বিখ্যাত ফরাসি লেখক সমালোচক আন্দ্রে মালরোঁ ১৯৪৫-৪৬-এ ছিলেন শার্ল দ্য গল সরকারের তথ্যমন্ত্রী, তারপর ১৯৫৯-৬৯ পর্যন্ত সংস্কৃতিমন্ত্রী। মালরোঁকে সবচাইতে বেশি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনেছিল ল্যুভ মিউজিয়ম। কেননা, মালরোঁ’র ভাবনা ছিল, জাদুঘর হচ্ছে একটা জাতির অস্তিত্বের প্রকাশ। ‘মুজে ইমাজিনেঘ্’ বা ‘ইমাজিনারি মিউজিয়ম’ শীর্ষক একটি লেখায় তিনি বলেছেন, “মিউজিয়ম ইজ নট্ অ্যা ট্র্যাডিশন, ইট্স্ অ্যান অ্যাডভেঞ্চার”। ল্যুভ জাদুঘরের বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গ উভয় ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিশীলনের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। বর্তমানে ল্যুভ-এর প্রবেশপথে যে-পিরামিডাকার ডিজাইনটি চোখে পড়বে সেটা আগে ছিল না। ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় ১৯৮৯ সালে।
সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, ৭০টি পিরামিড ত্রিভুজ ৬০৩টি ডায়মন্ড এবং সেগুলোকে সামগ্রিকতার আধারে ফুটিয়ে তোলার জন্যে ১,৯০,০০০ টন স্টিল ২,১০,০০০ টন অ্যালুমিনিয়ম ও অন্যান্য সামগ্রিতে সাজিয়ে তুলতে ফরাসি সরকারের ব্যয় হয়েছিল ১.৫ বিলিয়ন ইউরো। বোঝা যাচ্ছে মালরোঁ জাদুঘরকে অ্যাডভেঞ্চারেই পরিণত করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মালরো যখন ইরানে ‘ইরানি চিত্রকলার ৭০০০ বছর’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য রাখছিলেন সেখানে একটা দারুণ মূল্যবান কথা তিনি বলেছিলেন, জাদুঘরের কোনো দেয়াল নেই। অর্থাৎ যতই এটিকে আমরা আয়তনের আকারে দাঁড় করাই না কেন এর কেন্দ্রে রয়েছে সীমানাহীনতার ধারণা। ল্যুভ-এর প্রবেশপথে পিরামিড দেখে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল ‘কেন পিরামিড, এটা কী তাহলে মিশরকে স্মরণ করবার জন্যে’। একই সঙ্গে একথাও অনেকের বক্তব্যে উঠে আসে, আমরা তো মিশর বয়েই বর্তমানে এসেছি। জাদুঘর তাই ঘর হয়েও উন্মুক্ত সেখানে দেয়াল থাকলেও তা বন্ধনহীন এবং সময় সেখানে বিশেষ দেশকালের অনুবর্তী নয় বরং সারা পৃথিবী এসে একক পরিসীমানায় স্থিত হয় জাদুঘরে।
স্থানীয় ইতিহাসের সংরক্ষণ যে আদতে জাতীয় ইতিহাসেরই পরিচর্যা সেটা ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক এইসব দেশের দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে পারা যায়।
মালরোঁ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশিদূর করেন নি। কিন্তু তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন লাইব্রেরি আর জাদুঘর দেখে দেখে। নিৎশে’র ‘উবারমেনশ্খ্’-এর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তিনি। ১৮৮৩ সালে নিৎশে এই আদর্শ ‘সুপারহিউম্যান’-এর উত্থাপন করেন যে হবে ভবিতব্যের আদর্শ মানব। তবে জরথুস্ট্র এবং গ্যেটের মধ্যেও পাওয়া যাবে এমন ধারণা। মালরোঁ মনে করতেন ‘উবারমেনশ্খ্’-এর চেতনায় থাকবে সুউচ্চ সুমহান দর্শন যা বৈশি^ক আলোকোদ্ভাসন ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। আপনারা জানেন, মালরোঁ বিশে^র প্রায় সবক’টি মহাদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বাংলাদেশেও এসেছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণও করবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।
জাদুঘর যে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে সেকথা সকলেরই জানা কিন্তু মালরোঁ জাদুঘরকে বিশ^সভ্যতার ইতিহাসের নিরিখে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন। তাই দেখা যায় ল্যুভ-এ রোমান, গ্রিক, ইতালিয়, বেলজিয়, ডাচ, স্প্যানিশ, ফরাসি, ইংলিশ, ভারতীয় সমস্ত নিদর্শন সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত। একেকটা দেশের নিদর্শন একেকটা দেশের জাতির শক্তি শক্তির রূপান্তর ও বিবর্তনেরই ধারক। আজকে যদি জাদুঘর না থাকতো মিশরিয় সভ্যতার মমি এবং তার সূত্র ধরে সেই সভ্যতার সূত্রে মানবের অগ্রগতি কেবল নর নয় নারী সম্রাজ্ঞীর প্রথা কিংবা তাঁদের জ্ঞান বিজ্ঞান কারিগরি জ্যামিতি বাঁধ-বিশেষজ্ঞতা এইসবের হদিস আমরা পেতাম না। জাদুঘর না থাকলে পোড়ামাটিতে পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য ব্যবিলনিয় গিলগামেশ আমরা পেতাম না। এসিরিয় সম্রাট সারগন যখন ব্যবিলন আক্রমণ করেন, এটা বলা হয়, তিনি তাঁর সৈন্যদের ব্যবিলন জাতির মহাকাব্য গিলগামেশের কোনো ক্ষতিসাধন যাতে না হয় সেদিকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। ব্যবিলনের রাজসংগ্রহ থেকে সৈন্যরা অক্ষত অবস্থায় বয়ে আনে গিলগামেশের ভারি সব মাটির তৈরি পৃষ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ‘ব্লিৎসক্রিগ’ এবং ‘লন্ডন বম্বার্ডমেন্টের’ কথা আমরা জানি। সেইসঙ্গে এটাও বলা হয়, হিটলারের বিশেষ নির্দেশ ছিল বিশ^সভ্যতার অমূল্য নিদর্শনে সমৃদ্ধ লন্ডনস্থ ন্যাশন্যাল গ্যালারি’র যাতে কোনো ক্ষতি না হয়।
জাদুঘরে এই জাদুটা রয়েছে। জাদুকরেরা যে-জাদু দেখান সেটি আপাত কৌশলসর্বস্ব কিন্তু এ-সম্পর্কে জানা হয়ে গেলে আর কোনো কৌতূহল থাকে না। কিন্তু জাদুঘরের যত নিদর্শন সেসবের কৌশল জানা হলে বা না-জানা হলেও মানুষের কৌতূহলের শেষ হয় না। মিশরের পিরামিড কিংবা মমি-সংরক্ষণ নিয়ে আজও ইজিপ্টোলজিস্টরা গবেষণা করে চলেছেন। জাদুঘরের জাদু বাস্তবতানির্ভর যে-বাস্তবতা কাল-মহাকাল পেরিয়েও ভাস্বর। খানিকটা পেছনের দিকে তাকালে দেখবো, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে মহাজ্ঞানী এরিস্টটল তাঁর ‘লাইসিয়াম’-এ বিদ্যা-জ্ঞানার্জনে যে-পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়েছিলেন সেটি বর্তমানের ‘জাদুঘরে’র ধারণার সঙ্গে তুলনীয়। শিক্ষার মূল ভবনের নিকটে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বিশাল-বিচিত্র সংগ্রহ যেখানে ছিল উদ্ভিদ, প্রাণী, বস্তু প্রভৃতির সমারোহ। আধুনিক যে-ট্যাক্সোনমির কথা আমরা জানি সেটির প্রাথমিক প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তাঁর সেই সংগ্রহকে ব্যবহার করে তিনি শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন প্রাণীর, ‘রক্তযুক্ত’, ‘রক্তহীন’ কিংবা পাখি, উভচর, সরীসৃপ, মাছ, পোকা-পতঙ্গ এরকম। সম্রাট আলেকজান্ডার যখনই কোথাও গেছেন বিশেষ করে ভিন্ন জায়গায় যুদ্ধাভিযানে সেখানে গিয়েও তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষককে ভোলেন না। এরিস্টটলের সংগ্রহশালার জন্যে তিনি নিয়ে আসতেন উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী। কাজেই বলা যায়, জ্ঞানের সৃজনে এরিস্টটল যদি তাঁর সংরক্ষণকে কাজে লাগান তাহলে সেক্ষেত্রে ছাত্র আলেকজান্ডারের অবদানও স্মরণযোগ্য।
জাদুঘর এবং এর সংরক্ষণ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার একটা অনুমান লেখাটার শুরুতেই করা গিয়েছিল জাদুঘরের জন্যে ফরাসি সরকারের লক্ষ লক্ষ ফ্রাঁ ব্যয়ের ঘটনা থেকে। একবার ভাবুন মিশরিয় মমিগুলোর সঠিক সংরক্ষণ না হলে সঠিক ইতিহাসের প্রাপ্তি থেকেও আমরা বঞ্চিত হতাম। অনতিতরুণ তুতাংখামুন যাকে কৈশোরোত্তীর্ণ ফারাও বলা হয় দীর্ঘদিন ঐতিহাসিক-প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা ছিল তিনি ছিলেন কোনো এক ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের’ শিকার। কেননা তাঁর মাথার পশ্চাদ্ভাগে ভারি বস্তুর আঘাতের প্রমাণ ছিল। কিন্তু জাদুঘরে কেবল সংরক্ষণ নয়, সেটিকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করবার জন্যে বিশেষ ধরনের সংরক্ষণ-প্রকোষ্ঠ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির যে-বিশাল আয়োজন তা ছিল অচিন্ত্যনীয়। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা এক্স-রে স্ক্যানিং এইসব ব্যবহার করে বর্তমানের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দ্বারা উদ্ভাবন, প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করে দেখালেন অতীতের সত্যকে। তুতাংখামুন আক্রান্ত হয়েছিলেন হাড়ের যক্ষ্মারোগে যেটিকে আমরা বলি ‘বোন টিবি’, তাঁর সুঠাম দেহের অভ্যন্তরের হাড়গুলো অল্প বয়সেই শিকার হয়েছিল অবক্ষয়ের। ফলে তিনি চলন্ত রথের (চ্যারিয়ট) চাকায় জখম হলে সেটিই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আপনারা ভাবতে পারেন, জাদুঘরের জন্যে কিংবা সেখানে সংরক্ষণ করা নিদর্শনের জন্যে এত অর্থব্যয় নিশ্চয়ই পাগলামির সামিল, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডকে পাগলামি বললে উল্টো তারাই আমাদের বলবে পাগল।
বিশ্বের ইতিহাস ঘেঁটে অজস্র দৃষ্টান্ত না দিয়ে আমি কেবল একটা উদাহরণই দিচ্ছি। জার্মানির বার্লিনে সর্বমোট মিউজিয়মের সংখ্যা ৫০। এইসব জাদুঘর নিরেট সংরক্ষণাগার নয় এর পেছনে রয়েছে একটি উন্নত জাতির উন্নত চেতনার প্রতিফলন। জাদুঘরের নামগুলো থেকেই অনুমান করা যেতে পারে জার্মান জাতির জীবনাদর্শের উচ্চতা ও গভীরতা। যেমন ধরা যাক ‘ম্যুজিয়ম র্ফু ইসলামিশ্খ্ কুন্স্ট্’ বা ‘ম্যুজিয়ম ফর ইসলামিক আর্ট’। এরকম ‘ম্যুজিয়ম র্ফু ইন্ডিশ্খ্ কুন্সট্’, ‘ম্যুজিয়ম র্ফু ভোর্ল্কাকুন্ডে’ বা ‘ম্যুজিয়ম ফর এথ্নোলোজি’, ‘ম্যুজিয়ম র্ফু ভোক্সকুন্ডে’ বা ‘ম্যুজিয়ম র্ফ ফোক্লোর’। এসব নাম থেকে তো খানিকটা ধারণা করা যায় কিন্তু এমন জাদুঘরও থাকা সম্ভব যা কেবল অভিনবই নয় উদ্ভাবনীযুক্ত; ‘ম্যুজিকিন্সট্রুমেন্টেন ম্যুজিয়ম’ মানে হলো সংগীতে ব্যবহৃত যত ধরনের বাদ্যযন্ত্র সেগুলোর সংগ্রহ। পৃথিবীর নানা দেশের নানা সময়ের এইসব বাদ্যযন্ত্র দেখলে বোঝা যায় একেকটা মানুষ এবং একেকটা জাতির চিন্তার ধরন ভাবনার প্রকৃতি এবং তাদের প্রকাশের বিচিত্রতা। ভাবা যায়, একটা জাদুঘরের নাম ‘জুকার ম্যুজিয়ম’ মানে হলো ‘সুগার ম্যুজিয়ম’, সোজা বাংলায় ‘চিনির জাদুঘর’।
এছাড়া রয়েছে পোস্ট-ম্যুজিয়মÑ ডাকঘরের সঙ্গে সম্পর্কিত তাবৎ বিষয়বস্তুর সংরক্ষণাগার। জার্মানরাও যে নিজেদের গাঁটের অর্থ ব্যয় করে মিশরের সভ্যতাকে জাদুঘরে সংরক্ষণ করছে সেটা কেবল তাদের নিজেদের জন্যে নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যে, বিশে^র অতীতকে তারা ধারণ করে চলেছে বর্তমানকে বুঝবার জন্যে এবং ভবিষ্যতকে নির্ণয় করবার জন্যে। তাই তাদের জাদুঘরের নাম হয় ‘অ্যাজিপ্টিশ্খেস্ ম্যুজিয়ম উন্ড প্যাপিরাস-সামলুং’ বা ‘মিশরসম্পর্কিত জাদুঘর এবং প্যাপিরাস-সংগ্রহশালা’। জাদুঘরের ধারণা যে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বহুগুণিতক হতে পারে সেটা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা দুরূহ। এ থেকে একটা জিনিষ অনুধাবণযোগ্য; বিশ্বের সভ্যতায় তাদের যে-সমৃদ্ধি ও উন্নতি ধারাবাহিক সাফল্য সেটা তাদের জাদুঘরের সংখ্যা ও বিন্যাসের মধ্যেই প্রতিফলিত। বেশ কিছুকাল বিলেতে বসবাস করে সেখানেও প্রায় একই ব্যাপার লক্ষ করেছি।
জার্মানিতে যে-ম্যুজিয়ম র্ফু ভোক্সকুন্ডে তারই এক চমৎকার সংস্করণ ইংল্যান্ডের ‘ফোক মিউজিয়ম্’ যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘লোক জাদুঘর’। ইংল্যান্ডের প্রতিটি ‘শায়ার’ বা ‘জেলা’য় রয়েছে অন্তত একটি ফোক মিউজিয়ম। সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে নিকট অতীত কিংবা সাম্প্রতিক কালের মানুষের ব্যবহৃত কিংবা মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত বহুবিধ নিদর্শনের এক অসাধারণ ও সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা এই ফোক মিউজিয়ম। ফোক মিউজিয়মকে একদিক থেকে বলা যায়, স্থানীয় ইতিহাসের সংরক্ষণ-কেন্দ্র। ধরা যাক কেম্ব্রিজে দেখেছি কেট্ল্ইয়ার্ড ফোক ম্যুজিয়ম, উর্স্টারশায়ারে সেখানকার ফোক মিউজিয়ম, নরউইচে ওয়ার মিউজিয়ম, ব্র্যাডফোর্ডশায়ারে সে-এলাকার লোক জাদুঘর এভাবে সমস্ত ফোক মিউজিয়মকে একসঙ্গে মেলালে সেই মেলবন্ধনের ফল হয় স্থানীয় ইতিহাস থেকে জাতীয় ইতিহাসের আভিমুখ্য। স্থানীয় ইতিহাসের সংরক্ষণ যে আদতে জাতীয় ইতিহাসেরই পরিচর্যা সেটা ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক এইসব দেশের দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে পারা যায়।
কিন্তু এখনও আমরা অপেক্ষা করছি তেমন একটি জাদুঘরের জন্যে যেখানে এসে আমাদের তরুণ প্রজন্ম গর্বভরে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে, হ্যাঁ, জাদুঘর সেই জাদুই দেখাতে পারে যে-জাদুতে সমস্ত অতীত বর্তমানের আয়নায় আলোকোদ্ভাসিত।
ইংল্যান্ডের ফোক মিউজিয়মগুলোর অভ্যন্তর পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে অনুভব করতে পারি কেন উন্নত বিশ্ব জাদুঘরকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। জাদুঘর যে সভ্যতারই অণুবিশ্ব সেটা এইসব জাদুঘরের বাস্তবতা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। আমার জানা ছিল, ইতিহাস থেকে যেমনটা জানতে পারা যায় আরকি, ইংল্যান্ডের টেমস্ নদী সেই খ্রিস্টপূর্ব আমল থেকেই কঠিন শীতে জমে যেতো। এমনও জেনেছি পুরু হয়ে জমে যাওয়া সেই টেমস্ নদীর ওপর দিয়ে লোকেরা স্বাভাবিক রাস্তায় চলাচলের মতই চলাচল করতো। কিন্তু লোক জাদুঘওে সংরক্ষিত জিনিসপত্র দেখে আমি হতবাক। কয়েকদিন বা একাধিক মাসের একটা ঘটনায় কত কিছুর আয়োজন প্রবাহ চলমান হয়ে উঠতে পারে। মানুষের ইতিহাস সমাজটা যে কত বহুস্তরা ও বিচিত্র হতে পারে ফোক মিউজিয়মের বাস্তবতা থেকে সেটা উপলব্ধি করা যায়। কতগুলো নিদর্শন থেকে দেখলাম ১৬৮৩-৮৪ সালে জমে যাওয়া টেমস্ নদীতে হচ্ছে ‘টেমস্ ফ্রস্ট ফেয়ার’ বা ‘টেমস তুষার-মেলা’।
চিত্রকর থমাস ওয়াইক অসাধারণ এক পেইন্টিংয়ে ধরে রেখেছেন সেই তুষার-মেলাকে। দেখে যেন হয় যেন গতকালের মেলা। ১১ ইঞ্চি বা ২৮ সেন্টিমিটার পুরু সেই বরফ ছিল ২ মাসকাল স্থায়ী। এর আগে ১৬০৮ সালের ফ্রস্ট ফেয়ার-এ দোকানপাট বসেছিল জমাট টেমসের ওপরÑ নাপিত, শুঁড়িখানা, ফলবিক্রেতা, জুতার কারিগররা বসিয়েছিল দোকান। ফুটবল খেলেছিল লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে। নাচগান এবং জুয়ার আসরও বসেছিল। ১৮৩৫ সালের স্যাটার্ডে ম্যাগাজিনেও এর বিবরণ পাওয়া যায়। ১৬৮৩-৮৪ সালের দিকে এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বহুকিছ্; ঘোড়দৌড়, স্কেটিং, পাপেট শো, ফুটবল, বোলিং, স্কিইং, জুয়া, ষাঁড়ের লড়াই, শেয়াল শিকার, পাথর ছুঁড়ে মোরগ-হত্যা। লোকেরা খাবারদাবারেও ছিল যথেষ্ট মনোযোগী। গরুর মাংস, রুটি, খাসির রোস্ট, গরম আপেল, কফি, গরম চকোলেট, চা, জিন এইসব খাবারের উল্লেখ থেকে তাদের সম্পর্কে অনেককিছু জানা যায়। একটা হাতি অনেকক্ষণ সময় ধরে হেঁটে বেড়িয়েছিল মেলায়। মজার ব্যাপার, ডেভিস নামের একজন ব্যবসায়ী বরফজমা টেমসের ওপর স্থাপন করে তার প্রিন্টিং মেশিন। ১২৪ পৃষ্ঠার একটা গোটা বই পেরোলো যেটির নাম ‘ফ্রস্টিয়ানা’। ১৮১৪ সালে প্রকাশিত একটি চমৎকার গ্রন্থের কথা বলা যায় যেটি টেমসের এই তুষার-মেলা ও তৎসম্পর্কিত সমস্ত বিষয়কে এমনভাবে সূত্রবদ্ধ করে যেন ফোক মিউজিয়মগুলোই রূপ নিয়েছে বইয়ের পাতায়Ñ বইটির শিরোনাম ‘আ হিস্ট্রি অব দ্য রিভার টেমস্ ইন্ আ ফ্রোজেন স্টেট: অ্যান্ড দ্য ওয়ান্ডারফুল ইফেক্টস্ অব ফ্রস্ট, স্নো, আইস অ্যান্ড কোল্ড ইন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ইন ডিফারেন্ট পার্টস্ অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারস্পার্সড্ উইথ ভেরিয়াস অ্যামিউজিং অ্যানিক্ডোটস্’।
আমরা কি কখনো খোলা আকাশের নিচে একেবারে উন্মুক্ত জাদুঘরের কথা ভাবতে পারি! সেরকম এক জাদুঘরই হলো ইংল্যান্ডের স্টার্টফোর্ড-আপঅন-আভন-এর ‘শেক্সপিয়র ট্রি গার্ডেন’। শেক্সপিয়রের নামে উদ্যান-বাগান পৃথিবীর নানা জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা কিংবা জার্মানির নাম জানি যেখানে রয়েছে শেক্সপিয়রের সম্মানে উদ্যান কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন। আবার এক আমেরিকারই বিভিন্ন রাজ্যে দেখা যাবে এ বিশ^খ্যাত নাট্যকারের সম্মানে নানা উদ্যান; কানেকটিকাট্, ব্রুকলিন, ইলিনয়, ওহাইও, ক্যালিফোির্নয়া কিংবা আরও নানান জায়গায়। তবে শেক্সপিয়রের আভন নদীর তীরের সেই ‘ট্রি গার্ডেন’টির চরিত্রই আলাদা। শেক্সপিয়রের সাহিত্যে যত বৃক্ষের উল্লেখ পাওয়া যায় সেসবের সব লাগানো হয়েছে এ-বাগানে এবং সংরক্ষণ করা হচ্ছে যুগ-যুগ ধরে। এ এক বিস্ময়কর প্রকল্প। মানুষের উদ্ভাবনী যে কতটা চিত্তাকর্ষক হতে পারে সেটা বোঝা যাবে এখানে এলে। ‘দ্য কমেডি অব এরর’, ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’, ‘আ মিডসামারস্ নাইটস্ ড্রিম’, ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘মাচ অ্যাডো এ্যাবাউট নাথিং’, ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘কিং লিয়র’, ‘দ্য টেম্পেস্ট’ সবই আছে এ-উদ্যানে। ছিল সেই রাণি এলিজাবেথের যুগে, আছে আজও এবং নিশ্চয়ই থাকবে আগামিতেও। এরকম উদ্ভাবনী কি কাজে লাগাতে পারি না আমরাও। আমি মনে মনে ভাবি আমাদেরও রয়েছে এরকম একটি উন্মুক্ত জাদুঘর, হয়তো মৌসুমি-বৃষ্টিময় অঞ্চল বলে তার ওপরটা আবরণে ঢাকা। একটা বিশাল জায়গাজুড়ে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র এবং সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত সেক্টর নির্দেশিত। গোটা দেশ বিভক্ত এগারোটা সেক্টরে। আবার, যে-বীরশ্রেষ্ঠরা শহিদ হয়েছিলেন, জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী জেনে বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজেদের প্রাণ তাঁদের নামগুলোও সেইসব সেক্টরের কোনো না কোনো স্থানে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মত। এমনকি রাতেও সেগুলো জ্বলে, দূর থেকে চোখে পড়ে অগ্নিময় সেসব অকুতোভয় সত্তার নাম। হ্যাঁ, আমরা গর্বিত, আমাদের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। কিন্তু ‘শেক্সপিয়র ট্রি গার্ডেনের’ মতো একটি বিশাল উন্মুক্ত ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের’ স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি যেটি আমাদের জীবৎকালে সম্ভবপর না হলেও হয়তোবা বাস্তব রূপ লাভ করবে ভবিষ্যতের কোনো প্রজন্মে।
জাদুকরের জাদুর অবলম্বন ইতিহাস নয় কিন্তু জাদুঘরের জাদুর আসল অবলম্বনই হলো ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কুতি ও সমকাল যেখানে এসে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি হ্যাঁ, এইসব হলো আমাদের থাকার, আমাদের হয়ে ওঠার, আমাদের সার্থকতার এবং আমাদের গৌরবের স্মারক। ষোড়শ শতাব্দিতে ফ্লোরেন্সের টসকানিতে কোসিমো দ্য মেদিচি যে-ব্যক্তিগত জাদুঘরটি গড়ে তুলেছিলেন একদিন সেটিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল সমগ্র টসকানির জন্যে, পরে সমগ্র দেশের জন্যে এবং শেষে সারা বিশে^র জন্যে। হাঙ্গেরিতে রাজা ম্যাথিয়াস, অস্ট্রিয়ায় ম্যাক্সিমিলিয়ান, চেকোস্লোভাকিয়ায় রাজা রুডলফ, জার্মানিতে অ্যালবার্ট যেখানে যে-রাজাই জাদুঘর গড়ে তুলুন না কেন একসময়ে সেগুলো হয়ে গেছে জনগণের সম্পত্তি। আমরা বিশ্বের সেসব দুর্লভ জাতির মধ্যে অন্যতম যে-জাতি নিজের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে শত্রুর কবল থেকে। কেবল তাই নয় আমাদের জাতিগত পরিপূর্ণতা অর্জনের পথে যেসব ফলক আমরা পেরিয়ে এসেছি বিশ্বের খুব অল্প জাতিরই রয়েছে এমন গৌরবের স্মারক। কিন্তু এখনও আমরা অপেক্ষা করছি তেমন একটি জাদুঘরের জন্যে যেখানে এসে আমাদের তরুণ প্রজন্ম গর্বভরে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে, হ্যাঁ, জাদুঘর সেই জাদুই দেখাতে পারে যে-জাদুতে সমস্ত অতীত বর্তমানের আয়নায় আলোকোদ্ভাসিত।