ঘাটুগান বা ঘাডুগান—ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকজ-সংগীতের নাম। এই অঞ্চলে সত্তরদশক পর্যন্ত এই ঘাটুগানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। গ্রামের মানুষের বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেই বিবেচিত ছিল এই গান। ওই সময়ে নাটক, যাত্রাপালা, জারিগান, বাউলগান, দেশজ খেলাধুলাও বিনোদনের প্রাণ ছিল। পরবর্তী সময় আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, জলবায়ুসহ কৃষিজ-সংস্কৃতি, ঋতু, শিক্ষাসংস্কৃতি ও পেশাবৃত্তির ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে ধীরে-ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।
আশির দশকে এসে এ গানের কিছুটা রেশ পাওয়া গেলেও বর্তমানে ঘাটুগান বিলুপ্ত প্রায়। এখন কোথাও ঘাটুগান হয় বলে শোনা যায় না। নব্বই দশক থেকে গ্রামে টিভির অনুপ্রবেশ ঘটায় লোকজ সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। কোনো গ্রামে একটি টিভি থাকলেই গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য সন্ধ্যার পর সে বাড়িতেই ভিড় করতে দেখা গেছে। নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রায় প্রতিটি গ্রামে একাধিক টিভির অনুপ্রবেশ ঘটে, চায়ের স্টলে টিভি প্রদর্শন করা হয়; এমনকি যেসব গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, সেসব গ্রামের ধনিকশ্রেণীর মানুষেরা ব্যাটারি দিয়েও টিভি চালানো শুরু করলে লোকজ বিনোদনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ আরও কমে যায়। ফলে টিভিকে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রামের মানুষেরা গ্রহণ করে নিজেদের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়েছে। একুশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান সময় মোবাইল ফোন আশ্রিত গান, ভিডিও ইত্যাদি বিনোদনের বিষয়গুলোর পর্যাপ্ততার কারণে গ্রামের নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতির অস্থিত্বই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মানুষের রুচিরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যও সুস্থ বিনোদনের সকল ধারাকে করেছে কলুষিত। যেমন, এখন যাত্রাপালার নামেই নগ্ননৃত্য প্রদর্শন, জুয়া খেলা, গোপনে পর্নো-ভিডিও প্রদর্শন অসুস্থ বিনোদন সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঢুকে মানুষের রুচি ও মননশীলতাকে বিপর্যস্ত করেছে।
এই নিবন্ধে যে ঘাটুগানের বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে কিভাবে ও কখন লোকজ বিনোদনের মাধ্যম হয়েছিল তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধারণা করা হতে পারে এই ঘাটুগান যাত্রা, নাটক, পালাগান ইত্যাদির একটি মিশ্ররূপ যা পরবর্তী আলোচনা থেকে স্পষ্ট করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, ঘাটুগানের কাঠামো বা ফরমেটে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা রয়েছে। এখানে ময়মনসিংহের নান্দাইল, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, মদন ও কিশোরগঞ্জের তাড়াইল এলাকার লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ঘাটুগানের আলোচনা করা হয়েছে। শামসুজ্জামান খানের সম্পাদনায়, ড. আমিনুর রহমান সুলতানের সমন্বয়ে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা ময়মনসিংহ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়: লোকনাট্য ও লোকনৃত্য (পৃষ্ঠা ৩০৫-৩৩৬) নিবন্ধে ঘাটুগানের বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে ভিন্নতা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই নিবন্ধে ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ ও ফুলপুরের উপজেলার ঘাটুগানের বিস্তারিত চিত্র চিত্রিত হয়েছে যা এই নিবন্ধ থেকে ভিন্ন কাঠামোগত দিক থেকে ভিন্ন।
ঘাটুগান কী
আগেই বলা হয়েছে অঞ্চলভেদে ঘাটুগানের কাঠামোগত ভিন্নতা রয়েছে। এখানে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ময়মনসিংহের নান্দাইল, কিশোরগঞ্জের তাড়াইল, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও মদনের ঘাটুগানের কাঠামো বা ফরমেট সম্পর্কে বলা হচ্ছে। এসব এলাকার ঘাটুগান ‘যাত্রাপালা’ বা ‘নাটকে’র কাঠামোর মতো। একটি গানের দল হওয়ার পরেই দলের লোকেরা ঠিক করে কোন পালাটি তারা মঞ্চস্থ করবে অর্থাৎ কোন পালা ‘নামাবে’। অনেক সময় স্থানীয় নাট্যকারে এই পালা রচনা করেন, যা কখনো মুদ্রিত বই হিসেবে বাজারে পাওয়া যায় না। আবার অনেক সময় যাত্রাপালার বই বাজার থেকে কিনে নিয়ে সেটিকেই নিজেদের মতো করে কাস্টোমাইজ করে নেন এবং সেটিই মঞ্চস্থ করেন। এ-রকম আলোচিত কিছু ‘পালা’ লেখকের শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ‘হিংসার পরিণাম’, ‘গুনাই বিবি’, ‘বেহুলা লখিন্দর’ ইত্যাদি। এসব পালার যে নায়িকার অভিনয় করে তাকেই আঞ্চলিক ভাষায় ‘ঘাডু’ বা ‘গাডু’ বলা হয়। এসব গানের দল, বলা যায়, গ্রামের দরিদ্রশ্রেণীর সংস্কৃতিমনা লেখাপড়া কমজানা মানুষেরই দল। আমরা একটি যাত্রাপালাকেই কল্পনা করতে পারি, যে পালায় মেয়েদের চরিত্রগুলোয় ছেলেরাই অভিনয় করে, আর তেমন ভিন্নতা নেই।
ঘাটু
প্রথমেই জানা দরকার ‘ঘাটু’ (অঞ্চলভেদে ‘ঘেটু’ ‘ঘাডু’ বা ‘গাডু’ বলা হয়) কী? ‘ঘাটু’ হলো কোনো সুদর্শন, যার গানের কণ্ঠ ভালো, যে গান গাইতে আগ্রহী এবং পালায় কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের বা নায়িকার অভিনয় করে তাকেই ‘ঘাটু’ বলা হয়। গায়ের রং কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, শারীরিক গড়নও অনেক সময় বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য বিষয় হলো গানের উপযোগী কণ্ঠস্বর। বয়সে বিশের নিচে এমন তরুণদেরই ঘাটু হিসেবে নির্বাচন করা হয়। অনেকেই স্বেচ্ছায় ঘাটু হয়, অনেককে প্রভাবিত বা বলপূর্বক দলে আনা হয়।
ঘাটুগানের সাংগঠনিক কাঠামো
গ্রামের সংস্কৃতিমনা কিছু মানুষের উদ্যোগে একটি গানের দল গঠন করার সিদ্ধান্ত হয় এবং আলোচনা সাপেক্ষে তারা একজন ম্যানেজার নির্বাচন করেন। এই ম্যানেজারই দলের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন এবং দলকে পরিচালনা করে। তাকে সহযোগিতা করার জন্য অন্যান্য উদ্যোগী মানুষ থাকলেও তাদের নির্দিষ্ট কোনো পদবি থাকে না এবং অন্য কোনো পদের রেওয়াজ নেই। তবে কার কী ধরনের ভূমিকা থাকবে, তা নির্ধারিত থাকে। দলের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো ‘প্রম্পট মাস্টার’। ম্যানেজার সার্বিকভাবে দল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকলেও প্রম্পট মাস্টারের নেতৃত্বে পালা নির্বাচন, পাত্রপাত্রী নির্বাচন ও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। প্রম্পট মাস্টার পালা চলাকালেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে, যেমন, মঞ্চের পাশে বসে আস্তে আস্তে সংলাপ বলা এবং অভিনয় মহড়া অনুযায়ী হচ্ছে কি না, তা দেখা। এছাড়া বাদ্যযন্ত্রের দায়িত্বে কে বা কারা থাকবে তাও নির্ধারিত থাকে। ঘাটুগানের দল একটি অনানুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিচালিত হলেও এই দলের মধ্যে একতা, সংহতি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা অত্যন্ত নিবিড় এবং দলের সদস্যদের সুখ-দুঃখের সবাই একে অন্যের পরিপূরক।
সাধারণত গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন প্রভাববিস্তারকারী সংস্কৃতিমনা মানুষকেই ম্যানেজার নির্বাচন করা হয়। অনেক সময় ম্যানেজার নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তার সমমনা মানুষকে নিয়ে দল গঠন করার উদ্যোগ নিজেই নিয়ে থাকে। দলের জন্য ম্যানেজারকেই টাকা-পয়সা খরচ করতে হয় যা গরিব মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল মানুষই ম্যানেজারের পদটি পেয়ে থাকে। দলে বা সমমনা মানুষের মধ্যে এই পদের মর্যাদাও যথেষ্ট রয়েছে বলে অনেকেই নিজের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে ম্যানেজারের পদটি গ্রহণ করেন। তবে শিক্ষিত ব্যক্তিদের এই ঘাটুগানের দলের ম্যানেজার হতে দেখা যায় না। সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিতে গানের দলের অবস্থান ভিন্নমাত্রার।
ঘাটুর সামাজিক অবস্থান
কোনো গ্রামের গানের দলের কোনো ঘাটু নির্বাচিত হলে তার খাওয়া-থাকার ভার ম্যানেজারের ওপরই বর্তায়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, কোনো দলের ঘাটু মানে সে দলের ও গ্রামের সমমনা মানুষের প্রত্যেকের কাছে একজন মেহমানের মর্যাদায় থাকে। সে একজন মেহমানের মতো জুতো ঘুরে, বেড়ায়, গান গায়, কোনো কাজকর্ম করে না। ভালো কাপড়চোপড় পরে, জুতো পায়ে ঘুরে বেড়ায় তার ইচ্ছেমতো। তার চুলের সিঁথি কাটারও বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, ব্যাকব্রাস করে মাথার আড়াআড়ি করে আঁচড়িয়ে সামান্য ফুলিয়ে রাখে (যাকে ফুটকা তোলা সিঁথি বলা হয়)। এই চুলের ফ্যাশনকে অনেকেই বিদ্রূপ করে ‘ঘাটু সিঁথি’ বলে। গানের সময় ছাড়া তার বিস্তর অবসর। এই সময় সে যেখানে খুশি যেতে পারে, যার বাড়িতে খুশি সে খেতে পারে। গ্রামের অতিথিপরায়ণ বলে তার খাওয়ার জন্য গানের দলের ও সমমনা মানুষের কোনো বাড়িতেই বাধানিষেধ নেই। কোনো কোনো ঘাটুকে ম্যানেজার বা গ্রামের মানুষের চাঁদা দিয়ে তাকে কিছু টাকাপয়সা দেওয়া হয়, তবে খুবই অপর্যাপ্ত—সাধারণ শ্রমিকের মজুরির সমপরিমাণ। এক সময় গ্রামের মানুষের মধ্যে সেরকম সহৃদয়তার ভাব ছিল, অভাব ছিল না বলেই একজন মানুষকে আদরযত্ন করতে কেউ কখনো দ্বিধা করত না। তবে ঘাটু ম্যানেজারের বাড়িতেই থাকে এবং তার সারাক্ষণের নেওটা। হাটে-বাজারে কিংবা অন্য কোথাও গেলে ম্যানেজারের সঙ্গে ঘাটুকে থাকবে এটাই বিধান।
সৌখিন
‘সৌখিনের’ অপভ্রংশ ‘সখিন’ ও আঞ্চলিক ভাষায় ‘সহিন’। ঘাটুর একজন সর্বক্ষণিক সঙ্গী বা বন্ধু থাকে। সে বন্ধু তার সমবয়সী নয়। বয়েসে বড়। সাধারণত ম্যানেজারই সৌখিন হয়, তবে অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্য কেউই তার সঙ্গী বা বন্ধু হতে পারে। এই সৌখিন শব্দটি মানুষ বিদ্রূপ করেই বলে। সৌখিন শব্দটির নেতিবাচক অর্থ বহন করলেও ঘাটু বা সৌখিন তারা আমলে আনে না। একটি অপ্রমাণিত ও গুজব প্রচলিত আছে যে, সৌখিন ও ঘাটুসমকামী যৌনাচার প্রবৃত্ত হয়। এ-কারণেই অনেকেই তাদের আচরণকে নেতিবাচকভাবে দেখে কিন্তু গানের দল যেহেতু একটি গ্রামের শক্তিশালী সংগঠন ও এমন আচরণই রেওয়াজ, তাই এ সত্যটি অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে।
অভিনেতা
ঘাটুগানের অভিনেতা সব নিজ গ্রাম থেকেই নির্বাচিত হলেও কোনো কোনো বিশেষ চরিত্রের জন্য পাশ্ববর্তী কোনো গ্রামের অভিনেতার আগ্রহী হলে কিংবা আমন্ত্রণ জানিয়ে অভিনেতা নির্বাচন করা হয়। জোকার বা বিবেকের চরিত্রের জন্য অন্য গ্রামের অভিনেতাকেও নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য অন্যগ্রামের মানুষকে নির্বাচন করা হয়। কারণ, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর গ্রামে খুব কম মানুষই পাওয়া যায়। অভিনেতা নির্বাচনের ব্যাপারে প্রম্পট মাস্টারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও দলের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মর্জিতে তার ব্যতিক্রমও হয়। যেহেতু পুরুষরাই নারী চরিত্রের অভিনয় করে থাকে তাই নারী চরিত্রের জন্য পুরুষ নির্বাচন করা বেশ কঠিন হয়। গলার স্বর, শারীরিক গঠন,অভিনয়ে আগ্রহ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনাপূর্বক অভিনেতা নির্বাচন করতে বেশ বেগ পেতে হয়।
কর্মী ব্যবস্থাপনা ও খরচ
ঘাটুগান সম্পূর্ণ নিজ খরচেই হয়ে থাকে। এই গানের অভিনেতারা কোনো রূপ সম্মানী পায় না বরং যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো তারা চাঁদাও দেয়। দলের সম্পূর্ণ খরচ নিজেদের চাঁদা থেকেই মেটানো হয়। ম্যানেজার এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। অনেক সময় ম্যানেজার অতিরিক্ত টাকা দিয়ে দলের খরচ মিটিয়ে থাকে। এছাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও চাঁদা তোলা হয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলার প্রয়োজন হলে গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে (দরবার ডেকে) একটি দিন ঠিক করা হয় এবং সেই নির্ধারিত দিনে গানের দলের সদস্যরা বস্তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান অথবা চাউল চাঁদা হিসেবে তোলে। প্রতি বছর পৌষ মাসে আমন ধানের মৌসুমে গানের দলে চাঁদা তোলার একটি প্রচলন ছিল সত্তর দশকের আগে। টাকা-পয়সার হিসাব ম্যানেজার করলেও অনেক সময় ক্যাশিয়ারও নির্বাচন করে তাকে আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিজ গ্রাম ছাড়া অন্য কোনো গ্রাম থেকে যদি গান করার আমন্ত্রণ আসে তখন কিছু বায়না পাওয়া যায়। সে বায়না থেকে সামান্য টাকা আসে যা কেবল গান মঞ্চস্থ করার খরচটি মিটানো সম্ভব হয়। অন্য গ্রামে গান করতে গেলে গানের দলের সমদ্যদের বেশ ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
মহড়া
বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মানুষের বিস্তর অবসরের সময় লোকজ-সংস্কৃতিমনা মানুষেরা দলবদ্ধ হয়ে অনানুষ্ঠানিক সাংগঠনিক কাঠামোয় গানের দল প্রতিষ্ঠিত করে দীর্ঘদিন মহড়া দিয়ে দল প্রস্তুত করে। মহড়া রাতেই নির্ধারিত বাড়িতে হয়। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও অন্য সময়েও মহড়া অনুষ্ঠিত হতে পারে। আবার গান মঞ্চস্থ হওয়ার আগেও দুয়েক দিন মহড়া দিয়ে দল ঠিক করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে গান মঞ্চস্থ করা হয়। কেননা, অভিনয় ও গানের সুনাম ও দুর্নামের ব্যাপারটিকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মঞ্চ
ঘাটুগানের জন্য চারটি চৌকি দিয়ে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয় উন্মুক্ত স্থানে। চৌকির পাশ ঘেঁষে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সামানিয়া সামিয়ানা টানানো হয়। অভিনয় শিল্পীর পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র বাজানোর জন্য একদল যন্ত্রী থাকে। গান অনুষ্ঠানের সময় তারা যাত্রাদলের যন্ত্রীদের মতো মঞ্চের এক কোনায় বসে। সেখানে প্রম্পট মাস্টারও বসে সংলাপ প্রম্পট করে এবং মাঝে মাঝে ইশারায় নির্দেশনা দেয়।
বাদ্যযন্ত্র
হারমোনিয়াম একটি, ঢোল একটি, করতাল একটি ও একটি খুঞ্জরিই প্রধান বাদ্যযন্ত্র। তবে কোনো কোনো সময় বাঁশের বাঁশিও বাজাতে দেখা যায়। এসব বাজনাদারদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে যতটুকু পারে তা দিয়েই তারা আসর জমিয়ে রাখতে পারে। গানের জন্যও কোনো অনুশীলন নেই, সুরের কোনো ধরাবাঁধা স্বরগ্রাম নেই, তারা যেভাবে সুর করতে পারে তা দিয়েই গান হয়। ঘাটুর পরিশীলিত অঙ্গভঙ্গিতে নাচের নমুনা লক্ষ করা যায় তবে সেসব অঙ্গভঙ্গিতে নৃত্যের কোনো ব্যাকরণ আছে বলে মনে হয় না বা নাচের কোনো মুদ্রার মধ্যে পড়েও না বলে সব গানের মধ্যে একই রকম মুদ্রা দেখা যায়। কেবল দুটি হাত নাড়ানো ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অঙ্গের আলোড়ন চোখে পড়ে না। গানের নারীর সকল চরিত্রই পুরুষরাই করে থাকে গানের সময় তারা সবাই একইভাবে হাত দুটি কেবল নাড়াচাড়া করে বিশেষ ভঙ্গিমায়।
পোশাক/প্রপস
সাধারণ বাজার থেকে উজ্জ্বল রঙের কমদামি কাপড়, স্নো/ক্রিম, পাউডার, লিপস্টিক, রোজ, জরি, পাটের তৈরি মেয়েদের বিশেষ রকম চুল, শাড়ি, ব্লাউজ, রাজার গাউন, পায়জামা, মুকুট, কাঠের বা অ্যালোমুনিয়ামের তৈরি তরবারি, টিনের খাপ, জুতো,কমদামি ইমিটেশন অলঙ্কার; যেমন, গলার হার, পুতির মালা, কানের দুল, টিকলি ইত্যাদি। নারীর চরিত্রে অভিনেতাদের জন্য বুক উঁচু দেখাতে বিশেষ উপায়ে নারকেলের খোল (আঞ্চলিক ভাষায় আরচি বলা হয়) কেটে এবং ছিদ্র করে সুতা দিয়ে বুকে বেঁধে বুক উঁচু করা হয়। সত্তর দশকের পূর্বে গ্রামাঞ্চলে ব্রা’য়ের প্রচলন ছিল না বলে বুক উঁচু করার জন্য নারকেলের খোলের ওপর ব্লাউজ ব্যবহার করে নারী চরিত্রের কস্টিউম বানাত এবং নারীর চরিত্রের পুরুষদের জন্য লম্বা চুল বাজার থেকে কেনা হতো। নারী চরিত্রের সবার পায়েই ঘুঙুর বাঁধতে হয়।
আলো
ঘাটুগান দিনে বা রাতে মঞ্চস্থ হয়। এটি নির্ভর করে এলাকার মানুষের নিজস্ব সুবিধা অনুযায়ী। দিনের বেলায় হলে দুপুরের খাওয়ার পর তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গান চলে। আর রাতে হলে রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত গান চলে। দুই বা তিন ঘণ্টার মধ্যে পালা শেষ হয়ে যায়। রাতের বেলায় গান হলে মঞ্চের দুকোনায় কখনো চার কোনায় চারটি হ্যাজাক দিয়ে দিয়ে আলোর ব্যবস্থা হয়।
প্রদর্শন
ঘাটুগানে কোনো রূপ অশ্লীলতা নেই। বর্তমান সময়ে যাত্রাপালায় যেধরনের অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন করা হয় ঘাটুগানে সেরকম করার সুযোগ নেই। গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য এই গান এক সময় সুস্থ বিনোদনের একটি বিশেষ মাধ্যম ছিল। তাই দর্শক হিসেবে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারী-পুরুষও গানের দর্শক হিসেবে উপভোগ করে। নারীদের দর্শকদের জন্য পৃথক বিশেষ স্থানের ব্যবস্থা করা হতো। তবে দিনের বেলায় হলে নারীরা মঞ্চের পাশে বসতে দেখা যায় নি। মঞ্চটিই এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে কারো বাড়ির আঙ্গিনা থেকে মেয়েরা গান শুনতে পারে। ঘাটুগানের দর্শক খুব বেশি নয়। সংস্কৃতিমনা নারী-পুরুষ, আশপাশের দুচারটি গ্রামের মানুষই গানের দর্শকশ্রোতা। তবে যদি নামকরা কোনো ঘাটু ও অভিনেতা দলে থাকে তাহলে দর্শক বেড়ে যায়। একটি গানের দর্শক গড়পড়তায় তিনচারশ হয়তো হবে।
প্রচার
কোনো গ্রামে ঘাটুগান হলে কয়েকদিন আগে থেকে স্থানীয় বাজারে ঢোল পিটিয়ে খবরটি প্রচার করা। এভাবে একদুটি বাজারে ঢোল পিটালেই তা মানুষের মুখে মুখে গানের কথা ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য আর বাড়তি কোনো প্রচারের প্রয়োজন পড়ে না। পালা করে অন্যান্য গ্রামের মানুষদের যদি মুগ্ধ করতে পারে তাহলে দূর দূরান্তের গ্রামেও গান করতে যায় সামান্য বায়নাপাতি নিয়েই। বায়নাপাতি যা দেয়া হয় তা দিয়ে কস্টিউমের খরচ মেটানো সম্ভব হয়, কোনো বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। আনন্দ, শখ আবার কারো পরিচিতি বা গ্রামের নামের জন্যই এই গানের দল করে, বাণিজ্য করার নয়।
বর্তমানে বাণিজ্যনির্ভর বিনোদনের নানা মাধ্যমের আগ্রাসন ও অনুপ্রবেশের ফলে শখ ও আনন্দধারার লোকজ সংস্কৃতির মাধ্যমগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঘাটুগান ছিল নির্মল আনন্দ ও বিনোদনের একটি মাধ্যম যা বর্তমানে ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই না। কোনো গ্রামে একটি দল থাকলে সে গ্রামে হিংসাত্মক ঘটনা খুব কমই ঘটত। এই দলের পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ, ভালোবাসা, সংহতি, সহযোগিতা ও সহমর্মিতাবোধের কারণে গ্রামের পরিবেশই থাকত প্রাণচঞ্চল। বর্তমান সময়ের যান্ত্রিক সভ্যতা আর যন্ত্রনির্ভর বিনোদনের জবরদখলের কারণে লোকজ ঘাটুগানের আসর আর ফিরে আসবে বলেও আশা করা যায় না। এই গানের দলের একতাবদ্ধতার কারণে অনেক সামাজিক অঘটন ঘটতে পারত না। অনেক সময় তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়াত। তবে এতো ভালো দিক থাকলেও ঘাটুগানের দলের মধ্যে কখনো উচ্ছৃঙ্খলাও দেখা যেত। যেমন, কোনো মানুষের কাছে যদি চাঁদা চাওয়া হতো আর সে ব্যক্তি তা দিতে অস্বীকৃতি জানাত তাহলে গোপনে বা তার ক্ষেতের পাকা ধান কেটে নিয়ে যেতেও দেখা গেছে। কখনো ধান বা পাট ক্ষেত কেটে ক্ষতি করেছে। কোনো গ্রামের গানের দল থাকা মানে ওই গ্রামে একটি সংঘটিত শক্তি থাকা, যে শক্তি কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে আবার কখনো কারো দ্বারা দলের ক্ষতি হলে তার ফসল কেটে বা অন্য কোনোভাবে গোপনে তাকে শায়েস্তা করতেও পিছপা হতো না। কোনো কোনো সময় শক্তির দাপটে বেআইনি ও অন্যায়ের পক্ষও নিতে দেখা যায়। কোনো গানের দলের ঘাটু আদর-যত্নে থাকলেও গোপনে ও অপ্রকাশ্যে তার সম্পর্কে সমকামিতার কথা বলা হলেও এর সত্যমিথ্যে যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। তবে গ্রামের শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসরমান, নিরীহ প্রকৃতির, ধর্মীয় মনোভাবের মানুষেরা ঘাটুগানকে সমর্থন করে না এবং তাদের কার্যকলাপ তারা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে।