গ্রেগ ব্লিউয়েট নামে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট টিমের একজন ওপেনার ছিলেন। ওয়ানডেতে তেমন একটা ভালো না করতে পারলেও টেস্টে বেশ নাম করেছিলেন। পরিসংখ্যানের হিসাবে নয়, অনেকের মতে, একজন টেস্ট ওপেনারের যে যোগ্যতাগুলো থাকা দরকার, তার সবকটাই ব্লিউয়েটের মাঝে ছিলো। তার একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম কোনো একটা দৈনিকের খেলার পাতায়। বেশ বড়সড় সাক্ষাৎকার। পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল, রান তো অনেকেই করতে পারে কিন্তু ক্রিকেটীয় দর্শনের প্রতিফলন কয়জন ক্রিকেটারের মাঝে পাই আমরা! ব্লিউয়েট সেই সীমিত সংখ্যক টেস্ট ওপেনাদের একজন যিনি মনে করতেন, একজন ভালো টেস্ট ওপেনারকে জানতে হবে কোথায় তার অফস্ট্যাম্পটা আছে। ব্যাটসম্যানদের আরেকটা গুনের কথাও তিনি বলেছিলেন সেই সাক্ষাৎকারে, তা হলো, একজন ভালো ব্যাটসম্যানের পায়ের কুশলতা হওয়া চাই একজন নৃত্যশিল্পীর মতোই নিখুঁত এবং দ্রুত। বলকে ফেরাবে অথবা আঘাত করবে ব্যাট কিন্তু বলের কাছে ব্যাটসম্যানকে নিয়ে যায় তার পা। হুবহু না হলেও ব্রায়ান লারাও এমন একটা ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন অবসরে যাওয়ার পর এক সাংবাদিকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়। সেই আলাপচারিতার কিয়দংশও পড়া হয়েছিল কোনো একটা দৈনিকের খেলার পাতায়। তখন খেলার পাতাগুলো খুব মন দিয়ে পড়তাম। লারার কথাগুলো এখনো মনে আছে, লোভ সংবরণ না করতে পারলে ভালো ক্রিকেটার হওয়া যায় না। পরিসংখ্যানে অনেকেই লারার চেয়ে এগিয়ে আছেন ক্রিকেট বিশ্বে। তার যে দুয়েকটা রেকর্ড আজও টিকে আছে যেমন, টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস ইত্যাদি, এগুলো আরও অনেকদিন টিকে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। কেননা যত দিন যাচ্ছে ক্রিকেটের নান্দনিকতা থেকে ততই আমরা সরে আসছি। এখন টি-টুয়েন্টির যুগ। বিশ ওভারের খেলায় মরা পিচগুলো এভাবে তৈরি করা হয়। যেন বোলারদের ওপর তাণ্ডব চালাতে পারেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার মতো বিষয় হলো, ভালো বোলারের মূল্যায়নের কোনো ক্ষেত্র সেখানে নেই। ক্রিকেটের অর্ধেকটা ব্যাটিং হলে, অর্ধেকটা বোলিং। মানুষের সময় এখন কমে গেছে। পাঁচদিন গ্যালারিতে বসে টেস্ট ক্রিকেট দেখার ধৈর্য কারও নেই। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেও না। টেস্ট ক্রিকেট তো দূরের কথা পঞ্চাশ ওভারের ওয়ানডের সূর্যই তো প্রায় অস্তমিত হতে চলেছে। সবকিছু শর্টেন্ড হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনের কারণগুলোতে আমরা যদি ধরতে চাই তাহলে প্রথমেই আসবে যুগের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে মানুষের সময় কমে যাওয়া। নান্দনিকতার বোধ ক্ষয়ে যাওয়া এবং অতি অবশ্যই যুগের এই লক্ষণকে পুঁজি করে একটা ভোগবাদী ও পণ্যায়নসর্বস্ব যুগে আমাদের প্রবেশ।
এই কথাগুলো কেবল যে ক্রিকেটের জন্য প্রযোজ্য তা নয়। আমি মনে করি শিল্পের সব শাখার ক্ষেত্রেই কমবেশি কথাগুলোকে ফেলা যায়। বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে। কেবল বাংলাকবিতা নয় বিশ্বকবিতার বিবর্তনের দিকে যদি আমরা একবার তাকাই তাহলেই এটা আমাদের চোখে ধরা পড়ে যে, বিশাল যে ব্যাপ্তি ও পরিধি নিয়ে যে কাব্যধারার সূচনা হয়েছিলো তা আজ কলেবরের দিক থেকে ক্ষুদ্র হতে হতে একটা মিনিমাম জায়গায় এসে পৌঁছেছে। হ্যাঁ, আমি মনেকরি কবিতার বিবর্তনের যে সূক্ষ্ম ধারা সেটাও সাম্রাজ্যবাজ, পুঁজিবাদ, ভোগবাদ ও কর্পোরেট বাস্তবতার শিকার। একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো গত কয়েক বছরে কয়টি দীর্ঘ কবিতা আপনি পড়েছেন! আমার মনে হয় সংখ্যাটা এক বা দুইয়ের অধিক হবে না। আশঙ্কাজনক হলেও সত্যি যে, সংখ্যাটা শূন্যে নেমে আসাও অস্বাভাবিক হবে না। বরং এটার সম্ভাবনাই বেশি। পণ্যায়নের এই যুগে কবিতাকেই তো জাতীয় এবং বৈশ্বিক কালচার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। দুর্বোধ্যতা, বিচ্ছিন্নতাসহ নানারকম কারণ দাঁড় করিয়ে কবিতাকে কালচারের মূল ধারা থেকে বেশ দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তো, এই প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ কবিতা তো আরও বিপন্ন। আরও আশঙ্কাজনক দীর্ঘ কবিতার ভবিষ্যত। অথচ পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই কবিতার সূচনা হয়েছিলো দীর্ঘ কবিতার মধ্য দিয়েই। কি সংস্কৃত, কি ইংরেজি, কি জার্মান—অধিকাংশ ভাষার কবিতাধারার সূচনাই দীর্ঘ কবিতার মধ্য দিয়ে। আজকের সময়ে এসে আমরা সেই লেখাগুলোকে মহাকাব্য বলে চিহ্নিত করি। আমি মনে করি, কেবল আজকের কবিতা নয়, আজকের উপন্যাস, বা গল্প বা নাটক এমনকি সমালোচনা-সাহিত্যের বীজও ওই মহাকাব্যের মধ্যেই নিহিত ছিল। কালের পরম্পরায় বহুধাবিভক্ত হয়ে মহাকাব্যের দেহ থেকেই যেন আজকের সাহিত্য বিবর্তিত হয়ে এসেছে। কবিতার ক্ষুদ্র কলেবর নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। আফসোসের কিছু নেই। আপনি দেখুন বর্তমানের উপন্যাসও কি আসলে ওই যুগের মহাকাব্যের খুব নিকট প্রতিবেশি নয়! কেবল ছন্দধারা বা কনস্ট্যান্ট পোয়েটিক এপ্রোচের কথা বাদ দিলে আর তো কিছুই বদলায়নি। এখানেও মনে হয় আইনস্টাইনের সেই অমোঘ উচ্চারণের কথা, শক্তির ধ্বংস বা বিনাশ নেই, রূপান্তর আছে মাত্র। একশো প্রজন্ম পরেও যেমন একটা বংশের ধারা জীনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে ঠিক তেমনই সেই আদিকাব্যের ধারাও বর্তমান সাহিত্যের কমবেশি সব রূপেই বিদ্যমান। বিচ্ছিন্নতা এসেছে, বিশ্লিষ্টতা এসেছে, ক্ষুদ্রতা এসেছে। স্ফীত কলেবর ক্রমশ ক্ষয়ে এসেছে কিন্তু পোয়েটিক অ্যাপ্রোচ বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু ঠিকই প্রবহমান আছে।
কলেবরের কথা মাথায় রাখলে, আজকের যুগে যাকে আমরা দীর্ঘকবিতা বলি, তার প্রকৃত পূর্বসূরি হচ্ছে মহাভারত। একথা অস্বীকার করার যো নেই, যে সীমিত সংখ্যক মহাকাব্য নিজগুনে আজও টিকে আছে, ভাষাগত কৃষ্টির অনিবার্য অধ্যায় বা সূচনালগ্ন হিসাবে বিবেচ্য হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মহাভারত ছাড়াও, রামায়ন, ইলিয়াড, অডিসি, ঈনিড, বিউলফ, ডিভাইন কমেডি ইত্যাদি আছে। একটা আশ্চর্যজনক তথ্য পেলাম কয়েকদিন আগে যে কলেবরের দিক থেকে মহাভারত নাকি হোমারের সংযুক্তভাবে ইলিয়াড এবং অডিসির (দুটোতেই কমপক্ষে দুই লক্ষ বিশ হাজারের অধিক কাপলেট বা শ্লোক আছে এবং উভয়ের শব্দসংখ্যা ১.৮ মিলিয়নের চেয়ে বেশি বই কম নয়) প্রায় দশগুণ বড়, দান্তের ডিভাইন কমেডির চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বড় এবং রামায়নের চেয়ে প্রায় চারগুণ বড়। এত বিশাল ব্যাপ্তির ভেতরে হাজার হাজার আখ্যান, উপাখ্যান এক হয়ে মূলসুরটিকে ঠিকই সঙ্গত রাখতে পেরেছে। এটা অবশ্যই আশ্চর্য হওয়ার মতো একটা বিষয়। দৈর্ঘ্য বিস্মিত করে না। বিস্মিত করে এই বিশাল পরিধির মধ্যে একটাই মূলসুর অক্ষুণœ থাকার বিষয়টা। একজন কবির যোগ্যতা কোন পর্যায়ে গেলে এটা সম্ভব। উপন্যাসের কথাও বলা যেতে পারে। যেমন লিও টলস্টয়ের উপন্যাসগুলো একএকটা বিশাল আকৃতির। কিন্তু এই বিশাল আকৃতির ভেতরে কোথাও কোনো অসঙ্গতি নেই। এখানেই কবিতার সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটের অ্যানালজিটা খাপ খায়। যেন কত দীর্ঘ সময় ধরে নিবিষ্ট থাকা যায়, টানটান থাকা যায়, এগুলোই তখন রান তোলার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। বলের যোগ্যতা যাচাই করে খেলার নাম হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটিং। রান তোলাই টেস্ট ক্রিকেটে মূল কথা নয়। কখনো কখনো দুইএকটা সেশন বা একটা দিন টিকে থাকাই টেস্ট ক্রিকেটের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ায়। আমি মনে করি কবিতাধারাতেও কবির মূল যোগ্যতার পরিচায়ক হচ্ছে কনস্ট্যান্ট পোয়েটিক অ্যাপ্রোচ। দীর্ঘ কলেবরের ভেতর দিয়েই যা সহজে প্রতীয়মান হয়।
কলেবরের কথা বাদ দিয়ে এবার আসি সময়ের দৃষ্টিকোণে। সময়ের কথা বিবেচনা করলে গিলগামেশের মহাকাব্যই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো মহাকাব্য যাকে এখন পর্যন্ত পরিণত সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর রচনাকাল নিয়ে অবশ্য সংশয়ের শেষ নেই। কোথাও কোথাও পাওয়া যায় খৃষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ নাগাদ এই মহাকাব্য রচিত হয়েছিলো। কারো কারো মতে খৃষ্টপূর্ব ২১০০ অব্দ নাগাদ। যাই হোক, ২১০০ থেকে ১৮০০ বি.সি.-এর মাঝমাঝি রচিত হলেও এটাকেই ধরে নেয়া যায় পৃথিবীর প্রথম (এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত) মহাকাব্য। সুমেরীয়রা নাকি বলতো বিলগামেশ। আমরা এখন বলি গিলগামেশ। গিলগামেশের মূর্তি আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে এবং গিলগামেশের মহাকাব্যে বর্ণিত কিছু চরিত্র এবং ঘটনার স্মারক বহন করার কারণে ঐতিহাসিকরা গিলগামেশকে একজন ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবেই গণ্য করেন। ইতিহাসের কথা বলা আমার লক্ষ্য নয় বলে সেদিকে আর নাই বা গেলাম। তো, দেখা যাচ্ছে প্রায় চার হাজারের বেশি বছর ধরে মহাকাব্যের ধারাটি টিকে আছে। অবশ্য একথা অস্বীকার করার যো নেই, আজ আমরা যেসকল কবিতাকে দীর্ঘ কবিতা আখ্যায়িত করি তার সাথে সেই আদি যুগের মহাকাব্যের বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বসাহিত্যে এবং বিশেষত বিশ্বকবিতার বলয়ে ঘটে গেছে নানা তত্ত্বের প্রয়োগ। মূখ্য গৌণ নির্বিশেষে সেইসব তত্ত্বের প্রতিফলনেই হয়তো একটু একটু করে মহাকাব্যের ধারা থেকে আজকের দীর্ঘ কবিতা পৃথক হয়ে গেছে কেননা মহাকাব্যের যে ঐতিহাসিক (!) পটভূমি বা জাতীয় বিষয়ের সিলেকশন, বা আখ্যানধর্মিতা এবং উপাখ্যানসংযুক্তি কোনোটাই আজকের দীর্ঘ কবিতায় সেই মাত্রায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই প্রসঙ্গে মার্ক স্ট্রান্ডের একটা বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ছে, যদিও সেই কবিতাটি দীর্ঘ নয়। অতিক্ষুদ্রই বলা চলে। আসুন চোখ রাখা যাক সেইদিকে, In a field/I am the absence/of field./This is/ always the case./ Wherever I am/I am what is missing/ When I walk/I part the air/and always/the air moves in/to fill the spaces/Where my body’s been./ We all have reasons/for moving./I move/to keep things whole. (Keeping Things Whole/ Mark Strand.) দীর্ঘ কবিতার কথা বলতে গিয়ে ক্ষুদ্র কবিতার আশ্রয় কেন নেওয়া! কারণ থিংস ফল অ্যাপার্ট। এটাই সম্ভবত বিবর্তন। এটাই সম্ভবত অভিযোজন। আপনি যখন কোনো পথে হেঁটে যাবেন প্রতিটা মুহূর্তেই, প্রতিটা পদক্ষেপেই আপনার গত মুহূর্তের স্থান ভরে দেবে বাতাস। কোনো কিছুই শূন্যতা রাখে না। কোনো না কোনোভাবে তা পূর্ণ হয়ে যায়। যেমন মহাকাব্যের যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি আর সেই স্থান দখল করে নিয়েছে বিবিধ সাহিত্যধারা যার একটা অংশের নাম কবিতা।
এখানে একটা কথা আবার বলি, অধিকাংশ ভাষার সাহিত্যধারার সূচনাই হয়েছে মহাকাব্য বা মহাকাব্যধর্মী রচনা দিয়ে। কিন্তু বাংলা কবিতার আদিমতম নিদর্শন হিসাবে এখনও যা আমাদের হাতে আছে তা হলো চর্যাপদ। এই চর্যাপদ কিন্তু কোনো মহাকাব্য নয়। ভাষার উদ্ভবের দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে হয়তো বলবেন, বাংলা হলো সংস্কৃতজাত ভাষা। এটা তো সত্য। কিন্তু ভাষা হিসাবে বাংলার পৃথক হওয়ার ধাপগুলোও অস্বীকার করা যায় না। যেমন অস্বীকার করা যায় না, বাংলাভাষার উন্মেষের সময়কালেই এই ভাষা তার নিজস্ব সাহিত্যে বেলায় মহাকাব্যের দিকে ঝুঁকে পড়েনি। বরং একপ্রকার সংকলনধর্মী কাব্যিক রচনার মধ্য দিয়েই তার যাত্রা শুরু। সেই হিসাবে ধরলে বাংলা কবিতার সহজাত ট্রেন্ড হচ্ছে ক্ষুদ্র কবিতা এবং সংকলনধর্মিতার দিকে। সাহিত্য একটা রিলেটিভ বিষয়। একেক জনের কাছে তা একেক রকম অর্থ ধারণ করে। ইঙ্গিত করে। সুতরাং সবাই যে আমার সাথে একমত হবেন এমনটা আমি আশা করি না। আশা করা উচিৎও হবে না। কেননা আমি আর যাই হই বাংলা ভাষা বা বাংলা কবিতার গবেষক নই। আমি কবিতা লিখি। সাহিত্যের ধারাগুলোর মধ্যে কবিতাই আমার কাছে সবচেয়ে নান্দনিক। ফলে আমার পাঠ অনেকটা আত্মশিক্ষা-ধারার পাঠ। নিজেকে বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারার সাথে পরিচিত করে নেবার জন্য যেটুকু সামান্য প্রস্তুতি দরকার আমি কোনোদিন তার বাইরে যেতে চাই নাই। অনেকে আছেন বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের গবেষক। তাদের সঙ্গে কোনোপ্রকার বাদানুবাদ বা তর্কে যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমি ততটুকু চাই যতটুকু, আমার মনে হয়, কবিতা রচনার জন্য জরুরি। ফলে গবেষকদের সঙ্গে আমার একটা মতপার্থক্য তৈরি হতেই পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দৃষ্টিকোণ একান্তই আমার। এখানে পাণ্ডিত্য দেখানো বা বোঝানোর কোনো চিন্তা নেই।
________________________________________________________________________________________________
ওয়েইস্ট ল্যান্ড নিয়েও প্রচুর কথা হয়ে গেছে। সাহিত্যমনষ্ক কারোরই হয়তো এই কবিতা সম্পর্কে জানার তেমন একটা বাকি নেই। তাই ওইদিকেও আমি যাবো না। বরং আমি গত কয়েক বছরে আমার পড়া কিছু দীর্ঘ কবিতা নিয়ে কথা বলতে চাই। অবশ্যই এই কবিতাগুলো আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষার দীর্ঘ কবিতার সাম্প্রতিক ধারাকে সমর্থন করে। তবে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে শুরুর আগেও একটা শুরু থাকে। লাফ দেয়ার আগে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করার বিষয় থাকে।
_________________________________________________________________________________________________
তো, এটা বলা যায় উন্মেষের কাল থেকেই বাংলা কবিতা বিশ্বের অনেক ভাষার কবিতার থেকে একটা পার্থক্য রেখে যাত্রা শুরু করেছিলো। আমি মনে করি সেই ধারা এখনও সচল। এখনও বাংলা কবিতা দীর্ঘ কবিতার চেয়ে ক্ষুদ্র কবিতার দিকেই তার পক্ষপাত বজায় রেখেছে। যদিও এর মাঝেই বাংলা কবিতায় বেশ কিছু ভালো দীর্ঘ কবিতা রচিত হয়ে গেছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে বাংলা কবিতার মধ্যযুগ তো একরকম দীর্ঘ কবিতারই যুগ। সেখানে ক্ষুদ্র কবিতার উপস্থিতি খুব সামান্য। নিতান্তই নগণ্য। আধুনিক সময়-বলয়ে প্রবেশের পরও বাংলা কবিতা বেশ কিছু ভালো দীর্ঘ কবিতা পেয়েছে। এরমাঝে যারা এতদিনে টেক্সটের মর্যাদা পেয়ে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ। তার বিষয়ে এত কথা এত গবেষণা হয়ে গেছে যে বর্তমান অনুষঙ্গে কবিতার কথা বলতে হলে সেখানে যদি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টানা যায় তাহলে বিবিলিওগ্রাফির তালিকাই একফর্মার বেশি হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি বরং জীবনানন্দ থেকে আরম্ভ করি। যদিও সময়কালের হিসেবে, এবং খানিকটা প্রবণতার হিসাবেও মাইকেলের সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যে বিশেষত কবিতায় আধুনিকতার সূচনা হয়েছে বলা ধরা হয় কিন্তু প্রকৃত অর্থে পাশ্চাত্যঘেঁষা যে আধুনিকতার ধারা আমরা এখনো বহন করে চলেছি তার প্রকৃত প্রতিফলন শুরু হয় জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত প্রমুখ কবির হাতে। তাদের নিয়ে ড. দীপ্তি ত্রিপাঠীর ডক্টরাল থিসিস যা পরে পৃথক গ্রন্থ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় নামে, আমি মনে করি সেই গ্রন্থেই প্রথম আলাদাভাবে এবং বিশ্লেষণধর্মিতার মধ্য দিয়ে ওই সময়ের অর্জন এবং স্বাতন্ত্র্যের রেখাগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে ধরা হয়েছিল। আজকের প্রেক্ষাপটে যাকে আমরা দীর্ঘ কবিতা বলি সেই কনসেপ্টের দীর্ঘ কবিতার যাত্রা শুরু ওই জীবনানন্দ-সুধীনদত্তদের হাতেই। দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে যা অনেকটাই সীমিত এবং মহাকাব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দূরত্ব রেখেই যার পথচলা। শুধু বাংলা কবিতা নয়, ইংরেজি কবিতায়ও ঊনবিংশ শতাব্দিতেই বর্তমান ধারার দীর্ঘ কবিতার সূচনা। এবং আমি মনে করি, আধুনিক কবিতাধারায় সবচেয়ে সফল দীর্ঘ কবিতা হলো এলিয়টের দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড। এই ওয়েইস্ট ল্যান্ড নিয়েও প্রচুর কথা হয়ে গেছে। সাহিত্যমনষ্ক কারোরই হয়তো এই কবিতা সম্পর্কে জানার তেমন একটা বাকি নেই। তাই ওইদিকেও আমি যাবো না। বরং আমি গত কয়েক বছরে আমার পড়া কিছু দীর্ঘ কবিতা নিয়ে কথা বলতে চাই। অবশ্যই এই কবিতাগুলো আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা ভাষার দীর্ঘ কবিতার সাম্প্রতিক ধারাকে সমর্থন করে। তবে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে শুরুর আগেও একটা শুরু থাকে। লাফ দেয়ার আগে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করার বিষয় থাকে। সেই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আমি জীবনানন্দের কাছে ফিরে যেতে পারি। জীবনানন্দের অন্যতম মৌলিক একটি দীর্ঘ কবিতা হলো আট বছর আগের একদিন, যে কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের কান্ত করে।… লাশকাটা ঘরে সেই কান্তি নাই। এই কবিতাতেই তিনি আরও উচ্চারণ করেছিলেন, যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা। এমন অদ্ভুত সুন্দর কিছু কথা যে কথাগুলোর ভেতরে কাসিকে পরিণত হবার শক্তি ছিল। এবং আমরা দেখি সত্যিই তাই হয়েছে। জীবনানন্দ অনস্বীকার্যভাবে রবীন্দ্রপরবর্তী শেষ ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছেন অগণিত পাঠকের কাছে। এমন কিছু বহুল পঠিত এবং চর্চিত দীর্ঘ কবিতা তো তার আছেই। অবসরের গান, অন্ধকার, শিকার ইত্যাদি কবিতা নিয়েও আলোচনা করা যায়। কিন্তু আমার মনে হয়, কেবল আবহ বা প্রেক্ষাপট বর্ণনার ভেতর দিয়েও যে মহৎ কবিতার জন্ম হতে পারে তা তিনি দেখিয়েছেন তার রূপসী বাংলায়। বাংলার প্রকৃতি এবং বাংলার প্রকৃতিই সাধারণভাবে বলতে গেলে এই কবিতার প্রধান উপজীব্য। শুধু তার দৃষ্টিকোণ থেকেই উঠে আসে বাংলার প্রতি অকৃত্রিম প্রেম, ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভূতি। আলাদা আলাদাভাবে একে পাঠ করা হলেও আমি মনে করি একটি একক দীর্ঘ কবিতা কেননা দীর্ঘ কবিতার মধ্যে আমরা সাধারণত যে মূলসুরের সন্ধান করি তা এই কবিতাটির সবগুলো অংশেই বিরাজমান। এখনও বলা চলে, দৃষ্টিকল্পধর্মীতার কথা মাথায় রেখে, হালের বাংলা কবিতাও সেই রূপসী বাংলার রেশ এবং আঙ্গিকগত কাঠামোই বহন করে যাচ্ছে। এছাড়াও দীর্ঘ কবিতার প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নামও অবধারিত ভাবে উঠে আসে। উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের কবি মলয় রায় চৌধুরীর জখম কবিতাটির কথাও। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো, জখম কবিতাটিকে অনেকে অ্যালেন গীন্সবার্গের হাউল কবিতার অনুপ্রাস হিসাবে গণ্য করেন। তা তারা করতে পারেন। ইন্সপিরেশনের জায়গা একজন কবির থাকতেই পারে। জীবনানন্দও তার অনেক কবিতা এহেন ইন্সপিরেশনের মাধ্যমেই রচনা করেছিলেন। জীবনানন্দের সর্বাধিক পঠিত (সম্ভবত) বনলতা সেন কবিতাটিও তো অ্যালান পো’র টু হেলেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসি গ্রে, কিটসের অন রিডিং চ্যাপম্যানস হোমার কবিতাগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত। অনুপ্রেরণার জায়গা একজন কবির মননে থাকতেই পারে। তবে তা যদি আক্ষরিক অনুবাদের মতো হয়ে যায় তাহলেই সমস্যা। আমি মনে করি জীবনানন্দের বনলতা সেন সেই দোষে দুষ্ট। কিন্তু তবু বনলতা সেনের মহত্ব কোথাও খাটো হয় না। বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম সফল কবিতা এটি এবং এই কবিতাটির বিশ্ববীক্ষার পেছনে হয়তো মূল শক্তি সেই কবিতাগুলোই যেগুলোর নাম আমি কিছুক্ষণ আগেই বললাম।
জীবনানন্দ দাশ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণুদের পর আসে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের নাম। একই সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকও উচ্চারিত হতে হয়। শামসুর রাহমানের ডেডেলাস, ইকারুশের আকাশ, আল মাহমুদের সোনালি কাবিন, সৈয়দ হকের বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা ও পরানের গহিন ভেতর এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কবিরাও কম বেশি দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। তাদেরই সমসাময়িক বিনয় মজুমদারের কথাও বলা যায়। ফিরে এসো চাকার দীর্ঘ পটভূমি পাঠককে মাহাবিষ্ট না করে পারে না। এরপর যার নাম উচ্চারণ করতে হয়, তিনি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লা। তাঁর মানুষের মানচিত্র, ইশতেহার বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
এতক্ষণ যাদের নাম উল্লেখ করা হলো, তারা কেউ ঘোষণা দিয়ে দীর্ঘ কবিতা রচনা করেননি। দীর্ঘ কবিতার ঘোষণা দিয়ে যিনি এর পক্ষে কলমও ধরেছেন, তিনি শিমুল মাহমুদ। তার সাদা ঘোড়ার স্রোত দীর্ঘ কবিতার পটভূমিতে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি।
হেনরী স্বপন কবিতায় মিতভাষী। সাধারণত ক্ষীণাঙ্গী কবিতা রচনায় তিনি নিবিষ্ট। কিন্তু এই কবিও দীর্ঘ কবিতা চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ কবিতা হলো, কীর্ত্তনখোলা। দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন রহমান হেনরীও। এমনকি এই কবি দীর্ঘ কবিতা বিষয়ে নিজের ভাষ্যও লিখেছেন। তবে, গত কয়েক বছরে আমি যে কয়টি ভালো দীর্ঘ কবিতা পড়েছি, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কবি মজনু শাহ্-এর মধু ও মশলার বনে। ২০০৬ সালে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। ভাই হারানোর বেদনা দিয়ে এই কবিতার শুরু। এই দীর্ঘ কবিতাটির ভূমিকার দিকে একবার তাকানো যাক কেননা ভুমিকার মধ্য দিয়েই কবি অনেকটা প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের, তার কবিতার প্রেক্ষাপটের সাথে।
আলী ছিল পরিবারের প্রথম পুত্র, আমার ভাই। এই নিষ্ঠুর এবং একই সঙ্গে
মধুধূলিময় পৃথিবীতে সে মাত্র সাতদিনের পরমায়ু পেয়েছিলো। তার কবরটুকু
পর্যন্ত এখন চিহ্নিত করা যায় না, এতটাই বিস্মৃত সে।
‘অঘ্রাণের পথে পায়চারী করা মানুষের হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও
আছে?
—এই প্রশ্ন ও বিভ্রমের ধূলি কখনো কখনো আমায় ঘিরে ফেলে, শত্রুর মতো।
মনে হয়, নক্ষত্র বা পাতালে নয়, এক অচেনা বায়ুপ্রবাহের মধ্যে কোথাও আজ
সে মুদ্রিত হয়ে আছে— নিচে, বিস্তীর্ণ মশলা বন। সেখানে বসে বসে কী করে
সে? হাওয়ায় গেরো দেয়? ফাঁদ পাতে নাকি আয়ুষ্মানদের জন্যে?
আলীকে দেখিনি আমি, কোনো ফটোগ্রাফও না-থাকায় তার রূপ কল্পনাতীত।
এই ত্রুটিপূর্ণ লেখা, ডালা-খোলা উড়ন্ত কফিন হয়ে তাকে অনুসরণ করছে।
এই ভূমিকাটুকু পাঠের পরেই পাঠক অনেকটা প্রস্তুত হয়ে যায় শোক আর বেদনা-বিহ্বল এক কবিতায় যাত্রার জন্যে। এই প্রস্তুটিটুকু অনেকসময়ই পাঠককে সহায়তা করে কবিতার সাথে একাত্ম হবার জন্যে। এখানে বলে রাখা ভালো, যারা কবিতায় কেবল মানে মানে করেন, অর্থ বা পরমার্থের খোঁজ করে বেড়ান- আমি তাদের দলভূক্ত নই। দশ চরণের কবিতা থেকে বিশ শব্দের সারাংশ বা দুই চরণের কবিতাংশ থেকে ভাবকে সম্প্রসারিত করার যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি। আমি বলছি না সেগুলো কবিতা নয়। অবশ্যই কবিতা। কিন্তু প্রেক্ষাপটের বিচার বিশ্লেষণ এবং সঙ্গতির বিষয়টাও মাথায় রাখা দরকার। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আছে যেগুলো পড়লে আজ বালখিল্য মনে হয়। কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথ বালখিল্য হয়ে যান না। ভাবকে সম্প্রসারিত করতে পারলেই বা সারকে অংশে টেনে নামাতে পারলেই তা কবিতা, অন্যথায় নয়, এটা আমি বিশ্বাস করি না। কবিতা কেবল জ্ঞাতকথার বিবরণ নয়, কবিতায় একই সাথে মিশে থাকে চেতন-অবচেতন-অচেতন। ফলে আজকের সময়ে যদি কেউ মনে করেন যে বিশাল কোনো ঘটনার আখ্যানধর্মী বিবরণ দিয়ে দীর্ঘ কবিতা রচিত হবে, তাহলে বলতে হবে বাংলা কবিতার বা বিশ্ব কবিতার বিবর্তনের সাথে তিনি পরিচিত নন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েক বছর আগে আমার কথা হয়েছিলো এমন একজন লোকের সাথে যিনি কবিতা না লিখলেও পড়াশোনা করেন। কবিতা নিয়ে তার পড়াশোনা কেমন আমি জানি না। জানার ইচ্ছাও ছিলো না। কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে যখন তিনি বলে বসলেন, এখনকার কবিতা আমি বুঝি না। সব শব্দবাজী। কবিতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বোধ্য করে তোলা। তার এই কথাটা আমাকে বেশ আহত করলো। কেন করলো সেটাও অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়। আমিও কবিতা লিখি। বর্তমান সময়েই লিখি। হয়তো এই কারণেই কথাটা আমাকে বেশ আহত করলো। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কী বোঝেন? তিনি উত্তর দিলেন, যা পড়ি সব বুঝি। কিন্তু কবিতা এখনকার কবিতা বুঝি না। আবার তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি আসলে কী? সে বললো, আমি মানুষ। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, মানুষ কী? এবার ভদ্রলোক খানিকটা বিস্মিত হলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উত্তর দিলেন, মানুষ আবার কী, মানুষ হলো মানুষ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষের অর্থ কী? এবার তিনি হয়তো আমার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে খানিকটা পিছু হটে গেলেন। বললেন, মানুষ আর কবিতা এক জিনিস না। হ্যাঁ, তার সাথে আমি একমত যে মানুষ আর কবিতা এক জিনিস না। মানুষ যেমন তার নিজের কোনো অর্থ জানে না, কবিতাও কবিতার অর্থ খোঁজে না, আমি বললাম। ১৯২২ সালে রচিত হবার পর থেকে এলিয়টের দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড এখনও পঠিত হচ্ছে, আমি কাউকেই বলতে শুনলাম না যে সে কবিতাটা সম্যক বুঝেছে। তারমানে কি এই যে এলিয়ট কবিনামধারী শব্দবাজ মাত্র। ভদ্রলোক বোধকরি এলিয়টের কবিতার সাথে ততটা পরিচিত নন। পিছু হটতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম, বাদ দিন এলিয়টের কথা, জীবনানন্দের কথা বলি, তার কোন কবিতাটা আপনি সম্যক বোঝেন? ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। আজকের সময় হলে হয়তো আমি ভদ্রলোকের সাথে এভাবে কথা বলতাম না। তিনি তার বিশ্বাস নিয়ে থাকুন। আমি আমার। এমন একটা ভাবনা থেকেই হয়তো এইসব আলোচনা থেকে দূরে থাকতাম। আমি বিশ্বাস করি কবিতায় কনটেন্ট এবং স্টাইল দুটোই জরুরী। আমরা যখন কোনো রবিশংকরের সেতার শুনি তখন কি সেই সুরের অর্থ খুঁজতে যাই। নাকি পাহাড়চূড়ায় উঠে অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্তের অর্থের সন্ধান করি। যদি না করি তাহলে কবিতার কাছে গিয়েই কেন বার বার অর্থ, অর্থ বলে চিৎকার চেঁচামেচি। এসব তারাই করেন যারা কবিতার বিবর্তনের সাথে অপরিচিত। এটা আমি অস্বীকার করবো না, কবিতার নামে কেউ কেউ শুধু শব্দবাজী করে থাকে। টুকরো টুকরো চিত্রকল্প বা কথার চমক দিয়ে থেমে যাওয়া লেখাগুলোকে আমারও কবিতা বলতে বাধে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই কথাকে সত্য বলে ধরে নেয়া যায় না। কবিতায় ভাব বা চিন্তার জায়গা সব সময়ই ছিলো, আছে, থাকবেও। কবিতার নান্দনিকতা মানে কেবল ভাষার নান্দনিকতা নয়, ভাব বা চিন্তারও নান্দনিকতা। রবার্ট ফ্রস্ট সম্ভবত বলেছিলেন, কবিতা তাই যা অনুবাদে হারিয়ে যায়। আমি বলি, কবিতার ভাব হলো তা, যা অনুবাদের পরও টিকে থাকে। অনুবাদের সাথে সাথেই ভাষার নান্দনিকতা অনেকটা হারিয়ে যায়। যেটুকু টিকে থাকে তাও যেন কবির ভাষার নান্দনিকতা নয়, অনুবাদকের ভাষার নান্দনিকতা। যদিও সেই অনুবাদকের ভাষার প্রেরণার জায়গায় কবির ভাষাই বসে থাকে। তাকে অনুবাদে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু কবিতাস্থিত চিন্তা সেই শক্তির নাম, ভাষা নির্বিশেষে যার নান্দনিকতা সমান। তাই হয়তো বহুবছর আগে ম্যাথু আর্নল্ড বলেছিলেন, স্টাইলের উৎকর্ষের সাথে কনটেন্টের উৎকর্ষতার সমন্বয় থাকে মহৎ কবিতায়। যাই হোক, আমরা ফিরে আসি মজনু শাহ-এর মধু ও মশলার বনে।
অনেক দূরের কেউ হয়ে গেছে সে যে আজ,
তবু আলী আলী বলে বহু বার
ডাকলাম তাকে।
আমার এ ডাক
যতদূর সত্য
যতদূর হেঁটে এসে ভুলগুলোকেই
পরম আত্মীয় বলে মনে হয়,
জেনে গেছি এমন অনেক সত্য
একদিন তার মধুঘুম
আর পুড়ে যাওয়া মশলা বনে ঢুকে।
যতদূর আমরা বুঝি ভাই হারানোর মিশ্র অনুভূতির কথা নিয়েই এই কবিতা রচিত বলে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা পেয়েছি তার ভূমিকায়। কিন্তু একবার খেয়াল করে দেখুন ওই ভূমিকাটুকু যদি আমাদের পড়া না থাকে, আর এই কবিতাটির প্রথম দুই চরণ আমরা বাদ দিয়ে কবিতাটি শুরু করি, তাহলে এক ধোঁয়ার জগতে যেন আমাদের প্রবেশ ঘটে। আমরা পাই কিছু চিত্রকল্প। নস্টালজিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি। আর অন্য কারো মধুর মতো স্বাদু ঘুমের জগত আর পুড়ে যাওয়া মশলার বনে ঢুকে পড়ে আমাদের মন। কিছুক্ষণ আগেই যে বললাম, আজকের দীর্ঘ কবিতা বলতে আমরা যা বুঝি তা প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রউত্তর বা এমনকি আশির দশকের দীর্ঘ কবিতার কনসেপ্টের সাথেও মিলবে না। শুধু দীর্ঘ কবিতা নয়, ছোট কলেবরের কবিতার বেলায়ও এই কথা প্রযোজ্য। তখনকার কবিতাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল বিষয়টাকেই ফোকাস করা হতো। একটি বৃত্তের সাথে তুলনা করলে সম্ভবত আরেকটু কিয়ারলি বলতে পারবো। এ যেন একটি বৃত্তের পরিধি থেকে ব্যাসার্ধ ধরে কেন্দ্রের দিকে যাত্রা। একেকবার পরিধির একেক বিন্দু থেকে। ফলে ওই সময়কার দীর্ঘ কবিতাগুলোতে থাকতো বিষয়ের কেন্দ্রায়ন। কিন্তু গত কয়েকবছরে আমি যে দীর্ঘ কবিতাগুলো পড়েছি, সেগুলোর প্যাটার্নে মনে হয়, প্রক্রিয়াটা যেন সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। আগে পরিধির যেকোনো বিন্দু থেকেই যাত্রা শুরু হোক না কেন, যাত্রার লক্ষ্য হতো কেন্দ্র, এই কেন্দ্র মানে বিষয়ের কেন্দ্র। ফলে একটা দীর্ঘ কবিতায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থাকলেও যাত্রাগতিপথ ছিলো একটা বিষয়ের দিকেই। ফলে তৈরি হতো লক্ষ্যের অভিন্নতা। যারা এলিয়েটর দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড পড়েছেন তারা জানেন নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়াবহতাকে তুলে ধরার জন্য তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ কবিতাটিতে আরোপ করেছেন। কখনো পারভার্টেড পারসনের, কখনো টাইরেসিয়াসের, কখনো জলে ডুবে মৃত্যুর এবং আরো আরো। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিলো একটাই। কী সেটা? আধুনিক যুগের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে মানবিকতার বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা। কিন্তু এখনকার দীর্ঘ কবিতাগুলো যেন, একটা বিষয় থেকে শুরু হয় মাত্র। অর্থাৎ যাত্রা শুরু হয় একটা বিষয় থেকে এবং গতি ধারা থাকে পরিধির দিকে। অথচ আগের কবিতাগুলোতে যাত্রাগতির দিক ছিলো কেন্দ্র অভিমুখী। আর এখন পরিধিমুখী। ফলে একটা নির্দিষ্ট বিষয় থেকে শুরু হলেও কিছুক্ষণ পরেই যেন আর সেই বিষয়ের অনুপ্রাস থাকে না। আমি ইচ্ছা করেই অনুপ্রাস শব্দটি ব্যবহার করছি কেননা এই শব্দের অর্থের মধ্যে রিপিটেশনের একটা ব্যাপার থাকে। ফলে কবিতা হয়ে গেছে ফ্র্যাগমেন্টাইজড। যেকোন অংশ থেকেই আপনি শুরু করতে পারেন। আদ্যপান্ত পড়া শেষ করে আপনি কিছু দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন যে দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর গতিপথ কখনোই কেন্দ্রের দিকে নয়। পরিধির দিকে।
_________________________________________________________________________________________________
যদিও কবিতার মেথড হচ্ছে হচ্ছে ভাষা। সাধারণ মানুষের ভাষা। রোমান্টিক যুগের সূচনালগ্ন থেকেই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে কবিতার ভাষাকে। ভাষাও এসেছে। কিন্তু একজন সাধারণ পত্রিকা পাঠকের কাছে ভাষা যেভাবে নিজেকে উন্মোচিত করে, সেই পাঠকের কাছেই কবিতার ভাষা ঠিক সেইভাবে নিজেকে উন্মোচিত করে না। ফলে পাঠক ভাবেন, এ হলো দুর্বোধ্য, বোঝা যায় না, আর পড়বো না।
_______________________________________________________________________________________________
পূর্বের দীর্ঘ কবিতায় দৃষ্টিকোণের যাত্রাপথ ছিলো বিষয়ের (বৃত্তের বেলায় যেমন কেন্দ্র) দিকে; আর এখন বিষয় থেকে পরিধির দিকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পাঠকের মনে হতে পারে নতুন নতুন কবিতা বুঝি একই ব্যানারে এনে যুক্ত করা হলো। কিন্তু ব্যাপারটা এমন না। টোনের সিমিলারিটি থাকে। অ্যাপ্রোচের সিমিলারিটি থাকে। এবং সর্বোপরি সিমিলারিটি থাকে পরিপ্রেক্ষিতের। কবিতার সাথে ভালো বোঝাপড়া না থাকলে এই ব্যাপারগুলো ধরা একটু কঠিন হয়ে পড়ে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, কবিতাও একটা প্রফেশনাল এক্সপার্টাইজের বিষয়। যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কোনো ছাত্রকে যদি চিকিৎসাবিদ্যার উপর ইংরেজি ভাষায় রচিত কোনো গ্রন্থ দিয়ে বলা হয়, পড়ে বোঝাও তো দেখি, কী লেখা আছে এতে? ইংরেজির ছাত্রের পক্ষে বোঝানোটা কঠিন হবে। আবার মেডিকেলের কোনো ছাত্র সেক্সপিয়রের কোনো নাটকের সংলাপ নাও বুঝতে পারে কেননা প্রতিটি বিষয়ের টার্মিনোলজি আলাদা। এখানেই নির্ভর করে কুশলতার বিষয়টি। প্রত্যেকের আলাদা। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বেশিরভাগ ডাক্তারের হাতের লেখা প্রেসক্রিপশান আমরা পড়তে পারি না। কিন্তু কোনো ঔষধের দোকানে যান, তারা ঠিকই পড়তে পারে। তারা হয়তো ঔষধের নামের ডাইমেনশনটা দেখেই বুঝতে পারে ডাক্তার কোন ঔষধের কথা লিখেছেন প্রেসক্রিপশনে। আমি যেটা বোঝাতে চাইছি তা হলো, প্রত্যেকটা বিষয়ের একটা আলাদা ভাষা বা, আরো ভালোভাবে বলতে গেলে মেথড অব কোডিং থাকে, যারা সেই মেথডের সাথে পরিচিত কেবল তারাই কোডটা ধরতে পারে। আমি মনে করি না, কবিতাও এর ব্যতিক্রম। যদিও কবিতার মেথড হচ্ছে হচ্ছে ভাষা। সাধারণ মানুষের ভাষা। রোমান্টিক যুগের সূচনালগ্ন থেকেই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে কবিতার ভাষাকে। ভাষাও এসেছে। কিন্তু একজন সাধারণ পত্রিকা পাঠকের কাছে ভাষা যেভাবে নিজেকে উন্মোচিত করে, সেই পাঠকের কাছেই কবিতার ভাষা ঠিক সেইভাবে নিজেকে উন্মোচিত করে না। ফলে পাঠক ভাবেন, এ হলো দুর্বোধ্য, বোঝা যায় না, আর পড়বো না। কিন্তু আমরা দেখি ইংরেজি ভাষার ছাত্র বা শিক্ষক হওয়ার পরও ইংরেজি ভাষায় রচিত মেডিকেলের গ্রন্থ তারা পড়তে পারেন না। তারমানে ভাষা এক হলেই হয় না। টার্মিনোলজির ব্যাপার থাকে। এপ্রোচের ব্যাপার থাকে। নানান ধরণের কলাকৌশল থাকে। জাতীয় বা বৈশ্বিক কালচারের অংশ হিসাবে কবিতা গত চার হাজার বছরে যে মেথড অব কোডিং গড়ে তুলেছে তার সাথে ন্যূনতম পরিচিতি না থাকলে একজন পাঠক আজকের কবিতা বুঝতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক। কবিতার বিবর্তনের সাথে কলাকৌশলগুলোর সাথে তার মিনিমাম পরিচিতি থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ, এলিয়টের কথা ধার করেই বলতে হয়, মহৎ কবিতা বোধ্য হবার আগেই পাঠকের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম। কিন্তু এখানে পাঠক বলতে আমি কাকে বোঝাবো? সেই পাঠক যে পাঠ্যপুস্তকের কবিতার বাইরে আর কোনো কবিতা পড়েনি? অথবা সেই পাঠক যে তার পাঠ্যতালিকার বাইরে কেবল পত্রিকার ভাষার সাথে পরিচিত? কাকে বোঝানো যায় পাঠক বলতে! এখানেই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পাঠকেরও নানান রকম থাকে। কবিতার পাঠক বরাবরই কম। যারা প্রকৃতই কবিতার পাঠক তারা কেবল বোঝার জন্যই কবিতা পড়েন না। কবিতার সাথে একাত্ম হবার জন্যও পড়েন।
আমার এক শিক্ষক আক্ষেপ করে বলতেন, আজকালকার টিভি নাটকগুলোতে শিক্ষার কোনো বিষয়ই থাকে না। তখন আমি উচ্চ-মাধ্যমিকে। একদিন তাকে বলেছিলাম, স্যার, নাটক নির্মাতারা কি আপনার শিক্ষক নাকি যে তারা আপনাকে শিক্ষিত করে তুলবে। তারপর অবধারিতভাবেই আমার উপর বর্ষিত হয়েছিলো অযুত বাক্যবাণ। আমি বৃক্ষের মতো নীরবে সয়ে গেছি। আজ হলে হয়তো বলতাম, স্যার, জীবন কেবল শিক্ষার নয়, সমঝোতারও। আমি মনে করি সেই সমঝোতার জায়গায় দাঁড়িয়ে আজকের কবিতাকে, বিশেষত দীর্ঘ কবিতাকে, দেখা উচিৎ পাঠকের।
মধু ও মশলার বনে কবিতাটিতেও আমরা দেখলাম ভূমিকা এবং প্রথম দুটো চরণ বাদ দিলেই আর কোনো লিংকেজ থাকে না বিষয়ে প্রবেশের। সারা কবিতায় তিনি ভাইয়ের মৃত্যুবেদনার কথাও প্রচার করেননি। কিন্তু শোক, ব্যথা, আমাদের বিস্মৃতি-প্রবণতা, আবার স্বপ্নের মতো জেগে ওঠা স্মৃতিÑ সব যেন একাকার হয়ে হয়ে একটা মিশ্র অনুভূতির জায়গা তৈরি করে কবিতাটিতে। পুরো কবিতাটি এখানে কোট করা সম্ভব নয়। আসুন আমরা তাকাই (ব্যক্তিগতভাবে আমার চোখ দিয়ে) কয়েকটি অংশের দিকে।
ডালিম ফলের দিকে এক সৌন্দর্যের ভূত
বিপন্ন ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে।
আর মোমবাতি জ্বেলে দেখি আমি
মশলা বনের ভেতর
কেউ একজন হেঁটে যায় ক্রমাগত,
মুহূর্তে মুহূর্তে
তার মুখ পাল্টে যায়,
সেগুনের পাতা দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ ঢাকা।
এখানেও যেন বলার ভঙ্গিতে আমরা বিষাদ ও বিষ্ময়ের এক মিশ্র অনুভূতির দ্বারা তাড়িত হই। আসুন আবার তাকানো যাক।
ব্লাস্ট ফার্নেসের ভেতরে ঢুকাতে চাই
আমার এ বাষ্পমেঘ-ভরা মাথা,
তার আগে, আরো কিছুকাল মাথা খাড়া রাখা
বড় দরকারÑ ঐতো, দ্যাখো, আমাকে গ্রাহ্য করে না
উটগুলো একদম, একমনে কাঁটাগাছ
খেয়ে চলে তারা, মুখ থেকে রক্ত ঝরে পড়ে,
তবু খায়, খেয়ে খেয়ে যেন একদিন
অনন্ত ক্ষুধার পাড়ে
মুখ তুলে দাঁড়াবে উটেরা—
দেখবে তখন
চন্দ্রমল্লিকার আলো থেকে
চন্দ্রমল্লিকার শান্ত আগুনে আবার
নেমে যাচ্ছি আমি, অভিযোগহীন।
ফের উঠে যাচ্ছি সিঁড়ি গুনে,
কোথায় যে যাচ্ছি টিয়ে পাখিদের পাহারা এড়িয়ে
সে কি কোনো কাঠবিড়ালীর রাজ্য?
এর আগে যে অংশটা কোট করেছিলাম, সেখানে সেগুনের পাতা দিয়ে পুরুষাঙ্গ ঢাকা একজনের কথা ছিলো, ভূমিকা পাঠের পরে আমাদের মনে হতে পারে বহুবছর পেরিয়ে সেই ভাইয়েরই এক বিকল্প রূপ যেন ওই চরিত্র। কিন্ত এই অংশে আমরা আর কোনো লিংকেজই পাই না। আমি আগেও খেয়াল করেছি, মজনু শাহ-এর কবিতায় লিংকেজটা তৈরি হয় বলার ভঙ্গিতে। টোনের মাধ্যমে। কিন্তু কবিতা পাঠে মনে হয়, অসংখ্য ইন্টারলকড চিত্রকল্পই বুঝি তার কবিতার মূল উপাদান। এরপরে এক জায়গায় তাকে আমরা বলতে শুনি,
মুখে চুনকাম করে এখন সাহেব হয়ে গেছে
সেই ভাই-বন্ধুদের কথা মনে পড়ে,
মনে পড়ে সেই ঘোড়াটির কথা
একবার উর্ধ্বে দুই পা তোলার পর
পা নামাতে ভুলেছে যে
বিস্মিত হবার মতো বিষয় হলো, ভাই শব্দটির উপস্থিতিও এখানে আর তার বিগত ভাইয়ের কথা মনে করাচ্ছে না। বরং মনে করাচ্ছে ভোল পাল্টে ফেলা নিকটজনদের কথা। এক ধরণের শ্লেষ, বিদ্রূপ বা উপহাসের সুরও এখানে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, কবির সেই ভাই বহুকাল আগেই এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য মাত্র সাতদিনের পরমায়ু নিয়ে জন্মেছিলো। বহুকাল হলো হারিয়ে গেছে সে। তার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হঠাৎ এসে পড়া এই উপহাসের সুরও কিন্তু তাই আমাদের অসঙ্গত বলে মনে হয় না। ফেরা যাক কবিতাটির শেষাংশের দিকে যেখানে আবার নামসহ ফিরে আসে সেই হারানো ভাইয়ের প্রসঙ্গ।
আমার আত্মার মধ্যে এক অচেনা বালক
মুঠো মুঠো ছড়ায় খাবার,
আর কোথা থেকে শত সহস্র বিষপিঁপড়ে
পড়িমরি ছুটে আসে —
কোনোদিন আমার আত্মাকে
হয়তো বিষপিঁপড়েদের উপহার দিয়ে
আলী মনে করে চলে যাবো
ঐ অচেনা বালকের পিছে—
সেই দেশে শুনি আয়নার সমাধি রয়েছে।
একটি বালক সেইখানে অজস্র দেখায় যদি,
যদি-বা দড়াম করে বন্ধ হয় ফেরার দরজা,
কী হবে সেদিন?
যদি আর না-ই ফিরি, আপেল গাছের তলে
সাপের শিশুরা যেন সেই দিন থেকে
আমাকেই বন্ধু মনে করে…
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বোদলেয়ারের করেসপন্ডেন্স কবিতাটি যারা পড়েছেন, তাদের হয়তো মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, প্রকৃতি এক বিশাল প্রতীকের রাজ্য। আর প্রতীক এমন এক বিষয় যা একেক কবির কাছে একেকরকমভাবে ব্যবহৃত হয়। শুধু এই কবিতাটিতে নয় শুধু, মজনু শাহের বেশ কিছু কবিতা পড়ে আমার ধারণা হয়েছে, তার কবিতা অনুভূতিকে যতটা জাগ্রত করে, আন্দোলিত করে, ততটা বোধকে নয়। এটা হতে পারে এমন যে, তার মেথড অব কোডিংটা আমি ধরতে পারছি না। আমাকে আরো নিবিষ্ট হতে হবে। কবিতায় চিন্তা বা দর্শনের যে জায়গা থাকে, আমার মনে হয়, তার কবিতায় সেই জায়গাটা বড় বেশি গৌণ। কিন্তু ভাষার জাদুর কারণেই কি-না জানিনা গত কয়েক বছরে আমার পড়া দীর্ঘ কবিতাগুলোর মাঝে এই কবিতাটি একটি।
এবার আসি ভাইয়ের শোক নিয়ে রচিত আরেকটি কবিতার দিকে। এই কবিতাটি লিখেছেন কাজী নাসির মামুন। কবিতার নাম অশ্রুপার্বণ। মানে কী? কান্নার উৎসব? উৎসব কি কেবল আনন্দের হয়? বেদনার ভাগাভাগিও কি উৎসব নয়? যদি হয় তবে সেই উৎসবের নাম হতেই পারে অশ্রুপার্বণ। আসুন কবিতাটির কিছু অংশের দিকে তাকানো যাক। এখানেও আমরা একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা পাই যা আমাদের সাহায্য করে কবিতাটির মূলসুরের সাথে পরিচিতি গড়ে নিতে।
ঢাকার আজিজে বসে রঙ্গলাল মেধাবীর মতো
আমরা দুু’ভাই সিগারেট
খেয়েছি; প্রতুল স্মৃতিগুলো ফেলে দিয়ে
ছেঁড়াখোঁড়া এই ইতিহাস নিরন্ন মস্তকে তুলে রাখি।
এখানে ফানুস ওড়ে; রঙিন বাতাসে ওড়ে টাকা।
অনেক উদ্বৃত্ত জীবনের গান মোড়ে মোড়ে বিরচিত হয়।
নারীর দেহের মতো সুবাসিত নাম
নিজের পকেটে নিয়ে যদি জানি
শরীরবিহীন এক জর্জ বুশ
জিয়ন কাঠিতে নাড়া দিলে
এখানেও ধ্বংস হয়, মৃত্যু নামে অগণিত লাল নীল…
সমূহ পুঁজির কুঠিয়াল
রাতভর টেনে খায় শ্রমের আগুন,
তখন আমার সাথে প্রেম আর পুদিনা পাতার দেশে
নিঃশেষিত মেঘের মতন
আমার হারানো ভাই জল হয়ে গেলে
আজিজ মার্কেটে ভেসে যাবো
নিষ্পন্ন সন্ধ্যায়।
এখানে দেখা যায় ভাইয়ের স্মৃতিচারণের কথা আছে। অবধারিতভাবে আছে মৃত্যুর প্রসঙ্গ। আর মৃত্যুর প্রসঙ্গেই ভাইয়ের মৃত্যুর এককেন্দ্রিকতা ছেড়ে তাকে আমরা আরো ব্যাপ্তি লাভ করতে দেখি যখন শুনি তিনি বলছেন, শরীরবিহীন এক জর্জ বুশ জিয়ন কাঠিতে নাড়া দিলে এখানেও ধ্বংস হয়, মৃত্যু নামে… সমূহ পুঁজির কুঠিয়াল রাতভর টেনে খায় শ্রমের আগুন। এখানেই যেন তিনি ব্যক্তিক থেকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণে চলে যান। তাকে আবার আমরা সেই ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণের কাছাকাছি আসতে দেখি ভূমিকাটির শেষাংশে। বলা বাহুল্য, ভূমিকা আকারে রচিত হলেও এই অংশটি একটি পৃথক কবিতার মর্যাদা পেতে পারে। পরে অবশ্য কবিতাটির শুরুতেই তাকে আমরা কান্নার উৎসবে দেখতে পাই, অদ্ভুত এক দার্শনিকতা নিয়ে,ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে তিনি বলে যান,
আয়ুর আকাশে চিরদিন
একটি দীঘল কালো মেঘ
অনন্ত উপেক্ষা নিয়ে
জীবনকে পরিহাস করে; তবু ভালো লাগে শালিক পাখির
আলাপচারিতা, ক্রোত্ ক্রোত্ ভালোবাসা দেখে
আমি যে শিখতে পাই আমার অন্তিম পলায়ন বিদ্যা!
মৃত্যু প্রহেলিকার ডুমুর গাছ কীভাবে চিনতে হয়
ফুলের অস্তিত্ব ছাড়া
সেইটুকু মন্ত্রমনোযোগ
কেবলি দেখতে পাই
অন্ধের দু’চোখ ভরা দৃশ্য!
অন্ধের দু’চোখভরা দৃশ্য, এক্সপ্রেসনটিকে আমার এখানে খুবই সঙ্গত মনে হয়। অন্ধ মানে হলো যে চোখে দেখতে পায় না। তার মানে একসময় সে দেখতে পেতো, এখন পায় না (জন্মান্ধের বিষয়টা অবশ্য ভিন্ন)। যেন ভাইয়ের মৃত্যু তাকে অন্ধ করে দিয়েছে ভাইয়ের স্মৃতিসংলগ্ন। ফলে সেই স্মৃতির দৃশ্যগুলোকে দেখে দেখে তিনি বলে যেতে থাকেন,
সে আসলে তুষার বালক;
গলে যেতে এসেছিল কাগজের সরল নৌকায়
ভাসতে ভাসতে জং ধরা পৃথিবীতে একবার।
তার স্মৃতি, সুপ্ত কুশলতা
কর্তিত যৌবনে দেহমুক্ত প্রাণ, বিঘিœত সংগ্রাম
আর তাকে সমবেত বেদনার অভিন্ন প্রলাপ
যেন সব ঔরসের পাদবিন্দু; স্লেটের পেন্সিলে এঁকে
নিজেই মুছতে হলো বাবাকে; মায়ের
বনজ হৃদয়ে শুধু একটি হলুদ পাতা গাছ থেকে পড়ে গেল।
গাছের গুঁড়ির মতো অনড় মন্থর পরিভাষা
আমিতো জানি না কিছু! বাবাকে দেখেছি
সহসা পারেন; মা-ও খুব প্রেমপ্রত্নীভরা নিপুণ পাথর।
সূর্যাস্ত মহিমাটুকু আঁচলে বাঁধতে গিয়ে
দূর আকাশের ধ্রুবতারা
নিজের সন্তান বলে ভাবতে পারেন
সারারাত তাকিয়ে তাকিয়ে
এখানেই আমরা দেখি ভাই হারানোর বেদনা এবং সন্তান হারানো বেদনা কে কীভাবে সামলে নিচ্ছে তারই যেন বিবৃতি পাচ্ছি আমরা। পিতার কৌশল এক, মায়ের আরেক। স্লেটের পেন্সিলে এঁকে একজন নিজেই মুছে ফেলেছেন কিছু এমন ভেবে বেদনায় মিশে যান, আরেকজন বনজ হৃদয় নিয়ে দূর আকাশের তারাকে নিজের হারানো সন্তান বলে ভেবে নিচ্ছেন। একেক জনের কৌশল একেক রকম। বেদনার এই উৎসবে আমরা এতক্ষণে তিন জন চরিত্র পাই। পিতা, মাতা আর শোকে অন্ধ ভাই। আরেকটি কথা এখানে না বললেই নয়। তুষার বালকের যে প্রতীকটি তিনি ব্যবহার করেছেন যা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং কবিতাটির মূলসুরের সাথে একইভাবে গাঁথা। এখানেই কবিতার প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে কাজী নাসির মামুন দীর্ঘ কবিতায়ও টেনে নেন আমাদের মনোযোগ আর আমরাও কবিতা ধরে এগুতে এগুতে টুকরো টুকরো স্মৃতি আর দর্শনের একটা স্থির জায়গা পেয়ে যাই। নব্বই অথবা শূন্য দশকের হাতেগোনা যে কয়েকজন কবি দীর্ঘ কবিতায় সিদ্ধহস্ত আমি মনে করি, কাজী নাসির মামুন তাদের অন্যতম। তার কবিতাগুলো অনেক সময়ই দর্শনের উপস্থিতির জন্যে পাঠকের মনে লেগে যায় স্থায়ী হয়ে। আসুন আবার তাকানো যাক কবিতাটির দিকে, বাবা-মায়ের প্রসঙ্গে আবার তাকে আমরা বলতে শুনি,
বাবা যে পারেন, মা যে পারেন দুনিয়া আলোড়িত
সবটুকু রক্তিম বুদ্বুদ
পরোক্ষ সঙ্কেতে হাওয়া করে দিতে?
মা কি তবে বেদনারহিত কেউ? ভুলে আছে যাতনার রক্তকোকনদ?
বাবা কি শত্রুঘœ ঋষি? হৃদয়ে স্পন্দিত এক অমূল্য বিষাদ, তবু
ডুমুর ফুলের মতো অদৃশ্য ব্যঞ্জনে ভাষাহীন
…………………………………………………………….
…………………………………………………………….
মা আমার চিনির তরল।
বাবা খুব দানাদার, জলে মিশে আছে।
সেই রস পান করে নারী ও রঙ্গন ফুলে জীবন জড়িয়ে খুব জানলাম,
যৌবন প্রেমকে বোঝে উৎসবের মতো।
এখানেও প্রাসঙ্গিকতার ছদ্মবেশ নিয়ে উঁকি দিলো দর্শন। উপলব্ধি। কিন্তু কোথাও অসঙ্গত লাগে না। আবার কবিতাটি পঞ্চমাংশে দেখি শীতের আবহে তিনি জীবনকে স্থাপন করে কোন উপসংহারের দিকে যেতে চান যেন-
শীত সমাকীর্ণ
কয়েকটি জলের ফোঁটায়
অমোঘ লিখতে গিয়ে জীবন… জীবন
ভেবে দেখি, আমার মা প্রতিকল্প হবে না কারোর।
বাবাও হবে না কারো বিকল্প স্বরূপ।
তবু রোজ মায়ের প্রকোপ থেকে সরে যাই; বাবার নির্জলা
উপস্থিতি মান্য করে দূরে আসি; দেখি মৃত ভাই
বিমূঢ় পঞ্জিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মহাকালে।
অনুষ্ঠান বিচলিত এই নাম মুছে যেতে থাকে।
মুছে যায় সরব জনতাবন, সুহৃদ আত্মীয় যারা, প্রিয় মুখ নারী আর একটি পাহাড়।
পাহাড় নদীকে জন্ম দেয়; নদী শুয়ে থাকে পাহাড়ের পাশে।
তবুও যোজন দূরে দু’জনেই দু’জনার।
মাটি ও জলের এই দুলে ওঠাÑএইটুকু স্তিমিত সঞ্চয় যেন
জীবনের গভীরে গোপন সঙ্গ—
বিদিত মৃত্যুর চাষ করা।
পাহাড় গড়িয়ে হয় সমতল, নদীও শুকায়;
তবু এই ভাতৃসঙ্ঘ, বিবাহ বন্দনা
পরিবৃত কলহকীর্তন, শয্যা; অনাগত জন্ম হন্তারক
ঘনায় ছোবল; তবু চন্দ্রাতপ; সজল বিচ্ছেদভরা পৃথিবীতে
সহসা লেলিয়ে দেই প্রেম, শুধু মনোহর অমৃত অঞ্জলি শ্রদ্ধাপরবশ;
মাটির কলসে সেই জল
কোনো কাক পাথর ডুবিয়ে খায়, তৃষ্ণা!
আহা, তৃষ্ণা বিরচিত ক্ষয়িষ্ণু প্রেমের মতো হে জীবনÑ
নিষ্পন্ন বিন্দুকে জেনে গেছি আমি?
জেনে গেছি এই সর্প সমাদরÑ বিষ আর মণি
তুমুল নিজের?
কাজী নাসির মামুনের দীর্ঘ কবিতায় কেন্দ্রের বিষয় এভাবেই ঘুরে ফিরে আসে। যেন পরিধি বরাবর এবং পরিধিকে ভেদ করে চলে যাওয়া একেকটা দৃষ্টিকোণ তাকে বেসিক কনসেপ্টের সরল রেখাকে ঘিরে তরঙ্গিত যাত্রায় উদ্বুদ্ধ করে। তার কবিতা তাই এত প্রাঞ্জল এবং জীবনসংলগ্ন।
বাংলা কবিতার দীর্ঘ ইতিহাসে দীর্ঘ কবিতাও একটি অংশ। এরও ব্যাপ্তি রয়েছে। আলোচনাও সেরকম পরিসর দাবি করে। তবে, এই প্রবন্ধে কেবল এই সময়ের কবিতা ও কবিতাকারের দৈর্ঘ্য ও হ্রস্বতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উপস্থিতকালের দুজন কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, এই দুজনই উত্তম দৃষ্টান্ত । এর মানে এই যে, এই সময়ে তাদের মতো করে, খুব বেশি দীর্ঘ কবিতার চর্চা এখন আর হচ্ছে না। যাই হোক, গত কয়েক বছরে যে কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা আমার পড়া হয়েছে এবং ভালো লেগেছে সেগুলোর কথাই এখানে বললাম। তবে আক্ষেপের বিষয়, দীর্ঘ কবিতার সেই ট্র্যাডিশন এখন অনেকটাই ফিকে হযে এসেছে। যদিও আমরা দেখি বিনোদনের জন্য এক হাজার দুই হাজার পর্বে মেগাসিরিয়ালগুলো বেশ জনপ্রিয়। কোনো কারণে রাতের এপিসোডটা মিস হলে, কাক ভোরে উঠে অনেকেই মিস করা এপিসোডটা পুনঃপ্রচারের সুবাদে দেখে নেন। তারমানে দৈর্ঘ্য কোনো বিষয় নয়। বিষয় দৈর্ঘ্যকে ধারণ করা। অশ্রুকুমার সিকদার তার আধুনিক কবিতার দিগ্বলয় গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে বলেছেন, পাউন্ড যদি ক্যান্টোজ বা তার অন্যান্য দীর্ঘ কবিতাগুলো না লিখতেন তাহলে তার অবস্থান আজকের মতো হতো না। এলিয়ট যদি দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড বা ফোর কোয়াট্রেটস না লিখতেন তবে কবি হিসাবে তার মহত্ত্বও বোধকরি আজকের মতো হতো না। অশ্রুকুমার সিকদারের কথাগুলোকে ফেলে দেয়া যায় না। আসলেই তাই, অশ্রুকুমার সিকদারের এই কথার সূত্র ধরে বলা যায় এ্যালেন গিন্সবার্গের কথা, তার হাউলের কথা। এখনো পর্যন্ত অধিকাংশ স্বীকৃত মহৎ কবির সিদ্ধি মূলত দীর্ঘ কবিতায় বলেই ধরা হয়। আবার এর উল্টোটাও আছে। যেমন লুইস জুফোস্কির এ’ দীর্ঘ কবিতাটি হয়তো আয়তনে অনেক কবিতাকেই হার মানিয়ে দেবে। আটশত পৃষ্ঠার ওপরে আয়তনের সেই কবিতাটি কিন্তু এতটা সিদ্ধি লাভ করতে পারেনি যতটা পেরেছে দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড অথবা পাউন্ডের ক্যান্টেজ অথবা গীন্সবার্গের হাউল। হাউল কবিতার প্রথম অংশটির কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। কী অসাধারণ অভিব্যক্তি এবং নান্দনিকতার মিশেল রচিত হয়েছে এখানে। আসুন আবার একবার চোখ রাখা যাক—
I saw the best minds of my generation destroyed by
madness, starving histerical naked,
dragging themselves through the negro streets at dawn
looking for an angry fix
যেন একটা জেনারেশনকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো একক ব্যাপ্তি এই কবিতার আছে। না পড়লে বোঝা যায় না দীর্ঘ কবিতার সাথে ক্ষুদ্র কবিতার ফারাক কোথায়। এখানে অশ্রুকুমার সিকদারের ওই গ্রন্থের ওই অধ্যায় থেকেই খানিকটা অংশ উদ্ধৃত করা যায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘উৎক্ষিপ্ত কররেখা’ নামে এক থেকে একাধিক লাইনের কিছু বিচূর্ণ কবিতা কণাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ’ বইতে এবং পাদটীকায় জানিয়েছেন ‘নানা সময় নানা পদ্য শুরু করেছিলামÑ এগোয়নি। লিখিত টুকরোগুলোর কয়েকটি তুলে দিয়ে নিস্তব্ধ অলিখিতের প্রতি নির্দেশ করছি মাত্র। এ কি নীরব কবিত্ব নাকি পরাভূত কবিত্ব? এর পরে কি আমরা অপেক্ষা করে থাকবো সেই কাব্যকৌতুকের জন্যে, যখন কবি বাঁধানো পৃষ্ঠা পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে ‘নিস্তব্ধ অলিখিতের দিকে’ নির্দেশ করবেন? বিদেশে এই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। মার্কিন ঔপন্যাসিক উইলিয়াম সারোয়ানের পুত্র আরাম সারোয়ানের একটি কবিতার বই বেরিয়েছে। বইয়ের কবিতাগুলো ছোট হতে হতে শেষে ‘স’ অক্ষরটাই হয়েছিলো কবিতা। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, তার পরের পৃষ্ঠায় আছে শুধু পৃষ্ঠাসংখ্যা, পরের পৃষ্ঠাগুলো সাদা, একেবারে সাদা। কবিতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চুকে গেছে, এরপর শ্রীমানের এই ঘোষণায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
যাবতীয় বিরুদ্ধতার পরও টেস্ট ক্রিকেট যেমন এখনো টিকে আছে। সারাদিন ব্যাট করে কোনো ব্যাটসম্যান হাফ সেঞ্চুরি করে পরের দিন নামার প্রত্যাশায় মাঠ ছেড়ে আসে, ঠিক তেমনই কবিতায়ও শক্তি এবং যোগ্যতার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় কবির দীর্ঘ কবিতাগুলোতে। ছোট ছোট আইডিয়া নয়, চিত্রকল্প বা চমকের প্রেজেন্টেশন নয়, কাব্যিক নান্দনিকতার ধারা নিয়ে, বক্তব্যের দৈর্ঘ্য নিয়ে টানটান নির্মাণ দিয়ে এখনো কতেক কবি আমাদের তাক লাগিয়ে দিতে পারেন। একারণেই প্রত্যাশা বেঁচে থাকে যে দীর্ঘ কবিতার গতিধারা বিলুপ্ত হবে না।