বিস্ময় বোধের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা, কল্পনার সীমা ও যুক্তির শৃঙ্খলার। কবিতা লিখতে এসে ব্যক্তি চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করবেন বটে, কিন্তু তাকে কল্পনার সীমারেখার মধ্যে বাজিয়েও দেখবেন। একইসঙ্গে মেনে চলবেন যুক্তির শৃঙ্খলাও। মনে রাখতে হবে—কবিতা যুক্তিহীন কল্পনার ফানুস নয়। চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা বটে, তবে কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়। কল্পনার সঙ্গে চিন্তার, আবেগের সঙ্গে প্রজ্ঞার সমন্বয়েই কবিতার অন্তরাত্মা ও বহিরঙ্গের সৃষ্টি। কবি জাকির জাফরানের কবিতাচর্চা সম্পর্কে বলতে, উপর্যুক্ত পটভূমি প্রথমেই মনে আসে।
জাকির জাফরানের এই পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি। এগুলো হলো—‘সমুদ্র পৃষ্ঠা’, ‘নদী এক জন্মান্ধ আয়না’ ও ‘অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী’। বইয়ের নামকরণেই রয়েছে এই কবির আধুনিকতা বোধ ও রুচির আভিজাত্য। প্রথম বইয়ের নাম ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’। অর্থাৎ সমুদ্রকে কবি দেখেছেন বিপুলায়তনের একটি সৌন্দর্য-জ্ঞান-ইতিহাসের অভিজ্ঞান হিসেবে। একইসঙ্গে প্রেমের পুস্তকও। ফলে এটি আর সমুদ্রের পৃষ্ঠ হয় না, হয় পৃষ্ঠা। অর্থা সমুদ্র কেবল দর্শনীয় বস্তু নয়, পাঠ্যও। সৌন্দর্য-জ্ঞানপিপাসু কেবল সমুদ্র দেখেই তৃপ্ত হবেন না, একইসঙ্গে বিস্মিত হবেন এর মোহনীয় রূপ দেখে। আবার বিপুল জলরাশি দেখে, এর আড়ালে যে রূপ-প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে, তা জেনে নিজের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার করবেন সমৃদ্ধ। এদিক থেকে ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’ মানেই হলো বস্তুজগতের নিবিড় পাঠ্যগ্রন্থ।
দ্বিতীয় বই ‘নদী এক জন্মান্ধ আয়না’। এই বইয়ের বিষয়বস্তুতে আগের দুই বইয়ের বিষয়বস্তুর পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। এই বইয়ে একইসঙ্গে ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ, অন্তক্ষরণ ও সামাজিক অবক্ষয়কে তুলে এনেছেন শব্দে-ছন্দে-অলঙ্কারে।
তৃতীয় কবিতার বই অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী। এই বইয়ের বিষয়বস্তু, কবিতার আঙ্গিক প্রথম বই থেকে খুব ব্যতিক্রম নয়। এমনকি ছন্দ-অলঙ্কারেও তেমন বৈচিত্র সৃষ্টি করেননি তিনি। তবে পূর্ববর্তী বই থেকে এই বইয়ে সম্পূর্ণ নতুনত্ব যেখানে দেখিয়েছেন, তা হলো বস্তুসত্য থেকে একটি নিরাপদ দূরত্ব দেখিয়েছেন। নিরেট বস্তু সূর্যকে তিনি দিয়েছেন প্রাণের অস্তিত্ব, একইসঙ্গে একাধিক সূর্যের অর্থাৎ বিচিত্র প্রাণের উৎসের বার্তা পাঠককে দিয়েছেন।সময়ের সাহসী ও মেধাবী সন্তানদের সঙ্গে উপস্থিতকালের রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন যে বৈরী আচরণ করে, তারই একটি পরাবাস্তব চিত্র আঁকা হয়েছে এই ‘অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী’ শব্দগুচ্ছে।
জাকির জাফরানের তিনটি কবিতাগ্রন্থ পাঠ শেষে তার কবিতার যে বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, সেগুলো মোটামুটি এ রকম:
ক) শব্দ-নির্বাচন, শব্দগঠন ও প্রয়োগে মিতব্যয়িতা,
খ) ছন্দ প্রয়োগে স্বাধীনতা ভোগ,
গ) অলঙ্কার নির্মাণ-প্রয়োগে স্পর্শের চেয়ে কল্পনা ও অনুভবের প্রাধান্য,
ঘ) ব্যক্তি দহন, যন্ত্রণা, সুখ, দুঃখ ও কল্পনার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে কবিতার অনুষঙ্গ করো তোলা
ঙ) মৃদু প্রতিবাদ ও নিম্নকণ্ঠের বিদ্রূপ
চ) রাজনৈতিক সচেতনতা
ছ) গল্পের পটভূমি তৈরি
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর আলোকে তার কবিতা পাঠকালে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, সেটি হলো—যাপিতজীবনের চিত্র আঁকায় জাকির জাফরান বেশ যত্নশীল। অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায় তিনি এঁকে চলেন বাস্তব দুনিয়ার ছবি, একইসঙ্গে বর্ণনা করেন কাঙ্ক্ষিত স্বর্গের চিত্রও। অর্থাৎ তিনি একইসঙ্গে বাস্তবতা-কল্পনার মিশেল দিয়ে কবিতার আত্মা-দেহ সৃষ্টি করেন।
আধুনিককালের কবিকে কেবল প্রচলিত শব্দের ওপর নির্ভর করলেই চলে না, তাকে শব্দের স্রষ্টা হতে হয়। প্রচলিত-প্রাপ্ত শব্দরাজির পাশাপাশি নবনব শব্দ নির্মাণের মাধ্যমেই একজন শক্তিমান কবি উপস্থিতকালের অন্যান্য কবির কণ্ঠস্বর থেকে নিজের স্বরকে আলাদা করে তোলেন। জাকির জাফরান বিষয়টি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। প্রথম বই সমুদ্রপৃষ্ঠা থেকেই তিনি এই স্বাক্ষর রেখেছেন। এই বইয়ের কবিতাগুলো সহজ-সরল শব্দসহযোগে রচিত। কোনো জটিল বাক্যের মারপ্যাঁচ নেই কিন্তু গভীর ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি দীর্ঘ-বর্ণনার পক্ষে নন; অল্পকথায় যাপনচিত্র ও মনের নিগূঢ় বাসনা প্রকাশের পক্ষে। জীবনাভিজ্ঞতা বর্ণনায় বাস্তবচিত্রের পাশাপাশি কল্পনার আশ্রয়ও নিয়েছেন। তবে সেই কল্পনা এতই জীবনঘনিষ্ঠ যে, প্রায় চেনাজানা জগৎ থেকে তাকে আলাদা করা যায় না। সে রকম একটি কবিতা রয়েছে প্রথম কাব্য ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’য়—নাম ‘চিঠি’।
মূলত এই কবিতাটিই তাঁকে তার সমকালীনদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেয়। এতে পঙ্ক্তিসংখ্যা মাত্র সাত, স্তবক দুই। এবার কবিতাটি পাঠ করা যাক:
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো ডালে বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে পাখিটির দিকে
আর মনে হলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
(চিঠি: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
পুরো কবিতাটি বিয়োগান্তক, দর্শনময়। মানুষের সঙ্গপ্রিয় স্বভাব, সর্বপ্রাণপ্রেমের পাশাপাশি হৃদয়বৃত্তির প্রসঙ্গও এসেছে এ কবিতায়।
মৃত্যু চিরন্তন। বিজ্ঞান, সভ্যতা অনেকে এগিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভৃত উন্নয়নের কারণে মানুষের অকালমৃত্যু অনেকটাই কমেছে। কিন্তু আজও মৃত্যুকে জয় করা যায়নি। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধর্মীয় পুরোহিত এমনকি শিল্পী-সাহিত্যিক কিংবা বিজ্ঞানীরাও মৃত্যুচিন্তায় কাতর হন। মৃত্যু প্রসঙ্গ মনের কোণে উদিত হওয়া মাত্রই এক অভাবনীয় শিহরণ খেলে যায় মানবদেহে। কিন্তু সে মৃত্যু কেমন হওয়া উচিত? স্বাভাবিক জীবনযাপনকারী মানুষ সাধারণত একবাক্যেই বলেন, স্বভাবিক মৃত্যু চাই। কেবল সংসার জীবনে অসুখী কিছু মানুষ, সমাজচ্যুত কিছু মানুষ কিংবা জীবনের প্রতি বিরাগ জন্মেছে, এমন কিছু মানুষ আত্মহননের মতো সিদ্ধান্ত নেন। বাকিরা স্বাভাবিক মৃত্যুরই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু অস্বাভাবিক কিংবা অপঘাতে মৃত্যু সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ কখনোই কামনা করেন না।
মানুষ সাধারণত মানুষের অপমৃত্যু বা অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত হন। প্রাণীজগতের অন্য কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রে ব্যথিত না হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং উল্লসিতও হন। আবার নিজেই অনেক পশু-পাখি হত্যা করেন। আর এ কাজে মানবজাতি প্রায় নির্বিচারী। পশু-পাখির প্রতি তাদের দরদ তুলনামূল কম। যেটুকু দরদ তারা দেখান, সেটুকু মূলত গবাদি পশুপাখির প্রতিই দেখান। কারণও সবার জানা।
মানবজাতি সুযোগ পেলেই বন্যপশু শিকারে নামেন। আর সুযোগ পেলে গল্পচ্ছলে একজন আরেকজনকে শিকারের গল্প শোনান। কখনো কখনো শিকারের কাহিনীকে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবেও উপস্থাপন করেন। স্বজন হত্যার বিচার চাইতে পারে মানুষ, সে বিচার তারা পায়ও। মানুষ যখন পশু-পাখি শিকার করে, তখন পশুপাখি সমাজে বেদনার স্রোত বয়ে যায় সত্য, কিন্তু তার প্রতিকার প্রার্থী তারা হতে পারে না। কেবল ভাঙা বুক নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে। সে বেদনা মানুষকে সাধারণত স্পর্শ করতে পারে না। মৃত পাখি বা সঙ্গীহারা পাখিটির জন্য শিকারি মানবসন্তানের মনে কোনো বেদনা জাগে না। বরং মানবসন্তানের অনুশোচনার শেষ থাকে না এই ভেবে যে, উড়ে যাওয়া পাখিগুলো কিংবা পালিয়ে যাওয়া পাখিগুলোকেও কেন সে শিকার করতে পারলো না! পশুপাখির সমাজে নিশ্চয় মানবজাতির এই আচরণ বর্বরোচিত আচরণ। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এসব তেমন দোষের নয়। কিন্তু যিনি সর্বপ্রাণবাদী, প্রেমিকহৃদয়, তার মতে, প্রাণীহত্যা মানেই পাপ। তিনি প্রতিটি প্রাণীরই স্বাভাবিক জীবনযাপন ও স্বাভাবিক মৃত্যুর পক্ষে। জাকির জাফরান এই বার্তাটিই তার ‘চিঠি’কবিতায় দিতে চেয়েছেন। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, যে মানবসন্তান বাবার কাছে অঙ্ক কষার ছলে পাখি শিকারের বেদনাময় গল্প শোনেন, তার মনে নিঃসঙ্গ পাখিটির জন্য মমতা জাগে। আর নিঃসঙ্গ পাখিটির সঙ্গে নিজের একাকিত্বকে মিলিয়ে বিচার করেন একই সমান্তরালে। তার মনে পড়ে যায়, প্রেয়সীর সঙ্গে তার দেখা না হওয়ার কথা।
আগেই বলেছি, কবিতাটি ছোট। জাকির জাফরানও খুব অল্পকথায় বলে যান অনেক কথা। এ সময়ের দাগ কেটে যাওয়ার মতো কবিতাগুলোর আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রাণে প্রেম, বেদনাবোধ ও হৃদয়বৃত্তির প্রসঙ্গ যেখানে উঠবে, জাকির জাফরানের ‘চিঠি’ কবিতাটি সর্বাগ্রে সে আসরে উঁকি দেবে বনেদি গৃহস্থবাড়ির সব সামলে শক্তহাতে সংসারের হাল ধরে রাখা লাজুক বউটির মতো।
প্রথম কাব্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ ক্ষুদ্র কবিতার নাম ‘পায়ে বাধা দুটি সর্বনাম’। এ কবিতাটিও ‘চিঠি’র মতোই নির্বাচিত শব্দ ও অল্পকথনে রচিত। এখানেও মানবজীবনে গূঢ় রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু সম্পূর্ণ উন্মোচন না করেই পাঠকের চিন্তার রেখাকে উস্কে দিয়েছেন। কবিতাটি চার স্তবকে রচিত। প্রথম স্তবক এক পঙ্ক্তির, দ্বিতীয় স্তবক চারপঙ্ক্তির, তৃতীয় স্তবক তিন পঙ্ক্তির এবং শেষ স্তবক প্রথম স্তবকের মতোই এক পঙ্ক্তির।
এই কবিতায় ব্যক্তির আন্তঃক্ষরণ ও সামাজিক অস্থিরতার চিত্র আঁকতে গিয়ে তুলে ধরেছেন সকাতর মানবমনের আকাঙ্ক্ষা, বিব্রতকর পরিস্থিতি ও মুক্তির কাঙ্ক্ষা। তীব্র শ্লেষোক্তি ‘নিচু এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন’ বলে সমাজ-ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির প্রত্যাশা, আস্থার প্রসঙ্গ তুলতে তুলতে নিজেকে সমর্পণ করেন নারী ও প্রকৃতির সীমাহীনতার কোলে। একইসঙ্গে নির্মাণ করেন একটি বিস্ময়কর উপমাআশ্রিত চিত্রকল্প—’চুলে/ এত রৌদ্র-কুমকুম, চোখ যেন সমুদ্রপৃষ্ঠা’। জীবন সংগ্রামের পথে পথে ক্লান্তি ও সমাজের কষাঘাতে বিপর্যস্ত কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়-ছায়ার জন্য নিজেকে এভাবেই প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করেন।
এ রকম মিতকথনের আরও একটি কবিতার নাম ‘আমি’। এটি রয়েছে তার দ্বিতীয় কাব্য ‘অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী’তে। পুরো কবিতাটি উল্লেখযোগ্য:
আমার এ জীবন-নকশা
বৃথা যায় প্রভু,
শুকনো পাতার নিচে আজ
চাপা পড়ে গেছি
আমি আগুন আগুন।
(আমি: অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী)
ভাগ্যবিড়ম্বিত ও বিলম্বে উপস্থিত ব্যক্তির চরিত্র আঁকতে গিয়ে একটি পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছে জাকির জাফরান, যেখানে প্রথমে তীব্র হাহাকার ধ্বনিত হয়, পরে নিজের প্রকৃত শক্তিমত্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। সমাজ অনেক সময় উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত স্থানে বসায় না। অযোগ্যরা প্রায় শীর্ষপদে বসে যোগ্যদের পীড়ন করে। পরন্তু সুযোগ পেলে যোগ্যদের সর্বস্বান্ত করে দেওয়ারও চক্রান্ত করে। কিন্তু কবি বলছেন, এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হতে পারে না। এই অবসান হতে হবে। কিন্তু কিভাবে, তার উত্তরও অল্পকথায় তিনি দিয়েছেন শ্লেষোক্তির সাহায্যে। বলেছেন: ‘শুকনো পাতার নিচে আজ/ চাপা পড়ে গেছি / আমি আগুন আগুন।’ শুকনো পাতার নিচে আগুনকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না, আগুন সব কিছু জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। তাই সুবিধাভোগী-শোষক-নিপীড়কদের উদ্দেশে কবির এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ।
স্বল্পতম শব্দে বিপুল ব্যঞ্জনা তৈরি করতে জানেন জাকির জাফরান। শব্দ খরচের ক্ষেত্রে তিনি যেন কৃপণ, খুব হিসাব করে শব্দ ব্যয় করেন। তবে যে কটি শব্দ তিনি নির্বাচন ও প্রয়োগ করেন, সে কটি শব্দ যেন, তার তিনশ গুণ বেশি শব্দের ব্যঞ্জনা ধারণ করে। সে রকম একটি স্বল্পভাষী কবিতার নাম ‘ঘর’। এ কবিতায় কেবল মানবজীবনের প্রেম-কামের চিত্রই আঁকা হয়নি, একইসঙ্গে চিত্রিত হয়েছেন সবচেয়ে কঠিন দার্শনিক প্রত্যয়ও। নারী-পুরুষের পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতার এক অনন্য আখ্যান এই ক্ষুদ্র কবিতা। কবিতাটিতে কোনো শব্দের কোনো জটিলতা নেই, নেই কোনো দুর্বোধ্য শব্দের প্রয়োগও। এবার পাঠ করা যাক কবিতাটি:
ঘর মানে শুধুই ঠিকানা নয়
নয় শুধু ধূসর খেয়াল।
ঘরের ভেতরেও নদী বয়
নারী ছাড়া নদী ছাড়া
ঘর মানে শুধুই দেয়াল।
(ঘর: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
মাত্র কয়েকটি সরল-অজটিল শব্দে জীবনের এমন গূঢ় তত্ত্ব আবিষ্কারই জাকির জাফরানকে দার্শনিক প্রত্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি মানবজাতিকে শোনান নারীপুরুষের সমান গুরুত্বের কথা, সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা; একইসঙ্গে প্রেম-কাম-যাপনের তাৎপর্যও।
আধুনিককালে কবিরা ছন্দকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন এবং কবিতায় এর প্রয়োগ করেন। রবীন্দ্র-উত্তরকালের সব প্রধান আধুনিক কবিই ছন্দ মেনে চলেছেন, কবিতায় ছন্দকে নিজের মর্জিমতো বাজিয়েছেন। যারা ছন্দ আয়ত্ত করতে পারেনি, তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে ছন্দের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করেছেন। উত্তরকালে ছন্দসিদ্ধ কবিতাই টিকে আছে, ছন্দবিদ্বেষীরা হারিয়ে গেছেন। ফলে প্রকৃতি কবিরা মানেন—কবির প্রাথমিক অভিজ্ঞানপত্রই হলো ছন্দসিদ্ধি। ব্যত্যয়ে হাজার শব্দের জড়ভরত উৎপাদিত হবে, কবিতা হবে না। জাকির জাফরান বিষয়টি জানেন ও মানেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি ছন্দানুগ। ছন্দবৈচিত্র্য নেই তেমন, এমনকি ছন্দ নিয়ে তিনি তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেননি। নিরূপিত ছন্দের প্রচলিত রীতিকেই তিনি মান্য করেছেন। তবে ছন্দ প্রয়োগে তিনি স্বাধীনতা ভোগ করেছেন অতি-মাত্রায়। এ কারণে অক্ষরবৃত্তীয় কবিতাগুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তিনি পর্ব-পঙক্তি-মাত্রাবিন্যাসের স্বাভাবিক রীতিকে তেমন গ্রাহ্য করেননি।
কিন্তু যে কটি কবিতায় তিনি নিরূপিত ছন্দের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, সে কবিতাগুলো যেমন শ্রুতিমধুর, তেমনি হৃদয়গ্রাহীও।
ক)
দল বাঁধিয়াছি কালো চোখের অক্ষরে।
পরিচয় দিবসের ঘ্রাণে
সংবেদনার রক্তে আমি জবুথবু, মহাকাল।
লাজুক ধানের মতো ছাত্রী ভেসে আসে
বই খাতা হাতে
রুল-করা আকাশের দিকে
চোখ, আর
একটি মাছ ভালোবাসে একটি পাখিকে।
(সংবেদনা: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
খ)
মনের ছবি দেহের গোপন বাঁকে
ভেসে ওঠে মেঘের মতো ওড়ে
পাখ-পাখিনী রঙ্গ করে বলে
ধর্মের কল অন্ধকারে নড়ে।
(আগুন নিয়ে খেলা: নদী এক জন্মান্ধ আয়না))
গ)
পাখিদের ঠোঁটে ঝুলে আছে এ জীবন
কখন যে পড়ে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়
তবুো থামেনি প্রেমিকের আনাগোনা
জেগেছে বিরহ, জাগেনি মৃত্যুভয়।
(হৃদয়ওয়ালা: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
ঘ)
প্লাস্টিক সুন্দরী বাঁচে হাজার বছর
ফুল পাখি পাতা আজ কেঁদে কেঁদে যায়
প্রকৃত সুন্দর কেন এত যে নশ্বর
জল আর জীবনের অববাহিকায়।
(দুরারোগ্য প্রণয়: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
উদ্ধৃত কবিতা ও কবিতাংশগুলোর মধ্যে প্রথম ও শেষটি অক্ষরবৃত্তের, দ্বিতীয়টি স্বরবৃত্তের ও তৃতীয়টি মাত্রাবৃত্তের উদাহরণ। এই তিনটি উদারণ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে জাকির জাফরান ছন্দে সিদ্ধি অর্জন করেছেন। তবে মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্তে তিনি খুব বেশি কবিতা রচনা করেননি। তার প্রায় সব কবিতা-ই অমিল-অসমপঙ্ক্তির অক্ষরবৃত্তে রচিত। আর অক্ষরবৃত্তে লিখতে গিয়ে পঙ্ক্তিসাম্য বজায় রাখেননি। কখনো কখনো কবিতার পঙ্ক্তিগুলোকে করে তুলেছেন গদ্যবাক্যের কাছাকাছি। এর ফলে বাক্যস্থিত পর্বগুলোয় মাত্রাসমতাও রক্ষিত হয়নি। কিন্তু তার শব্দবিন্যাসে এক ধরনের প্রবহমানতা রয়েছে, যা মাত্রার ভারসাম্যহীনতাকে পুষিয়ে দেয়। প্রকৃতিপক্ষে তিনি ছন্দপ্রয়োগে স্বাধীনতা ভোগ করেন। তবে বিষয়টি কবিতার নিবিড়পাঠককে বিব্রত করে না।
জাকির জাফরান মিথভাষী হলেও তার কবিতার ভাষা নিরলঙ্কৃত নয়। অধিকাংশ কবিতাই সালঙ্কৃত। উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ ও প্রয়োগে তিনি স্পর্শ-ইন্দ্রিয়ের চেয়ে কল্পার সীমাহীনতা ও অপার অনুভবপ্রবণতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে তার কবিতা অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে কখনো কখনো হয়ে উঠেছে কল্পনা-স্বপ্নের ভুবন। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তির দহন, যন্ত্রণা, সুখ, দুঃখ ও কল্পনার পাশাপাশি সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়কেও কবিতায় তুলে এনেছেন। আবার সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কবিতাকে স্লোগান করে তোলেননি। তার প্রতিবাদের ভাষা কোমল, নিচুকণ্ঠের। এমনকি বিদ্রূপেও মৃদুভাষ্যের। তিনি প্রায় কবিতার ভেতর কোনো না কোনো গল্পের বীজ বুনে দেন।
তবে চিত্রকল্প নির্মাণে তিনি যতটা অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখেন, ততটাই কল্পনার আশ্রয় নেন। ফলে তার চিত্রকল্প আশ্রিত পঙ্ক্তিগুলোয় সৃষ্টি হয় এক পরাবাস্তব জগৎ। জাকির জাফরান কবিতাকে প্রবহমান রাখতে গিয়ে প্রায় অন্ত্যমিল-মধ্যমিল বর্জন করেছেন। অনুপ্রাস তার কবিতায় নেই বললেই চলে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক:
ক)
…নৌবহরের মতো ভেসে চলে মা’র চুল
স্তিমিত বাতাসে। (মা: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
খ)
আকাশে গ্রেনেড ওড়ে প্রাচীন অভ্যাসে। (ছাত্রী জেগে ওঠে: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
গ)
হেমন্তের বাদামী ওষুধ আর চকোলেট ভর্তি লরি আসে, শীত এলে। (শীত: অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী)
ঘ)
তরমুজ কাটলে দুভাগ হয়ে পড়ে থাকে তার লাল আকাশ। (লাল আকাশ: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো একেকটি চিত্রকল্পের উদাহরণ। প্রথম দুটিতে মূলত সময়ের অস্থিরতাকে প্রকাশ করা হয়েছে। শেষের দুটিতে কব্যিক-কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে।
কবিতা শব্দে-ছন্দে-অলঙ্কারে রচিত প্রপঞ্চ। তাই এর আঙ্গিক-প্রকরণ নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক, শেষপর্যন্ত বিষয়বস্তুই এর মুখ্য অনুষঙ্গ। পুরনো বিষয়কেও নতুনভাবে উপস্থাপনে কে কতটা সাফল্য দেখাতে পারেন, সেটিই পাঠক-সমালোচকের কাছে বড় প্রশ্ন। জাকির জাফরানের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ নারী, প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, রাজনীতি ও সামাজিক অবক্ষয়।
ক.
নিশ্চল সময় থেকে দূরে, আরো দূরে, কোনো দিন
সহায়ক স্মৃতি যদি মনে পড়ে, নক্ষত্রের প্রস্থান যদি
মনে আসে, তবে, সার্থক শব্দের পাশে
দুটি বাক্য জুড়ে দিও, বলিও তোমার প্রেম,
বলিও জাকির জাফরান চিরদিন বৃথা যায়, বৃথা গেল।
(নক্ষত্রের প্রস্থান: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
খ.
কালো এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন।
গোস্তাখি মান করো প্রিয়। কম্পমান বাসনার মতো দুঃখিত যুবরাজ, দেখিনি কখনো। ভাল্লাগছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এ দেশ, এই ভেজা চুলের জঙ্গল। আর খেলাচ্ছলে ঘটে যাওয়া প্রথম এই মিরাকল। ভাল্লাগছে। নিচু আকাশের তলে তুমি এক এক কুহু-প্রায়। অত্যন্ত পাখি তুমি। প্রাণেরও কৈতর তুমি। মেঘ হয়ে ভাসো দেখি বিছানায়।
(প্রিয়ঝু সিরিজ-১৭: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
গ.
ফিরে এসো অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী
ফিরে এসো অগ্নিদগ্ধ দেহমাদল
যে কোনও নিদ্রাহরণের আগে
রক্তজলে শয্যা পাতার আগেই ফিরে এসো
(অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী: অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী)
ঘ.
আমার বিনিদ্র রাত দিয়ে
বানানো যাবে কি সেই সন্ধ্যা
যার মধ্যে থাকবে তোমার
নীল জোনিপোকার আস্তানা?
(সন্ধ্যা: অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী)
ঙ)
কেউ দেখেনি কেউ দেখেনি সোনা
নাভির নিচে জাগছে পান্থশালা
বকুল গাছের মান ভাঙানো রাতে
শরীর যেন বকুল ফুলের মালা।
(বকুল গাছের মান ভাঙানো গান: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
চ)
নদীও কূটনীতি জানে,
কথা দিয়ে কোনোদিও জল সে দেয় না,
কোনোদিনও সমুদ্রে মেশে না,
তৃষ্ণার্ত হোসেন হায়! নদী এক জন্মান্ধ আয়না।
(নদী এক জন্মান্ধ আয়না: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
ব্যক্তিগত দুঃখবোধকে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা কবিদের থাকে। জাকির জাফরানও তার ব্যতিক্রম নন। উদ্ধৃত কবিতাংশগুলোয় তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সামষ্টিকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা যেমন করেছেন, তেমনি উপস্থিতকালের বিষয়কে উত্তরকালে এবং জাতীয় বিষয়কে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দেওয়ারও সাধনা করেছেন। সময়কে দেখেছেন তীব্র এক অবক্ষয়ের ভেতর, দেখেছেন মানুষের ক্রুর-জটিল রূপ, প্রেমহীনতা, নিষ্ঠুরতা। তীব্র শ্লেষোক্তিতে বলেছেন, ‘নদীও কূটনীতি জানে।’ তাই নদীকে মানবের স্বভাবের ভেতর আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। সুরুচি-সুবোধ সমাজ থেকে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে বলে তার ক্ষোভের অন্ত নেই। এ কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সুসময়-সুরুচিকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তীব্র ক্ষোভে যেমন বলেছেন, ‘কালো এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন’ তেমনি দেখেছেন, ‘নাভির নিচে জাগছে পান্থশালা’ও। অর্থাৎ একই সঙ্গে তিনি দ্রোহী ও প্রেমিক। এই প্রেম কেবল মানবপ্রেমেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রকৃতিতেও সমানভাবে বিলিয়ে দিতে চান তিনি।
জাকির জাফরান ও তার সমসাময়িকদের কবিতা পাঠের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘এ সময়ে যারা কবিতা লেখার কসরৎ করতে চেয়েছেন, তাদের সিংহভাগেরই রচনা হয় তীব্র ভাবাবেগের স্ফূরণ মাত্র, নয় কোনো মতবাদ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষিক রূপ। যা তারা প্রেমিকা বা কোনো নারীর উদ্দেশে কিংবা মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে লিখেছেন। কিন্তু মনের স্বাভাবিক অবস্থায় ওই রচনার শিল্পমান নিয়ে কখনো ভাবেননি। প্রয়োজনও মনে করেননি। এ কথা সত্য—ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রকাশ-প্রবণতা আধুনিকদের মজ্জাগত। কিন্তু আজকের যে তরুণরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদের অভিরুচিই গড়ে ওঠেনি। যা গড়ে উঠেছে, তা হলো অন্যকে বোঝার চেয়ে বোঝানোর, বহির্জগতের নানা প্রপঞ্চ জানার চেয়ে নিজেকে বিজ্ঞপিত করার মানসিকতা।’ (বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের কবিতা: মোহাম্মদ নূরুল হক)। কিন্তু জাকির জাফরানের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো খাটে না। তিনি অপ্রস্তুত কবিযশপ্রার্থী নন। তার কবিতায় রয়েছে প্রচুর জীবনাভিজ্ঞতার ছাপ, কল্পনার স্ফুরণ। শব্দে, বিষয়ে, ছন্দে, অলঙ্কারে, প্রকাশশৈলীতে তিনি হয়ে উঠেছেন তার সময়ের অন্য দশ কবির চেয়ে আলাদা।