একটি অন্ধকার ঘরে বা জায়গায় টর্চ লাইট জ্বালালে টর্চের আলো যতটুকু জায়গা আলোকিত করে, ছোটগল্পও ঠিক একটি জীবনের সামান্য একটু অংশই তুলে আনে। প্রতিদিন ভেসে যাওয়া সহস্র বিস্মৃতি রাশি থেকে দুই-চারটি অশ্রুজল উঠে আছে ছোটগল্পে।
গল্পকাররা জীবনের একেক অংশে আলো ফেলেন, অবলোকন করেন নিজস্ব জায়গা থেকে, ফলে বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি। গল্পও হয়ে ওঠে নানা রঙের, নানা ধরনের। আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় নিত্য-নতুন গল্প। একটি সার্থক ছোটগল্প যেমন শেষ হয়েও শেষ হয় না, তেমনি মানবজীবনের নতুন নতুন গল্পেরও শেষ হয় না। কাল থেকে কালে জমা হয় গল্পের পর গল্প।
পড়ুন ছোটগল্প সংক্রান্ত আরও প্রবন্ধ: সাম্প্রতিক ছোটগল্প: ভবিষ্যতের দিকে ॥ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কথাগুলো বলার কারণ সমকালীন গল্প নিয়ে চিন্তাসূত্রের প্রথম কিস্তির ছয়টি গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর দ্বিতীয় কিস্তির দশটি গল্পও প্রকাশিত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে যা বেশ আলোড়ন তুলেছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনাও হচ্ছে। এই আলোড়ন বা আলোচনার কারণ হলো প্রকাশিত গল্পগুলো যারা লিখেছেন, তাদের কেউ পাঠকের কাছে স্বল্প পরিচিত, কেউবা সমাধিক পরিচিত। তবে, সব গল্পকারই তরুণ। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, তারা মূলত দ্বিতীয় দশকের জাতক। (এক্ষেত্রে নতুনদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে পাঠকের সামনে তুলে ধরা জন্য চিন্তাসূত্র বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য।)
জানি, সমকালীন কল্লোল, কোলাহলের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই ফিরে যাবেন, ক্লান্ত হয়ে রেখে দেবেন হাতের কলম। কেউবা আবার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবেন মহাকালের কড়া নাড়তে।
তারপরও সমকালীন প্ল্যাটফর্মে সবাইকে দেখার (গল্প পড়ার) একটি বিশেষ গুরুত্ব সবসময়ই থাকে। এর ফলে নতুনদের কণ্ঠস্বর, দৃষ্টিভঙ্গি, গল্পের গতিপথ চিহ্নিত করা যায়। বোঝা যায়, গল্প কতটুকু এগোলো, কতটুকু এগিয়ে থেমে রইলো। তাদের চিন্তা, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বোঝার জন্যেও সমকালীন গল্পের গুরুত্ব সমাধিক।
ইলিয়াস বাবরের ‘কবি জয়নালের দুঃখ’ গল্পের কথাই ধরা যাক।
পড়ুন ইলিয়াস বাবরের গল্প: কবি জয়নালের দুঃখ ॥ ইলিয়াস বাবর
গল্পটির শুরুতে আমরা দেখি, জয়নাল এক রিকশাঅলার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ‘এই খানকির পোয়া, চোখে ন দেহর? চোখ কি ঘরত রাই আসসোছ না?’ বলে গালাগালি করছে। গালাগালির কারণ রিকশাঅলা কবির পাঞ্জাবির এক কোনা ছিঁড়ে ফেলেছে। এই পাঞ্জাবিটি কবি জয়নালের খুবই প্রিয়। যা পড়লে তার দশ বছর প্রায় কমে, সবাই প্রশংসা করে। গল্পের কথকসহ আরেকজন নানা জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে কোন কারণে পাঞ্জাবিটি এত প্রিয় যে সামান্য পাঞ্জাবি ছেঁড়ার কারণে জয়নাল এত ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো।
তখন কবি জয়নাল জানায়, সামান্য পাঞ্জাবি ছেঁড়ার কারণে জয়নাল দুঃখিত বা চিন্তিত নয়। তার চিন্তার কারণ হিসেবে জানান, ‘আমি পাঞ্জাবির জন্য পেরেশান করি না পাগল, শ্বশুরের দেওয়া পাঞ্জাবিটার বাহানা ধরে তার কন্যে আজ কোন পেঁদানিটা আমাকে দেয়, সেটা ভেবেই!’
লক্ষণীয় গল্পটির আকস্মিক শুরুতে পাঠক কিছুটা চমকে যায়। এরপর গল্পটি এগিয়েছে লঘুচালে চমকের জট ছুটাতে ছুটাতে। গল্প সংগঠনের সময় খুব বেশি নয়। এরপরও গল্পকার গল্প শেষ হওয়ার আগেই জয়নালের একটি পরিপূর্ণ চিত্র আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বৈঠকি মেজাজের এই গল্পটি মূলত দাঁড়িয়ে আছে শেষের টুইস্টের ওপর। এই টুইস্টের কারণেই গল্পটি টিকে গেছে।
রস বিচারে আশরাফ জুয়েলের ‘বিজ্ঞাপিত সুখ’ গল্পটি ‘কবি জয়নালের দুঃখ’ গল্পের বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান করলেও টুইস্ট-ই ‘বিজ্ঞাপিত সুখ’ গল্পের মূলশক্তি। ‘বিজ্ঞাপিত সুখ’ গল্পে আশরাফ জুয়েল নিখুঁতভাবে ডিটেলসের বর্ণনা দিয়েছেন। গল্পের পাত্রপাত্রী আমাদের নিত্যদিনের দেখা একটি ভিক্ষুকের দল। যার দলপ্রধানের ‘শরীর বলতে তেলের ব্যারেলের মতো একটি দেহ, দেহের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে লেগে আছে প্রায় চুলশূন্য একটি মাথা। বাস বা ট্রাকের টায়ারের টিউব কেটে গোলাকার দেহটির জন্য পোশাকের মতো কিছু একটা একটা বানানো হয়েছে।’ এই দলে আছে জন্মান্ধ এক লোক, আছে খোঁড়া মহিলা, একটি কিশোরী। ঘটনাক্রমে তাদের সঙ্গে ভাগ্যবিড়ম্বিত জোমেলার দেখা হয়। জোমেলা শহরে আগন্তুক। কিছুই চেনে না, কিছুই জানে না। গল্পকার শুনিয়ে দেন ঢাকা আসার সময় এবং আসার আগের সময়ের কাহিনি। জোমেলার প্রধান শত্রু তার রূপ। শহরে আশ্রয়হীন জোমেলা আশ্রয় নেয় এই ভিক্ষুক দলের সঙ্গে। ভিক্ষুক দল ছোট একটি দোতলা বাড়িতে থাকে। সবাই প্রতিদিন ভিক্ষা করতে বের হলেও জোমেলাকে তাদের সঙ্গী হতে হয় না। গল্পের একপর্যায়ে জোমেলার সঙ্গে ভিক্ষুক দলের প্রধান শমশের হাওলাদারের সঙ্গে বিয়ে হয়। শমশের হাওলাদের শরীরের অনেক অঙ্গ না থাকলেও তার মধ্যে আছে মানবিকতা। আছে ভালোবাসা। আছে ঔচিত্যবোধ। বিয়ের কয়েকদিন পর জোমেলা সাজলে শমশের তার সঙ্গে কিছুক্ষণ রসিকতা করে, তারপর তাকে পাঠিয়ে দিতে চায় অন্ধ গেলমানের ঘরে। সে জোমেলাকে বলে, ‘‘বউরে, অ্যাক্সিডেন্ট আমার বউ বাচ্চার লগে লগে আমার শরীর থাইকা আরও অনেককিছু কাইড়া নিয়া গ্যাছে, দ্যাখ, দ্যাখ। কিন্তু আমার মনডা তো জীবিত আছে রে, হে-য়ে তো অনেক কিছুই চায়।’
পড়ুন আশরাফ জুয়েলের গল্প: বিজ্ঞাপিত সুখ ॥ আশরাফ জুয়েল
নিজেকে ধরে রাখতে পারে না জোমেলা। চিকন সুরে কাঁদতে আরম্ভ করে। এই দুনিয়ায় নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত মনে হয়।
‘দ্যাক বউ, গেলমান আন্ধা মানুষ, ওই তোর এই রূপের কিছুই দেখবো না। ওর লগে যহন মেলামেশা করবি তহন ওর জায়গায় আমারে ভাইবা নিস। যা আইজ গেলমানের লগে, যা বউ, তোর জোয়ান শরীর, তুই উপোষ থাকবি ক্যান? জোয়ান শরীররে উপোষে রাখলে শরীর খারাপ করে। আমি তোগোরে ওপর থাইকা দেহুম, তোগোরে মেলামেশা করা অবস্থায় দেখলেও আমার মনের স্বাদ পূরণ হইবো বউ, আমিও তহন নিজেরে গেলমান ভাবুম, যা বউ যা, নিচের ঘরে যা।’
‘বিলম্বিত সুখ’ গল্পের সমাপ্তি এতটাই আকস্মিক যে পাঠককে কিছুক্ষণের জন্য তা বিহ্বল করে দেয়।
আনোয়ারা আল্পনার ‘বিরানব্বই’ গল্পটি ভিন্ন-আঙ্গিকে লেখা। লেখক প্রথমে পাঠকের উদ্দেশ্যে ধাঁধা ছুড়ে দিয়েছেন। পাঠককে গল্পের ভেতরে ঢুকতে হলে এই ধাঁধার দোলাচল পেরিয়ে যেতে হবে। এছাড়া লেখক পাঠককে সরাসরি গল্পের অংশ করে নিয়েছেন। অর্থাৎ যাদের নিয়ে গল্প, মারুফ ও স্বপ্না, যাদের বয়সের সমষ্টি বিরানব্বই, তারা গল্পটি আলাদা আলাদাভাবে বলেছেন লেখককে, লেখক শুনিয়েছেন পাঠককে।
পড়ুন আনোয়ারা আল্পনার গল্প: বিরানব্বই ॥ আনোয়ারা আল্পনা
নিরানব্বই গল্পটি প্রেমের নিঃসন্দেহে। শুধু তাই নয়, মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধও এ গল্পের প্রধান উপজীব্য। গল্পকার খুব কৌশলে গল্পটি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এক মুহূর্ত আগেও পাঠক বুঝতে পারে না গল্পটি কোথায় যাচ্ছে। প্রথমে গল্পটিকে নিরেট প্রেমের কচকচানি মনে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টে গেছে সবকিছু। মনে হয়েছে কোনো থ্রিলার। তারপর মনে হবে, না, মানবিকতাই এ গল্পের মূল সুর। লেখক নারী পুরুষের মাঝে শুরু দৈহিক আকর্ষণ নয়, মমত্ববোধের মাঝে জন্ম নেয় যে প্রেম সে প্রেমকেই তুলে আনতে চেয়েছেন।
গল্পের উপকরণ অনেকটা এক থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ ভঙ্গিই যে গল্প দুটোর মাঝে যোজন যোজন পার্থক্য রচনা করে, তার একটি চমৎকার নিদর্শন আনিফ রুবেদের ‘বানুষ ও মানরের ডুগডুগিটা সম্ভবত বিচারক’ ও কাজী মোহাম্মদ আসাদুল হকের ‘ডগি’ গল্প দুটো। গল্প দুটোর উপরকণ একই বললাম, কারণ দুটো গল্পেই মানুষ আর প্রাণি সহবস্থান। কিন্তু পরিণতি বিচারে দুটো দুই ভুবনের বাসিন্দা।
পড়ুন আনিফ রুবেদের গল্প: বানুষ ও মানরের ডুগডুগিটা সম্ভবত বিচারক ॥ আনিফ রুবেদ
‘বানুষ ও মানরের ডুগডুগিটা সম্ভবত বিচারক’ গল্পে আমরা দেখি, সেমাদুল নামে এক ব্যক্তি, বানরের খেলা দেখানো যার পেশা। বানরের লেখা দেখানোর পাশাপাশি খেলা দেখতে আগত মানুষের কাছে সে বিভিন্ন রোগের ওষুধ বেঁচে। মানুষদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য সেমাদুল বিভিন্ন লৌকিক গল্প বলে। রঙ-ঢঙের কথা বলে। সেই গল্পের মাঝে বিভিন্ন দর্শন ফুটে ওঠে। মূলত গল্পকার এভাবে সেমাদুলের কথার মাঝে গল্পের চাবি রেখে দেন। সেমাদুল সমবেত লোকজনের উদ্দেশে বলে, ‘ভাই, বানরকে আমি বানর বলি না। বানুষ বলি। বানর আমার কাছে মানুষের মতোই লাগে। শুধু কথা বলতে পারে না। আর এ বানর মানুষকে সালাম করতে পারে, মানুষকে নমস্কার করতে পারে। […] সব মানুষকে আমি মানুষও বলি না। অনেকেই আছে দেখতে মানুষ কিন্তু আসলে মানুষ নয়। তাদেরকে আমি মানর বলি।’
গল্পের পরিণতিতে আমরা দেখি সেমাদুলের কুমারী কন্যাসন্তান জন্ম দিলে, তাকে নিয়ে বিচার বসে। সবাই জানতে চায়, সন্তানের বাবার নাম। তখন শেফালী প্রকৃত পিতার নাম বলতে গিয়েও সে বানরের নাম বলে। বলে তার সন্তানের পিতা বানর। তখন সেমাদুল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বানরকে মারধোর করে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যেতে থাকে। তখন বানর তার শেকল ছিঁড়ে সেমাদুলের অনুগামী হয়। অর্থাৎ বানর তার কাজের প্রতি সৎ থাকলেও মানুষ তার নামের প্রতি সুবিচার বহন করতে পারেনি। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্পের কথা। আমু শহরের গিয়ে দেখে শহরের কুকুরের মাঝে কোন হিংস্রতা নেই, কুকুরের সব হিংস্রতা মানুষের মাঝে। আনিফ রুবেদের গল্পেও আমরা দেখি মানুষের মাঝে যে মনুষ্যত্ববোধ থাকার কথা, তা নেই। বরং একটি ইতরবাচক প্রাণীও কখনো কখনো মানুষকে তার মাধুর্য দিয়ে ছাড়িয়ে যায়।
‘ডগি’ গল্পে প্রাণির সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসার কথা ফুটে উঠেছে। বন্যার সময় এক আহত কুকুর এসে বাসায় আশ্রয় নেয় গল্পকথকের। দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে গেলেও সে কুকুর বাড়ি থেকে চলে যায় না। বাড়ির একজন সদস্য হয়েই উঠে কুকুরটি। যাকে বাড়ির সবাই ডগি বলে ডাকে। বাড়িতে অনাহুত কেউ প্রবেশ করতে চাইলে ডগি বাধা দেয়। এভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু একদিন লেখক বাজারের উদ্দেশে বের হলে দেখতে পায় নর্দমার সামনে স্কুল ফেরত ছেলেদের জটলা। লেখক সামনে এগিয়ে যায়। তারপরের দৃশ্য তার জবানিতে শোনা যাক, ‘একটি মৃতপ্রায় কুকুর নর্দমায় পড়ে আছে। মাথার একাংশ বিভৎস রকমে থেঁতলে গেছে। পুরো দেহে ছাপছাপ রক্ত। গলার হলুদ রঙের বেল্টটি দেখে নিশ্চিত হলাম এই আমাদের ডগি। আর বাজারে যাওয়া হলো না, বাসায় ফিরে গেলাম। বাসার সবাই ডগিকে দেখতে চাইলো। কিন্তু এ বীভৎস দৃশ্য তাদের দেখাব কী করে? জোরাজোরির কারণে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। আট বছরের মেয়েটি আমার ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সে কান্না যে বড়দের মাঝেও সংক্রামিত না হওয়ার কারণ নেই তা অনুমেয়। ডগি বলে ডাকতেই ডগি চোখ খুললো, তারপর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার বন্ধ করে ফেললো সে বিশ্বস্ত চোখজোড়া!’
পড়ুন কাজী মোহাম্মদ আসাদুল হকের গল্প: ডগি ॥ কাজী মোহাম্মদ আসাদুল হক
গল্পকার গল্পটি প্রচলিত ঢঙে আগাগোড়া বর্ণনা করে গেছেন। গল্পটির বিশেষত্ব হলো, এর গতিময়তা এবং কুকুরের মৃত্যুতে লেখক পরিবারের শোক পাঠকের মনে রূপান্তরিত পারার ক্ষমতা।
সুমন মজুমদারের ‘ঘরে ফেরার কাল’ গল্পটি দুটো চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। চরিত্র দুটোর মধ্যে একজনকে চিহ্নিত করা গেলেও অন্যজন অনির্ণীতই থেকে যায়। চিহ্নিত চরিত্রটি একজন লেখক (হয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন), দ্বিতীয় চরিত্রটি হতে পারে একজন ডাক্তার, হতে পারে লেখকের মনোলোকের দ্বিতীয় সত্তা। সংলাপধর্মী এ গল্পটি আমাদের সামনে কোনো পূর্ণায়ব গল্পের চিত্র তুলে ধরে না। লেখক প্রচলিত গল্পের আঙ্গিককে অবহেলা করে এগিয়ে গেছেন নিজানন্দে। খণ্ড খণ্ড ভাবনাচূর্ণ কোলাজে নির্মিত গল্প স্থির থাকেনি কালিক সীমার মাঝেও। স্রষ্টার মতোই লেখক এখানে স্থান, কাল, পাত্রবিহীন এক অখণ্ড আবহ সৃষ্টি করেছেন। প্রচলিত গল্পপ্রেমী এ গল্প পড়তে গিয়ে হোঁচট খাবে নিঃসন্দেহে। এছাড়া ‘ঘরে ফেরার কাল’ একাধিক পাঠ দাবি করে এবং পাঠ থেকে পাঠান্তরে বদলে যায় গল্পের অর্থ, ভাবনার জগৎ।
পড়ুন সুমন মজুমদারের গল্প: ঘরে ফেরার কাল ॥ সুমন মজুমদার
মোস্তফা অভির ‘মৌরি ফুলের গন্ধ’ গল্পের বিষয় আমাদের পরিচিত প্রেম কাহিনী। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পের কথক পিতৃহারা। বিএ পাস। সোনার হরিণ চাকরির আশায় গ্রাম থেকে ঢাকা আসে। কষ্টে দিন কাটে তার। তারপর একদিন একটি চাকরিও পায় সে। ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও দুতিন বছর পর সে খালার বাসায় যায়। খালাতো বোন মৌরির সঙ্গে তার সখ্য বাড়ে। সে সখ্য গড়ায় নিবিড় প্রণয়ে। উন্নত জীবনের আশায় গল্পকথক পাড়ি জমায় দুবাইতে। সেখান থেকে সে একবার প্রীতম নামের এক ছেলের মারফত কিছু জিনিসপত্র পাঠায় মৌরির কাছে। এরপর একদিন গল্পকথক খেয়াল করতে থাকে মৌরির সঙ্গে তার এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। দেশে এসে সে জানতে পারে মৌরি এখন তাকে তার ভালোবাসে না। মৌরির ভালোবাসার সবটাইজুড়ে আছে প্রীতম।
পড়ুন মোস্তফা অভির গল্প: মৌরি ফুলের গন্ধ ॥ মোস্তফা অভি
এ গল্পের বিষয় গৌরব সামান্য। তবে গল্পের বিষয় সাধারণ হলে লেখকের ভাষা ও বলার ভঙ্গি খুবই চমৎকার। গল্পের ভাষা ও গাঁথুনির জন্য পাঠক গল্প বলতে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবে না। এই কথার পক্ষে প্রমাণস্বরূপ ‘মৌরি ফুলের গন্ধ’ গল্পের কিছু অংশ উদ্ধার করা যাক:
‘হাজার মাইল উঁচু দিয়ে উড়ছে প্লেন। এত স্বচ্ছ এত গাঢ় নীল যে আকাশ হতে পারে অত দূরের মাটিতে বসে তা অনুমান করা যায় না। ধুলোভরা মাটির থেকে এখন কত ওপরে আমি! এখানে মা, বোন দুটো আর মৌরি কারও দেখা নেই। পৃথিবীটা দারুণ শূন্য মনে হতে থাকে। তখন বিমানবালার মিষ্টি কণ্ঠস্বর; আর, আর দেখে নেই শেষবারের মতো দেশের মাটি, দেশের জল। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে আমার প্রিয়জনদের মাটিটা আবছা দেখতে চাই। চেয়ে দেখি, চারিদিকে মহাশূন্যতা, নীল আর ঝিরিঝিরি সাদায় একাকার।
দুবাই গিয়ে আমার নতুন করে সংগ্রামের জীবন শুরু। যে জীবনের সঙ্গে আমার আগে পরিচয় নেই। সেই কাকভোরে বিছানা ছেড়ে হুড়মুড় করে ওঠা, তারপর দীর্ঘপথ যেতে হয় গাড়ি করে সেই আজমান শহর। কাজের জায়গা থেকে ফিরি প্রায় রাত নটায়। প্রতিদিন মৌরির সঙ্গে কথা হয়, আমি অতীতের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করি। এমনও হয়, কথা বলতে বলতে ভোর হয়ে যায়। ক্রমশ ফোনের কার্ড কিনতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি। শরীরটা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। তবু এই কথার মায়া ছাড়তে পারি না। আমি দুবাইয়ের আকাশ, আরব সাগরের পাড় আর দূরের ধূধূ মরুর বুকে দেখতে পাই মৌরির মিষ্টি মুখের ছায়া। শুধু আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করি, কবে ফিরব সোনার বাংলাদেশে।’
বিষাদের নিটোল স্বরগ্রামে বাঁধা ফারাহ্ সাঈদের ‘দরজা দরদিয়া’ গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত। দরজার আংটাকে কেন্দ্র করে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া ফুপুর কথা। রতন কাকুর মুখে ফুপুর আখ্যান এ গল্পে বিবৃত হয়েছে। গল্পের অবয়ব নির্মাণে লেখিকা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। ফুপুর স্মৃতিগন্ধে ভরপুর দরজার আংটা দিয়ে যে গল্পের শুরু শেষ হয়েছে সে দরজার আংটাতেই এসে:
‘এ বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। গতকাল বিকালে আব্বা অফিস থেকে ফিরে এসে জানালেন। নতুন বাড়ি তৈরি হবে পাশেই। আব্বার সঙ্গে কথা হয় না আমার। তবে আজ একটা আবদার করলাম। লোহার এই দরজটা খুলে নিয়ে নতুন বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। ওখানে নতুন কোনো সদর দরজা আমি চাই না! শুধু একবার কারণ জানতে চাইলো আম্মা, বললাম, আলতা ফুফু।
ছুঁয়ে দেখি আরেকবার হাতলটা। চকচকে সিল্কের মতো। আঙুল পিছলে যেতে চাইলেও আমি চেপে ধরি। আংটাতে হাত রাখি। এখানেই বছর পুরনো শুকিয়ে যাওয়া একটি বেলিফুলের মালা কতদিন জড়িয়ে জাপটে ধরে আছে, কে জানে!’
এই রিংকম্পজিশনের মাঝে লেখি আমাদের শুনিয়েছেন আলতা ফুপুর ভালোবাসা, অভিমানের কাহিনি, উঠেছে এসে পরিবারের কথা, বাৎসল্য স্নেহের কথা। ছোট, বড় বাক্যের মিশেলে ফুপুর স্মৃতি মাখা বিষাদের আখ্যান মন ছুঁয়ে যায় ঘাসে লেগে থাকা স্বচ্ছ শিশিরের মতো।
পড়ুন ফারাহ্ সাঈদের গল্প: দরজা দরদিয়া ॥ ফারাহ্ সাঈদ
শেরিফ আল সায়ারের ‘আসলমের সিনেমা’ একটি হাস্যরসাত্মক গল্প। আজগর আলীর বাড়িতে তার ছেলের বালিশের নিচে রাখা পিস্তল নিয়ে গল্পের শুরু এবং পিস্তলটি খেলনার পিস্তল এই রহস্যমিমাংসার মাধ্যমে গল্পের গ্রন্থিমোচন ঘটে।
শেরিফ আল সায়ারের গল্পে সেন্স অব হিউমারের ব্যবহার প্রবল। যা নিঃসন্দেহে গল্পকারের শক্তিমত্তার পরিচায়ক। তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও রসিয়ে বলার ক্ষমতা অনবদ্য। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, এখন অনেক লেখকই মনে করেন, লেখার মধ্যে যদি হাস্যরসাত্মক কিছু এসে পড়ে তাহলে লেখার সিরিয়াস ভাব থাকে না। অথচ বিশ্বসাহিত্য থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের বড় বড় লেখকদের লেখায় সেন্স অব হিউমারের প্রবল উপস্থিতি, যা তাদের লেখাকে আকর্ষণীয় করেছে।
পড়ুন শেরিফ আল সায়ারের গল্প: আসলামের সিনেমা ॥ শেরিফ আল সায়ার
শেরিফ আল সায়ারের গদ্যের ভঙ্গিটাও খুব টানটান। যার ফলে পড়তে শুরু করলে অনায়াসে এগিয়ে যাওয়া যায়। গল্পের প্রথম অংশ থেকে একটু উদাহরণ উদ্ধৃত করা যাক:
‘মমতা বেগম যখন ফোন করে আজগর আলীকে খবরটা দেন, তখনই তার মাথা ঘুরানি অবস্থা। দ্রুত তিনি টয়লেটে ছোটেন। জীবনে যখনই তিনি কোনো টেনশনে পড়েছেন, তখনই তার পেটে প্রচ- জোরে মোচড় দিয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি অফিসের টয়লেটে বসে ছিলেন পাক্বা একঘণ্টা। সেখানে অনবরত ঘেমেছেন। টয়লেটও যে শান্তিমতো হয়েছে, সেও বলা যাবে না। হাই কমোডে বসে থাকতে থাকতে একসময় তার মাথা ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল ছোটখাটো কিংবা বড় কোনো স্ট্রোক হয়ে এখানে তার মৃত্যু হবে। টয়লেটে মৃত্যু হয়ে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকবেন। অনেক্ষণ পর আবিষ্কার করা হবে টয়লেট বন্ধ। তাকে বের করে আনা হবে। তিনি থাকবেন নাঙ্গা। অফিসের কোনো কলিগ সেই নাঙ্গা হয়ে পড়ে থাকার ছবি তুলবে। সেই নাঙ্গা ছবি একজন আরেকজনকে দেখিয়ে বলবে, আহারে আমাদের আজগর ভাই বড় ভালো লোক ছিলেন।’
তবে এই গল্পটির সমাপ্তি গল্পের রস ক্ষুণ্ন করেছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদটির প্রয়োজন হয়তো ছিল না। তিনি যদি একটি পিস্তলটি খেলনার এই তখ্য উদ্ঘাটনের সময় গল্পের রাশ টানতেন, তাহলে হয়তো গল্পটি আর মনোমুগ্ধকর হতো। যদিও শেষবিচারে একজন গল্পকারই তার গল্পের আদিঅন্ত নির্ধারণের মালিক।
মাহরীন ফেরদৌসের ‘মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি’ গল্পটির সময়ের বিস্তার এক রাত। গল্পটি রেবেকার দেয়ালে নড়বড়ে তারকাঁটা ভালোভাবে গাঁথার ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছে। শেষ হয়েছে তার ছোট ভাই রক্তিমের মৃত্যুর ইঙ্গিতের মাধ্যমে। যে ছিল ভুল রাজনীতির শিকার।
পড়ুন এ সংক্রান্ত আরও প্রবন্ধ: আঙ্গিক ভাঙাগড়ার ছয় গল্প ॥ রাকিবুল রকি
ছোট ছোট বাক্যে এর মধ্যে উঠে এসে তার মায়ের কথা, বাবার কথা, ছোট বোন রাবিতার কথা, বড় বোন রোকেয়া, রোকেয়ার দাম্পত্য জীবন, রেবেকার নিজের দাম্পত্য জীবন, কাজের বুয়ার কথা, উঠে এসেছে পরিবারের বর্তমান আর্থিক দৈন্যের চিত্র, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, ভুল রাজনীতির কারণে মানুষের জীবন বিপন্ন হবার কথা। গল্পটিতে ডিটেলসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এতে গল্পের লাভ না ক্ষতি হয়েছে এ বিচারের আগে আমরা গল্প নির্মাণের বিষয় নিয়ে একটু কথা বলবো। গল্পটি দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। গল্পের প্রথম থেকে রক্তিমের আগমনের আগপর্যন্ত এক ভাগ এবং তারপর থেকে শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় ভাগ। প্রথমভাগে আমরা দেখি গল্পকার একের পর এক চরিত্রের, তাদের চারিপাশের, মনোলোকের অবস্থা বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে সংলাপ যৎসামান্য এবং ডিটেলসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, যা গল্পের গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়ভাগ থেকে সংলাপ এবং ডিটেলসের পরিমিত ব্যবহার আমরা লক্ষ করি।
পড়ুন মাহরীন ফেরদৌসের গল্প: মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি ॥ মাহরীন ফেরদৌস
গল্পের রেবেকার একাকিত্ব, সংগ্রাম, দায়িত্ববোধ সবকিছু মিলিয়ে রেবেকাকে গল্পের মূল চরিত্র হিসেবে দাঁড় করালেও লেখক গল্পের ফোকাস কখনো রোকেয়া, কখনো কাজের বুয়া চম্পার মা, কখনো রক্তিমের দিকে ধরাতে গল্পটি ঠিক রসঘন হয়ে ওঠেনি।
তবে এ গল্পের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর আবেগ। লেখক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, নির্মাণ করতে পেরেছেন এক বিষণ্ন আবহ। যা খুব সহজে মন ছুঁয়ে যায়।
সমকালীন গল্পের দ্বিতীয় কিস্তিতে প্রকাশিত দশটি গল্পই বয়নে, কথনে, প্রকাশ ভঙ্গিমায় একটি থেকে অন্যটি পৃথক, স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য একদিন তাদের প্রাতিস্বিক পরিচয়ের ধারক হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।