বাংলার মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে টুসু গান। বাঙালি নারীর অব্যক্ত যন্ত্রণা রূপ পায় এই গানে। গ্রাম বাংলার কুমারি মেয়েরা মনের কথাকে যত্ন করে টুসু গানের মাধ্যমে আমাদের শোনাতে চায়। তাদের গানে যেমন থাকে সমাজের চলমান ছবি, তেমনি থাকে নারীর নিজস্ব পাওয়া-না পাওয়া, রাগ-দুঃখ-অভিমানের কথাও। তাই গ্রাম বাংলার নারীমন তথা নারী সমাজকে বুঝতে সংস্কৃতির শেকড় লোকসংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম এই লোকসংগীতগুলোকে যথার্থভাবে অধ্যয়ন করা জরুরি।
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা লোকসংস্কৃতির আকরভূমি। এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান লোকউৎসব টুসু পরব। স্থানীয়দের কাছে এর আরেক নাম মকর পরব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি থেকে পৌষ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে চলে টুসু পূজা। টুসু পরব উদযাপনের সময় এক মাস ধরে হলেও শেষ চার দিন বিশেষভাবে পালন করা হয়। পৌষ-সংক্রান্তির দিনকে মকর সংক্রান্তি, তার আগের দিন ‘বাউড়ি’ এবং তার আগের দিন ‘চাউড়ি’ নামে পরিচিত। স্থানীয়দের কাছে মকর সংক্রান্তির পরের দিন ‘আখান’ নামে পরিচিত।
সারা মাস ধরে টুসু গান গাওয়া হলেও মূলত পৌষ-সংক্রান্তি বা মকর দিনে ভোরবেলা মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে দেবীকে কাঠের তৈরি রঙিন কাগজে সজ্জিত চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যায়। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অন্যের প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে গাইতে দেবী বিসর্জন দেয়। এই সব গানের বিষয়বস্তু সেই সব এলাকার সমাজের বিভিন্ন ছবিকেই তুলে ধরে। গানগুলোর মধ্যে বিষয়বস্তুর ব্যাপক বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।
প্রচলিত সমাজ জীবনের প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনা এই গানগুলোর মধ্যে স্থান করে নেয়। লোকগানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেগুলো সাধারণ মানুষের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা থেকে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা অবলীলায় সাঙ্গীকৃত করে নিতে পারে। আমরা এখানে টুসু গানের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান কী? এই সমস্ত লোকগানের মধ্যে নারী মনস্তত্ত্ব কিভাবে কাজ করেছে? নারী-জীবনের যন্ত্রণাময় জীবন আলেখ্য কতখানি নারীবাদী ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে? এই সম্পর্কে নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করবো।
পুরুলিয়ায় প্রচলিত একটি টুসু গানের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি দরিদ্র শ্বশুরবাড়ির অভাবী এক গৃহবধূর যন্ত্রণার কথা:
বাপে আমায় বিহা দিলো
ভালো শ্বশুরঘর দেইখে
জনম গেলো মাড় খাইতে
(হামি) রহিব কেমন মতে?১
এখানে একজন দরিদ্র গৃহবধূর নিত্যকালীন অভাব যন্ত্রণার কথা টুসু দেবীর কাছে নালিশের মতো করে শুনিয়েছে কোন এক নাম না-জানা গৃহবধূ। বস্তুতপক্ষে আমরা বাস্তব জীবনে দেখি একজন দরিদ্র মেয়েকে বেশিরভাগ মা-বাবা বিয়ে দেয় দুবেলা-দুমুঠো খেতে পাবে এরকম কোনো ঘর দেখে। মেয়েটির মা-বাবা জানে অবস্থাপন্ন ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে মেয়ের ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। তাই মেয়েটি এখানে টুসুর কাছে নালিশের সুরে বলেছে বাপ মা আমাকে বিয়ে দিয়েছে ভালো শ্বশুরঘর দেখে তবু তার দুবেলা পেট ভরে খাবার জুটছে না, মাড় খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে।
শুধু তার হৃদয়ের অব্যক্ত যন্ত্রণাকেই দেবীর কাছে গানের আকারে প্রকাশ করেছে। পুরুষতান্ত্রিকতা এটাই চায়, তার বানানো নিয়মকে যেন সমাজ স্বীকৃত নিয়ম বলে মেনে নেয় নারী।
এখানে ‘ভালো’ শব্দটিকে একটু বিচার করা প্রয়োজন। আধুনিক সমাজে ছেলে-মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন হয় কার কতটা মন ‘ভালো’ বা শুধু অন্নসংস্থানের থেকে শারীরিক বা মানসিকভাবে ভালো থাকার মতো বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে অনেক বেশি। কিন্তু এখনো সমাজের একটা অংশে শ্বশুরঘরে শুধু খাওয়া পরা বা অন্নসংস্থান হওয়াটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার সার্থক দলিল হয়ে আছে এই লোকগানটি। গৃহবধূটি এখানে দারিদ্র্যের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত শ্বশুর বাড়ি ছাড়ার কথা চিন্তা করেছে, সে হয়তো জানে বাড়িতে এলেও দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়বে না। সে হয়তো তার শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করার মতো শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারবে না, তবু দারিদ্র্যের জ্বালা তার মুখ দিয়ে বলতে বাধ্য করেছে, ‘রহিব কেমন মতে?’
অন্য আরেকটি গানে শ্বশুর বাড়িতে গৃহবধূর কৃচ্ছ্রসাধনের ছবি ধরা পড়েছে:
হল্যদ বনে টুসু তুমি
হল্যদ কেন মাখো না?
শাশুড়ি ননদের ঘরে
হল্যদ মাখা চলে না।২
এখানে একজন সাধারণ গৃহবধূকে শ্বশুর বাড়িতে কিভাবে বিধি-নিষেধে আওতার মধ্যে থাকতে হয়, তারই চিত্র ধরা পড়েছে। গৃহবধূ যেন বিধি-নিষধকেই নিয়ম হিসেবে ধরে নিয়েছে। অথচ তার মনের কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে একটু হলুদ মেখে সাজসজ্জার কিন্তু এটুকু সাজসজ্জার স্বাধীনতাকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ির নিষেধের জাঁতাকলে। গৃহবধূটির সামান্য সাজগোজ করার স্বাধীনতার অধিকারটুকুও নেই। গানটিতে যেন সে স্বীকার করে নিয়েছে, এটাই সমাজের নিয়ম। শাশুড়ি-ননদের ঘরে হলুদ মাখার মতো বিলাসিতা চলে না, এজন্য সে কোনো বিদ্রোহ করেনি, তার কোনো প্রতিবাদ নেই। শুধু তার হৃদয়ের অব্যক্ত যন্ত্রণাকেই দেবীর কাছে গানের আকারে প্রকাশ করেছে। পুরুষতান্ত্রিকতা এটাই চায়, তার বানানো নিয়মকে যেন সমাজ স্বীকৃত নিয়ম বলে মেনে নেয় নারী।
বাঙালি নারীর একটি বৃহত্তম সমস্যা হলো সতীন সমস্যা। নারী অবমাননার এর থেকে আর কোনো বড় দিক হতে পারে না। কোনো একজন পুরুষ নিজস্ব ইচ্ছায় কোনো একজন নারীর সঙ্গে বিচ্ছেদ স্থাপন করতে পারেন অথবা নতুন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, তাতে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কোনো একজন নারীর সুস্পষ্ট উপস্থিতিতে কোনো একজন পুরুষ অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করছে এর থেকে চরম অবমাননাকর বিষয় আর কিছু হতে পারে না। যুগ যুগ ধরে তাই এই বিষয়টি নারীদের কাছে ব্যাপক প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে। নারীরা যেখানেই সুযোগ পেয়েছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, প্রতিবাদ করেছে। লোকসংগীতে যেহেতু নারীর নিজের কথা বলার সুযোগ অনেক বেশি, সেহেতু প্রায় সব ধরনের লোকসংগীত সতীন সমস্যার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। মনে রাখতে হবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে লিখিত অধিকাংশ কাব্যই পুরুষদের লেখা। তাই সেখানে কোনো কোনো জায়গায় নারীর অবহেলা ও বঞ্চনার চিত্র থাকলেও নারীদের নিজস্ব জবানিতে উঠে আসা জীবনালেখ্য প্রায় নেই বললেই চলে।
কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের ভুল ভেঙে যায় যখন দেখি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীবিদ্বেষী মন এর মধ্যেও খুঁজে ফেলে পুরুষকে ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত অর্থাৎ আধিপত্যকামী নারীবিদ্বেষী পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ যেন-তেন-প্রকারেণ নারীদের হীনভাবে বা ছোট করে দেখাবেই।
সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ নিরক্ষর ও গ্রাম্য নারীর নিজস্ব সৃষ্টি লোকসংগীতগুলো এই বিষয়ে প্রবলভাবে ব্যতিক্রম। লোকসংগীতগুলোতেই নারী হৃদয়ের অভাব-অভিমান, সুখ-দুঃখ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সফলভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।
এ রকম একটি টুসু গানে আমরা দেখতে পাচ্ছি গৃহবধূটি তার নতুন সতীনকে সহ্য করতে পারছে না। তাই সতীনকে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে সন্নিপাত ধরিয়ে হত্যার চক্রান্ত করেছে:
আইলো সতিন বইসলো সতিন
খা লো সতিন পাখাল ভাত
অদা ঘরে শুঁয়াই রাখে
ধরাই দিব সন্নিপাত।৩
উপর্যুক্ত গানটির উল্লেখযোগ্য বিষয় এখানে গৃহবধুটি অন্য একজন নারীর প্রতি ক্রোধ ব্যক্ত করেছে। অথচ সেই নারীটির কোনো দোষই হয়তো নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, পুরুষের ইচ্ছায়, পুরুষের নিয়ন্ত্রণে বিবাহ সম্পর্কিত নিয়ম-নীতি পালিত হয়। তাই এখানে যে মেয়েটিকে বা নারীকে পুরুষটি দ্বিতীয়বার বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, সে অভিযোগের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে না। অথচ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে ব্যবস্থা পুরুষ নিয়ন্ত্রিতভাবে হয়ে এসেছে, সেখানে নারী বা পুরুষ কেউই পুরুষকে প্রশ্ন করে না। কেননা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সবসময় এমন ব্যবস্থা রাখার পক্ষে, যেখানে একজন নারীও তার দুর্ভাগ্যের জন্য দোষারোপ করবে অন্য একজন নারীকে।
পাশ্চাত্য লেখক কেট মানে তার ‘ডাউন গার্ল: লজিক অব মিসোজিনি’ গ্রন্থে বিষয়টিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন এটি হলো পিতৃতন্ত্রের ‘ল এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ’ বা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ অর্থাৎ মিসোজিনিস্টরা শুধু পুরুষকে কেন্দ্র করে সমাজকে বিচার করেন, তাই নয় তারা পুরুষতান্ত্রিক রীতিনীতিকে বজায় রাখার পক্ষেও কাজ করেন।
আরেকটি গানে দেখা যায়:
পুরুলিয়াতে দেখ্যে আলি
মায়া লোকের দকান মেলে
এমনি মায়ার দকান মেলা
মরদকে ফাঁদে ফেলে। ৪
উপর্যু্ক্ত গানে দেখতে পাচ্ছি আপাতভাবে নারী অগ্রগতির একটি দৃষ্টান্ত। পুরুলিয়ার মতো অনগ্রসর একটি অঞ্চলের ‘মায়া লোকেরা’ বা মহিলারা আর্থিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে দোকান করেছে বা দোকান দিয়েছে। এটা আপাতদৃষ্টিতে নারী অগ্রগতির একটি সার্থক দৃষ্টান্ত। কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের ভুল ভেঙে যায় যখন দেখি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীবিদ্বেষী মন এর মধ্যেও খুঁজে ফেলে পুরুষকে ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত অর্থাৎ আধিপত্যকামী নারীবিদ্বেষী পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ যেন-তেন-প্রকারেণ নারীদের হীনভাবে বা ছোট করে দেখাবেই। এই গানে এমন ভাবনা একটু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারা যাবে।
তথ্য সূত্র:
১.লোকভূমি মানভূম: সম্পাদনা শ্রমিক সেন ও কিরীটি মাহাতো, বর্ণালী, কলকাতা, এপ্রিল ২০১৫
২.তদেব
৩.তদেব
৪.ছত্রাক পত্রিকা, ১৯৮৯