বাউল কবি দুদ্দু শাহের গান বাংলার লৌকিক ভাবধারায় নিজস্ব এক স্থান দখল করে নিয়েছেন, যা আমাদের দর্শনের দিক থেকেও লোকদর্শনের পর্যায়ে ভাবজগতের গানগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব লোক কবি বা গীতিকারের আমরা অনেক সময় দার্শনিক কবি বা মহাপুরুষ, মহামানব বা সমাজ থেকে আলাদা প্রাণী হিসেবে তাদের অভিহিত করে থাকি। তারা কিন্তু নিজেদের দার্শনিক বা মহাপুরুষ ভেবে এসব গান বা কবিতা রচনা করেন না। এসব লোককবি, বাউলের গানে বা রচনায় রয়েছে দার্শনিক তত্ত্ব, সমাজের কুসংস্কার, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণচেতনা যুগবাস্তবতা ইত্যাদি। আবার তাদের গানে রয়েছে তাদের জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, জীবন বাস্তবতা, মানুষের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত তাদের চোখের সম্মুখে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে অবলম্বন করে তারা রচনা করেছেন গান। যা আজ আমাদের কাছে দার্শনিক তত্ত্ব বা নিজের জীবনের খণ্ডিত চিত্রই মনে হয়। দুদ্দু শাহের কবি প্রতিভা শুধু যে ভাবগত চিন্তা চেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। তাঁর চিন্তা-চেতনার জায়গা ছিল ইতিহাস ও সমাজকে কেন্দ্র করেও। এজন্যই আমরা দেখতে পাই তাঁর গানে উঠে এসেছে সমাজ চেতনা, যুগচেতনা, বাস্তব চেতনা, মানবিক চেতনা। তাঁর গানের মূল বাণী অসাম্প্রদায়িক চেতনা বোধ, যা শুধু মানবিকতারই জয়গান করে।
দুদ্দুশাহ একজন বস্তুবাদী শিল্পী। যার গানে আমরা একজন মানবিক প্রেমিক পুরুষের সন্ধান পাই। যা কিনা সমাজতন্ত্রের একজন অগ্রপথিক হিসেবেও মনে করতে পারি এতে কোনো দ্বিমত রয়েছে বলে মনে করি না। তাঁর গানে যে সব অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ রয়েছে যা তাঁর গুরু লালন শাহের মত বা পথকে অবলম্বন করেই প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে করি। কিন্তু তিনি তাঁর গানে লালনের শিষ্যত্ব স্বীকার করলেও কিন্তু তাঁর গান বা কবিতায় রয়েছে নিজস্ব বাচনভঙ্গি ও নিজস্ব ভঙ্গিমা, যা একমাত্র দুদ্দুশাহকেই চিনিয়ে দেয়। এ বাউল কবির গান এতই শক্তিশালী যে কিছু কিছু জায়গা স্বয়ং লালনের চেয়েও শক্তিশালী বলে আমি মনে করি তাঁর গানে বাউল তত্ত্বের অনেক গুহ্য কথার সঠিক ব্যাখ্যা এসেছে, যা আমাদের দুদ্দু পাঠের মাধ্যমে এ পথ অনেকটা সহজ হয়েছে কিন্তু দুদ্দু শাহ এ অজ্ঞাত-তত্ত্বের সঠিক ব্যাখ্যা না দিলে এ মতাদর্শনের অজানা তথ্য শুধু আমাদের কাছে অজানায় রয়ে যেত। কিন্তু দুদ্দুশাহ আমাদের কাছে সে সব তথ্যকে সহজ সাধ্য করে তুলে ধরেছেন। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে দুদ্দুশাহ গ্রন্থের রচয়িতা এস, এম লুৎফর রহমান বলেছেন—‘তাঁর অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি চেতনা, লালন শাহের-ই-মত ও পথ অবলম্বন করে বিকশিত হওয়ায় তিনি যোগ তন্ত্র, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও ইসলামি লৌকিক সুফি মতসমূহের সমীকরণ করে গান রচনায় সমর্থ হয়েছেন। ওইসব মতের নির্যাস নিয়ে তিনি বাউল মতবাদের তত্ত্ব ও দর্শন গড়ে তুলেছেন। এই বাউল কবি সমাজের অসঙ্গতির দিকেই তাঁর তর্জনি আঙুল তুলেছেন এবং তা গানে প্রকাশ করেছেন। তিনি সেই ঊনিশ শতকের সমাজ বাস্তবতার চিত্রই একেছেন তাঁর গান ও কবিতায় এগুলো সম্ভব হয়েছে তার যথার্থ আত্মউপলব্ধির দ্বারা, যা তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করেছে। এজন্যই আমরা তাঁকে একজন সচেতন বাউল, দার্শনিক বা এদেশের বস্তুবাদের অগ্রপথিক বললেও বোধ হয় বেশি বলা হবে না। কিন্তু এ মানুষের জন্ম, মৃত্যু তারিখ ও নাম নিয়ে রয়েছে বিভ্রাট, যা আমাদের সত্যিই ভাবিত করে।
জন্মসাল বিভ্রাট
দুদ্দু শাহ সম্পর্কে আমরা সঠিক তথ্য বা উপাত্তের কোনো নিশ্চিত সন্ধান পাইনি, তবে তাঁর গীতের ওপর নির্ভর করে তাঁর জন্মকালের সময় নির্ণয় করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্ডিত। এ গীতিকারের জন্মসাল সম্পর্কে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন—‘তিনি (দুদ্দুশাহ) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে অর্থাৎ ১৮৫০-১৯০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের লোক বলিয়া মনে করা হয়। ১
অন্যদিকে বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন—‘দুদ্দুশাহ লালন শিষ্য। তাঁর গানে লালনের উল্লেখ গুরু হিসেবেই। অন্যপক্ষে তাঁর গানে সমসাময়িক ঘটনার যে ইঙ্গিত আছে, তাঁর অনুসারে হয়তো এই সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে তিনি ঊনিশ শতকের মধ্যবর্তী পর্যায়ের মানুষ।২ এ সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার মূলে রয়েছে দুদ্দুশাহের একটি গান। যা কিনা পাঠের মাধ্যমে বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। যা তাঁর সিদ্ধান্তের ভিত্তিমূল। এজন্যই তিনি এ গানটি তার লেখায় পাদটিকায় উল্লেখ করেছেন।
যে হতে প্রতিমা
পূজার সৃষ্টি হয়।
ভূগোল ইতিহাস দেখে
করো তা নির্ণয়।শৃগাল মুখো মূর্খ বামন
না জেনে ব্রহ্মের করণ
নোড়া পূজার করে প্রচলন
যে দ্যাখে-তাই কয়।
না জেনে পুরুষ প্রকৃতি
শিব-লিঙ্গ পূজা হয় সতী
দেখে হাসে ভাই তাদের এ রীতি
যত শিক্ষিত সবাই।সতীদাহ বলে যারে
তাকি মনুষ্যে করে?
রামমোহন বন্ধ করে
গেছে দেখ তাই।দীন দুদ্দুর বিনয় বচন
ধর্ম নাম শয়তানী করণ
সৃষ্টি করে বিটলে বামন
লালন শাঁই কয়। ৩
অনুমান করা যায় যে, ঊনিশ শতকে ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা এক মহামারী আকার ধারণ করেছিল। মহামতী রামমোহন রায়সহ অন্যসব মহতীদের চেষ্টায় সমাজ থেকে তা রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। এমনকি এটি রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে রোধ করা হয়েছিল। যার ফলে পরবর্তীকালে এটি আর চালু করার কোনো সুযোগ থাকেনি। কিন্তু ওই গানে ‘সতীদাহ’ ‘রামমোহন’ প্রসঙ্গ থাকার কারণকে নির্ভর করেই সম্ভবত লেখক দুদ্দুশাহকে ঊনিশ শতকের মধ্যবর্তী পর্যায়ের মানুষ বলে উল্লেখ করার প্রয়াস পান। আলোচ্য প্রসঙ্গে খোন্দকার রিয়াজুল হক কুষ্টিয়ায় কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত ‘লালন অনুগামী দুদ্দুশাহ’ প্রবন্ধে দুদ্দুশাহর জন্ম বাংলা ১২৪৮ সালে (ইংরেজি ১৮৪১) জন্মগ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন৪। খোন্দকার রিয়াজুল হকের এ মতকেই স্বাগতম জানিয়েছেন বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. আনোয়ারুল করিম। তিনি আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন যেহেতু খোন্দকার রিয়াজুল হক প্রায় দুদ্দুশাহের বাড়ির কাছের মানুষ তাঁর চেয়ে সঠিক তথ্য আর কে নিখুঁত করে বের করতে পারে। ৫ কিন্তু শাহ লতীফআফী আনহু লিখেছেন ভিন্ন কথা। তাঁর লেখায় আমরা পাচ্ছি দুদ্দুশাহের দীর্ঘজীবী হওয়ার সন্ধান এবং তিনি দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন তারই ইতিহাস। পূর্ব বঙ্গীয় বাউল সমাজের বর্তমান (১৩৬৬ সালে) কোষাধ্যক্ষ জনাব আফতাব শা’র হিসাব মতে তিনি (দুদ্দুশাহ) বাংলা ১৩৪১ সালের মাঘ মাসে ইহলোক ত্যাগ করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১১১ বছর। এ হিসাব সত্য হলে তাঁর জন্ম সন বাংলা ১২০৩ সাল। ৬ কিন্তু এ সালটাও যে ঠিক তারও ঠিক এবং জোরালো কোনো যুক্তিযুক্ত তথ্যের সন্ধান আমরা পাচ্ছি না। তাঁর মানে আমরা ধরেই নিতে পারি শাহ লতীফ আফী আনহুও একটা ধারণার ওপর ভিত্তি করে বা সেই সময়ের কোনো ঘটনার ওপর ভিত্তি করে এ কথাটি লিখতে বাধ্য হন। যদি তিনি সঠিক সালটি জানতেনই, তাহলে তিনি সেই সালটি জোরালোভাবে জানাতেন এবং সঠিক তথ্য-উপাত্ত আমাদের সামনে হাজির করতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। আবার মহসিন হোসাইন নামে একজন খ্যাতিমান কবি ও লোক গবেষক তার প্রণিত বৃহত্তম যশোরের ‘লোক কবি ও চারণ কবি’ গ্রন্থে দুদ্দু শাহের জন্ম ১৮৪১ বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর তারিখ ১৯১৯ সাল বলে উল্লেখ করেছেন। সব কিছু বিবেচনা করে আমরা যদি দেখি, তাহলে দেখতে পাই খোন্দকার রিয়াজুল হক দেখাচ্ছেন ১৮৪১-১৯১১=৭০ বছর, শাহ লতীফ আফী বলেছেন, ১৭৯৬-১৯০৭=১১১ বছর এবং মহসিন হোসাইন লিখেছেন, ১৮৪১-১৯১৯=৭৮ বছর জীবিত ছিলেন। এস এস লুৎফর রহমানের রচিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘দুদ্দু শাহ’ গ্রন্থে তিনি শাহ লতীফ আফী আনহু সাহেবের মতটাই মেনে নিয়েছেন। কারণ তাঁর কাছে বাউলদের হিসাবটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এ মতটায় মানার পরেও তিনি বলেছেন, অন্য কোনো সূত্র থেকে অধিকতর নির্ভরযোগ্য নতুন তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত দুদ্দুশাহ ১২০৩ সালে জন্মলাভ করেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সমীচীন।৭ দুদ্দুশাহ সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাচ্ছি না বলেই যে ওই সালটাকে দুদ্দুশাহের জন্ম তারিখ হিসেবে মেনে নিতে হবে, এমনও তো কোনো কথা বা যুক্তি থাকতে পারে কি? শ্রদ্ধেয় লুৎফর রহমান শাহ লতীফ আফী আনহুর লেখাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বাউলদের হিসেব বিবেচনায়। আমার প্রশ্ন বাউল হলেই যে তাদের হিসাবটা গ্রহণ করতে হবে, এমন তো কোনো কথা হতে পারে না। তাদের হিসাবে কি কোনো ভুল থাকতে পারে না? না কি তারা বাউল বলে তাদের কোনো ভুল হয় না? তবে এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে, দুদ্দুশাহ ১১১ বছরের দীর্ঘজীবন পাননি। উপর্যুক্ত আলোচনার বিচার বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, লালনশিষ্য দুদ্দুশাহ বাংলা ১২৪৮ (ইংরেজি ১৮৪১) সালেই জন্মগ্রহণ করেন।
নাম নিয়ে যত কথা
লালনের একনিষ্ঠ শিষ্য দুদ্দুশাহ। তাঁর নাম নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে রয়েছে নানা বাকবিতণ্ডা। কোনটি আসল নাম—দুদ্দুশাহ না দুদ মল্লিক শাহ? এমন প্রশ্ন আমার মধ্যে নানা সময় নানা তথ্যানুসন্ধানের আশা জাগিয়েছে। তাঁর অনেকটা উত্তর খুঁজে পেয়েছি খোন্দকার রিয়াজুল হকের ‘লালন অনুগামী দুদ্দুশাহ’ প্রবন্ধে। তিনি সেখানে লিখেছেন—‘কথিত আছে তাঁর আসল নাম দবিরুদ্দীন। ফকিরী মত গ্রহণ করার পর তিনি দুদ মল্লিক শাহ বা সংক্ষেপে দুদ্দুশাহ নামে খ্যাত হন। ৮ এখানে গবেষক এস এম লুৎফর রহমান খোন্দকার রিয়াজুল হকের বরাত দিয়ে এই বাক্যের সঙ্গে ‘কেউ কেউ তাঁকে দুধ মল্লিক বিশ্বাস বলেও’ উল্লেখ করেছেন। এ লাইনটা কিন্তু আমরা খোন্দকার সাহেবের ‘লালন অনুগামী দুদ্দুশাহ’ প্রবন্ধে দেখতে পাই না। তাহলে ধরেই নিতে পারি লুৎফর রহমান তাঁর লেখাকে শক্তিশালী করার জন্য বা তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য খোন্দকার সাহেবের উক্তির সঙ্গে নিজের যুক্তি মিশ্রিত উক্তিটি করেছেন। খোন্দকার সাহেব তাঁর পিতার পরিচয় দিতে গিয়ে এই প্রবন্ধে বর্ণনা করেন—‘মোহাম্মদ ঝড়– মণ্ডল পিতা এবং কাকা জিন্দার আলী বিশ্বাস।৯ তাহলে এখানে আমাদের সবার প্রশ্ন হতে পারে বাবা ‘মণ্ডল’ এবং কাকা ‘বিশ্বাস’ হওয়ার কারনটা কী? খোন্দকার সাহেব একই প্রবন্ধে তাঁর জবাব দিয়ে বলেছেন—‘সম্ভবত তার পিতা নিরক্ষর ছিলেন। তাই তাঁর নামের শেষে ‘মণ্ডল’ শব্দ দেখা যায়। আর তাঁর কাকা লেখাপড়া জানতেন বলে ‘বিশ্বাস’ রূপে অভিহিত হন। এই রীতি আজো লালন দুদ্দুর জন্মভুমি অঞ্চলে প্রচলিত আছে।১০ এ মতটি লুৎফর রহমান তাঁর গ্রন্থে মেনে নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন এবং তিনি দুদ্দুর জন্মভুমিতে ক্ষেত্রানুসন্ধানে গিয়ে একই তথ্য পান। মরহুম শাহ লতীফ আফী আনহু দুদ্দুশাহের নাম সম্পর্কে লিখেছেন—‘দুদ্দুর পূর্ণ নাম দবীরুদ্দীন’ শাহ। তাঁর গানগুলোতে সর্বত্রই দুদ্দু এই ছোট্ট নামটি ভনিত হয়েছে’।১১ শিক্ষিত বা নিরক্ষর হলেই যদি সমাজের নিয়ম-রীতি অনুযায়ী মণ্ডল বা বিশ্বাস উপাধি ধারণ করতে হয়, তা হলে আমরা তথ্যসূত্র অনুযায়ী বলতেই পারি দুদ্দুশাহ শিক্ষিত ছিল এবং তাঁর নামের পরে ‘মণ্ডল’ না বসে ‘বিশ্বাস’ বসত। তবে আমাদের চিন্তার অবকাশ থেকেই যায় দুদ্দু শাহের নাম আসলে দবীরুদ্দিন না দুদ্দুশাহ কিংবা দুদ মল্লিক। কিন্তু এর সঠিক হদিস আজ এত বছর পরে এসেও কেউ কি দিতে পেরেছেন? আমারা দেখি যে, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া বা যশোরের বিভিন্ন জায়গা দুদ্দুশাহ লালন শাহের শিষ্য হিসেবে পরিচিত। এমনকি নিজস্ব গীতের অপরিসীম ক্ষমতা বলে লোকসঙ্গীতে সারা বাংলাদেশে দুদ্দুশাহ সুপরিচিত।
এ কথা বলতে পারি যে, দুদ্দু শাহের দুদু বা দুদ্দু পিতৃ প্রদত্ত নাম পরে লেখাপড়ার সূত্রে তাঁর নাম দবির উদ্দীন বা দুদ মল্লিক রাখা হয়ে থাকতে পারে। আমরা গ্রামে গঞ্জে দেখি যে, মানুষের নাম সঠিক করে বলা হয় না। তাঁরা মানুষের সঠিক নামকে বিকৃত করেও ডাকতে পারে, তেমনই দুদু নাম থাকলে তা পরবর্তী সময়ে দুদ্দুও হয়ে যেতে পারে। তিনি নিজের গীতেও তার পরিচিত নাম দুদ্দু বলেই উল্লেখ করেছেন। আমরা এখন এ সিদ্ধান্তে যেতে পারি যে, তার নাম যা কিছুই হোক না কেন, সে নিজের নাম নিজেই রেখে গেছেন তাঁর গীতের মধ্যে দিয়ে। তিনি এখন দুদ্দুশাহ নামেই সর্বদিকে সুপরিচিত।
পারিবারিক অবস্থা
অনেকে মত দিয়েছেন—দুদ্দুশাহের পারিবারিক অবস্থা অনেক মানসম্পন্ন ছিল। তা না হলে কি সে সময় কেউ কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হন? তবে আমরা রিয়াজুল হকের তথ্যমতে জানতে পারি, দুদ্দুর পিতা মোহাম্মদ ঝড়ু মণ্ডল একজন কৃষক ছিলেন। নিজের জমাজমির- আয় থেকে তিনি সংসার চালাতেন।১২ এই একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটে ড. আনোয়ারুল করিমের লেখাতেও।১৩ এ মতের পক্ষে কেউ কোনো জোরালো তথ্য দাঁড় করাতে পারেননি। কিন্তু এ সময় এসে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমরা খোন্দকার সাহেবের লেখার অন্য জায়গা দেখতে পাই পিতার আর্থিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল থাকার দুদ্দু বাল্যকালে বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ পান। তৎকালে হরিশপুর শ্রীনাথ বিশ্বাসের পাঠশালা বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। তাঁর পিতা তাঁকে সেই পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। ১৪ এ লেখা থেকেও আমরা বুঝতে পারি যে দুদ্দু শাহের পিতা একজন নিরক্ষর কৃষক হলেও সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন এমনকি সে সময় সমাজের অধিকাংশ মানুষই কৃষিক্ষেত্রে কাজ করতেন এবং সন্তানদেরকে কাজ করে খাওয়ার জন্য তাগিত দিতেন। কেননা সে সময় পেটের খাবারের জন্যই সবাই ব্যস্ত থাকতো। সেই সমাজ থেকে একজন কৃষক তাঁর ছেলেকে লেখাপড়া করানোর জন্য তাকে স্কুলে পাঠাচ্ছে এ থেকে বুঝতে হবে যে তাদের অবস্থা সমাজের আর চার পাঁচজন কৃষকের মত ছিল না।
তাদের অবস্থা একটু উন্নতই ছিল, যে কারণে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। এ থেকে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, সে সময় দুদ্দু শাহের পারিবারিক অবস্থা অনেক ভালো ছিল। তাকে সমাজের একজন মানসম্মত পরিবারের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
তথ্যসূত্র:
১। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য- বাংলার বাউল ও বাউল গান (২য় সংস্করণ কলিকাতা ১৩৭৮)
২। বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর বাউল কবি দুদ্দুশাহ (ঢাকা-১৩৭১)
৩। এস এম লুৎফর রহমান: দুদ্দুশাহ, বাংলা একাডেমী (সাল ১৯৮৯)
৪। খোন্দকার রফিউদ্দীন: ভাব সঙ্গীত, র্যামন পাবলিশার্স, চতুর্থ মুদ্রণ ২০১২
৫। লেখক কর্তৃক সংগৃহীত
৬। শাহ লতীফ আফী আনহু: বাউল কবি দুদ্দু শাহ, সমকাল, ৩য় বর্ষ ৮ম সংখ্যা (চৈত্র ১৩৬৬)
৭। এস এম লুৎফর রহমান: পূর্বোক্ত
৮। খোন্দকার রফিউদ্দীন: পূর্বোক্ত
৯। খোন্দকার রফিউদ্দীন: পূর্বোক্ত
১০। খোন্দকার রফিউদ্দীন: পূর্বোক্ত
১১। শাহ লতীফ আফী আনহু: পূর্বোক্ত
১২। খোন্দকার রফিউদ্দীন: পূর্বোক্ত
১৩। আনোয়ারুল হক: বাউল সাহিত্য ও বাউল গান (কুষ্টিয়া-১৯৭১)
১৪। খোন্দকার রফিউদ্দীন: পূর্বোক্ত