মনীষী কার্ল মার্কস শ্রমিকজীবনের শোষণ-বঞ্চনার কারণ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বিচ্ছিন্নতার যে তত্ত¡ দিয়েছিলেন তা বিশ্বব্যাপী নানা পরিসরে লক্ষিত হয়। অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে এই বিচ্ছিন্নতার আময় সাহিত্যের ক্ষেত্রভূমিতে বিচিত্রভাবে প্রভাব সঞ্চার করে চলেছে। বিশেষ করে তিরিশোত্তর কাব্যধারায় এই বোধের সার্থক স্ফুরণ লক্ষ করা যায়। কার্ল মার্কস তাঁর ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ গ্রন্থে বলেছেন; প্রতিযোগিতা বিভিন্ন ব্যক্তিমানুষকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, বুর্জোয়াদেরই শুধু নয় বরং আরও বেশি পরিমাণে শ্রমিকদের-প্রতিযোগিতা তাদের একত্রিত করে, তা সত্ত্বেও।’
পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা মানবিক বোধকে অবসিত করে। পুঁজিবাদ পুঁজির গগনবিদারী বিস্তার ছাড়া কিছুই বোঝে না। পুঁজির এরূপ অবিমৃশ্যকারিতা লক্ষ করে মনীষী মার্কস কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে বলেছেন; ‘বুর্জোয়াশ্রেণি যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, গোষ্ঠীতান্ত্রিক এবং রাখালিয়া সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। বিবিধ সামন্ততান্ত্রিক বাঁধনে মানুষ ছিল স্বতঃস্ফ‚র্ত ঊর্ধ্বতনদের কাছে সেগুলোকে এরা ছিঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে, আর মানুষের সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিগোচর স্বার্থের বন্ধন। নির্বিকার নগদ টাকার বাঁধন ছাড়া আর কিছুই এরা বাকি রাখেনি’। ফলে মানুষের সকল ব্যক্তিমূল্য বিনিময় মূল্যে পরিণত করেছে ধনতন্ত্র। এ থেকেই মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা, শ্রেণীবিভক্তি।
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) সাম্যবাদী তত্ত¡দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না কিংবা ধনতন্ত্রের সমর্থকও ছিলেন না। গণতন্ত্রের সহজ সরল অবস্থাবলয়ে তাঁর রাজনৈতিকবোধ ছিল ক্রিয়াশীল। স্বভাবসিদ্ধ মানবতাবাদী প্রকৃতিপ্রেমিক এই কবি মানুষের হঠকারিতা ও ধনতান্ত্রিক অবিমৃশ্যকারিতায় যারপরনাই ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিলেন। শান্ত-স্থিতধী, পশ্চাৎকণ্ঠ কবির সহজ জীবনযাপন ও অকৃত্রিম নান্দনিকতার মূল্যায়ন করে নি সমকালীন পুঁজিবাদী সমাজ। চাকরির জন্য তাঁকেও হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে। অনেক সময় স্বভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারেন নি বলে বারবার চাকরিচ্যুত হয়েছেন। রাজতন্ত্রের সমর্থক হয়েও টি, এস, এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) সে পুঁজির নিগড়ে বাঁধা ইউরোপকে দেখেছিলেন পোড়োভূমি হিসেবে, তেমনি জীবনানন্দের কাব্যযাত্রায় ‘ঝরাপালক’ (১৯২৮) কিংবা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) নামাঙ্কিত অভিধা জীবনের অবসিত পর্যায়কেই উপস্থিত করে। কবির প্রথম আত্মস্বাক্ষরিত কাব্য ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে শুরু করে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’র কবিতা ধনতন্ত্রসৃষ্ট যত রকমের আময় মানুষকে সমাজ-সংসার ও সুন্দরের সাধনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, সেগুলোর কাব্যিক ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন জীবনানন্দ। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘বোধ’ কবিতাতে তিনি উপলব্ধি করলেন :
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখের শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
কার্ল মার্কস দেখেছেন একজন মজুরী শ্রমিক কখনোই নিজের কাজের সঙ্গে একান্ত হতে পারে না। যে শ্রমশিল্পের সঙ্গে শ্রমিকের রক্তঘামের সাধিত্র যুক্ত হয়ে পণ্যের জন্ম দেয়, শ্রমিকের কাছে সেই পণ্যকে বন্য মনে হয়। আর্নস্ট ফিশার-এর ভাষ্য: ‘নিজের সৃষ্ট বস্তু থেকে সে যেমন বিচ্ছিন্ন তেমনি উৎপাদনকর্মে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে সে তার আপন সত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন।’ পুঁজিবাদী সমাজে সবকিছুকেই যখন পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যখন সবকিছুর মধ্যে খোঁজা হয় বিনিময় মূল্য, সেখানে শিল্পী সাহিত্যিকদের যন্ত্রণার সংবেদ থেকে মুক্ত থাকার পথ নেই। শিল্পস্রষ্টারা সংবেদী মনের অধিকারী হন। সমকালীন জীবন, পরিপার্শ্ব যদি ওষ্ঠাগত হয়, প্রতিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে চলবার ধৈর্য এবং স্থৈর্য শিল্পী যখন হারিয়ে ফেলেন, তখনই তিনি বিচ্ছিন্ন বলয় তৈরি করে জ্বরা-ক্লান্তি-বিষণ্নতা কিংবা অবসাদ-নিঃসঙ্গতা অবক্ষয়ী চিত্তবৈকল্যে ভুগতে থাকেন। কবি টি.এস. এলিয়ট, নাট্যকার বের্টোল্ড ব্রেখট, ফ্রানজ কাফফা প্রমুখ ইউরোপীয় আধুনিক সাহিত্যস্রষ্টার রচনায় ধনতান্ত্রিক অবক্ষয় ও ওষ্ঠাগত সময়ের চালচিত্রে বিচ্ছিন্নতার নানা ছবি অঙ্কিত হয়েছে। জীবনানন্দের কবিমানস ও সমকালীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সামূহিক বৈপরীত্য বিদ্যমান ছিল।
বুর্জোয়া শোষণে নিস্পৃষ্ট শ্রমিকরা উৎপাদন কাজে নিজেকে তিলে তিলে বিলিয়ে দিয়ে কিভাবে স্বকীয় সত্তা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি বীভৎস অবস্থায় এসে দাঁড়ায় মার্কস তার লেখায় নানাভাবে যন্ত্রণাক্লিষ্ট শ্রমিক শ্রেণীর এই বিচ্ছিন্নতাজনিত নাজেহাল অবস্থার বর্ণনা করেছেন।
ধর্মীয় সংঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনা, মারী-মন্বন্তর-হানাহানি, বেকারত্ব, দেশের সিংহভাগ মানুষের মৌলিক চাহিদাপূরণের অক্ষমতা, তার নিজের দেখা দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, শেষ পর্যন্ত বরিশালের মাটি থেকে বিচ্যুত হয়ে কলকাতায় গমন তার মানসিক ও কাব্যিক যন্ত্রণার বেদি নির্মাণ করেছিল। যোগ্যতার সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও এম.এ. পাস করেও যাকে জীবনবীমার এজেন্ট সাজতে হয়, ছোটাছুটি করতে হয় ব্যবসার জন্য, তিনি সামাজিক-মানসিক বিচ্ছিন্নতার ছবি আঁকবেন না তো কী করবেন? কাজেই ডিকাডেন্ট জীবনের মর্মমূল থেকে জীবনানন্দ যে বিচ্ছিন্নতার লেখচিত্র অঙ্কন করেছেন, সেটাকে আমরা আরোপিত বলতে পারবো না। বরং বলতে পারি, বাংলার সামাজিক-দৈশিক পরিস্থিতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বলয়ের বোধন কবির এরূপ সাহিত্যসৃষ্টির মানসিক পরিসর নির্মাণ করেছিল।
কার্ল মার্কসের বিচ্ছিন্নতাতত্ত্বকে একজন সমালোচক চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হচ্ছে; প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা, অন্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা, আপন সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতা ও মানবপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা। (তানভীর মোকাম্মেল, মার্কসবাদ ও সাহিত্য) বলাবাহুল্য জীবনানন্দের কবিসত্তার সঙ্গে পরিপার্শ্বের যে বিচ্ছিন্নতা সেখানে উল্লিখিত বিচ্ছিন্নতার সব পর্যায়ই লক্ষ করা যাবে। তিনি এই বিচ্ছিন্নতাবোধের ব্যাপারগুলো দু’ভাবে কাব্যদেহে ধারণ করেছেন। এক পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মানুষ ও অন্যান্য বিষয়ের বিচ্ছিন্নতা; দুই, কবির নিজস্ব সত্তার সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতার বিচ্ছিন্নতা। এগুলো ছাড়াও কবিতার প্রকরণের ক্ষেত্রেও স্বভাবসিদ্ধ বিচ্ছিন্নতা চিহ্ন প্রকটিত। আমরা বিষয়গুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
জীবনানন্দকে বলা হয় প্রকৃতির কবি। বাঙলার রূপ-রস নানা আভরণে তিনি কাব্যদেহে পরিশোভিত করেছেন। এ কারণে কেউ কেউ তাকে রূপসী বাংলার কবি বলে থাকেন। বাঙলার প্রকৃতির সদর্থক ব্যঞ্জনা নিয়ে লেখা কবিতার বই তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। ১৩৪০-৪১ বঙ্গাব্দে রচিত ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে। এখানে বাংলার প্রকৃতির সদর্থক ও নঞর্থক উভয় চিত্রই বিদ্যমান। ইংরেজি তিরিশের দশকের শেষে এই কবিতাগুলো রচনা করলেন কিন্তু কোন পত্রিকায় প্রকাশ করলেন না। এমনকি যে খাতায় এগুলো রক্ষিত ছিল, সেখানে কোনো পরিমার্জনার ছাপ ছিল না।
কবিভ্রাতা অশোকানন্দ দাশ গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এই কাব্যগ্রন্থে যে কবিতাগুলি সংকলিত হল, তার সবগুলিই কবির জীবিতকালে অপ্রকাশিত ছিল; …কবিতাগুলি প্রথমবারে যেমন লেখা হয়েছিল, ঠিক তেমনই পাণ্ডুলিপিবদ্ধ অবস্থায় রক্ষিত ছিল; সম্পূর্ণ অপরিমার্জিত। পঁচিশ বছর আগে খুব পাশাপাশি সময়ের মধ্যে একটি বিশেষ ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে কবিতাগুলি রচিত হয়েছিল।’
আমাদের ধারণা রূপসী বাংলার কবিতাগুলো একটি ভাবাবেগে লিখিত হলেও নিজের স্বভাবের সঙ্গে এগুলোর বৈপরীত্যের জন্যই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবি আর আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। যে প্রকৃতিকে তিনি বিচ্ছিন্নতার আধার হিসেবে নির্মাণ করেছেন, দেখেছেন অবক্ষয়ের প্রতীকে, তাৎক্ষণিক সেটাকে সদর্থক মাহাত্ম্যময় জীবনানুগ করে দেখাকে হয়তো স্ববিরোধিতা মনে করেছেন। ফলে জীবদ্দশায় ওগুলো প্রকাশের কথা আর তিনি ভাবেননি, কি পত্রিকায়, কি গ্রন্থকারে। যাই হোক জীবনানন্দ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে প্রকৃতির যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা জীবনের না-সূচক সীমায় অভিযোজিত। তার প্রিয় ঋতু হেমন্ত এসেছে প্রাচুর্যের স্বপ্নগাথা নিয়ে নয়, এসেছে ঊষরতা আর রিক্ততার খবর নিয়ে। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে প্রকৃতির মধ্যে জীবনের সবুজ মহিমা খুঁজে পায় না। জীবনানন্দের প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতায় হেমন্তের নেতিবাচক ভাবালোক লক্ষ করার মতো :
ক.
প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরাঘাস-আকাশের তারা!
[মাঠের গল্প: ধূসর পাণ্ডুলিপি]খ.
ভাসিছে কুয়াশা
দিকে দিকে, চড়–য়ের ভাঙা বাসা
শিশিরে গিয়েছে ভিজে পথের উপর
পাখির ডিমের খোলা, ঠাণ্ডা-কড় কড়!
শসাফুল- দু’ একটা নষ্ট শাদা শসা
মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা
লতায় পাতায়,
[মাঠের গল্প: ধূসর পাণ্ডুলিপি]গ.
তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেত্রে রোদ গেছে পড়ে,
এসেছে বিকাল বেলা তার শান্ত শাদা পথে ধরে;
তখন গিয়েছে থেমে অই কুড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়’
হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা
শেফালীর বিছানার পর,
মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর!
তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল
চলে গেছে পাড়া গাঁর আইবুডু মেয়েদের দল!
[অবসরের গান: ধূসর পাণ্ডুলিপি]
প্রকৃতিকে যে ভাবে উপস্থাপন করলে জ্বরা-ক্লান্তি-যুগজ্বর-অবসাদ-রিক্ততা-ঊষরতা কিংবা হতাশা-স্থবিরতা-একাকিত্ব-বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, সেভাবেই জীবনানন্দ নিসর্গচিত্র অঙ্কনে স্বাচ্ছদ্য অনুভব করেছেন। এরূপ প্রকৃতিচিত্রে বিবর্ণতা বা অস্বাভাবিকতার পরিলেপন দিতে কবি সিদ্ধহস্ত। অর্থাৎ নিসর্গের প্রাণোচ্ছল, স্বাভাবিক ও সবুজাভ রূপ যেটাকে স্বভাবোক্তি বলা হয়, সেটা তিনি আঁকছেন না। হয়তো বা আঁকলেও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অন্যখানে। জীবনানন্দীয় নিসর্গের বিকৃত রূপের দৃষ্টান্ত:
ক.
যেখানে গাছের শাখা নড়ে
শীত রাতে মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন
যেখানে বন
আদিম রাত্রির ঘ্রাণ
বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান!
[সহজ: ধূসর পাণ্ডুলিপি]খ.
অঘ্রাণের মাঝরাতে
হিম হাওয়া যেন শাদা কঙ্কালের হাতে
এ দেহেরে এসে ধরে!
[পিপাসার গান : ধূসর পাণ্ডুলিপি]
হলুদ নদী, সোনালি সোনালি চিল, নীল হাওয়ার সমুদ্র, সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ, শিঙের মতো বাঁকা নীল চাঁদ, শতাব্দীর নীল অন্ধকার, কমলা রঙের রোদ, হলুদ হলুদ জ্যোৎস্না প্রভৃতি প্রসিদ্ধি ব্যবহার করে জীবনানন্দ নিসর্গের উপাদানের অস্বাভাবিকতার প্রলেপ সংযুক্ত করেছেন।
অন্য মানুষ থেকে কিংবা মানব প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণ জীবনানন্দের কবিতায় নানাভাবে ঘটেছে। স্বকীয় ভনিতায় কিংবা উত্তমপুরুষের অভিব্যক্তিত্বে বিচ্ছিন্নতার প্রথম ঘোষণা শোনা যায় ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘বোধ’ কবিতায়। সকল লোকের মাঝে থেকেও কবি একাকী হয়ে পড়েছেন। পৃথিবীর পথ ছেড়ে নক্ষত্রের পথে যেতে তার ইচ্ছে নেই। অন্যদের মতো তার হৃদয় ও মানুষের মুখ, মানুষীর মুখ, শিশুদের মুখ দেখার জন্য উৎসুক। কিন্তু সেই হৃদয়ই হয়ে উঠেছে অবক্ষয়ের আধার :
চোখের কালোশিরার অসুখ।
কানে যেই বধিরতা আছে,
যে কুঁজ-গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা-পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,
যে সব হৃদয়ে চলিয়াছে
সেই সব।
[বোধ: ধূসর পাণ্ডুলিপি]
আর একারণেই কবিমানসে শূন্যতার অবিমিশ্র সম্পাত ঘনীভূত হয়েছে। কবি লিখেছেন :
সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়
সব চিন্তা প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়।
[বোধ: ধূসর পাণ্ডুলিপি]
যুগের হঠকারিতা আর অবিমৃশ্যকারিতা কবিকে যখন মানবীয় জীবনচেতনা থেকে অপসৃত করেছে, তখন প্রেমের মহিমাতেও তিনি সান্ত¡না খুঁজে পান নি। নারীকে ভেবেছেন ঘাই হরিণী। প্রেমের পাত্রীর মধ্যে দেখেছেন মেকি কৃত্রিমতা। কবির ভাষ্য :
চেয়ে দেখি-দুটো হাত, কখানা আঙুল
একবার চুপে তুলে ধরি;
চোখ দুটো চুন চুন-মুখ খড়ি খড়ি!
থুতনিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি-
সব বাসি, সব বাসি-একেবারে মেকি!
[পরস্পর: ধূসর পাণ্ডুলিপি]
এই মেকি মূর্খ সুন্দরীরা সসম্মানে নিজেদের ঐশ্বর্য আখের গোছাতে পেরেছে :
পৃথিবীর পথে পথে সুন্দরীরা মুর্খ সসম্মানে
শুনিল আধেক কথা-এই সব বধির নিশ্চল
সোনার পিতল মূর্তি তবু আহা ইহাদেরই কানে
অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল।
[ইহাদেরই কানে: মহাপৃথিবী]
এই মেকি কৃত্রিমতাদুষ্ট অসুস্থজীবন চেতনা কবি সমাজে-সংসারে, কালে-কালান্তরে পরিব্যাপ্ত হতে দেখেছেন। শুভবোধ থেকে মানুষ হয়েছে বিচ্ছিন্ন। শ্রেয় আর প্রেয় থেকে সকল মূল্যবোধ তিরোহিত। যুবকেরা হয়েছে নষ্ট তাই সুরঞ্জনাকে নষ্ট যুবকের কাছে যেতে বারণ করেছেন। পঁচিশের নারীরা হয়েছে বিয়াল্লিশে রিরংসার মতন কঠিন :
উনিশ শ বেয়াল্লিশ সালে এসে উনিশশো পঁচিশের জীব
সেই নারী আপনার হংসীশ্বেত রিরংসার মতন কঠিন।
[মহিলা: বেলা অবেলা কালবেলা]
সুষমিত আচরণ ও মানবীয় বোধের সুকুমার বৃত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষের জান্তব প্রকৃতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানুষ কাপড় পরে কিন্তু তার আনুপার্বিক পশুত্ব হার মানায় সবকিছুকে। সভ্যতাগর্বী কলকাতাকে লিবিয়ার জঙ্গলের সঙ্গে তুলনা করে উলঙ্গ আকারসর্বস্ব মানুষ সম্পর্কে কবি লিখেছেন :
নগরীর মহৎরাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব অতিবৈতনিক
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।
[রাত্রি: সাতটি তারার তিমির]
মানবীয় গুণাবলি থেকে সত্যি সত্যিই মানুষ যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে বস্তুসর্বস্ব জীবনচেতনায় আমূলিত হয়, তখন সমস্ত রকমের ভ্রষ্ট আর নষ্ট চরিত্রের বীভৎসা মানুষের জান্তব পরিধিকে বাড়িয়ে দেয়। সমকালীন জীবনবাস্তবতার সন্তাপে এ সব ভয়াবহ আরতির সংবেদ কবি জীবনানন্দ তার কাব্যদেহে ধারণ করেছেন বলিষ্ঠভাবে। মানুষ পুঁজির স্পর্শে কত নির্দয় আর নীচতার আঁধিতে নেমে যেতে পারে সে চিত্র কবির লেখনীতে উঠে এসেছে:
ক.
পৃথিবীর বালি রক্ত কালিমার কাছে তারপর
আমরা খারিজ হয়ে দোটানার
অন্ধকারে তবুও তো
চক্ষুস্থির রেখে
গণিকাকে দেখায়েছি ফাঁদ
প্রেমিককে দেখায়েছি ফাঁকির কৌশল।
[সূর্যপ্রতিম: সাতটি তারার তিমির]খ.
শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ!
চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়-অলীক প্রয়াণ!
মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর;
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোন দিন ঋতু ক্ষণ
অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই।
[এই সব দিন রাত্রি: শ্রেষ্ঠ কবিতা]
এ সবকিছু থেকে কবির মনে হয়েছে; ‘অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’। কবির কাছে স্পষ্ট : ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। পৃথিবীর চলমান জীবন পরিপূর্ণ বৈপরীত্যকে ধারণ করেই মিথ্যার মোড়কে সজ্জিত হয়ে উঠেছে :
যারা অন্ধ সব চেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবীর অচল আজ তাদের সুপ’রামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
[অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ: জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ]
এরূপ অবস্থায় সংবেদী মানুষের আউট সাইডার বা আউটকাস্ট হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরিস্থিতিই মানুষকে এলিয়েনেটেড করে ফেলে। ফ্রানজ কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) ‘দি ট্রায়াল’, ‘দি ক্যাসল; ব্রেখট (১৮৯৮-১৯৫৬) এর নাটক ‘সমাধান’ প্রভৃতিতে কী ভাবে মানুষ তার সত্তা হারিয়ে ফেলে তা সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে।
বুর্জোয়া শোষণে নিস্পৃষ্ট শ্রমিকরা উৎপাদন কাজে নিজেকে তিলে তিলে বিলিয়ে দিয়ে কিভাবে স্বকীয় সত্তা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি বীভৎস অবস্থায় এসে দাঁড়ায় মার্কস তার লেখায় নানাভাবে যন্ত্রণাক্লিষ্ট শ্রমিক শ্রেণীর এই বিচ্ছিন্নতাজনিত নাজেহাল অবস্থার বর্ণনা করেছেন।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘জীবন’ কবিতার ২৩ সংখ্যক অংশে কবি বলছেন : ‘মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন’। ২৯ সংখ্যক অংশে বলছেন : ‘ঘুমাব বালির পরে জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে’।
শুধু কবি জীবনানন্দ দাশই নয়, তার সমকালীন অন্য কবিদেরও ধনতান্ত্রিক সমাজের ক্লেদ ও যুগজ্বর বিচ্ছিন্নতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল। বিষ্ণুদে’র স্বীকারোক্তি, ‘মানুষের অরণ্যের মাঝে আমি বিদেশি পথিক’। সুধীনদত্ত বিচ্ছিন্নতাদৃষ্ট হয়ে বলেছেন, ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী’। জীবনানন্দের কাব্যে কবির Alienation আস্তে আস্তে কবির নিজের কাছেই নিজেকে অপরিচিত করে তুলেছে। শ্রমিকের কাছে নিজের কাছেই নিজেকে অপরিচিত Indifferent বলে মনে হয়। কবিও অবক্ষয়-একাকীত্বের নাগপাশে ছিন্ন হয়ে সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বিশ্বাসের অপমৃত্যু, ক্লান্তিকর একঘেঁয়েমি, এমন কি আমাদের সন্তানদেরও যে হৃদয়ের বলে মনে হয় না সেই ট্র্যাজেডিও তিনি কাব্যে পঙ্ক্তিতে তুলে ধরেছেন। বিচ্ছিন্নতা থেকে ব্যক্তির মৃত্যুর অনিবার্য পরিণামও তিনি চিহ্নিত করে দেন :
ক. আমরা অনেক লোক মিলে তবু এখন একাকী
বংশ লুপ্ত করে দিয়ে শেষ অবশিষ্ট ডোডো পাখি।
[বিভিন্ন কোরাস: মহাপৃথিবী]খ. মানুষের বংশ এসে সময়ের কিনারে থেমেছে,
আমাদের সন্ততিও আমাদের হৃদয়ের নয়।
[ বিভিন্ন কোরাস: মহাপৃথিবী]গ. কেবলই ব্যক্তির, ব্যক্তির মৃত্যু শেষ করে দিয়ে আজ
আমরাও মরে গেছি সব…।
[সূর্য প্রতিম: সাতটি তারার তিমির]
সর্বাংশ কাব্যচেতনায় পরিব্যাপ্ত এই বিচ্ছিন্নতাবোধ কবিরসত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহতাকে রক্তিম করে তোলে। নিজের প্রতি সংশয়িত, নিজের সত্তার প্রতি দ্বিধান্বিত কবির উচ্চারণ :
ক….যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে
জন্ম দেবে জন্ম দেবে বলে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় নাকি? তাহাদের মন
আমার মনের হতো না কি?
[বোধ: ধূসর পাণ্ডুলিপি]খ. কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি
হে নর, হে নারী,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনি নি কোনদিন;
আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শূকরের চীৎকার সেখানে,
শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর
এই সব ভায়াবহ আরতি!
গভীর অন্ধকারের ঘুনের আস্বাদে আমার আত্মালালিত আমাকে কেন জাগাতে চাও?
[অন্ধকার : বনলতা সেন]
জীবনানন্দের অনতিক্রান্ত এই বিচ্ছিন্নতা যাকে তিনি এড়াতে পারেন না বলে সহজ স্বীকারোক্তিতে মেনে নিয়েছেন, সেটা শুধু বক্তব্যে ও চিন্তায় কাব্যদেহে সমাচ্ছন্ন হয় নি। কবিতার প্রকরণে, শব্দে শব্দে, বাক্যে-চরণে সর্বত্র বিচ্ছিন্নতার প্রচ্ছাপ ছড়িয়ে গেছে। বক্তব্য সন্নিবেশে এলোমেলো-পরস্পরবিরোধী ভাবলালিত্যের প্রকাশ তাঁর কাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এক কাব্য থেকে আরেক কাব্যে হয়তো কবিদর্শনের বৈপরীত্য দেখা যায়, যেমন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে নারীকে ঘাই হরিণীর সঙ্গে প্রতিতুলনা করে নারীত্বের অপকর্ষ দেখানো হলো। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যে কবি নারীত্বের মহিমাকে উচ্চে তুলে ঘোষণা করলেন :
মানবকে নয়, নারী শুধু তোমাকে ভালোবেসে
বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।
[তোমাকে: বেলা অবেলা কালবেলা]
কিন্তু একই কবিতায়, একই বাক্যে বক্তব্য সন্নিবেশে, বাক্যসন্নিবেশে এবং শব্দ প্রয়োগে বিচ্ছিন্নতা জীবনানন্দের বিচ্ছিন্নতাবোধের গভীরতাকে স্পষ্ট করে তোলে। বিপরীত বিশেষণের প্রয়োগেও তার বরাবর সোৎসাহ লক্ষ করা যায়। ভীষণ সুন্দর, উল্লাসের মতন যন্ত্রণা, বেদনা উল্লাস, ভয়াবহ স্বাভাবিক প্রভৃতির ব্যবহার বিচ্ছিন্নতার দ্যোতক। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘জীবন’ কবিতার ২৩ সংখ্যক অংশে কবি বলছেন : ‘মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন’। ২৯ সংখ্যক অংশে বলছেন : ‘ঘুমাব বালির পরে জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে’। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র “১৩৩৩” শীর্ষক কবিতায় এক জায়গায় কবির উক্তি :
আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ
তার আগে এই রাত্রিদিন
পড়িতেছে ঝরে!
ঠিক এক পাঁচ লাইন পরে কবি আবার বলছেন :
আমার পয়ের তলে ঝরে নাই তৃণ
তবু সেই রাত্রি আর দিন
পড়ে গেল ঝরে!
সাতটি তারার তিমির কাব্যের ‘মকর সংক্রান্তির রাতে’ কবিতায় কবি মকর সংক্রান্তির রাতের বর্ণনা করে বলেছেন :
মকর সংক্রান্তির রাত অন্তহীন তারায় নবীন
তবুও তা পৃথিবীর নয়
এখন গভীর রাত, হে কালপুরুষ
তবু পৃথিবীর মনে হয়।
[মকরসংক্রান্তির রাতে: সাতটি তারার তিমির]
এখানে লক্ষণীয়, কবি মকর সংক্রান্তির রাতকে নিয়েই কবিতা লিখছেন এবং একই রাতের মধ্যে গভীর রাতকে নির্দেশ করছেন, এটাও পরস্পর অনন্বয়ের নামান্তর। এই কাব্যের ‘সপ্তক’ কবিতায় একই বাক্যে কবির বিচ্ছিন্নতাবোধের স্বাক্ষর সুষ্পষ্ট :
এইখানে সারোজিনী শুয়ে আছে-জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।
[সপ্তক: সাতটি তারার তিমির]
কবি সরোজিনীর শোয়ার বার্তা পরিবেশন করে তৎক্ষণাৎ একই বাক্যে তার অনির্দৃশ্যতার কথা বলেছেন। এভাবে জীবনানন্দের কবিতায় ভাবে, ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবোধ একটি জটিল গ্রন্থি যোজনা করেছে।
ধনতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের ক্লেদ প্রমত্ত শ্রেণিবিভক্তি ঠিক রেখে রাষ্ট্রে কতটুকু কাল্যাণধর্ম আর প্রেমপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, তা কবির বুর্জোয়া মানবতাবাদেরই এই ভাবান্তর। তবু ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার মধ্যে ‘শুশ্রূষার মতো শত শত/ শত জল ঝর্ণার ধ্বনি’ শুনে ইতিবাচক উত্তরণের দিকে জীবনানন্দ পঞ্চাশোত্তর কালে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, এটা আমাদের জন্য কম প্রাপ্তি নয়।
বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসাবে কার্ল মার্কস তার কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেছেন। শিল্পের যে অগ্রগতি বুর্জোয়া শ্রেণী না ভেবেই বাড়িয়ে চলে তার ফলে শ্রমিকদের প্রতিযোগিতাহেতু বিচ্ছিন্নতার জায়গায় আসে সম্মিলনহেতু বৈপ্লবিক সংযুক্তি। বুর্জোয়ার পতন ও প্রলেতারিয়েতের জয় লাভের ভেতরে ধনতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। তিরিশের কবিদের মধ্যে বিষ্ণু দে ও সমর সেন মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের পথ পেয়েছিলেন। ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়ট রোমান ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে পেয়েছিলেন বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের রসদ। কিন্তু জীবনানন্দ না ধর্ম, না মার্কসবাদ এ দুয়ের কোনো কিছুকে অম্বিষ্ট করতে পারেননি।
কাব্যসাধনার প্রথম পর্যায়ে মৃত্যু তথা জীবন থেকে পলায়নকে বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের উপায় ভেবেছিলেন :
কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস
যক্ষার রোগীর মতো ধূঁকে মরে মানুষের মন!
জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ!
মরণ সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে!
[জীবন: ধূসর পাণ্ডুলিপি]
‘বনলতা সেন’ কাব্যের ‘আমি যদি হতাম’ কবিতাতেও বললেন বনহংসের মত জন্ম গ্রহণ করলে শিকারীর গুলির আঘাতে স্তব্ধতা এবং শান্তি ফিরে আসতো। আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা আর অন্ধকার থাকতো না। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় একজন গৃহীর আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের ব্যাপারটিও দেখিয়েছেন জীবনানন্দ। কিন্তু কাব্যসাধনার শেষ পাদে পৌঁছে প্রেমকেই বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের উপায় হিসাবে তিনি বিবেচনা করলেন। ‘বনলতা সেন’ কাব্যে তার ঘোষণা ছিল :
এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
[সূচেতনা: বনলতা সেন]
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থে এসে জীবনানন্দ নিশ্চিত হয়েছেন: ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।’ তার ধারণা :
হয়তো বা মানুষের সমাজের শেষ পরিণতি গ্লানি নয়;
হয়তো বা মৃত্যু নেই, প্রেম আছে শান্তি আছে।
মানুষের অগ্রসর আছে…
আমাদের মৃত্যু হয়ে গেলে এই অনিমেষ আলোর বলয়
মানবীয় সময়কে হৃদয়ে সফলকাম সত্য হতে বলে
জেগে রবে; জয়, আলো সহিষ্ণুতা স্থিরতার জয়।
[মহাত্মা গান্ধী: বেলা অবেলা কালবেলা]
জীবনানন্দের বিশ্বাস মানুষের প্রতি প্রেম মানুষের কল্যাণের সর্বোত্তম সাধনার ভেতর থেকেই বিচ্ছিন্নতাকে অপনোদন আর শান্তি ও স্থিরতাকে জয় করা সম্ভব :
বিদায় নিয়েছে হিংসা ক্লান্তির পানে;
কল্যাণ কল্যাণ; এই রাত্রির গভীরতর মানে।
শান্তি এই আজ
এইখানে স্মৃতি
এখানে বিস্মৃতি তবু; প্রেম,
ক্রমাগত আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি।
[অনেক নদীর জল: বেলা অবেলা কালবেলা]
বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে, ধনতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের ক্লেদ প্রমত্ত শ্রেণিবিভক্তি ঠিক রেখে রাষ্ট্রে কতটুকু কাল্যাণধর্ম আর প্রেমপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, তা কবির বুর্জোয়া মানবতাবাদেরই এই ভাবান্তর। তবু ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার মধ্যে ‘শুশ্রূষার মতো শত শত/ শত জল ঝর্ণার ধ্বনি’ শুনে ইতিবাচক উত্তরণের দিকে জীবনানন্দ পঞ্চাশোত্তর কালে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন, এটা আমাদের জন্য কম প্রাপ্তি নয়।
আরও পড়ুন: চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার পেলেন ৩ জন (ভিডিও)