চাণক্য বাড়ৈ। এই সময়ের প্রতিশ্রুতিমান তরুণ কবিতাকর্মী। ভাটি-বাংলার জরায়ু থেকে উত্থিত কবিতার আমিষপুত্র। যার কবিতার শরীর রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, পুরাণ, মিথ, কিংবদন্তি, প্রত্নবিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান, মৈমনসিংহ গীতিকাসহ বাঙালি ঐতিহ্যের নানা সংবেদন-শক্তিতে ভরপুর। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনে করেন, বাংলার মানস সংস্কৃতি সাহিত্য ও সংগীত, অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এসব বিষয় যে প্রকৃতিলগ্ন, তা তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। ভাটি-বাংলার সতেজতা ও সবুজ ফসলের আত্মায় মোড়া কবি চাণক্য বাড়ৈ-এর কবিতা উল্লিখিত বিবিধ অনুসঙ্গে সচল ও সক্রিয়। দুটো কাব্যগ্রন্থ ‘পাপ ও পুনর্জন্ম’ এবং ‘চাঁদের মাটির টেরাকোটা’ নিয়েই মূল আলোচনা।
প্রথমে কবির কাব্যগ্রন্থ ‘পাপ ও পুনর্জন্ম’ বিষয়ে বলি। কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় আছে ফেলে আসা শৈশব, নস্টালজিয়া, রূপকথা, মানুষের যাপনবৈচিত্র্য,ধর্মানুষ্ঠান, পূজাচার। নিজের মাটিজাত শরীরের হৃদয় ছুঁয়ে প্রতিটিকবিতা যেন অন্যরকম বোধে সৌন্দর্যময় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মৈমনসিংহ গীতিকা, বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী, ঠাকুরমার ঝুলি, পূজা, মন্দির, তীর্থযাত্রা, বাংলার ঋতুজ ঐশ্বর্য্য অনবদ্য রূপের ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে কবির চমৎকারসব উপলব্ধির জগতে। ‘চাঁদের মাটির টেরাকোটা’ কাব্যগ্রন্থেও আছে সেই বিবিধ অনুরণন, যা গল্পভাষ্যের বর্ণনাভঙ্গিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ইতিহাস, পুরাণ, নানা কিংবদন্তি ছুঁয়ে বিশ্ববীক্ষণে আলাদা হয়ে উঠেছে।
সর্বোপরি কবির কবিতাগুলো বাংলা কবিতার ঐতিহ্যে একটি ভিন-কণ্ঠের আবহে যেন অনন্যতা পেয়েছে। এখানে ‘চাঁদের মাটির টেরাকোটা’ ও ‘পাপ ও পুনর্জন্ম’ কাব্যগ্রন্থ দুটিকে দুটি আলাদা পর্বের বিভাজনে মূল-ভাষ্যরূপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
চাঁদের মাটির টেরাকোটা
প্রকৃত ঈশ্বর: মানুষ ধ্যানে-চিন্তায় ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে প্রতিপালক ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে। করেছে সম্পূর্ণ জাগতিক বা ইহকালীন সাধনা। এভাবে নানা ভাবান্তর, বিশ্বাস ও মতান্তরে সবাই নিজের আত্মসুখ ও শান্তির কপোতকে ধরতে চাইছে। এবং এ থেকে কবির বোধেও তৈরি হয়েছে প্রশ্নপিপাসা। কবির ভাষ্য, ‘করোটিতে প্রশ্নপিপাসা অথচ বিস্ময় ছাড়া আর কোনো যতিচিহ্ন নেই।’ এছাড়াম ‘বাড়ছে চন্দ্রকাতরতা, আমরা চলেছি মঘা-অশ্লেষার রাতে—গন্তব্য জানিনা বলে খুঁজে ফিরছি সপ্তর্ষীমণ্ডল—গুরু নানক, এইতোসেই পথ,যেপথে ফিরে এসেছিল ভাওয়াল সন্ন্যাসী—’
অথবা ‘ভোর হলো, আমাদের চারপাশে ক্রুশকাঠ, শিবলিঙ্গ—সারি সারি ভেজাবুদ্ধের দল…’
অলৌকিক অশ্বারোহী: কিছু মানুষ শুধু বস্তুগত সুখ আর কাক্সক্ষার মাঝে নিজের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের গল্প বুনতে সদা পটিয়সী। কিন্তু প্রকৃতকবি ও শিল্পী এইসব কিছুকে পরওয়া করেন না। নিজের আত্মসুখ ও সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন বুননই তার আরাধ্য। কবি বলেন, ‘সবাই নক্ষত্রের মালিকানার কথা ভাবে—আমি তার আভাটুকু চাই—কেউকেউ বলে, এ অসুখ কবিতাবাহিত।মেনে নিয়ে চলে যাই,যেদিকে মুখ করে ফুটে আছে রক্তজবাগুলো…’ কবি তাই মুহূর্তে চলেযেতে পারেন ,নেপচুন, ফকল্যান্ড, জাঞ্জিবার, ভানুয়াতু অথবা শাকিরার গোপন বেডরুমে। উল্লিখিত কবিতার চরণভঙ্গিতে ও ভাবনার বিপ্রতীপে দেখা যায়, জীবনের গতি শুধু বস্তুসুখ আর যাপনের মধ্যে সীমিত হওয়া উচিত নয়। মানুষের পৃথিবীতে আরও কিছু আরাধ্য থাকা উচিত, যা মানুষকে নতুন বোধে নব সৃষ্টিতে করবে অনেক বেশি সুন্দর ও নান্দনিক।
যাঁর সমর্পণ বিধাতার প্রতি। অন্যদিকে তরুণ কবি, যার ধ্যান আরবোধের জানালা ছুঁয়ে উঁকি দেয় শুধু ঈশ্বর নয়, কল্পিত যাত্রার আরও বেশি কিছু।
পরিত্যক্ত হেরেম: অতীতের ঘটে যাওয়াকোনো রাজার শাসন। যার পরিত্যক্ত হেরেম থেকে ছুটে আসছে বিগত দিনের কোনো জরা বা ক্লান্তি। অথবা সুখের উদ্যানে বসা ফুলের আসর। কবি কোনো জাতিস্মর পাখি অথবা ফুলের কাছ থেকে জেনে নিতে চান, এসব অলিখিত অনুরণন বা আনন্দ উপাখ্যান। আবার পরিত্যক্ত হেরেম জাদুর আয়নার পাশে বসে থেকে কবি এমন এক বয়ান শোনান, যার অবচেতনে আমরা সমাজবাস্তবতার কিছু গূঢ় সত্যের মুখোমুখি হই। যিনি নিদ্রিত রাজার কাছে জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেন এবং নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেন নিজেকেও। কবির বয়ানে, ‘পরিত্যক্ত এই হেরেমজুড়ে আজ জমাট স্তব্ধতা, থেমে গেছে ঝাড়, সেই সুর, সোমস্রোত—তুমি শুধু একা বিষাদের পেয়ালায় পান করো কল্পনা নির্মিত সুখ’
সুদেষ্ণা সাহা: পৃথিবীতে চির সত্যের মতো কিছু অন্ধকার মানুষের মজ্জাগত হয়ে আছে, যা পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাপনার রাঘব-মূর্তিকে সামনে নিয়ে আসে। এইসব বিবিধ অনুরণন একজন সংবেদনশীল শিল্পীর মনে কী রকম গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, বলাই বাহুল্য। একদিকে মানুষের প্রতি মানুষের বন্য আচরণ, সাদা-কালোভেদ বা বর্ণবিভাজন, আরেকদিকে সংবেদনশীল মানুষের মানবিক মন, দুটোই যেন আজ ক্ষতবিক্ষত ও প্রশ্নাহত হয়ে আছে প্রবল আত্ম-অধিকারের নিমিত্তে। কবির কবিতায়, ‘সুদেষ্ণা সাহাকে দেখি না বহুদিন। আজ এই নিষ্কর্ম অনুজ্জ্বল বিকেলে তার কথা মনে পড়ে গেলো।কম কথা বলতো সে। মাছির মতো একটা বিদ্ঘুটে আঁচিল ছিল মুখে। চেহারা সুন্দর ছিল না বলে আর পাঁচটি মেয়ের মতো কেউ দেয়নি তাকে প্রেমের প্রস্তাব—এ নিয়ে তাকে দুঃখ করতে দেখিনি কোনোদিন।শুধু একটি কষ্ট ছিল তার…’
বিশ্বসংসার ছাড়িয়ে বাংলার ঘরে ঘরেও এমন কত সুদেষ্ণা সাহা নির্মম সত্য ঘটনার উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে আছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লিখিত কবিতায়, কবির ভেতরের মানবিক সত্তা ও নরোম সংবেদনা দুটো দিকই ফুটে উঠেছে।
হৃদসংক্রান্তি:
‘আমার হৃদ্পিণ্ড ঠোঁটে করে উড়ে যাচ্ছে যে পাখি, তার জন্য এই উলুধ্বনিময় সন্ধ্যা—ভাবছি,কে হবে এই হৃদ্সংক্রান্তিরযোগ্য পুরোহিত—’ কবিতায় আতপ, হলুদ, শিলনোড়া, হরিতকী, নিম, সুগন্ধী চন্দন, দূর্বা, তিল, তুলসীভরা বরণকূলাসহ স্বাস্থ্যকর নানা উদ্ভিজ্জ ও ভেষজ জিনিসপত্র নিয়ে কবি বসে আছেন। কবি আমাদের সেই পাঁচ হাজার বছর আগের (পাক-ভারতের) আয়ুর্বেদ চিকিৎসা-শাস্ত্রের উত্তরাধিকারকে যেন নানা প্রকরণে বহন করে চলেছেন। কবি নিজের পবিত্র জলে এইসব পুরোনো ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনের এক অমোঘ মেলবন্ধন ঘটাতে চান।/
আদি পুস্তক অথবা মনসামঙ্গল: কবি শোকসভার স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছেন। চারদিকে অন্ধকার। দ্বিধার সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কবির চোখে অনেক জিজ্ঞাসা ও দ্বন্দ্ব। কবি বলেন, ‘মনে পড়ে, স্বর্গযাত্রীদের লক্ষ্য করেই এখানেএসেছি—একটাঅচেনা রঙেরধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসছে পথ—একদিকেকেউ ফানুসওড়াচ্ছে,কেউ ভাসাচ্ছে কাগজের নাও, নীলকণ্ঠ ফুলের মালাআরশোকপ্রস্তাব দুটি জমজ শিশু হয়ে নেমেগেল হাতথেকে—আমার সমস্ত শরীরবেয়ে নাগিনীর মতো ঝরে পড়ছে ঘাম—আর দীর্ঘক্ষণ বগলেচেপে ধরা বইটি আদিপুস্তক নাকি মনসামঙ্গল, কিছুতেই তা মনে করতে পারছি না—।’
মনসার আশীর্বাদ বা অনুগ্রহযেন এই নদীবিধৌত বঙ্গের নিজস্ব এক অনার্য সত্তা। কবি এমন কোনো আদিপুস্তক বা মনসামঙ্গলের মনসার কাছে নিজের দুঃখবোধ আকাঙ্ক্ষার আশু নিরাময় যেন পেতে চান।
সহজ কথার সাজঘর: এ কবিতায় কবির এক অনবদ্য শিল্পচেতনার রঙ মিশে আছে। প্রতিটি কথন, চিন্তন আরবোধের জানালা ছুঁয়ে গার্হস্থ্য জীবন, স্মৃতির নদী,কোলাহল, আচরিত ধর্ম, সবকিছুরভেতর মন নামক এক হৃদয় সংবেদনা নিয়ে কবি নিজেও যেন শিল্পের এক অনবদ্য কথক হয়ে উঠতে চান।যেখানে নিজের শিল্পীত মেজাজ ভরে আছে জীবন আর শিল্পের সমার্থক হয়ে। আবার এর মধ্যে কবির পিতা শাস্ত্র পড়ছেন। যাঁর সমর্পণ বিধাতার প্রতি। অন্যদিকে তরুণ কবি, যার ধ্যান আরবোধের জানালা ছুঁয়ে উঁকি দেয় শুধু ঈশ্বর নয়, কল্পিত যাত্রার আরও বেশি কিছু। শিল্পের একেকটা খোলস উগরে নিয়ে হতে চান মাটিলগ্ন, নিজের শিল্পীত যাপনের কাছাকাছি।কবি বলেন, ‘শাস্ত্র পড়েন পিতা, তিনি চান বিধাতার মন—ছেলে এক তরুণ কবি—চায়সে অসংখ্য তরুণীর মন—/ মন এক অভিন্ন ঈশ্বর—তাই নিয়ে ধ্যানের জগতে নিমগ্ন দুজন।’ [১৭]
অল্প লাইনে ছোট ছোট অনুভূতি দিয়ে ‘সহজ কথার সাজঘর’ নামক দীর্ঘ কবিতার একটি সাম্পান ভাসিয়ে দেন কবি। জাগতিক ভাবনা, ধ্যান আর মনের নানাবিধ জিজ্ঞাসার সঙ্গে কবিও একাত্ম হয়ে উঠেছেন। ‘সহজ কথার সাজঘর’ থেকে আরও কিছু পঙ্ক্তি, ‘ঠাকুরমারোগশয্যায়, আমি মদের টেবিলে—উত্তরাধুনিক সড়কবেয়েপ্রগতির মন্দিরে এসেছি—জীবন, সে তো এক সময়খেকো বাঘ, অথবাপ্রেম—সে তো এক সুখী মানুষের জামা।’ [১৩]
কবিতায়কোনো ইজম বা মতবাদকে আপেক্ষিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে কবি জীবনের আসল সত্যকে বুঝে উঠতে চান। অর্থাৎ, আগে মানুষ এবং তার অস্তিত্ব। মানুষের এইযে নানা জিজ্ঞাসা এবং তার যাপনপদ্ধতি, উভয়ের মাঝেকোনোমৌলিক মুক্তি আদৌ ঘটেছে কী না! জীবনকে ‘সময়খেকো বাঘ’বাপ্রেমকে সুখী ‘মানুষের জামা’র সাথে তুলনা করে কবি মানুষের অন্তর্গত এক ধ্রুব সত্যকে উন্মোচন করতে চানযেন। ১২ নম্বর কবিতায়, ‘তুমিসেই নিশাচর নদী, মধ্যরাতে ফুঁসে ওঠা যার স্বভাব—ভরাজোয়ারে তোমারচোখের মণিতেভেসে ওঠে এক নাবিকেরছায়া…’।
কবির যাপিত নগর-যন্ত্রণার প্রতি হাঁপিয়ে ওঠার পর নিজের দেশ-গ্রামের প্রতি এবং সবুজের প্রতি যেন অবচেতন-মায়া আরও বেড়ে গেছে।
এভাবে মাঝেমধ্যে অতীন্দ্রীয় ভাবনায় জেগে ওঠেন কবি। এবং নিজের নোঙরে বা নিজ সত্তার কাছে প্রশ্ন জিইয়ে রেখে নিজেরই মোহনার ছায়া থেকে ঘুরে আসেন।অনেক সময় ঈশ্বরের কাছেও প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে নিজের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান খোঁজেন, ‘কান্নার ভাষা ছিল এক—আনন্দেরও—হে নিখিলেশ্বর, শুধু তোমাকে ডাকার ভাষাই ছিল আলাদা। জন্মে ছিল না কোনো পার্থক্য, ছিল না মৃত্যু এবং সঙ্গমেও—হে পরওয়ারদিগার, শুধু তোমার কাছেপৌঁছানোরপ্রার্থনা ছিল ভিন্ন…’
পাপ ও পুনর্জন্ম
প্রশ্ন: ‘প্রশ্ন’ কবিতায়আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের কাছে কবিরযে নৈবেদ্য তা উল্লেখ করার মতো।যেখানে ফুটে উঠেছে অসাম্প্রদায়িকচেতনা। এতে করে আমাদের হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধেরযে অবক্ষয়, সে সম্পর্কে আবারও অবগত হই। একসময় মসজিদে নামাজ শেষ হওয়ার পর সনাতন ধর্মাবলম্বীর ঘরে ধূপ-ধুনোর জ্বলন, আবার কাঁসা বা হরে-কৃষ্ণ ধ্বনি; মুসলমান ঘরে ধর্মাচার বা নামাজ আদায়করণ—এইসব বিবিধ আচার-ধ্বনির ঐক্যে প্রশ্নবিদ্ধযন্ত্রণায় ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালিচেতনাবদ্ধ দৃষ্টান্তে অনন্য হয়ে উঠেছে। কবি বলছেন, ‘খুব ভোরে প্রতিদিনকার মতো আজও তুমি একরাশ ফুল নিয়ে মণ্ডপে যাচ্ছিলে…’ অথবা, ‘…ঘাটের মসজিদে ফজরের আজানশেষ হলে, দত্তবাড়ির বেণুকাকুররেওয়াজশুরু হয়।আরভোরেরপ্রশান্ত বাতাসে উড়তে শুরু করে হলুদ প্রজাপতির মতোঅসংখ্য এসরাজ—’
চন্দ্রাবতী: চন্দ্রাবতীর রামায়ণ; রীতিমতো পৌরাণিক রামায়ণকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো। যার রামায়ণে গাথা আছে নারীর অধিকার এবং সাহসী কথন। কবির কবিতায়:
‘তোমার দুঃখ বুঝি, চন্দ্রাবতী। ব্যর্থপ্রেমের ঘায়ে তুমি উন্মাদিনী নও—পাথর-কঠিন…’
অথবা
‘তুমি, পিতার আদিষ্টমেয়ে—সীতার দুঃখ নিয়ে অবশেষে রামায়ণ লিখেছ—
পরের কথা কানে লইলেগো নিজের সর্ববনাশ।
চন্দ্রাবতী কহে রামের বুদ্ধি হইলোগো নাশ।’
কবিতায় চন্দ্রাবতীর দৃঢ়-কঠিন মনোবলেরভেতর দিয়ে উঠে এসেছে সমাজের পিছিয়ে পড়া চিন্তনের ওপর চপেটাঘাত। যা অনেক বেশি সামসময়িক।‘চন্দ্রাবতী’ কবিতাটিতে ভাটি-বাংলার নানা রূপ-সচেতনতায় জেগে উঠেছে সময়ের সাহসী বচন।
রুদ্র: নিজের ভূগোল, নিজের মাটির প্রতি আলাদা নিবেদন তখনই ঐশ্বর্যময় ওঠে, যখনদেশের প্রতি মায়া ও মমত্ব আলাদা করে বাড়ে। ভূমির প্রতি কবির এমন ভালোবাসা ও মায়ার অমোঘ বচন এই কবিতা:
অভিবাদন!
উদ্বেল দিন, খর দুপুর,মেঘময় অপার আকাশ
ক্লান্তি-জারিত উজ্জ্বল বিকেল—বটছায়া—’
কবির যাপিত নগর-যন্ত্রণার প্রতি হাঁপিয়ে ওঠার পর নিজের দেশ-গ্রামের প্রতি এবং সবুজের প্রতি যেন অবচেতন-মায়া আরও বেড়ে গেছে। কবি খোঁজেন মুক্তি:
চৌচির মাঠ,গেরুয়াগ্রাম, রুদ্ধশ্বাস দগ্ধ শহরে—
হে রুদ্র,
তোমার আসন বিছানো’
ঝাঁ চিকচিক রোদ, বাউণ্ডুলে বাতাস এবং স্নিগ্ধ নদীর কাছে যেন কবির এইসব বিবিধ আহ্বান।বন্যা:
নদীমাতৃক এইদেশেবন্যার পুনরাবর্তনই বরং স্বাভাবিক;
৮ ফাল্গুন, এমনই একটি বন্যা হয়েছিল
যেদিন লাল রক্তেভেসে এসেছিল
অ আ ক খ—
১ ২ ৩ ৪…’
কবির স্মৃতিতেজেগে আছে বন্যাকবলিতদেশেরকোনো এক ভয়াল স্মৃতি।যে স্মৃতি এই বাংলার স্বপ্নপোড়া মানুষের সিঁদুরে মেঘদেখার মতোই এক মজ্জাগত। কবির চারপাশ দুঃস্বপ্ন ও হাহাকারে যেনছেয়ে যায়;তখন আমরাও কবির সাথেভাটি-বাংলার বাস্তবতার এমনকোনো দুঃসহ স্মৃতির সাথে একাত্ম হয়ে উঠি।
ইতিহাসের কিছু নিছক আড়ম্বর ও বিভ্রান্তির দায় মাথায় না নিয়ে সহজাত সরল ভঙ্গি ও নির্মেদ কথনে তৈরি করেছেন কবিতার নিজস্ব নির্মাণ।
বোধিবৃক্ষ: কবিরচেতনাবোধে ঝুলে আছেকোনোক্রুশকাঠ ও অস্থিরতা। তাই তিনিবেছে নিতে চান বুদ্ধের মতোঅহিংস ও ধ্যানস্থ থাকারমন্ত্র। কবির এই কবিতারবোধে লুকিয়ে আছে পাক-ভারত উপমহাদেশের স্পিরিচুয়াল ও ভাববাদী জীবনাচরণ;যা আবহাওয়া, ভূগোল-প্রভাবিত ও প্রকৃতিঘন। তারই একটি স্পষ্ট রূপ ফুটে উঠেছে এ কবিতায়। এবং এই আবহ ও আবেশের মধ্য দিয়েই কবি দ্বিধাহীনভাবে এই উপমহাদেশের মহান ব্যক্তিত্বগৌতম বুদ্ধের অহিংস ভাবনার কথাও ভাবতে ভোলেননি:
ফলবতী গাছের দিকে বাড়িয়েছি হাত
আমার প্রার্থনা কী, আমিই জানি না…’
এক অস্থির ও বন্ধ্যা সময়ে কবিযেন দিশাহীন ও দ্বিধাচিত্ত হয়ে আছেন। এই নিমকালেকোথাওকোনো স্বস্তি পাচ্ছেন না। তাইতো কবি বলেছেন:
আমাদের চেতনাও ঝুলে আছে ক্রুশকাঠে
আর এ যুগের যিশু পুনরুত্থান-রহিত!
অথচ আমি কতদিন
বোধিবৃক্ষের নিচে ধ্যানস্থথেকেজেনেছি—
বুদ্ধের মতোবেঁচে থাকা ভালো।
তাই ফলবতী গাছের নিচে বাড়িয়েছি হাত।’
অতিমাত্রায় প্রযুক্তি নিভর্রতা আমাদের যাপন আর চিন্তা-চর্যায়শেকড়কেচেনার বা জানার উপলব্ধিথেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কবিতার ট্রেন্ডকোন দিকেযেতে পারেসেটা নিয়েও একশেকড়চ্যুতির আশঙ্কা বা সংশয় কাজ করছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের চোখফেরাতে হবে মাটি ওশেকড়ের দিকে। শুধু ইতিহাস নয়, প্রত্নতাত্বিকযে চিহ্ন বা ঐতিহ্য, তার মূলেও আমাদেরচোখফেরাতে হবে।
বাঙালির উৎস আদি বাঙ্গালের ঐতিহ্যকেচেতনে-অবচেতনে ধারণ করতে হবে। কথা হচ্ছে, আমি যদি এই সময়ে বসে ইউরোপীয় গ্রাম্য সমাজ, পরিপার্শ্ব, হলিউডের সিনেমাটিক দৃশ্য বা অ্যাডভেঞ্চারিজমের হুবহু প্যাটার্নের ভেতর দিয়ে কবিতা করি, হবে? আবারদেশীয় আচার নিয়ন্ত্রিত চটুল শব্দ, বাক্য, উপমা দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করি, তা-ও হবে না। এতে করে কবিতা, মাটিজাত ভাষিক যে মৌলিক চেতনা, তার মূল আবেদনকে হারাবে। তাই নিজ মাটি, আচার-অভ্যাস, আবহাওয়া, ভূ-প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের বৈশ্বিক হতে হবে। নতুন কবিতা লিখতে আসা বহু কবিও আছেন, যারা না বুঝে এই প্রবণতা বা অভ্যাসের মাঝে কবিতা করার চেষ্টা করছেন। কবি চাণক্য বাড়ৈ-এর কবিতায় আছে সেই মাটিজাত প্রাণভোমরা, যার মূলে কোনো প্রতারক ছল বা বাড়তি উল্লম্ফন নেই। ইতিহাসের কিছু নিছক আড়ম্বর ও বিভ্রান্তির দায় মাথায় না নিয়ে সহজাত সরল ভঙ্গি ও নির্মেদ কথনে তৈরি করেছেন কবিতার নিজস্ব নির্মাণ।