কাব্যপ্রেমীদের কাছে ফরাসি কবি আর্তুর র্যাঁবো সবসময়ই একটি বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তার শিল্পের উচ্চমান, স্টাইলের নতুনত্ব ও বহুবর্ণিল জীবনমুখিতা তার কবিতাগুলোকে খুব সহজেই ওই সময়ের সাহিত্য সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেছিল। তার বিষাদময় প্রতীকী কবিতাগুলোর অভিনব ভাষা ও নির্মাণ শৈলী যুগের পর যুগ ধরে পাঠক সমাজের কাছে আকর্ষণীয়, বহুল পঠিত। অপরিসীম আগ্রহের বিষয় হয়েও রয়েছে। প্রেম, দর্শন, নিসর্গবোধ ও ব্যাক্তিগত আবেগ মিলেমিশে গিয়ে তার কবিতাকে এক উচ্চ পর্যায়ের শিল্পে পরিণত করেছে; যা পাঠককে করেছে একইসঙ্গে সন্তুষ্ট ও আকৃষ্ট। র্যাঁবোকে মনে করা হয়, বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে নন্দিত ও নিন্দিত কবিদের একজন। তাই তাকে যেমন অনেকেই একদিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তেমনি তার ডাকে সাড়াও দিয়েছেন দুনিয়ার বহু বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক। আর সে কারণেই তার রয়েছে পৃথিবীব্যাপী অগনিত ভক্তপাঠক। র্যাঁবোর নাম উচ্চারিত হয় উনিশ শতকের ফরাসি কবি আলফানস ডি লামারটিন, ভিক্টর হুগো, শার্ল বোদলিয়ার, পল ভ্যালেরি ও স্টেফান মালার্মের সঙ্গে।
১৮৫৪ সালের ২০ অক্টোরর বেলজিয়ামের সীমান্তের কাছে মেজ নদীর তীরে, ফ্রান্সের আরদেন অঞ্চলের শার্লভিল শহরে জঁ নিকোলা আর্তুর র্যাঁবোর জন্ম হয়। শিশু বয়স থেকেই মায়ের চাপিয়ে দেওয়া নানা নিয়মকানুন ও ধর্মের অনুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি সঞ্চিত করেন বিষাদের শক্তি। ফলে চরম বৈরী পরিবেশেই একেবারে কিশোর বয়সেই তার কবিতায় ফুটে উঠেছিল এক অভিনব স্বর। আবিষ্কৃত হয়েছিল কবিতার নতুন মাত্রা, নতুন পথ, নতুন ধ্যানধারণা। তার গভীর ধ্যানমগ্ন, দুর্দান্ত স্বেচ্ছাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত সব কবিতাই লেখক-পাঠক সমাজে তাকে করে তুলেছিল অনন্য সাধারণ এক ব্যতিক্রমধর্মী কবি।
বালক র্যাঁবোর কখনোই পড়াশোনায় মন বসেনি। অথচ ক্লাসে সবসময় প্রথম স্থানই দখল করতেন। এই অনন্য মেধার অধিকারী বিস্ময়কর বালক র্যাঁবো চরম বৈরী পরিবেশেই একেবারে অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন। সাকুল্যে পাঁচ বছর লেখালেখির সঙ্গে নিজেকে নিবেদিত করেই যুক্ত হয়ে ছিলেন। তার বয়স যখন ১৬ তখন থেকে শুরু করে ২০ বছর। আর তখনই লেখালেখির জগৎ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে দাঁড়ান। ২১ বছর বয়সে এসে ঘোষণা দেন, তিনি যতটুকু লেখার, লিখে ফেলেছেন। এরপর কোনো কিছু লেখার মানেই হবে কেবলই পুনরাবৃত্তি।
র্যাঁবোর বাবা ফ্রেদেরিক র্যাঁবো ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। তিনি তার আর্মি ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই দেশের বাইরে কাটিয়েছিলেন। ১৮৪৪ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়া জয়ের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। এসময় তার পারফর্মেন্সের জন্য তাকে লেজেন্ড অব অনার দেওয়া হয়। তিনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন। তার লম্বা বড় গোঁফের জন্য বেশ জনপ্রিয়ও ছিলেন।
১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম তার ল্যাটিন ভাষায় লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির জন্য স্কুল থেকে পুরস্কার পান। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন আসতে থাকে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে বিদ্রোহের রূপটি প্রকট হয়। সেই বিদ্রোহ প্রথমে ঘোষিত হয় সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে।
আর মা ভিতালি কুইফ ছিলেন ফ্রান্সের অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আরডেইনাস পরিবারের মেয়ে। দু’ভাই আর দু’বোনের মধ্যে র্যাঁবো ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তার চেয়ে এক বছরের বড় ছিলেন ভাই ফ্রেদেরিক ও ছোট দুই বোন। তৃতীয় বোন ভিতালির জন্ম ১৮৫৮ সালে। সবচেয়ে ছোট বোন ইসাবেলার জন্ম ১৮৬০ সালে। ক্যাপ্টেন বাবা ফ্রেদেরিক খুব অল্পদিন তাদের সঙ্গে ছিলেন। শুধু অফিসিয়ালি ছুটির দিনগুলোতে তিনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেন। কিন্তু অত্যন্ত একগুঁয়ে স্বভাবের স্ত্রী ভিতালি কুইফের সঙ্গে তার মনোমালিন্য লেগেই থাকতো। ফলে ভীষণ ধার্মিক ও দায়িত্বপরায়ণ, একগুঁয়ে নারী ভিতালি কুইফের হাতে সন্তানদের দায়িত্ব তুলে দিয়ে তিনি ১৮৬০ সালে স্থায়ীভাবে সংসার ত্যাগ করে চলে যান। তাদের মধ্যে কখনো ডিভোর্স হয়নি। কিন্তু তারা দুজনেই চিরদিন বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করেছেন। এদিকে ধর্মপরায়ণ অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা সহজ সরল ছোট ছেলে র্যাঁবোর ওপর তার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দিতে চাইলেন। ফলে সংসারত্যাগী পিতার মতোই বালক র্যাঁবোও বারবার সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে লাগলেন। মাত্র পাঁচ বছর লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেই তার আশ্চর্যজনক সব ব্যাখ্যাতীত পঙ্ক্তি দিকে প্যারিসের ওই সময়ের সমস্ত দুঁদে শিল্পী-সাহিত্যিকদের একেবারে চমকে দিয়েছিলেন। ১৮৭১ সালে তার লেখা ‘সাত বছরের কবিরা’ নামক কবিতায় তিনি ওই সময়ের মনোভাব ও বিদ্বেষ প্রকাশ করেন এভাবে:
মা বাড়িতে পড়ালেখা করার বইটিকে বন্ধ করে
সন্তুষ্ট এবং গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন,
অথচ তিনি একবারের জন্যেও তাকিয়ে দেখলেন না পর্যন্ত
তার শিশুটির কুঁচকানো কপালের নিচের
নীল চোখগুলোতে তার প্রতি ঘৃণায় ভরে ওঠা আত্মাটিকে…
০২.
১৮৬২ সালে আট বছর বয়সে র্যাঁবোকে রসেট (Rossat) ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তিনি পড়ালেখায় এতটাই মনযোগী ছিলেন যে, তাকে স্কুল থেকে ১৮৬৬ সালে ডবল প্রমোশন দেওয়া হয়। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ালেখা করেছিলেন। স্কুল জীবনে ছিলেন শান্তশিষ্ট ঈশ্বরভীরু এক পড়ুয়া বালক। এসময় তিনি বাইবেলের পাশাপাশি পড়েছেন জেমস ফেমিমোর, কুপার ও গুস্তাভ আইমারডের লেখা গল্পগুলো। পরবর্তী সময়ে বোদলেয়ার, মুসে ও লুসের কবিতাসহ আরও অনেক কবির কবিতা তিনি পড়ে ফেলেন। শিক্ষকরা তার প্রতিভা দেখে সবসময়ই বিস্মিত হতেন। আর সেই অল্প বয়সেই তিনি ফরাসি, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় বেশকিছু কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ল্যাটিন ভাষায় লিখলেন ষাট পঙ্ক্তির একটি কবিতা। আর পাঠিয়ে দিলেন সম্রাট ৩য় নেপোলিয়ানের ছোট ছেলের কাছে। তবে সেই কবিতার কোনো অনুলিপি পাওয়া যায়নি।
০৩.
পড়ালেখায় ভালো ফলের জন্য স্কুলজীবনে র্যাঁবো অনেক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তার কবি জীবন ছিল সাকুল্যে (১৮৭০-৭৪) চার বছর। এই কবি জীবনের মধ্যে ১৮৭০ সালকেই মনে করা হয় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তার পাঁচ বছরের কবি জীবনের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছে ১৮৭০ সালে। এ সময় তিনি ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ল্যাটিন ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রিয় শিক্ষক জর্জ ইযামবার র্যাঁবোর সঙ্গে ভিক্টর হুগো, বভিলসহ বিখ্যাত সব ফরাসি সাহিত্যিকের সাহিত্যের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম তার ল্যাটিন ভাষায় লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির জন্য স্কুল থেকে পুরস্কার পান। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন আসতে থাকে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে বিদ্রোহের রূপটি প্রকট হয়। সেই বিদ্রোহ প্রথমে ঘোষিত হয় সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে। ১৮৭৩ সালে লেখা ‘নরকে এক ঋতু’ কাব্যগ্রন্থে তার সেই বিদ্রোহী মনোভাবেরই প্রকাশ পেয়েছে। ‘নরকে এক ঋতু’ থেকে কয়েকটি লাইন পড়লেই বোঝা যাবে তার সেই সময়ের মনোভাব কেমন ছিল:
এটাই সত্যি যে খানিকক্ষণ আগপর্যন্ত আমার জীবনটি ছিল একটি দীর্ঘ উৎসব মুখর জীবন
সেই প্রশস্ত গভীর হৃদয়ে বয়ে যেত শরাবের নহর।
এমনই এক রাতেই তো আমি বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম জগতের সমস্ত সৌন্দর্যকে
আর এখন আমি আমার জীবনের উপর ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছি
আর সেইসব ন্যাকান্যাকা সৌন্দর্যকে এখন আমি নিকুচি করি
নিজেকে সদা প্রস্তুত রেখেছিলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব বলে
কিন্তু হায় শেষ রক্ষা হল না, আমি সব ছেড়েছুঁড়ে ভেগে গেলাম
হায়রে ছলনাময়ী! হায়রে দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত এই জীবন!
হায় কী বিদ্বেষভারাক্রান্ত এই মন! আমার সমস্ত সহায়সম্পত্তি তোমার হাতেই গচ্ছিত করে গেলাম।আর এখন আমি আমার মন থেকে আমি আমার সকল মানবিক আশা আকাঙ্ক্ষা
মুছে ফেলতে পেরেছি
হিংস্র প্রাণীর মতো আমি আমার সমস্ত আনন্দ উল্লাসকে ছোবল মেরে গলা টিপে মেরেছি।
আমি জল্লাদদের ডেকেছিলাম যাতে মরার সময় আমি তাদের বন্দুকের বাঁট কামড়ে ধরতে পারি
আমি মহামারীদের ডেকেছিলাম আমাকে ধুলোয় আর রক্তের বন্যায় মিশিয়ে দেয়ার জন্য।দুর্ভাগ্যই আমার ঈশ্বর। আমি কাঁদায় লুটোপুটি খেয়ে চলেছি।
শরীর শুকিয়েছি অপরাধের নিঃশ্বাসে। আর মশকরা করেছি উন্মত্ততার সাথে।
এবং এই সুন্দর বসন্তকাল নির্বোধের মতো
ভয়াবহ হয়ে ভেংচি মারা হাসিটিকে উপহার দিয়েছিল আমাকে।অতঃপর, খুব সম্প্রতি যখন নিজেকে শেষ চিৎকারের ভেতর আবিষ্কার করলাম!
এটি আমাকে আবারো সেই প্রাচীন উৎসবের চাবি খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ করলো
যেখানে আমি আরও একবার আমার ক্ষুধাকে ফিরে পেতে পারি।পরোপকার হোলো সেই চাবি।
আর এই অনুপ্রেরণাই প্রমাণ করে যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম!(নরকে এক ঋতু ॥ অনুবাদ: ফারহানা রহমান)
০৪.
এদিকে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অর্থাৎ ১৮৭০ সাল থেকেই র্যাঁবোর বাড়ি থেকে পালানো শুরু হয়। আর এই ১৬ বছর বয়সেই কবিতায় তার নিজস্ব একটি স্বরও ফুটে ওঠে। একেবারেই তার নিজের ভাষা, যার সঙ্গে অন্য কোনো কবির কবিতার ভাষার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তার উঠতি বয়সের আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, স্বাধীনতার প্রতি তার একাগ্র মনোভাব; এসবকিছুই ফুটে ওঠে কবিতাগুলোর মধ্যে। ১৮৭০ সালের জুলাই মাসে যখন ফ্রান্স আর জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে, ওই সময় র্যাঁবো রাজনীতির ব্যাপারে হঠাৎ খুব উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তখন স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার স্কুলকেন্দ্রিক ফর্মাল পড়ালেখাও জীবনের মতো শেষ হয়ে যায়। এ বছরের আগস্ট মাসে প্রথম তিনি নিজ শহর শার্লভিল থেকে বিনা টিকিতে ট্রেনে করে প্যারিসে চলে আসেন। স্টেশনে নামা মাত্রই স্থানীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মাজাসের কারাগারে আটকে রাখে।
সেখান থেকে তার প্রিয় শিক্ষক ইযামবার তাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেন। কিন্তু দেখা যায় মাত্র একমাস পরেই তিনি আবারও পালিয়ে যান বেলজিয়ামের দিকে। বাড়িতে থাকা অবস্থায় র্যাঁবো এতটাই অস্থির হয়ে ওঠেন যে, এসময় তার শিক্ষক জর্জ ইযামবারকে লেখা একটি চিঠিতে নিজের অবস্থা এভাবে উল্লেখ করেন:
‘দেখুন এভাবেই আপনাকে দেওয়া আমি আমার কথা রেখেছি। কিন্তু এভাবে প্রতি মুহূর্তে আমার শুধু মৃত্যুই হচ্ছে। এই জীবন আমাকে বিকারগ্রস্ত করে ফেলছে। কারণ এটি একেবারেই অতি সাধারণ, আটপৌরে এই বিচ্ছিরি জীবন। এই একঘেঁয়েমি জীবন আমাকে রীতিমতো পাগল বানিয়ে ফেলেছে। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে হয়ে উঠছি। আপনি জানেন যে আমি কত একগুঁয়ে একজন মানুষ। আমি ভয়ঙ্করভাবে স্বাধীনতাকে ভাএলাবাসি। আমার এই জীবনে স্বাধীনতাই সবকিছু। চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা দেখলে আমার ঘৃণা হয়। আমি ঘর ছেড়ে আজকেই বেরিয়ে পড়তে চাই। আর সেটা আজই। আমার যদি কিছু নতুন কাপড় থাকতো, তাহলে আমার ঘড়িটাকেই বিক্রি করে দিয়ে এখনই পালিয়ে যেতাম। জয় হোক স্বাধীনতার!’
(চিঠির অনুবাদ: ফারহানা রহমান)
এরপর তিনি সত্যি সত্যি ঘর ছেড়ে পালালেন। প্রথমে শারলরোয়ায় কিছুদিন থেকে এরপর সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলেন। পরে আবার ব্রাসেলসে ফিরে যান। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পুলিশের সহায়তা নিয়ে মা তাকে নিজ শহর শার্লভিলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু ১৮৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবারও পালিয়ে যান প্যারিসে। এই সময় তিনি কপর্দকহীন অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, পত্রপত্রিকা পড়েন ও ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খান। অসহনীয় দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওই বছরের মার্চ মাসেই তিনি আবারও শারলভিলের দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেন। এ সময় খুব মনোযোগ দিয়ে লাইব্রেরিতে পড়ালেখা শুরু করেন। তিনি এবার বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও সমাজতন্ত্রীদের রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হন। আরদেন উন্নয়ন নামক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু এপ্রিলে সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবারও তিনি প্যারিসের পথে যাত্রা করেন। র্যাঁবোর জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তার দূষিত রক্ত কবিতাটির বর্ণনার মাধ্যমে কিছুটা বোঝা যায়:
কোনো রকম পেশার কথা শুনলেই আমার গা গোলায়। মালিক বা শ্রমিক, সবাই গ্রাম্য,নীচ। যে হাত কলম ধরে আর যে হাত লাঙল চালায় – এ দু’য়েরই সমান দাম। এ শতাব্ধিতে দেখি হাতই সবকিছু, কী দারুণ এক হাতের শতাব্ধি এটা। আমার কখনই হাত থাকবে না। এরপর চাকর বাকরের ওপর অতি নির্ভরতার কারণে আমরা নানা জটিল ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। ভিক্ষাবৃত্তির সততা আমাকে কষ্ট দেয়। দুষ্কৃতকারী আর ছিন্নমুস্ক নপুংসক এই দুজনকে দেখলেই আমার বমি পায়। আমি, আমি এখনো অক্ষত আছি, এবং এতে আমার কিছু যায় আসে না।
(দূষিত রক্ত: অনুবাদ: শিশির ভট্টাচার্য)
০৫.
র্যাঁবো একটি কথা স্পষ্ট করেই বলে গেছেন। তা হলো, ‘কবিতা লেখা হয়, লেখা যায় না। কবিরা কবিতা লেখেন না বরং কবিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কাব্য রচিত হয়। কবি মাত্রই জন্মগতভাবে কবি, জোর করে কবি হওয়া যায় না।’
এরপরের কয়েক বছর র্যাঁবো একা একাই সারা দুনিয়া চষে বেড়ান। ১৮৭৪ সালে প্রথমে আসেন লন্ডন। এখানে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং ইলিউমিনিশন বা ‘বোধি’ কাব্যটি সমাপ্ত করেন। বছরের শেষের দিকে তিনি হুজুগের বসে পিয়ানো বাজানো শিখতে শুরু করেন।
র্যাঁবো মনে করতেন কবিরা হচ্ছে মিস্টিক বা বাউল, যারা নিজের মন ও শরীরকে ব্যবহার করে অজানার সন্ধ্যান করেন এবং অনির্বচনীয় জগতের সন্ধান পাওয়ার পর সেই জগতের বিভিন্ন দিক সাধারণ মানুষের কাছে বর্ণনা করার চেষ্টা করেন। প্রচলিত ভাষার শব্দ ও বাক্য যেহেতু অনির্বচনীয় জগতের বর্ণনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই কবিরা উপমার আশ্রয় নেন। তবে শুধু উপমাই কবিতা নয়। উপমা অবশ্যই কবিতার অন্যতম উপাদান। তবে উপমা, ছন্দ ও কবির অভিজ্ঞতা সব কিছু মিলিয়েই একটি কবিতা সৃষ্টি হয়। বাস্তব জগৎ থেকে কবির আবিষ্কৃত জগৎ যত বেশি আলাদা হয়, উপমার দুর্বোধ্যতা ততই বাড়তে থাকে। কবিতায় চলে আসে পরাবাস্তবতা।
০৬.
আর্তুর র্যাঁবো প্রকৃতপক্ষেই লিখেছেন একেবারেই কম সংখ্যক কবিতা। সবমিলিয়ে তার মাত্র আশিটির মতো কবিতার সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৮৭০ থেকে ১৮৭৪ সাল। এই পাঁচ বছর মাত্র তার কাব্যজীবন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম লেখা শুরু আর প্রথমদিকে তিনি অন্য আর সব কবির মতোই অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লেখা শুরু করেন। শেষ দুবছর তিনি কাব্যময় গদ্যরচনা করেছিলেন। তিনি যে পাঁচবছর কবিতা রচনা করেছেন, ওই সময় তার নিজের কবিতার মান নিয়ে তিনি খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। র্যাঁবো মনে করতেন তার কবিতার যে স্টাইল ও নতুনত্ব সেটি একেবারেই অনন্য। কবিতার উচ্চমান নিয়ে তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া মাত্রই তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য দূর দেশে পাড়ি দেন। গবেষক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী, হস্তীশিকারি, অস্ত্রবিক্রেতা ইত্যাদি হেন পেশা নেই, যে পেশায় তিনি অর্থ উপার্জন করার জন্য বেছে নেননি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তী সময়ে কবি জীবন নিয়েই শুধু লজ্জিত হয়েছিলেন। কিশোর বয়সের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি প্রায়ই হাসিঠাট্টা করতেন।
১৮৭৩ সালে ‘নরকের ঋতু’ আর ১৮৭৪ সালে ‘বোধি’ নামক দুটি চমৎকার পরাবাস্তব গদ্যকাব্য রচনা করেন তিনি। স্বাধীনতার পূজারি, চিরবাউণ্ডুলে, খ্যাপাটে স্বভাবের বিদ্রোহী এক মন নিয়ে বেড়ে ওঠা র্যাঁবোর কাছে নিজের লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো একবার পড়েই ছিঁড়ে ফেলা বা ফেলে দেওয়াটা একটা খেলায় পরিণত হয়েছিল। আর তাই তার যেটুকু রচনা তিনি নষ্ট করার সুযোগ করে উঠতে পারেননি, শুধু সেটুকুই পাঠক পড়ার সুযোগ পেয়েছে। মাত্র ২০ বছর বয়সে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তিনি সাফাই দিলেন এই বলে যে, ‘নরকে এক ঋতু’ লেখার পর তার আসলে আর নতুন কিছু লিখার বাকি ছিল না। তিনি যা কিছু কবিতায় বলতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ স্বর্গ নরক অথবা ঘুম আর নির্ঘুমতা তার সবকিছুই এখানে তিনি বলে ফেলেছেন। এরপর যদি তিনি কিছু লিখেন তাহলে সেটা হবে শুধুই পুনরাবৃত্তি। অবশ্য এরপরেও তিনি ১৮৭৪ সালে ‘বোধি’ নামক গদ্য কবিতাটি লিখেছিলেন। আর সেটিই শেষ। আর কখনো তিনি কবিতা লেখেননি। তবে ছাড়েননি পথ চলা আর বাউণ্ডুলেপনা। বহু দেশ ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বেশিরভাগই আবার পায়ে হেঁটে। আজন্ম অস্থির ও পরিব্রাজক র্যাঁবো কোথাও বেশিদিন স্থির হয়ে কাটাতে পারতেন না।
০৭.
১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি পল ভ্যারলেন (Paul Verlaine) তাকে প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানান। আর তখন থেকেই শুরু হয় ভ্যারলেনের সঙ্গে র্যাঁবোর রহস্যময় সেই কিংবদন্তী প্রেমের। ১৮৭২ সালের পুরোটি বছর দুবন্ধু মিলে প্যারিসের ক্যাফেগুলো চষে বেড়ান আর ঘুরে বেড়ান ইউরোপে মহাদেশের বহু শহর গ্রাম আর অলিগলি। র্যাবোর সাঁথে ভারলিনের মাত্রাতিরিক্ত সম্পৃক্তায় ভারলিনের স্ত্রী মাতিলদে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের কথাবার্তা চলতে থাকে। ১৮৭২ সালের জুলাই মাসে মাথিলদে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারলিন স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে রাস্তায় বের হন। ওই সময় র্যাঁবোর সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে যায়। এসময় তিনি ঘর সংসার সব কিছু ত্যাগ করে র্যাবোর সঙ্গে ব্রাসেলসে পালিয়ে যান। কয়েকমাস বেলজিয়ামে অবস্থান করে সেপ্টেম্বরে দু’বন্ধু মিলে লন্ডনে এসে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। তারা ইংরেজদের কাছ থেকে ইংরেজি ভাষা শিখতে চেষ্টা করেন। এর পরিবর্তে তাদের ফরাসি ভাষা শেখান। নভেম্বরের দিকে আর্থিক অবস্থার চরম অবনতি হলে র্যাঁবো শারলভিলে ফিরে আসেন। কিন্তু ভারলিন লন্ডনেই থেকে যান। ১৮৭৩ সালের মে-জুলাই মাসের দিকে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। ফলে র্যাঁবো ব্রাসেলস ছেড়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। এ সময়ই র্যাঁবোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে তাকে গুলি করেন ভ্যারলেন। যদিও র্যাঁবো শুধু হাতেই সামান্য কিছুটা আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু ভ্যারলেনকে এই অপরাধের জন্যই দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জুলাইয়ের শেষের দিকে র্যাঁবো তার বিখ্যাত কাব্য ‘নরকের এক ঋতু’র কাজ শেষ করেন। অক্টোবরে লেখাটি বাজারে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। এরপরের কয়েক বছর র্যাঁবো একা একাই সারা দুনিয়া চষে বেড়ান। ১৮৭৪ সালে প্রথমে আসেন লন্ডন। এখানে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং ইলিউমিনিশন বা ‘বোধি’ কাব্যটি সমাপ্ত করেন। বছরের শেষের দিকে তিনি হুজুগের বসে পিয়ানো বাজানো শিখতে শুরু করেন।
০৮.
১৮৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকেই তিনি জার্মানির স্টুটগারডে জার্মান শেখার জন্য বসবাস শুরু করেন। এসময় তিনি পায়ে হেঁটে সুইজারল্যান্ড ও আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে ইতালিতে ঢোকেন। ইতালির মিলান শহরে এসে র্যাঁবো ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জুনের দিকে কিছুটা সুস্থ হলে স্প্যানিশ ভাষা শেখার উদ্দেশ্যে স্পেনে চলে যান। এরপর স্পেন থেকে প্যারিস হয়ে অস্ট্রিয়ায় যান। ১৮৭৬ সালের এপ্রিল মাসে ভিয়েনা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ান পুলিশ তাকে ভিয়েনা থেকে বের করে দেয়। এরপর তিনি পুরো দক্ষিণ জার্মান অঞ্চল পায়ে হেঁটে ফ্রান্সে এসে পৌঁছান। ওই বছরের মে মাসের দিকে হল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় এসে পৌঁছান।
জুলাইতে রেলওয়ের এক ওয়াগনে করে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। আগস্ট মাসে বোন ইজাবেলকে সঙ্গে নিয়ে মারসাই শহরের দিকে রওনা হলে পথে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন। ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে আগস্টের ২৫ তারিখে একজন যাজকের কাছে পাপ স্বীকার করেন তিনি।
সেখান থেকে মাত্র তিন সপ্তাহ পরে পালিয়ে গিয়ে আবারও ইউরোপে ফিরে আসেন। ফিরে আসার ভাড়া না থাকায় জাহাজের খালাসির কাজ করে ভাড়া পরিশোধ করেন। ১৮৭৭ সালে সুইডেন ও ডেনমার্ক ভ্রমণ করেন সার্কাস দলের সঙ্গে। ওই বছর মে মাসে আমেরিকান কনস্যুলেটে গিয়ে আমেরিকান নেভিতে চাকরির দরখাস্ত করেন। সেপ্টেম্বরে আসেন ফ্রান্সের মার্সেই শহরে। কিছুদিন পর আবার রোমে চলে যান। ১৮৭৮ সালে সুইজারল্যান্ড হয়ে মিলান তারপর জাহাজে করে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছান। সেখান থেকে সাইপ্রাসে যান বাড়ি তৈরির ঠিকাদারি করার জন্য। এরপর ১৮৮০ সালের মার্চ মাসে সাইপ্রাসে এসে ট্রুডো পাহাড়ের চূড়ায় ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের বাড়ি তৈরির কাজের সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানেও বনিবনা হয় না। ফলে লোহিত সাগরের বিভিন্ন বন্দরের দিকে রওয়ানা হন। জেদ্দা, সুয়াকিম, মাসাউয়া, হোদেইদা ইত্যাদি জায়গায় কাজের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন। এসময় মারেজান নামক এক কোম্পানিতে কাজ নিয়ে এডেন বন্দরে আসেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে জেলিয়া বন্দর থেকে একটি ক্যারাভানের সঙ্গে সমালিয়ার মরুভূমিসহ ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ডিসেম্বরে ইথিওপিয়ার হায়ার শহরে এসে পৌঁছান।
০৯.
১৮৮৬ সালের অক্টোবর মাসে রাজা মেনেলিকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন র্যাঁবো। চুক্তি অনুযায়ী ২ হাজার বন্দুক, ৭৫ হাজার কার্তুজের একটি চালান, ৩০টি উট আর ৩৪ জন চালক ও একজন দোভাষী নিয়ে শোয়ার রাজধানী আনকোবারের পথে রওয়ানা হন। চারমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভ্রমণের পর গিয়ে পৌঁছান আনকোবারে। ওখানে গিয়ে জানতে পারলেন, রাজা মেনেলিক অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে চলে গেছেন। কবে ফিরবেন অথবা আদৌ ফিরবেন কি না, কেউ জানে না। ফলে চালানের সমস্ত টাকা লোকসান হতে একপ্রকার পথে বসলেন র্যাঁবো। মানসিক অবসাদগ্রস্ত র্যাঁবো ১৮৮৭ সালের শেষের দিকে বাম হাঁটু ও ঊরুতে ভীষণ ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এদিকে কিছুটা সুস্থ হতেই ১৮৮৮ সালের মার্চ মাসে তিনি অস্ত্রের গোপন চালান নিয়ে অম্বাদু রওনা হলেন। ঘোড়ার পিঠে করে ১১ দিনে ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অম্বাদু পৌঁছান। ওখান থেকে চলে আসেন ওবোকো শহরে। এরপর ৮৮ সালের মে মাসে তিনি অস্ত্রের ব্যবসা পুরোপুরি ছেড়ে দেন। অতপর হারারে পৌঁছে নিজের টাকায় একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান খোলেন।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে র্যাঁবোর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তার বোন ইজাবেল লিখেছেন,
‘‘আর্তুর যখন খুব ছোট ছিল, তখন সে শুধু মজা করার জন্য লিখতো। ওর বয়স যখন দশ হয়েছে কি হয়নি তখন (আরদেনের বাড়িতে) দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটতো আমাদের আর্তুরের লেখা অজানা দেশে দারুণ সব কাল্পনিক ভ্রমণের বিবরণ শুনে। মরুভূমি আর মহাসাগর, পর্বতমালা আর নদীনালার মাঝে ছিল সেই সব দেশ। এ ধরনের ভ্রমণকাহিনী লেখা ছিল স্বাভাবিকভাবেই তার বাচ্চাবয়সের একটি খেলা। পড়া হয়ে যাওয়ার পর আর্তুর তার পাণ্ডুলিপিগুলো ছিঁড়ে ফেলতো এবং ফেলে দিতো। পড়ে যেসব লেখা সে লিখেছে পনের থেকে আঠারো বছর বয়সে, তখন সেগুলো সে লিখেছে নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্য। সম্ভবত অতি উৎসাহের কারণে এবং (পাঠকদের প্রতি) তার অতিরিক্ত দয়ার্দ্র মনোভাবের কারণে।
আর্তুর কখনো তার লেখা ছাপাতে চেষ্টা করেনি। ‘নরকের ঋতু’ রচনাটি মুদ্রিত হয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর আগে সে মুদ্রিত বইগুলো সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিল। ওর নিজের কাছে যত পাণ্ডুলিপি, কবিতা, গদ্য ছিল সব সে নষ্ট করে ফেলেছে। নিজের রচনা নিয়ে আর্তুর ঠাট্টা করতো, হাসাহাসি করতো। যেদিন সে তার সম্পূর্ণ রচনাবলী পুড়িয়ে ফেললো (এবং খুবই আনন্দের সাথেই কাজটি করেছে সে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি) সেদিন থেকে আর্তুর আর সাহিত্য নিয়ে কখনো একটি কোথাও বলেনি।’’
১০.
এদিকে ১৮৯১ সালের মাঝামাঝি এসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ডান পায়ে প্রচণ্ড ব্যথাসহ র্যাঁবো হাসপাতালে ভর্তি হন। এসময় মাকে চিঠি দিয়ে আসতে বলেন। মে মাসের শেষে তার পা অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়। জুলাইতে রেলওয়ের এক ওয়াগনে করে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। আগস্ট মাসে বোন ইজাবেলকে সঙ্গে নিয়ে মারসাই শহরের দিকে রওনা হলে পথে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন। ক্যান্সার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে আগস্টের ২৫ তারিখে একজন যাজকের কাছে পাপ স্বীকার করেন তিনি।
১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর সকাল দশটায় স্বেচ্ছায় সব ইন্দ্রিয় নিয়ে ছুটে চলা এই বিস্ময়কর বাউণ্ডুলে কবি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
(আর্তুর র্যাঁবো’র জীবন কাহিনী অবলম্বন করে ক্রিস্টোফার হ্যাম্পটন ১৯৬৭ সালে একটি নাটক লেখেন। পরবর্তী কালে এই চিত্রনাট্যটিকে নিয়ে চলচ্চিত্রকার আগনিয়েস্কা হল্যান্ড ১৯৯৫ সালে টোটাল ইক্লিপস নামে একটি জীবনীমুলক-নাট্য চলচ্চিত্র তৈরতিতেন। ১৯ শতকের দুই ফরাসি কবি জ্যঁ আর্তুর র্যাঁবো ও পল ভ্যারলেইনের মধ্যে আবেগপ্রবণ যে সম্পর্ক ছিল, যেটি সবসময় সাহিত্যজগতের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, সেই সম্পর্কটিকে কেন্দ্র করেই সিনামাটি মূলত তৈরি করা হয়েছে। যদিও এতে আসলে র্যাঁবো’র সম্পূর্ণ জীবনকেই চিত্রায়িত করা হয়েছে। এখানে র্যাবো’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও পল ভ্যারলেইনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেভিড থেলিস।)
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা