ঔপনিবেশিক যুগের বাংলা কবিতার প্রধান বিষয় ছিল স্বাদেশিকতা, বন্দিদশার মুক্তিকামনা, সার্বভৌমত্ব অর্জন, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখরতা, জড়ত্ব ও ক্লীবত্ব থেকে মুক্তজীবনের দিকে ফেরা। এজন্য সে সময়ের কবিগোষ্ঠীকে দুটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়েছে— ভাষাসংগঠনকে তেজস্বী করে তোলা আর ছন্দবৈচিত্র্য রক্ষা করা। সমগ্র বাংলা কবিতায়, বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই চৈতন্যবোধ প্রধান অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে, বিশশতকের নব্বই ও একুশ শতকের সূচনাপর্বে বাংলা কবিতা মোড় নেয় দর্শনজাত রূপমগ্নতার দিকে; মোচড় দিয়ে ওঠে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উৎকর্ষে। এর মধ্য দিয়ে কবিরা আত্মস্থ করেন দেশজ ভূগোল, বিশ্ববীক্ষণ, মিথের কল্পজগৎ, লোকায়ত অনুষঙ্গ ও মূল্যবোধজারিত বৌধিকতা। বিশ্বগ্রামের যুগে, সম্ভবত—এ সময় থেকেই কাব্যদর্শন স্থূলতার পথ পরিহার করার সুযোগ পায়। সূক্ষ্ম, অণুসূক্ষ্ম হয়ে ওঠে কবিতার জগৎ। ছন্দবৈচিত্র্যে না হলেও, ভাষাসৌন্দর্যে কাব্যকলা বহুরৈখিক বোধের চিত্রকলার মোড়কে মূর্ত হতে শুরু করে। স্মর্তব্য, এ সময়ের কবি ও কবিতা সংখ্যাধিক্যেও অন্যূন, প্রবল; ভারসাম্যপূর্ণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যে পূর্ণ তাদের কাব্যজগৎ।
কবিতা—প্রধানত কবিতাই সূক্ষ্ম জীবনচেতনা কামনা করে। আর কোনো শিল্প এত রহস্যময় হয়ে উঠতে পারেনি; এত গাঢ় অনুভব অন্য কোনো শিল্প মূর্ত করে তুলতে পারেনি। ঐতিহ্য ও লোকজীবনের অনুষঙ্গে কবিতা হয়ে ওঠে জীবনবেদ, একান্ত আরাধ্য। জীবনকে মর্মর পাথরের মতো সে উজ্জ্বল করতে চায়। কিন্তু, সে তো পাথর নয়—চায় রক্তমাংসের উপাখ্যানকে প্রমূর্ত করতে। আত্মপ্রত্যয় তার কাম্য, প্রার্থনাও কাম্য। মৃত লখিন্দর আবার জেগে ওঠে, বেহুলা আবার পূর্ণ হয়ে ওঠে। মানব-মানবীর একান্ত জগৎ হয়ে ওঠে সর্বজনীনতার স্মারক। বাঙালি-জাতিসত্তায় মিশে আছে প্রীতি, ঐক্য ও সম্প্রীতির ইতিকথা—ইহবোধ ও পারত্রিক কল্যাণ তার নিত্য অনুষঙ্গ। এ সময়ের কবিতায় এই দুই সত্তা একাকার হয়ে আছে সমান গৌরবে। কবি কাজী নাসির মামুন এমনই আখ্যান তুলে ধরেন এভাবে:
ক.
প্রাণ দাও, বিষ ঝেড়ে ভুলি এ মৃত্যুর প্রহসন
বাঁচার তাগিদ জেনে বুড়ো হোক নহলী যৌবন
(লখিন্দরের গান-এক: কবি কাজী নাসির মামুন)খ.
মথুরায় কৃষ্ণ-তলোয়ার।
বিনোদিনী গ্রাম
রোদে জেগেছিল
(লখিন্দরের গান-তিন: কবি কাজী নাসির মামুন)
বোঝা যায়, জীবনের জন্য উজ্জ্বল কামনা তার আছে। প্রেমের জন্য তার আকাঙ্ক্ষা দুর্বার। কৃষিজীবনের সংস্কৃতি ও তার মূল্যবোধকে বারবার পরখ করতে চেয়েছেন তিনি। প্রাক নগরায়নের মিথ তার কাব্যজুড়ে আছে বিশাল জায়গা দখল করে। উদ্দেশ্য—দ্রাবিড় বাংলার জীবন অবলোকনের মধ্য দিয়ে জাতিসত্তার শক্তি চিহ্নিত করা; ঐক্যসূত্রে জীবনের মর্মমূল আবিষ্কার করা। এ এক নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বটে। বাঙালির জীবন নানান রঙে, নানান ফুলে সৌরভময়। কিন্তু, তার শক্তি স্বতন্ত্র অন্যখানে; সেটা আত্মপরিচয়ে, জাতিসত্তায়।
একটি রোদের মাসি মায়ের পতাকা
থেকে বোন চিনে নেয়। গ্রাম
ঝলসে ওঠার কথা ছিল।
বুনট বাতাস শর্ত ভাঙা পতাকায়
বোন বোন ওড়ে
(লখিন্দরের গান-পাঁচ: কবি কাজী নাসির মামুন)
কাজী নাসির মামুনের কবিতায় বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাসকে খুঁজে পাই বারবার। বাঙালির অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা দরকার। অপশাসন থেকে মুক্তি তার কাম্য। সবরকম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার নাগপাশ থেকে মুক্তি অর্জন করতে হবে। কবি বলেন প্রতিরোধ-যুদ্ধের কথা; বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়।
মাছে-ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত;
আমাকে দাঁড়াতে হবে।
কেরামন-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ন ইতিহাস,
অ-হল্য জীবনচরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্ট লাঠিয়াল;
আমার দখল নেবে কে আছে এমন?
(লখিন্দরের গান-দশ: কবি কাজী নাসির মামুন)
অন্যদিকে, কবি জাকির জাফরান বেছে নিয়েছেন মৃদু-কোমল ভাষা। তার কবিতায় আছে জীবনের প্রতি মায়াবী আবেগ; প্রেমের প্রতি অকৃত্রিম দরদ। বিষণ্নতা, দুঃখবোধ ও সামাজিক অনাচার তার কবিতার অনুষঙ্গ। জাকির জাফরানের কবিতায় প্রতীক ও রূপক চেতনা নতুন বোধ সৃষ্টি করে।
আমার দুঃখের গল্পে দ্যাখো
কেবলি বাঘের ছড়াছড়ি।
এই রক্তমোচনের রাতেও
তোমার নিষ্ঠুর শ্লোক ভেঙে
সত্যি সত্যি নেমে আসে বাঘ।
তখনই দুঃখকে লুকিয়ে রাখি
আমি রক্তের ভিতর,
আর বলে ফেলি, মামা!
আমাদের ঘরে কোনো হরিণ ঢোকেনি।
(দুঃখ: জাকির জাফরান)
জাফরান দেখিয়েছেন জীবনের আরেকটি দিক, আত্মরক্ষার কৌশল। বাঘ ও হরিণের প্রতীকে এই গল্পবলা তার সহজাত, স্বভাবনিষ্ঠ। জাফরান বলেন কম, স্বল্পয়াতনে। কিন্তু তার ভাষা দর্শনঋদ্ধ; চিত্রকল্পবহুল। একটি প্রেমের কবিতায় এমন ভাষার নমুনা পাই।
রাত্রি গভীর হলে
তোমার শরীর নিয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করি
আর বলি, তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে রাত
চুল খোলো রাত্রি-সহোদরা
যুদ্ধক্ষেত্র প্রসারিত হোক।
পরে তুমি ডানা মেলে দিলে
আমি তাতে মুখ গুঁজে থাকি
যেন মেঘের ভিতর ঢুকে গিয়েছে বিমান বাংলাদেশ।
(দ্বিরালাপ: জাকির জাফরান)
জাফরান মূলত জনভাষার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে।ব্যক্তিভাষা সৃষ্টিতে তার সক্ষমতা প্রশ্নাতীত। তিনি তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছেন প্রজ্ঞার সাথে, আত্মবিশ্বাসে।
এসেছি শিরস্ত্রাণ পরে, দুটি চোখে পাখি,
চেনা যায়?
-কে তুমি?
আমি জাফরান, তোমার পশ্চাদভূমি।
-কেন এলে?
আয়ুর কৌটায় দাঁত বসাতে এসেছি।”
(অস্তিত্ব বিষয়ক: জাকির জাফরান)
এ জীবন চেতনার অন্যনাম আত্মদর্শন। এছাড়া কবিতা হয় না। শিল্প অমরত্ব পায় না।
অনুভূতির দৃশ্যায়ন ভাষার মধ্য দিয়েই সাধিত হয়। যাপনের অভিজ্ঞতা প্রতিটি মানুষের রয়েছে। একে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলার কঠিন কাজটি কবিকে করতে হয় ধ্যানী সন্ন্যাসীর মতো। তার সমস্ত অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ভাষাশক্তির বদৌলতে। মামুন রশীদ, চন্দন চৌধুরী, ফেরদৌস মাহমুদ, তুহিন তৌহিদ, চাণক্য বাড়ৈ, শামীম হোসেন প্রমুখের কবিতায় এই রূপটি প্রকাশ পায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। স্বপ্ন ও বাস্তব, সবকিছুর ভেতর দিয়ে নিজেদের নির্মাণ শৈলী এগিয়ে চলে তাদের। কবিতায় তারা অভিজ্ঞতারই বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। নমুনা দেই:
ক.
কোনো দুঃসংবাদ নয় বরং প্রতিদিন ডানা গজানো ঘুড়ি ওড়ে
মুকুরে প্রতিফলিত মিথ্যে মুখের মতো, বদ্ধ কুঠুরিতে।
(প্রবাস: মামুন রশীদ)খ.
হয়তো আমার সাধারণ হবার জন্যই নিজের ভেতরটা উড়ে গেল
বাইরে, এবং পৃথিবীতে তৈরি হলো যাবতীয় সম্পর্ক; আর এই সাধারণ
হবার আশায়ই আমি মাথা গুঁজলাম ঘাসের ভেতর, আমার ওপরেই
পড়ুক জগতের সব পায়ের বেদনা।
(শুধুমাত্র সাধারণ: চন্দন চৌধুরী)গ.
আমাদের একমাত্র শিশুটি যাই-ই আঁকে তাই-ই জীবন্ত হয়ে যায়,
শিশুটি লাল-হলুদ পাখি আঁকে
আমাদের
নিঃসঙ্গ বারান্দায় শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির।
… … …
শিশুটি লাল সূর্য আঁকে
আমরা দেখতে পাই
তোমাদের ছাদে বিশাল সূর্য হাসি হাসি মুখে গিটার বাজায়”
(আমাদের শিশু: ফেরদৌস মাহমুদ)ঘ.
আমার যে হাতে ছিলো ঘুটির নাটাই,
আমি সেই হাতটাকে গুটিয়ে নিয়েছি, আর
সুতো কেটে দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি ঘুড়িটির দিকে।”
(প্রজাপতিঘুড়ি: তুহিন তৌহিদ)ঙ.
যে জীবন পেরিয়ে এলাম শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্য এসব
বাহারি নামের একেকটি সাঁকো ছাড়া আর কিছু নয়- আর মৃত্যু এক জ্যোর্তিময় পাখি,
বুকের মাঝখান থেকে টুপ করে খুটে নেয় ‘প্রাণ’- সুস্বাদু শস্যদানা।
(এপিটাফ অথবা চুক্তিপত্র: চাণক্য বাড়ৈ)চ.
মেয়েটি এখন প্রজাপতি। দেয়াল জুড়ে
ছড়িয়েছে চোখ- মেঘদৃষ্টির রেখা
পাখি হবার বাসনা নিয়ে বসন্তসূত্রের
ধরেছে হাত।
(বসন্তসূত্রে: শামীম হোসেন)
বিবিধ অনুষঙ্গে এঁদের কবিতা নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল; কিন্তু তা মাটির পৃথিবীরই রসায়ন—জীবনের সঞ্চিত ধন।
সংস্কৃতি এক বেগবান সত্তা—মানবমণ্ডলীর গায়ে লেগে থাকে আমৃত্যু, অপরিহার্য হয়ে। ঐতিহ্য তাকে মহিমান্বিত করে, তার সত্তায় দোলা দেয়। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবোধ একটি উন্নত সাংগঠনিক সত্তা ও কাঠামো দিয়েছে। সম্প্রীতিবোধ সৃষ্টি করেছে। ঐকতান ও সমবায়ী জীবনক্ষেত্রের দিকে নিয়ে গেছে। সেখানে সবুজের সমারোহ, জীবনের স্পন্দন। এই নির্মাণের সপক্ষে আমরা উপস্থাপন করতে পারি অতনু তিয়াস, সিদ্ধার্থ টিপু ও মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার মর্মবাণী।
অতনু তিয়াস জীবনবাদী কবি। তবে তিনি প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত। তার স্বর কোমল, কিন্তু তীক্ষ্ণ। প্রয়োজনীয় কথাটি, প্রয়োজনের দিকটি তিনি স্পষ্ট করেন মন্ত্রের মতো। সেখানে বাঙালি-সত্তার, সুখময় জীবনের গান খুঁজে পাই। ধর্মবোধের আড়ালে অর্থনৈতিক মুক্তিই তার লক্ষ্য।
আমার পুতুল বৌ কোনোদিন বিষ্ণুপ্রিয়া হলে
হাতের রেখায় ফুটে উঠবে প্রসন্ন ধানছড়া।
(বৌ: অতনু তিয়াস)
কিংবা,
সময় একটু পেছনে চলো
মা আমার দুধভাত মেখে অনন্তকাল ধরে বসে আছে পৈঠায়
আমি বাড়ি যাবো।
(আমি বাড়ি যাবো: অতনু তিয়াস)
সিদ্ধার্থ টিপু সাধারণ শ্রেণির মানুষের কাছে যেতে চান; তাদের জীবনালেখ্য তুলে ধরতে উৎসুক। বঞ্চিতজনের বেদনা তাকে মর্মাহত করেছে। তিনি চান শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক; মানবিক সাম্যময় সমাজ-রাষ্ট্র গড়ে উঠুক। তিনি বলতে পারেন প্রার্থনার মতো সুরে:
এই তাম্রলিপির গ্রহে তোর একটা ঘর হোক সখা-
ঘরভরতি আগুনরাঙা সূর্যমুখী ফুল।
(শীতে সূর্যমুখী: সিদ্ধার্থ টিপু)
মোহাম্মদ নূরুল হক গভীর, তীব্র সংরাগী, মানবপ্রেমী ও চেতনালোকের কবি। অপভাষাকেও তিনি শিল্পসম্মত করে তুলেছেন। প্রতীক ও রূপকের বয়নে তার কবিতা শিল্পিত, অনুভব ঋদ্ধ। দর্শনজাত প্রজ্ঞায় তার কবিতা বহুল উচ্চার্য। উদাহরণ দেই:
ক
সেবার শিখেছিলাম—চূড়ায় উঠতে নেই; চূড়া খুব ছোট
আমি জানি মুঠোভর্তি নদীগুলো কোনোদিন চূড়ায় ওঠেনি।
(রোদের আঁচড়: মোহাম্মদ নূরুল হক)খ.
তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শিখে নাই?
(স্রোতের নামতা: মোহাম্মদ নূরুল হক)
মোহাম্মদ নূরুল হক প্রমত্তা নদীর মতো বহমান; তার ভাষা গতিশীল। প্রেমে, সম্প্রীতির বাঁধনে তার কবিতা ব্যতিক্রমী; সংহত ও ঋজু।
যদি ভুল করে কোনো ভুলফুল ফোটে তোমাদের ছাদে
জেনে রেখো সে ভুল আমি;
জেনে রেখো তোমার খোঁপায় ঠাঁই হলো না
তাই ফুটেছি অকালে হৃদয়ের দাবি নিয়ে জংলি কুসুম।
(জংলি কুসুম: মোহাম্মদ নূরুল হক)
তার সামগ্রিক কবিতা হৃদয়ের দাবি মেটাতে চেয়েছে। তিনি বাংলা কবিতায় এক অপরিহার্য সত্তা।
বাংলা কবিতা প্রাগ্রসর; চলিষ্ণু। ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে, এর দর্শন ও চিন্তার পাটাতন; ভাষার সৃজনদক্ষতার পাললিক রূপ ও রূপতত্ত্ব। আশার কথা, আমাদের বাংলা কবিতা আজ সমগ্রসত্তা বিকশিত করে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।