দীক্ষিত কবিমাত্রই পঙ্ক্তিবিন্যাসে যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি মাত্রাচেতনায়ও। পঙ্ক্তিবিন্যাসের বৈচিত্র্যের জন্য ছন্দজ্ঞান থাকা জরুরি। ব্যত্যয়ে পঙ্ক্তিবিন্যাস হয়ে উঠবে আঙ্গিক সর্বস্বতার একটি অংশমাত্র। ছন্দজ্ঞানের সঙ্গে মাত্রাচেতনা ও পঙ্ক্তিবিন্যাসের সম্পর্ক গভীর। দীক্ষিত কবি বক্তব্য স্পষ্ট করার লক্ষ্যে যেমন পঙ্ক্তিবিন্যাস করেন, তেমনি বক্তব্যের আড়াল সৃষ্টির জন্যও। অপ্রস্তুত কবিযশপ্রার্থী ছন্দ উচ্ছেদ করার জন্য যত উদগ্রীব, ছন্দসিদ্ধির জন্য তার তিলার্ধও চেষ্টা তার থাকে না; ছন্দ না জেনেই ভাঙার স্বপ্ন দেখে। ফলে নিজের কবিতার সর্বনাশ শুরুতেই ডেকে আনে।
নজরুল পঙ্ক্তি বিন্যাসে ও মাত্রাচেতনায় সচেতন ছিলেন; ছিলেন নিরীক্ষাপ্রবণও। একটি কবিতায় কোন ছন্দের প্রয়োগে কী ধরনের পঙ্ক্তি বিন্যাস সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, সে সম্পর্কে তার সচেতন প্রয়াস লৰণীয়। পঙ্ক্তিবিন্যাসের প্রথম ও সার্থক উদাহরণ ‘বিদ্রোহী’। অতি পর্ব, মধ্যখণ্ডন, ছন্দসন্ধির সমন্বয়ে এ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো বহুবর্ণিল রেখার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্রভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
এখানে শুরুর পঙ্ক্তির শুরুতে বল শব্দের পর একটি স্পেস, তার পর ছয় মাত্রার দুটি পর্ব। অতি পর্বসহ তিন পর্বে এ পঙ্ক্তির সমাপ্ত। তার আরও তিনটি পঙ্ক্তি রয়েছে, প্রতিটির নিয়মিত পর্ব সংখ্যা দুই। পঙ্ক্তিগুলোর পর্বসংখ্যা ও মাত্রা সংখ্যা সমান ও স্বাভাবিক। কিন্তু ‘উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর’ পঙ্ক্তির শুরুতে ‘উঠিয়াছি’ চার মাত্রার একটি অপূর্ণ পর্ব সম্পন্ন হয়ে উঠেছে পরবর্তী শব্দযুগল ‘চির-বিস্ময়’ থেকে প্রথম অংশের ‘চির’সহযোগে। এর পরের পঙ্ক্তি ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!’ থেকেও অতিপর্ব ‘মম’ শেষে একটি স্পেস। তারপর ‘ললাটে’ শব্দের পর বাকি তিন মাত্রার জন্য পরবর্তী শব্দ ‘রুদ্রভগবান’ থেকে ‘রুদ্র’ নিয়ে ‘ললাটে রুদ্র’ পর্ব গঠন করে ছন্দসন্ধির নিয়মকে মান্য করেছেন। আবার ‘দীপ্ত জয়শ্রীর’ শব্দবন্ধেও পর্বসন্ধি ঘটিয়ে কবিতা পঙ্ক্তি পরিপূর্ণ করে তুলেছেন। ‘দীপ্ত জয়শ্রীর’ শব্দযুগলে ছয় মাত্রার পর্ব বিন্যাসের ৰেত্রে ‘দীপ্ত জয়শ’ পর্যন্ত গ্রহণ শেষে বাকি থাকে, ‘শ্রীর’। লৰ্য করলে উপলব্ধি করা সহজ, কেবল শব্দযুগল ‘দীপ্ত জয়শ্রী’ হলেও এখানে ছয় মাত্রা মেলে, তখন পরবর্তী ধ্বনি ‘র’ ওপর পূর্ববর্তী ধ্বনিপুঞ্জকে নির্ভর করতে হয় না।
আর যখন উচ্চারণ করেন, ‘আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!’ তখন ‘ধৃষ্ট’ শব্দ মাত্রাবৃত্তের সাধারণ সূত্র উজিয়ে তিন মাত্রার স্থলে দুই মাত্রার মর্যাদা পায়। পাঠকের সতর্ক কানই দুই মাত্রার সাৰ্য দেয়। পঙ্ক্তিবিন্যাসের ৰেত্রে পঙ্ক্তির শুরুতে অতিপর্বের প্রয়োগ থাকলেও এ পঙ্ক্তিতে মূল পঙ্ক্তি থেকে স্পেসসমেত ‘আমি’ শব্দ অতিপর্ব নয়, বরং পঙ্ক্তিস্থ পর্বগুলো যদি এভাবে বিন্যাস করি, ‘আমি ধৃষ্ট, আমি/দাঁত দিয়া ছিঁড়ি/বিশ্ব মায়ের/অঞ্চল’ তখন স্পষ্ট হয়, ‘ধৃষ্ট’ শব্দটি দুই মাত্রার। পূর্ববর্তী পঙ্ক্তির ‘চঞ্চল’ শব্দের সঙ্গে পর্ববর্তী পঙ্ক্তির ‘অঞ্চল’ শব্দের ধ্বনি ও মাত্রাসাম্য বজায় থাকে। ‘বিদ্রোহী’ মাত্রাবৃত্তের ষাণ্মাত্রিকপর্বের অসম পঙ্ক্তিযোগে রচিত হলেও প্রবহমানতার কারণে চরণান্তের মিলও মস্নান হয়ে পড়ে। অন্ত্যমিল এ কবিতায় অবান্তর কি না সে প্রশ্নও এখানে প্রাসঙ্গিক। মাত্রাবৃত্তের স্বাভাবিক তান এখানে মান্যতা পায়নি। অসম পঙ্ক্তি উপস্থিতি, কবিতাটিকে করে তুলেছে একঘেয়েমি মুক্ত। প্রথাগত চরণানত্মিক মিলসম্পন্ন কবিতা সাধারণত সমপার্বিক হয়ে থাকে। নজরুল সে প্রথা ভেঙে নতুন সুরে সৃষ্টি করেছেন; তথাগদ্য ছন্দের সূচনা এখান থেকেও হতে পারত। কিন্তু চরণানত্মিক মিল থাকায় তথাগত গদ্যছন্দের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব হয়নি। গদ্যছন্দের সমাত্মীয় ছন্দও বলা যায় না।
পঙ্ক্তি বিন্যাসের ৰেত্রে সচেতন প্রয়াস লৰ্য করা যায়, ‘সিন্ধু’ কবিতায়। অৰরবৃত্তের অসম পঙ্ক্তিযোগে সৃজিত এ কবিতায় পর্বান্তের মিল থাকা সত্ত্বেও অসম পর্ব ও পঙ্ক্তির মিথস্ক্রিয়ায় সে অন্ত্যমিল উহ্য হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ মাত্রা সংখ্যা ২২ এবং সর্বনিম্ন ৪ মাত্রা। বক্তব্যের প্রয়োজনে পঙ্ক্তিকে বড় থেকে ছোট করেছেন, বড়ও করেছেন।
অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে
এ-নিখিলে
জানিতে না আপনারে ছাড়া।
তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’নাড়া।
প্রথম পঙ্ক্তিতে আট মাত্রা, দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে মাত্রা সংখ্যা চার। উভয় পঙ্ক্তির অন্ত্যমিল রৰিত। তৃতীয় পঙ্ক্তিতে দশ মাত্রা এবং চতুর্থ পঙ্ক্তিতে বাইশ মাত্রা। তৃতীয় ও চতুর্থ চরণান্তেও মিল রক্ষা করা হয়েছে।
অৰরবৃত্তের আরও একটি কবিতা ‘দারিদ্র্য’। প্রতিচরণে চৌদ্দ মাত্রা এবং চরণান্তে মিল সত্ত্বেও চরণান্তে ভাবের সমাপ্তি টানা হয়নি। ভাবকে প্রবহমানতা রয়েছে।
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা।—দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উপর্যুক্ত পাঠোদ্ধারের প্রথম দুই পঙ্ক্তির অন্ত্যমিল সত্ত্বেও ভাবের সমাপ্তি ঘটেছে তৃতীয় পঙ্ক্তির আট মাত্রার প্রথম পর্বে। আবার তৃতীয় পর্বের ছয় মাত্রিক শেষ পর্বের ভাব সম্পন্ন হয়ে উঠেছে চতুর্থ পঙ্ক্তিতে। প্রকৃতপৰে সেখানেও ভাবের পরিপূর্ণ উদ্বোধন সম্ভব হয়নি, কবিচিত্তের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে, ‘উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ৰুরধার/বীণা মোর শাপে তব হল তরবার’ উচ্চারণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। চার মাত্রাকে তিন মাত্রায় পরিণত করার নৈপুণ্য এ কবিতায় দেখিয়েছেন, ‘দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগ বালা!’ পঙ্ক্তির শুরুর ‘দংশিল’ শব্দে। ‘দংশিল’ শব্দে সাধারণত চার মাত্রা হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে পঙ্ক্তির শুরুতে, প্রথম শব্দের শুরুতে থাকা ‘দং’ রুদ্ধদল হওয়ার কারণে পরবর্তী শব্দ ‘সর্বাঙ্গে’র ভারি উচ্চারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ায় চার মাত্রার পরিবর্তে তিন মাত্রাই গ্রাহ্যতা পায়।
‘চাঁদনীরাতে’ কবিতার একটি চিত্রকল্পঋদ্ধ পঙ্ক্তি, ‘সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী’। ছয় মাত্রিক মাত্রাবৃত্তে রচিত। কিন্তু ‘সপ্তর্ষির’ শব্দটিতে যদিও ছয় মাত্রা রয়েছে, তবুও সংশয় জাগে পাঁচ মাত্রার! দ্রুতলয়ে পাঠকালে পাঁচ মাত্রাই মান্য হলেও ধীরলয়ে পঠনপাঠনে ছয় মাত্রাই গ্রাহ্যতা পায়। ‘বাতায়ন পাশে গুবাকতরুর সারি’ কবিতার পঙ্ক্তি বিন্যাস ও মাত্রাচেতনার বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। একটি উদাহরণে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ‘—তোমার পাখার হাওয়া/ তারই অঙ্গুলি পরশের মত নিবিড় আদর ছাওয়া’ পঙ্ক্তি দুটির গঠন ও মাত্রা বিন্যাসের দিকে লৰ্য করলে উপলব্ধি হয়, প্রথম পঙ্ক্তিটি আট মাত্রার। একটি ছয় মাত্রার পূর্ণ পর্ব। অপরটি অপূর্ণ। দ্বিতীয় পঙ্ক্তির শুরুর পর্ব ‘তারই অঙ্গুলি’ স্বাভাবিক নিয়মে সাত মাত্রার। কিন্তু এখানে ‘তারই’ শব্দের ‘ই’ প্রত্যয়কে পূর্ববর্তী বর্ণ ‘র’ সঙ্গে সমন্বিত করে নিলে তখন শব্দটিতে মাত্র দুই মাত্রাই শোনা যায়। মাত্রা গণনার সময় যদি ধরা হয়, তার+ই তাহলে তিন মাত্রা, কিন্তু শ্রুতিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে, ‘তারি’। সে হিসেবে দুই মাত্রাই শ্রেয়।
নজরুলের পঙ্ক্তি বিন্যাসের আরেকটি বিশষত্ব, একটি অপূর্ণ পঙ্ক্তিতে যে ভাবের শুরু, পূর্ণ পঙ্ক্তিতে সে ভাবের পরিপূর্ণতা।
ক.
পরশুরামের কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! (বিদ্রোহী)খ.
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান (সাম্যবাদী)গ.
হায়রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়! (মানুষ)ঘ.
এই দুনিয়া পাপশালা
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা! (পাপ)ঙ.
শোনো মানুষের বাণী
জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক কোনো গ্লানি! (বারাঙ্গনা)চ.
হে চঞ্চল
বারে বারে টানিতেছে দিগন্তিকা-বন্ধুর অঞ্চল! (সিন্ধু)
উপর্যুক্ত পাঠোদ্ধারগুলো বিশ্লেষণ শেষে প্রতীয়মান হয়, নজরুল পর্ববিন্যাস ও পঙ্ক্তিসজ্জায় সচেতন ছিলেন। তাই একই কবিতায় অসম দৈর্ঘ্যের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এছাড়া তার পঙ্ক্তিসজ্জার আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পঙ্ক্তির শুরুতে অতিপর্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তাতে কবিতা যেমন হয়েছে বহুরৈখিক, তেমনি প্রাকরণিক দিক থেকেও কবিতার একটি গ্রহণযোগ্য ভিত তিনি তৈরি করেছেন, যে ভিতের ওপর তার একটি শৈলীও সৃষ্টি করেছেন।
নজরুল তার কবিতায় পঙ্ক্তি বিন্যাস ও মাত্রাচেতনায় একটি বিশেষ ধারা তৈরি করেছেন। যে ধারা নজরুলের সাহিত্যিক স্বকীয়তাকে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে। ছন্দবিষয়ে গভীরতর অভিনিবেশ না থাকলে মাত্রাচেতনায় সাফল্য অর্জন অসম্ভব। নজরুল বাংলাছন্দের প্রতিটি প্রকরণ সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ সচেতন। ফলে ছন্দের ভাঙাগড়ায় তার নিরীক্ষাও ছিল, প্রতিকৃতের। এদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম নিরীক্ষাপ্রবণ কবিদের জন্য নমস্য।
বি.দ্র: পুনঃপ্রকাশিত