাফাখোর বেনিয়া মাত্র নয়, একজন স্নেহময় পিতা; ভিখু বেঁচে থাকার আকুলতাসম্পন্ন, প্রেমে-কামে একজন সম্পন্ন মানুষ। মীর মশাররফ যেমন এজিদের ঘৃণা জাগিয়ে তুলেছেন পাঠকমনে, রবীন্দ্রনাথ কিংবা মানিক তেমনটি করেননি। সঙ্গত কারণেই চরিত্রগুলো আপন মহিমায় বিকাশের পথ খুঁজে নিয়েছে। লেখক শুধু সে বিকাশের পথটি চিনিয়ে দিয়েছেন। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। নাজিব ওয়াদুদও রবীন্দ্রনাথ ও মানিকের দলে। নাজিব ওয়াদুদের চরিত্রগুলো স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে জানে। ‘কারফিউ’, ‘আবাদ’, ‘খনন’, ‘নোনা প্রেম’ গল্পে অসম সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন চরিত্রগুলো আপন আপন গন্তব্য ও কর্ম নির্বাচন করে নেয়। সেখানে লেখক পথপ্রদর্শক মাত্র। তার বেশি নয়। সংলাপ রচনায় তিনি আধুনিক। আখ্যান বর্ণনায় অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো স্বতঃস্ফূর্ত।