কাব্যপ্রেমীদের কাছে ফরাসি কবি জাঁ নিকোলা আর্তুর র্যাঁবো সবসময়ই একটি বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তার শৈলীর নতুনত্ব, বহুবর্ণিল ও জীবনমুখিতা কবিতাগুলোকে খুব সহজেই ওই সময়ের সাহিত্যসমাজে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। সেগুলো পরবর্তী সময়ে যুগের পর যুগ ধরে পাঠকসমাজে নন্দিত হয়ে এসেছে। একইসঙ্গে প্রেম, দর্শন, নিসর্গচেতনা ও ব্যক্তিগত আবেগ মিলেমিশে তার কবিতাকে এক উচ্চ পর্যায়ের শিল্পে পরিণত করেছে, যা পাঠককে করেছে আকৃষ্ট। র্যাঁবোকে মনে করা হয় বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে নন্দিত ও নিন্দিত কবিদের একজন। তাই তাকে যেমন অনেকে একদিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তেমনি তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন দুনিয়ার বহু বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক। আর সে কারণেই তার রয়েছে পৃথিবীব্যাপী অগুনিত ভক্ত। র্যাঁবোর নাম উচ্চারিত হয় উনিশ শতকের খ্যাতিমান ফরাসি কবি-কথাকার আলফানস ডি লামারটিন, ভিক্টর হুগো, শারল বোদলেয়ার, পল ভ্যালেরি ও স্টেফান মালার্মের সঙ্গে।
১৮৫৪ সালের ২০ অক্টোরর বেলজিয়ামের সীমান্তের কাছে ফ্রান্সের আরদেন অঞ্চলের শার্লভিল শহরে জঁ নিকোলা আর্তুর র্যাঁবোর জন্ম। র্যাঁবোর বাবা ফ্রেদেরিক র্যাঁবো ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। তিনি তার আর্মি ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই কাটিয়েছিলেন। ১৮৪৪ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত তিনি আলজেরিয়া জয়ের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। এসময় তার পারফর্মেন্সের জন্য তাকে লেজেন্ড অব অনার দেওয়া হয়। তিনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন। তার লম্বা গোফের জন্য তিনি সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।
শিক্ষকরা তার প্রতিভা দেখে বিস্মিত হতেন। আর সেই অল্প বয়সেই তিনি ফরাসি, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি ল্যাটিন ভাষায় লিখলেন ষাট পঙ্ক্তির একটি কবিতা।
আর মা ভিতালি কুইফ ছিলেন ফ্রান্সের অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আরডেইনাস পরিবারের মেয়ে। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে র্যাঁবো ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তার চেয়ে এক বছরের বড় ছিল এক ভাই ফ্রেদেরিক ও ছোট দুবোন। তৃতীয় বোন ভিতালির জন্ম ১৮৫৮ সালে এবং সবচেয়ে ছোট বোন ইসাবেলার জন্ম ১৮৬০ সালে। ক্যাপ্টেন বাবা ফ্রেদেরিক খুব অল্পদিন তাদের সঙ্গে ছিলেন। শুধু অফিসিয়াল ছুটির দিনগুলোয় তিনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেন কিন্তু অত্যন্ত একগুঁয়ে স্বভাবের স্ত্রী ভিতালি কুইফের সঙ্গে তার মনোমালিন্য লেগেই থাকতো। ফলে ভীষণ ধার্মিক ও দায়িত্বপরায়ণ, একগুঁয়ে নারী ভিতালি কুইফের হাতে সন্তানদের দায়িত্ব তুলে দিয়ে ফ্রেদেরিক ১৮৬০ সালে স্থায়ীভাবে সংসার ত্যাগ করে চলে যান। তাদের মধ্যে কখনো ডিভোর্স হয়নি কিন্তু তারা দুজনেই চিরদিন বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করেছেন। এদিকে ধর্মপরায়ণ অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা সহজ সরল ছোট ছেলে র্যাঁবোর ওপর তার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দিতে চাইলেন। মায়ের চাপিয়ে দেওয়া নানা নিয়মকানুন ও ধর্মের অনুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন র্যাঁবো। ১৮৭১ সালে তার লেখা ‘সাত বছরের কবিরা’ নামক কবিতায় তিনি ওই সময়ের মনোভাব ও বিদ্বেষ প্রকাশ করেন এভাবে:
‘এবং মা বাড়ির জন্য পড়ালেখা করার বইটি বন্ধ করলেন
তিনি সন্তুষ্ট এবং গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে গেলেন, এবং দেখলেন না কুঁচকানো কপালের নিচের নীল চোখগুলোকে
তার শিশুর ঘৃণায় ভরে ওঠা আত্মাটিকে’
দুই.
১৮৬২ সালে আট বছর বয়সে র্যাঁবোকে রসেট (Rossat) ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তিনি পড়ালেখায় এতটাই মনযোগী ছিলেন যে, তাকে স্কুল থেকে ১৮৬৬ সালে ডবল প্রমোশন দেওয়া হয়। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ালেখা করেছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন শান্তশিষ্ট ঈশ্বরভীরু এক পড়ুয়া বালক। এসময় তিনি বাইবেলের পাশাপাশি পড়েছেন জেমস ফেমিমোর, কুপার ও গুস্তাভ আইমারডের লেখা গল্পগুলো। পরে পড়েছেন বোদলেয়ার, মুসে ও লুসের কবিতা। শিক্ষকরা তার প্রতিভা দেখে বিস্মিত হতেন। আর সেই অল্প বয়সেই তিনি ফরাসি, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি ল্যাটিন ভাষায় লিখলেন ষাট পঙ্ক্তির একটি কবিতা। আর পাঠিয়ে দিলেন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ানের ছোট ছেলের কাছে। তবে সেই কবিতার কোনো অনুলিপি পাওয়া যায়নি।
তিন.
পড়ালেখায় ভালো ফলের জন্য র্যাঁবো অনেক পুরস্কারও পেয়েছিলেন স্কুল জীবনে। তার কবি জীবন ছিল সবমিলিয়ে ১৮৭০-৭৪ এই পাঁচ বছর। তবে ১৮৭০ সালকেই মনে করা হয় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তার পাঁচ বছরের কবি জীবনের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছে এ বছরটিতে। এ সময় তিনি ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ল্যাটিন ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রিয় শিক্ষক জর্জ ইযামবার র্যাঁবোর সঙ্গে ভিক্টর হুগো, বভিলসহ অন্যান্য বিখ্যাত সব ফরাসি সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম তার ল্যাটিন ভাষায় লেখা কবিতা প্রকাশিত হয় এবং কবিতাটির জন্য তিনি স্কুল থেকে পুরস্কার পান। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন হতে থাকে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে বিদ্রোহের রূপটি প্রকট হয়। সেই বিদ্রোহ প্রথমে ঘোষিত হয় সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে। ১৮৭৩ সালে লেখা ‘নরকে এক ঋতু” কাব্যগ্রন্থে তার সেই বিদ্রোহী মনোভাবেরই প্রকাশ পেয়েছে। ‘নরকে এক ঋতু’ থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়লেই বোঝা যাবে কবির সেই সময়ের মনোভাব।
খানিকক্ষণ আগেও যদি আমি সঠিকভাবে মনে করতে পারি, আমার জীবনটি ছিল একটি দীর্ঘ উৎসব সেখানে সমস্ত হৃদয় ছিল প্রশস্ত, সেখানে শরাবের নহর বয়ে যেতো।
এমনই এক রাতে সৌন্দর্যকে কোলে তুলে নেই। এবং তাকে ত্যক্তবিরক্ত দেখি। এবং আমি তাকে অপদস্থ করি।
ন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে নিজেকে সশস্ত্র করেছিলাম।
আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। হায় ছলনাময়ী, হায় দুঃখ দুর্দশা, হায় বিদ্বেষ, আমার সমস্ত সহায়সম্পত্তি তোমার হাতেই গচ্ছিত রইলো।
মন থেকে আমি আমার সকল মানবিক আশা আকাঙ্ক্ষা মুছে ফেলতে পেরেছি
হিংস্র প্রাণীর মতো আমি আমার সমস্ত আনন্দ উল্লাসকে ছোবল মেরে গলা টিপে মারি
আমি জল্লাদদের ডেকেছিলাম, যেন মরার সময় আমি তাদের বন্দুকের বাঁট কামড়ে ধরতে পারি
আমি মহামারীদের ডেকেছিলাম আমাকে ধুলোয়-রক্তে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য
দুর্ভাগ্যই আমার ঈশ্বর। আমি কাদায় লুটোপুটি খেয়েছি। শরীর শুকিয়েছি অপরাধের নিঃশ্বাসে। আর মশকরা করেছি উন্মত্ততার সঙ্গে।
এবং বসন্ত নির্বোধের ভয়ানক হাসিটিকে আমাকে কাছে নিয়ে এসেছিল।অতপর, সম্প্রতি যখন নিজেকে শেষ চিৎকারের কাছে আবিষ্কার করলাম! এটি আমাকে আবারও সেই প্রাচীন উৎসবের চাবি খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ করলো, যেখানে আমি আরও একবার আমার ক্ষুধা ফিরে পেতে পারি।
পরোপকার হোলো সেই চাবি।—এই অনুপ্রেরণাই প্রমাণ করে যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম!’
(নরকের এক ঋতু, অনুবাদ: ফারহানা রহমান)
চার.
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অর্থাৎ ১৮৭০ সাল থেকেই র্যাঁবো বাড়ি থেকে পালানো শুরু করেন। আর ১৬ বছর অর্থাৎ এই বয়সটিতেই কবিতাতে তার নিজস্ব একটি স্বর ফুটে ওঠে। তার উঠতি বয়সের আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, স্বাধীনতার প্রতি তার একাগ্র মনোভাব এসব কিছুই ফুটে ওঠে এসব কবিতায়। ১৮৭০ সালের জুলাই মাসে যখন ফ্রান্স আর জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ বাধে ওই সময় র্যাঁবো রাজনীতির ব্যাপারে হঠাৎ করেই খুব উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এসময় স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় র্যাঁবোর স্কুলকেন্দ্রিক ফর্মাল পড়ালেখাও শেষ হয়ে যায়। এবছরের আগস্ট মাসে প্রথম তিনি নিজ শহর শার্লভিল থেকে বিনা টিকিতে ট্রেনে করে প্যারিসে চলে আসেন। স্টেশনে নামা মাত্রই স্থানীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মাজাসের কারাগারে আটকে রাখে। সেখান থেকে তার প্রিয় শিক্ষক ইযামবার তাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেন কিন্তু দেখা গেলো একমাস পরেই অর্থাৎ অক্টোবর মাসে তিনি আবারও পালিয়ে যান বেলজিয়ামের দিকে।
কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তিনি সাফাই দিলেন এই বলে যে, ‘নরকে এক ঋতু’ লেখার পর তার আসলে আর নতুন কিছু লিখার বাকি নেই। তিনি যা কিছু কবিতায় বলতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ স্বর্গ নরক অথবা ঘুম আর নির্ঘুমতা তার সবকিছুই এখানে তিনি বলে ফেলেছেন
প্রথমে শার্লরোয়ায় কিছুদিন থেকে র্যাঁবো সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলেন এবং পরে আবার ব্রাসেলসে ফিরে যান। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পুলিশের সহায়তা নিয়ে মা তাকে নিজ শহর শার্লভিলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু ১৮৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবারও পালিয়ে যান প্যারিসে। এ সময় তিনি কপর্দকহীন অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, পত্রপত্রিকা পড়েন ও ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খান। অসহনীয় দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এবছরের মার্চ মাসে র্যাঁবো আবারও শার্লভিলের দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেন। এ সময় তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে লাইব্রেরিতে পড়ালেখা শুরু করেন। তিনি এবার বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও সমাজতন্ত্রীদের রচনাবলীর সঙেগ্ পরিচিত হন। আরদেন উন্নয়ন নামক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু এপ্রিলে সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবারও প্যারিসের পথে যাত্রা করেন। র্যাঁবোর জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তার ‘দূষিত রক্ত’ কবিতাটির বর্ণনার মাধ্যমে কিছুটা বোঝা যায়:
‘কোনো রকম পেশার কথা শুনলেই আমার গা গোলায়। মালিক বা শ্রমিক, সবাই গ্রাম্য, নীচ। যে হাত কলম ধরে আর যে হাত লাঙল চালায়–এ দু’য়েরই সমান দাম। এ শতাব্দিতে দেখি হাতই সবকিছু, কী দারুণ এক হাতের শতাব্দি এটা। আমার কখনোই হাত থাকবে না। এরপর চাকর বাকরের ওপর অতি নির্ভরতার কারণে আমরা নানা জটিল ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। ভিক্ষাবৃত্তির সততা আমাকে কষ্ট দেয়। দুষ্কৃতকারী আর ছিন্নমুণ্ড নপুংসক এই দুজনকে দেখলেই আমার বমি পায়। আমি, আমি এখনো অক্ষত আছি, এবং এতে আমার কিছু যায় আসে না।’
(দূষিত রক্ত, অনুবাদ: শিশির ভট্টাচার্য)
পাঁচ.
র্যাঁবো একটি কথা স্পষ্ট করেই বলে গেছেন যে, ‘কবিতা লেখা হয়, লেখা যায় না। কবিরা কবিতা লেখেন না বরং কবিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কাব্য রচিত হয়। কবি মাত্রই জন্মগতভাবে কবি, জোর করে কবি হওয়া যায় না ।’ র্যাঁবো মনে করতেন, কবিরা হচ্ছে মিস্টিক বা বাউল, যারা নিজের মন ও শরীরকে ব্যবহার করে অজানার সন্ধান করেন এবং অনির্বচনীয় জগতের সন্ধান পাওয়ার পর সেই জগতের বিভিন্ন দিক সাধারণ মানুষের কাছে বর্ণনা করার চেষ্টা করেন। প্রচলিত ভাষার শব্দ ও বাক্য যেহেতু অনির্বচনীয় জগতের বর্ণনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই কবিরা উপমার আশ্রয় নেন। তবে শুধু উপমাই কবিতা নয়। উপমা অবশ্যই কবিতার অন্যতম উপাদান তবে উপমা, ছন্দ ও কবির অবিজ্ঞতা সব কিছু মিলিয়েই একটি কবিতা সৃষ্টি হয়। বাস্তব জগৎ থেকে কবির আবিষ্কৃত জগৎ যত বেশি আলাদা হয়, উপমার দুর্বোধ্যতা ততই বাড়তে থাকে, আর কবিতায় চলে আসে পরাবাস্তবতা।
ছয়.
আর্তুর র্যাঁবো প্রকৃতপক্ষেই লিখেছেন একেবারেই কম কবিতা। সবমিলিয়ে তার মাত্র আশিটির মতো কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। আগেই বলেছি, ১৮৭০–১৮৭৪—এই পাঁচ বছর মাত্র তার কাব্যজীবন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম লেখা শুরু আর প্রথমদিকে তিনি অন্য আর সব কবিদের মতোই অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লেখা শুরু করেন। শেষ দুবছর তিনি কাব্যময় গদ্যরচনা করেন। ১৮৭৩ সালে ‘নরকের ঋতু’ আর ১৮৭৪ সালে ‘বোধি’ নামক দুটি চমৎকার পরাবাস্তব গদ্যকাব্য রচনা করেন। স্বাধীনতার পূজারি, চিরবাউণ্ডুলে, খ্যাপাটে স্বভাবের বিদ্রোহী এক মন নিয়ে বেড়ে ওঠা আর্তুরের কাছে নিজের লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো একবার পড়েই ছিঁড়ে ফেলা বা ফেলে দেওয়াটা একটা খেলায় পরিণত হয়েছিল। আর তাই তার যেটুকু রচনা তিনি নষ্ট করার সুযোগ করে উঠতে পারেননি শুধু সেটুকুই পাঠক পড়ার সুযোগ পেয়েছে। মাত্র ২০ বছর বয়সে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তিনি সাফাই দিলেন এই বলে যে, ‘নরকে এক ঋতু’ লেখার পর তার আসলে আর নতুন কিছু লিখার বাকি নেই। তিনি যা কিছু কবিতায় বলতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ স্বর্গ নরক অথবা ঘুম আর নির্ঘুমতা তার সবকিছুই এখানে তিনি বলে ফেলেছেন। অবশ্য এরপরেও তিনি ১৮৭৪ সালে ‘বোধি’ নামক গদ্য কবিতাটিও লিখেছেন। আর সেটিই শেষ। আর কখনো তিনি কবিতা লেখেননি। তবে ছাড়েননি পথ চলা আর বাউণ্ডুলেপনা। বহু দেশ ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর বেশিরভাগই তাও আবার পায়ে হেঁটে। আজন্ম অস্থির ও পরিব্রাজক র্যাঁবো কোথাও বেশিদিন স্থির হয়ে কাটাতে পারতেন না।
সাত.
১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি পল ভ্যারলেন (Paul Verlaine) তাকে প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানান। আর তখন থেকেই শুরু হয় ভ্যারলেনের সঙ্গে র্যাঁবোর রহস্যময় সেই কিংবদন্তী প্রেমের। ১৮৭২ সালের পুরো বছর দুই বন্ধু মিলে প্যারিসের ক্যাফেগুলো চষে বেড়ান আর ঘুরে বেড়ান ইউরোপে মহাদেশের বহু শহর গ্রাম আর অলিগলি। র্যাঁবোর সঙ্গে ভারলিনের মাত্রাতিরিক্ত সম্পৃক্ততায় ভারলিনের স্ত্রী মাতিলদে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের কথাবার্তা চলতে থাকে। ৭২ সালের জুলাই মাসে মাতিলদে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারলিন স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে রাস্তায় বের হন এবং ওই সময় র্যাঁবোর সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে যায়। এসময় তিনি ঘর-সংসার সব কিছু ত্যাগ করে র্যাঁবোর সঙ্গে ব্রাসেলসে পালিয়ে যান। কয়েকমাস বেলজিয়ামে অবস্থান করে সেপ্টেম্বরে দুবন্ধু মিলে লন্ডনে এসে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন। এ সময় তারা ইংরেজদের কাছ থেকে ইংরেজি ভাষা শিখতে চেষ্টা করেন এবং তার পরিবর্তে তাদের ফরাসি ভাষা শেখান। নভেম্বরের দিকে আর্থিক অবস্থার চরম অবনতি হলে র্যাঁবো শার্লভিলে ফিরে আসেন। কিন্তু ভারলিন লন্ডনেই থেকে যান। ১৮৭৩ সালের মে-জুলাই মাসের দিকে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। ফলে র্যাঁবো ব্রাসেলস ছেড়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। আর এ সময়ই র্যাঁবোর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে তাকে গুলি করেন ভারলেন। র্যাঁবো হাতে সামান্য আঘাত পান আর ভ্যারলেন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। জুলাইয়ের শেষের দিকে র্যাঁবো তার বিখ্যাত কাব্য ‘নরকের এক ঋতু’ এর কাজ শেষ করেন। অক্টোবরে লেখাটি বাজারে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। এরপরের কয়েক বছর র্যাঁবো একা একা বহুদেশ চষে বেড়ান। ১৮৭৪ সালে প্রথমে আসেন লন্ডন। এখানে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং ইলিউমিনিশন বা ‘বোধি’ কাব্যটি সমাপ্ত করেন। বছরের শেষের দিকে তিনি হুজুগের বসে পিয়ানো বাজানো শিখতে শুরু করেন।
ওখানে গিয়ে জানতে পারলেন যেম রাজা মেনেলিক অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে চলে গেছেন। কবে ফিরবেন অথবা আদৌ ফিরবেন কি না, কেউ জানে না। ফলে চালানের সমস্ত টাকা লোকসান হতে একপ্রকার পথে বসেন র্যাঁবো।
আট.
১৮৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকেই তিনি জার্মানির স্টুটগারডে জার্মানি ভাষা শেখার জন্য বসবাস শুরু করেন। এসময় তিনি পায়ে হেঁটে সুইজারল্যান্ড ও আল্পস পর্বতমালা পার হয়ে ইতালিতে ঢোকেন। ইতালির মিলান শহরে এসে র্যাঁবো ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জুনের দিকে কিছুটা সুস্থ হলে স্প্যানিশ ভাষা শেখার উদ্দেশ্যে স্পেনে চলে যান। এরপর স্পেন থেকে প্যারিস হয়ে অস্ট্রিয়ায় যান। ১৮৭৬ সালের এপ্রিল মাসে ভিয়েনা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ান পুলিশ তাকে ভিয়েনা থেকে বের করে দেয়। এ সময় তিনি পুরো দক্ষিণ জার্মান অঞ্চল পায়ে হেঁটে ফ্রান্সে এসে পৌঁছান। ওই বছরের মে মাসের দিকে হল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় এসে পৌঁছান। সেখান থেকে মাত্র তিন সপ্তাহ পরে পালিয়ে গিয়ে আবারও ইউরোপে ফিরে আসেন। ফিরে আসার ভাড়া না থাকায় জাহাজের খালাসির কাজ করে ভাড়া পরিশোধ করেন। ১৮৭৭ সালে সুইডেন ও ডেনমার্ক ভ্রমণ করেন সার্কাস দলের সঙ্গে। ওই বছর মে মাসে আমেরিকান কনস্যুলেটে গিয়ে আমেরিকান নেভিতে চাকরির দরখাস্ত করেন। সেপ্টেম্বরে আসেন ফ্রান্সের মার্সেই শহরে। কিছুদিন পর আবার রোমে চলে যান। ১৮৭৮ সালে সুইজারল্যান্ড হয়ে মিলান, তারপর জাহাজে করে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছান। সেখান থেকে সাইপ্রাসে যান বাড়ি তৈরির ঠিকাদারি করার জন্য। এরপর ১৮৮০ সালের মার্চ মাসে সাইপ্রাসে এসে ট্রুডো পাহাড়ের চূড়ায় ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের বাড়ি তৈরির কাজের সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানেও বনিবনা হয়নি। ফলে লোহিত সাগরের বন্দরের দিকে রওয়ানা হন। জেদ্দা, সুয়াকিম, মাসাউয়া, হোদেইদা ইত্যাদি জায়গায় কাজের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন। এ সময় মারেজান নামক এক কোম্পানিতে কাজ নিয়ে এডেন বন্দরে আসেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে জেলিয়া বন্দর থেকে একটি ক্যারাভানের সঙ্গে মোমালিয়ার মরুভূমিসহ ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ডিসেম্বরে ইথিওপিয়ার হায়ার শহরে এসে পৌঁছান।
নয়.
১৮৮৬ সালের অক্টোবর মাসে রাজা মেনেলিকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন র্যাঁবো। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২ হাজার বন্দুক, ৭৫ হাজার কার্তুজের একটি চালান, ৩০টি উট আর ৩৪ জন চালক ও একজন দোভাষী নিয়ে শোয়ার রাজধানী আনকোবারের পথে রওয়ানা হন। চারমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভ্রমণের পর গিয়ে পৌঁছান আনকোবারে। ওখানে গিয়ে জানতে পারলেন যেম রাজা মেনেলিক অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে চলে গেছেন। কবে ফিরবেন অথবা আদৌ ফিরবেন কি না, কেউ জানে না। ফলে চালানের সমস্ত টাকা লোকসান হতে একপ্রকার পথে বসেন র্যাঁবো। মানসিক অবসাদগ্রস্ত র্যাঁবো ১৮৮৭ সালের শেষের দিকে বাম হাঁটু ও ঊরুতে ভীষণ ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এদিকে কিছুটা সুস্থ হতেই ১৮৮৮ সালের মার্চ মাসে তিনি অস্ত্রের গোপন চালান নিয়ে অম্বাদু রওনা হলেন। ঘোড়ার পিঠে করে ১১ দিনে ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অম্বাদু পৌঁছান। ওখান থেকে চলে আসেন ওবোকো শহরে। এরপর ৮৮ সালের মে মাসে তিনি অস্ত্রের ব্যবসা পুরোপুরি ছেড়ে দেন। এরপর হারারে পৌঁছে নিজের টাকায় একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান খোলেন।
দশ.
১৮৯১ সালের মাঝামাঝি এসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ডান পায়ে প্রচণ্ড ব্যথাসহ র্যাঁবো হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় মাকে চিঠি লিখে আসতে বলেন। মে মাসের শেষে তার পা অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়। জুলাইতে রেলওয়ের এক ওয়াগনে করে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। আগস্ট মাসে বোন ইসাবেলাকে সঙ্গে নিয়ে মারসাই শহরের দিকে রওনা হলে পথে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন। ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে আগস্টের ২৫ তারিখে একজন যাজকের কাছে পাপ স্বীকার করেন তিনি। ওই বছরেই অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর সকাল দশটায় এই বিস্ময়কর বাউন্ডুলে কবি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ ১০ নভেম্বর। আজ তার ১২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।